মৃত্যু- হোক স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিক- সবসময়ই বেদনাদায়ক। স্বাভাবিক মৃত্যুই যদি বেদনাদায়ক হয় তাহলে অস্বাভাবিক মৃত্যু কত মর্মান্তিক হতে পারে তা তো সহজেই বোঝা যায়। যাদের কোন আপনজন আচমকা মৃত্যুমুখে পতিত হয় তারাই শুধু বলতে পারে তাদের মনের উপর দিয়ে কী ঝড় বয়ে যায়!
অস্বাভাবিক মৃত্যুর এমনিতেই তো উপলক্ষের অভাব নেই। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন কারো না কারো আপনজনের মৃত্যুর খবরে হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। অবস্থা তো এমন ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, ঘর থেকে বের হয়ে নিরাপদে ঘরে ফিরে আসার কোন নিশ্চয়তা এখন নেই। পথচারীকে চাপা দেয়া বেপরোয়া গাড়ীচালকদের জন্য যেন একটা পাশবিক বিনোদনের রূপ নিয়েছে। তার উপর আছে গুম-খুন-অপহরণ। অগ্নিদগ্ধ হয়ে, বা পানিতে ডুবে মৃত্যু, সেটাও কম বেদনাদায়ক নয়। সম্প্রতি তুচ্ছ থেকে তুচ্ছ কারণে আত্মহননের প্রবণতাও উদ্বেগজনক হারে বেড়ে গিয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বে এ প্রবণতা অনেক আগে থেকেই ব্যাপক ছিলো। আমাদের প্রাচ্যসমাজে নিজস্ব কিছু মূল্যবোধ ও সংস্কৃতির কারণে এ প্রবণতা যথেষ্ট কম ছিলো।
কিন্তু এখন সবকিছুকে ছাপিয়ে এবং ছাড়িয়ে সেলফি-মৃত্যুই যেন সবচে’ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে বিশ্বব্যাপী। বললে ভুল হবে না, সেলফি এখন একটি মরণনেশায় পরিণত হয়েছে। কারণে অকারণে মানুষকে এখন যেন সেলফি তোলার নেশায় পেয়ে বসেছে।
সেলফি মানেই তো একটা অর্থহীন কাজ। তারপরো যদি তা সাদামাটা গোছের হয়, ঝুঁকিপূর্ণ না হয় এবং বিশেষ করে মৃত্যুর ঝুঁকি তাহলে অর্থহীন কাজ হিসাবেও হয়ত তা মেনে নেয়া যায়। আশঙ্কাজনক বিষয় তো এই যে, এখন তা সাদামাটা পর্যায়ে আর নেই। কী উন্নত বিশ্ব, কী অনুন্নত বিশ্ব, প্রতিটি সমাজের বহু মানুষ যেন আজ মরণনেশা সেলফিতে আক্রান্ত!
ভালো কি মন্দ সে প্রসঙ্গে না গিয়েও সঙ্গতভাবেই এখনকার সমাজকে বলা যায় ফেসবুক-সমাজ। ফেসবুকে বেশী লাইক, বা কমেন্টস পাওয়ার আশায় মানুষ এখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেলফি তোলে নিজ নিজ ফেসবুকে আপলোড করে ‘সস্তা’ বাহবা কুড়াতে চায়। এভাবে সেলফি তোলার নামে অতিরিক্ত অ্যাডভেঞ্চার দেখাতে গিয়ে অনেকেই নিজের হাতে নিজের মৃত্যু ডেকে আনছে।
আগেই বলেছি, এটা শুধু বাংলাদেশের সামাজিক ব্যাধি নয়, বরং বিশ্বব্যাপী একটা মরণব্যাধি। যুক্তরাষ্ট্রের কার্নেগি ইউনিভার্সিটি এবং দিল্লীর ইনিস্টিটিউট অব টেকনলজি ‘সেলফি ডেথ’ নামে যে জরীপ চালিয়েছে তাতে বিশ্বব্যাপী সেলফি-মৃত্যুর ভয়াবহতা উঠে এসেছে। সমাজচিন্তকরা, শুরুতে যারা বিষয়টিকে নির্দোষ বিনোদন বলে এড়িয়ে যাচ্ছিলেন, তারাও এখন পরিস্থিতির ভয়াবহতায় বিচলিত বোধ করছেন।
ঐ জরিপ-প্রতিবেদনে জানা যায়, ২০১৪ সালের মার্চ মাসে সর্বপ্রথম সেলফিমৃত্যুর ঘটনা প্রকাশ পায়। ঐ বছর ১৫ জন, ১৫ সালে ৩৯জন, ১৬ সালে ৭৩জন সেলফিমৃত্যুর মর্মান্তিক শিকার হয়েছে।
হাতির সঙ্গে, কুমিরের সঙ্গে সেলফি তুলতে গিয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ঝুলন্ত সেতুতে ঝুলন্ত অবস্থায়, চলন্ত ট্রেনের ছাদে, এমনকি নীচে রেল লাইনের উপর শুয়ে সেলফি তোলার ঘটনাও রেকর্ড করা হয়েছে। সেলফি তোলার জন্য বিশ্বব্যাপী তরুণ-তরুণীরা এখন ডেঞ্জার জোন তালাশ করতে শুরু করেছে।
মনোবিজ্ঞানীরা এখন জোরেশোরে বলতে শুরু করেছেন, ঝুঁকিপূর্ণ সেলফি তুলে সামাজিক মাধ্যমে পেস্ট করা একটা ভয়াবহ মনোরোগ এবং মাদকাসক্তির চেয়েও ভয়াবহ নেশা।
এ সর্বনাশা প্রবণতার মূল উৎস কী? আমাদের পর্যবেক্ষণে যা উঠে এসেছে তা হলো, যাদের জীবনে মহৎ ও মানবিক কোন লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নেই প্রধানত তারাই সেলফি রোগে আক্রান্ত হয়। দ্বিতীয়ত পারিবারিক, সামাজিক বা অন্য কোন কারণে জীবনের প্রতি যারা আকর্ষণ হারিয়ে ফেলেছে তারা ঝুঁকিপূর্ণ সেলফিতে বিশেষভাবে আক্রান্ত। এভাবে সম্ভবত তারা নিজের পরিবার ও সমাজের উপর প্রতিশোধ তুলতে চায়। তৃতীয়ত জীবনে যারা যত বেশী আত্মকেন্দ্রিক বা সেলফিস তারা তত বেশী সেলফি নেশায় আক্রান্ত। তাই বলা যায়, সেলফি ও সেলফিস আজ সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ জন্য বিশ্বব্যাপী সামাজিক চেতনা ও মানবিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলার কোন বিকল্প নেই। আমার জীবন শুধু আমার জন্য নয়, আমার পরিবারের জন্য, আমার চারপাশের মানুষের জন্য এবং দুস্থ মানবতার জন্য, এই মানবিক চেতনাই হতে পারে সেলফিমৃত্যু থেকে মুক্তির কার্যকর উপায়।
পরিশেষে বলতে হয়, সেলফি একটি আত্মকেন্দ্রিক মরণনেশা। বিশেষ করে যারা আখেরাতে বিশ্বাস করে তাদের জন্য এটা বড় ধরনের ধর্মীয় অপরাধ, এজন্য আল্লাহর সামনে একদিন অবশ্যই অপরাধী-রূপে দাঁড়াতে হবে। তাই আমরা অন্তত বিশ্বাসীদের প্রতি আহ্বান জানাই সেলফি-অপরাধ থেকে নিজেদের মুক্ত রাখুন। আল্লাহর ওয়াস্তে নিজের জীবনের প্রতি দয়া করুন!
জাতির আশাভরসার সর্বশেষ অবলম্বন!