শিশু-কিশোর ও নবীনদের পত্রিকা

মাসিক আল-কলম-পুষ্প

যিলক্বদ ১৪৩০হিঃ (১৪) | তোমাদের জন্য

সফরনামার জন্য মুবারকবাদ

লিখেছেনঃ মাওলানা আব্দুল মালিক

হজ্বের সফরনামার জগতে একটি কল্যাণকর বিপ্লব সৃষ্টিকারী সফরনামা ‘বাইতুল্লাহর মুসাফির’-এর প্রকাশনার জন্য দারুলকলম, আশরাফাবাদ, ঢাকা-কে আন্তরিক মুবারকবাদ ও শোকরানা পেশ করছি। ইসলামী সাহিত্যের প্রকাশনা-অঙ্গনে সত্যি এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। সুতরাং সমস্ত হামদ ও প্রশংসা এবং শোকর ও কৃতজ্ঞতা একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার জন্য, যিনি লেখকের কলম ও কলব থেকে এই কিতাব বের করেছেন এবং দারুলকলমকে তা প্রকাশ করার তাওফীক দান করেছেন। আসল কথা হলো, ‘ঈঁ সা‘আদাত বাযো.রে বাযূ নীস্ত/ তা. নাবাখশাদ খোদা.য়ে বাখশেন্দাহ’ (এ সৌভাগ্য নয় শক্তির জোরে/ দাতা যদি না দেন দয়া করে।)

অনবদ্য রচনাশৈলী এবং কলমের ‘সিহরবয়ান’ ও যাদুময়তার আদর্শ উদাহরণ এই সফরনামা সম্পর্কে আমার অনুভব-অনুভূতি ইতিপূর্বে অতি সংক্ষেপে আমি আল-কাউছারে লিখেছি এবং আল্লাহর শোকর এখন তা সফরনামার ‘উদ্বোধনিকা’ হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছে। সত্য কথা এই যে, আমার যা কিছু বলার ছিলো তার খুব সামান্য অংশই আমি বলতে পেরেছি, প্রথমত যোগ্যতার অভাবে, দ্বিতীয়ত সময়ের অভাবে এবং তৃতীয়ত স্থানের অভাবে। আল্লাহ যদি তাওফীক দান করেন, এ বিষয়ে অনেক কিছু বলার আছে এবং অনেক কিছু করার আছে, যাতে কিতাবটির ফায়দা ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হতে পারে। এখন এখানে আমি সফরনামার একটি নতুন বিষয় তুলে ধরতে চাই, যার গুরুত্ব কোন অংশেই কম নয়।

কিতাবকে কারো নামে ‘উৎসর্গ’ করার প্রচলন সালাফ থেকেই চলে এসেছে। সুতরাং ধারণা ছিলো, বাইতুল্লাহর মুসাফিরও তার সফরনামা কারো না কারো নামে উৎসর্গ করবেন। কিতাবটি হাতে আসার পর দেখলাম যথারীতি তিনি তা উৎসর্গ করেছেন, তবে আমি অবাক হলাম এবং আত্মিক আনন্দ লাভ করলাম এটা দেখে যে, এ বরকতপূর্ণ কিতাবটির ছাওয়াব তিনি হাদিয়া করেছেন তাঁর বড় মেয়ের জন্য। তিনি লিখেছেন, ‘আমার বড় মেয়েকে, যে আমার জন্য বাইতুল্লাহর যিয়ারাতের সৌভাগ্য নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিলো বলে আমি বিশ্বাস করি। ...’

অবাক হয়েছি এজন্য যে, বিশেষ করে আমাদের ইলমী মহলে এটি অভাবিতপূর্ব একটি কাজ। আর আনন্দ লাভ করেছি এজন্য যে, এর দ্বারা তিনি আমাদের সামনে চিন্তা-ফিকিরের একন নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। বস্তুত এই ‘কালিমাতুল ইহদা’ হচ্ছে সুপ্রাজ্ঞ লেখকের সুগভীর অন্তর্জ্ঞান, অনুকরণীয় পিতৃত্ব ও মমত্বের অনুপম প্রকাশ এবং শোকরগুযারি ও ‘হকশিনাসি’-এর আদর্শনমুনা।

যেহেতু বড় মেয়ের জন্মগ্রহণের পরপর আল্লাহ তাঁকে যিয়ারাতে বাইতুল্লাহ নছীব করেছেন সেহেতু এটিকে তিনি ‘কন্যাভাগ্য’ বলে গ্রহণ করেছেন, তবে পরম দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে এটিকে তিনি নিজের ধারণা ও বিশ্বাসের পরিমণ্ডলে সীমাবদ্ধ রেখেছেন, কারণ গায়বের ইলম তো একমাত্র আল্লাহর কাছে। শরীয়তের পরিভাষায় এটাকে ‘তাফাউল’ বা নেক ফাল বলে, যার বৈধতা দলীল দ্বারা প্রমাণিত।

আইয়ামে জাহিলিয়াতে আরবদেশে (আসলে শুধু আরবদেশে নয়, বরং সারা পৃথিবীতে) কন্যাসন্তানের কী করুণ অবস্থা ছিলো, তা আমরা সবাই জানি, তবে অনেকেই যা জানি না তা এই যে, ইসলাম কন্যাসন্তানকে কী অধিকার ও মর্যাদা দান করেছে। যারা জানি তারাও নিজেদের জীবনে খুব কমই তা পালন করি। তাই তো বর্তমান যুগেও অমুসলিম সমাজের মত মুসলিম সমাজেও কন্যাসন্তান বিভিন্নভাবে চরম নিগ্রহ, লাঞ্ছনা ও বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকে। এমনকি যদি সত্য কথা বলার অনুমতি দেয়া হয় তাহলে বলতে হবে যে, আহলে ইলমও- সম্মানজনক ব্যতিক্রম বাদে- এবিষয়ে সমাজের সামনে দ্বীন ও শরীয়াতের শিক্ষা ও আদর্শ পুরোপুরি তুলে ধরতে ব্যর্থ হচ্ছেন। অথচ আমরা জানি, এই উম্মতের পেয়ারা নবী বিভিন্ন হাদীছে কন্যসন্তানকে মুহব্বতের সঙ্গে উত্তম প্রতিপালনের ক্ষেত্রে কী মহাপুরস্কারের খোশখবরি দান করেছেন! কন্যাসন্তানকে তিনি মাতা-পিতা ও জাহান্নামের মাঝে আড়াল সাব্বস্ত করেছেন।

‘কালিমাতুল ইহদা’ পড়ে আমার মনে হয়েছে, প্রাজ্ঞ লেখক একদিকে যেমন আদর্শ পিতারূপে কন্যাসন্তানের প্রতি অন্তরের মমত্ব প্রকাশ করেছেন তেমনি অন্যদিকে আমাদের সামনে উপরে বর্ণিত আবেগ ও জাযবা এবং চিন্তা ও চেতনা তুলে ধরেছেন। আর এটাই আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছে দিন-রাতের শত ব্যস্ততার মাঝেও কিছু কথা আরয করতে। আল্লাহ যেন কবুল করেন, আমীন।

যেহেতু এখন এমনকি মুসলমানদের সমাজেও নারী-উন্নয়ন ও নারী-অধিকাররের শোরগোল জোরেশোরে চলছে, সেহেতু এই সুযোগে সফরনামার আলোকে কিছু কথা পেশ করা মুনাসিব মনে হচ্ছে।

পুরুষজাতি হচ্ছে আল্লাহর বান্দা, আর নারীজাতি হচ্ছে আল্লাহর বান্দী। উভয় জাতির খালিক ও মালিক হচ্ছেন আল্লাহ তা‘আলা। নরী ও পুরুষকে ভিন্নরূপে সৃষ্টি করার হিকমত ও রহস্য তিনিই শুধু জানেন এবং তিনিই শুধু উভয়ের দায়-দায়িত্ব এবং হক ও অধিকার নির্ধারণ করে দিতে পারেন। সুতরাং আল-ইসলাম নামে তিনি যে চিরন্তন দ্বীন ও শরী‘আত নাযিল করেছেন সেখানেই শুধু পাওয়া যেতে পারে নারীর প্রকৃত অধিকার ও মর্যাদা, আর সুন্নাতে নববীতে রয়েছে সেই শিক্ষার বাস্তব ও পূর্ণাঙ্গ নমুনা। কিন্তু আফসোস, দ্বীন ও শরী‘আত এবং সুন্নাতে নবী সম্পর্কে বে-খবর মুসলমানরা আজ অন্যদের শ্লোগানে বিভ্রান্ত হয়ে নারী-অধিকার ও নারী-উন্নয়ন তালাশ করছে অন্যজাতি, অন্যসভ্যতা ও অন্যমতবাদের কাছে। এভাবে নারী হচ্ছে আরো লাঞ্ছিত, বঞ্চিত ও প্রতারিত। স্বাধীনতা, মুক্তি ও প্রগতির নামে তাদের উপর চালানো হচ্ছে আরো বেশী যুলুম, আরো বেশী অত্যাচার। অন্যদিকে যাদের কাছে রয়েছে দ্বীন ও শরী‘আতের এই নেয়ামত তাদের অধিকাংশ উদাসীনতা ও অবহেলার কারণে নারীজাতিকে তাদের সেই সব মর্যাদা ও অধিকার প্রদান থেকে বহু দূরে সরে আছে, যা ইসলাম ও শরী‘আতে মুহম্মদীর মূল উদ্দেশ্যের অন্তর্ভুক্ত।

আলহামদু লিল্লাহ, এই সফরনামার অসংখ্য কল্যাণ ও উপকারিতার মাঝে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কল্যাণ ও ফায়দা এই যে, লেখক বিভিন্ন ঘটনা এবং বিভিন্ন উপলক্ষকে আশ্রয় করে নারীজাতির বিভিন্ন শ্রেণী সম্পর্কে ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শ তুলে ধরেছেন, খুবই সূক্ষ্মভাবে, তবে অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী ও মর্মস্পর্শীরূপে। যদি হৃদয় ও মস্তিষ্ক একত্র করে তা পড়া হয় এবং যথাযোগ্য ফায়দা হাছিল করার নিয়তে পড়া হয় তাহলে মা-বোন ও স্ত্রী-কন্যা সকলরূপেই নারীজাতির মর্যাদা ও অধিকার এবং হুকূক ও আদাব সম্পর্কে ইসলামের সঠিক শিক্ষার ছহীহ ইলম হাছিল হবে এবং দৈনন্দিন জীবনে সেগুলো বাস্তবায়নের নেক জাযবা দিলের মধ্যে পয়দা হবে, ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তা‘আলা আমাকে এবং প্রত্যেক পাঠককে যেন এই সৌভাগ্য দান করেন, আমীন।

পরিশেষে উপরে যে আলোচনা করা হলো সে আলোকে সফরনামা থেকে কিছু উদ্ধৃতি এখানে তুলে ধরা উপকারী হবে বলে আমি মনে করি। আমার ইচ্ছা আছে, শিক্ষামূলক বিভিন্ন জরুরী বিষয়ের শিরোনামে সফরনামা থেকে একটি সংকলন আগামী কোন এক ফুরসতে পেশ করবো ইনশাআল্লাহ।

উদ্ধৃতিসমূহ