আল কুদসসংখ্যা (৩/২)

আল কুদসসংখ্যা (বিশেষ)

ইয়াসির আরাফাত!

একটি নক্ষত্রের উদয় ও পতন!! হিরো থেকে জিরো!

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

ফিলিস্তীনের এক বিশাল জাতীয় ব্যক্তিত্ব, যার আলোচনা ছাড়া ফিলিস্তীনের মুক্তিসংগ্রামের  গৌরবময় ইতিহাস লেখা হতে পারে না এবং  লেখা হতে পারে না আত্মসমর্পণের লজ্জার ইতহাস!!

পৃথিবীর কোন জাতির ইতিহাসে এমন স্তরে এমন ব্যক্তি আর আছেন কি না আমাদের জানা নেই যার জীবনের একটা অংশ সূর্যের আলোর মত উজ্জ্বল! যেখানে আমরা দেখতে পাই সিংহের মত নির্ভীক একটি হৃদয়, যার কণ্ঠে শুনতে পাই আহত সিংহের গর্জন!! যার প্রতিটি বক্তব্য উদ্যম-উদ্দীপনা, প্রেরণা ও প্রাণচাঞ্চল্যে পরিপূর্ণ!! যার প্রতিটি পদক্ষেপে দৃঢ় প্রত্যয়, প্রতিটি উদ্যোগে গভীর আত্মপ্রত্যয়!! যিনি প্রতিটি দিন এবং প্রতিটি রাত যাপন করেছেন মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে, তবে মৃত্যুভয় থেকে মুক্ত হয়ে!!

ফিলিস্তীনের শিশু-নারী-পুরুষ প্রতিটি মানুষ যাকে ভালোবেসেছে প্রাণের চেয়ে বেশী, যার একটি মাত্র ইশারায় প্রাণ দিতে প্রস্তুত ফিলিস্তীনের শত শত তরুণ, এবং অসংখ্য আরব মুজাহিদীন।

হঠাৎ তার জীবনে এলো এমন দুঃখজনক পরিবর্তন যা হয়ে থাকলো কোন বিরাট মানুষের জীবনের বিরাট বিস্ময়!! তার জাতি হলো শোকাহত ও স্তব্ধ!! চিরকালের নির্ভীক মানুষটি এমন ভীরুতার পরিচয় দিলেন যা বিশ্বাস করা কঠিন! যে কণ্ঠে বিশ্ব ও মুসলিমবিশ্ব শুনেছে আহত সিংহের গর্জন সে কণ্ঠে এখন ...!! যিনি ছিলেন মৃত্যুভয় থেকে মুক্ত তিনি হয়ে পড়লেন মৃত্যুভয়ে বিচলিত!! যিনি ছিলেন শত্রুর জন্য মূর্তিমান ত্রাস, তিনি হলেন শত্রুর ভয়ে ভীত-কম্পিত!! শত দুর্যোগের আঁধার রাতেও জাতির জন্য যিনি ছিলেন আশার প্রতীক, তিনি হয়ে গেলেন জাতির জন্য অন্ধকার ভবিষ্যতের অশুভ ছায়া!!

এমন মানুষ স্বাভাবিক কারণেই হওয়ার কথা ছিলো সারা জাতির ঘৃণার পাত্র, হওয়ার কথা ছিলো মুসলিমবিশ্বের ধিক্কারের পাত্র, কিন্তু তা হয়নি। এত কিছুর পরো জাতির একটা অংশ তাকে সমর্থন করেছে, আর বিরাট একটা অংশ তার নীতি ও পদক্ষেপ প্রত্যাখ্যান করেছে, কিন্তু ঘৃণা করেনি। এমনকি বিশ্বাসভঙ্গের অভিযোগও উত্থাপন করেনি! ভেবেছে ‘নক্ষত্রের পতন’, কিন্তু কখনো ভাবেনি ‘নক্ষত্রের অধঃপতন’!! মুসলিমবিশ্ব তাকে স্মরণ করতো শ্রদ্ধার সঙ্গে; এতকিছুর পরো এখন তাকে স্মরণ করে করুণার সঙ্গে!!

ইনি ফিলিস্তীনের জাতীয় নেতা জনাব ইয়াসির আরাফাত! আপন জাতির ইতিহাসের পাতায় এবং তাদের হৃদয়ের অঙ্গনে আজো তিনি জীবিত এবং জীবন্ত যুগপৎ গৌরব ও বেদনার সঙ্গে। মুসলিম বিশ্ব আজো তাকে স্মরণ করে শ্রদ্ধা ও করুণার মিশ্র অনুভূতির সঙ্গে।

***

অধিকাংশ বড় মানুষের ক্ষেত্রে যা হয়, তার ক্ষেত্রেও হয়েছে। সুনিদির্ষ্টভাবে তার জন্মস্থান ও জন্মতারিখ বলা যাচ্ছে না।   কেউ গরজ করে তা মনে রাখেনি। লিখে রাখা  তো পরের কথা। কারণ কারো জানা ছিলো না, আজকের এই সাধারণ ঘরের সাধারণ শিশুটি একদিন হয়ে ওঠবে এমন অসাধারণ যে, লক্ষ লক্ষ মানুষ ভালোবেসে শ্রদ্ধাভরে জানতে চাইবে তার জন্মস্থান এবং জন্মতারিখ! তবে পারিপার্শ্বিক সব বষিয় বিবেচনা করে প্রায় নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, ১৯২৯ সালের ২৪শে আগস্ট কায়রোতে তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন। তার বাবা ছিলেন আলকুদ্সের বাসিন্দা। সেখান  থেকে হিজরত করতে হয়েছে কায়রোয়। তিনি খুব সাধারণ ব্যবসার মাধ্যমে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করতেন। মোটামুটি চলে  যেতো। তিনি ১৯২৭ সালে বাইতুল মাকদিস থেকে হিজরত করে কায়রো শহরে আসেন এবং সাকাকীন মহল্লায় বসত গড়ে তুলেন। ইয়াসির আরাফাত ছিলেন বাবার ষষ্ঠ পুত্র।

চার বছর বয়সে তিনি মাকে হারান। ‘মাকে হারান’ কথাটা আরাফাতের জীবনে মোটেই রূপক ছিলো না। সবদিক  থেকেই ছিলো বাস্তব। তার মা ছিলেন এমনই মমতাময়ী এবং এমনই ব্যক্তিত্ববতী যে, ঐ বয়সেই আরাফাত তার মায়ের মমতা এবং ব্যক্তিত্বের দ্যুতি অনুভব করতে পেরেছিলেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মাকে তিনি ভুলতে পারেননি। মা না  থেকেও  যেন তার জীবনের অনেকখানি জুড়ে ছিলেন। জীবনের শেষভাগে যদি তার বিচ্যুতি না ঘটতো তাহলে সঠিক অর্থেই বলা যেতো, মা তার জীবনের সবটুকুই জুড়ে ছিলেন।

মাকে যখন মনে পড়তো, তিনি কাঁদতেন না। কান্নাকে তার মনে হতো অনেক বড় দুর্বলতা। আর স্বভাবের দিক থেকেই তিনি ছিলেন এমন যে, কোন বিষয়ে দুর্বলতা প্রকাশ করা ছিলো তার একদম না-পছন্দ। তাই মায়ের কথা মনে হলে যখন কান্না পেতো তখন তিনি নিজের কান্না গোপন করে ফিলিস্তীনের ঐ সব শিশুকে ডেকে সান্ত¦না দিতেন যারা মাকে বাবাকে, কিংবা বাবা-মা উভয়কে হারিয়েছে। শৈশবে যারা তার কাছে সান্ত¦না পেয়েছে তাদের অনেকেই পরবর্তী জীবনে ছিলেন বিপ্লবের পথে তার নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। এমনকি দু’একজন পরিবর্তিত জীবনেও তার সঙ্গ ত্যাগ করেননি।

মায়ের ইনতিকালের পর পিতা তাকে অজ্ঞাত কারণে আলকুদ্সে পাঠিয়ে দেন। সেখানে তিনি ১৯৩৬-এর বিপ্লবের ঘটনাপ্রবাহ খুব নিকট  থেকে দেখার সুযোগ লাভ করেন। এরই উপর তার চেতনা গড়ে ওঠে। এই বিপ্লবী চেতনাই পরবর্তী জীবনে তার জন্য দিকনির্দেশক হয়েছিলো।

প্রবীণবয়স পর্যন্ত তিনি বিবাহ করেননি। এ বিষয়ে পশ্নের সম্মুখীন হলে তিনি বলতেন, ‘আমি তো ফিলিস্তীনের মুক্তিসংগ্রামকে বিবাহ করেছি। আবার বিবাহ করার সুযোগ কোথায়! কিন্তু পরে যখন তিনি খৃস্টানধর্মের  মেয়ে সোহা-এর সান্নিধ্যে আসেন তখন তার নতুন উপলব্ধি হয় যে, শুধু মুক্তিসংগ্রাম -কে ‘বিবাহ’ করা যথেষ্ট নয়। সোহার গর্ভে তার একটি

কন্যাসন্তান জন্মগ্রহণ করেছিলো। অনেকের ধারণা, আরাফাতের জীবনে সোহার আগমন একটি দুষ্ট গ্রহের মতই ছিলো। তিনিই আরাফাতকে শেষপর্যন্ত একথা বুঝাতে সক্ষম হন যে, সশস্ত্র সংগ্রামের পরিবর্তে শান্তি ও সমঝোতার পথে চলাই এখন সময়ের দাবী। সশস্ত্র সংগ্রাম এ পর্যন্ত মৃত্যু ও নৃশংসতা এবং ধ্বংস ও বিনাশ ছাড়া আর কিছু দিতে পারেনি। শান্তি-সমঝোতার মাধ্যমে মুক্তি ও স্বাধীনতার যে লক্ষ্য, অন্তত তার কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব। আর  সেটা সম্ভব হলে পূর্ণ স্বাধীনতার গন্তব্যে উপনীত হওয়া কঠিন হবে না। আরাফাতের জীবনের এ অংশে স্ত্রী সোহার উপস্থিতি এতই প্রবল ছিলো যে, বহুবছর আগে মৃত্যু-বরণকারী মায়ের উপস্থিতি তিনি আর মনে রাখতে পারেননি।

পড়াশোনা ও বেড়ে ওঠা

১৯৩৭ সালে ইয়াসির আরাফাত কায়রোয় বাবার কাছে ফিরে আসেন এবং বাদশাহ ফুয়াদ বিশ্ববিদ্যালয়ে (বর্তমান কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন।  সেখানে তিনি সিভিল ইনজিনিয়ারিং-এ উচ্চতর অধ্যয়ন করেন। ১৯৫১ সালে তিনি ঐ বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করে বের হন। এই পুরো সময় তিনি লেখাপড়ায় ব্যস্ত থাকলেও ফিলিস্তীনের রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর, বিশেষ করে আপন পূর্বপুুরুষের হাজার বছরের বাস্তুভিটা  থেকে ব্যাপকহারে ফিলিস্তীনিদের উচ্ছেদ এবং ইহুদিদের বিপুল

অনুপ্রবেশ, এসবের উপর তার সজাগ দৃষ্টি ছিলো। ছাত্রাবস্থায়ও তিনি তার অবস্থান থেকে  পিতৃভূমির সেবায় সাধ্যমত কাজ করে যাচ্ছিলেন। তিনি তার কাজের প্লাটফর্মরূপে (প্রাক্তন) ফিলিস্তীনী ছাত্রপরিষদ গঠন করেন। তখন থেকেই তিনি ও তার সংগঠন মিশরীয় গণমাধ্যমে যথেষ্ট আলোড়ন সৃষ্টি করে। শুরু থেকেই তিনি কথার চেয়ে কাজে  বিশ্বাসী ছিলেন এবং ফিলিস্তীনের পবিত্র ভূমিতে ইহুদী আগ্রাসনের প্রতিরোধে অস্ত্রধারণের ডাক দিচ্ছিলেন। তার এ বিপ্লবী ভূমিকা ছিলো তখন সরকার ও জনগণ উভয় পর্যায়ে আরব-সেন্টিমেন্টের সম্পূর্ণ অনুকূল।

মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুন-নাছের তখন আরব-জাতীয়তাবাদের ডাক দিয়ে আরববিশ্বের অবিসংবাদিত নেতা ও জাতীয় বীরের মর্যাদায় বরিত হয়েছেন। ঐ সময় (১৯৫৬ সাল) তিনি সুয়েজকে জাতীয়করণের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন, যা ইঙ্গ-ফরাসী স্বার্থের উপর ছিলো প্রচ- আঘাত। ফলে বৃটিশ, ফরাসী ও ইসরাইলী বাহিনী সম্মিলিতভাবে মিশরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

এই সময়টা ইয়াসির আরাফাতের ভবিষ্যত ভাবমর্যাদা গড়ে তোলার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। তিনি মিশরীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ফিলিস্তীনী ছাত্রদের একটি সশস্ত্র ব্রিগেড গঠন করেন এবং মিশরীয় বাহিনীর পাশাপাশি যুদ্ধে প্রশংসনীয় ভূমিকা রাখেন। এভাবে তিনি বিশেষ করে ফিলিস্তীনী জনগণের এবং সাধারণভাবে আরব জনগণের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেন।

ফিলিস্তীনের মুক্তিসংগ্রাম তখন পর্যন্ত বিভিন্ন মত ও পথের দল-উপদলগুলোর বিচ্ছিন্ন তৎপরতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। দল-উপদলগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের বড় অভাব ছিলো। ফলে মুক্তিসংগ্রামে প্রত্যাশিত গতি সৃষ্টি হচ্ছিলো না। এ উদ্দেশ্যে (আড়ালের উদ্দেশ্য ছিলো ফিলিস্তীনী মুক্তিসংগ্রামেরে উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা)  প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুন-নাছেরের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৬৪ সালে সর্বদলীয় ফিলিস্তীন মুক্তিসংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ইয়াসির আরাফাত তখন জামাল আব্দুন-নাছেরের প্রিয়ভাজন হিসাবে ফিলিস্তীন মুক্তিসংগ্রাম পরিষদ গঠনের পিছনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

১৯৬৯ সাল ছিলো আরববিশ্ব ও মুসলিমবিশ্বের জন্য অগ্নিগর্ভ বছর। ঐ বছর অষ্ট্রিয়া থেকে আগত এক ইহুদী সন্ত্রাসী মসজিদুল আকছায় অগ্নিসংযোগ করে। তাতে সমগ্র ফিলিস্তীন ভূখ-সহ, আরববিশ্ব ও মুসলিম বিশ্বে  ক্রোধের আগুন জ্বলে ওঠে।  ঐ বছরই সশস্ত্র বিপ্লবের প্রবক্তারূপে তিনি ফিলিস্তীন মুক্তিসংস্থা (পি,এল,ও)-এর কার্যকরী পরিষদের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। মূলত তিনি ছিলেন তার নিজস্ব মুক্তিসংস্থা ‘ফাতহ’-এর প্রধান। ফাতাহকে তিনি ফিলিস্তীন মুক্তিসংস্থায় একীভূত করে পুরো সংস্থার একচ্ছত্র নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হন। এখান থেকেই মূলত তার জীবনে নতুন এক অধ্যায় শুরু হয়, বিপ্লবী অধ্যায়।

আরাফাতের চিন্তাধারা

যদিও বলা হয়, শুরুতে আরাফাত ইখওয়ানের ঘনিষ্ঠ ছিলেন, তবে সত্য এই যে, ফিলিস্তীন সম্পর্কে ইয়াসির আরাফাতের চিন্তাচেতনা কখনো ইসলামকেন্দ্রিক ছিলো না, ছিলো সম্পূর্ণরূপে আরবজাতীয়তাবাদ-কেন্দ্রিক। তবে প্রতিপক্ষও এটা স্বীকার করে করে যে, তার জাতীয়তাবাদ সারা জীবন জাতিকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে, ব্যক্তিস্বার্থ বা ব্যক্তিচিন্তাকে কেন্দ্র করে নয়।

ইয়াসির আরাফাত ছিলেন জাতীয়তাবাদের ঐ প্রজন্মের সন্তান যারা আত্মপ্রকাশ করেছে পঞ্চাশের দশকে। মূলত ষাট ও সত্তরের দশকে তারা ফিলিস্তীনের মুক্তিসংগ্রামে নিজেদের মত করে বিরাট ভূমিকা রেখেছেন। তখন তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিলো ইহুদিবাদী সন্ত্রাসিদের দখল  থেকে ফিলিস্তীনের পিতৃভূমিকে উদ্ধার করা এবং বিভিন্ন দেশে আশ্রয়গ্রহণ করা শরণার্থিদের তাদের পূর্বপুরুষের হাজার বছরের ভিটেমাটিতে ফিরিয়ে আনা এবং সমগ্র ফিলিস্তীন-ভূখ-ে স্বাধীন সার্বভোৗম ফিলিস্তীনরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।

ঐ প্রজন্মের জাতীয়তাবাদী শক্তির বিশ্বাস ছিলো, সশস্ত্র সংগ্রামই হলো ফিলিস্তীনের ভূমি  থেকে অবৈধ দখলদারদের নির্মূল করা এবং স্বাধীন ফিলিস্তীনরাষ্ট্র-গঠনের একমাত্র পথ।

রাজনৈতিক ও সামরিক কর্মতৎপরতা

ইয়াসির আরাফাত ১৯৫৮ সালে কুয়েত গমন করেন। সেখানে কয়েকবছর তার ব্যয় হয় ফিলিস্তীনী তরুণদের সংগঠিত করা এবং সশস্ত্র সংগ্রামের জাতীয়তাবাদী চিন্তাচেতনায় উদ্বুদ্ধ করার কাজে। অবশেষে ১৯৬৫ সালে কুয়েতের মাটিতেই  তিনি এবং তার শৈশবের বন্ধু আবুজিহাদ ‘ফাতাহ’ নামে একটি বিপ্লবী সেল গঠন করেন।

এ প্রসঙ্গে বলা হয়, আরাফাত ও তার জাতীয়তাবাদী অনুসারীরা বলতেন, ‘ফাতাহ’ হচ্ছে তাদের সংগঠনের মূল নাম

حركة تحرير فلسطين

এর উল্টো দিক থেকে প্রতিটি শব্দের প্রথম হরফের সমন্বয়ে গঠিত শব্দ। তাতে শব্দ হিসাবে তার অর্থ দাঁড়ায় ‘বিজয়’।

ফাতাহ-এর পতাকাতলে যে সকল ইসলামপন্থী নেতা শরীক ছিলেন তাদের দাবী ছিলো,  কোরআনের বিপ্লবী সূরা ‘আলফাত্হ’-এর আয়াত

إنا فتحنا لك فتحا مبينا এর ফাতহ শব্দটিকে নামের উৎসরূপে ঘোষণা করা হোক। কিন্তু ইয়াসির আরাফাত ও তার অনুসারিদের জাতীয়তাবাদী চিন্তা এরকম ধর্মীয় ধ্যানধারণা গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলো না।

ইসলামপন্থী নেতৃবৃন্দ অবশ্য ঐক্যের স্বার্থে এ বিষয়ে আর অগ্রসর না হয়ে নীরবতা অবলম্বন করাই সঙ্গত ভেবেছেন।

ফাতাহ-এর মুখপত্ররূপে একটি সাময়িকী প্রকাশ করা হয় ‘ফিলিস্তীনুনা’ (আমাদের ফিলিস্তীন) নামে, যার উদ্দেশ্য ছিলো ফিলিস্তীনী ও আরব তরুণদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চিন্তাচেতনার প্রচার প্রসার এবং সশস্ত্র সংগ্রামের প্রতি তাদের উদ্বুদ্ধ করা।

ঐ সাময়িকীতে যা কিছু লেখা হতো তার ভিত্তি ছিলো নিছক জাতীয়তাবাদ। ফিলিস্তীনের ভূখ-ে ইসলামই যে মূলশক্তি, পবিত্র আলকুদ্স ও মসজিদুল আকছাই যে মুসলিম তরুণদের মধ্যে জিহাদের জোশ ও আবেগ সৃষ্টির মূল প্রেরণা সেটা তারা ভাবতেন না। অন্তত জাতীয়তাবাদ ও ইসলাম উভয়ের সমন্বয়ের চিন্তাও তাদের মধ্যে ছিলো না।

এদিকে অবাক করার বিষয় ছিলো এই যে, জাতীয়তাবাদের সঙ্গে লেনীন ও চেগুয়েভারা  থেকে প্রেরণা সংগ্রহ করার চিন্তাটি তারা দিব্বি গ্রহণ করে নিয়েছিলেন!

শুরু থেকেই ইয়াসির আরাফাত সচেষ্ট ছিলেন তার বিপ্লবী সেল ফাতাহ যেন প্রথমে আরববিশ্বে, তারপর সারা বিশ্বে ফিলিস্তীনি-দের একমাত্র বৈধ সংগঠনরূপে স্বীকৃতি লাভ করে। প্রথমে তিনি আরব জাতীয়তা-বাদী নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং যথেষ্ট সফলতা অর্জন করেন। ১৯৫৬ সালেই আলজিরিয়ায় ফাতাহর প্রথম দফতর খোলা হয় এবং সেখান থেকে শুরু হয় আরাফাতের কূটনৈতিক ও সামরিক তৎপরতা।

১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে সম্মিলিত আরববাহিনীর লজ্জাজনক পরাজয়ের পর ইয়াসির আরাফাত জর্দান সীমান্ত  থেকে ইসরাইলের ভিতরে এমন দুঃসাহসিক কিছু সশস্ত্র অভিযান পরিচালনা করেন, যার সুবাদে তিনি আরব ও মুসলিমবিশ্বে আলোচনা ও খ্যাতি-বন্দনার শীর্ষে উঠে আসেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় তার ও তার কর্মতৎপরতার প্রতি। তখন থেকে ইসরাইল প্রকাশ্যে এবং আমেরিকা পর্দার আড়ালে হয়ে ওঠে তার জানিদুশমন।

১৯৬৮ সালে মিশরের  প্রেসিডেন্ট যিনি আরব-ইসরাইল যুদ্ধে পরাজিত নায়করূপে তখন ভগ্ন ভাবমর্যাদার শিকারÑ ইয়াসির আরাফাতকে ফিলিস্তীনী জনগণের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি বলে স্বীকৃতি প্রদান করেন।

আরফাতের জীবনে বিপর্যয়ের

শুরু

১৯৭০ সালে এক দুঃখজনক দুর্ঘটনায় ফিলিস্তীন মুক্তিসংগ্রাম হঠাৎ করেই যেন মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। জর্দানেও শুরু হয় জাতীয়তাবাদী চিন্তা। এটাই ছিলো স্বাভাবিক। ফিলিস্তীন যদি মুসলিম উম্মাহর অংশ হয়েও আত্মশক্তির উৎসরূপে ইসলামকে বাদ দিয়ে জাতীয়তাবাদের চিন্তা করতে পারে তাহলে জর্দানও জাতীয়বাদের চিন্তায় আক্রান্ত হতে পারবে না কেন?  ভৌগোলিক বিভক্তির মাধ্যমে যদি ছোট ছোট আরবদেশ হতে পারে তাহলে আরবজাতীয়তাবাদ  বিভক্ত হয়ে ছোট ছোট আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠবে না কেন?!

বাস্তব-অবাস্তব কিছু কারণে জর্দানের বাদাশাহসালামাতের মনে হলো, ইয়াসির আরাফাত এবং ফাতাহ-এর কর্মকা- জর্দানের স্বার্থকে মারাত্মকভাবে ক্ষুণœ করছে। ফলে কালবিলম্ব না করে ইহুদিদের হাতে পারাজিত ও পর্যুদস্ত জর্দানবাহিনী ফাতাহর প্রতিরোধবাহিনীর বিরুদ্ধে রীতি -মত যুদ্ধে নেমে পড়লো। শুরু হয়ে গেলো ভ্রাতৃঘাতী লড়াই। উভয়পক্ষে প্রচুর হতাহত হলো।

এর পর আর কী?! বিনা যুদ্ধে ইসরাইলের শত্রুশক্তি বিধ্বস্ত! ইহুদীমহলে উল্লাস হবে না  কেন?!

সবকিছু শেষ হওয়ার পর শুরু হলো আরবমধ্যস্ততা। সিদ্ধান্ত হলো, ফিলিস্তীনী প্রতিরোধ-বাহিনী ও তার নেতা আরাফাত আপাতত লেবাননে আশ্রয় গ্রহণ করবেন। বস্তুত তখন থেকেই ফাতাহ বা ফিলিস্তীনী মুক্তি সংস্থার প্রতিরোধ কার্যক্রম প্রায় শূন্যের কোঠায়  নেমে আসে। এমনকি তাদের সংগ্রামী চেতনা ও লড়াকু মনোভাবও নিস্তেজ হয়ে যায়।

এদিকে সম্মিলিত আরব কূটনীতির মাধ্যমে এবং ইসরাইল ও তার মুরুব্বি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উৎসাহে ফিলিস্তীন মুক্তি সংস্থাকে ফিলিস্তীনের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধিরূপে জাতিসঙ্ঘে পর্যবেক্ষকের মর্যাদা দান করা হয়। আর তাতেই আরাফাত মনে করতে শুরু করেন, সশস্ত্র সংগ্রামের চেয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা অধিক কার্যকর।

১৯৭৪-এর ১৩ই নভেম্বর ফিলিস্তীন মুক্তিসংস্থার প্রধান হিসাবে ইয়াসির আরাফাত জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেন। ঐ ভাষণের মূল বক্তব্য ছিলো ফিলিস্তীনসমস্যা পৃথিবীর অন্যান্য জনগোষ্ঠীর ন্যায্য সমস্যাবলীর একটি, যারা সাম্রাজ্যবাদের হাতে নিপীড়নের শিকার হচ্ছে।

১৯৮৮ সালের নভেম্বরে ফিলিস্তীন জাতীয় পরিষদ ফিলিস্তীনের ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক অধিকারের ভিত্তিতে ফিলিস্তীনের ভূমিতে ফিলিস্তীন-রাষ্ট্রগঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, যার রাজধানী হবে পবিত্র আলকুদস। একই সঙ্গে আলজিরিয়ায় অন্তর্বর্তীকালীন ফিলিস্তীনসরকার গঠনেরও  ঘোষণা দেয়া হয়।

ইসরাইলের প্রতি স্বীকৃতি

মোটামুটি আশির দশকের শেষ দিকে বিভিন্ন ঘাতপ্রতিঘাত ও নাটকীয় ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে ফিলিস্তীনী মুক্তিসংস্থার চিন্তাধারায় মৌলিক পরিবর্তন শুরু হয়। তারা সশস্ত্র সংগ্রাম ও প্রতিরোধ যুদ্ধের ঘোষিত নীতি  থেকে সরে আসে এবং আলোচনা ও কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যা সমাধানের নীতি গ্রহণ করে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইয়াসির আরাফাতের এই নীতিপরিবর্তনকে স্বাগত জানায়।

১৯৮৮ সালের ডিসেম্বরে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের আরেকটি ভাষণে তিনি ফিলিস্তীন মুক্তিসংস্থার পক্ষ হতে ইসরাইলের প্রতি স্বীকৃতি ঘোষণা করে বলেন, আমরা স্বীকার করি, পৃথিবীর মানচিত্রে ইসরাইলের টিকে থাকার অধিকার রয়েছে। তিনি শান্তিপ্রক্রিয়া শুরুর ঘোষণা দিয়ে বলেন, ফিলিস্তীন ও ্ইসরাইলসহ মধ্যপ্রাচ্যের সকল দেশের অধিকার রয়েছে শান্তিতে বসবাস করার।

এভাবে ইয়াসির আরাফাত নিজেরই হাতে নিজের অতীতের দীর্ঘ ও গৌরবময় সংগ্রামী জীবনের উপর ছুরি চালিয়ে দেন। সম্ভবত জীবনের প্রতি, ভবিষ্যতের প্রতি হতাশা থেকেই তিনি এটা করেছেন। হয়ত তিনি ভেবেছেন, লড়াই করে যা পারা যায়নি, ইসরাইলের অস্তিত্ব মুছে  ফেলে সমগ্র ফিলিস্তীনভূখ-ের উপর স্বাধীন সার্বভৌম ফিলিস্তীনরাষ্ট্র গঠন করা, এবার  দেখা যাক, আত্মসমর্পণের লজ্জা বরণ করে হলেও তার অর্ধেক পাওয়া যায় কি না, ফিলিস্তীনের কিছু অংশের উপর ফিলিস্তীনরাষ্ট্র গঠন করা!

১৯৮৯ সালের এপ্রীল মাসে ফিলিস্তীন কেন্দ্রীয় পরিষদ ইয়াসির আরাফাতকে স্বতন্ত্র ফিলিস্তীন রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে। আর আরাফাত ১৯৯০ এর শুরুতে শান্তিপ্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়ার ঘোষণা দিয়ে বলেন, এ বিষয়ে তিনি ইসরাইলী নেতাদের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছেন।

১৯৯৪ সালে কায়রোতে ইয়াসির আরাফাত এবং ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী আইজেক রবিন গাযা ও আরিহা অঞ্চলে ফিলিস্তীনী স্বায়ত্ত্বশাসন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে চুক্তি সম্পন্ন করেন, যা কায়রো চুক্তি নামে পরিচিত।

সবকিছু হারিয়ে ইয়াসির আরাফাত যা অর্জন করলেন তা হলো ইসরাইলের সম্মতিক্রমে ২৭ বছরের নির্বাসিত জীবন শেষে ১৯৯৪ জুন মাসে তথাকথিত ‘ফিলিস্তীন জাতীয় কর্তৃপক্ষ’-এর প্রেসিডেন্টরূপে গাযায় প্রত্যাবর্তন।

এরপর একদিকে চলতে থাকে ইয়াসির আরাফাতের একতরফা শান্তিপ্রচেষ্টা, অন্যদিকে চলতে থাকে ইসরাইলি সরকার ও তার প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ হতে হঠকারিতা ও অবিমৃষ্যকারিতামূলক কর্মকা-, যার একটি হলো, নতুন নতুন শর্ত ও চাহিদা উত্থাপন। একটা শেষ না হতেই আরেকটা! সবচে’ বড় চাহিদা হলো, ফিলিস্তীনের শান্তিবিরোধী প্রতিরোধশক্তির নির্মূলপ্রক্রিয়া আরো জোরদার করা।

একই গতিতে চলতে থাকে ইহুদী উপনিবেশ গড়ার কর্মযজ্ঞ।

অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় ক্যাম্পডেভিড শান্তিআলোচনা। এরপর ২০০০ সালের জুনমাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিলক্লিন্টনের পৃষ্ঠপোষকতায় ক্যাম্পডেভিডে ইয়াসির আরাফাত এবং ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী এহুদা ব্যারাকের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিলো, ঝুলন্ত বিষয়গুলোতে কোন সমাধানে উপনীত হওয়া, যেমন আলকুদসপ্রসঙ্গ, ইহুদী উপনিবেশপ্রসঙ্গ এবং শরণার্থিদের নিজ ভূমিতে ফিরে আসাপ্রসঙ্গ। দীর্ঘ দুই সপ্তাহ স্থায়ী বৈঠক কোন ফলাফল ছাড়াই শেষ হয়।

২০০১ সালের ৮ই জানুয়ারী ফিলিস্তীনী প্রধান ইয়াসির আরাফাত মার্কিন প্রস্তাবমালা প্রত্যাখ্যান করেন, যা প্রেসিডেন্ট বিলক্লিন্টন ফিলিস্তীনী ও ইসরাইলী উভয় পক্ষের সামনে উপস্থাপন করেছিলেন, যার মধ্যে ছিলো ফিলিস্তীনী শরণার্থিদের স্বদেশভূমিতে ফিরে আসার দাবী  পরিত্যাগ করা এবং আলকুদসকে উন্মুক্ত শহরে পরিণত করা যেখানে ইসারইল ও ফিলিস্তীন উভয়ের আলাদা রাজধানী প্রতিষ্ঠা করা হবে।

ইয়াসির আরাফাতের কাছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের সবচে’ বড় প্রত্যাশা ছিলো ফিলিস্তীনের প্রতিরোধশক্তি-গুলোকে দমন ও নির্মূল করা। একাজ তিনি যথাসাধ্য আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তা ইসরাইলের কাছে সন্তোষজনক ছিলো না। তাই ইয়াসির আরাফাতের প্রতি অসন্তোষ ক্রমেই বাড়তে থাকে। অবশেষে তা চরমে উপনীত হয় যখন আরাফাত ২০০২সালে দ্বিতীয় ইন্তিফাদার প্রতি সমর্থন ঘোষণা করেন। আসলে ‘দিকভ্রান্ত’ আরাফাতেরও ধৈর্যচ্যুতি ঘটেছিলো। মনেপ্রাণে তিনি ছিলেন ফিলিস্তীনী জনগণের নেতা। তাকে কিনা প্রস্তাব দেয়া হচ্ছে ফিলিস্তীনী শরণার্থিদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দাবী থেকে সরে আসার! তিনি তো দাহলান ছিলেন না, এমনকি ছিলেন না মাহমূদ আব্বাস!! তাই তিনি তার ক্রোধ প্রকাশ করার উপলক্ষরূপে দ্বিতীয় ইনতিফাদাকে বেছে নিয়েছিলেন।

২০০১-এর সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয় ইন্তিফাদার বিস্ফোরণ ঘটে যখন এরিয়েল শ্যারোন পরিদর্শনের নামে মসজিদুল আকছায় অনুপ্রবেশ করেন। এমনিতেই সাধারণ ফিলিস্তীনিদের মধ্যে শান্তি আলোচনা ও শান্তিচুক্তি সম্পর্কে চরম হতাশা ও ক্ষোভ বিরাজ করছিলো। কারণ না তাদের ফিলিস্তীনরাষ্ট্রের স্বপ্ন পূর্ণ হচ্ছিলো, না অধিকৃত ভূমির একইঞ্চিও পুনরুদ্ধার, আর না শরণার্থিদের নিজ ভূমিতে ফিরে যাওয়ার কোন ব্যবস্থা। অথচ ফিলিস্তীনিদের বিসর্জন দিতে হয়েছে অনেক কিছু। অবৈধ ও দখলদার হওয়া সত্ত্বেও ইসরাইলরাষ্ট্রের অস্তিত্ব স্বীকার করে নিতে হয়েছে। অবস্থার বিচারে মনে হচ্ছিলো আরো অনেক কিছু তাদের বিসর্জন দিতে হবে, কোন বিনিময় ছাড়া। এসব কারণে এমনিতেই সর্বত্র বিরাজ করছিলো অব্যক্ত একটা ক্ষোভ, যদিও সবকিছু শান্ত ছিলো, কিন্তু  সেটা ঝড়পূর্ব থমথমে অবস্থা; কিংবা বলা যায় আগ্নেয়গিরির লাভা উদ্গীরণের আগের অবস্থা। এর মধ্যে এরিয়েল শ্যারোনের দাম্ভিকতাপূর্ণ আচরণ ছিলো আগুনে ঘী ঢালার চেয়েও ভয়াবহ কিছু।

ইয়াসির আরাফাত, জাতির প্রতি তার শুভকামনার ঘাটতি ছিলো না, এটা ঠিক। তাই তিনি ইন্তিফাদাকে কেন্দ্র করে বলা যায় আবার যেন আগের অবস্থানে ফিরে আসতে চাইলেন। কিন্তু শাব্দিক অর্থেই তখন তিনি জালে আটকা পড়া অসহায় সিংহ! ইন্তিফাদার প্রতি সমর্থন ঘোষণা করে না তিনি ইন্তিফাদার পক্ষে কিছু করতে পারলেন, আর না নিজের, এত বিসর্জনের বিনিময়ে অর্জিত নিরাপত্তাটুকু রক্ষা করতে পারলেন।

এত ঘটা করে যে ইহুদীবাদী চক্রের সঙ্গে তিনি শন্তিচুক্তি সম্পন্ন করলেন, ইসরাইলের যে দুই হায়েনার সঙ্গে মিলে তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার গ্রহণ করে ধন্য হলেন তারা তাকে তার তথাকথিত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের রাজধানী ‘রামাল্লায় দিনের পর দিন অবরুদ্ধ করে রাখলো। সবকিছু ছিলো প্রকাশ্যে। কোন রাখঢাক ছাড়া। শ্যরোন ঘোষণা করলেন, ‘ইসরাইলরাষ্ট্রটি এখন যুদ্ধাবস্থায় রয়েছে; সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। আর ফিলিস্তীনী কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট ইসরাইলের শত্রু, মুক্তবিশ্বের শত্রু। আরাফাত মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির প্রতিবন্ধক এবং সমগ্র অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য বিপদ।’

এবার বুঝুন অবস্থা! এটাকেই বুঝি বলে, না ঘরকা, না ঘাটকা।

আসল কথা হলো, ইসরাইল ও তার মুরুব্বি আমেরিকা ততদিনে  বুঝে গিয়েছে আরাফাতের স্বভাববৈশিষ্ট্য। তার কাছ থেকে তাদের আর কিছু পাওয়ার ছিলো না। তাছাড়া তার বিকল্প ততদিনে তাদের হাতে এসে গেছে; মাহমূদ আব্বাস, যিনি ইহুদিদের সেবায় বিবেক তো বিবেক, নিজের আস্তিত্ব পর্যন্ত বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত। ইসলামপন্থী প্রতিরোধযোদ্ধাদের প্রতি তার শুধু রাজনৈতিক আক্রোশই ছিলো না, ছিলো, নির্ভেজাল জাতআক্রোশ। সুতরাং তার মাধ্যমে সহজেই আপোশহীন ইসলামী প্রতিরোধশক্তিকে নির্মূল করা হবে অনেক সহজ। তাহলে আরাফাতকে এখন...!

তিনি দিনের পর দিন তার ‘প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে’ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে থাকলেন। ভূমি থেকে কামানের গোলা, আকাশ থেকে বিমানের বোমা, লাগাতার বর্ষিত হতে থাকলো, প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ হলো বিধ্বস্ত। জতিসঙ্ঘ মৌখিক নিন্দাটুকুও জানানোর গরজ বোধ করলো না। পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিলো, তাকে হত্যা করার সমস্ত আয়োজন চূড়ান্ত। তবু আল্লাহর এই বান্দা তার অবস্থানে অটল ছিলেন। শেষ পর্যন্ত রহস্যজনক অসুস্থতার মধ্যে তাকে ফ্রান্সের প্যারিস হাসপাতালে নেয়া হলো। তখন তিনি অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণজনিত কারণে অচেতন, গভীর কোমার পর্যায়ে।

পরিষ্কার ছিলো, এ অসুস্ততা গভীর কোন ষড়যন্ত্রেরই ফল, যার পিছনে ছিলো ইসরাইলের গোপন হাত। 

শেষপর্যন্ত ১১ই নভেম্বর ২০০৪ ইয়াসির আরাফাত মৃত্যুবরণ করেন। এভাবে একটি নক্ষত্র প্রবল দ্যুতি নিয়ে উদিত হয়ে মধ্যাকাশ থেকেই পতনের সম্মুখীন হলো।

আরাফাতের জীবন ও পরিণতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষ, জাতীয়তাবাদী ও ইসরাইল-ফিলিস্তীন শান্তিতে বিশ্বাসী নেতৃবৃন্দ যদি শিক্ষা নিতেন!

সব খেলোয়াড়ই তাদের খেলা খেলে যাচ্ছে, আর ইতিহাসও তার যাত্রা অব্যাহত রেখেছে। আমরা নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করি, একটি ‘কাফেলা’ সত্যের উপর অবিচল থাকবে। কেউ তাদের সঙ্গত্যাগ করে তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না।

তারা ইহুদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করবে শাম ও দামেস্কের আশেপাশে।

ইহুদীরা নির্মূল হয়ে যাবে, গাছ ও পাথারও তাদের আশ্রয় দেবে না।

এটা আমাদের প্রিয় নবীর ভবিষ্যদ্বাণী!

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট