শিশু-কিশোর ও নবীনদের পত্রিকা

মাসিক আল-কলম-পুষ্প

যিলক্বদ ১৪৩০হিঃ (১৪) | কাশগর ও কায়রো

ইউরোপের হিজাব ভীতি কেন?

সমপ্রতি ধর্মীয় কারণে মুখমণ্ডল টেকে রাখাকে অপরাধ হিসাবে গণ্য করে ইতালির পার্লামেন্টে একটি বিল উত্থাপন করা হয়েছে। এটি যদি আইন হিসাবে অনুমোদন লাভ করে তাহলে কোন মুসলিম নারী বোরকা বা নেকাব ব্যবহার করলে কঠিন দণ্ড ও জরিমানার সম্মুখীন হবেন। এই বিলের স্বপক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলা হয়েছে, ‘ইতালি ও ইতালির জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে এ আইন অপরিহার্য।’ হিজাব বা নেকাব কীভাবে ইতালির নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হতে পারে, সেটা অবশ্য বলা হয়নি। বোরকার ভেতরে করে বোমা বহন করা যায়, যদিও এমন ঘটনা ইউরোপে এখনো ঘটেনি, কিন্তু নেকাব বা স্কার্ফ! সেটা নিষিদ্ধ হবে কেন, নিরাপত্তাই যদি কারণ হয়ে থাকে! কোন মুসলিম দেশ যদি একই যুক্তিতে ওভারকোট নিষিদ্ধ করে যে, কোটের ভিতরে বোমা বহন করা সম্ভব তাহলে পশ্চিমা দেশে কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে, যদিও এর সাথে ধর্মের প্রশ্ন জড়িত নয়? পক্ষান্তরে হিজাব হচ্ছে মুসলিমদের ধর্মীয় পরিচয়ের অংশ। ইউরোপে নগ্ন পোশাকের মুসলিম নারীও রয়েছে, যারা নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশ করতে চায় না। পক্ষান্তরে যারা হিজাব পরেন তারা নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় প্রকাশ করতে চান। পোশাক তো ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের অংশ, আর পশ্চিমারা ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মানবাধিকার নিয়ে গর্ব করে থাকে। অথচ তারাই এখন ধর্মীয় পরিচয় মুছে দেয়ার জন্য আইন করে মুসলিম নারীর ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মানবাধিকার হরণ করতে উদ্যত হয়েছে! আসলে ইসলামভীতি এখন আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্বকে অন্ধ করে ফেলেছে। প্রকৃত ভয়টা তাদের কোথায় সেটা অবশ্য প্রকাশ পেয়ে গেছে ইতালির বিখ্যাত নারীসাংবাদিক ওরিয়ানা ফিলাচির মন্তব্যে। ২০০৬-এর ১৫ই সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণকারী এই সাংবাদিক নয় এগারোর পর ‘রেইজ এ্যন্ড প্রাইড’ নামে একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী বই লিখেছেন, যা ইউরোপে বেস্ট সেলারের তালিকায় ছিলো এবং এপর্যন্ত এর পনের লাখের বেশী কপি বিক্রি হয়েছে। বইটির ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, ‘মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র পশ্চিমাবিদ্বেষ ছড়িয়ে পড়েছে বাতাসের বেগে আগুনের ফুলকির মত। ইসলামী উগ্রবাদীরা বেড়ে চলেছে এক, দুই, চার, আট, ষোল এই গতিতে।’ ইতালির জনগণের প্রতি ফালাচির আহ্বান হলো, ‘আমার প্রিয় জনগণ, শুনুন, সবদিক থেকেই আমরা ধ্বংস হয়ে যাবো। কেননা আমাদের সংস্কৃতির মৃত্যু হলে আমরা পাবো বেল টাওয়ারের স্থলে মিনার, মিনিস্কার্টের স্থলে বোরকা, আর আমাদের পানীয়ের জায়গা নেবে উটের দুধ।’ ইতালির প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে ফালাচির বক্তব্য হলো, ‘শুনুন ইতালির প্রধানমন্ত্রী, আপনাকে বলছি, রোমের মসজিদ বেল টাওয়ার গুঁড়িয়ে দেয়ার স্বপ্ন দেখছে। আপনার পুলিশবাহিনী কি এতটাই অক্ষম? আপনার গোয়েন্দা সংস্থা কি এর কিছুই জানে না? কেন জানে না?’ উদাহরণ আরো দেয়া যায়, কিন্তু তার কি খুব বেশী প্রয়োজন আছে? তো হিজাবের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যে যে হৈচৈ শুরু হয়েছে তার পিছনে আসল কারণটা হলো মুসলিমবিদ্বেষ এবং ইসলামভীতি। এমনকি ফালাচি পোপকে স্পেনের মুসলিম শাসনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেছেন, ‘যদি ইসাবেলা, আর ফার্ডিনান্ড মুসলমানদের তাড়াতে সক্ষম না হতেন তাহলে এখন আমাদের আরবীভাষায় কথা বলতে হতো। অভিবাসীরা যে হারে বাচ্চা দিচ্ছে তাতে আমি অতীতের দুঃস্বপ্ন আবার দেখতে পাচ্ছি। রাস্তায় যত মুসলিম নারী দেখা যায় তার অর্ধেকই হচ্ছে গর্ভবতী, অথচ ইতালিয়ানরা তো শিশুপ্রসব ভুলেই গিয়েছে!’ দেখুন, মুসলিমবিদ্বেষে অন্ধ এই ভদ্রমহিলা স্বাভাবিক শালীনতাবোধও কীভাবে ভুলে গেছেন! স্পেন! মুসলিম উম্মাহ স্পেনের মাধ্যমে ইউরোপকে কী দিয়েছে, আর ইউরোপ কী প্রতিদান দিয়েছে সে প্রসঙ্গ এখন থাক। আমরা শুধু অবাক হই একথা ভেবে যে, এই বর্ণবাদী মানসিকতার জ্ঞানপাপীরাই মুসলিম বিশ্বকে বিভিন্ন উপলক্ষে মানবাধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা, সংখ্যালঘু অধিকার ইত্যাদি সম্পর্কে উপদেশ দান করে থাকেন। আমাদের পার্বত্যচট্টগ্রাম ও উপজাতি নিয়েও তাদের মাথাব্যথা কম নয়। আমরা অস্বীকার করি না যে, ইউরোপের সমাজে কল্যাণরাষ্ট্রের বহু গুণ রয়েছে, তবে এটাও বাস্তব সত্য যে, ইউরোপের মুসলিমবিদ্বেষ এখন আর মুখোশের আড়ালে গোপন কোন বিষয় নয়। মধ্যযুগীয় সেই কুৎসিত মানসিকতা সেখানে এখন ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়ছে। হান্টিংটনের সভ্যতার দ্বন্দ্ব সেই একই মানসিকতার বুদ্ধিবৃত্তিক প্রকাশমাত্র। তারপরো ইউরোপকে আমরা আহ্বান জানাবো, সংযম ও যুক্তির পথে আসুন এবং ইসলামকে জানতে ও বুঝতে চেষ্টা করুন। তাহলে অবশ্যই বুঝতে পারবেন যে, ইউরোপের বহু সামাজিক অবক্ষয়ের সার্থক সমাধান ইসলামই আপনাদের দিতে পারে। মুসলিম উম্মাহর বুদ্ধিজীবী সমাজকেও আমরা আহ্বান জানাবো, পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ ত্যাগ করে তাদের মূল উদ্দেশ্য বুঝতে চেষ্টা করুন এবং আত্মপরিচয় অনুসন্ধানপূর্বক শেকড়আশ্রয়ী হতে চেষ্টা করুন। আমরা বিশ্বাস করি, সমগ্র বিশ্বজুড়ে যে ইসলামী জাগরণ শুরু হয়েছে তা রোধ করা কিছুতেই সম্ভব নয়। কারণ আল্লাহ তার কালিমাকে অবশ্যই পূর্ণতা দান করবেন, যদিও কাফিররা তা অপসন্দ করে।