শিশু-কিশোর ও নবীনদের পত্রিকা

মাসিক আল-কলম-পুষ্প

রমযান ১৪৩০ হিঃ (১৩) | প্রথম পাতা

সম্পাদকীয়:ভাষণ, না প্রহসন !

আমেরিকার রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়ক যারা; কথা বলার ক্ষেত্রে তাদের একটি নিজস্ব ঐতিহ্য রয়েছে। তারা যখন আভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা বলেন, বা প্রতিশ্রুতি দেন তখন সত্য কথা বলেন, কখনো মিথ্যা বলেন না এবং ভুলেও কোন মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেন না। কারণ সেটা তাদের জন্য ডেকে আনতে পারে চূড়ান্ত ভরাডুবি। আমেরিকা মুসলিমবিশ্বের শত্রু হতে পারে, কিন্তু জাতি হিসাবে মার্কিনীদের এ গুণ স্বীকার করতেই হবে যে, তারা অত্যন্ত দায়িত্বশীল ও অধিকারসচেতন। রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রপরিচালকদের কাছে তারা সততা ও সত্যবাদিতা আশা করে। এক্ষেত্রে সামান্য বিচ্যূতিও ক্ষমা করতে তারা প্রস্তুত নয়। উদাহরণ হিসাবে শুধু ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারির উল্লেখই যথেষ্ট। পক্ষান্তরে আন্তর্জাতিক নীতি ও রাজনীতির ক্ষেত্রে অমুসলিম বিশ্বের সঙ্গে তারা বলে অসত্য বা অর্ধসত্য, আর মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে বলে নির্জলা মিথ্যা। আমাদের সঙ্গে তারা সত্য কথা বলে না, এমনকি অর্ধসত্যও না। তাদের প্রতিটি কথা হয় অসত্য এবং প্রতিটি প্রতিশ্রুতি হয় মিথ্যা। এ বিষয়ে মার্কিন জাতির কোন মাথাব্যথা নেই; মার্কিন স্বার্থ রক্ষিত হলেই তারা খুশী। এখানে বিশদ তথ্য পরিবেশনের পরিবর্তে আমি শুধু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, সাবেক প্রেসিডেন্ট বুশ যখন ইরাকে আগ্রাসন চালান তখন তার জনপ্রিয়তা ছিলো প্রশ্নাতীত। কারণ তিনি জয়ী হয়েছিলেন এবং তেলসম্পদের উপর দখল নিশ্চিত করে ফেলেছিলেন। শেষ দিকে তার জনপ্রিয়তায় যে ধ্বস নেমেছিলো, তার কারণ কিন্তু ইরাকের গণহত্যা, কিংবা গণবিধ্বংসী অস্ত্র সম্পর্কে মিথ্যাচার নয়: আসল কারণ হলো ইরাকযুদ্ধের বিপুল ব্যয়, যার মন্দ প্রভাব পড়েছে মার্কিন অর্থনীতির উপর, তদুপরি মার্কিন সৈন্যদের প্রচুর রক্তক্ষয়। বর্তমান প্রেসিডেন্ট ওবামা আমাদের সঙ্গে আচরণে ও উচ্চারণে একই ঐতিহ্য রক্ষা করছেন। অবশ্য তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই এবং আমরা অবাক হইনি। তবে সমপ্রতি তিনি তার পূর্বসূরীদের ঐতিহ্য থেকে সরে এসে একটি কঠিন সত্য উচ্চারণ করেছেন। মধ্যপ্রাচ্য সফরের প্রাক্কালে বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘একজন ভালো বন্ধু হওয়ার প্রথম শর্তই হচ্ছে সততা, কিন্তু আমাদের যতটা সৎ হওয়া প্রয়োজন তা আমরা নই।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমার দৃষ্টিতে যা খুবই ভয়াবহ তা হলো, যুক্তরাষ্ট্র মনে করে যে, সে তার নিজের মূল্যবোধ অন্য দেশের উপর চাপিয়ে দিতে পারে, যাদের রয়েছে পৃথক ইতিহাস ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতি। তবে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, বাকস্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা- এগুলো কেবল পশ্চিমা নীতি নয়, বরং সার্বজনীন নীতি বলেই আমি মনে করি।’ (পরবর্তী অনিবার্য বাক্যটি হবে, ‘সুতরাং আমেরিকা শক্তি প্রয়োগ করে ঐ সব সার্বজনীন নীতি অন্যদের উপর চাপিয়ে দেয়ার অধিকার রাখে এবং সেটাই তারা আফগানিস্তান ও ইরাকে প্রয়োগ করেছে এবং এখন পাকিস্তানে করছে।) মিস্টার ওবামা যে জিনিসটাকে ভয়বাহ মনে করেন, আমরাও সেটাকে ভয়াবহ মনে করি, তবে গণতন্ত্রপ্রসঙ্গে আমরা বিনয়ের সঙ্গে প্রশ্ন করতে চাই, ইরাকে রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়ে আপনি যে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান, সেটা ফিলিস্তিনে কেন নয়? হামাস তো ‘সাফসুতরা’ নির্বাচনে ফিলিস্তিনী জনগণের রায় নিয়েই ক্ষমতায় এসেছিলো; কেন তাদের এমন নির্মমভাবে নির্মূল করা হচ্ছে? আলজিরিয়াতেই বা গণতন্ত্র কেন উপেক্ষিত হলো? শুধু এজন্য যে, নির্বাচনে ইসলামী দল বিজয়ী হয়েছে? তুরস্কে? তাহলে কোন্‌ গণতন্ত্রের পূজারী আপনি, আপনার আমেরিকা? কাকে বলে আইনের শাসন? আবুগারীব কারাগারের নিষ্ঠুরতা? গোয়ান্তানামো বন্দী- শিবিরের পাশবিকতা? মার্কিন সৈন্যরা জিজ্ঞাসাবাদের নামে যে জঘন্য বর্বরতা চালিয়েছে তার বিচার হলো না কেন? বন্দীনির্যাতনের সমস্ত সচিত্র প্রমাণ সিআইএ ধ্বংস করে ফেললো কেন? আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য? মিস্টার ওবামা! বাকস্বাধীনতা যদি সার্বজনীন হয় তাহলে কেন ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ নামের যে ভয়াবহ সন্ত্রাস, আমরা তার প্রতিবাদ করতে পারি না? কেন প্রশ্ন করতে পারি না, পারমাণবিক বিস্ফোরণের পরও উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে কেন শুধু মৌখিক নিন্দা, অথচ নিছক সন্দেহের উপর ইরানকে কোণঠাসা করার জন্য এত তোড়জোড়? ধর্মীয় স্বাধীনতা যদি সার্বজনীন হয় তাহলে কেন পাশ্চাত্যে মুসলিম নারীরা হিজাব ব্যবহারের ধর্মীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত? কেন কার্টুন ছেপে নবীর অবমাননা করে বারবার মুসলিম উম্মাহর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করা হয়, আর বিশ্ব তা উপভোগ করে? কেন সালমান রুশদিদের এত সমাদর? মিস্টার বারাক ‘হোসেন’! আপনাকে ধন্যবাদ। আপনি সত্যি বলেছেন, বন্ধুত্বের জন্য প্রথম শর্ত হলো সততা, যা আমেরিকা কখনো রক্ষা করে না। সুতরাং আমেরিকা কখনো মুসলিমবিশ্বের বন্ধু হতে পারে না। আমাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ অবশ্য চৌদ্দশ বছর আগেই বলে দিয়েছে, কারা কখনো আমাদের বন্ধু হতে পারে না, বরং হতে পারে পরস্পরের বন্ধু! সুতরাং দোষ আপনার নয়, দোষ আমাদের দুর্ভাগ্যের। এত কিছুর পরো, নাসের, সাদাত, মোবারক ও আরাফাত, মাহমূদ আব্বাস এবং কারযায়ী, মুশাররফ ও জারদারিরা আমেরিকাকেই মনে করে বন্ধু। পতনকালে মানুষ এমনই অন্ধ হয়। আপনার এমন ব্যতিক্রমী সত্যভাষণের পরো মনে তো হয় না, কারো চৈতন্যোদয় ঘটবে। তবে আপনি বলতে পারবেন, শত্রু হয়েও আমি তোমাদের সত্য কথা বলেছিলাম।