শিশু-কিশোর ও নবীনদের পত্রিকা

মাসিক আল-কলম-পুষ্প

জিলহজ্ব ১৪৪০ হিঃ (৩/৮) | রোযনামচার পাতা

হাফিদা শামস ও উম্মে হাবীবার রোযনামচা!

হাফিদা শামসের  রোযনামচা

৫-৪-৪০ হি.

সন্ধ্যা থেকে গানের আওয়াযে বড় কষ্ট হচ্ছে। মাঝে মধ্যে ওয়াযের আওয়াযেও কষ্ট হয়। গোনাহ ও পাপাচার যদি কষ্টের কারণ হয়, বরদাশত করা যায়। নেক আমল যদি মানুষের কষ্টের কারণ হয় তাহলে! হাঁ, মাইকের মাধ্যমে উচ্চ চিৎকারের ওয়ায অনেক সময় অসহনীয় হয়ে ওঠে। শুনেছি হযরত উমর রা. ঐ ব্যক্তিকে শাসন করেছেন যিনি মসজিদে নববীতে উচ্চস্বরে ওয়ায করছিলেন । তাহলে...

কত রকম হতে পারে জীবন! এখানে কত আনন্দ, উল্লাস! আলোকসজ্জার কী বিপুল আয়োজন! অথচ পাশেই অন্ধকার ঝুপড়ি। প্রয়োজনের আলোটুকুও নেই।

যিনি জীবন দিয়েছেন তিনিই তো দিয়েছেন জীবনের সুখ এবং দুঃখ। ছবর ও শোকর হলো তা প্রকাশের মাধ্যম। কিন্তু আফসোস, দুঃখের সময় তো একটু হলেও মনে পড়ে, কিন্তু সুখের সময়! যিনি সুখ দান করেছেন তারই নাফরমানি! আল্লাহ্, তুমি মাফ করো।

৭-৪-৪০ হি.

মা তার সন্তানের জন্য কতটুকু, আর সন্তান তার মায়ের জন্য কতটুকু! ফোঁটা ফোঁটা দুধ, আর ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু!

১-২-৪০ হি.

আমাদের ছোট্ট বাগানে যে লাউ গাছ তাতে একটা লাউ ধরেছে। প্রতিদিন গিয়ে দাঁড়াই গাছটির পাশে। একটু একটু করে পরিবর্তন হচ্ছে, বড় হচ্ছে। জীবনের এরূপ পরিবর্তন এত কাছ থেকে এমন নিবিড়ভাবে সম্ভবত আর কখনো দেখা হয়নি। ছোট্ট লাউটির মুখ এতদিন উপরের দিকে ছিলো। যত বড় হচ্ছে ততই নীচের দিকে ঝুঁকছে। মুগ্ধ বিস্ময়ে এ পরিবর্তন আমি দেখি, আর মনে পড়ে পুষ্পের একটি লেখা যার শিরোনাম হলো, ‘যিনি যত বড় তিনি তত বিনয়ী।

০০ তোমার এ নিবিড় পর্যবেক্ষণ আমাকে মুগ্ধ করেছে। বিশেষ করে প্রসঙ্গক্রমে পুষ্পের লেখার শিরোনাম মনে পড়া। এটা

 

তোমার রোযনামচাকে বেশ উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে। তোমার অবগতির জন্য বলছি, এ চিন্তা সর্বপ্রথম যিনি উপদেশ আকারে তুলে ধরেছেন তিনি শেখ সাদী। তিনি বলেন, ‘যে ডালে ফল ধরে সে ডাল ঝুঁকে থাকে।’

১১-৪-৪০ হি.

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। জানালার পাশে বসে আছি। ভোরের লাল সজীব সূর্যটি পশ্চিম দিগন্তে কেমন বিষণœ মলিন অবস্থায় ডুবে যাচ্ছে। ভোরের সূর্যকে সন্ধ্যায় এত বিষণœ মনে হয় কেন! একি বিদায়ের বিষণœতা! আসলে বিষণœতা থাকে আমাদের অনুভবে। সূর্য কেন বিষণœ হবে! তার তো একদিকের বিদায়ে অন্যদিকের উদয়। এভাবে আড়াল হয়ে হয়ত সূর্য মনে করিয়ে দেয় আমাদের বিদায়ের কথা। প্রতিদিনের দেখা দৃশ্য বলে হয়ত হৃদয়ে তেমন কোন...।

প্রার্থনা করি, জীবনের সূর্য যখন অস্ত যাবে তখন আমরা যেন অর্জন করি এমন উজ্জ্বল সজীব প্রভা যার পরে আর সন্ধ্যা নেই।

১২-৪-৪০ হি.

হুযূরের ‘মা’ লেখাটি পড়লাম, প্রথমে ষষ্ঠ সংখ্যায়, তারপর সপ্তম সংখ্যায়। কীভাবে প্রকাশ করবো হৃদয়ের অনুভূতি! সত্যি ‘মা’-এর কোন তুলনা নেই। যার হৃদয়ে রয়েছে মায়ের প্রতি অফুরন্ত শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, আকুতি ও আত্মনিবেদন তাঁর পক্ষেই শুধু সম্ভব এমনভাবে লেখা। তাছাড়া নিজের চোখেই তো দেখতে পাই মায়ের প্রতি আমার হুযূরের আত্মনিবেদন! কামনা করি, পৃথিবীর সকল সন্তান যেন এমন হৃদয় দিয়েই মাকে বরণ করে, তাহলে সেই সন্তানের জীবন হবে শুভ্র, পবিত্র ও আলোকিত।

শুধু একটি বাক্যের কথা বলি, ‘মায়ের সঙ্গে বার্ধক্যের সিঁড়িতে একটু উপরে নীচে দাঁড়িয়ে থাকা আজকের আমি!’ সত্যি অপূর্ব! বাস্তব চিত্রটি কত সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে! মায়ের সঙ্গে তার প্রথম সন্তানের বয়সের কাছাকাছি পার্থক্যের এই যে অভিপ্রকাশ, এর চেয়ে সুন্দর আর কী হতে পারে!

২০-৪-৪০ হি.

ফজরের সময় জাগ্রত হলাম একটি মৃত্যুসংবাদ শুনে। খুব কাছের মৃত্যু। আমাদের এ ভবনেরই একটি ফ্লাটের বাসিন্দা। মৃত্যু কত নিশ্চিত, তবু আমরা কত নিশ্চিন্ত! আমি তো ঘুমের ঘোরে বেঘোর ছিলাম, অথচ এভবনেই এসেছিলেন মৃত্যুর ফিরেশতা, যার সম্পর্কে ফায়ছালা হয়ে গিয়েছে তার কাছে! তিনি তো পৌঁছে গিয়েছেন তার আখেরি মানযিলে। আমার জন্যও তো রয়েছে নির্ধারিত একটি দিন। হয়ত আরো কিছু সুযোগ রয়েছে সুন্দর মৃত্যুর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার।

হে আল্লাহ্, যিনি চলে গিয়েছেন তাকে মাগফিরাতে কুল্লী নাছীব করুন, আর আমাদের তাওফীক দান করুন...।

২২-৪-৪০ হি.

সকাল থেকে এলাকাটা আজ এত নীরব, যেন নিঝুম এক পল্লীগ্রাম! শুধু পাখী আছে, আর পাখীর কলতান! জানি, এ নীরবতা একদু’দিনের, তবু তো কিছুটা স্বস্তি বোধ হচ্ছে ...! আজ উপলব্ধি হচ্ছে, নীরবতা জীবনে কতটা স্বস্তি আনে।

হয়ত আগামীকাল মানুষের কোলাহলে আবার হারিয়ে যাবে প্রকৃতির এ নীরবতা এবং পাখীর কলতান, তবু কামনা করি, হারিয়ে যাওয়া স্বস্তি যেন কিছুটা হলেও ফিরে আসে আমাদের প্রতিদিনের সকাল-সন্ধ্যার জীবনে।

০০  তোমার প্রতি আমি আন্তরিক কৃতজ্ঞ। তোমার রোযনামচা আমার চোখের পাতা ভিজিয়েছে এবং দিলকে কিছু সময়ের জন্য হলেও নরম করেছে। *

 

 উম্মে হাবীবার রোযনামচা!

১/২/৩৯ হি.

নানা এখন অনেকটা সুস্থ। নানার অসুস্থতার ছায়া যেমন আমাদের দেহ-মনে, পড়া-লেখায় ও কাজকর্মে পড়েছিলো, তেমনি তাঁর সুস্থতার ছোঁয়াও এখন আমাদের সবকিছুতে অনুভূত হচ্ছে। বিশেষ করে আম্মু!

এ ক’দিন আম্মু যেন আর আম্মু ছিলেন না, একজন নিবেদিতপ্রাণ সেবিকার প্রতিমূর্তি হয়ে ছিলেন! কাকে বলে মা-বাবার সেবা ও খেদমত, কিতাবের পাতায় তো অনেক পড়েছি, এবার দেখলাম আমার মাকে, আমার আম্মুকে! আমার গর্ব, আমি এমন মায়ের সন্তান!

অসুস্থতার পর থেকে এখন পর্যন্ত নানা রয়েছেন আম্মুর সার্বক্ষণিক পরিচর্যায়।

নানার কখন কী প্রয়োজন, কী তাঁর ভালো লাগছে, কী ভালো লাগছে না, সব যেন আম্মুর জানা। নানার আহার-নিদ্রা-ঔষধ-পথ্য, সবকিছুর ব্যবস্থা আম্মু করে চলেছেন, ঠিক যেন ঘড়ির কাঁটা ধরে।

কোন কিছু নানাকে মুখে বলতে হয় না, আম্মু যেন নানার মুখ দেখেই অনুমান করে নেন। নানার মনের সঙ্গে আম্মুর মনের যেন অদৃশ্য কোন সংযোগ রয়েছে। আসলে মমতা ও ভালোবাসা এবং দরদ ও মুহব্বতের এমনই হয় টান! আমার মা যেন এখন নানার মা, নানা যেন আম্মুর বুড়ো খোকা! আম্মুকে হাসতে হাসতে বললাম, আমাদের তো তুমি ভুলেই গিয়েছো! আম্মু হেসে বলেন, নইলে আমরা তোমার খেদমত পাবো কীভাবে!

আল্লাহ করুন, আমি যেন হতে পারি আমার আম্মুর মত।

২/২/৩৯ হি.

বৃহস্পতিবার রাত থেকে শনিবার পর্যন্ত একটানা বৃষ্টি! পুরো পরিবেশ শীতল। এখন কার্তিক মাস, হেমন্তকালের শুরু। হেমন্ত মানেই শীতের আমেজ। তারপর তো শীতকাল। বাংলামাসগুলোর কথা ভাবলেই আমার ভিতরটা কেমন চঞ্চল হয়ে ওঠে। প্রকৃতির হলুদ-সবুজ বর্ণে বর্ণীল হয়ে উঠি। যেখানেই থাকি, আমার কল্পনায় থাকে গ্রামবাংলার চিরায়ত রূপ, মেঠো পথ, সবুজ ঘাস, কুঁড়ে ঘর, খড়ের গাদা, বিরাট উঠান ...।

৪/২/৩৯ হি.

আজ আত্-তারীকু ইলা তাফসীরিল কুরআনিল কারীম সমাপ্ত হয়েছে, আল্লাহ্র ফযল ও করমে। আল্লাহ্ আমার প্রিয় আদীব হুযূরকে সর্বোত্তম জাযা দান করুন, আমীন। কিতাবটি পড়তে গিয়ে আমি যেন ডুবে গিয়েছিলাম ইলমের সমুদ্রে। কুরআনুল কারীমের মধুরতা, তার উপর আরবী ভাষার মাধুর্য, তার উপর লেখকের আবেগ ও দরদ, সব মিলিয়ে নূরুন আলা নূর!

৫/২/৩৯ হি.

নানা আগামীকাল চলে যাবেন। সারাটা দিন পার হয়েছে ব্যস্ততা ও বিষণœতার মিশ্র পরিবেশের মধ্যে। সন্ধ্যার পর অনেকেই এলেন নানার সঙ্গে দেখা করে বিদায় জানাতে।

একটু আগে নানার কাছে গিয়ে বসলাম। মাশাআল্লাহ, নানাকে আজ কত সুস্থ-সজীব দেখাচ্ছে! মনে করার চেষ্টা করলাম যেদিন অসুস্থ অবস্থায় এলেন গ্রামের বাড়ী থেকে, রোগে শোকে কেমন বিপর্যস্ত ছিলেন! দেখেই কান্না পেয়েছিলো। আজো কান্না পাচ্ছে। দুই কান্নায় কত তফাত! সেদিন কেঁদেছিলাম নানার অসুস্থতার জন্য, আজকের কান্না হলো নানার বিচ্ছেদের জন্য।

কাল থেকে হায়, এই প্রিয় বুড়ো মানুষটিকে আর দেখতে পাবো না। বিচ্ছেদ এত কষ্টের, তারপরো সত্য এই যে, বিচ্ছেদ ছাড়া জীবন যেন অচল!

৯/২/৩৯ হি.

আজ বাসায় আমার অনেকগুলো  বোন এসেছে। কিছু মানুষ আছে যারা রক্তের কেউ নয়, কিন্তু আত্মার আত্মীয়।

রাত দশটায় কাজের ব্যস্ততা সেরে, সবকিছু গুছিয়ে বসলাম রোযনামচার খাতা নিয়ে। কিন্তু আজ বেশী সময় দিতে পারবো না। এখনি বিদায় জানাবো রোযনামচা বন্ধুকে। এখনই শুয়ে পড়বো, তবে ঘুমোবো না, বোনদের সঙ্গে গল্প করবো। গল্প মানে সুখের কথা, দুঃখের কথা। আমাদের সবার জীবনেই তো থাকে এমন কিছু, যা বলার জন্য আমরা কাছের মানুষকে খুঁজি।

১০/২/৩৯ হি.

একটি ‘ফুলকলি’ এসেছিলো ওর বাবা-মায়ের সঙ্গে। ফুলের মত ছোট্ট মেয়েটি, দু’বছর পূর্ণ হয়নি। আধো আধো বোল কী যে মধুর! এমনভাবে কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে, আদর কেড়ে নেয়, যেন কত দিনের চেনা, কত কালের আপন! সারাটা সময় পুরো ঘর মাতিয়ে রেখেছিলো। যখন চলে গেলো মনটা...! বিদায় দিতেই হলো। বিদায় এমনই অনিবার্য যে, সব আবেগ তার কাছে পরাস্ত হয়।

১২/২/৩৯ হি.

মামার কিতাব আকাবিরে দেওবন্দের ছাত্রজীবন-২ পড়ছি। একটা কথা আছে, ‘মিছরি যত খাও তত মিঠা’, মামার কিতাব যেন তাই!

কিছুই ভালো লাগছে না, মনটা কেমন জানি করছে! কারো কথা খুব মনে পড়ছে। মানুষ কত তাড়াতাড়ি আপন হয়, আবার কত তাড়াতাড়ি পর হয়ে যায়! মনে হয় আমার আপন যারা তাদেরো মন আমি এখনো ভালো করে বুঝতে পারি না। মনেরও বোধহয় একটা মন আছে, যেটাকে বলা যায় ‘ভিতরের মন’।

০০ রোযনামচা ছাড়াও কিছু লেখা পাঠিয়ো।