শিশু-কিশোর ও নবীনদের পত্রিকা

মাসিক আল-কলম-পুষ্প

মুহররম.১৪৪০হিঃ (৩/৬) | হযরত আলী নাদাবীর পাতা

হযরত মাওলানা সৈয়দ আবুল হাসান আলী নাদাবী রহ-এর মধ্যপ্রাচ্যসফরের রোযনামচা

ডাক দিয়ে যায় মুসাফির!

যুবসমাজই মূল শক্তি তারপর আমি শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বললাম, পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যে কোন আদর্শ - হোক তা সত্যের পথে, কিংবা বাতিলের পথে- যে কোন আদর্শ ও বিপ্লব সফল হয়েছে, যুবশক্তির জীবন উৎসর্গ করার মাধ্যমেই হয়েছে।আধুনিক যুগের সবচে’ বড় বাতিল বিপ্লব ছিলো কমিউনিজমের। এ বিপ্লব সর্বোচ্চ সফলতা অর্জন করেছে ঐ সকল যুবকের ত্যাগ ও আত্মত্যাগের মাধ্যমে যারা কমিউনিজমের আদর্শ প্রচার প্রসারের পথে প্রাচুর্যময় জীবন এবং অর্থনৈতিক ভবিষ্যত অকাতরে বিসর্জন দিয়েছে। এমন অবিশ্বাস্য ঘটনাও ঘটেছে অনেক যে, অভিজাত ও বিত্তশালী পরিবারের সন্তান যার বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন ছিলো অত্যন্ত সম্ভাবনাপূর্ণ, যার সামনে ছিলো সফল জীবনের হাতছানি, যার পরিবার, মা-বাবা তাকে কেন্দ্র করে সুখের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে, হঠাৎ দেখা গেলো সে লা-পাত্তা! পরে জানা গেলো, শহরের চাকচিক্য থেকে বহু দূরে কোন অজপাড়া গাঁয়ে সে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছে তৃণমূল থেকে কমিউনিজমের আদর্শ সৈনিক গড়ার উদ্দেশ্যে।আমাদের উপমহাদেশে এমনো দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করে, মর্যাদাপূর্ণ চাকুরির মোহ উপেক্ষা করে পথে পথে কমিউনিজমের প্রচারপত্র ও বই-পত্রিকা বিতরণ করছে এবং উদাত্ত কণ্ঠে পথচারীদের কমিউনিজমের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে। হয়ত সহপাঠী, পরিচিত বা পরিবারের কারো সঙ্গে ঐ অবস্থায় দেখা হয়ে যায়, কিন্তু সে কোন সঙ্কোচ বোধ করে না, বরং সৌগরবে প্রচারকার্য চালিয়ে যায়।একসময় ভারতবর্ষের সব জেল ভরে গিয়েছিলো কমিউনিজমের আদর্শে নিবেদিত যুবকদের দ্বারা। তাতে তাদের দৃঢ়তা ও প্রতিজ্ঞায় কোন পার্থক্য হয়নি। এমনকি জেলখানার ভিতরেও তারা কমিউনিজমের প্রচারকার্য চালিয়ে গিয়েছে সমান উদ্যমে। কমিউনিজমের সূতিকাগার ও প্রাণকেন্দ্র রাশিয়ার যুবসমাজের ত্যাগ ও উৎসর্গের ঘটনা ছিলো আরো চমকপ্রদ, আরো অবিশ্বাস্য। হাঁ, সত্যি বিশ্বাসই হতে চায় না, যার সামনে পড়ে আছে, সম্ভাবনা-ময় ভবিষ্যত এবং প্রাচুর্যের জীবন সে কীভাবে প্রাণ উৎসর্গ করেছে হাসিমুখে জারের গুপ্তবাহিনীর নির্যাতনের মুখে। এমনকি ভালোবাসার পাত্রীর চোখের পানিও তাকে ফিরিয়ে রাখতে পারেনি আদর্শের পথ থেকে। এই যুবকদের যুবশক্তিকে আমি শ্রদ্ধা করি, কারণ মিথ্যাকে তারা সত্য ভেবে গ্রহণ করেছিলো এবং ধারণার সত্যের জন্য সর্বপ্রকার কষ্ট ও দুর্ভোগ বরণ করেছিলো।এবার আমি আপনাদের বলতে চাই; হক ও সত্যের পথে আদর্শ ও বিপ্লবের পতাকা ধারণ করা, এটাও যুবশক্তিরই কাজ। যুুগে যুগে আদর্শের পথে, বিপ্লব প্রতিষ্ঠার মহান উদ্দেশ্যে উম্মাহর যুবশক্তিই ত্যাগ ও আত্মত্যাগের তুলনাহীন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। এ প্রসঙ্গে আমি তাদের সামনে তুলে ধরলাম ঐ সকল ত্যাগ ও আত্মত্যাগের কিছু অমর কাহিনী যা জিহাদের জোশ ও জাযবা এবং শাহাদাতের আকুতি ও ব্যাকুলতায় ভারতবর্ষের মুসলিম যুবকরা তাদের বুকের রক্ত দ্বারা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য লিখে রেখে গিয়েছে। কখন? জিহাদ ও খিলাফাতের পতাকা বহনকারী মহান ইমাম সৈয়দ আহমদ বিন ইরফান শহীদযখন বিশাল ভারতের যুবসমাজকে বিপ্লব, জিহাদ ও খিলাফাত প্রতিষ্ঠার কাফেলায় শরীক হওয়ার দাওয়াত দিয়েছিলেন। কীভাবে ভারতবর্ষের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ছুটে গিয়েছিলো একেকজন যুবক, যাদের দেশ ছিলো ভিন্ন, ভাষা ও গোত্র ছিলো ভিন্ন, যাদের ঈমান ও কালিমা ছাড়া সবকিছু ছিলো ভিন্ন? ভারতের দূরদূরান্ত থেকে একেবারে উত্তর সীমান্তে আফগানিস্তানের দুর্গম অঞ্চলে তারা ছুটে গিয়েছিলো, আলোর দিকে পতঙ্গ যেমন ছুটে যায়। একজন যুবকও আর ফিরে আসেনি দেশের মাটিতে। শেষ পর্যন্ত তারা ইমামকে সঙ্গ দিয়েছেন এবং তার ‘দামান’ ধরে রেখেছেন। শাহাদাতের শেষ মুহূর্তেও তাদের চোখের তারায় ছিলো আনুগত্যের দ্যুতি ও কৃতজ্ঞতার প্রভা! হঠাৎ একদিন শোনা যেতো অমুক এলাকার অমুক ‘খাতা-পীতা ঘারানার’ টগবগে জোয়ান নিরুদ্দেশ! তারপর একদিন দেখা যেতো তাকে সুদূর আফগানিস্তানের মুজাহিদীনের কাফেলায়।নাম না জানা অসংখ্য যুবকের কাহিনী আর কীভাবে শোনাবো! শুধু শুনুন সৈয়দ মুসার জিহাদ ও  মোজাহাদার কাহিনী। মাত্র আঠারো বছর বয়সে যিনি দেশ-গোত্র, পরিবার ও মা-বাবার মায়া ত্যাগ করে ছুটে গিয়েছিলেন ইমাম ইরফানের ডাকে তাঁর জিহাদী কাফেলায়। মাহয়ার যুদ্ধে তিনি আহত হলেন। মাথার আঘাত থেকে এমনভাবে রক্ত ঝরতে লাগলো যে, মুখম-ল ও সারা শরীর খুনে লাল হয়ে উঠলো। অবস্থা দেখে সবাই তো অস্থির পেরেশান, কিন্তু কিশোর সৈয়দ মূসা পূর্ণ শান্ত সমাহিত, যেন তিনি মান্যিলের শীতল ছায়া দেখতে পেয়েছেন! তাঁর মুখে ছিলো প্রশান্তির হাসি, আর রাব্বে কারীমের প্রশংসা।এরপর আমি সংক্ষেপে যুবক আবু মুহাম্মাদের ঘটনাও শোনালাম, যা দিলের মধ্যে শুধু ঈমানের গরমিই পয়দা করে না, শাহাদাতের তড়পও জাগিয়ে তোলে।উদ্যম উদ্দীপনা ও যৌবনতরঙ্গে আন্দোলিত ইখওয়ানী যুবক ইউসুফ কারযাবী গভীর আগ্রহ ব্যক্ত করলেন ইমাম ইরফানের জিহাদী কাফেলায় শরীক মাওলানা ইয়াহয়া ও মাওলানা জা‘ফর থানেশ্বরী রহ.-এর ঈমানোদ্দীপক ঘটনা শোনার। আমিও ভিতরের উচ্ছলতায় প্রবাহিত হয়ে তাদের শোনালাম সেই দুই মুজাহিদ যুবকের ত্যাগ ও আত্মত্যাগ এবং আল্লাহর রাস্তায় কোরবানির জাযবাভরা কাহিনী।বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে হাযিরীনের উদ্দেশ্যে আমি বললাম, হকের দাওয়াত এবং সত্যের পথে বিপ্লব শুধু কথা দ্বারা, বা শুধু জোশ ও আবেগ দ্বারা কখনো হয় না। এর জন্য প্রয়োজন পরিপূর্ণ দ্বীনী, আখলাকী ও ইলমি তারবিয়াতের এবং প্রয়োজন আত্মিক ও আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধি অর্জনের। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, ইসলামী হুকূমাত ও খিলাফাত প্রতিষ্ঠার আন্দোলন বা জিহাদ আবেগ ও জাযবার শক্তি এবং বিশুদ্ধ জ্ঞান ও বুদ্ধির সুসমন্বয় ছাড়া কখনো সফল হতে পারে না এবং টিকে থাকতেও পারে না। উপরে যে তারবিয়াত ও আত্মশুদ্ধির কথা বললাম, তাতে যদি ত্রুটি থেকে যায় তাহলে তার পরিণতি ভবিষ্যতে বড় ব্যাপক ও গুরুতর আকারে প্রকাশ পায়। তখন তাকদীরের ফায়ছালার সম্মুখীন হওয়া ছাড়া ফিরে আসার সুযোগ থাকে না।আমার বক্তব্য প্রায় একঘণ্টা স্থায়ী হলো। তারপরো শ্রোতাদের পিপাসার যেন নিবারণ হলো না। আমারও যেন বিতরণ-তৃষ্ণা তৃপ্ত হলো না! তাই আমি বক্তব্য অব্যাহত রাখলাম।একপর্যায়ে তারা ভারতবর্ষে ইসলামী দাওয়াত ও আন্দোলনের পন্থা ও রূপরেখা সম্পর্কে জানতে চাইলেন। মিশরে চলমান দাওয়াতি মেহনতের প্রেক্ষাপটে এটা ছিলো অত্যন্ত সময়োপযোগী আবেদন। তাই সে আবেদনে সাড়া দিয়ে এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা করলাম। তাতে তারা অত্যন্ত আপ্লুত হলেন এবং মুগ্ধতা ও ঐকান্তিকতা প্রকাশ করলেন। আসলে বক্তা ও শ্রোতার মধ্যে আগে থেকেই অন্তরঙ্গতার সেতুবন্ধন তৈরী হয়ে ছিলো। কারণ তাদের অনেকেই আমার কিতাব মাযা খাসিরাল আলাম আগে থেকেই পড়েছেন এবং সুপ্রভাব গ্রহণ করেছেন।জলসা শেষে বড় ক্লান্ত শ্রান্ত অবস্থায় বেশ গভীর রাতে আমরা অবস্থানস্থলে ফিরে এলাম।২২/৪/৭০ হি. ১/২/৫১ খৃ. বৃহস্পতিআজ সকালে আমার দাওয়াতি রিসালা ‘বাইনাল আলাম ওয়া জাযীরাতিল আরাব’ (দুনিয়া ও জাযীরাতুল আরবের মধ্যে দায় ও দায়িত্বের বন্ধন)-এর ভূমিকা লিখলাম। তারপর ড. আহমদ আমীনের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে জীযা গেলাম। তিনি আমাদের অপেক্ষায় ছিলেন। বিভিন্নমুখী আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি আমাকে যোগবিদ্যা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। আমি বললাম, এটি ভারতবর্ষে বেশ ব্যাপক ও জনপ্রিয় একটি শাস্ত্র। যারা এর চর্চা করে, তারা এর মাধ্যমে শরীর ও স্বাস্থ্যের পরিপুষ্টির ক্ষেত্রে যথেষ্ট উৎকর্ষ অর্জন করে। বাকি রইলো আধ্যাত্মিকতা, তো বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় শরীরকে কষ্ট দেয়া, ঋপু ও প্রবৃত্তি দমন করা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তারা অতিপ্রাকৃতিক বিভিন্ন বিষয়ের প্রদর্শন করতে পারে। দীর্ঘ সময় ধরে নিজেদের তারা যাবতীয় স্বাদ-আনন্দ, চাহিদা ও খাহেশাত থেকে বঞ্চিত রাখার মাধ্যমে কিছু একটা শক্তি অর্জন করে, এতে কোন সন্দেহ নেই। আর আত্মিক শক্তি -প্রকার ও প্রকৃতিতে যেমনই হোক- যখন অর্জিত হয়, বিস্ময়কর কিছু প্রদর্শনের যোগ্যতা এসেই যায়। তবে তাদের এ যোগ্যতা ও কামাল আত্মিকতার আবরণে নিছক স্থূল বিষয়। আহলুল্লাহ ও আহলে দিল যারা তাঁদের কারামাত ও কামালাতের  মোকাবেলায় এগুলো ভেল্কি ও ভোজবাজির বেশী কিছু নয়, যার জন্য ধর্মীয় মর্যাদা আরোপ করা যায়। আল্লাহ তা‘আলা সুন্নাহ ও শরী‘আহর আনুগত্যের সম্পদ দান করার মাধ্যমে এ সব গৌণ বিষয় থেকেআমাদের নির্মুখাপেক্ষী করে দিয়েছেন। সুন্নাহ ও শারী‘আহর অনুসরণের পর আত্মিক উৎকর্ষ ও আধ্যাত্মিক মোক্ষ লাভের জন্য এগুলোর কোন প্রয়োজনই আর  থাকে না। একারণেই সুন্নাহর অনুসারী ছুফিয়া কেরাম আসল মনোযোগ ও সাধনা নিবদ্ধ রাখেন হৃদয় ও আত্মার পরিশুদ্ধি এবং দিল ও কলবের ইছলাহ ও ছাফাই হাছিল করার দিকে। প্রসঙ্গ যখন তাছাওউফ ও ছুফি তত্ত্বের দিকে অগ্রসর হলো তখন জানা গেলো, ড. আহমদ আমীন এ বিষয়ে কিছু সমঝ-বুঝ রাখেন এবং এ অঙ্গনে তার মোটামুটি বিচরণ রয়েছে। এমনকি জনৈক নকশবন্দী শায়খের নিকট তিনি কিছু সবক ও দীক্ষাও গ্রহণ করেছেন। আমি বললাম, কোন সন্দেহ নেই যে, এ সম্প্রদায়টির জ্ঞান ও অভিজ্ঞানে এমন কিছু যিকির, ওয়াযীফা ও মা‘মূলাত রয়েছে, কালবী সুকূন, আত্মিক প্রশান্তি ও আধ্যাত্মিক শক্তি লাভে যা সহায়ক হয়।জ্ঞানী ও অন্তর্জ্ঞানীর পার্থক্যড. আহমদ আমীন বললেন, এখন নাম মনে নেই, কোন এক কিতাবে পড়েছি, একবার সুপ্রসিদ্ধ বিজ্ঞানী ইবনে সীনার সঙ্গে সুপ্রসিদ্ধ বুযুর্গ শায়খ আবুল খায়র-এর সাক্ষাৎ হলো। তারা উভয়ে একসঙ্গে তিনটি দিন যাপন করলেন। পরে কেউ ইবনে সীনাকে শায়খ আবুল খায়রের মাকাম ও মরতবা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলো, আর তিনি বললেন, তাঁর উচ্চ মার্গীয়তা তো এমন যে, আমি যা জানি তিনি তা দেখেন (অর্থাৎ যে বিষয়ে আমার যুক্তিজ্ঞান সে বিষয়ে তাঁর রয়েছে দিব্যজ্ঞান।)একই ভাবে শায়খ আবুল খায়রকে জিজ্ঞাসা করা হলো ইবনে সীনা সম্পর্কে। তিনি বললেন, ইবনে সীনা যা জানেন, আমি তা দেখি। (অর্থাৎ যে বিষয়ে তাঁর জ্ঞান রয়েছে সে বিষয়ে আমার অন্তর্জ্ঞান রয়েছে।)পুরো বক্তব্য শুনে আমি বললাম, এ বিরাট সত্য ও রহস্যের প্রতি ইঙ্গিত করেই আল্লামা ইকবাল তাঁর কবিতাপঙ্ক্তিতে বলেছেন-র্সিরে দ্বীঁ, মাারাা খবর, ঊ রাা নযর/ ঊ দরূনে খাানা, মাা বায়রূনে খাানা।দ্বীনের রহস্য তো এই যে, আমার রয়েছে খবর, তার রয়েছে নযর। আমি ঘরের বাইরে, তিনি ঘরের ভিতরে।বহুত্ব থেকে একত্বে উত্তরণকথাপ্রসঙ্গে আমি বললাম, এই যে এত শাস্ত্রচর্চা ও জ্ঞানসাধনা, এর আসল উদ্দেশ্য কী? উদ্দেশ্য হলো বহুর ধাঁধা থেকে বের হয়ে এক-এর আলোতে প্রবেশ করা। এটাই মানুষের সর্বোচ্চ জ্ঞান ও সর্বোচ্চ নির্বাণ। কারো সামনে যখন এ সত্য উদ্ভাসিত হয় তখন সে চিন্তার বিক্ষিপ্ততা, জাগতিক ধাঁধায় উন্তি এবং উপায়-উপকরণের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি লাভ করে। এ পরম জ্ঞানের সাহায্যে সহজেই সে কার্যকারণ থেকে কার্যকারণের ¯্রষ্টার সমীপে উপনীত হতে পারে।আমার কথার সূত্র ধরে ড. আমীন বললেন, একবার আমি বন্ধুদের অন্তরঙ্গ আলাপচারিতার সময় বললাম, আকল ও বুদ্ধি এককভাবে জ্ঞানের উৎস নয়, বরং একই ভাবে কলব ও হৃদয়ও জ্ঞানের অন্যতম উৎস। কিন্তু কতিপয় বন্ধু এ মতের উপর অটল থাকলেন যে, আকল ও বুদ্ধিই হচ্ছে জ্ঞানের একক উৎস।ড. আমীনকে আমি বললাম, এ বিষয়ে শায়খ মুজাদ্দিদ আহমদ সারহিন্দী’র বড় সুন্দর বক্তব্য রয়েছে। তিনি আকল ও বুদ্ধির সীমাবদ্ধতার কথা বলতে গিয়ে একটা বড় নিগূঢ় তত্ত্বের উন্মোচন করেছেন, তাঁর মতে ‘এমন কিছুর অস্তিত্ব নেই যাকে বলা যায় ত্রুটিমুক্ত আকল (বা বুদ্ধি)। তদ্রপ কাশফ ও অন্তর্জ্ঞানও সর্বাংশে নির্ভুল নয়. বরং উভয়টি প্রভাবগ্রস্ত হয় কখনো বাহ্যজ্ঞান দ্বারা, স্বতঃসিদ্ধতা দ্বারা, আর কখনো অভ্যাস ও প্রবৃত্তি দ্বারা। অনেক সময় সত্য ও মিথ্যা এবং শুদ্ধ ও অশুদ্ধ এমন মিশে যায় যে, মানুষ তা বুঝেই উঠতে পারে না। ঠিক যেমন আয়নার মধ্যে অনেক কিছুই প্রতিবিম্বিত হয়।’জ্ঞান ও ইলমের নির্ভুল উৎসপ্রসঙ্গের বিস্তার ঘটিয়ে আমি বললাম, জ্ঞান ও ইলমের একমাত্র উৎস, পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসের সঙ্গে যাকে আমরা নির্ভুল ও বিশুদ্ধ বলে গ্রহণ করতে পারি তা হলো অহী বা ঐশী প্রত্যাদেশ যা আম্বিয়া কেরামের মাধ্যমে ঊর্ধ্ব জগত থেকে এসেছে।আশ্চর্যের বিষয়, প্রসিদ্ধ জার্মান দার্শনিক একই সিদ্ধান্তে  উপনীত হয়েছেন। তিনি তার আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থে বিমূর্ত বুদ্ধির অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন।***আমরা কায়রোর চিড়িয়াখানার ভিতরে পায়চারী করছিলাম, আবার প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে কথাও বলছিলাম। একসময় আমরা ‘টি-কর্ণারে’ পৌঁছলাম। ড. আমীন আমাদের জন্য দুপুরের খাবার ফরমায়েশ করলেন।আমরা লেকের পাড়ে ছাতার নীচে বসলাম। সেটা বড় উপভোগ্য সময় ছিলো। একদিকে স্বচ্ছ জলের উপর সন্তরণরত ঝাঁক ঝাঁক হাসের মনোরম দৃশ্য, অন্যদিকে ড. আমীনের তথ্যসমৃদ্ধ ও তত্ত্বপূর্ণ কথার অমৃত। উভয় স্বাদ ও সৌন্দর্যে আমি তখন বিভোর। একপর্যায়ে আহমদ আমীন স্বীকার করলেন, এতে কোন সন্দেহ নেই যে, তাছাওউফ ও আত্মশুদ্ধির মাধ্যমেই মানুষ আধুনিক বস্তু-সভ্যতার মোহ-মায়া থেকে বের হয়ে আসতে পারে এবং পারে এর সফল মোকাবেলা করতে।আফগানী ও আবদুহূ সম্পর্কে মন্তব্যতাছাওউফের প্রসঙ্গ ধরে বললাম, আমার মনে হয় সৈয়দ জামালুদ্দীন আফগানীর জীবনে তাছাওউফের কিছু ‘স্পর্শ’ ছিলো এবং তিনি ‘যিকরে কলবী’-এর আমল করতেন। ড. আমীন বললেন, আমি যদ্দুর জানি, শায়খ মুহম্মদ আব্দুহূর ক্ষেত্রেও এটা ঘটেছিলো। কারণ তারা উভয়ে অত্যন্ত বিষয়-নিস্পৃহ ও দুনিয়া-বিমুখ ছিলেন। মৃত্যুকালে তাঁরা উত্তরসূরীদের জন্য কিছুই রেখে যাননি।আমি জানতে চাইলাম, আপনি কি শায়খ মুহম্মদ আব্দুহূ’র শিষ্যত্বে এসেছেন? তিনি বললেন, আমি তার দু’টি দরসে শরীক হয়েছি। তিনি বড় উদার ও বদান্য চরিত্রের মানুষ ছিলেন। ঈছার (নিজের উপর অন্যকে অগ্রাধিকার প্রদান) ছিলো তাঁর স্বভাবের অন্তর্ভুক্ত। তাঁর যা কিছু অর্জন-উপার্জন, তা আপন সঙ্গী-অনুগামী ও গরীব-অভাবীদের মাঝে বণ্টন করে দিতেন। তিনি কাঁচা ইটের কাঁচা ঘরে থাকতেন। ...প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে তিনি ওয়াহদাতুল ওয়াজূদ (সকল অস্তিত্ব একই সত্তায় একীভূত-এই দার্শনিক মত) সম্পর্কে আমার মতামত জিজ্ঞাসা করলেন। আমি বললাম, এটা যতটা না তত্ত্বধর্মী, তার চেয়ে বেশী বাস্তবধর্মী। তিনিও সহমত পোষণ করলেন।হঠাৎ যেন আহমদ আমীনের উপর ভাবাচ্ছন্নতা ভর করলো, তিনি মন্তব্য করলেন, ‘জীবনের কোন কোন পর্যায়ে কিছু উত্তম সময় ও ভাব-অনুভব মানুষ লাভ করে, যা তাকে ঊর্ধ্বজগতের অনেক উচ্চতায় নিয়ে যায়। কিন্তু এই আত্মিক ভাবতরঙ্গ স্থায়িত্ব লাভ করে না।’ আমি বললাম, এ অবস্থা স্থায়ী হলে সমস্যা ছিলো। মানুষ জীবন থেকে ছিটকে পড়তো। জীবনকে কখনো জীবনের আঙ্গিকে যাপন করতে পারতো না। তিনি বললেন, ‘কিন্তু আমি শুনেছি এ অবস্থা কারো কারো ক্ষেত্রে স্থায়ী হয়?!’ বললাম, তা হতে পারে যখন কারো মধ্যে এ বিষয়ে স্বভাবযোগ্যতা অর্জিত হয়।শিক্ষক ও বিচারক, প্রকৃতিগত পার্থক্যআমাদের আলোচনার প্রকৃতি ছিলো বহুমুখী। তাই প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তর ঘটেই চলেছিলো। একপর্যায়ে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার কি বিচারক হওয়ার আগ্রহ ছিলো? তিনি বললেন, মোটেই না। এ জন্যই তো শেষ পর্যন্ত বিচারালয় ছেড়ে বিদ্যালয়ে চলে এসেছি এবং শিক্ষকতার দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। সম্ভবত বিচারের পরিবর্তে আমার শিক্ষকতামুখী হওয়ার অন্তর্নিহিত কারণ এই যে, বিচারকের কাছে আসে শুধু বিপর্যস্ত পরিবার, পক্ষান্তরে শিক্ষকের কাছে আসে ঐ সব ‘ফুলকলি, জীবনের উদ্যানে যারা প্রস্ফুটিত হতে চায়!তিনি বললেন, আমার এক শিক্ষক বলতেন, তোমার মেধা ও মনমানস তো গণিতমুখী, বিষয় হিসাবে তুমি সাহিত্য কেন বেছে নিয়েছো?আমি বললাম, আসলে এ কারণেই আপনার লেখা মূলকেন্দ্রিক ও বাহুল্যবর্জিত। আহমদ আমীন বললেন, সাহিত্যে যুক্তিবাদিতা আমার পছন্দ, যার কারণে আমার মধ্যে কাব্যরুচি গড়ে উঠেনি। কারণ কবিতা যুক্তিধর্মী নয়, ভাবধর্মী।এর মধ্যে দুপুরের খাবার পরিবেশন করা হলো। দস্তরখান থেকে ফারেগ হয়ে আমরা যোহর আদায় করলাম এবং বিদায়ের অনুমতি চাইলাম। অবকাশ যাপনের জন্য তারও আলেকজান্দ্রিয়া যাওয়ার কথা।মুসলিম যুবসংস্থার ড. আব্দুল হামীদ মিলনায়তনেরাতে আমরা জাম‘ইয়্যা শুব্বানুল মুসলিমীন-এর মিলনায়তনে একত্র হলাম, যার নাম রাখা হয়েছে ড. আব্দুল হামীদ-এর নামে। আমরা একত্র হলাম ড. সা‘ঈদ রামাযানের বক্তৃতাসভায় অংশগ্রহণের জন্য। তাঁর বক্তৃতা ছিলো সুদীর্ঘ এবং জোশ-জাযবায় উত্তাল। লাগাতার দু’ঘণ্টা তিনি বললেন। বিষয়- বস্তু ছিলো ইসলামী ঐক্য (ইসলামের নামে যারা কাজ করে তাদের ঐক্য কীভাবে হতে পারে!?)তাঁর বক্তৃতায় একাডেমিকতার উপর ধর্মপ্রাণতার ছাপ ছিলো প্রবল। (এভাবেও বলা যায়, ইলমি আন্দাযের চেয়ে দ্বীনী আন্দায ছিলোপ্রবল।)সমাবেশ, বক্তৃতা এবং শ্রোতাদের উপস্থিতি ও মনোযোগ, সব মিলিয়ে যা আমার অনুভবে এলো তা এই যে, মিশরের জীবনে এরই মধ্যে বড় একটা বিপ্লব ঘটে গিয়েছে। দ্বীনী আলোচনা, যা কখনো অপরিচয় দ্বারা অপাঙ্ক্তেয় ছিলো এবং স্বভাব ও সাধারণ রুচির কাছে অসহনীয় মনে হতো, এখন তা প্রিয় ও পছন্দনীয় বিষয়রূপে বরিত হচ্ছে। যুবক-সম্প্রদায় ও ছাত্রসমাজ যথেষ্ট দ্বীনমুখী ও ধর্মপ্রাণ মনে হলো। কানায় কানায় পূর্ণ জলসা একাগ্র চিত্তে পুরো বক্তৃতা শুনেছে। বহু যুবক, যারা বসার জায়গা পায়নি, দাঁড়ানো অবস্থায়ও একই ভাবে কথা শুনেছে। শ্রোতাদের মধ্যে জোশ, জাযবা, আবেগ, উচ্ছ্বাস ছিলো এমনই প্রবল যে, মাঝে মধ্যেই তাকবীরধ্বনিতে পুরো সমাবেশ মুখরিত হচ্ছিলো।২৫/৪/৭০ হি. ২/২/৫১ খৃ. জুমাসকালে নাশতাপর্ব সমাপ্ত করে আমরা আলহাজ আলী শরীফের শাবরাস্থ দোকানে উপস্থিত হলাম। উদ্দেশ্য ছিলো এখান থেকে আওসিমে গিয়ে জুমা আদায় করা। তারপর আলহাজ আতিয়্যা আলবাহওয়াশী’র গৃহে দুপুরের দাওয়াতে শরীক হওয়া। সেখানে হঠাৎ আমাদের সুহৃদ শায়খ আহমদ উছমান দেখা করার জন্য চলে এলেন। তিনি বেশ উত্তেজিত ও পেরেশান অবস্থায় বলতে লাগলেন, ‘মিশরের উপর তো বজ্রপাত ঘটেছে!আমি হয়রান হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ঘটনা কী?!তিনি বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আওয়াজ তুলেছে, ‘বিনোদনকর্মে নিযুক্ত পেশাদার’ নারিদের উপর থেকে বিধিনিষেধ তুলে নিতে হবে এবং আগের মত তাদেরকে বিনোদনসেবায় নিয়োজিত হওয়ার অনুমতি দিতে হবে। তাদের অজুহাত হলো, বখাটে যুবকেরা পথে ঘাটে সাধারণ মেয়েদের উত্তক্ত করছে, পেশাদার নারিদের অবাধ অনুমতি দেয়া ছাড়া পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। এ ঘটনায় তিনি খুব ব্যথিত, মর্মাহত ও অস্থির ছিলেন।পরে আবার তিনি আমার কাছে এলেন। দ্বীনী গায়রাত ও চেতনা এবং ইসলামী জোশ-জাযবায় তিনি তখন খুবই বে-হাল। আযহারী আলেমদের কড়া সমালোচনা করে বললেন, তারা বেতন-ভাতা, আর সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির দাবীতে ধর্মঘট করতে পারেন, সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে পারেন না?! দ্বীনের অবমাননার প্রতিবাদে হরতালে যেতে পারেন না?! নিজেদের দুনিয়ার জন্য যা করতে পারেন, আল্লাহ-রাসূল ও আখেরাতের জন্য অন্তত অতটুকু কেন করতে পারেন না?!আমি তাকে শান্ত করে বললাম, আপনার কথা সত্য এবং অনুভূতি যুক্তিযুক্ত, তবে রোগ ও রোগের প্রতিকার অন্যত্র। সমাজে এধরনের অবক্ষয় এবং অধঃপতন বাড়তেই থাকবে যতক্ষণ না সাধারণ মানুষের মধ্যে দ্বীনী চেতনা ও আখেরাত-চিন্তা জাগ্রত করার মেহনত শুরু হবে। সুতরাং সমালোচনায় সময়ের অপচয় না করে কর্তব্য হলো এ বেদনাদায়ক অবক্ষয়-অবনতি রোধ করার জন্য সমাজের সর্বস্তরে দ্বীনী গায়রত ও আত্মমর্যাদাবোধ জাগ্রত করার কাজে সর্বশক্তি নিয়োজিত করা।যতক্ষণ পর্যন্ত সমাজের বিভিন্ন স্তরে দ্বীনী চেতনা ও আত্মমর্যাদা-বোধ সৃষ্টি না হবে; যতক্ষণ না সামগ্রিক জাতীয় চেতনা সরকারের নীতি ও নৈতিকতার গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হবে ততক্ষণ-যত চেষ্টাই করা হোক-  রোগের উপশম হবে না। এছাড়া প্রতিটি চেষ্টাই হবে সাময়িক, খ-িত ও ত্রুটিপূর্ণআলহাজ আতিয়্যা আলোচনার যথার্থতা উপলব্ধি করে কিছুটা আত্মস্থ হলেন। তখন আমরা তারই গাড়ীতে করে মিশরের গ্রাম ও গ্রামীণ জীবন দেখার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। আমাদের সঙ্গে ছিলেন ছাওতুল উম্মাহ (উম্মাহর কণ্ঠস্বর) পত্রিকার প্রধান সম্পাদক এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রীর একান্ত সচীব উস্তায মুহাম্মাদ গানাইম।গাড়ীতেই মিশরীয় রেডিওর কোরআন তিলাওয়াত চলছে।মুসলিম সমাজে এ এক নতুন প্রবণতা। রেডিও বা রেকডর্-প্লেয়ারে কোরআন তেলাওয়াত চলতে থাকে। কেউ শোনে, কেউ শোনে না; কারো মনোযোগ থাকে, কারো থাকে না। তেলাওয়াত কিন্তু চলতে থাকে একই মাত্রায়! এটা কোরআনের প্রতি অবমাননার কোন্ পর্যায়!! শয়তান কত খুশী হয়, আল্লাহ কত নারায হন!!মনের ভিতরে এসব ভাবনার তোলপাড়ের মধ্যেই আমি বললাম, ‘দেখুন কোরআনের তেলাওয়াতশ্রবণ এখন কত ব্যাপক, কিন্তু তেলাওয়াতের কল্যাণ ও সুপ্রভাব গ্রহণ কত সামান্য!’ মনে হলো ব্যথিত হৃদয়ের কথা হৃদয়ে কিছুটা হলেও রেখাপাত করলো। মিশরের একটি গ্রামেগাড়ী নিজের গতিতে চলতে থাকলো। একসময় আমরা আওসিম নামের গ্রাম-এলাকায় পৌঁছে গেলাম। এই প্রথম মিশরের কোন গ্রাম আমার দেখা হলো। গ্রাম ও গ্রামীণ জীবনের ক্ষেত্রে মিশর ও ভারতবর্ষে তেমন কোন পার্থক্য চোখে পড়লো না, বরং এতটা মিল ও সদৃশতা ছিলো যে, আমরা যেন ভারতবর্ষেরই কোন গ্রামাঞ্চলে এসে পড়েছি। জনপদ এত অনুন্নত ও পশ্চাদপদ, জীবন এতই দারিদ্র্যপূর্ণ ও অভাবগ্রস্ত, শিশু থেকে শুরু করে নারী-পুরুষ  সবারই এমন ভগ্ন স্বাস্থ্য যে, কী বলবো! একটু আগে দেখে আসা কায়রোর জীবনের সঙ্গে দূরতম সম্পর্কও নেই। কায়রো সভ্যতা, সংস্কৃতি ও প্রাচুর্যের ঝলমল আলোতে প্লাবিত; এখানে আলোর চিহ্নমাত্র নেই! শুধু অন্ধকার, নিরক্ষরতার, অভাব, দারিদ্র্য ও অনাহারের এবং সরকারের অবজ্ঞা, অবহেলা ও উদাসীনতার।জীবনযাত্রার মানের পার্থক্য বড় বিপজ্জনক!একই সমাজে, একই শহরে, বরং শহরের বিভিন্ন এলাকার মধ্যে জীবনযাত্রার ধরন ও প্রকৃতিতে এই যে এত বিরাট পার্থক্য, দেশ ও জাতির জন্য এটা বড়ই বিপজ্জনক। এ পার্থক্য যথাসম্ভব শীঘ্র সহনীয় মাত্রায় কমিয়ে আনা জাতি ও সরকারের অবশ্যকতর্ব্য এবং আশু দায়িত্ব। এ পার্থক্য এবং মুখহাকরা এ দারিদ্র্য সামাজিক বিক্ষোভ-বিদ্রোহ এবং কমিউনিজমের অনুপ্রবেশের পথ সুগম করে।একসময় আমরা আলহাজ আতিয়্যা বাহওয়াশীর গৃহে প্রবেশ করলাম। গৃহ মানে রীতিমত প্রাসাদ! কায়রোয় কানে এসেছিলো, এ প্রাসাদ নির্মাণের ব্যয় ‘মাত্র’ পঁচিশ হাজার পাউন্ড! দিনের শুরুতে আযহারী আলেমদের প্রতি হাজী ছাহেবের ক্ষোভের কথা মনে পড়লো। আসলে আমাদের সব সময় নিজেকে দিয়ে শুরু করা দরকার।কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর জুমার জন্য আমরা মসজিদে গেলাম। আমাদের বন্ধু সৈয়দ আলী মাহমূদ শরীফ খোতবা দিলেনএবং জুমা পড়ালেন। নামাযের পর আমার বক্তৃতার ঘোষণা দেয়া হলো। আমি অপ্রস্তুত অবস্থায় দাঁড়িয়ে গেলাম এবং সূরাতুল আছরের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা পেশ করলাম। বক্তব্য শেষ হতে না হতেই মুছাফাহার জন্য মানুষ আমার উপর যেন উপচে পড়লো! এমন প্রচ- চাপ হলো যে, রীতিমত আশঙ্কা হলো, পড়ে যাওয়ার এবং ...!! বন্ধুরা আমাকে বেষ্টনীতে নেয়ার চেষ্টাকরলো, তবে কাজ হলো না। এমন উষ্ণ আন্তরিকতা ও ঐকান্তিকতা, এমন আল্লাহ-ওয়াস্তিয়া মুহাব্বাত ও ভালোবাসা, যার অভিজ্ঞা আগে আর হয়নি। আমার রীতিমত লজ্জাই হচ্ছিলো। মানুষ যদি জানতো আমার ভিতরের অবস্থা!!গ্রাম-হৃদয়ের এ উষ্ণ ভালোবাসা কিসের লক্ষণ?!মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলাম, এ সহজ সরল মানুষ-গুলোর সুধারণা তিনি যেন সত্য করেন; আমাকে যেন আখেরাতে শরমিন্দা না করেন। গ্রাম-হৃদয়ের এ আন্তরিকতা ও উষ্ণ ভালোবাসা দেখে বহুবারের মত আবারও বিশ্বাস হলো যে, হৃদয় ও আত্মা এবং কালব ও রূহের উপর দ্বীন-ঈমানের শক্তি-প্রভাব সত্যি অতুলনীয় এবং অপ্রতিহত। না হলে কীভাবে এটা হয়, হতে পারে যে, আমি দূর হিন্দুস্তানের পরদেশী মুসাফির, এরা মিশরের দূর পাড়া গাঁয়ের, জীবন ওজীবনের প্রাচুর্য থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষ; আমাদের মধ্যে নেই কোন পরিচয় ও বন্ধন, দ্বীন ও ঈমানের পরিচয়-বন্ধন ছাড়া। তারপরো আমাকে তারা এমন উষ্ণ ভালোবাসার সঙ্গে গ্রহণ করলো, যা পৃথিবীর কোন দেশে কোন পরদেশী মুসাফির কল্পনাও করতে পারে না। এটা তো দ্বীনের পরিচয়, ঈমানের বন্ধন এবং ইসলামী ভ্রাতৃত্বের আকর্ষণ ছাড়া আর কিছু নয়!!আপনত্বের আশ্চর্য এক প্রশান্তির অনুভূতি নিয়ে আপ্লুত হৃদয়ে মসজিদ থেকে বের হলাম। জালাল হোসাইনসহ অনেকে অপেক্ষায় ছিলেন। জনাব আতিয়্যা তাদেরও দাওয়াত দিয়েছেন দস্তরখানে আমার সঙ্গে শরীক হওয়ার।‘কাঁচামালের অপচয়’!!মসজিদের সেই ঈমানোদ্দীপক দৃশ্যটি ভুলতেই পারছিলাম না। হৃদয়ের গভীরে অভাবিতপূর্ব এক আনন্দজোয়ার বারবার যেন উপচে পড়ছিলো। দস্তরখানে শরীক বন্ধুদের সামনে দিলের কাইফিয়াত ও হৃদয়ের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে বললাম, বন্ধুগণ, পৃথিবীতে যত উৎকৃষ্ট ‘মানব-কাঁচামাল’ পাওয়া সম্ভব তা আপনাদের কাছে প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। কিন্তু আফসোস, এগুলোর বড় নির্দয় অপচয় ঘটছে। এমন কোন দরদী ও কুশলী কারিগর নেই যিনি এ মূল্যবান কাঁচামালের যথাযথ ব্যবহার করে অতি উচ্চস্তরের মানবসম্প্রদায় গড়ে তুলতে পারেন, যাদেরকে ঈমান ও ইসলামের সর্বোৎকৃষ্ট ‘উৎপাদন’-রূপে তুলে ধরা যায়।উস্তায জালাল আমাকে সমর্থন করে বললেন, পূবে পশ্চিমে বিভিন্ন দেশে আমি গিয়েছি; ইউরোপের বিভিন্ন জনপদ ও জনগোষ্ঠীও আমার বারবার দেখা হয়েছে। আমাদের গ্রামজনপদে যে সহজ সরল মানুষগুলো বাস করে তাদের চেয়ে স্বচ্ছ হৃদয়ের, তাদের চেয়ে পরিচ্ছন্ন জীবনের এবং তাদের চেয়ে বদান্য স্বভাবের মানুষ কোথাও দেখিনি। বিশ্বাসের এমন দৃঢ়তা, জীবনের প্রতি এমন আশ্বস্ততা, এমন অল্পে তুষ্টি ইউরোপের জনপদ ও পশ্চিমের জনগোষ্ঠীর মধ্যে কল্পনাও করা যায় না। কিন্তু আমরা আশ্চর্য এক হীনমন্যতার শিকার! আমরা আসলে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি। নিজেদের প্রতি, উম্মাহর প্রতি আস্থা ও নির্ভরতা যেন শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। নিজেদের ‘ভগ্ন- স্বাস্থ্যের’ গ্রাম ও জনপদকে আমরা তুচ্ছ ভেবে অবমূল্যায়ন করি, পক্ষান্তরে ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর প্রতি মুগ্ধতা প্রকাশ করি। নিজেদের সবকিছুকে মনে করি অসুন্দর ও অগৌরবের, আর পশ্চিমের সবকিছুকে মনে করি সুন্দর ও গৌরবের। আল্লাহর কসম, আরব মুসলমানদের মধ্যে, বিশেষ করে গ্রামের সাধারণ মানুষগুলোর মধ্যে যে স্বচ্ছতা ও পরিচ্ছন্নতা, যে উদারতা ও সহৃদয়তা, যে বিশ্বাস ও আশ্বস্তি এবং যে স্বভাবযোগ্যতা ও সুপ্ত সম্ভাবনা দেখেছি তা আর কোথাও দেখিনি।সবাই, বিশেষ করে উস্তায আব্দুল ওয়াহহাব সমর্থনসূচক অভিব্যক্তি প্রকাশ করলেন।এরপর আমি সবার সামনে হিন্দুস্তানের বিশদ চিত্র তুলে ধরলাম যে, কীভাবে কোন্ পদ্ধতিতে সেখানে দাওয়াত ও ইছালাহ-এর কাজ হচ্ছে। সাধারণ মানুষের মধ্যে সংস্কার ও সংশোধনের কাজ কী হেকমত ও প্রজ্ঞার সঙ্গে এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। সর্বোপরি দ্বীনী গায়রত ও চেতনার অধিকারী শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে কী নেযাম ও ব্যবস্থার মাধ্যমে দাওয়াতের মেহনতে শামিল করা হচ্ছে। আমি বললাম, এ নেযামের নাম হলো ‘খুরূজ ফী সাবীলিল্লাহ্’ বা আল্লাহ্র রাস্তায় বের হওয়া। মানুষ দাওয়াতী মেহনতের উদ্দেশ্যে জীবনের কিছু সময় (সপ্তাহ, মাস ও বছরের নির্দিষ্ট কিছু দিন) ফারেগ করে সম্পূর্ণ নিজের খরচে ঘর থেকে বের হয়। শহরে গ্রামে গিয়ে মসজিদকে কেন্দ্র করে মানুষকে দ্বীনের দাওয়াত দেয়। কোরআন ও সুন্নাহর উপর আমল করার জন্য তারগীব ও উৎসাহের পন্থায় উদ্বুদ্ধ করে। নিজেরাও পুরোনো দাঈদের কাছ থেকে দ্বীন শিক্ষা করে, আবার নতুনদের শিক্ষা দান করে। এভাবে আল্লাহর রহমতে দাওয়াত ও তাবলীগের এবং ইছলাহ ও সংশোধনের এক ব্যাপক মেহনত চলছে পুরো হিন্দুস্তানজুড়ে।উস্তায জালাল আমাকে সমর্থন করলেন এবং পাক-ভারতে এ মোবারক মেহনত দ্বারা মুসলিম জীবনে যে বিরাট ফায়দা ও কল্যাণ প্রত্যক্ষ করেছেন তা বেশ উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বর্ণনা করলেন।সবার মধ্যে খুব আগ্রহ দেখা গেলো নিজ নিজ এলাকায় এরকম মেহনত শুরু করার। হয়ত আল্লাহ তা‘আলা গায়ব থেকে কোন ছূরত পয়দা করে দেবেন।দস্তরখান থেকে ফারেগ হয়ে আমরা আছর আদায় করলাম। তারপর আলহাজ বাহওয়াশী ও বন্ধুবর আলী মাহমূদের সঙ্গে আলোঝলমল জীবনের শহর কায়রো ফিরে এলাম। সঙ্গে নিয়ে এলাম কিছু সুখের স্মৃতি, কিছু অনুতাপের অনুভূতি।জামে আযহার প্রাঙ্গণে কিছু সময়আমরা হাজার বছরের স্মৃতিধন্য জামে আযহারের খুব কাছে অবস্থান করছি। তারপরো আযহার দেখতে না যাওয়া, মনে হলো অসৌজন্যের শামিল। তাইআর বিলম্ব না করে জামে আযহার যেয়ারাতের উদ্দেশ্যে গেলাম। যদিও তখন শিক্ষকদের (দুঃখজনক) ধর্মঘটের কারণে যাবতীয় শিক্ষাকার্যক্রম স্থগিত, তবু ভাবলাম, ছাত্রাবাস, শ্রেণীকক্ষ ও প্রশাসনিক ভবন যতটুকু দেখা সম্ভব দেখে আসি। তাতে চোখ কিছুটা হলেও তো শীতল হবে!প্রথমে আমরা সেই ঐতিহাসিক জামে মসজিদে দাখিল হলাম, যা যুগপৎ ‘উপাসনালয়’ ও বিদ্যালয় -রূপে ইতিহাসের সুদীর্ঘ সময়-পরিসরে অনন্য ভূমিকা পালন করেছে এবং উম্মাহর জীবনে অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছে। মসিজদের এ মহান শিক্ষাঙ্গন থেকে যুগে যুগে কত ইমাম, মুহাদ্দিছ, ফকীহ, সংস্কারক এবং দা‘ঈ-মুজাহিদ তৈরী হয়েছেন তা শুধু আল্লাহ জানেন। বস্তুত মুসলিম জাহানের আর কোন শিক্ষাঙ্গন ও বিদ্যাপীঠ বা বিশ্ববিদ্যালয় এ বিষয়ে জামে আযহারের সঙ্গে তুলনায় আসতে পারে না। মসজিদ-মাদরাসার অভিন্ন সত্তা কত না সুখের, কত না সৌভাগ্যের! সুতরাং এ মহান মসজিদ ও বিদ্যাঙ্গনকে আমাদের সশ্রদ্ধ সালাম ও অভিবাদন।যখন আমরা মসজিদে প্রবেশ করলাম নিজের অজান্তেই দিলের মধ্যে, ভাষায় বর্ণনা করা যায় না, শুধু নিজে অনুভব করা যায়, এমন কিছু ভাব ও অনুভব আন্দোলিত হলো। ধীরে ধীরে ঐ সকল ওলামায়ে উম্মত, ছুলাহায়ে উম্মত, ফুকাহায়ে উম্মত, দা‘ঈ ইলাল্লাহ ও মুজাহিদীনে উম্মতের ছায়া ও ছবি অন্তরে উদ্ভাসিত হলো, যারা এখান থেকে দ্বীনের ইলম হাছিল করে যিন্দেগির ময়দানে বিপুল দায়িত্ব পালন করেছেন এবং অমর কীর্তি ও কৃতিত্ব রেখে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। যদিও তখন মসজিদের এই আলিশান ইমারত ছিলো না এবং এই শানদার কালীন ও গালিচা ছিলো না। ছিলো খুব সাধারণ ভবন, আর খেজুর পাতার ছেঁড়া চাটাই। কিন্তু ঐ ছেঁড়া চাটাইয়ের উপর বসেই যুগের সিংহপুরুষ ও মরদানে খোদা প্রতাপশালী রাজা -বাদশাহদের উপরও রাজত্ব করেছেন। সে যুগের ছালাত- ইবাদতের নূরানিয়াত এবং ইলমের খোশবু ও জ্ঞানের সুবাস এ যুগেও যেন অনুভব করা যায়!আমাদের মত মুর্দা দিলের মানুষও যেন কিছুটা অনুভ করতে পারে! সেই ইলম, আমল, আখলাক ও আফকার এবং সেই ইখলাছ, তাকওয়া ও আল্লাহ-ভীতি; সেই দুনিয়ার ভোগবিলাস বর্জন এবং আখেরাতের প্রতি আত্মনিবেদন, এ সবের একটা মৃদু সুবাস-ঝাপটা যেন আমাদের সমগ্র সত্তাকেও সুবাসিত করে গেলো।বিষণœ হৃদয়ে এই ভাবনা নিয়ে মসজিদ থেকে বের হলাম যে, ধর্মঘট শেষে যখন ইলমের ‘চাহাল-পাহাল’ ও শিক্ষার প্রাণচাঞ্চল্য শুরু হবে তখন ইনশাআল্লাহ আবার আসবো আযহারের সেই দৃশ্য দেখতে।মসজিদ থেকে বের হয়ে আমরা আযহারের বিশাল দফতর-ভবনে গেলাম। প্রায় সবক’টি কক্ষ ঘুরে ঘুরে দেখলাম। দফতর বেশ প্রশস্ত ও জাঁকজমকপূর্ণ, যেন গুরুত্বপূর্ণ কোন রাষ্ট্রীয় দফতর। প্রতিটি কক্ষের দরজায় লাগানো ফলক দেখে দেখে যাচ্ছি। শেষ দিকে একটি সুন্দর ফলকে দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো, আযহারের নিজস্ব সাময়িকী ‘আল-আযহার’-এর কার্যালয়। কাজ যেমনই হোক, আয়োজন বিশাল; আমাদের হিন্দুস্তানের দ্বীনী মহলে যা কল্পনা করাও সম্ভব নয়। ওখানে তো অবস্থা হলো, আয়োজন যেমনই হোক কাজ বড়।উস্তায ফরীদ ওয়াজদীর সঙ্গেএখানে হঠাৎ আমি থেমে গেলাম। উস্তায ফরীদ ওয়াজদীর কথা মনে পড়ে গেলো। ছাত্রজীবন থেকে আমি তাঁকে জানি, বলা যায়, গুণমুগ্ধ! তার রচিত দাইরাতু মা‘আরিফিল ক্বারনিল ‘ইশরীন (বিশশতকের বিশ্বকোষ)-এর সঙ্গে ভালো পরিচয় ছিলো। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর বহু প্রবন্ধ আমি পড়েছি।এই সুযোগে তাঁর সঙ্গে যদি দেখা হয়, ভালোই তো হয়! ‘পরিচয়-বেতাকা’ পাঠালাম। একটু পরেই ডাক এলো। বেশ আন্তরিকতার সঙ্গে তিনি আমাদের খোশামদেদ জানালেন। যখন জানলেন, সুদূর হিন্দুস্তান থেকে এসেছি এবং তাঁর লেখা ও রচনাবলীর সঙ্গে আমাদের পরিচয় রয়েছে তখন আরো খুশী হলেন এবং স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে সেটা প্রকাশও করলেন।আমি বললাম, আপনার পুরোনো গ্রন্থ ‘মুসলিম নারী’ যা আপনি কাসিম আমীনের লেখা ‘মিশরীয় নারী’ এর খ-নে লিখেছেন, ভারতে অনেক আগেই উর্দূ ভাষায় তার অনুবাদ হয়েছে। ভারতের শিক্ষামন্ত্রী মাওলানা আবুল কালাম আযাদ যুবক বয়সে এর অনুবাদ করেছেন; তবে মনে করা হয়, অনুবাদটি উর্দূ সাহিত্যের মানে পূর্ণ উত্তীর্ণ। যেমন প্রাঞ্জল, তেমনি সাবলীল,আর তেমনি অলঙ্কারসমৃদ্ধ।আমি আরো বললাম, আপনি মিশরের অন্যতম প্রবীণ লেখক। আল্লাহ্ আপনার হায়াতে বরকত দান করুন; জানতে ইচ্ছে করে, এখন আপনার বয়স কত হবে?মৃদু হেসে বললেন, বাহাত্তর; তবে চাইলে ২কে ৭এর আগেও যোগ করা যায়! বললাম, আপনার কীর্তি অবশ্য তেমন তারুণ্যই প্রমাণ করে!আরো বললাম, আপনার ধর্মীয় ও আধুনিক জ্ঞানের মধ্যে সমন্বয়কারী ব্যক্তিত্বের সঙ্গে আমরা পরিচিত। আপনি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং ইউরোপের দর্শন-ফালসাফার অস্ত্র দ্বারাই ইসলামের সেবা করছেন।তিনি সন্তোষ প্রকাশ করে বললেন, এ যুগে ইসলামের সুন্দরপ্রতিনিধিত্ব করার এবং ইসলামের গুণ, সৌন্দর্য ও বৈশিষ্ট্য তুলে ধরার এটাই সর্বোত্তম পন্থা। অন্তত আমি তাই মনে করি।ইংরেজি সংস্কৃতি ও ফরাসি সংস্কৃতির পার্থক্যফরিদ ওয়াজদীকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার শিক্ষা-দীক্ষা ও সংস্কৃতির ভাষা কি ইংরেজি, না ফরাসি? তিনি বললেন, ফরাসি, তবে ইংরেজিকে আমি ফরাসির উপর অগ্রাধিকার প্রদান করি।আমি বললাম, সম্ভবত জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে ইংরেজি অধিক শক্তিশালী, পক্ষান্তরে ফরাসি ভাষার গতি ও শক্তি হলো শিল্প, সাহিত্য ও কাব্যভাবনায়।তিনি সমর্থন জানিয়ে বললেন, আসলেও তাই।আমি বললাম, জাতিগতভাবে ইংরেজ অত্যন্ত বাস্তববাদী এবং সর্বক্ষেত্রে বাস্তবতায় বিশ্বাসী। তাদের স্বভাবের মধ্যে যেমন রয়েছে নিরলসতা ও একাগ্রতা তেমনি রয়েছে অধ্যবসায় ও ঐকান্তিকতা। তিনি বললেন, ‘ইংরেজদের মধ্যে আধ্যাত্মিকতার প্রতি যথেষ্ট প্রীতি ও আকর্ষণ রয়েছে। এ বিষয়ে তাদের ব্যাপক অধ্যয়নও রয়েছে। আশা করা যায়, ভবিষ্যতে তাদের ভিতর থেকে আধ্যাত্মিকতার আলো বিচ্ছুরিত হবে।’মাপ করবেন, আমি বলতে চাই, আধ্যাত্মিকতার প্রতি ইংরেজদের মনোযোগ নিছক একটি আর্ট ও শিল্পরূপে, একটি বিষয় ও শাস্ত্ররূপে। জীবনে এর বাস্তবায়ন ও প্রতিপালনে তাদের কোন আগ্রহ নেই। মোটকথা, আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে সত্যের সন্ধান তাদের উদ্দেশ্য নয়, তথ্যের অনুসন্ধান উদ্দেশ্য। আরো সহজ ভাষায় যদি বলি, আধ্যাত্মিকতার তারা সাধক নয়, গবেষক। সাধনা ও গবেষণার পার্থক্য তো ...! শেষ পর্যন্ত আমার পর্যালোচনা তিনি মেনে নিলেন বলেই মনে হলো।তারপর কথা হলো হিন্দুস্তানের মুসলিম জনগোষ্ঠী ও তাদের ভবিষ্যত সম্পর্কে। একপর্যায়ে তিনি বললেন, আশা করি ভবিষ্যতে হিন্দুদের মধ্যে ইসলামের প্রতি ঝোঁক ও আগ্রহ দেখা দেবে। আমি বললাম, বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায় আমারও এরকম আশা হয়।ঘটনাক্রমে তার ওখানে দেখা হয়ে গেলো মিফতাহু কুনূযিস্-সুন্নাহ গ্রন্থের অনুবাদক উস্তায ্ফুয়াদ আব্দুল বাকীর সঙ্গে। গ্রন্থটি তিনি ওলন্দায ভাষা থেকে আরবীতে ভাষান্তরিত করেছেন। তিনি মাওলানা সৈয়দ সোলায়মান নদবী সম্পর্কে খোঁজ খবর নিলেন এবং তাঁর উচ্চ প্রশংসা করে বললেন, ‘তিনি আমার পত্র ও উপহার উত্তমরূপে গ্রহণ করেছেন এবং আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। তদুপরি তিনি আমার কাজের অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন, যা তাঁর মত ব্যক্তির পক্ষ হতে অনেক বড় বিষয়।’আমি উস্তায ফুয়াদ আব্দুল বাকীকে আমার কিতাব হাদিয়া দিলাম, যা তিনি সানন্দে গ্রহণ করলেন। আগামী সোমবার এখানে আবার আসবেন এবং আমাকে তার কিছু কিতাব হাদিয়া দেবেন, বলে, বিদায় নিলেন।আযহারের ছাত্রাবাস, আমার পর্যবেক্ষণদারুল কুতুবিল মিছরিয়্যা (লাইব্রেরী)-এর সাবেক তত্ত্বাবধায়ক ‘সামীর মুহায্যাব’ (সুশীল বিনোদনসঙ্গী) গ্রন্থের লেখক উস্তায আলী ফিকরীর সঙ্গেও অকস্মাৎ দেখা হয়ে গেলো এবং পরিচয়পর্ব সম্পন্ন হলো।পরে আমরা শরী‘আ অনুষদের ছাত্র মুহাম্মাদ দামিরদাশীর পথ- নির্দেশনায় অনুষদ ও তার গ্রন্থাগার দেখতে গেলাম। একই ভাবে দেখলাম আযহারের ছাত্রাবাস।যদি সত্য বলি, ছাত্রাবাসের বিশৃঙ্খলা, অপরিচ্ছন্নতা, অস্বাস্থ্যকর ও নোংরা পরিবেশ দেখে কষ্টই হলো। আমার ধারণা এ ধরনের ছাত্রাবাসে যারা থাকে তাদের মধ্যে দুর্বল ব্যক্তিত্ব ও পশ্চাদ্পদতার অনুভূতি সৃষ্টি হবে, পক্ষান্তরে শৃঙ্খলা, সুব্যবস্থাপনা ও পরিচ্ছন্নতা- বিশিষ্ট আধুনিক শিক্ষাঙ্গন ও তার ছাত্রদের প্রতি অতিরিক্ত সমীহ ও ভীতির অনুভূতি সৃষ্টি হবে। এককথায় যেটাকে বলে হীনমন্যতাবোধ। তার উপর সমস্যা এই যে, আযহারের ছাত্রদের মধ্যে তো দ্বীন এবং দ্বীনের ইলম সম্পর্কে গৌরব ও গর্ববোধ করার চেতনাও নেই, যা আগের যুগে ছিলো, যা হীনমন্যতাবোধ দূর করে আত্মমর্যাদাবোধ সৃষ্টি করতে পারে। সুতরাং আমার মনে হয়, আযহার কর্তৃপক্ষের অবশ্য- কর্তব্য হবে সুন্দর, সুশৃঙ্খল, পরিচ্ছন্ন ও মানসম্পন্ন ছাত্রাবাসের ব্যবস্থা করা, যা আধুনিক বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যা-লয়গুলোর চেয়ে অন্তত কম যেন কিছুতেই না হয়।আছরের সময় আমরা উস্তায মুহাম্মাদ রাশাদ আব্দুল মুত্তালিবের সঙ্গে শায়খ মুছতাফা ছাবরী আফেন্দীর সাক্ষাৎ লাভের উদ্দেশ্যে গেলাম। তিনি হলেন উছমানী সালতানাতের সাবেক শায়খুল ইসলাম। তার সাক্ষাৎ লাভ করা সম্ভব হলো না। কারণ তিনি তখন বেশ অসুস্থ ছিলেন। আমরা তার জন্য মাযা খাসিরাল আলাম..., ও কিছু পুস্তিকা হাদিয়া হিসাবে রেখে চলে এলাম।(চলবে ইনশাআল্লাহ)