শিশু-কিশোর ও নবীনদের পত্রিকা

মাসিক আল-কলম-পুষ্প

জিলহজ্ব ১৪৪০ হিঃ (৩/৮) | সম্পাদকের রোযনামচা

সম্পাদকের রোযনামচা

সম্পাদকের রোযনামচা

১ -৩ - ৪০ হি.

পঞ্চম সংখ্যার সম্পাদকীয়, দ্বিতীয় পর্বের প্রথম লাইন, ‘চলো একটু উঁকি দেই ইতিহাসের পাতায়।’ অনেকেই স্বচ্ছন্দে লেখে, ‘উঁকি মারা’; রুচিতে বড় বাঁধে।

‘উঁকি দেয়া যাক’, করা যাক, যাওয়া যাক, দেখা যাক, এগুলো হচ্ছে তরল ও লঘু প্রকাশ। তরল ও লঘু বিষয়েই গ্রহণযোগ্য, কঠিন, গুরুত্বপূর্ণ ও ভাবগম্ভীর বিষয়ে একেবারেই বেমানান। ‘এখন এককাপ চা খাওয়া যাক’ চলতে পারে, কিন্তু ‘এ বিষয়ে একটু গবেষণা করা যাক’! বলতে হবে, ‘এ বিষয়ে একটু গবেষণা করি/করা কর্তব্য/উচিত’।

৩ - ২ - ৪০ হি.

সম্পাদককে সম্বোধন করে একজন লিখেছে, ‘আশা করি আমার লেখা সম্পর্কে আপনি একটা নির্মোহ পর্যালোচনা করবেন।

ভেবেছে, কী সুন্দর শব্দপ্রয়োগই না করলাম! নির্মোহ শব্দটি সুন্দর, সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমার কী মোহ থাকতে পারে, যা থেকে মুক্ত হওয়ার উপদেশ বা পরামর্শ তুমি দিচ্ছো!

৪ - ২ - ৪০ হি.

একজন পাঠিকা, রোযনামচা পাঠিয়েছে। একটা অংশ এই-

‘মেছবাহ হুযূর আজীব মানুষ। মানুষের ভুল ধরে খুব। কিন্তু কেউ তার ভুল ধরবে, এটা ওনার সহ্য হয় না।’

দেখো না, ভালো মেয়েটি কী বলে! আগে তো ভুল ধরা শিখতে হবে! ছোটদের ভুল কীভাবে শোধরাতে হয়! সমস্তরের ভুল কীভাবে ধরতে হয়! বড়দের ভুল সম্পর্কে কীভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হয়! তারপর কখন কীভাবে করতে হয়! এসবই তো শেখার বিষয়। ভুল ধরা, তারবিয়াত ও সংশোধন করা এবং সমালোচনা ও পর্যালোচনা করা, এটা রীতিমত একটা শিল্প!

তাজা একটা নমুনা দেখা যেতে পারে। শাব্বির আহমদ ইলয়াস! ভালো ছেলে। প্রচুর লেখা পাঠাচ্ছে। লেখার আন্দাযও সুন্দর। আশা করা যায়, আল্লাহ্র ইচ্ছায় ভবিষ্যত সুন্দর হবে। সে পুষ্পের পঞ্চম সংখ্যার কিছু মুদ্রণ ভুল ধরেছে, শিরোনাম দিয়েছে, ‘ভুলের পিঠে ঘা’! আমার মত একজন বেচারাকে রীতিমত ঘা মেরে ভুল ধরতে হবে! প্রতিটি ভুল চিহ্নিত করার আন্দাযটাও সুসঙ্গত নয়। একটা ভুল সম্পর্কে লিখেছে, ‘পঞ্চম সংখ্যার ৫৫ পৃষ্ঠায় চতুর্থ কলামে ‘উৎ’ শব্দটি ভুল, সঠিকটা হলো ওত!

এভাবে বলা যেতো না! ‘ওখানে আছে উৎ, সঠিক কোনটি, উৎ না কি উত?!

সপ্তম সংখ্যায় প্রকাশিত রোযনামচায় হাফীদা শামস আমার একটি ভুল ধরেছে, তাও সাদামাটা মুদ্রণভুল নয়, রীতিমত ভাষা ও সাহিত্যের ভুল; কিন্তু পূর্ণ আদব রক্ষা করে। পড়ে দেখো।

ভাই ও বোন! তুমি ভুল ধরবে, আমার তাতে আপত্তি কী! তবে আমি চাই পুষ্প থেকে সবাই কিছু গ্রহণ করুক, শুধু ভাষা ও শব্দ নয়; চিন্তা, চেতনা, আদব, সৌজন্য ও উত্তম চরিত্র, সবকিছু!

এখানে ইচ্ছা করলে, একটা জিনিস চিন্তা করা যায়: শাব্বীর আহমদ ইলয়াসের আমি সমালোচনা করেছি, কিন্তু শুরুটা হয়েছে কত উদার প্রশংসা দিয়ে! এটা শিল্প, সৌজন্য ও প্রজ্ঞা!

৪ - ১২ - ৩৯ হি.

কিশোর পুষ্প বিভাগে (পৃ. ২৬) শিউলী ফুল কি ...’ লেখটিতে একটি বাক্য ছিলো, ‘আকাশ থেকে ঝরা তারা যেন ছিটিয়ে আছে মটিতে!’

মনে হলো, শুরুতে অনাবশ্যক দীর্ঘতা রয়েছে। আর ‘ছিটিয়ে আছে’ শব্দের মধ্যে রয়েছে হালকা হলেও তুচ্ছতার গন্ধ! তা ছাড়া ‘ঝরা তারা’ এর উচ্চারণে তানাফুর ও শ্রুতিকটুতা রয়েছে।

সম্পাদনার পর বাক্যটি হয়েছে- ‘আকাশের তারাগুলো যেন মাটিতে ছড়িয়ে আছে!

এর পর মনে হলো, ‘আকাশের তারা’-এখানে যেমন উপমা রয়েছে, পরবর্তী অংশেও একটি সুন্দর উপমা দরকার, উভয় অংশের ভারসাম্যের জন্য। এ চিন্তা থেকে সম্পাদনায় এ উপমাটির সংযোজন- ‘মাটিতে ছড়িয়ে আছে ফুল হয়ে!’

পাঠক যদি ভাষা ও বক্তব্যের উপর এরূপ সমালোচকের দৃষ্টি অর্জন করতে পারে তাহলে সেটা হয় সমৃদ্ধ পঠন।

৭ - ২ - ৪০ হি

কিশোর পুষ্পে (পৃ. ২৬) প্রেরণা- বাক্যটি ছিলো, ‘সুন্দর ভবিষ্যতের প্রত্যাশায় তুমিও ডানা মেলে দাও ময়ূরের মত!

আমাদের সহসম্পাদিকা বললেন, খুব কোমল করে, ভুল ধরার মত করে নয়, কিছু জানতে চাওয়ার মত করে, ‘ময়ূরের ক্ষেত্রে কি ডানা হতে পারে?’

তাই তো! তাই তো! কৃতজ্ঞতার সঙ্গে বললাম, তুমি গ্রহণ করো আমার অভিবাদন! আমি গ্রহণ করি, সুন্দর ‘আগামী’র ঐশী আশ্বাস!

এরপর ডানা’র স্থলে পেখম শব্দটি লিখলাম।

ভুল ধরা, তাও আবার ছোটদের তরফে বড়দের, সত্যি এটি শিখবার মত শিল্প!

৮ - ২ - ৪০ হি.

পৃ. ২৬ ‘মনে পড়ে এবং মনে পড়ে না’ লেখাটিতে বিভিন্ন ব্যক্তির নাম-ঠিকানার উল্লেখ ছিলো, যা কোন লেখার সার্বজনীনতার পথে অন্তরায়। তখন লেখাটা পড়ে থাকে লেখকের নিজস্ব ‘সম্পত্তি’ হয়ে। কিন্তু কোন লেখার সার্থকতা হলো তার সার্বজনীনতায়, যখন লেখা হয়ে যায় সবযুগের সবমানুষের চিরায়ত ‘সম্পদ’। সে আলোকে সম্পাদিতরূপটি দেখুন! আরো দেখুন, লেখকের ভাবনা ছিলো এরূপ, ‘আবার কি ফিরে আসতে পারে না সেই দিন, রাত; সেই সকাল, সন্ধ্যা; সেই চাঁদ, সেই জোসনা!!

উত্তরে প্রথমে লিখেছিলাম, পারে! সবই ফিরে আসতে পারে, যদি সঙ্গে থাকে অনুশোচনার দীপ্তি এবং কর্ম ও সাধনার শক্তি!

পরে ভাবলাম, এটি হলো শুধু তার লেখার প্রশ্নের অংশটির উত্তর। ছেলেটি যে আমাদের বন্ধন ত্যাগ করেছিলো! আমাদের প্রীতি ও মমতাকে অসম্মান করেছিলো! তাহলে এদিক থেকেও একটি প্রশ্ন হতে পারে এবং হতে পারে তার উত্তর!

তো উত্তরটি যেন হয় উভয় প্রশ্নের জন্য প্রযুক্ত, সেই সঙ্গে যেন হয় ব্যতিক্রমী ও মর্মস্পশী, এসব ভেবে মনে হলো শুধু দুই প্রকৃতির দু’টি চিহ্নই হতে পারে সেই উত্তর, যার প্রথম বৈশিষ্ট্য হবে, শব্দের পরিবর্তে  নৈশব্দের ভাষা।

আমার ধারণা, অনেকের মনে হবে, এর চেয়ে শব্দের উত্তরই তো ভালো ছিলো! তবু আমার যা মনে হয়েছে সেটা চিন্তা করে দেখা যেতে পারে।

আরেকটি বিষয়, আমাদের এখানে যে ছেলেটি চতুর্থ বর্ষ পর্যন্ত পড়েছে, সে যদি ফুলের ঝরে পড়াকে লেখে ড শূন্য ড় দিয়ে তাহলে তার লেখাই হয়ে গেলো তার প্রশ্নের ‘একটা’ উত্তর! সেদিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে ভাষার বর্ণের পরিবর্তে, ভাবের ‘রক্ত-বর্ণ’ দ্বারা।

(প্রথমে ছিলো ‘ভাবের বর্ণ দ্বারা’)

৯ - ২ - ৪০ হি.

৭ম সংখ্যা, পৃ. ৯০, ‘ভুলিতে পারি নাই...’ মূল লেখায় ছিলো, আমার এক বান্ধবী আমাকে দু’টি পাখী হাদিয়া দিয়েছিলো। ...’ স্থূলতার ছাপ দূর করার জন্য সম্পাদনা করলাম, ‘ভারি সুন্দর দু’টি পাখী আমার ছিলো।’ দ্বিতীয় সম্পাদনার সময় মনে হলো। প্রশ্ন হতে পারে, কোন কোমল হৃদয় কি পারে পাখীকে খাঁচায় ‘বন্ধ’ রাখতে! (ইচ্ছে করেই বন্দী শব্দটি এড়িয়ে গেলাম) লেখিকাও তা করেনি! কিন্তু বর্ণনার ধারা থেকে ভুল ধারণা হতে পারে। তো ভুল বোঝার সুযোগ বন্ধ করার জন্য লিখলাম, ‘... দু’টি পাখী আমার জীবনে এসেছিলো’। এখন দেখো তো কত আবেদন-পূর্ণ হলো!

একই লেখায় একটি বাক্য হলো, ‘আগের মত ডাকে না। দানা-পানিও খায় না।’ তেমন কোন খুঁত নেই শব্দপ্রয়োগে এবং দুই পর্বের সমতার ক্ষেত্রে। কিন্তু হঠাৎ মনে হলো, খায় না, এর চেয়ে ছোঁয় না, অনেক বেশী আবেদন-পূর্ণ। কারণ তাতে জীবনের প্রতি তার উদাসীনতার প্রকাশ ঘটছে, যা এখানে উদ্দেশ্য।

১১ - ২ - ৪০ হি.

‘ব্যাখ্যাতলব’ এটি পুষ্পের নতুন ব্যবহার। ব্যাখ্যাসাপেক্ষ-এর ব্যবহার রয়েছে। তো ব্যাখ্যাতলব-এর ব্যবহার স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণযোগ্যতা পেতে পারে। ব্যখ্যাতলববিষয় মানে হবে এমন বিষয়, বোঝার জন্য যার ব্যাখ্যাা তলব করা যায়। প্রশ্ন উঠতে পারে বাংলা ও আরবী শব্দের যুগলতা সম্পর্কে। তো বাংলায় এরও প্রচুর উদাহরণ রয়েছে। যেমন ফীবছর, মানে প্রতিবছর।

৮ - ৮ - ৪০ হি.

এবারের সংখ্যা (অষ্টম) বিলম্বিত হওয়ার একটা কারণ তো হলো আমার দীর্ঘ ও কঠিন অসুস্থতা, তবে তার চেয়ে বড় কারণ হলো, প্রথম সংখ্যা থেকে সপ্তম সংখ্যা পর্যন্ত যে ধারাবাহিক প্রবাহ হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত হয়েছিলো এবং বেশ জোয়ারের সঙ্গে, হঠাৎ করেই তাতে ভাটা পড়ে গিয়েছে, এমনকি দেখতে দেখতে প্রবাহটা শুকিয়েই গিয়েছে। হৃদয়ের প্রবাহ ছাড়া কলমের আসলে কিছুই করার থাকে না।

এ দীর্ঘ সময় কী অস্থিরতা ও যন্ত্রণার মধ্যে অতিক্রম করেছি তা বলে বোঝাতে পারবো না। তবে সান্ত¡না এই যে, এর মধ্যে ‘এসো উর্দূ শিখি’ (দ্বিতীয় খ-) শুরু হয়ে যথেষ্ট অগ্রসরও হয়েছে। হঠাৎ করেই একটি প্রবাহ এসেছিলো। প্রায় পঞ্চাশ ভাগ কাজ হয়েছে। তারপর সে প্রবাহেও ভাটা!

এখন চেষ্টা করছি-কতকটা অনন্যোপায় হয়ে- প্রবাহহীন অবস্থায়ও পুষ্পের কাজ এগিয়ে নেয়ার জন্য! সবকিছুর আগে ও পরে শুধু আল্লাহ্!

১০ - ৮ - ৪০ হি.

‘শিশুটি কান্না করছে’, শুনতে কেমন হলো? শ্রুতিকটু, না শ্রুতিমধুর?

একটি মেয়ে লিখেছে, ‘গিয়ে দেখি, গাছে ফুলটি নেই, আমি তখন অনেক কান্না করলাম।’

ভালো মেয়ে, রান্না করো, তবে কান্না করো না। ‘রান্না করে’ এবং ‘রাঁধে’, দু’টোই চলে, কিন্তু ‘কান্না করে’ চলে না। ‘এত কান্না করা ঠিক না’, কথাটা ঠিক না, বলতে হবে, ‘এত কাঁদা/কান্না ঠিক না।’ ‘তখন আমার ভিষণ কান্না পেলো’, ঠিক আছে।

১৩ - ৮ - ৪০ হি.

এবারের সংখ্যায় ২৭ এর পাতায় প্রকাশিত আমাতুল্লাহ ফারজানার লেখাটির জন্য এবার তাকে পুষ্পের প্রথম অতিথি সম্পাদিকা নির্বাচন করা হয়েছে। লেখাটির মধ্যে চিন্তার নতুনত্ব রয়েছে এবং রয়েছে ভাবনার অভিনবত্ব। আসলে এটি ছিলো একটি সুন্দর কাঁচামাল যা সম্পাদিত হয়ে বর্তমান রূপ লাভ করেছে। ফারজানা যদি তার মূল লেখাটি সামনে রেখে সম্পাদিত রূপটি পাঠ করে, বেশ উপকৃত হবে। তুলনামূলক অধ্যয়নের মাধ্যমে বোঝা যাবে, পুষ্পের সম্পাদনার ধরন এবং বোঝা যাবে, পুষ্পের প্রিয় পাঠক তাদের  লেখাগুলোর মাধ্যমে সম্পাদনার কাজে কী ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী সাহায্য করে থাকেন। 

১৬ - ৮ - ৪০ হি.

একজন লিখেছে, ‘পুষ্পের সুবাসে

আমি মুখরিত হতে চাই’। অদ্ভুত শব্দপ্রয়োগ, মুখরিত হওয়ার জন্য তো শব্দ বা আওয়াজ চাই, কলরব ও কোলাহল চাই। সুবাস দ্বারা মুখরিত হয় কীভাবে? ফুলের সুবাসে তো মানুষ মোহিত হয়!

সস্তা লেখার বড় দোষ বেহিসাবি ও লাগামহীন শব্দপ্রয়োগ। সস্তা লেখার পড়া থেকে নিজেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করা জরুরি।

১৮ - ৮ - ৪০ হি.

সুন্দর লেখা শেখার পথে অনেক বড় একটা বাধা হলো কঠিন শব্দব্যবহারের প্রবণতা। সহজ ও সাধারণ শব্দ এবং সহজ ও সাধারণ বাক্য ব্যবহার করলে লেখার বিষয়টি অনেক সহজ হয়ে যায়। প্রশ্ন হবে, ভাষার অভিধানে কঠিন শব্দগুলো তাহলে কেন? কঠিন শব্দের জন্যও রয়েছে নিজস্ব কিছু ক্ষেত্র, কিন্তু তা বোঝার জন্য আগে ভাষায় পারদর্শী হওয়া জরুরি। এটা শুধু বাংলাভাষার বিষয় না, সবভাষার ক্ষেত্রেই এটা সত্য।

আমার প্রথম প্রচেষ্টা হবে বানানে বিশুদ্ধতা অর্জন। তারপর হালকা ফুলকা বিষয় নিয়ে লেখার অনুশীলন। প্রথমে আসবে রোযনামচা, তারপর ছোট ছোট সফরনামা, ছোট ছোট চিন্তা ভাবনা। এগুলো লিখতে হবে একেবারে সহজ শব্দে, সহজ বাক্যে। এর সঙ্গে থাকতে হবে নিয়মিত অধ্যয়ন।

এসো কলম মেরামত করি, কিতাবে এসম্পর্কে যথেষ্ট আলোচনা রয়েছে। কিন্তু পুষ্পে যারা লিখছে তারা এগুলো পড়ে বলে তো মনে হয় না।

১৯ - ৮ - ৪০ হি.

লেখার মধ্যে প্রতিদিন কিছু না কিছু উৎকর্ষের ছাপ আসতেই হবে। আর নিয়মিত যত্ন পরিচর্যা করলে তা না হওয়ার কোন কারণ নেই। রোযনামচা ও ছোট ছোট লেখার এত নমুনা রয়েছে পুষ্পের পাতায় যে, তা অনুসরণ করে যে কেউ নিজের লেখার উৎকর্ষ সাধন করতে পারে। পুষ্পের একদু’জন পাঠক-পাঠিকা এক্ষেত্রে প্রশংসনীয় উন্নতি লাভ করেছে। আসলে চেষ্টার অসাধ্য কিছু নেই, আবার চেষ্টা ছাড়া উন্নতিরও কোন সুযোগ নেই।

২০ - ৮ - ৪০ হি.

এ সংখ্যার উদ্বোধনী বক্তব্যে আছে, ‘কখনো কি আমি কাউকে প্রশ্ন করেছি, কিংবা কেউ আমাকে জিজ্ঞাসা করেছে! পৃথিবীর বাগানে এই যে এত এত ফুল, এগুলো আল্লাহ্ কেন সৃষ্টি করেছেন?

আগে ছিলো এরকম, ‘কখনো কি আমরা চিন্তা করেছি, পৃথিবীর বাগানে এত ফুল আল্লাহ্ কেন সৃষ্টি করেছেন?’

মনে হলো, চিন্তার কাজটা নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ। অথচ বিষয়টি এমনই সার্বজনীন যে, চিন্তাকে অতিক্রম করে আলোচনায় যাওয়া উচিত। তখন লিখলাম, কখনো কি আমরা জানতে চেয়েছি...। আবার মনে হলো, এটাও তো একমুখী বিষয় হলো, অর্থাৎ শুধু আমার বিষয়। অথচ জানতে চাওয়ার আকুতি তো সবার মধ্যেই থাকা উচিত, তাই লিখলাম, ‘কখনো কি আমি কাউকে প্রশ্ন করেছি, কিংবা কেউ আমাকে প্রশ্ন করেছে...’

মনে হলো ‘প্রশ্ন’শব্দটির পুনরুক্তি শ্রুতিকটু। তাই দ্বিতীয় স্থানে প্রশ্নের স্থলে ‘জিজ্ঞাসা’ লিখলাম। এখন মনে হচ্ছে, এ অংশটি উহ্য থাকলেই ভালো হয়, যেমন, ‘কখনো কি আমি কাউকে প্রশ্ন করেছি, কিংবা কেউ আমাকে...’

পৃথিবীর বাগানে এত ফুল আল্লাহ্ কেন সৃষ্টি করেছেন?’

বিষয়টি যেহেতু অনন্যসাধারণ সেহেতু বাক্যের উসলূব ও শৈলীর মধ্যে জোরালোতা ও গতিময়তা থাকা সঙ্গত, তাই লিখলাম, ‘পৃথিবীর বাগানে এই যে এত এত ফুল, এগুলো আল্লাহ্ কেন সৃষ্টি করেছেন?’

শেষ বাক্যটি ছিলো, ‘আসুন আমরা হৃদয় দিয়ে পুষ্পকে গ্রহণ করি, তাহলেই সার্থক হবে আমাদের জীবন এবং পুষ্পের এ মহাআয়োজন!

‘তাহলেই’-এর মধ্যে ‘আমরাই একমাত্র’ এরূপ একটা অনুভূতির অবচেতন উপস্থিতি মনে হয়, তাই ‘তাহলেই’-এর স্থলে লেখা হয়েছে, ‘যেন’।

২২/৮/৪০ হি.

্‘করা লাগবে’ এর দৌরাত্ম্যে এখন আমি আর কোন বই বা পত্রিকা পড়তে পারি না। আমার পাঠরুচি কেমন যেন গুলিয়ে আসে। বিজ্ঞানচিন্তা এখন নিয়মিত পড়ি, পড়তে হয়, পুষ্পের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের প্রয়োজনে। সেদিন পত্রিকাটা হঠাৎ করে হাত থেকে পড়েই গেলো এ বাক্যটির সামনে এসে, ‘মহাজাগতিক রশ্মি সম্বন্ধে আমাদের আরো জানা লাগবে’। ‘জানতে হবে’ কখন কীভাবে যে ‘জানা লাগবে’ হয়ে গেলো, আল্লাহ্ মালুম!

আগে ছিলো ‘যেতে হবে’, এখন হয়েছে ‘যাওয়া লাগবে’ এটা কি ভাষার উন্নতি না অবনতি? আশঙ্কা হয়, রুচিহীনতাই হয়ত একসময় রুচিশীলতার স্থান দখল করে বসবে! রুচিশীলদের হয়ত তখন সাহিত্যের অঙ্গন থেকে নির্বাসনে যেতে হবে (যাওয়া লাগবে)।

২৭/৮/৪০ হি.

‘বাজ’ মানে কী? শিকারী পাখী? হতে পারে। বজ্র-এর পরিবর্তিত রূপ? তাও হতে পারে। তবে আরেকটা ‘বাজ’ হচ্ছে ফারসি ভাষার উপসর্গ, যা উর্দুর দেহলিয পার হয়ে বাংলাভাষার অঙ্গনে প্রবেশ করেছে। শুধু প্রবেশ করেছে নয়, রীতিমত নিজের আসনটাও পাকাপোক্ত করে নিয়েছে। ব্যাকরণের পরিভাষায় এটাকে বলে ‘লাহিকা’ বা প্রান্তিকা। এটি শব্দের শেষে যুক্ত হয়ে শব্দটিকে কর্তৃবাচ্যে রূপান্তরিত করে। যেমন জানবায, ভালো অর্থে, যুদ্ধবাজ, মন্দ অর্থে, ফেতনাবাজ, দখলবাজ। সম্প্রতি এর অপব্যবহার মাত্রা ছাড়িয়ে গিয়েছে বলেই মনে হয়। একজন লিখেছেন, ‘তিনি ছিলেন অসম্ভব রকমের ‘স্বপ্নবাজ’। অর্থাৎ নিজে যেমন বড় বড় স্বপ্ন দেখতেন তেমনি নতুন প্রজন্মকে বড় বড় স্বপ্ন দেখতে উদ্বুদ্ধ করতেন। বলাবাহুল্য, এ হচ্ছে ভাষার বিচ্যুতি ও তরলায়ন। আগে বলা হতো, স্বাপ্নিক, স্বপ্নদ্রষ্টা, স্বপ্নদিসারী।

২৮/৮/৪০ হি.

একটি লেখায় আছে, ‘মনের মধ্যে অনেক স্বপ্ন পুষে রেখেছি, আমরা তো হৃদয়ে স্বপ্ন লালন করে জীবন অতিক্রম করেছি; এখন ছেলেরা কেন যে স্বপ্নকে বেড়াল বানিয়ে পোষা শুরু করেছে, কে জানে। হয়ত বলা হবে, বেড়াল কেন, পাখীও তো হতে পারে! হতে তো পারেই, তবে সে জন্য আবার আনতে হবে (আনা লাগবে) একটা খাঁচা। সেই খাঁচার মধ্যে স্বপ্নকে করতে হবে (করা লাগবে) বন্দী! কী দরকার এই ঝামেলায় যাওয়ার! তার চেয়ে স্বপ্নকে লালন করলেই তো হয়!

‘মনের মধ্যে রাগ/ঈর্ষা/হিংসা পুষে রেখো না’ ঠিক আছে, কিন্তু আকাক্সক্ষা, আকুতি, স্বপ্ন, ইচ্ছা, এসব ক্ষেত্রে! বোধহয় ঠিক না!

২৯/৮/৪০ হি.

আল্লাহ্র রহমতে পুষ্পের শুধু সম্পাদনা করার মাধ্যমে ভাষা ও সাহিত্যের অঙ্গনে আমি কী পরিমাণ উপকৃত হয়েছি এবং হচ্ছি তা বলে শেষ করা যাবে না। পাঠক যদি সমালোচনা ও সম্পাদনার দৃষ্টিতে পড়ে এবং বারবার পড়ে তাহলে অনেক উপকার হতে পারে। কিন্তু মুশকিল হলো, একবার পড়ারই যেন ধৈর্য নেই, বারবার পড়া তো...!

কাল একটি লেখা পেলাম, একটা বাক্যে একটা শব্দ ছিলো, ...স্বপ্নের সাগরে তরী ভাসিয়েছি...।

তরী শব্দটি সুন্দর হলেও এর ব্যবহার এখানে সঙ্গত নয়। স্বপ্নের তরী হতে পারে, কিন্তু স্বপ্নের সাগরে ভাসানোর জন্য তরী নয়, সম্ভবত ভেলা হচ্ছে উপযুক্ত শব্দ। (চলবে ইনশাআল্লাহ্)

 

শব্দের একটা অসঙ্গত ব্যবহার আমাকে বড় পীড়া দিয়েছে। নয়াদিগন্ত সাহিত্যপাতা, ৫ই শাবান/১২ই এপ্রিল, শুক্রবার; শিরোনাম,  ‘যেমন দেখেছি তাকে’। বাক্যটি হলো, ‘তরুণেরা গোগ্রাসে গিলত তার জলের ধারা।’

যদ্দুর জানি, গোগ্রাস হলো, গরু একবার যে পরিমাণ খাবার মুখে নেয়। গরু বোধহয় বেশী খায় এবং দ্রুত খায়। তাই যারা ঐ রকম করে খায় তাদের সম্পর্কে বলা হয়, গোগ্রাসে গিলছে। এটা গ্রাস বা লোকমাজাতীয় খাদ্যবস্তর ক্ষেত্রেই সঙ্গত। গরুর ক্ষেত্রে ঘাস, ভুসি; মানুষের ক্ষেত্রে ভাতের লোকমা, রুটির টুকরো। জল বা জলের ধারা গোগ্রাসে গেলা যায় কীভাবে, বোধগম্য নয়।

আগের শুক্রবারে ইসলামী পাতায় একটি শিরোনাম ছিলো ‘বাথরুমের বিধান’। মানে কী? বাথরুম কীভাবে তৈরী করতে হবে, ফিটিংস কেমন হবে, এসবের নিয়মকানুন? নিশ্চয় না! মানে হচ্ছে বাথরুমের প্রাকৃতিক কর্মটা সম্পন্ন করার শরীয়তসম্মত নিয়মাবলী। কথা হলো, এজন্য তো ফেকাহ শাস্ত্রের এবং শরীয়াতের নিজস্ব পরিভাষা রয়েছে, যেমন ‘ইস্তেন্জার আহকাম ও বিধান’। এখানে এরূপ ইংরেজি-বাংলার মিশ্রণের যৌক্তিকতা কোথায়? আরো তাজ্জবের বিষয় হলো, সম্ভবত বিষয়বস্তুর সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষার উদ্দেশ্যে শিরোনামের নীচে আধুনিক বাথরুমের ছবিও দেয়া হয়েছে! তাতে কেউ যদি শিরোনাম থেকে ঐ অর্থটাই বুঝতে চায় যেটা এখানে প্রথমে বলা হয়েছে, দোষ দেয়া যাবে?

 আসল কথা হলো ‘রুচি’। পাঠক বলি, লেখক বলি, আর বলি সম্পাদক, আমাদের অবশ্যই সুরুচি অর্জন করতে হবে।

  ১১/৭/৪০ হি.