শিশু-কিশোর ও নবীনদের পত্রিকা

মাসিক আল-কলম-পুষ্প

মুহররম ১৪৩২ হি: (১৮) | প্রথম পাতা

সম্পাদকীয়: আমার কায়া, আমার ছায়া

 

 

আমি কায়া, না ছায়া? ছায়া হলে কে আমার কায়া? যদি কায়া হই তাহলে কোথায় আমার ছায়া? এ জিজ্ঞাসা আমার বহু দিনের; এ জিজ্ঞাসা আমার ভিতরের, আমার হৃদয়ের, আত্মার। এ জিজ্ঞাসা জটিল, তবে অনিবার্য এবং অপরিহার্য এর জবাব। কারণ এ জিজ্ঞাসাই হলো জীবনের পথ, আর জবাব হলো পথের মঞ্জিল। আমাকে তো চলতে হবে জীবনের পথে এবং যত দীর্ঘ ও দুর্গম হোক পথ, আমাকে পৌঁছতে হবে জীবনের মঞ্জিলে, পৌঁছতেই হবে। জীবনের বড় দুর্ভাগ্য এই যে, আমরা যখন আত্মজিজ্ঞাসার সম্মুখীন হই, বিভিন্ন অজুহাতে তা এড়িয়ে যাই এবং নিজেকে সরিয়ে রাখি কাজের ছলে ও ব্যস্ততার ছলনায়। আমাদের চারপাশে আছে অনেক মায়া ও মায়াজাল। ভুলে, কিংবা ভুল করে আমরা জড়িয়ে থাকি সংসারের মায়ায় এবং জীবনের মায়াজালে। আমাদের মনে পড়ে না, কিংবা আমরা মনে করতে চাই না যে, আমার কাছে আমার হৃদয়ের একটি প্রশ্ন ছিলো; আমার কাছে আমার আত্মার একটি জিজ্ঞাসা ছিলো। অথচ এই অত্মজিজ্ঞাসার নির্ভুল উত্তর সন্ধানের মধ্যেই রয়েছে জীবনের মুক্তি এবং জীবন থেকে মুক্তির উপায়।

এ ভুল আমিও করেছিলাম। সংসারের মায়া ও জীবনের মায়াজালে আমিও ভুলে ছিলাম। এভাবে পথের অন্ধকারেই হয়ত শেষ হতো জীবন এবং শুরু হতো নতুন জীবন। কিন্তু আকাশের দয়া হলো; আকাশ থেকে করুণার শিশির ঝরলো। ভুলের ঘোর থেকে আমি জেগে উঠলাম এবং হৃদয়ের ব্যাকুলতা ও আত্মার আকুলতা নিয়ে আমি জানতে চাইলাম, কে আমি?! কায়া, না ছায়া? ছায়া হলে কে আমার কায়া? কায়া হলে কোথায় আমার ছায়া?

কিতাবের ছোহবতে কত নির্ঘুম রাত কেটেছে আমার! কিন্তু খুঁজে পাইনি এ জিজ্ঞাসার জবাব। যে জিজ্ঞাসার উৎস মস্তিষ্ক, তার উত্তর তুমি পাবে কিতাবের পাতায়। কিন্তু এ জিজ্ঞাসা তো মস্তিষ্কের নয়; এ জিজ্ঞাসা তো হৃদয় ও আত্মার।

কলমের সান্নিধ্যে কত সন্ধ্যা ভোর হয়েছে আমার! কিন্তু খুঁজে পাইনি এ জিজ্ঞাসার জবাব। যে জিজ্ঞাসার জন্ম বুদ্ধি ও যুক্তির কোলে, তার উত্তর তুমি পাবে কাগজ-কলমের কাছে। কিন্তু এ জিজ্ঞাসা তো বুদ্ধি ও যুক্তির নয়; এ জিজ্ঞাসা তো হৃদয়ের আবেগের এবং আত্মার আকুতির।

এ জিজ্ঞাসার জবাব আমি জানতে চেয়েছি জনপদের কোলাহল ও মরুভূমির নির্জনতার কাছে; বনের গভীরতা ও পর্বতের গম্ভীরতার কাছে; নদীর ঢেউ ও সাগরের তলদেশের কাছে; আমি জানতে চেয়েছি বাগানে ফুল ও সবুজ পাতার কাছে, কোকিল ও বুলবুলির কাছে; রিমঝিম বৃষ্টি ও শিশিরবিন্দুর কাছে; আমি জানতে চেয়েছি সন্ধ্যার জোনাকি ও প্রভাতসূর্যের কাছে, জোসনা রাতে চাঁদের কাছে, আঁধার রাতে ঝিলমিল তারাদের কাছে; আমি জানতে চেয়েছি রহস্যঘেরা এই সুন্দর প্রকৃতির কাছে। কিন্তু খুঁজে পাইনি আমার জিজ্ঞাসার জবাব। যে জিজ্ঞাসা জাগে স্বপ্নের প্রত্যাশা  ও স্বপ্নভঙ্গের বেদনা থেকে তার উত্তর তুমি পাবে প্রকৃতির শব্দ ও নৈশব্দের কাছে। কিন্তু আমার জিজ্ঞাসা তো ছিলো না কোন স্বপ্নের প্রত্যাশা, কিংবা স্বপ্নভঙ্গের বেদনার জন্য; এ জিজ্ঞাসা তো ছিলো আমার অস্তিত্বের জন্য, আমার অতীত ও ভবিষ্যতের জন্য; এ জিজ্ঞাসা তো ছিলো পরম সত্তার কাছে নিজেকে অর্পণ করার জন্য।

একদিন বাবার কবরের সামনে আমার হৃদয়ের আকুতি ও আত্মার মিনতি যখন ... ঠিক তখন যেন অদৃশ্যের একটি আলোকবার্তা পেলাম, ‘কোথাও পাবে না তুমি তোমার জিজ্ঞাসার জবাব, পাবে শুধু কোন কবরের কাছে। কারণ তুমি, তোমার কায়া, তোমার ছায়া, কবরই সবার ঠিকানা।

কিন্তু হায়, জীবনের মায়াজালে সারা জীবন আমরা যা ভুলে থাকি তারই নাম হলো মুত্যু ও কবর! আমার বাবার মৃত্যু আমি দেখেছি, দেখেছি তার কবর। হয়ত আমার সন্তান দেখবে আমার মৃত্যু এবং দেখবে আমার কবর, তারপর... তবু আমরা ভুলে থাকি মৃত্যুর কথা, কবরের কথা। কারণ আমি জানি না, কে আমি? কে আমার কায়া? কে আমার ছায়া! কায়া ও ছায়া! ছায়া ও কায়া! কায়া ও ছায়ার রহস্যঘেরা এ জীবনের মায়া ও মায়াজালে আর কতদিন, হে বন্ধু আর কত দিন!