আরাকান সংখ্যা (৩/১)

বানানের জলসা

বানানের জলসায় ইতিহাস

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অনেক দিন পর বানানের জলসা বসেছে। সবাই আশা করেছিলো, তাদের প্রিয় সভাপতি সাহেব আজ হাসিখুশি থাকবেন। হেসে হেসে কথা বলবেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বলবেন, অনেক দিন পর দেখা হলো। কেমন ছিলে তোমরা এতদিন?! একটু যেন বড় হয়ে গেছো সবাই? নিজেকে তো দেখতে পাই না! বলো দেখি, আমিও কি বড় হয়েছি?! কোথায়! কিছুই তো হলো না! না একটু হাসি, না একটু আদর!! না একটু মাথায় হাত বুলানো! আর থাক, একটা কানমলাও তো না!! কেমন গম্ভীর মুখে বসে আছেন! জানতে ইচ্ছে করছে, কী হয়েছে তাদের প্রিয় সভাপতি হুযুরের! কিন্তু সাহস করে জিজ্ঞাসা করবেটা কে?! জিজ্ঞাসা আর করতে হলো না। কিছুক্ষণ পর নিজেই বললেন, তোমরা মনে হয় অবাক হচ্ছো, এমন চুপচাপ বসে আছি কেন?! একসঙ্গে ঃ জ্বি হুযুর, জ্বি!! সভাপতি ঃ আসল ঘটনা হলো, আব্বু পাঠিয়েছিলেন আরাকানী মুসলমানদের খেদমতের জন্য। আরাকানের মুসলমানদের বলে রোহিঙ্গা। তো রোহিঙ্গা মুসলমানদের যে ভীষণ কষ্টের অবস্থা দেখে এসেছি, তাতে মনটা আর ভালো নেই রে! মুসলিমা ঃ আরাকান দেশটা কোথায় হুযূর? সভাপতি ঃ আচ্ছা, কিছু জানো না তাহলে আরাকানের খবর?! সবাই একসঙ্গে ঃ না হুযূর, জানবো কীভাবে আপনি না জানালে? সভাপতি ঃ আজ তাহলে বানানের জলসা থাক। চলো আজ তোমাদের আরাকানের ইতিহাস বলি। রোহিঙ্গা মুসলমানদের দুঃখ-কষ্টের
কাহিনী শোনাই। সবাই খুশী হয়ে সভাপতি সাহেবের কাছে এসে বসলো। সভাপতি ঃ আগে মানচিত্রটা তোমাদের বোঝাই। এই যে দেখো, বাংলাদেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। আর এই যে নদীটা, এর নাম হলো নাফনদী। আমাদের যেমন কর্ণফুিল নদী। তো নাফনদীর ওপারে হলো মিয়ানমার, আর এপারে হলো বাংলাদেশ। লম্বালম্বি নদীটাই হলো দুই দেশের সীমান্ত। মাঝখানটা হলো সীমান্তরেখা। রফীক ঃ মিয়ানমার নামটা তো হুযূর কখনো শুনিনি! সভাপতি ঃ হাঁ, মিয়ানমার নামটা ওরা নতুন রেখেছে। আগের নাম ছিলো বার্মা। রফীক ঃ তাই! বার্মা নামটা তো অনেক শুনেছি। সভাপতি ঃ তো শোনো, ঐ যে বললাম নাফনদীর কথা! সেই নাফনদী পার হয়ে যে বিশাল ভূখ- তার নাম হলো আরাকান। আরাকান একসময় ছিলো াস্বধীন দেশ। বহু বছর মুসলমানদেরও রাজত্ব ছিলো সেখানে। পরে সেটা বার্মার দখলে চলে যায়। আরাকানে শত শত বছর ধরে রোহিঙ্গা মুসলমানরা বাস করে আসছে। মাসুম ঃ হুযূর, ভূখ- মানে কি, আর বানান কী? সভাপতি (বিরক্ত হতে গিয়েও হলেন না) ঃ বললেন, ভূ-তে দীর্ঘঊ, মানে হলো জমি, ভূমি। আর খ--এর বানান হলো, ণ+ ড, মিলে হয়েছে -। খ- মানে টুকরো। তো ভূখ- মানে হলো একটুকরো জমি বা ভূমি। ভূ, আর খ- লিখতে হবে কিন্তু একসঙ্গে! নতুন শব্দের বানান আর অর্থ জানতে পেরে সবাই খুশী। সভাপতি ঃ (আবার বলতে শুরু করলেন ) বার্মা বা মিয়ানমার দেশটা বেশ বড়। বাংলাদেশের চারগুণ! পুরো দেশটাকে ছয়টি প্রদেশে ভাগ করা হয়েছে। তার মধ্যে একটা প্রদেশ হলো আরাকান। তবে এখানে একটা কথা। সবাই একসঙ্গে ঃ কী কথা হুযূর? সভাপতি ঃ আরাকান হলো পুরোনো নাম। এখন বার্মার লোকেরা নতুন নাম রেখেছে রাখাইন। সুফিয়া (অবাক হয়ে) ঃ কেন? নাম পরিবর্তন করে কী লাভ?! সভাপতি ঃ লাভ কিছুই না। ঐ নামটা মুসলমানদের রাখা নাম তো, তাই বার্মার লোকদের এ নাম পছন্দ না। তাই তারা নিজেদের পছন্দমত নাম রেখেছে। মারূফা ঃ তাহলে তো রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রতি বার্মার লোকদের অনেক হিংসা, অনেক বিদ্বেষ!! সভাপতি ঃ নয়ত কী! ওরা তো রোহিঙ্গা মুসলমানদের আরাকানে থাকতেই দেবে না। জ্বালাও পোড়াও করে আরাকানের মাটি থেকে উচ্ছেদ করে বাংলাদেশের দিকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। দেখো না, মাত্র দু’তিন মাসের মধ্যে ছয়লাখেরও বেশী রোহিঙ্গা মুসলিম নাফনদী পার হয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। হানিফ ঃ আহারে! কী যালেম বার্মার মানুষেরা! মারূফা ঃ যালেম মানে। এমন যারা করতে পারে তারা কি মানুষ?! তারা তো আস্ত জানোয়ার! তাসলীমা ঃ হুযূর, রোহিঙ্গারা কি বার্মার নাগরিক নয়?! সভাপতি ঃ কেন নয়! আমরা যেমন শত শত বছর ধরে এদেশে বাস করি, তাই আমরা বাংলাদেশের নাগরিক। তেমনি রোহিঙ্গারা শত শত বছর ধরে আরাকানে বাস করে। সুতরাং অবশ্যই তারা বার্মার নাগরিক। নাফীসা ঃ তাহলে কী বলে বার্মার লোকেরা রোহিঙ্গাদের তাড়াতে চায় দেশ থেকে? সভাপতি (একটু থেমে, কী যেন চিন্তা করে) ঃ একসময় কিন্তু বার্মার লোকেরাও ীস্বকার করতো যে, রোহিঙ্গারা বার্মার নাগরিক। তারপর হঠাৎ করে বলা শুরু করলো, তোমরা বাঙ্গালী, বাংলাদেশ থেকে এসে আমাদের
. জমি দখল করেছো। তোমাদের বাংলাদেশে ফিরে যেতে হবে। মাসূমা ঃ বড় যুলুেমর কথা! পৃথিবীতে এত মানুষ, এত দেশ! কেউ কি কিছু বলে না বার্মার দুষ্ট শাসকদের?! সভাপতি ঃ এখানেই তো দুঃখ! মুসলমানদের কষ্ট কেউ বুঝতে চায় না। ভারত, চীন, রাশিয়া, এত বড় বড় দেশ! বলে কী, বার্মা যা করছে ঠিকই করছে! মাসূমা ঃ হুযূর আরাকানে কী শুধু রোহিঙ্গারাই বাস করে? সভাপতি ঃ না, আরাকানে বৌদ্ধধর্মের লোকেরাও বাস করে। একসময় তাদের সংখ্যা ছিলো অল্প। মুসলিম রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ছিলো বেশী। প্রায় আশিভাগ। মুহসিনা ঃ তারপর কী হলো? সভাপতি ঃ রোহিঙ্গাদের উপর শুরু হলো যুলমু নির্যাতন। শুরু হলো ভয়াবহ রকম জ্বালাও পোড়াও, আর উচ্ছেদ- বিতাড়ন। তো রোহিঙ্গারা কোন উপায় না পেয়ে বাধ্য হয়ে দেশ ত্যাগ করতে শুরু করে। তারা বিভিন্ন দেশে আশ্রয় গ্রহণ করে। বাংলাদেশ তো খুব কাছে! তাই বেশীর ভাগ রোহিঙ্গা বাংলাদেশেই আশ্রয় নেয়। মারূফা ঃ বার্মার জনসংখ্যা কত হুযূর?! সভাপতি ঃ ভালো প্রশ্ন করেছো! বার্মা বা মিয়ানমার দেশটা বিশাল। মোট আয়তন সাড়ে ছয়লাখ বর্গকিলোমিটারেরও বেশী। আর জনসংখ্যা ছয়কোটির কিছু উপরে। অথচ দেখো, বাংলাদেশের আয়তন মাত্র এক লাখ ছাপ্পান্ন হাজার বর্গকিলোমিটার। অথচ জনসংখ্যা হলো সতের কোটি। হানিফ (অবাক হয়ে) ঃ বার্মা তাহলে এত বড় দেশ, মানুষ এত কম! তাহলে বার্মার সমস্যা কী, রোহিঙ্গারা যদি আরাকানে বাস করে? সভাপতি ঃ রোহিঙ্গারা হলো মুসলিম। আর মুসলমানদের ওরা সহ্যই করতে পারে না। মুহসিনা ঃ রোহিঙ্গারা আরাকানে কোত্থেকে এলো? কীভাবে এলো? সভাপতি ঃ খুব ভালো প্রশ্ন করেছো! আজ থেকে প্রায় দু’হাজার বছর আগে আরাকানের এক রাজা চট্টগ্রাম জয় করে আরাকানের মধ্যে শামিল করে নেয়। তখন বিভিন্ন উপলক্ষে চট্টগ্রাম থেকে বহু মানুষ আরাকানে গিয়ে বাস করেছে। আবার আরাকানেরও বহু মানুষ চট্টগ্রামে এসে বাস করেছে। এভাবে চলেছে বহু শত বছর। তারপর নরমিখলা নামে আরাকানের এক রাজা শত্রুদের দ্বারা পরাজিত হয়ে বাংলাদেশের মুসলিম শাসকের কাছে আশ্রয় নেন। মুসলিমা ঃ বাংলাদেশের শাসকের নাম কী? আর এটা কত বছর আগের ঘটনা? সভাপতি ঃ নামটা তো ঠিক মত মনে পড়ছে না। সম্ভবত গিয়াছুদ্দীন এবং তারপরে ছিলেন জালালুদ্দীন। ১৪৩০ খৃস্টাব্দের ঘটনা। তো যা বলছিলাম। মুসলিম শাসক বিতাড়িত রাজার প্রতি সদয় হয়ে ত্রিশহাজার সৈন্য দিয়ে তাকে সাহায্য করেন। সেই সৈন্য নিয়ে নরমিখলা আরাকান- রাজ্য উদ্ধার করেন। বলা হয় বাংলার শাসকের আচরণে মুগ্ধ হয়ে নরমিখলা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। নাফীসা ঃ ঐ যে ত্রিশহাজার সৈন্য, তাদের কী হলো। সভাপতি ঃ রাজা নরমিখলা নিজের রাজ্যের রক্ষার জন্য তাদেরকে আরাকানে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন। এভাবেই আরাকানে জন্ম হয়েছে রোহিঙ্গা নামে একটি আলাদা জনগোষ্ঠীর। শফীক ঃ হুযূর, শুনেছি, দশলাখেরও বেশী রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এত মানুষের থাকা খাওয়া কীভাবে হচ্ছে?! সভাপতি ঃ রোহিঙ্গারা তো আমাদের মুসলমান ভাই, সেহেতু তাদের সাহায্য করা তো আমাদের ঈমানী দায়িত্ব। বাংলাদেশের মানুষ সে দায়িত্ব সুন্দর ভাবেই পালন করছে। নাফীস ঃ হুযূর! আজকের মজলিসে কত কিছু জানা হলো! আমরা তো ভেবেছি, আপনি শুধু বানান জানেন! এখন দেখি আপনি ইতিহাসও জানেন। আসলে আপনি বিদ্যার জাহায। সভাপতি ঃ আবার বুঝি দুষ্টুিম ...

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা