শিশু-কিশোর ও নবীনদের পত্রিকা

মাসিক আল-কলম-পুষ্প

যিলক্বদ ১৪৩০হিঃ (১৪) | কাশগর ও কায়রো

আফগানিস্তান, নির্বাচন, তারপর?

আফগানিস্তানে দীর্ঘ নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে যে জিনিসটি সংঘটিত হলো তার নাম গণতান্ত্রিক নির্বাচন। প্রথম দফা নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণায় প্রেসিডেন্ট কারযায়ী বিজয়ী হয়েছেন, কিন্তু তার প্রতিপক্ষ (এককালে তার মান্ত্রিসভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী) ডঃ আব্দুল্লাহ ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ এনে পুনর্নিবাচন দাবী করেছেন, যেমনটি করেছিলেন ইরানে মুসাভী সাহেব। কিন্তু আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্ব মুসাভীর প্রতি যতটা সদয় ছিলো ডঃ আব্দুল্লাহর প্রতি ততটা দয়া দেখাতে রাজি হয়নি। ইরানে যেটা ছিলো ভোটডাকাতি, আফগানিস্তানে সেটাই হয়ে গেলো স্বচ্ছ নির্বাচন। তাই বিভিন্নভাবে দূতিয়ালী করে আমেরিকা প্রকাশ্যে এবং পর্দার আড়ালে ডঃ আব্দুল্লাহকে বোঝাতে চেষ্টা করলো যে, এভাবে অভিযোগ উত্থাপন করা গণতান্ত্রিক ব্যাবস্থার জন্য ক্ষতিকর। এমনকি তারা তালিবানভীতিও প্রয়োগ করে বুঝালেন যে, তালিবানদের প্রবল প্রতিরোধের মুখে বহু কষ্টে একবার নির্বাচন সম্পন্ন করা হয়েছে, দ্বিতীয়বার এধরনের ঝুঁকি নেয়া সম্ভব নয়। সুতরাং ডঃ আব্দুল্লাহর কর্তব্য হলো গণতন্ত্রের স্বার্থে অবনত মস্তকে মার্কিন উপদেশ মেনে নেয়া। কিন্তু ডঃ সাহেব তার অবস্থানে অনড়। বিষয়টি অবশ্যই খুব কৌতূহলোদ্দীপক যে, তিনি এতটা সাহস কোথায় পেলেন যে, নিজের সিদ্ধান্তে অটল তো থাকলেনই, সেই সাথে অকাট্য দলিল-প্রমাণ উপস্থান করে দেখিয়ে দিলেন, ব্যাপক কারচুপি হয়েছে এবং তা নির্বাচন কমিশন ও জাতিসংঘ তত্ত্বাবধায়কের পূর্ণ তত্ত্বাবধানে। এরপর পশ্চিমা বিশ্বের মুখরক্ষা করার কোন উপায় থাকলো না। তাই একান্ত অনন্যোপায় হয়ে তারা স্বীকার করে নিলে, কারচুপি হয়েছে এবং তা ব্যাপক পরিমাণে; এত ব্যাপক পরিমাণে যে, যেখানে দ্বিতীয় দফা নির্বাচনেরই প্রয়োজন ছিলো না সেখানে এখন পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, কারযায়ীর ভবিষ্যৎ অন্ধকার। সুতরাং তারাও বললেন, বলতে বাধ্য হলেন, পুনর্নিবাচনের কথা। কিন্তু কারযায়ী তা মানবেন কেন? কিন্তু তাকেও মানানো হলো প্রথমে নরমে, তারপর গরমে। শেষ পর্যন্ত পুনর্নিবাচনের সিদ্ধান্ত হলো। শুরু থেকেই আমি ঘটনাপ্রবাহ পর্যবেক্ষণ করছিলাম, আর অবাক হয়ে ভাবছিলাম, আসলে হচ্ছেটা কী?! হিসাব তো কোনভাবেই মিলছে না। আমেরিকার তো এখনো যে কোন মূল্যে কারযায়ীকে দরকার। তার অবস্থা তো পাকিস্তানের পারভেজ মুশাররফের মত নয় যে, মসনদ থেকে এখনই তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া যাবে! সেখানে তো আমেরিকার হাতে কোন ‘জারদারি’ নেই! তাহলে? রহস্যটা কোথায়? গেমপ্ল্যানটা কী? এরপর শুরু হলো নাটকের দ্বিতীয় অধ্যায়, আর তখনই সবকিছু জলের মত তরল হয়ে গেলো। ্‌এতো যে অনমনীয় ও সাহসী ডঃ আব্দুল্লাহ, হঠাৎ করেই তিনি হয়ে গেলেন খালি আব্দুল্লাহ! চমকপ্রদ একঘোষণার মাধ্যমে তিনি ‘গণতন্ত্র রক্ষার স্বার্থে’ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেন। আর মুসলিম বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ অবাক হয়ে এবং কিছু মানুষ অবাক না হয়েই দেখলো, ওবামা থেকে শুরু করে এমনকি জাতিসংঘ মহসচিবও কারযায়ীকে অভিনন্দন জানাচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে আফগানিস্তানে গণতন্ত্রের বুনিয়াদ মযবূত হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছেন। হায়, মুসাভী যদি এমন ‘ভালো মানুষ’ হতেন, কিংবা মার্কিন মুরুব্বী যদি তাকে কিছু ভালো উপদেশ দিতেন, যেমনটি দিয়েছেন আফগানিস্তানে আব্দুল্লাহ সাহেবকে! ডঃ আব্দুল্লাহর নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয়া সম্পর্কে হিলারী সাহেবা মন্তব্য করেছেন যে, এটা সম্পূর্ণ তার ব্যক্তিগত বিষয়’ তিনি ওবামার পক্ষে তার নিজের সরে দাঁড়ানোর সাথে এটাকে তুলনা করেছেন। এসম্পর্কে লণ্ডনের গার্ডিয়ান ‘আফগান নির্বাচনে সবাই পরাজিত’ শিরোনামের সম্পাদকীয় নিবন্ধে যে মন্তব্য করেছে তা এখানে তুলে ধরা যায়, ‘মিসেস ক্লিন্টন যদি সেই ব্যক্তিকে খোঁচা না মেরে থাকেন যিনি এখন তার প্রেসিডেন্ট তাহলে তিনি অবশ্যই বোঝবেন যে, এধরনের তুলনা অযৌক্তিক’ আসলে পুরো বিষয়টাই ছিলো একটা প্রহসন। যবনিকার পিছনের উদ্দেশ্য ছিলো কারযায়ীকে চাপের মুখে ফেলে আরো বেশী নতুজানু হতে বাধ্য করা। কারণ ইতিপূর্বে কিছু কিছু বিষয়ে তিনি মার্কিন বাহিনীর সমালোচনা করার সাহস দেখিয়েছিলেন। বৃটিশ পত্রিকা গার্ডিয়ানের মন্তব্য, ‘আব্দুল্লাহর সামনে সরে দাঁড়ানোটাই ছিলো একমাত্র বিকল্প। কারণ দ্বিতীয় নির্বাচনও হতো ঠিক প্রথম দফার মত। এজন্যই তথাকথিত স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের প্রধানকে সরানোর যে দাবী আব্দুল্লাহ করেছিলেন, ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট তা প্রত্যাক্ষান করেছেন এবং পশ্চিমা বিশ্বও তাতে সায় দিয়েছে। ওয়াসিংটনের এখন একমাত্র লক্ষ্য যথাসম্ভব দ্রুত কারযায়ীর অভিষেক। আমেরিকা আশা করছে, কারযায়ী এখন তার সমস্ত দাবী ও শর্তের সামনে মাথা নত করবে। তবে আমরা মনে করি, ওয়াশিংটনের উপলব্ধি করার সময় এসেছে যে, কারযায়ীর স্বার্থ এবং মার্কিন স্বার্থ এখন এক নয়।’ বলাবাহুল্য যে, এধরনের নির্বাচন এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করার জ্যই আমেরিকা ইরাকে এবং আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালিয়ে, হাঁ, আমরা আগ্রাসনই বলবো, লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করেছে এবং এখনো করে চলেছে। আমেরিকার শুধু দুঃখ, ইরাক আফগানিস্তান ও পকিস্তানে যা সম্ভব হলো, ইরানে তা সম্ভব হলো না কেন! মুসাভীরা আসলেই অপদার্থ! পাকা আপেলটি তাদের মুখের সামনে তুলে ধরা হলো, কিন্তু সামান্য একটি কামড়ও বসাতে পারলো না। আমি মনে করি, দোষটা মুসাভীর নয়; তিনি সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন, কিন্তু আহমদী নেজাদ সম্ভবত অন্য ধাতুতে গড়া!