শিশু-কিশোর ও নবীনদের পত্রিকা

মাসিক আল-কলম-পুষ্প

জিলহজ্ব ১৪৪০ হিঃ (৩/৮) | তোমাদের পাতা

এসো কলম মেরামত করি

 

 এসো কলম মেরামত করি

    এ যুগে অস্ত্রের যুদ্ধ যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি গুরুত্বপূর্ণ কলমের যুদ্ধ। সৈনিকের জন্য অস্ত্রের প্রশিক্ষণ, আর লেখকের জন্য কলমের প্রশিক্ষণ একই রকম অপরিহার্য।

আজকের আলোচনা ঃ  প্রসঙ্গ ঃ রোযনামচা

***

   বহুদিন পর আজ আবার রোযনামচা সম্পর্কে আলোচনার প্রয়োজন বোধ করছি। রোযনামচা কিছু নতুন বিষয় বা বিদ‘আত নয় যার প্রচলন আমার দ্বারা হয়েছে। যুগ যুগ ধরে, বরং বহু শতাব্দী ধরে নিয়মিত রোযনামচা লেখার প্রচলন মুসলিম-অমুসলিম উভয় সমাজেই ছিলো, এখনো আছে। মুসলিম সমাজেও বুদ্ধিজীবী মহলে যেমন ছিলো তেমনি আলিম ও মাশায়েখ সমাজেও ছিলো, এখনো আছে। আরবী-উর্দূ ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় বহু রোযনামচা ইতিমধ্যে ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়েছে।

সুতরাং রোযনামচা লেখার প্রতি যে আহ্বান তা আমার নিজস্ব উদ্ভাবন কিছুতেই নয়। আমি যেটা করেছি তা এই যে, বড়দের  থেকে রোযনামচা লেখার যে সুন্দর অভ্যাস, রীতি ও প্রথা চলে আসছে প্রাচীন কাল থেকে, তা অনুসরণের জন্য তালেবানে ইলমের উদ্দেশ্যে জোরালো আহ্বান রেখেছি। এটিকে আমি রীতিমত আন্দোলনের রূপ দেয়ার চেষ্টা করেছি।

পরে অবশ্য দেখা গেলো, আমি তো ক্ষুদ্র মানুষ, আমার আগেও হিন্দুস্তানের দেওবন্দী আলেম মাওলানা নূরুল আলম খলীল আমীনী ছাহেব তালেবানে ইলমের উদ্দেশ্যে রোযনামচা লেখার জোরদার দাওয়াত পেশ করেছেন। বিষয়টি আমার বিলকুল জানা ছিলো না। যখন জানলাম, খুশী হলাম যে, পাকভারত উপমহাদেশের স্বনামধন্য দ্বীনী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দারুল উলূম দেওবন্দ, যাকে বলা হয়, ‘মাদারে ইলমী’, সেই দারুল উলূম দেওবন্দের ‘নিবেদিতপ্রাণ’ একজন শিক্ষকের চিন্তার সঙ্গে আমার চিন্তার একাত্মতা সৃষ্টি হয়েছে।

যাই হোক, আগেও বলেছি, আজ আবার বলি, নিয়মিত রোযনামচা লেখার কল্যাণ ও উপকারিতা বহুমুখী এবং অসংখ্য।

নিয়মিত রোযনামচা লেখা এবং তা যথাযথরূপে সংরক্ষণের মাধ্যমে আমি আমার শৈশব, শৈশবের নির্দোষ চিন্তা-ভাবনা ও অনুভব অনুভূতি যেমন ধরে রাখতে পারি কাগজের পাতায় এবং বিভিন্ন ঘটনার আয়নায় তেমনি ধরে রাখতে পারি, শৈশবে আমার চারপাশে যা কিছু ছিলো এবং যা কিছু ঘটেছিলো তার কিছু কিছু চিত্র। কৈশোর ও তারুণ্য সম্পর্কেও একই কথা এবং একই কথা জীবনের যৌবনকাল ও বার্ধক্য সম্পর্কেও।

আমাদের স্মৃতি এত দুর্বল যে, জীবনের প্রায় সবটুকু অতীত হারিয়ে যায়। আনন্দের, বেদনার, সুখের, দুঃখের অনেক কিছুই তো ঘটে জীবনের বিস্তৃত পরিসরে। অনেক চিন্তাভাবনা ও কল্পনা-পরিকল্পনা আসে হৃদয়ের অঙ্গনে, অনেক স্বপ্ন দেখি আমরা জীবনকে কেন্দ্র করে, কিন্তু এসবের প্রায় কিছুই মনে থাকে না আমাদের। সময় যত অগ্রসর হতে থাকে, ধীরে ধীরে সবকিছু আবছা হতে থাকে এবং একসময় তা মুছে যায় জীবনের খাতা থেকে এবং স্মৃতির পাতা থেকে। যদি আমরা শৈশবের, কৈশোরের, তারুণ্যের এবং যৌবন ও বার্ধক্যের টুকরো টুকরো ঘটনা, খ- খ- চিন্তা-ভাবনা, সন্দুর সুন্দর স্বপ্নের কথা, কল্পনা ও পরিকল্পনার কথা লিখে রাখি রোযনামচার পাতায় তাহলে আমার প্রায় সবটুকু জীবনই যেন সংরক্ষিত হয়ে যায়, শুধু আমার জন্য নয়, আমার পরবর্তী প্রজন্মেরও জন্য, এমনকি দূর ভবিষ্যতের প্রজন্মের জন্যও।

দশ, বিশ, ত্রিশ, চল্লিশ এমনকি পঞ্চাশ বছর পর যদি রোযনামচার পাতাগুলো খুলে দেখি, চোখের ঝাপসা দৃষ্টিতে একটু পড়তে পারি, অবাক বিস্ময়ে এবং পরম আনন্দের সঙ্গে দেখতে পাবো, আমার শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য এবং আমার যৌবন ও বার্ধক্য যেন আমারই সামনে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। সবকিছু হারিয়ে গিয়েছিলো; অতীতের অন্ধকার গহ্বর থেকে সবকিছু আবার যেন জেগে উঠেছে। এমনকি আমার পরে যারা আসবে পৃথিবীতে তাদেরও সামনে জীবন্ত থাকবো আমি, আমার জীবন। অবাক হয়ে তারা ভাববে, এমন ছিলেন আমার বাবা, দাদা, নানা, আমার ...! এমন ছিলো তাঁর শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য, যৌবন ও বার্ধক্য!! এমন করে ভাবতেন তিনি! এমন করে স্বপ্ন দেখতেন তিনি নিজের সম্পর্কে, পরিবার, সমাজ ও দেশ সম্পর্কে, এমনকি পরবর্তী প্রজন্ম সম্পর্কে!! হয়ত তখন তাদের অন্তরে সৃষ্টি হবে আমার প্রতি কিছু ভালোবাসা, কিছু কোমল অনুভূতি! হয়ত তাদের হৃদয়ের গভীর থেকে আমার জন্য উৎসারিত হবে কিছু প্রার্থনা! হয়ত আমাদের মাগফিরাতের জন্য তাদের চোখ থেকে ঝরবে এক ফোঁটা, দু’ফোঁটা অশ্রু!!

এমনো হতে পারে যে, আমার কোন অসম্পূর্ণ স্বপ্ন এবং স্বপ্নভঙ্গের কোন বেদনা, আমার আলোর মুখ না দেখা কোন কল্পনা ও পরিকল্পনা তাদের আলোড়িত করবে! উদ্যমে উদ্দীপনায় তারা আন্দোলিত হবে এবং এগিয়ে আসবে সুদৃঢ় প্রত্যয় ও প্রতিজ্ঞায়। হয়ত তাদের চেষ্টায় সাধনায় আমারই হারিয়ে যাওয়া কোন না কোন স্বপ্ন, কোন না কোন পরিকল্পনা বাস্তবের আলো দেখতে পাবে, আর তার আজর ও ছাওয়াব জমা হবে কবরে, আমার আমলনামায়!

***

রোযনামচার আরো বড় উপকারিতা এই যে, এটি এমনই এক আদর্শ শিক্ষক, এমনই এক উপকারী বন্ধু যা প্রতিদিন আমাকে কিছু না কিছু শেখাতে থাকে! যার কাছ থেকে প্রতিদিন আমি কিছু না কিছু আলো গ্রহণ করতে থাকি। আমার চিন্তা ও চেতনা, আমার ভাব ও ভাবনা এবং কল্পনা ও পরিকল্পনা, এমনকি আমার স্বপ্ন দেখার শক্তি প্রতিদিন পুষ্টি লাভ করতে থাকে এবং একটু একটু করে পরিপুষ্ট হতে থাকে

এবং তা নিজের অজান্তেই, কারো সাহায্য-সহায়তা ছাড়াই। তোমার মানবশিক্ষক যারা, তাদের হয়ত ইচ্ছা আছে তোমাকে সময় দেয়ার, তোমার চিন্তা, চেতনা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় সমৃদ্ধি আনার, নিশ্চয় সদিচ্ছা তাদের আছে, কিন্তু তাদেরও রয়েছে বিভিন্ন ব্যস্ততা ও সীমাবদ্ধতা, তুমি কিন্তু সহজেই পারো, খুব সহজেই পারো তোমার রোযনামচা-শিক্ষকের সান্নিধ্য গ্রহণ করতে, খুব সহজেই পারো তাকে পর্যাপ্ত সময় দিতে এবং তার কাছ থেকে পর্যাপ্ত সময় নিতে।

একটি ছেলে বা মেয়ে, রোযনামচার সঙ্গে যার পরিচয় নেই, সম্পর্ক ও অন্তরঙ্গতা নেই এবং একটি ছেলে বা মেয়ে, নিয়মিত যে রোযনামচা লেখে, রোযনামচার সঙ্গে যার রয়েছে নিবিড় পরিচয় ও গভীর অন্তরঙ্গতা এবং রোযনামচার সঙ্গে রয়েছে তার হৃদয় ও আত্মার একাত্মতা, এ দু’জনের জীবন, জীবনবোধ এবং চিন্তা চেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে পার্থক্য হয় আকাশ-পাতাল! এমনকি উভয়ের চরিত্র, নীতি ও নৈতিকতা এবং হৃদয়বৃত্তির ক্ষেত্রেও সৃষ্টি হয় বড় রকমের ব্যবধান। এটা আমার দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা। রোযনামচা মানুষকে ভালো হওয়ার শিক্ষা দেয়; উত্তম থেকে আরো উত্তম হওয়ার প্রেরণা যোগায়। রোযনামচা মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে মানুষের প্রতি কোমল হওয়ার, দরদী হওয়ার, মানুষকে ভালোবাসার এবং মানুষের জন্য সামান্য হলেও ভালো কিছু করার।

আবারো বলছি, তুমি বিশ^াস করতে পারো, এটা নিছক তত্ত্বকথা নয়, এটা আমার দীর্ঘ শিক্ষকজীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা। আমার ছাত্রদের জীবনে, আমার চোখের সমানে একসময় যারা ছিলো শিশু বা কিশোর, যারা এখন আমারই চোখের সামনে তরুণ, যুবক, এমনকি বৃদ্ধ, তাদের জীবনের আয়নায় এ সত্য আমি সুস্পষ্টরূপে দেখতে পাই, কখনো আনন্দের অনুভূতি নিয়ে, কখনো বেদনার আঘাতে নীল হয়ে।

অনেকেই শুনেনি আমার কথা, শুনতে পায়নি, বা শুনতে চায়নি। কতভাবে বলেছি, বলেই চলেছি আদরে সোহাগে এবং শাসনে তিরস্কারে; তারা শুনেনি আমার ডাক, আমার আহ্বান, আমার আবেদন ও মিনতি। তাদের জীবনও রয়েছে আমার চোখের সামনে। এই তো সেদিন জীবনের দায় ও দায়িত্ব গ্রহণের প্রায় শেষপ্রান্তে এসে পড়া আমার প্রিয় ছাত্রদের বললাম, গত রাতে যারা রোযনামচা লেখোনি, সততার সঙ্গে দাঁড়াও। ধীরে ধীরে দাঁড়াতে লাগলো এবং প্রায় সাবই দাঁড়িয়ে গেলো! আমি তো বিস্ময়ে অবাক এবং বেদনায় হতবাক! তখন বুঝলাম, আমার উচিত ছিলো এভাবে বলা, ‘যারা লিখেছো, দাঁড়াও!  

অথচ রোযনামচা লেখার জন্য মাদরাসার পক্ষ হতে সময় নির্ধারণ করা আছে এবং তদারকির জন্য নেগরান নিযুক্ত রয়েছেন! হতাশার বিষয় হলো, এদের মধ্য থেকেই কয়েকজনকে আগামী দিনের জন্য শিক্ষকরূপে গড়ে তোলার চেষ্টা করছি! এদেরই হাতে হয়ত তুলে দিতে হবে আগামী দিনের শিশু-কিশোরদের শিক্ষা ও দীক্ষার ভার! নদীতে জোয়ার আসে, ভাটাও আসে। জীবন-নদীর স্রােতেও তাই।

আমার জীবনের নদীতে একসময় প্রবল জোয়ার ছিলো। সেই জোয়ারে আমি ছিলাম উচ্ছল, চঞ্চল। প্রতিকূলতা এবং হতাশা দুমড়ে মুচড়ে শুধু এগিয়ে চলেছি জোয়ারের প্রবল বেগে। এখন জীবনের নদীতে ভাটার টান। সাগরে গিয়ে পড়ার আগে এখন প্রতীক্ষায় আছি নতুন জীবনের, নতুন নদী ও তার জোয়ারের...

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

রোযনামচা কখন কল্যাণপ্রসূ?

আমার কোন কোন ছাত্রের মুখে একটা অভিযোগ ছিলো, রোযনামচা লিখতে চাই, কিন্তু লেখার বিষয় খুঁজে পাই না, পেলেও বুঝতে পারি না, কীভাবে লিখবো? এখন এ অভিযোগ আর শুনি না! দীর্ঘ যুগের সাধনায় এটুকু আমি বোঝাতে পেরেছি আমার পেয়ারে তালিবানে ইলমকে, কিছুটা হলেও বোঝাতে পেরেছি যে, রোযনামচার হাকীকত কী? কাকে বলে রোযনামচা এবং কীভাবে লিখতে হয় রোযনামচা। অর্থাৎ রোযনামচার রূপ ও স্বরূপ বুঝতে না পারাই ছিলো এ অভিযোগের মূল।

মনে পড়ে, বেশ আগের কথা। পুষ্পের তখন দ্বিতীয় যুগ। এক পাঠিকা এসেছিলো আমাদের আশরাফাবাদে মাদানী মানযিলে। পর্দার বয়স তখনো হয়নি, হয় হয় পর্যায়ের। তারো অভিযোগ ছিলো, রোযনামচা লিখতে চাই। কিন্তু কী লিখবো, আর কীভাবে লিখবো, বুঝতে পারি না। কলম নিয়ে বসে থাকি, থাকি তো থাকি, কিন্তু কোন লেখা মাথায় আসে না।

সামান্য সময়ের কথায় বুঝতে পারলাম, জীবনের প্রতি সে অত্যন্ত আন্তরিক, কিন্তু ‘মেয়েজীবনের’ প্রতি হতাশ! কারণ তার পরিবেশে একটা কথাই সে শুনতে পায়, লেখা-পড়া মেয়েদের জন্য নয়, ওদের কাজ হলো...! কিন্তু তার মন তা মানতে প্রস্তুত নয়। তার মন বিদ্রোহ করতে চায়, কিন্তু উপায় খুঁজে পায় না। এর মধ্যে পুষ্পের পরিচয় পেলো, আর যেন নবজীবন লাভ করলো। ...

এটা ছিলো তার নিজের কথা। আমাকে ‘সদয় শ্রোতা’ পেয়ে অনেক কথাই সেদিন সে বলেছিলো! আমি তো অবাক! এত সুন্দর করে বলতে পারে, ভাবতে পারে! অথচ লিখতে পারে না! আমি সঙ্গে সঙ্গে তার কথাগুলো কাগজে লিখে তার সামনে তুলে ধরলাম, আর বললাম, একথাগুলোই তো তুমি বলেছো?

সেও যেন কিছুটা অবাক! আমি বললাম, এটাই হলো রোযনামচা! মনের কথাগুলো মনের বন্ধুকে যেভাবে বলো সেভাবেই খাতায় লেখো!

 

‘খাতাবন্ধু’কে বলো, আর এটা তখনই সম্ভব হবে, রোযনামচাকে যখন তুমি মনের ‘সখী’ বানিয়ে মনের কথাগুলো, মনের সুখ-দুঃখ ও আনন্দ-বেদনাগুলো তাকে বলবে, থুক্কু তাকে লিখবে।

আমার ‘থুক্কু’তে সে এমন শব্দ করে হেসে উঠলো যে...

দীর্ঘ সাতবছর পুষ্প ছিলো না, কিন্তু তার হাতে কলম ছিলো, আর ছিলো তার প্রাণের সখী রোযনামচা! মাঝে মধ্যে আমার কাছে পাঠাতো রোযনামচার কিছু নির্বাচিত লেখা।

সেই মেয়েটি এখন মা, একটি মেয়ের! তার এখনকার রোযনামচা পড়ে আমি অবাক হই। ¯িœগ্ধ একটি পুলক ও বিস্ময় এবং কোমল একটি মুগ্ধতা ও শ্রদ্ধা আমাকে অভিভূত করে। এখন আমি প্রত্যয়ের সঙ্গে বলতে পারি, এমন মেয়ে যখন ঘরে ঘরে ‘জন্ম’ লাভ করবে তখনই আমরা পাবো আদর্শ মা। তাদের কোল আলো করে যে চাঁদের কণারা আসবে...

ফিরে আসি আগের কথায়। বলছিলাম, এ অভিযোগ এখন আর শুনতে পাই না যে, কী লিখবো, কীভাবে লিখবো বুঝতে পারি না। এখন আমার চারপাশে ছেলেরা এবং ‘পর্দার নিরাপদ আড়ালে’ মেয়েরা কিছু পরিমাণে হলেও এবং যেমনই হোক, রোযমাচা লিখছে। তবে এখানে সত্যের অনুরোধে বলতে হয়, অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও মেয়েরা যথেষ্ট এগিয়ে আছে এবং অনেক অনুকূলতার মধ্যেও ছেলেরা বেশ পিছিয়ে আছে।

এখন যে অভিযোগটি শুনতে পাই তা হলো, অনেক দিন থেকে রোযনামচা তো লিখছি, কিন্তু তেমন উপকার তো পাচ্ছি না!

আমার এক তালিবে ইলমকে এ কথার উত্তরে সেদিন বলেছিলাম, হয়ত লিখছো, তবে নিয়মিত নয়; হয়ত নিয়মিত লিখছো, তবে আন্তরিকতার সঙ্গে নয়, প্রীতি ও মমতার সঙ্গে তো নয়ই।

রোযনামচাকে ভালোবাসতে শেখো। রোযনামচাকে ভালোবাসা, অন্তরঙ্গতা এবং প্রীতি ও মমতা দান করো, তার পরে দেখো, রোযনামচা তোমাকে কী দান করে!

আমার কিছু ছেলে এবং বেশ কিছু মেয়ে রোযনামচাকে সেই ভালোবাসা ও মমতা দিয়েছে, দিতে পেরেছে। রোযনামচার কাছ থেকে, কলম ও কালির কাছ থেকে বিনিময়ে তারা পেয়েছে উন্নত চরিত্র, উত্তম চিন্তা, জীবন ও জগতের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক, মানুষের প্রতি প্রীতি ও ভালোবাসা, দুঃখী ও অভাবী মানুষের জন্য কিছু করার আকুতি এবং পেয়েছে উম্মতের প্রতি দরদ-ব্যথা, উম্মাহ্র জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার প্রত্যয় ও প্রেরণা।

তারা এখন লিখতে শিখেছে। তাদের লেখায় এখন প্রাণ আসতে শুরু করেছে! তাদের লেখায় এখন আমি আমার হৃদয়ের স্পন্দন শুনতে পাই; আমার বুকের তাপ ও উত্তাপ অনুভব করি! তাদের লেখায় আমি আমার অশ্রুর নোনা স্বাদ বুঝতে পারি!!

জানি, সংখ্যায় তারা অল্প। তবু হৃদয় সান্ত¡না গ্রহণ করে এই ভেবে যে, আকাশের তারা যেমন অসংখ্য, হয়ত একদিন ...!!

***

আচ্ছা, আবেগের উদ্যান থেকে আবার ফিরে যাই বাস্তবতার অঙ্গনে। যারা রোযনামচা লিখতে চায় এবং তার দ্বারা যথাযথরূপে উপকৃত হতে চায় তাদের জন্য আমার কিছু পরামর্শ-

প্রথমত এ পর্যন্ত রোযনামচা সম্পর্কে যা কিছু লেখা হয়েছে সেগুলো এখনো সংরক্ষিত আছে পুষ্পের বিভিন্ন সংখ্যায় এবং পুষ্পসমগ্রে, আর কিছু রয়েছে এসো কলম মেরামত করি গ্রন্থে। আমি অনুরোধ করবো, সেগুলো যেন বারবার পড়া হয় এবং পূর্ণ মনোযোগ ও একাগ্রতার সঙ্গে। তারপর সে আলোকে নিয়মিত রোযনামচা লেখার সাধনায় আত্মনিয়োগ করতে হবে।

দ্বিতীয়ত এ পর্যন্ত পুষ্পের পাতায় বহু রোযনামচা ছাপা হয়েছে। কিছু হলো শিশুদের উপযোগী, কিছু কিশোর ও তরুণদের উপযোগী, আর কিছু যুবক ও বড়দের উপযোগী। এগুলো একাগ্রতার সঙ্গে পড়া উচিত এবং নিজের লেখায় এগুলোর অনুসরণ করা উচিত।

তৃতীয়ত বড়দের বহু রোযনামচা ছাপার হরফে এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলো সংগ্রহ করে অধ্যয়ন করা উচিত এবং নিজের রোযনামচায় ঐগুলোর ‘উত্তম’ বৈশিষ্ট্য, কিছু যদি থাকে, গ্রহণ করা উচিত।

আমি বিশ^াস করি, এভাবে যদি কেউ নিয়মিত রোযনামচা লেখার চর্চা করে এবং সাধনা করে তাহলে রোযনামচাই হতে পারে তার জন্য একজন আদর্শ শিক্ষক, যে তাকে শিক্ষা দেবে প্রথমত সুন্দর চিন্তা ও চরিত্র, দ্বিতীয়ত তাকে শিক্ষা দেবে, কী ভাবে পথ চলতে হয়, কীভাবে জীবনের স্বপ্ন দেখতে হয় এবং কীভাবে স্বপ্নের বাস্তবায়নের পথে সুসংহত পদক্ষেপে এগিয়ে যেতে হয়।

রোযনামচা হবে তার জন্য এমন এক আদর্শ বন্ধু যে তাকে....