শিশু-কিশোর ও নবীনদের পত্রিকা

মাসিক আল-কলম-পুষ্প

রমযান ১৪৩০ হিঃ (১৩) | সম্পাদকের রোযনামচা

সম্পাদকের রোযনামচা

২-৮-৩০ হিঃ

আমার একটি প্রিয় গাছ ছিলো, গন্ধরাজ। আমার সঙ্গে তার হৃদয়ের বন্ধন ছিলো বিশবছরের বেশী। গাছটি ছিলো আমার এক প্রিয় ছাত্রের স্মৃতি। গাছটি কিছুদিন আগে নিহত হয়েছিলো এক নিষ্ঠুর লোকের হাতে। আমার প্রিয় গন্ধরাজের মৃত্যুশোকে পুষ্পের পাতায় আমি লিখেছিলাম, ‘গন্ধরাজ গাছটি মারা গেছে’। সেই লেখা একটি মেয়ের দিলের জখম তাজা করে দিয়েছিলো বলে সে আমার কাছে একটি মর্মস্পর্শী চিঠি লিখেছে, যা পুষ্পের বর্তমান সংখ্যায় ছাপা হয়েছে। কথা প্রসঙ্গে আমার স্ত্রীকে বললাম, ‘গন্ধরাজ গাছটি দুই দুইটি বন্যা সহ্য করে বেঁচে ছিলো।’ সঙ্গে সঙ্গে তিনি মন্তব্য করলেন, ‘প্রকৃতির বন্যা সহ্য করতে পেরেছে, মানুষের বন্যতা সহ্য করতে পারেনি।’ মন্তব্যটি এতো ভালো লাগলো যে, আমি বলে উঠলাম, বন্যা ও বন্যতা শব্দদু’টির এমন সুন্দর প্রয়োগ সম্ভবত বাংলাসাহিত্যে এর আগে আর কখনো হয়নি। তুমি লেখো না কেন? আসলে তুমি নিজের প্রতিভার প্রতি অবিচার করছো।

৫-৮-৩০ হিঃ

আজ একটি বাক্য লিখেছিলাম, ‘আমার জীবনে যখন আনন্দের কোন শুভ লগ্ন এসেছে, কলম আমাকে আলোকিত শব্দে অভিনন্দন জানিয়েছে। আমার জীবনে যখন বেদনার কোন বিষণ্ন মুহূর্ত এসেছে কলম আমাকে কালো কালির হরফে সমবেদনা জানিয়েছে।’ খুশী হলাম, একজনকে ডেকে শুনালাম, সেও খুশী হলো। বাক্যটি বারবার পড়ছি, হঠাৎ তাতে একটা বড় ত্রুটি ধরা পড়লো। তাকে বললাম, দেখো তো কোন ত্রুটি খুঁজে পাও কি না! কিছুক্ষণ চিন্তা করে সে বললো, দেখছি না তো! আমি বললাম, শব্দপ্রয়োগ মোটামুটি ঠিক আছে, তবে বাস্তবতার সাথে বৈপরীত্যের ত্রুটি রয়েছে। কারণ, আগে হরফ, তারপর শব্দ, অথচ এখানে আগে শব্দের কথা এসেছে, তারপর এসেছে হরফের কথা। যদি এভাবে লিখি তাহলে ত্রুটিটা দূর হয়- ‘আলোকিত বর্ণে/ কালো কালির শব্দে। আলোকিত-এর সঙ্গে হরফ চলবে না, কারণ তাতে সমশ্রেণিতা নেই। নূরানি হরফ চলতে পারে। এজন্য আলোকিত-এর সঙ্গে হরফের সমার্থক বর্ণশব্দটি ব্যবহার করতে হয়েছে। সাহিত্যচর্চা কিছুটা মেহনত ও সাধনা অবশ্যই দাবী করে। সাহিত্যের এ দাবী যে রক্ষা করবে সে এগিয়ে যাবে, অন্যথায় ...।

৬-৮-৩০ হিঃ

মাসিক আল-আমানাহ পত্রিকাটি আগে দেখিনি, আজ দেখলাম। সংখ্যা রজব, ৩০ হিঃ। সম্পাদকীয় -এর শিরোনামে একটি শব্দপ্রয়োগ,আমাকে মুগ্ধ করেছে, ‘রুজির স্বীকৃতি, নাকি রুচির বিকৃতি’। অবশ্য বক্তব্যের ভাষা ও ভঙ্গির সাথে আমার দ্বিমত রয়েছে। বড়দের সম্পর্কে কোন মন্তব্য করার ক্ষেত্রে আদব ও সংযম রক্ষা করার অনুশীলন আমাদের থাকতে হবে।

৮-৮-৩০ হিঃ

আজ পুষ্পের নামে আসা বেশ কিছু লেখা দেখলাম। আমি সবসময় দেখেছি; পুষ্পের বন্ধুদের লেখাগুলো সম্পাদনা করতে গিয়ে তাদের কাছ থেকে আমি আমার নিজের কলমের জন্য মূল্যবান মূল্যবান লেখা উপহার পেয়ে যাই। এজন্য তাদের কাছে আমি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। তারা যদি আরো যত্নের সাথে, আরো সাধনা করে লেখে এবং লেখা পাঠাতে থাকে তাহলে আমরা সবাই উপকৃত হবো, ইনশাআল্লাহ। সিদ্ধান্ত নিয়েছি -আল্লাহ যেন কল্যাণ দান করেন- এ সংখ্যা থেকে প্রথম পৃষ্ঠায় সম্পাদকের স্থানে লেখা হবে, ‘আবু তাহের মিছবাহ (এবং পুষ্পের লেখক বন্ধুরা), আর প্রতিসংখ্যায় একটি নির্দিষ্ট মাপকাঠির আলোকে সেই সংখ্যার একজন লেখকের নাম সহযোগী সম্পাদক হিসাবে মুদ্রিত হবে। এত দিন যে কিছু বীজ মাটির নীচে লুকিয়ে রাখার কথা বলে আসছিলাম হয়ত আজকের এ সিদ্ধান্ত সে বীজেরই অঙ্কুর। পুষ্পের লেখক বন্ধুদের আমি এভাবে সম্মানিত করতে চাই। আশা করি, বন্ধুরা সাহিত্যের পথে তাদের সাধনা ও অধ্যবসায় দ্বারা আমার সিদ্ধান্তের মর্যাদা রক্ষা করবে, আমীন।

৯-৮-৩০ হিঃ

নদবী ছাহেব ছোদের জন্য লেখা একটি বিজ্ঞান-বই আমাকে দিলেন, ‘আমাদের এই পৃথিবী’। বিজ্ঞানের বই সবসময় আমার প্রিয়। ছাত্রদের আমি বলি, ‘সস্তা গল্প -উপন্যাস ও রহস্যবইগুলোতে শেখার কিছু নেই। বিজ্ঞানের বই পড়ো, জ্ঞানের পরিধি বাড়বে।’ কিন্তু বইগুলোর ভাষা আমাকে হতাশ করে। আমার পুত্রকে বললাম, বইটি পড়ো, তবে ভাষার ত্রুটির দিকে যথাসম্ভব সতর্ক দৃষ্টি রেখে। যেমন লেখক লিখেছেন- ‘মাথার উপর তারকা খচিত নীলাকাশ।’ তারকা ও খচিত একসঙ্গে লিখতে হবে; হয়ত এটা প্রুফের ভুল। ঠিক আছে, তবে ‘তারাভরা’ লিখলে সহজ হতো। ‘নীলাকাশ’ কেন? ‘নীল আকাশ’ নয় কেন? তাছাড়া আমি জানি না, রাতের আকাশ নীল দেখায় কি না। শুনেছি আকাশের কোন রঙ নেই; চোখের বিভ্রমে দিনের মেঘমুক্ত আকাশ নীল দেখা যায়। সুতরাং দিনের আকাশ সম্পর্কে নীল বলা যায়, কিন্তু রাতের আকাশ সম্পর্কে নয়! তিনি আরো লিখেছেন, ‘মেঘহীন রাতের আকাশকে মনে হয় যেন একটা তারার বাগান। নীল সামিয়ানায় যেন ফুটে আছে অগণিত তারার ফুল।’ বাক্যটা কেমন হলো? মেঘহীন রাতের আকাশ/ রাতের মেঘহীন আকাশ/ রাতের মেঘমুক্ত আকাশ, তিনটির মধ্যে কোনটি ভালো? ‘মনে হয়’-এর পর ‘যেন’-এর কি খুব প্রয়োজন আছে? দু'টোর যে কোন একটি হলেই তো চলে, যেমন- (ক) আকাশকে মনে হয় তারার বাগান। (খ) আকাশটা যেন তারার বাগান। আকাশকে একবার বাগান বলে আবার সামিয়ানা বলার দরকার কী? দুই উপমার মাঝে সংযোগটা কী? তাছাড়া ‘তারার বাগান’ বলার পর ‘তারার ফুল’ বলার বিশেষ উপযোগিতা নেই; শুধু ফুল বললেই হয়, সেটাই বরং ভালো। পুরো বাক্যটি এমন হতে পারে- ‘রাতের মেঘমুক্ত আকাশ যেন তারার বাগান/ তারকার উদ্যান, কী সুন্দর ফুটে আছে অসংখ্য ফুল!’ আমার পর্যালোচনায়ও ত্রুটি থাকতে পারে। তবে জানতে ইচ্ছে করে, একজন পাঠক হিসাবে বাক্যটি সম্পর্কে আমি যে পরিমাণ চিন্তাভাবনা করলাম, লেখক হিসাবে তিনি কি তা করেছেন? বিজ্ঞানের বইগুলো ভাষার দিক থেকে ত্রুটিমুক্ত, সুন্দর ও সুখপাঠ্য হলে ক্ষতি কী?

১০-৮-৩০ হিঃ

আমার বন্ধুরা যারা পুষ্প পড়ে এবং পুষ্পের জন্য লেখা পাঠায় তারা মনে হয় খুব একটা লোগাত দেখে না। বানানের ত্রুটি থেকে মুক্ত হতে হলে লোগাতের নিবিড় ব্যবহার ছাড়া অন্য কোন পথ নেই। সম্ভবত তাদের চেয়ে আমারই লোগাত বেশী দেখা হয়। তবু ম্রিয়মান শব্দটির বানানে প্রায় ভুল করে বসেছিলাম। আমার ধারণা ছিলো দীর্ঘ ঈকার, দেখি, হ্রস্ব ইকার! লোগাত দেখতে গিয়ে আজ আবার মনে হলো, কবে হবে বাংলাভাষায় আলিমসমাজের নিজস্ব অভিধান, যাতে আমাদের ছেলেরা এক্ষেত্রে পরনির্ভরতা থেকে মুক্ত হতে পারে! উর্দুভাষায় আলিমদের লোগাত আছে, বাংলাভাষায় নেই কেন? বাংলাটা কি হিন্দুদের ভাষা? ইতিহাস কী বলে?

১১-৮-৩০ হিঃ

যতক্ষণ পুষ্পের কাজ করি, আমি অন্য এক জগতে বাস করি, যেখানে কোন দুঃখ নেই, কষ্ট নেই, আছে হৃদয় ও আত্মার শান্তি ও প্রশান্তি। আমার ছেলে মুহম্মদ আজ জিজ্ঞাসা করে, তুমি যখন কোন লেখা পাও, তোমার কেমন আনন্দ হয়? আজ ও লেখা পাওয়ার আনন্দে উদ্ভাসিত অবস্থায় আমাকে দেখতে পেয়েছিলো, তাই এ প্রশ্ন। আমার ভালো লাগলো, মনে হলো, খুব ধীরে হলেও ওর কিছুটা উন্নতি হচ্ছে, আলহামদু লিল্লাহ। বললাম, আব্বু! তোমাকে পেয়ে যেমন আনন্দিত হয়েছিলাম, আসমান থেকে যখন কোন লেখা পাই তেমনি আনন্দিত হই। আমার লেখা আসলেই আমার ‘সন্তান’।

১২-৮-৩০ হিঃ

আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দেশের কাজ করতে না পারলে মরেও শান্তি পাবো না। কারণ মৃত্যুর পর বাবা আমাকে জিজ্ঞাসা করবেন, দেশের মানুষের জন্য কী করে এসেছো? তখন কী জবাব দেবো।?’ সব দেশেই ‘প্রথম’ ব্যক্তিটির কাছে মানুষ প্রজ্ঞাপূর্ণ কথা আশা করে। দেশের জন্য কাজ করার আকুতি প্রকাশ করুন, এটা প্রশংসনীয়, কিন্তু মরেও শান্তি না পাওয়ার কথা কেন? মৃত্যুর বিষয়টি আলাদা করে তোলা থাকুক না! কবরে তো সওয়াল-জওয়াব হবে মুনকার-নাকীরের, বাবা-মেয়ের নয়!

১৬-৩-৩০ হিঃ

আমার একটি প্রিয় বিষয় হলো ‘লেখার মুহূর্ত’ যেটাকে লেখার জন্য ‘অন্তর্প্রেরণা’ও বলা যেতে পারে। সেই অন্তর্প্রেরণা আজ হঠাৎ করে আমার অন্তরে উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিলো এবং আমি একটি সুন্দর লেখা পেয়েছি। গতকাল আমার খুব ‘কাছের’ একটি মেয়ে মাতৃত্বের প্রথম গৌরব অর্জন করেছে। তার কুশল জানতে ফোন করেছিলাম। আমার স্ত্রী ফোন ধরামাত্র শুনতে পেলাম স্বর্গীয় কান্নার সুমধুর শব্দ! আমার ভিতরে কেমন যে তরঙ্গদোলা শুরু হলো! আমি একেবারে অন্য জগতে চলে গেলাম। আমার স্ত্রী অবাক, কথা বলছি না কেন! আমি বললাম, এই নিষ্পাপ শিশুটির কান্না আমাকে অন্য জগতে নিয়ে গেছে। বলেই ফোন রেখে দিলাম এবং কলম তুলে নিলাম। এটা সন্ধ্যার আগের ঘটনা। সন্ধ্যার পরে ফোনে আমার স্ত্রীকে ‘সদ্যপ্রসূত’ লেখাটি পড়ে শোনালাম। তিনি বললেন, আল-হামদু লিল্লাহ! শিশুর কান্না কি এর আগে আমি শুনিনি! আমার বড় মেয়ের প্রথম কান্না আমি শুনেছি। কিন্তু এটা হয়নি, যেটা আজ হলো। এটা সবসময় হয় না, কখন হবে কেউ বলতে পারে না। আসলে এগুলো হচ্ছে উপলক্ষ আকাশের দান নেমে আসার।