শিশু-কিশোর ও নবীনদের পত্রিকা

মাসিক আল-কলম-পুষ্প

জিলহজ্ব ১৪৪০ হিঃ (৩/৮) | হযরত আলী নাদাবীর পাতা

ডাক দিয়ে যায় মুসাফির!

হযরত মাওলানা সৈয়দ আবুল হাসান আলী নাদাবী রহ-এর মধ্যপ্রাচ্যসফরের রোযনামচা

ধারাবাহিক-৫

পথের দু’পাশে ছিলো দোকানের সারি। প্রতিটি দোকান যেন একটা করে ক্ষুদে মজলিস! কোনটায় গায়ক গলা ছেড়ে  শোকগাঁথা গায়; কোনটায় ক্বারী গানের মত তেলাওয়াত করে, কোনটায় চলছে পেশাদার ওয়ায়েযের ‘মারছিয়া’ ওয়ায। সবাই নিজ নিজ জটলা মাতিয়ে রেখেছে। কানফাটা চিৎকারে কিছুই শোনা যায় না, তবু যেন সবাই বিভোর! কেউ কেউ সমঝদারির সঙ্গে মাথা দোলায়। এমনকি তালি বাহবা দিয়ে, আর ‘দোবারা ইরশাদ’ বলে উৎসাহও যোগায়। সে এক আজিব হালত, যে দেখেনি সে বিশ্বাস করবে না, আর যে দেখেছে সে অবিশ্বাস করবে। দ্বীন-ধর্ম দূরে থাকুন, রুচিশীল ও সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষও এসব কিছুতেই বরদাশত করতে পারে না, এমনকি বিনোদনের নামেও না। কারো যে মাথা ধরে যাচ্ছে না, সে-ই আশ্চর্যের বিষয়! আমার শুধু মনে পড়ছিলো কোরআনের আয়াত-

‘ছাড়ো ওদের কথা, নিজেদের দ্বীনকে যারা খেল-তামাশার বিষয় বানিয়ে নিয়েছে।’

পুরো বিষয়টা যেন ছিলো কোরআনের এ আয়াতেরই যিন্দা তাফসীর!

আফসোসের বিষয় তো এই যে, এগুলো সব চলছে হাজার বছরের ইলমী ঐতিহ্যের অধিকারী আল-আযহারের দেয়াল থেকে ‘আওয়াযপৌঁছা’ দূরত্বের মধ্যে। কিন্তু মনে হলো না, আযহারের বাসিন্দাদের তাতে ‘শান্তিভঙ্গ’ হচ্ছে!

মুহম্মদ গাযালীর সঙ্গে কিছুক্ষণ

১-৬-৭০ হি. ৩-২-৫১ খৃ.

মিসরের শীর্ষস্থানীয় দ্বীনী ও ইলমী শাখছিয়াত এবং ইখওয়ানের অভিভাবকপুরুষ শায়খ মুহম্মদ আলগাযালীর খেদমতে হাযির হলাম। তিনি আমাদের উষ্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করলেন। গাম্ভীর্য ও আভিজাত্য রক্ষা করে তিনি যথেষ্ট বলতে পারেন। দ্বীন ও ইলম এবং দাওয়াহ্ ও সংস্কার বিষয়ে প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে বিভিন্ন রকম কথা হলো তাঁর সঙ্গে। একপর্যায়ে এমন কতিপয় লেখক সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীর আলোচনা উঠলো, ইসলামের ফিকাহ (আইন ও বিধান)শাস্ত্রের সমালোচনায় যারা কলম পরিচালনা করেছেন এবং ‘ওযনদার’ কিতাব লিখেছেন, যাতে দ্বীনের উছূল ও মূলনীতির উপর নগ্ন হামলা হয়, অথচ তাদের প্রতিপালন হয়েছে দ্বীনী পরিবেশে ও ধর্মীয় পরিম-লে।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তাদের মধ্যে এই বিপরীত প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পাওয়ার কারণ ও অনুঘটক কী? এমন তো নয় যে, কিছু কারণ রয়েছে তাদের নিজস্ব সত্তা ও স্বভাব প্রবণতার মধ্যে, আর কিছু কারণ রয়েছে তাদের জীবনের বিভিন্ন তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্যে, যেমন কিছু কিছু দেশে এরূপ অবস্থা দেখা যায়?

ুতিনি আমার চিন্তাকে সমর্থন করে বললেন, ‘এই শ্রেণীর লোকদের একজনকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। আযহারে তিনি আমার  ঘনিষ্ঠ সহপাঠী ছিলেন। পরবর্তী জীবনে একটি দ্বীনী সংগঠনের সঙ্গে তার রোকন পর্যায়ের সম্পর্ক ছিলো। তিনি অত্যন্ত অভাব অনটনের জীবন যাপন করতেন। পক্ষান্তরে তারই চোখের সামনে তার দ্বীনী সাথীদের জীবন ছিলো আরাম, আয়েস ও বিলাস প্রাচুর্যের। কিন্তু আদর্শ ও আন্দোলনের পথে যারা তার সহযাত্রী, জীবনের কষ্টের ক্ষেত্রে তারা ছিলো তার প্রতি বিলকুল  বেগানা। কারো অন্তরেই তার প্রতি ছিলো না সামান্য হামদর্দি ও সহানুভূতি। ন্যূনতম মানবতা-বোধেরও পরিচয় দেয়নি তারা। বন্ধুত্ব ও সাথিত্বের দাবী-হক রক্ষা করা তো দূরের কথা। এ বাস্তবতা দ্বীন ও দ্বীনী চিন্তা-চেতনার প্রতি তার অন্তর বিষিয়ে তুলেছিলো। ফলে দ্বীনদার মহল সম্পর্কে তিনি বিরূপ ধারণায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। আমার মনে হয়, এই মানুষটি

যদি কখনো কোন গুরুত্বপূর্ণ ও নীতিনির্ধারণী পদে সমাসীন হন, আর লোকনিয়োগের সুযোগ আসে তাহলে তিনি তথাকথিত দ্বীনদার লোকদের মুকাবেলায় দ্বীনবঞ্চিত মানুষকেই অগ্রাধিকার দেবেন। কারণ দ্বীনদারির মধ্যে তিনি হৃদয়হীনতা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাননি। তাদের মধ্যে না ছিলো মানবিকতা ও উচ্চ নৈতিকতা, না ছিলো ন্যূনতম আখলাক ও ইনসানিয়াত।’

শায়খ গাযালী যা বলেছেন তা তিক্ত বাস্তব। সংবেদনশীল ও অস্থিরচিত্ত এমন বহু মানুষের ক্ষেত্রেই তা প্রযোজ্য যারা দ্বীনী শিক্ষা অর্জন করেছে এবং দ্বীনী পরিবেশে প্রতিপালিত হয়েছে, কিন্তু ধীরে ধীরে দ্বীনের প্রতি বীতশ্রদ্ধ বা বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে। মানুষের স্বভাব যদি সংবেদনশীল ও তীক্ষè অনুভূতি- প্রবণ হয়, আর এরূপ তিক্ত ও অমানবিক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয় তখন অনিবার্যভাবেই তার মধ্যে প্রচ- প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, যা তাকে ‘চিন্তা-বিদ্রোহ’ পর্যন্ত নিয়ে যায়। এটাই ঘটেছে কমিউজম-দর্শনের জনক কালমার্কসের জীবনে এবং তার মত আরো বহু বিদ্রোহী ব্যক্তিত্বের জীবনে।

অবশ্য পুরো বিষয়টি ভিন্ন দৃষ্টি-কোণ থেকেও দেখার সুযোগ ছিলো এবং আপন নীতি ও নৈতিকতা দ্বারা চারপাশের পরিবেশের মধ্যে কাক্সিক্ষত সংস্কার-সংশোধন আনা সম্ভব ছিলো। অর্থাৎ অন্যরা যা করেনি, করতে পারেনি, আমি তো তা করে দেখাতে পারতাম!

সাধারণ বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থা এবং সেখানকার শিক্ষকদের প্রসঙ্গে কথা হলো এবং কথা হলো বড় বড় লেখক সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে। শায়খ গাযালী বললেন, আফসোস, এদের অনেকেই উচ্চ শিক্ষিত, জ্ঞানী-গুণী। তাদের জ্ঞান ও জানাশোনার পরিধি যেমন বিস্তৃত তেমনি গভীর। এমনকি সঙ্গত-ভাবেই তাদের কতিপয়কে জীবন্ত ‘বিশ্বকোষ’ বলা যায়। তারা ইসলামের ইতিহাস, তাহযীব-তামাদ্দুন ও সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং সেগুলোর উদ্ভব-বিকাশ ও উত্থান-পতনের উপর এমন সব উচ্চাঙ্গের গবেষণাগ্রন্থ রচনা করেছেন যে, একাডেমিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকেও বিশ্বপর্যায়ে এগুলোর মূল্য ও গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। এগুলো তো ভালো দিক এবং প্রশংসার বিষয়; কিন্তু অন্ধকার দিক এই যে, তাদের বেশীর ভাগের অবস্থা হলো, নিজেদের জীবনে ইসলামের শিক্ষা ও দীক্ষা বাস্তবায়নের বিষয়ে যত্ন ও মনোযোগ নেই। নামায-রোযা, আরকান-আহকামের প্রতি গুরুত্ব নেই। আমার তো প্রবল ্আশঙ্কা এই যে, মুরজিয়াদের মতই তারা না আবার আমলের গুরুত্বকেই অস্বীকার করে বসেন। শিক্ষক ও অধ্যাপকরূপে এধরনের লোকদের প্রতি আমি আশ্বস্ত নই। একই ভাবে ঐ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ে উদ্দেশ্য হচ্ছে এমন একটি আদর্শ শ্রেণী তৈরী করা যারা হতে পারবে দ্বীন ও দুনিয়া উভয় শিক্ষার হারানো যোগসূত্র। কিন্তু পরে আমরা কী  দেখতে পাই? দ্বীনের উপর দুনিয়ার ছাপ ও প্রভাব প্রধান হয়ে ওঠে। সঠিক ও ভারসাম্যপূর্ণ সামগ্রিকতা ও সুসমন্বয় দেখা যায় না, যা ছিলো মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। উদ্দেশ্য হচ্ছে এমন একটি আদর্শ শ্রেণী তৈরী করা যারা হতে পারবে দ্বীন ও দুনিয়া উভয় শিক্ষার হারানো যোগসূত্র। কিন্তু পরে আমরা কী  দেখতে পাই? দ্বীনের উপর দুনিয়ার ছাপ ও প্রভাব প্রধান হয়ে ওঠে। সঠিক ও ভারসাম্যপূর্ণ সামগ্রিকতা ও সুসমন্বয় দেখা যায় না, যা ছিলো মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য।

আযহারের শিক্ষাব্যবস্থা

আযহারের শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনা করতে গিয়ে শায়খ গাযালী বললেন, ‘ইসলামের উছূল ও মূলনীতি এবং প্রাথমিক ও মৌলিক বিষয়ের শিক্ষায় এখানে যতটা সময় ব্যয় করা হয় তার চে’ অনেক বেশী ব্যয় করা হয় প্রয়োজনহীন বিশদ আলোচনা পর্যালোচনায়, অর্থাৎ ‘কী, কেন, কখন, কীভাবে- এসব নিয়েই বেশী মগ্নতা থাকে। ফলে দ্বীনের মূল শিকড় ও তার উচ্চ চূড়া দু’টো সম্পর্কেই থেকে যায় জ্ঞানের অসম্পূর্ণতা। তাছাড়া ওখানকার দ্বীনী রুচিশীলতা, ঝোঁক ও প্রবণতা এবং আত্মনিবেদনের অনুভূতিও খুবদুর্বল ও ভঙ্গুর।’

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তাহলে আযহারের বৈশিষ্ট্য ঠিক কোন স্থানটিতে? তিনি বললেন, ‘(যদি বলতেই হয় তাহলে বলবো) আব্বাসী যুগের গ্রন্থবদ্ধ জ্ঞান, দর্শন, ভাষা ও ভাষাতত্ত্বই হচ্ছে তাদের বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্র।’

দ্বীনী দাওয়াত ও মাযহাবী মতবিরোধ; করণীয়

দ্বীনী দাওয়াত ও সংস্কার প্রচেষ্টা, যার আসল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের দ্বীনী হালাতের সংশোধন এবং আমল, আখলাক ও নীতি-নৈতিকতার উন্নতি সাধন, তো সেটা মাযহাবী ইখতিলাফ ও মতবিরোধ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকা উচিত, বরং অপরিহার্য; পুরো আলোচনায় এ  চিন্তা-বিন্দুতে আমরা উভয়ে একমত ছিলাম। এমনকি আমাদের মতে ঐ সমস্ত ফিকহী আলোচনা-গবেষণাও বেশী সামনে আনা উচিত নয়, যাতে ইজতিহাদের মতভিন্নতা ও বিরোধ রয়েছে। এ প্রসঙ্গে শায়খ গাযালী বললেন, ‘হয়ত আপনি অনুভব করে থাকবেন, আমার লেখায় যখন এসব প্রসঙ্গ আসে যাতে প্রশস্ততা ও শিথিলায়নের অবকাশ রয়েছে সেসব ক্ষেত্রে আমি অত্যন্ত সংযম ও সতর্কতা অবলম্বন করি। কারণ আমি বিশ্বাস করি, ইখতিলাফি ও মতবিরোধপূর্ণ বিষয়ে জড়িত হওয়া দ্বারা কাউম ও মিল্লাতের উন্নতি এবং উম্মাহ্র অগ্রগতি কিছুতেই অর্জিত হতে পারে না।

এরপর তিনি একটি কিতাবের প্রতি ইঙ্গিত করে সকৌতুকে বললেন, ঐ কিতাব সম্পর্কে আপনার কী মত যার নামই হলো, ‘জাতির উন্নতি ইমামের পিছনে ক্বিরাত-ফাতেহা পড়ার মধ্যে’?

নামের অভিনবত্বের বিষয়টি আমরা বেশ উপভোগ করলাম।

পর্দা সম্পর্কে শায়খ গাযালীর ভারসাম্যপূর্ণ মত

শরীয়াতে পর্দার যে বিধান তার সীমা ও প্রকৃতি সম্পর্কে শায়খ গাযালী মধ্যপন্থার অনুসারী। তাঁরস্পষ্ট কথা হলো, পর্দা শরীয়ত-সম্মত হওয়া উচিত, (বাড়াবাড়ি পর্যায়ে হওয়া উচিত নয়), যাতে নারীসমাজ স্বচ্ছন্দে দ্বীনী খেদমত ও কার্যক্রম এবং বিভিন্ন সমাজ- উন্নয়নের কাজে অংশগ্রহণ করতে পারে। উদাহরণ উল্লেখ করে তিনি বললেন, ‘ইখওয়ানী কর্মীরা যখন জেলজুলুম ও কারানির্যাতনের শিকার হলো তখন নারীসমাজ কী প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছেন, বন্দীদের পরিবার-পরিজনকে কীভাবে সান্ত¡না যুগিয়েছেন, সাহায্য-সহায়তা নিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছেন তা সবাই জানেন। ইখওয়ানের শুধু নারী কর্মীরাই ছিলেন বন্দীদের মধ্যে এবং তাদের পরিবার-পরিজনের মধ্যে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। এই আত্মত্যাগী ও নিবেদিতপ্রাণ নারীকর্মীরা না হলে বিপদগ্রস্ত পরিবারগুলোর সঙ্কট ও সমস্যা আরো গুরুতর আকার ধারণ করতো।

তিনি বললেন, ‘আমরা তাদের জন্য এই সীমা পর্যন্ত পর্দা জরুরি বলে ফতোয়া দিয়েছি যা সতর-সহায়ক, অর্থাৎ এমন লেবাস যা ঢিলাঢালা ও মর্যাদাপূর্ণ, যা পুরুষের অন্তরে শ্রদ্ধার উদ্রেক করে।’

দ্বীনী জোশ-জাযবা ও আত্ম-ত্যাগের অনুভূতির স্থায়িত্ব

এ বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হলো। তিনি আমার এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত হলেন যে, মিসরের জনসাধারণ, বিশেষ করে যারা পল্লীগ্রামে বাস করে তারা এমন সম্ভাবনাপূর্ণ কাঁচামাল যে, ঠিকমত কাজে লাগাতে পারলে বিরাট কাজ হতে পারে।

এরপর আমাদের মধ্যে এমন একটি বিষয়ে আলোচনা হলো যার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক হচ্ছে ঐ সব ইসলামী দল-সংস্থা ও জামাতের সঙ্গে যারা দ্বীনের তরক্কী ও উন্নতি-অগ্রগতির জন্য কাজ করছে। বিষয়টি এই যে, দ্বীনী ময়দানের কর্মীদের অন্তরে কোরবানী ও ত্যাগ-আত্মত্যাগের যে জাযবা ও উদ্যম-উদ্দীপনা, সবসময় তা এক রকম থাকে না। তাতে জোয়ার-ভাটা ও শীতলতা-উষ্ণতা দেখা দিতেই থাকে। অথচ যে কোন দ্বীনী মেহনতের জন্য কর্মীদের অন্তরের এ উদ্যম-উদ্দীপনাই হলো আসল জ্বালানী শক্তি, যাতে ঘটতি দেখা দিলে দলের কর্মকা-, জামাতের কার্যক্রম, এমনকি মেহনতের অস্তিত্বের বিষয়টিও ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়। তো এ ক্ষেত্রে কী কী উপায় ও কর্মপন্থা অনুসরণ করা যায় যাতে ত্যাগ ও আত্মত্যাগ এবং ঈছার ও কোরবানীর জোশজাযবা ও উদ্যম-উদ্দীপনা তাদের অন্তরে একমাত্রায় বিদ্যমান থাকে। সম্ভব হলে ক্রমে যেন বৃদ্ধি পেতে থাকে, কিন্তু কোনভাবেই যেন তাতে ভাটা না পড়ে?

সন্দেহ নেই খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। তো কতিপয় অন্তর্জ্ঞানী এর সমাধান নির্দেশ করে বলেছেন, ‘এমন আধ্যাত্মিক দীক্ষা ও রূহানী তারবিয়াতের কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে জামাতের সকল সদস্যের অন্তরে আত্মিক পুষ্টি ও রূহানী গেযার সরবরাহ চলতে থাকে। এমন আমল-অযিফা গ্রহণ করা উচিত যা জামাতের অভ্যন্তরে দ্বীনী জাযবা সর্বদা জাগরূক রাখে। উদ্যম-উদ্দীপনা, হৃদয়ের তাপ উত্তাপ এবং কলবের তড়প ও গরমি, কখনো যেন নিস্তেজ ও স্তিমিত না হতে পারে।

মোটকথা, জামাতের অভিভাবক, নীতিনির্ধারক ও কর্ণধারদের এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় আনতে হবে। কারণ এটাই হচ্ছে জামাতের রূহানী শক্তি ও প্রাণ-প্রেরণার মূল উৎস। ...’

বিদায়ের সময় হলো। সুন্দর কিছু সময় যাপনের পর আমরা বিদায়ের অনুমতি চাইলাম। তিনি এ আশা ব্যক্ত করে আমাদের বিদায় জানালেন যে, অচিরেই আমরা আবার মিলিত হবো।

জনৈক বয়োবৃদ্ধ ফিলিস্তীনী শায়খের সঙ্গে সাক্ষাৎ

ছালাতুল আছরের পর শায়খ আরিফ বিন আর্ব্দু-রহমান আল-শরীফের সঙ্গে দেখা করার জন্য গেলাম। তিনি হলেন, আমাদের বন্ধু সৈয়দ ইয়াসীন আল-শরীফেরদাদা। তিনি ফিলিস্তীনের অধিবাসী। একসময় তিনি ছিলেন মসজিদুল আকছার (হালকায়ে দরসের) মুর্দারিস এবং স্থানীয় প্রশাসকবর্গের তত্ত্বাবধায়ক। তিনি তখন প্রায় শতবর্ষী বৃদ্ধ (৯৫ বছর)। একজন শরণার্থীরূপে তিনি নতুন মিসরে তার সন্তান ও নাতি-নাতিনের সঙ্গে বসবাস করছেন। তিনি অত্যন্ত উষ্ণ আন্তরিকতা ও সম্মানের সঙ্গে আমাদের গ্রহণ করলেন এবং বারবার এ কথা বলে আমাদের অভিনন্দন জানালেন, ‘(আপনাদের আগমনে) আমরা ইসলামের সুঘ্রাণ পাচ্ছি।’

একটু পরপর ভিতরের আবেগে উদ্বেলিত হয়ে বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে যে কথাটি তিনি বলছিলেন আমাদের অন্তরে তা বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করলো। তাঁর কথাটি ছিলো, ‘মসজিদে আকছা আজ বেদনার্ত অসহায়’। বলছিলেন, আর অশ্রু সম্বরণের ব্যর্থ চেষ্টা করছিলেন।

আসলে সত্যিকারের মুসলিম যারা তাদের অন্তরে ফিলিস্তীনের ক্ষত কখনো শুকোতে পারে না।

অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে তিনি মসজিদুল আকছা ও হারামে ইবরাহীমীর ফাযায়েল বয়ান করলেন। ওখানে যে সাকীনা ও প্রশান্তি, যে আনওয়ার ও বারাকাত তিনি অনুভব করেছেন তা এমনভাবে তুলে ধরলেন যে, আল-আকছার ছালাত ও যিয়ারাতের জন্য আমাদেরও অন্তর ব্যাকুল অস্থির হলো।

একসময় দু‘আর অনুরোধ জানিয়ে আমরা তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিলাম। বয়সের ভার ও বার্ধক্যের দুর্বলতা সত্ত্বেও দরজা পর্যন্ত এগিয়ে এসে তিনি আমাদের বিদায় জানালেন।

অবস্থানক্ষেত্রে ফেরার পথে আমরা মুহাম্মাদ ফরীদ সড়ক এবং ফুয়াদ সড়ক অতিক্রম করলাম। সেখানে দেখা গেলো, সজ্জা ও আলোক-সজ্জার চূড়ান্ত রূপ। সিনেমাঘরে দর্শকের, যাকে বলে, উপচে পড়া ভিড়। প্রবেশপথে দীর্ঘ লাইন। এদিকে সড়কে লেটেস্ট মডেলের অসংখ্য গাড়ি ছুটে চলেছে, আসছে বা যাচ্ছে। দোকানের সাইনবোর্ডে আরবী হরফ না থাকলে সহজেই মনে করা যেতে পারতো, আমরা বড় কোন ইউরোপীয় শহরে আছি।

ড. মুহম্মদ আহমদ গামরাবী-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ

বৃহস্পতিবার/২-৫-৭০ হি./ ৭-২- ৫১ খৃ.

সকাল দশটার দিকে আমরা ড. মুহম্মদ আহমদ গামরাবীর আব্বাসিয়াস্থ বাসভবনে গেলাম। তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়েছিলো ছাত্রাবস্থায় তাঁর কিতাব ‘জাহেলি সাহিত্যের বিশ্লেষণধর্মী সমালোচনা’ পড়ার মাধ্যমে। তারপর তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধ ও ভূমিকা পড়েছি, যাতে তাঁর দ্বীনী গায়রাতের যথার্থ প্রতিবিম্বন ঘটেছে।

যেমন আশা করেছিলাম তেমনি তাঁকে দেখতে পেলাম; শিক্ষিত, সংস্কৃতিবান ও ঈমানী চেতনায় বলীয়ান একজন মুমিন।

দীর্ঘ সময় বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হলো। তিনি আন্তরিকতা ও উদারতার সঙ্গে সময় দিলেন। একপর্যায়ে আমি কতিপয় লেখক-সাহিত্যিক ও সাংবাদিক সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম, চিন্তায়, বিশ্বাসে যারা দ্বীন থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে। কারো কারো কলম-চালনায় তো রীতিমত ইসলাম ও ইসলামী আকীদা-বিশ্বাসকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা রয়েছে। অথচ নামে, পরিচয়ে, মৃত্যুতে, জানাযায়, কাফন-দাফনে তারা মুসলিম! এমন কেন হলো? এমন কেন হয়?

তিনি বললেন, ‘তারা আসলে তাদের পূর্ববর্তী শিক্ষা-দীক্ষার ‘বিষফল’।

আমি বললাম, ‘কিন্তু তাদের দু‘একজন তো আযহারে শিক্ষা অর্জনকারী!’ তিনি বললেন, ‘তা ঠিক, তবে যদ্দুর জানি, আযহারের শিক্ষাজীবনেও তারা প্রশ্নবিদ্ধ ছিলো। আযহারের প্রতিও তাদের কোন শ্রদ্ধা, বা একাত্মতা ছিলো না। কোরআন-সুন্নাহর জ্ঞানচর্চার প্রতি তাদের কোন মনোনিবেশ ছিলো না; তাদের সমস্ত আগ্রহ নিবদ্ধ ছিলো ভাষা ও সাহিত্য এবং শিল্প ও কাব্যচর্চার প্রতি। আযহারের পরিবেশে থেকেও তা-ই নিয়ে তারা ডুবে থাকতো।’

তিনি আরো বললেন, ‘দীর্ঘ দিনথেকে আমাদের এখানে শিল্প-সাহিত্য ও কাব্যচর্চা ধর্মবিমুখতার শিকার। আব্বাসী যুগের আবু নাওয়াস এবং তার ‘সতীর্থ’দের কবিতায় নিমগ্ন থেকে যাদের সময় কাটে তাদের সম্পর্কে কীভাবে আশা করা যায় যে, তারা হবে ধর্মপ্রাণ এবং দ্বীনের সেবায় নিবেদিত? তদুপরি আযহার থেকে তারা চলে যায় আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর স্কলারশিপ নিয়ে সেখান থেকে চলে যায় ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচ্যবিদ্যাবিশারদদের সংস্পর্শে। ফল যা হওয়ার তাই তো হবে!!’

আমি বললাম, ‘আপনিও তো ঐ যুগেরই ‘ফসল’! আপনিও তো শিক্ষা-দীক্ষার ঐ পরিবেশেই প্রতিপালিত! আপনি কীভাবে এমন বৈরী পরিবেশের উপর জয়ী হলেন?’

তিনি বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, ‘আমার বিষয়টি তাদের সঙ্গে তুলনা করা ঠিক নয়। কারণ আমার পরিবার ছিলো দ্বীনী ও ইলমী পরিবার। আমার ভাইয়েরা আযাহারে শিক্ষার্থী ছিলেন। আমিও তাদের সঙ্গে আযহারে যাওয়া আসা করতাম। আমি যে আযাহারকে দেখেছি তা ছিলো আজকের আযহার থেকে যথেষ্ট ভালো। আযহারের যে সকল ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য আমি লাভ করেছি তারা ছিলেন অন্য প্রজন্মের।

আসলে আমি প্রভাব গ্রহণ করেছি পারিবারিক জীবন থেকে এবং সেখানকার সুন্দর দ্বীনী ও ইসলামী পরিবেশ থেকে।’

আমি বললাম, ‘দ্বীন ও আহলে দ্বীনের প্রতি বিদ্রোহী হয়ে ওঠার পিছনে হয়ত মূল কারণ হচ্ছে মুসলিম সমাজের বর্তমান অবক্ষয় -অধঃপতনের বেদনাদায়ক চিত্র এবং নৈরাশ্যজনক পরিবেশ-পরিস্থিতি। কারণ এটা তো সত্য যে, মানুষ যখন সংবেদনশীল, অস্থিরচিত্ত ও দুর্বল ¯œায়ুর অধিকারী হয় তখন এগুলো তারা মেনে নিতে পারে না। সমাজ ও ধর্ম এবং দ্বীন ও দ্বীনদার উভয়ের মাঝে তারা গুলিয়ে ফেলে, আর না

বুঝেই বিদ্রোহ করে বসে স্বয়ং দ্বীনের বিরুদ্ধে।

তিনি বললেন, ‘তাহলে তারা বিপরীত দিকে কেন বিদ্রোহী হয় না। অর্থাৎ দ্বীনের পক্ষ গ্রহণ করে দ্বীন থেকে বিচ্যুত সমাজের বিরুদ্ধে কেন রুখে দাঁড়ায় না? কেন তারা দ্বীনের দাওয়াত এবং সমাজের পরিবেশ সংশোধনের আন্দোলন শুরু করে না?’

আমি বললাম, ‘এটা তো আসলে তার দ্বারাই হয় যাকে আল্লাহ তাওফীক দান করেন।’

আদব ও সাহিত্যকে দ্বীনমুখী করা কীভাবে সম্ভব?

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আদব ও সাহিত্যকে, যা আজ ধর্মহীনতার বাহন হয়ে আছে, কীভাবে দ্বীনমুখী করা সম্ভব?’

তিনি বললেন, ‘শিল্প ও সাহিত্য তখনই দ্বীনমুখী হতে পারে যখন ব্যাপক দ্বীনী আন্দোলন গড়ে তোলা যাবে এবং সমাজে ইসলামী জীবনধারার সুপ্রতিষ্ঠা সম্ভব হবে। কারণ লেখক-সাহিত্যিকগণ তাই লিখবেন এবং তাদের কলম থেকে তাই বের হবে যার চাহিদা সমাজজীবনে থাকবে। সাহিত্য সবসময় ‘বাজারচাহিদা’ অনুসরণ করে এবং লেখক সাধরণ পাঠকবর্গের চাহিদা চিন্তা করেই কলম চালনা করেন। তো মানুষের মধ্যে যখন দ্বীনের প্রতি এবং ইসলামী চিন্তাধারার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হবে তখন লেখক-সাহিত্যিক তা-ই সৃষ্টি করবেন যার প্রতি পাঠকের মুগ্ধতা ও মূল্যায়ন রয়েছে।’

অর্থাৎ তাঁর মতে পাঠককে কেন্দ্র করে সাহিত্য গড়ে ওঠবে, সাহিত্যকে কেন্দ্র করে পাঠক গড়ে ওঠবে না। আরো স্পষ্ট করে যদি বলি, সমাজবিপ্লব সাহিত্য সৃষ্টি করবে, সাহিত্য সমাজবিপ্লব সৃষ্টি করবে না। কিন্তু...!

(আমার মনে হয়, যিনি সাহিত্যিক এবং সাহিত্যের সাধক, তিনি পাঠক তৈয়ার করেন; আর যারা নিছক লেখক বা গ্রন্থজীবী, পাঠক-চাহিদা তাদের তৈরী করে। -অনুবাদক)

আযহারী প্রশাসনের কাছে প্রস্তাব

জানতে চাইলাম, ‘আযহারের প্রতি আপনার পরামর্শ কী? এবং কোন্ জিনিসটিকে আযহারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের জন্য আপনি সহায়ক মনে করেন?

তিনি বললেন, ‘শায়খ যাওয়াহিরীর আমলে আমি প্রস্তাব রেখেছিলাম আযহারী শিক্ষকদের জন্য প্রশিক্ষণ -কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার, যাতে আযহারে যেসব বিষয় পড়ানো হয় ঐসব বিষয়ে যোগ্য শিক্ষক তৈরী করা সম্ভব হয়। তাতে আযহার ঐ সমস্ত শিক্ষকের ‘সেবাপ্রয়োজন’ থেকে মুক্ত হয়ে যাবে যাদের চিন্তা-চেতনা ও ধ্যানধারণা আযহারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এবং নয় আযহারের শান-উপযোগী। যে সমস্ত শিক্ষক নিজেরাই দ্বীন ও দ্বীনী চিন্তার প্রতি আশ্বস্ত নন, ছাত্রদের মধ্যে তারা শুধু দ্বিধা-সংশয়ের পরিবেশই সৃষ্টি করতে পারেন। ইসলামী আকীদা-বিশ্বাস এবং আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের আবহ ও মনমানসিকতাই শুধু তৈরী করতে পারেন। ফলে ছাত্রদের মধ্যে দ্বীন সম্পর্কে ভুল ধারণা, আস্থাহীনতা ও অস্থিরতার অবস্থা তৈরী হয়, যার প্রভাব অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। পক্ষান্তরে যখন শিক্ষকগণ ঐ আযহারী প্রশিক্ষণকেন্দ্র থেকে বের হয়ে আসবেন তখন তারা প্রকৃতি বিজ্ঞানকে পড়াবেন কোরআনের আয়াতের তাফসীর ও ব্যাখ্যারূপে। দ্বীনের সঙ্গে, ইসলামের পরম সত্যের সঙ্গে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমন্বয় সাধনে তারা সক্ষমতা অর্জন করবেন। এভাবে বর্তমানের যে সমস্যা তার একটা সুন্দর সমাধান বের হয়ে আসবে।’

শায়খ বললেন, ‘কিন্তু আমার মনে হয়েছে, এরূপ একটি বাস্তবধর্মী প্রস্তাব প্রশাসনিক জটিলতা ও লালফিতার দৌরাত্ম্যের শিকার হয়েছিলো। তাই সেটা আর বাস্তবায়নের মুখ দেখতে পায়নি। তবে এখনো আমার একই মত।’

ইসলামী প্রাচ্যে বিজ্ঞানগবেষণার দৈন্য

অন্য প্রসঙ্গে তিনি বললেন, ‘ইসলামী প্রাচ্যে শুধু প্রকৃতি- বিজ্ঞানের চর্চা-গবেষণা ও অধ্যয়ন-সাধনার অভাব। এখন আমাদের কর্তব্য হলো, প্রকৃতিবিজ্ঞানের সকল শাখাকে বিজ্ঞান হিসাবেই শিক্ষা করা, পাশ্চাত্যের বিদ্যা হিসাবে নয়। পাশ্চাত্যের শিল্প-সাহিত্য, সমাজবিদ্যা ও সংস্কৃতি, এসবে আমাদের কোন প্রয়োজন নেই। আমাদের প্রয়োজন শুধু সর্বপ্রকার বিজ্ঞানের শিক্ষা অর্জনের, আর তাতে পাশ্চাত্যের কোন দখলস্বত্ব নেই যে, অন্য কেউ তা অর্জন করতে পারবে না, যেমন আমাদের দখলস্বত্ব ছিলো না, যখন ওরা আমাদের কাছ থেকে নিয়েছে। পক্ষান্তরে সমাজবিদ্যা ও শিল্পসাহিত্য, এগুলোর মধ্যে রয়েছে পাশ্চাত্যের জীবন, দর্শন ও সংস্কৃতির ছাপ, সুতরাং তা আমরা ছুঁয়েও দেখতে চাই না।’

তিনি বললেন, ‘আরেকটা কথা হলো, বিজ্ঞান-অধ্যয়নের ক্ষেত্রে পদ্ধতি হবে এই যে, আমরা তা শিখবো কোরআনের আয়াতের তাফসীর ও ব্যাখ্যারূপে, সত্যায়ন -কারীরূপে নয়। তাছাড়া বিজ্ঞানের যে তত্ত্ব স্বতঃসিদ্ধ সত্যরূপে সুপ্রমাণিত, আর যেগুলো এখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণার পর্যায়ে রয়েছে সেগুলোর মধ্যে পার্থক্য করার যোগ্যতা আমাদের থাকতে হবে এবং প্রতিটিকে নিজ নিজ স্থানে রেখে শিখতে হবে।

মিসরের অনুকরণবিষয়ে সতর্কবাণী

খুব গুরুত্ব দিয়ে ড. গামরাবী বললেন, ‘পাকভারত উপমহাদেশ ও ইন্দোনেশিয়ার ভবিষ্যত সম্পর্কে আমরা বড় আশাবাদী। ...’

আমি বললাম, ‘এখন পাকভারতে এমন কিছু দ্বীনী কাজ ও কার্যক্রম চলছে যা মিসরেও দেখা যায় না।’

তিনি বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়ে বললেন, ‘তবে মিসরকে অনুকরণের বিষয়ে ঐ সকল দেশ ও জনগোষ্ঠী-কে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কোন বিষয়ের বৈধতার জন্য তারা যেন মিসরকে প্রমাণরূপে গ্রহণ না করে শুধু এই যুক্তিতে যে, মিসরে আযহারের মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তো আযহারের উপস্থিতিতে মিসর যদি এ পথ গ্রহণ করতে পারে তাহলে আমরা কেন পারবো না! তাতে অসুবিধা কোথায়? (অসুবিধা এই যে, আযহার এখন হুকুমতের মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তাছাড়া দ্বীন ও শরীয়াতকে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান ছাড়পত্র দিতে পারে না, দ্বীন ও শরীয়াতই বরং ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ছাড়পত্র দেয়। -অনুবাদক)’

আযহারের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উৎকণ্ঠা

আযহার ও তার ভবিষ্যত সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ড. গামরাবী বললেন, ‘আযহার-বিরোধিতা এখন প্রবল আকার ধারণ করেছে এবং এর বিরুদ্ধে নানামুখী চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র চলছে। আযহারকে যে বিভিন্ন কলেজে এবং বিভিন্ন বিদ্যালয় ও বিভাগে বিভক্ত করে বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে, এটা আসলে ইংরেজদের কারসাজি। কারণ ইংরেজ যখন দেখলো, একটা শহরের একটা স্থানে দ্বীনের ইলম হাছিলের নামে এত বিশাল ‘ছাত্রসমাবেশ’ হচ্ছে, যা প্রয়োজনের সময় ইসলামের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ শক্তিরূপে সামনে আসতে পারে। এটাকে নিজেদের জন্য বড় বিপদ ও হুমকি বলে তারা মনে করলো।

তখন তারা সুদূরপ্রসারী চিন্তা করে বিভিন্ন শহরে শাখা প্রতিষ্ঠা করার নামে আযহারকে এভাবে বিভক্ত করে দিয়েছে, যাতে আযহার ও তার ছাত্ররা বিশাল কোন শক্তিরূপে সামনে আসতে না পারে। ইংরেজরা যুক্তি তুলে ধরে যে, প্রত্যেক শাখায় ঐ অঞ্চলের ছাত্ররা শিক্ষা অর্জন করবে। বিপুল ব্যয় স্বীকার করে তাদের কায়রো শহরে আসতে হবে না। এতে শিক্ষাব্যয়ের ক্ষেত্রে সাশ্রয়ের দিক থেকে ছাত্র-অভিভাবকদের সুবিধা অবশ্যই হলো, তবে আযহারের অবিভক্ত শক্তি খ-িত হয়ে গেলো। ...’

বিদায়ের সময় গামরাবীকে আমি মাযা খাসিরা-এর নোসখা হাদিয়া দিয়ে ফিরে এলাম। তিনি উষ্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের বিদায় জানালেন।

কেল্লা ও তার মসজিদ

আমরা ড. গামরাবীর বাসস্থান থেকে বের হয়ে কেল্লার দিকে রওয়ানা হলাম। মুহম্মদ আলী পাশার আমলে এ কেল্লা ছিলো তার শাসনের মূলকেন্দ্র। কেল্লার শানদার মসজিদটি আমরা পরিদর্শন করলাম। এর সামগ্রিক নির্মাণশৈলী, স্থাপত্যসৌন্দর্য ও সাজসজ্জা মুগ্ধ হওয়ারই মত। এমনই মযবূত বুনিয়াদের উপর এটি নির্মিত যে, কালের ঝাপটা মুকাবেলা করে এখনো তা পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় টিকে আছে। কোন সন্দেহ নেই, এ মসজিদ স্থাপত্য-শিল্পের এক জীবন্ত নমুনা।

এরপর আমরা ঐ বিশাল ভবনের দিকে গেলাম, খিদভী হুকুমতের সময় যা ছিলো প্রশাসনিক ও দাফতরিক কর্মকা-ের প্রাণকেন্দ্র। এখানে বাইরে দাঁড়িয়ে আমরা পুরো কায়রো শহর দেখতে  পেলাম। বড় বড় মসজিদ এবং উঁচু উঁচু মিনারের দৃশ্য বড়ই মনোমুগ্ধকর ছিলো। তবে একসময় সারা অন্তরে কেমন যেন একটা বিষণœতা ছেয়ে গেলো। প্রতিটি মিনার, মনে হলো, মুসলিম উম্মাহ্র বিগত গৌরবের শোকপ্রতীক। দূর থেকে জীযা-এর পিরামিডও দেখা যাচ্ছিলো, আমাদের কাছে যার বার্তা ছিলো এই যে, আল্লাহ্র মোকাবেলায় পৃথিবীর কোন তাপ ও প্রতাপ স্থায়ী হতে পারে না। একসময় না একসময় তা পাথরের স্তূপ হয়ে যায়। শীতকাল ছিলো। সকালের মিষ্টি রোদ ছিলো। সোনালী রোদের চাদর যেন কায়রো শহরকে আবৃত করে রেখেছিলো। কোন শহরকে একটু উঁচু থেকে দেখার যখনই সুযোগ হয়, জীবনের ক্ষুদ্রতা এবং মানুষের উচ্চাভিলাষের তুচ্ছতা চোখের সামনে যেন স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

কেল্লার কুতুবখানা

এর পর অল্প সময়ের জন্য আমরা কেল্লার কুতুবখানায় প্রবেশ করলাম। সেখানে الوقائع المصريـة এর ভলিউমগুলো দেখার সুযোগ হলো। এ পত্রিকাটি ১৮৮২ সনে মুহম্মদ আলী কায়রো থেকে প্রকাশ করেছিলেন। প্রথমে তুর্কী ও আরবী দু’টি ভার্সনে প্রকাশিত হতো। পরে তুর্কী ভার্সনটি বাদ দেয়া হয়। এর সম্পাদনার দায়িত্বে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে সবচে’ খ্যাতিমান হলেন শায়খ রিফা‘আ তাহতাবী, শায়খ হাসান আল-আত্তার, উস্তায আহমদ ফারিস শিদয়াক ও শায়খ মুহম্মদ আবদুহু। এ পত্রিকাটির নাম আমরা দেখতে পেতাম ‘তারীখুল আদাবিল আরাবী’ এবং ‘তারীখু মিছর সিয়াসী’ কিতাবে। তখন থেকে পত্রিকাটির নোসখা দেখার আগ্রহ ছিলো, আজ তা পূর্ণ হলো। আল-লিওয়া পত্রিকার ভলিউমও দেখলাম, যার তত্ত্বাবধান করতেন এবং যাতে লেখালেখি করতেন মরহূম মুস্তফা কামিল।

মুআইয়িদ পত্রিকার ভলিউমও দেখা হলো। আহমদ যাকী পাশার ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারও দেখার সুযোগ হলো, যা তিনি  কেল্লার কুতুবখানা-কে দান করে গিয়েছেন, একসময় যা ছিলো দারুল উরূবাহ নামে তাঁর জৌলুসপূর্ণ বাসভবনের শোভা ও সৌন্দর্য। সম্ভবত তাঁর মৃত্যুর পর এ বিশাল গ্রন্থাগারের ‘উপযুক্ত’ দেখভাল করবে, এমন কেউ ছিলো না।

সামরিক জাদুঘর

তারপর আমরা সামরিক জাদুঘর দেখলাম। ফেরাউনী যুগ, আরবযুগ, মামলূক যুগ এবং আলাবী যুগ- এভাবে বিভিন্ন যুগে ভাগ করে সাজানো হয়েছে। মিসরের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে এখানে আমরা বেশ কিছু মূল্যবান তথ্য অর্জন করলাম। কিছু পুরোনো মানচিত্র ছিলো যার ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক মূল্য অনেক।

আমাদের সঙ্গে ছিলেন শায়খ আহমদ উছমানের পুত্র যাকারিয়্যা কামাল। এই জাদুঘর সম্পর্কে আমাদের সবার মধ্যে তার জানাশোনা ছিলো বেশী। কারণ মাধ্যমিকের সহপাঠীদের সঙ্গে কয়েকবার তিনি এটি পরিদর্শন করেছেন শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে। তাই তিনি বেশ স্বচ্ছন্দে সবকিছুর বিবরণ দিয়ে গেলেন। বেশ উপকারী ও উপভোগ্য পরিদর্শন হলো।

বিভিন্ন মসজিদ ও মাকবারা পরিদর্শন

আমরা যোহর আদায় করলাম সুলতান হাসান মসজিদে। তারপর দেখতে গেলাম রিফা‘ঈ মসজিদ। এখানে রয়েছে রাজা ফুয়াদ এবং তার পিতা ইসমা‘ঈল খিদভী ও অন্যান্যের মাকবারা। তারপর ইমাম শাফেয়ী রহ.-এর মসজিদ পরিদর্শন করলাম এবং তাঁর কবর যিয়ারাত করলাম। অল্প সময়ের মধ্যে দ্রুত বহু মাকবারা দেখা হলো। আমার ভিতরে তখন যে অনুভূতি হলো তা এই যে, ইতিহাসের প্রত্যেক কীর্তিপুরুষ ও সাধুজনের জন্য যদি আলাদা মাকবারা তৈরী করা হতো তাহলে মৃতদের শহর হতো জীবিতদের শহর থেকে অনেক বড়। এমনকি জীবিতরা হয়ত তখন ঘর তোলার জন্য একটুকরো জমিও পেতো না!

ইসলাম ভালোই করেছে যে, মাকবারা নির্মাণের প্রবণতাকে উৎসাহিত করেনি। তাছাড়া আল্লাহ্র রাসূল উম্মতের প্রতি বড় অনুগ্রহ করেছেন যে, মাকবারা-প্রীতি সম্পর্কে তিনি কঠিন সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন এবং এ সম্পর্কে কঠোর ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। এই বলে তিনি ইহুদি-নাছারাদের সঙ্গে সম্পর্কহীনতা ঘোষণা করেছেন যে, যখনই তাদের মধ্যে কোন পুণ্যবান মানুষ মৃত্যুবরণ করতো, তার কবরকে কেন্দ্র করে তারা মসজিদ নির্মাণ করতো।

জুমাবার/৩-৫-৭০ হি. ৮-২-৫১ খৃ.

ফুসতাত ও জামে আমর ইবনুল আছ রা.

আজ সকালে আমরা, ক’জন মিসরীয় বন্ধুর সঙ্গে ফুসতাত শহরদেখতে গেলাম। প্রথমে প্রবেশ করলাম জামে আমর ইবনুল আছ রা. কর্তৃক স্থাপিত মসজিদে, যার ভবন এখন বড় শানদার। যুগে যুগে মিসরের শাসকগণ একে সম্প্রসারণ করে বর্তমান আয়তন ও অবয়বে এনেছেন। এটি এখন মূল জামে আমর ইবনুল আছ থেকে অনেক বেশী প্রসারিত। তবে এখনো তা হিজাযী ছাপ ধারণ করছে, যা দেখলে মিনা-এর মসজিদে খায়ফ এবং হারামাইনের বিভিন্ন মসজিদের কথা মনে পড়ে যায়। এই মসজিদে আমরা অপূর্ব আত্মিক প্রশান্তি ও রূহানী সুকূন এবং আশ্চর্যরকম কলবি কাশিশ্ ও হৃদয়াকর্ষণ অনুভব করেছি, যা মিসরের অন্য কোন মসজিদে অনুভব করিনি। এটা ফুল-নকশা ও সাজসজ্জার বাহুল্য থেকে মুক্ত, যাকে বর্তমান যুগে আর্ট ও শিল্প মনে করা হয়। এমন সাধারণ ও আড়ম্বরহীন, অথচ ভাবগম্ভীর মসিজদ মিসরে আর নেই।

বস্তুত এটি হলো মিসরের ভূমিতে সেই প্রথম মসজিদ যা তাকওয়ার বুনিয়াদের উপর নির্মাণ করা হয়েছে, যেন তা তাওহীদের প্রাণকেন্দ্র হতে পারে, আর তাতে শুধু এক আল্লাহর ইবাদত হয়।

এ মসজিদের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিলো ঐ সমস্ত পবিত্র হাতে যা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র হাতের স্পর্শে বারবার ধন্য হয়েছে এবং নবীর হাতে বাই‘আত গ্রহণের সৌভাগ্য অর্জন করেছে।

তবে আফসোস হলো এটা দেখে যে, মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ে কর্তৃপক্ষ অমার্জনীয় অবহেলার পরিচয় দিচ্ছে। চারপাশে গান্দা ময়লা আবর্জনার স্তূপ লেগে আছে, যেন এর দেখভাল করার কেউ নেই! শুনেছি, রাজা ফারূক প্রতিবছর এখানে জুম্আুতুল বিদা আদায় করার জন্য আগমন করেন। হয়ত ব্যবস্থাপকগণ তখন কালীন-গালিচা বিছিয়ে অযত্ন অবহেলার সব ছাপ ঢেকে রাখেন। তাই রাজার কোন খবরই হয় না।

কিছু বেহুদা রসম

একটি খুঁটি দেখলাম, লোহার মজবুত জাল দিয়ে ঘেরাও করা। আমাদের বলা হলো, শ্রমিকদের দায়িত্ব ছিলো, এটিকে বহন করে যথাস্থানে স্থাপন করা, কিন্তু বেশী ওজনের কারণে সম্ভব হয়নি। এতে শ্রমিকদল ধরে নিলো যে, খুঁটিটা নিজের ভিতরের কোন ‘খবিছি’র কারণে মসজিদে দাখেল হতে অস্বীকার করছে। তখন থেকে যুগপরম্পরায় মানুষ শাস্তি ও সায়েস্তা হিসাবে এটাকে জুটাপেটা করে আসছিলো। মিশরীয় সরকার ভালো একটা কাজ করেছে এরূপ হাস্যকর বিদ‘আত বন্ধ করে দিয়ে। এমনই ‘জিহাদি জোশ’ যে, লোহার জাল দ্বারা বেচারা খুঁটিকে জুতার হামলা থেকে রক্ষা করতে হয়েছে! হায়, এই জোশে জিহাদ যদি...!

অন্য একটি কোণে দেখা গেলো বিপরীত অবস্থা। কথিত আছে, ওখানে সাইয়েদা নাফীসা রাহ. বসে মানুষের বিভিন্ন উপকার করতেন। ঐ খুঁটিকে নাকি মানুষ জিহ্বা দিয়ে চাটতো। চেটে চেটে ক্ষয়ই করে ফেলেছে। হুকূমত লোহার জালি লাগিয়ে এ বিদ‘আতও বন্ধ করেছে। ভালো কাজকে ভালো তো বলতেই হবে, হোক না পরিমাণে তা সমুদ্রের মধ্যে বিন্দু!

সেই ফুসতাতে

মসজিদ থেকে বের হয়ে আমরা পুরোনো মিসরে অবস্থিত ফুসতাত শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। এটা ছিলো ঐ অঞ্চলের প্রথম ইসলামী শাসনকেন্দ্র। মাসীহী কবরস্তান, ছালীব ও গীর্জার পাশ দিয়ে আমরা এগিয়ে গেলাম। ইসলামের প্রথম সময়ের স্মৃতি ধারণকারী এবং ইতিহাসের গৌরব ও মর্যাদা রক্ষাকারী ফুসতাতের জনপদে যদি ইসলামী জীবনধারার কিছু ছাপ ও প্রভাব বিদ্যমান থাকতো, কত না ভালো হতো! অন্তরে কত না প্রশান্তির অনুভূতি হতো! কিন্তু ...

ফুসতাতের সীমানায় প্রবেশ করে দীর্ঘ সময় আমরা বিভিন্ন ধ্বংসাবশেষ ও বিরানভূমির পাশ দিয়ে হেঁটে গেলাম। মনের ভিতরে তখন কী রকম অনুভূতি যে হলো! কল্পনায় যেন দেখতে পেলাম ছাহাবা-মুজাহিদীনের তাঁবু-খীমা ও সেনাছাউনী! হয়ত এখানে ছিলো যুবায়র ইবনুল আওয়ামের খীমা, আর ওখানে ওবাদা ইবনে ছামিতের তাঁবু। ওই যে ভগ্নাবশেষ, হয়ত ওখানে ছিলো মুহম্মদ ইবনে মাসলামার অবস্থান, আরো দূরে যে উঁচু ভূমি, হয়ত ওখানে ছিলো আমীরে লশকর হযরত আমর ইবনুল আছের বাসস্থান। বাসস্থানও ছিলো এমন যেখানে আজকের কায়রোর কোন ফকীর মিসকীনও থাকতে চাইবে না! কিন্তু এই গরীবখানার বাসিন্দার হাতেই বিশাল রোমসা¤্রাজ্যের পতন ঘটেছিলো! তিনিই জয় করেছিলেন এই বিরাট উপত্যকা! তাঁর স্বনামধন্য পুত্র আব্দুল্লাহ ইবনে আমর হয়ত এঘরেই ইবাদত করেছেন, আর হাদীছ শুনিয়েছেন। হয়ত ...!!

কল্পনা বাস্তবকে পরাস্ত করতে পারে না

কিছু সময়ের জন্য হলেও ভুলে যেতে চেয়েছিলাম যে, আমি আধুনিক যুগের মিসরভূমিতে আছি। চিন্তাকে কেন্দ্রীভূত করে আমি চেয়েছিলাম বর্তমানের আবিলতা থেকে মুক্ত হয়ে অতীতের সেই গৌরবের যুগে, সেই নূরানী পরিবেশে কিছু সময় যাপন করতে। কিন্তু কল্পনা কতক্ষণ বাস্তবকে চাপা দিয়ে রাখতে পারে! আমার কল্পনা শেষ পর্যন্ত বাস্তবের সামনে পরাজয় স্বীকার করলো। হঠাৎ দেখি, আমি তো এ যুগে আধুনিক মিসরের মাটিতেই দাঁড়িয়ে আছি! চারপাশের সবকিছু দেখতে পাচ্ছি, শুনতে পাচ্ছি!

আমরা ঐ সকল প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের কাছে গেলাম যা হারিয়ে যাওয়া শহরকে খনন করে তুলে আনা হয়েছে।

এখানে আমরা কিছু সময় অবস্থান করলাম এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছ থেকে ফুসতাতের ক্রম- বিবর্তন সম্পর্কে কিছু ঐতিহাসিক তথ্য পেলাম। উমাইয়া ও আব্বাসী আমলের ফুসতাত সম্পর্কেও তারা তাদের জানা তথ্য আমাদের জানালেন।

এরই মধ্যে একটি গাড়ী এসে থামলো। কয়েকজন তুর্কী স্কলার ও প-িৎ ব্যক্তি গাড়ী থেকে নামলেন। তাদের সঙ্গে ছিলেন প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ের বিশেষজ্ঞ প্রফেসর হাসান আব্দুল ওহ্হাব। তাঁর সঙ্গে আমাদের বন্ধু আহমদ উছমানের পরিচয় ছিলো। তিনি তাঁর সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। তিনি উষ্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের খোশামদেদ জানালেন এবং আরব প্রত্নতত্ত্ব পরিদর্শনে তাঁর সেবা ‘নিবেদন’ করলেন। এ অনুগ্রহের জন্য তাঁকে আমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলাম এবং আগামী সোমবার তাঁর সঙ্গে দেখা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নিলাম।

এখান থেকে আমরা ‘শিরকিস’-এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম এবং শায়খ সোলায়মান মসজিদে জুমা আদায় করলাম। বেশ বড় মজমা ছিলো। এখানেও ‘হিন্দুস্তানের মেহমান এবং মুমিন ভাই’ পরিচয়ে আমাদের ইকরাম করা হলো। মজমার উদ্দেশ্যে কিছু দ্বীনী আলোচনা পেশ করলাম, যাতে হিন্দুস্তানের দ্বীনী মেহনতের কথা উঠে এলো। এ মেহনতের ব্যতিক্রমী কর্মপন্থা সম্পর্কে আলোচনা করলাম। তারপর এর বড় বড় উপকার এবং সে সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতা সবিস্তারে তুলে ধরলাম। সবাই বেশ আগ্রহের সঙ্গেই আলোচনা শুনলো বলে মনে হলো।

দুপুরের দস্তরখান শায়খ আহমদ উছমানের ঘরে সম্পন্ন হলো, যার বড় গুণ হলো অনাড়ম্বরতা ও আন্তরিকতা।

এরপর আমরা শাবাবু সাইয়েদিনা মুহম্মদ (মুহম্মদী যুবদল)-এর দফতরে গেলাম। দুর্ভাগ্যক্রমে সেখানে কাউকে পাওয়া গেলো না। অবশ্য আমাদের যাওয়াটাও পূর্বনির্ধারিত ছিলো না। সেখানে

আমরা সাক্ষাৎপত্র (ভিজিটিং কার্ড) রেখে এলাম। এরপর গেলাম দারুল হিদায়াতিল ইসলামিয়্যাহ-এর দফতরে আল্লামা সাইয়েদ খিযির হোসায়নের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে। তাঁকেও পাওয়া গেলো না, অথচ ...!

পাওয়া ও না পাওয়া, দু’টো থেকেই আমরা সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারি, যদি জীবনের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি হয় স্বচ্ছ।

সাইয়েদা যায়নাব মসজিদে মাগরিবের নামায আদায় করলাম। মুমিন যখন আযানের ডাকে সাড়া দিয়ে মসজিদে যায়, এ অনুভূতি তার অন্তরে বড় প্রশান্তি আনে যে, তার মাওলা তার ইন্তিযারে আছেন। এখানে সাইয়েদা যায়নাব মসজিদে আমার অন্তরেও এ প্রশান্তির অনুভূতি হলো। বান্দাদের তালাশ করেও পেলাম না; মাওলাকে তালাশ না করেও আমার ইন্তিযারে পেলাম!

অনেক বড় এবং অনেক সুন্দর মসজিদ এটি। বরং কেল্লার মসজিদের পর এটিই কায়রোর সুন্দরতম মসজিদ।

৪/৫/৭০হি. ১০/২/৫১ খৃ. শনিবার

আজ দিনের বেশীর ভাগ ব্যয় করলাম দু’টি স্থানে আমার দু’টি পুস্তিকার প্রুফ সংশোধন করে। প্রথমটি হলো দারুল কুতুবিল আরাবী প্রকাশনালয়ে بـين العـالـم وجـزيـرة العـرب (বিশ^ ও আরব উপদ্বীপের সংলাপ)-এর প্রুফ, দ্বিতীয়টি হলো আনসারুস্-সুন্নাহ দফতরে الـمد والـجـزر فـي تـاريـخ الإسـلام -এর প্রুফ।

উস্তায মুহম্মদ আলী তাহিরের সঙ্গে আলোচনা

ইয়াসীন শরীফের সঙ্গে আগেই সময় নির্ধারণ করা ছিলো। সে অনুযায়ী মাগরিবের পর আমরা আশ-শূরা এর সম্পাদক মুহম্মদ আলী তাহিরের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে গেলাম। আমীর শাকীব আরসালানের সঙ্গে তাঁর বিশেষ সম্পর্কের কারণে এবং আমীরের গ্রন্থাবলীর প্রকাশক হওয়ার সুবাদে হিন্দুস্তানে থাকা অবস্থায়ই আমরা তাঁর নামের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম। তাছাড়া হিজাযে থাকা অবস্থায় তার নতুন গ্রন্থ مـعـتـقـل هاكستب এর কিছু অংশ পড়া হয়েছিলো।

মুহম্মদ আলী তাহির ফিলিস্তীন বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি। ফিলিস্তীনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক হৃদয়ের এবং ফিলিস্তীন সম্পর্কে তাঁর জানাশোনা আপনজনের।

সেখানে গিয়ে দেখি, ফিলিস্তীনী জেনারেল আব্দুল্লাহ আত্-তালও উপস্থিত রয়েছেন। আমাদের আলোচনার বিষয় ছিলো, ‘ফিলিস্তীন কী কারণে আমাদের হাতছাড়া হলো?’

প্রসঙ্গক্রমে উস্তায তাহির বললেন, ‘আমি বিশেষভাবে ফিলিস্তীনের উপর একটি গ্রন্থ রচনা করতে চাই, যাতে ফিলিস্তীনের ইতিহাস যেমন আসবে তেমনি ফিলিস্তীনে এ পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছে তারও বিবরণ থাকবে। কেননা আমার আশঙ্কা হচ্ছে, ফিলিস্তীন যেমন আমাদের ভূগোল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে তেমনি একসময় ইতিহাস থেকেও হারিয়ে যাবে। পরবর্তী যুগের লেখক-গবেষক হয়ত ফিলিস্তীন সম্পর্কে জানতে চাইবে, কিন্তু পূর্ণাঙ্গ ধারণা ও তথ্য তারা পাবে না। আমি চাই, আমার পরিকল্পিত গ্রন্থটি যেন হয় ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য একটি দলীল, যাতে প্রতিটি ঘটনার উল্লেখ হবে প্রমাণিত সত্যরূপে।

দেখুন, আমার মনে হয়, ফিলিস্তীন যেন হুবহু উন্দুলুসের ভাগ্য বরণ করতে যাচ্ছে। ‘আলমুকরী’ যদি তাঁর অমর গ্রন্থ ‘নাফহুত্-তীব’ রচনা করে না যেতেন তাহলে উন্দুলূস আজ ইতিহাসের অঙ্গন থেকেও হারিয়ে যেতো। যে কোন ভূখ- ইতিহাস থেকে মানচিত্রে ফিরে আসতে পারে, কিন্তু ইতিহাস থেকে হারিয়ে গেলে তা আর ফিরে পাওয়ার আশা থাকে না।’

কামনা করি, কথা ও কাজ যেন একত্র হয়।

(চলবে ইনশাআল্লাহ