শিশু-কিশোর ও নবীনদের পত্রিকা

মাসিক আল-কলম-পুষ্প

যিলক্বদ ১৪৩০হিঃ (১৪) | রোযনামচার পাতা

এক দিনের ভ্রমণে

লিখেছেনঃ আব্দুল্লাহ আলমামূন

কঙবাজার সমুদ্রসৈকত হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার কুদরতের অন্যতম নিদর্শন। দেশ-বিদেশের কত মানুষ আসে সমুদ্রসৈকতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে! আমারও বহু দিনের স্বপ্ন কঙবাজার সমুদ্রসৈকত দেখার, কিন্তু বিভিন্ন কারণে তা হয়ে উঠেনি। এবার হঠাৎ করেই এসে গেলো সুবর্ণ সুযোগ। খুব ভোরে আমরা চার বন্ধু রওয়ানা হলাম। আমাদের মনে তখন কী অপরিসীম আনন্দ তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়!

ইচ্ছে ছিলো গাড়ীর জানালা দিয়ে দু'চোখ ভরে দেখবো প্রকৃতির সৌন্দর্য, কিন্তু গাড়ীর দোলুনিতে কখন ঘুমিয়ে পড়লাম বুঝতে পারিনি। কিছুক্ষণ পর জেগে একটি বিল দেখতে পেলাম। একপাশে সাদা কাশবন। বিশাল এলাকা জুড়ে জলাশয় এবং জলজ উদ্ভিদ। জায়াগায় জায়গায় মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হোগলা বন। এখানে সেখানে শাপলা, কলমিলতা ও পদ্মফুল। আবার গলাডোবা ধানক্ষেত। সবমিলিয়ে অপূর্ব এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য! আল্লাহর সৃষ্টি কত সুন্দর!একসময় আমরা সাগরপারে পৌঁছে গেলাম। সাগরের প্রবল বাতাস এবং উত্তাল ঢেউ যেন আমাদের স্বাগত জানালো। সাগরের বিশালতা দেখে আমি অভিভূত হলাম। মানুষের ক্ষুদ্রতা এবং তার শক্তির তুচছতা স্পষ্টভাবে অনুভব করতে পারলাম। উত্তাল ঢেউগুলো তীরে এসে আছড়ে পড়ছিলো। সাগরের ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য আসলে শব্দের পর্দায় প্রকাশের বিষয় নয়, হৃদয়ের পর্দায় উদ্ভাসের বিষয়। সুন্দরকে ভালোবাসে এবং সৌন্দর্যকে উপভোগ করে অনেকেই, কিন্তু ঘুমিয়ে থাকা সুন্দরকে জাগাতে পারে এবং লুকিয়ে থাকা সৌন্দর্যকে তুলে আনতে পারে ক’জন!

ছোট-বড় অনেকে সাঁতার কাটছে দেখে আমরাও নামলাম, প্রথমে হাঁটু পানি, তারপর কোমর পানি, তারপর...। ঢেউয়ের দোলায় অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো। সাগরকে মনে হলো অনেক আপন; আমার মাওলার সৃষ্টি! বড় বড় ঢেউয়ের মাঝে একঘণ্টার মত সাঁতার কাটলাম। তারপর উঠে এসে বাতাসে কাপড় শুকালাম। এখন বিদায়ের পালা, কিন্তু আমার যেতে মন চাচ্ছিলো না। সাগর যেন অল্প সময়ের মধ্যেই আমাকে আপন করে নিয়েছিলো।

এরপর আমরা যাত্রা করলাম সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে। বড় কোন জাহাজের পরিবর্তে আমরা উঠলাম স্পিডবোটে। বড় রোমাঞ্চকর হলো আমাদের সাগরযাত্রা। ভয় যে করছিলো না তা নয়, তবে ভয়মিশ্রিত আনন্দটা ভোলার মত নয়! ঢেউয়ের সঙ্গে অনেক উপরে যায়, আবার ঢেউয়ের সঙ্গে নেমে আসে; মনে হয় এই বুঝি উল্টে যাবে। অনেক তাড়াতাড়ি পৌঁছে গেলাম সেন্টমার্টিন দ্বীপে। চারদিকে সীমাহীন সমুদ্র, মাঝখানে ছোট্ট এই সবুজ দ্বীপ। সাগরের গর্জন, আর বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়ায ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। সাগরের মাঝে এত সুন্দর একটি দ্বীপ আছে আমাদের! ভাবতেই খুব গর্ব হলো। মানুষগুলোকে মনে হলো খুব সহজ-সরল। নগরজনপদ থেকে দূরে সাগরের কোলে যারা প্রতিপালিত তারা সহজ-সরল তো হবেই!

অল্প সময়ে ঘুরে ঘুরে দ্বীপটাকে যদ্দুর সম্ভব দেখলাম এবং অভিভূত হলাম। গাছে গাছে অনেক পাখী। একটা পাখী ডাকছিলো বড় করুণ সুরে। বহু দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছিলো তার দুঃখী করুণ সুর। কূক! কূক! কূক! যেন নিজের মনে দুঃখ ছড়িয়ে দিচ্ছে চারপাশের প্রকৃতিতে। অনেক্ষণ পাখীটার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আশ্চর্য সুন্দর ও মর্মস্পর্শী একটি তাল-লয়-ছন্দ ছিলো পাখীটার ডাকে। হয়ত পাখীটি ডাকছিলো ওর হারিয়ে যাওয়া সঙ্গিনীকে! বিদায় তো নিতেই হবে, কিন্তু মনে হলো বিমুগ্ধ হৃদয়কে এখানে এই সাগরঘেরা সবুজ দ্বীপেই রেখে যেতে হবে। জাহাজে করে ফিরলাম। মাঝ সমুদ্রে সূর্যাস্তের দুর্লভ দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হলো। যেন অনেক দুঃখ-বেদনা নিয়ে ধীরে ধীরে সাগরের পানিতে ডুবে গেলো ক্লান্ত-শ্রান্ত ও বিষণ্ন সূর্যটা, আমাদেরও মনটা ডুবে গেলো বিষণ্নতার সাগরে।

রাত আটার দিকে আমরা বাড়ীতে ফিরে এলাম। বহু বছর পরো আমার মনে আজকের এই সাগরভ্রমণের আনন্দঘন দিনটি।