শিশু-কিশোর ও নবীনদের পত্রিকা

মাসিক আল-কলম-পুষ্প

জিলহজ্ব ১৪৪০ হিঃ (৩/৮) | প্রথম পাতা

সম্পাদকীয়

দু’টি শিক্ষার দুই বিপরীত প্রকৃতি!

শুধু আমাদের দেশে নয়, শুধু পাক-ভারত উপমহাদেশে নয়, বরং সারা পৃথিবীতে শিক্ষার মোটামুটি দু’টো ধারা রয়েছে। বিশে^র উন্নত দেশগুলোর ক্ষেত্রে যেমন এটা সত্য, তেমনি সত্য অনুন্নত ও পশ্চাদ্পদ জাতিগুলোর ক্ষেত্রেও। যেমন সত্য মুসলিম বিশে^র ক্ষেত্রে, ব্যাপক পরিসরে; তেমনি সত্য অমুসলিম বিশে^র ক্ষেত্রে, সীমিত পর্যায়ে।

একটা হলো জাগতিক শিক্ষা, আরেকটি হলো ধর্মীয় শিক্ষা। জাগতিক শিক্ষার মূল বুনিয়াদ হলো জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অগ্রসর এবং কর্মকুশলতায় উন্নত জনশক্তি তৈরী করা; পক্ষান্তরে ধর্মীয় শিক্ষার মূল বুনিয়াদ হল, ঊর্ধ্বজাগতিক বিশ^াস ও চেতনা সৃষ্টি করা এবং মানুষের ভিতরে সুপ্ত মানবিক গুণাবলীর বিকাশ ঘটানো।

জাগতিক শিক্ষায় ঊর্ধ্বজাগতিক কোন শক্তির প্রতি বিশ^াস দূরের কথা, সে সম্পর্কে কোন ধারণাই থাকে না। এখানে বিশ^াস নয়, কর্মই একমাত্র উদ্দেশ্য; এখানে মানবতা ও মানবিকতা নয় এবং মানবের অন্তর্সত্তা নয়, বরং জৈবিকতা ও দেহসত্তাই একমাত্র বিবেচ্য; এখানে শিক্ষার পুরো কার্যক্রম আবর্তিত হয় ব্যক্তির নিজের প্রয়োজন এবং দেশ ও সম্প্রদায়ের সামষ্টিক প্রয়োজনকে কেন্দ্র করে। এখানে ব্যক্তির বাইরে কোন ব্যক্তি নেই এবং নেই আপন দেশ ও সম্প্রদায়ের বাইরে আর কোন দেশ ও সম্প্রদায়।

ধর্মীয় শিক্ষায় ঊর্ধ্বজাগতিক শক্তির প্রতি বিশ^াস ও নির্ভরতা এবং পরম সত্তার প্রতি আনুগত্য ও ভালোবাসাই হচ্ছে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এখানে শিক্ষার সমগ্র কার্যক্রম আবর্তিত হয় মানবসত্তাকে কেন্দ্র করে। অর্থাৎ সমগ্র মানবজাতিকে সেখানে অভিন্ন একটি সত্তারূপে বিবেচনা করা হয়, আর দেশ, জাতি ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে সমগ্র মানবজাতির কল্যাণ ও প্রয়োজন পূর্ণ করাই হয় উদ্দেশ্য।

ধর্মীয় শিক্ষায় ঊর্ধ্বজাগতিক শক্তির প্রতি পূর্ণ বিশ^াস যেমন থাকে, তেমনি থাকে জীবনের প্রতিটি কাজে, প্রতিটি পদক্ষেপে ঊর্ধ্বজাগতিক সত্তার সামনে জবাবদিহিতার প্রবল অনুভূতি। এ শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই থাকে ঊর্ধ্বজাগতিক সত্তার সন্তুষ্টি অর্জন এবং তার অসন্তুষ্টি পরিহার।

***

এখানে আমরা আমাদের আলোচনাকে বিশ^পরিসরে ব্যাপ্ত করতে চাই না, বরং সঙ্গত কারণেই উপমহাদেশের পরিসরে সীমাবদ্ধ রাখতে চাই।

জাগতিক ও ধর্মীয় উভয় শিক্ষাব্যবস্থার কিছু নিজস্ব স্বভাব, প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে। পাকভারত উপমহাদেশের যে শিক্ষাব্যবস্থাকে সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থা, বা ইংরেজি শিক্ষা বলা হয়, যাকে কেন্দ্র করে স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি এবং বিভিন্ন বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, এই শিক্ষাব্যবস্থার কিছু সাধারণ প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে, এবং রয়েছে কিছু স্বভাবপ্রবণতা যা ঐ শিক্ষাব্যবস্থায় গড়ে ওঠা শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনিবার্য-রূপে পাওয়া যায়। কিছু বৈশিষ্ট্য ও প্রবণতা রয়েছে বাইরের অবয়বে, চেহারা ছূরতে ও জীবনযাত্রায়, আর কিছু বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি রয়েছে ভিতরের সত্তায়, চিন্তাচেতনায় এবং আচরণ ও জীবনধারায়।

পাকভারত উপমহাদেশে আলিয়া নামে ইংরেজ সরকারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান ও পৃষ্ঠপোষকতায় যে ইসলামধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তারও রয়েছে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য, প্রকৃতি ও প্রবণতা। ঐ শিক্ষাব্যবস্থায় যে সব শিক্ষার্থী গড়ে ওঠে তাদের মধ্যে সেগুলোর প্রতিফলন দেখা যায়। এখানেও একই কথা, কিছু বৈশিষ্ট্য, প্রকৃতি ও প্রবণতা রয়েছে বাইরের

 

 

 

অবয়বে, চেহারা ছূরতে, জীবনযাত্রায়, আর কিছু রয়েছে ভিতরের সত্তায়, চিন্তা-চেতনায় এবং আচরণ ও জীবনধারায়।

কাউমী মাদরাসা নামেও মুসলিম জাহানে, বিশেষ করে পাকভারত উপমহাদেশে রয়েছে ইসলামধর্মীয় একটি ‘সাধারণ’ শিক্ষাব্যবস্থা। কাউম বা জাতির দ্বীন-ঈমান, আকীদা-বিশ্বাস, ইলম ও আমল এবং চিন্তা ও চরিত্রের হিফাযত ও সংরক্ষণ যেহেতু এই শিক্ষাব্যবস্থার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সেহেতু এটা কাউমী শিক্ষাব্যবস্থা নামে পরিচিত।

আবার যেহেতু এই শিক্ষাব্যবস্থা গড়েই উঠেছে সর্বপ্রকার সরকারী সাহায্য-সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা পরিহার করে শুধু কাউম ও জাতির সম্মিলিত সাহায্য-সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতায় এবং সমগ্র জাতির নিজস্ব প্রয়োজন ও চাহিদার ভিত্তিতে সেজন্যও এ শিক্ষাব্যবস্থার নাম হয়েছে কাউমী শিক্ষাব্যবস্থা।

যাই হোক, আমি বলতে চাচ্ছি যে, কাউমী শিক্ষাব্যবস্থারও রয়েছে সাধারণ কিছু স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য এবং প্রকৃতি ও প্রবণতা। এ শিক্ষাব্যবস্থায় যারা প্রতিপালিত তাদের মধ্যে সেগুলোর অনিবার্য প্রতিফলন ঘটে। এখানেও একই কথা; কিছু বৈশিষ্ট্য ও প্রবণতা রয়েছে বাইরের অবয়বে, চেহারা ছূরতে ও জীবনযাত্রায়, আর কিছু স্বভাব ও প্রকৃতি রয়েছে ভিতরের সত্তায়, চিন্তাচেতনায় এবং আচরণ ও জীবনধারায়।

তো যে শিক্ষাব্যবস্থায় একজন শিক্ষার্থী গড়ে ওঠবে, তার বাইরের অবয়বে এবং ভিতরের সত্তায় ঐ শিক্ষাব্যবস্থার ছাপ ও প্রভাব থাকবে এটাই স্বাভাবিক এবং এটাই সাধারণত দেখা যায়। কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই থাকে। তবে সেটা ঐ শিক্ষাব্যবস্থার গুণগত প্রকাশ নয়; সেটা ঘটে সাধারণত পারিপার্শ্বিক ও আরোপিত বিভিন্ন কারণে। সবাই বুঝে নেয় যে, এটা ঐ শিক্ষাব্যবস্থার সাধারণ বৈশিষ্ট্য ও প্রবণতা নয়। পারিপার্শ্বিক কোন কারণে তা ঘটেছে এবং ঘটতে পারে। সুতরাং এর ভিত্তিতে কোন শিক্ষাব্যবস্থার না প্রশংসা করা যায়, না সমালোচনা; কোন শিক্ষাব্যবস্থা না গ্রহণ করা যায়, না বর্জন। গ্রহণ বা বর্জন তো হবে শুধু শিক্ষাব্যবস্থার নিজস্ব সত্তাগত গুণ ও বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে এবং অন্তর্নিহিত স্বভাব ও প্রকৃতির বিচারে। স্কুল কলেজ, ইউনিভার্সিটির কোন শিক্ষার্থী যদি সুন্নতমুখী জীবন অনুসরণ ক তবে সবাই বুঝে নেয়, এটা ঐ শিক্ষাব্যবস্থার অবদান নয়, পারিবারিক সংস্কৃতি, ভিন্ন পরিবেশ, বা সংস্পর্শের প্রভাব।

আলিয়া ও কাউমী শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কেও একই কথা। কাউমী শিক্ষাব্যবস্থায় প্রতিপালিত ও গড়ে ওঠা কোন আলিম যদি বিশ^াসে দুর্বল এবং আচরণে বস্তুমুখী হয়ে পড়েন বা সরকারতোষণের পথে চলেন এবং নাস্তিক্যবাদী কর্মকা-ের সঙ্গে, যে কোন পর্যায়েই হোক, একাত্মতা পোষণ করেন; তদ্রƒপ কোন ছাত্র যদি আমলে আকীদায় গাফলত ও ‘শিথিলতা’র পরিচয় দেয় তাহলে সবাই বুঝে নেয়, কাউমী শিক্ষাব্যবস্থার যে সাধারণ বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি তা থেকে তার বিচ্যুতি ঘটেছে।

এ পর্যন্ত যা বলা হলো, ধারণা করি, মৌলিক -ভাবে এর সঙ্গে কারো দ্বিমত নেই।

***

এবার আমরা কয়েকটি মানদ- নির্ধারণ করে ঐ আলোকে জাগতিক ও ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থার তুলনামূলক আলোচনায় অগ্রসর হতে চাই।

প্রথম মানদ-টি হলো জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষতা ও কুশলতা, সেই সঙ্গে ঐ দক্ষতা ও কুশলতা মানবকল্যাণে নিয়োজিত হওয়া।

দ্বিতীয় মানদ-টি হলো নৈতিকতা, সততা, ত্যাগ ও আত্মত্যাগ।

তৃতীয় মানদ-টি হলো যৌন জীবনের পরিচ্ছন্নতা এবং নেশা ও মাদকের অভিশাপ থেকে মুক্ত থাকা।

চতুর্থ মানদ-টি হলো বস্তুমুখিতা ও আখেরাতমুখিতা

পঞ্চম মানদ-টি হলো পরিবারমুখিতা, পারিবারিক দায়িত্বের প্রতি স্বতঃস্ফূর্ততা এবং সন্তানের শিক্ষা-দীক্ষা ও প্রতিপালনের প্রতি দায়বোধ, তারপর বৃদ্ধ মা-বাবার প্রতি সদয়তা ও আত্মনিবেদন।

উপরে যে ক’টি মানদ-ের কথা বলা হলো (এবং এরূপ আরো কিছু মানদ-ের উল্লেখ হতে পারে), প্রতিটি মানদ- ব্যক্তির জীবনে যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি সমাজ ও জাতির জীবনে, এমনকি বিশ^পরিসরেও সীমাহীন গুরুত্বের অধিকারী। সুতরাং এসকল মানদ-ে অবশ্যই আমাদের বিচার করে দেখতে হবে যে, উভয় শিক্ষাব্যবস্থার ফলাফল কী?

প্রথমে চিন্তা করুন বিশ^ পরিসরে, তারপর চিন্তা করুন যথাক্রমে জাতীয় পরিসরে, পারিবারিক পর্যায়ে এবং ব্যক্তিগত জীবনে।

***

আমরা আন্তরিকভাবে বিশ^াস করি, সারা বিশে^, বিশেষ করে আমাদের উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থার যে দ্বৈততা এটাই মূলত ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনের যাবতীয় অশান্তি, দুর্যোগ ও বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। এ অবস্থা থেকে উদ্ধার পেতে হলে যুগপৎ ‘বস্তু ও বিশ^াস’কে ভিত্তি করে একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার কোন বিকল্প নেই। সুতরাং সর্বপ্রকার প্রান্তিকতা ও সঙ্কীর্ণমনস্কতা পরিহার করে আমাদের সবাইকে আজ এগিয়ে আসতে হবে এমন এক সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে যেখানে দ্বীন ও দুনিয়া এবং জগত ও ঊর্ধ্বজগত উভয়ের ঘটবে সুসমন্বয়। এটা উন্নত বিশে^র ক্ষেত্রে যেমন জরুরি তেমনি জরুরি অনুন্নত বিশে^র ক্ষেত্রে। শিক্ষাব্যবস্থার এই যে সার্বজনীন মূলনীতি এটাকেই তুলে ধরা হয়েছে আমাদের পাক কালামে এভাবে- ‘রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনয়া হাসানাতান ওয়া ফিল আখিরাতি হাসানাতান ওয়া কিনা আযাবান্নার।

অর্থাৎ মানবজাতির সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা হবে এমন যা তাকে দুনিয়াতেও সুখ-শান্তি ও কল্যাণ দান করবে, আবার আখেরাতেরও কল্যাণ নিশ্চিত করবে। সর্বোপরি যে শিক্ষাব্যবস্থা মানবজাতিকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করবে।

এটা তো হলো তাদের কথা যারা পরকালে বিশ^াস করে। এমনকি যারা পরকালে বিশ^াসী নয়, যারা নাস্তিক তাদেরও অস্বীকার করার উপায় নেই যে, নৈতিকতার অনুশীলন এবং মানবিকতার পরিচর্যার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এছাড়া জীবন ও জগত চরম নৈরাজ্য ও ফাসাদের শিকার হতে বাধ্য।

***

এটা আমাদের একটা জাতীয় দুর্বলতার মত হয়ে গিয়েছে যে, শিক্ষার প্রসঙ্গ এলেই শোরগোল শুরু হয় মাদরাসা শিক্ষার সংস্কার বা আধুনিকায়ন প্রসঙ্গে। আমাদের পরিষ্কার বক্তব্য এই যে, দু’টি শিক্ষাব্যবস্থাকে আলাদা করেই যদি দেখতে হয় তাহলে যুক্তির আলোকে বিচার করে বলুন, কোন্ শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার এবং ব্যাপক সংস্কার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে জরুরি? কোন্ শিক্ষাব্যবস্থা আজ জাতির জন্য এবং মানবজাতির জন্য বড় বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে? আমাদের প্রথম প্রয়োজন কোন্টি? কিছু মানুষকে মূল স্রােতধারায় ফিরিয়ে আনা, নাকি মূল স্রােতধারাকে যৌন নৈরাজ্য, মাদকের অভিশাপ এবং ভোগবাদী চেতনা ও বিশ্ন্থেকে উদ্ধার করা! *