শাবান ১৪৩৯ হিঃ (৩/৪)

তোমাদের পাতা

এসো কলম মেরামত করি

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

এ যুগে অস্ত্রের যুদ্ধ যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি গুরুত্বপূর্ণ কলমের যুদ্ধ। সৈনিকের জন্য অস্ত্রের প্রশিক্ষণ, আর লেখকের জন্য কলমের প্রশিক্ষণ একই রকম অপরিহার্য।

আজকের আলোচনা ঃ অনুবাদ ও তরজমা প্রসঙ্গে

অনুবাদ মানে কী? তরজমা! তরজমা মানে কী? অনুবাদ! না, এভাবে তো বোঝা গেলো না; খোলাসা করে বুঝিয়ে বলতে হবে।

এমনিতে যে কারো মনে হবে, অনুবাদ বা তরজমা শব্দদু’টি কঠিন কিছু তো নয়। আমরা সবাই বুঝি, কাকে বলে তরজমা বা অনুবাদ। কিন্তু সমস্যা বাঁধে, যখন বলা হয়, আচ্ছা, যা বোঝো তা একটু বুঝিয়ে বলো তো, কাকে বলে অনুবাদ বা তরজমা? এজন্যই একটু ব্যখ্যা দরকার।

তো একভাষায় লেখা কোন বিষয়কে যখন অন্যভাষার লেবাস পরানো হয় তখন সেটাকে বলে অনুবাদ, বা তরজমা। এখন তো পরিষ্কার বিষয় আরো ঘোলাটে হয়ে গেলো! সুতরাং বিষয়টা উদাহরণের সাহায্যে বোঝা দরকার।

ইবনে খালদূন তার বিখ্যাত ‘আলমুকাদ্দিমা’ লিখেছেন আরবী ভাষায়। অত্যন্ত মূল্যবান গ্রন্থ। যিনিই পড়বেন, জ্ঞানের রাজ্যে বিপুল সমৃদ্ধি অর্জন করবেন। যারা আরবীভাষী, কিংবা আরবী ভাষা জানেন তারা তো সহজেই গ্রন্থটি অধ্যয়ন করে উপকৃত হতে পারেন।

প্রশ্ন হলো উর্দূ ভাষার মানুষ, যারা আরবী জানেন না, এ গ্রন্থটি থেকে তারা কীভাবে উপকৃত হবেন? বহু বছর, বহু শতাব্দী পার হলো; উর্দূভাষাী মানুষ শুধু জানলেন ইবনে খালদূনের আলমুকাদ্দিমার কথা। ঐ জানা পর্যন্তই। গ্রন্থটি অধ্যয়ন করার এবং তা থেকে উপকৃত হওয়ার সুযোগ তাদের হলো না।

একসময় একজন মানুষ এগিয়ে এলেন, যিনি উর্দূ যেমন ভালো জানেন তেমনি ভালো জানেন আরবীভাষা। তিনি উর্দূভাষিদের জন্য আলমুকাদ্দিমা কিতাবটি পড়ার এবং তা থেকে উপকৃত হওয়ার ব্যবস্থা করার চিন্তা করলেন। তিনি কী করলেন? আলমুকাদ্দিমা কিতাবটি হুবহু উর্দূভাষায় লিখলেন। আরো স্পষ্ট করে যদি বলি, ইবনে খালদুন কিতাবটি উর্দূতে লিখলে যেমন হতো, প্রায় তেমন করেই উর্দূতে লেখা হলো। এখন তো খুব সুবিধা হয়ে গেলো! উর্দূভাষীরা আরবী না জেনেও আলমুকাদ্দিমা থেকে ফায়দা হাছিল করতে পারলো। তাদের সামনে জ্ঞানের অজানা একটি রাজ্য উন্মুক্ত হলো।

তো যে জ্ঞানী মানুষটি এ কাজটা করলেন, আরবীভাষায় লেখা আলমুকাদ্দিমা হুবহু উর্দূভাষায় লিখলেন, তিনি কী করলেন? আরবীভাষার লেবাস বদল করে আলমুকাদ্দিমাকে উর্দূভাষার লেবাস পরিয়ে দিলেন। এ কাজটাকেই বলে অনুবাদ বা তরজমা। তিনি আরবীভাষার কিতাবটি উর্দূভ্ষাায় তরজমা করলেন। তাতে উর্দূভাষী মানুষের বড় উপকার হলো। তারা মহাজ্ঞানী আল্লামা ইবনে খালদূনের জ্ঞান থেকে উপকৃত হওয়ার সুযোগ পেলো। আল্লামা ইবনে খালদূনও উপকৃত হলেন। তাঁর জ্ঞান শুধু আরবীভাষী পাঠকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো, এখন তা উর্দূভাষী বিপুল পাঠকের কাছেও পৌঁছে গেলো।

একই কথা বাংলাভাষার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যারা বাংলাভাষী, আরবী জানে না, উর্দূও জানে না তারা আলমুকাদ্দিমার জ্ঞানভাণ্ডার থেকে বঞ্চিত ছিলো। একজন মানুষ এগিয়ে এলেন, যিনি আরবী যেমন ভালো জানেন তেমনি ভালো জানেন বাংলাভাষা। তিনি আরবীভাষায় লেখা আলমুকাদ্দিমা কিতাবটি হুবহু বাংলাভাষায় লিখলেন। তিনি আরবীভাষার লেবাস বদল করে আলমুকাদ্দিমা কিতাবটিকে বাংলাভাষার লেবাস পরিয়ে দিলেন। এ কাজটাই হলো অনুবাদ, বা তরজমা। এতে বাংলাভাষী মানুষের বড় উপকার হলো। তারা নিজেদের ভাষায় আলমুকাদ্দিমার জ্ঞানভাণ্ডার থেকে উপকৃত হওয়ার সুযোগ পেলো। একই প্রয়োজনে ইংরেজি ভাষার পাঠকদের জন্য ইংরেজিতে আলমুকাদ্দিমার তরজমা বা ট্রান্সলেশন হলো।

এভাবে বিভিন্ন ভাষায় তরজমার মাধ্যমে আলমুকাদ্দিমার জ্ঞানভাণ্ডার পৃথিবীর সকলভাষার জ্ঞানপিপাসু মানুষের কাছে পৌঁছে গেলো।

এবার তাহলে আমরা একটি উদাহরণের মাধ্যমে অনুবাদ বা তরজমার একটা সহজ পরিচয় পেলাম।

এটাও বোঝা গেলো, তরজমা বা অনুবাদ কত গুরুত্বপূর্ণ কাজ! সেই সঙ্গে কত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ!

যিনি অনুবাদ বা তরজমা করছেন তার মূহূর্তের অসতর্কতার কারণে, ভাষার জ্ঞান বা বিষয়বস্তু সম্পর্কে জ্ঞানের অভাবের কারণে গুরুতর বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। আল্লাহ না করুন, তিনি ভুল তরজমা করলেন। ফল কী হলো, আল্লামা ইবনে খালদূন যা বলতে চেয়েছেন অনুবাদের পাঠক তা বুঝলো না, কিংবা পাঠক যা বুঝলো আল্লামা ইবনে খালদূন আদৌ তা বলেননি!! এভাবে জ্ঞানের রাজ্যে সৃষ্টি হতে পারে বড় ধরনের নৈরাজ্য।

এটা তো হলো মানুষের লেখা সাধারণ কিতাবের কথা। যদি কোরআন ও হাদীছের তরজমার বিষয় হয়, তাহলে তো তরজমার গুরুত্ব ও গুরুতরতা বহু বহু গুণ বেড়ে যায়; এমনকি ভুল তজমার কারণে ঈমান-আখেরাতের বিষয়ও প্রশ্নের মুখে পড়ে যেতে পারে।

সুতরাং স্বীকার করতেই হবে। তরজমা বা অনুবাদ যেমন পৃথিবীর সবভাষার মানুষের জন্য একটি অপরিহার্য প্রয়োজন, তেমনি তা অত্যন্ত দায়িত্বপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ।

তাহলে একথাও স্বীকার করতে হবে যে, তরজমা বা অনুবাদ, এটা সবার কাজ নয়। যে কারো এ কাজে হাত দেয়া সঙ্গতও নয়। এ জন্য নীরবচ্ছিন্ন সাধনা, পরিশ্রম ও অনুশীলনের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় দক্ষতা, যোগ্যতা ও কুশলতা অর্জন করতে হয়। তারপর খুব সতর্কতার সঙ্গে অনুবাদ করতে হয়। প্রতিটি পদক্ষেপ সামনের দিকে খুব ভেবে চিন্তে রাখতে হয়।

সহজে বোঝার জন্য একটা উপমা এখানে বোধহয় দেয়া যায়। একজন দর্জী কী কাজ করেন? মানুষের শরীরের মাপ গ্রহণ করে হুবহু সেই মাপে পোশাক বা লেবাস তৈয়ার করেন। তাকে খুব সতর্কতার সঙ্গে মাপ নিতে হয়, কাপড় কাটতে হয়, তারপর সেলাই করতে হয়। কোথাও সামান্য ত্রুটি হলেই গুরুতর বিপর্যয় ঘটে যায়।

তো দর্জীর কাজ কি যে কেউ করতে পারেন? এ জন্য কি পেশাগত দক্ষতা ও কুশলতার প্রয়োজন নেই। নতুন দর্জী পুরোনো দর্জীর কাছে প্রয়োজনীয় নবীসি ও প্রশিক্ষণ গ্রহণ না করেই কি লেবাস তৈরীর কাজ শুরু করতে পারেন?

এ বিষয়ে তো আমাদের সবারই কমবেশী অভিজ্ঞতা রয়েছে। লেবাস যদি সঠিক মাপে, নিখুঁত সেলাইয়ে প্রস্তুত হয়, আমরা কত খুশী হই?! বিপরীত ক্ষেত্রে কী গুরুতর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়!! এমনও তো হয় যে, লেবাসটা ব্যবহারেরই অযোগ্য হয়ে পড়ে! তাই দেখা যায়, কোন দর্জীর জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী এবং তার প্রতি মানুষের আস্থা প্রশ্নহীন। আর কোন দর্জীর কাছে দ্বিতীয়বার ...।

তারপরো কথা আছে, সাধারণ কারো জন্য পোশাক তৈয়ার করা, আর বিশিষ্ট কারো জন্য তৈয়ার করা, সর্বোপরি বাদশাহর জন্য, শাহেনশাহের জন্য রাজকীয় পোশাক প্রস্তুত করা কি একই কথা? একই কাজ?

অনুবাদ বা তরজমার বিষয়টিও একই রকম, বরং আরো অনেক বেশী কঠিন, অনেক বেশী দায়িত্ব -পূর্ণ ও ঝুঁকিবহুল। এখানেও লেবাস বদল করে নতুন লেবাস তৈরীর বিষয়। সুতরাং এখানেও প্রয়োজন কাজে নামার আগে সর্বোচ্চ দক্ষতা, যোগ্যতা ও কুশলতা অর্জন করা।

এত সহজ কথা এত লম্বা বয়ানে বলতে হলো এজন্য যে, আমরা সবাই জানি, আমাদের বাংলাভাষায়, বিশেষ করে দ্বীনী মহলে অনুবাদ ও তরজমার ক্ষেত্রে কী ধরনের বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য চলছে এবং কীরূপ বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে। সুতরাং এ বিষয়ে আসলেই আমাদের খুব সতর্ক হতে হবে।

***

আজকের মজলিসে অনুবাদ ও তরজমা সম্পর্কে কিছু কথা বলতে চাই। আরো আগেই বলা দরকার ছিলো, ইচ্ছেও ছিলো, কিন্তু কেন যেন বলি বলি করেও বলা হয়ে উঠেনি।

পৃথিবীর যে কোন ভাষায় মৌলিক সাহিত্যের মত অনুবাদ সাহিত্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। বয়সের দিক থেকেও অনুবাদ-সাহিত্য মৌলিক সাহিত্যের প্রায় সমান।

অনুবাদকের মর্যাদা এদিক থেকে খুব উচ্চস্তরে যে তিনি মূল লেখক ও ভিন্নভাষী পাঠকের মধ্যে সেতুবন্ধনের ভূমিকা পালন করেন।

একজন অনুবাদকের প্রথম দায়িত্ব হলো মূল লেখকের প্রতি এবং অনুবাদ-পাঠকের প্রতি পূর্ণ বিশ্বস্ততা ও আমানতদারি রক্ষা করা। মানুষ হিসাবে ভুল হলে হতে পারে, কিন্তু স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে আমানতদারি ও বিশ্বস্ততা ভঙ্গ করা কিছুতেই সঙ্গত নয়। এটা হবে অমার্জনীয় অপরাধ।

একটি অনুবাদ ও তরজমাকে কখন বলা হবে সফল ও সার্থক সে বিষয়ে অনুবাদ-বিশেষজ্ঞদের মধ্যে যথেষ্ট মতপার্থক্য রয়েছে। থাকাই স্বাভাবিক। তবে যে জিনিসটির খুব বেশী প্রয়োজন তা হলো পরমত সহিষ্ণুতার সঙ্গে নিজের মত ও বক্তব্যকে যুক্তির ভাষায় উপস্থাপন করা। এ বিষয়ে আমি মনে করি, অযথা বিতর্কে জড়িত হওয়া সঙ্গত নয়।

তো কামিয়াব তরজমা ও সফল অনুবাদ সম্পর্কে আমার নিজস্ব কিছু চিন্তা ও যুক্তি রয়েছে। সেগুলোই ধীরে ধীরে পুষ্পের প্রিয় পাঠকবর্গের সামনে তুলে ধরতে চাই। আমি সর্বান্তকরণে কামনা করি, আমাদের বাংলাভাষায়, বিশেষ করে দ্বীনী মহলে সফল কিছু অনুবাদক এবং কামিয়াব মুতারজিম যেন উঠে আসেন। মূলত সহযোগিতার উপাদান নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ানোই আমার এ লেখার উদ্দেশ্য। আল্লাহ আমাদের সবাইকে কবুল করুন। আমীন।

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা