শিশু-কিশোর ও নবীনদের পত্রিকা

মাসিক আল-কলম-পুষ্প

কাশ্মীরসংখ্যা | হযরত আলী নাদাবীর পাতা

ডাক দিয়ে যায় মুসাফির!

হযরত মাওলানা সৈয়দ আবুল হাসান আলী নাদাবী রহ-এর মধ্যপ্রাচ্যসফরের রোযনামচা

ধারাবাহিক ৬

(গতবারের পর)

তারপর তিনি ফিলিস্তীনের বেদনাদায়ক ঘটনাপ্রবাহের উপর আলোকপাত করলেন। তাতে তিনি ফিলিস্তীন সম্পর্কে আরব-সরকার ও আরবনেতৃত্বের অমার্জনীয় অবহেলা, অবজ্ঞা ও নির্লিপ্ততার বিষয়ও তুলে ধরলেন। তিনি বললেন, ‘আমরাই তোমাদের রক্ষা করবো’ বলে ফিলিস্তীনীদের হাত থেকে সামান্য যা কিছু সেকেলে অস্ত্র ছিলো তাও, বলতে গেলে ছিনিয়ে নেয়া হলো। ফলে ইহুদি আগ্রাসনের মুখে তারা হয়ে পড়লো সম্পূর্ণ নিরস্ত্র অসহায়। নিজের আবরু ইজ্জতের হিফাযত করবে, আর একদু’টো ইহুদিকে মেরে তারপর মরবে, সে উপায়ও থাকলো না। ফল দাঁড়ালো এই যে, ফিলিস্তীনের একেকটি জনপদে বস্তিতে ইহুদি হায়েনারা অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়তো, আর দেখতে দেখতে অসহায় মানুষগুলো ‘ছাফ্ফান ছাফ্ফা’ হয়ে যেতো। প্রতিটি বস্তি যেন ছিলো ইহুদি হায়েনাদের মুখের উপাদেয় গ্রাস। আরবসরকার ও তাদের জেনারেলরা, ফিলিস্তীন যাদের কাছে কোন ‘ইস্যু’ই ছিলো না, দূর থেকে শুধু তামাশাই দেখে গেলো। বস্তুত জাতি ও যুদ্ধের ইতিহাসে এর চেয়ে বেদনাদায়ক তামাশা আর দ্বিতীয়টা নেই। আরবরা যদি ফিলিস্তীনী যোদ্ধাদের শুধু তাদের নিজেদের অবস্থার উপর ছেড়ে দিতো, সেটাও হতো অনেক ‘বড় দয়া’! তাহলে অন্তত আত্মরক্ষার লড়াইটা তারা লড়তে পারতো সাহস ও বীরত্বের সঙ্গে, যেমন এতদিন লড়েছে। কিন্তু এখানে অবস্থা ছিলো ‘হাত-পা বেঁধে ক্ষুধার্ত নেকড়ের মুখে ছেড়ে দেয়া’র মত! ...

এরপর আমাদের আলোচনা হলো সমকালীন উম্মাহর বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ ও জাতীয় নেতৃবৃন্দের নৈতিক অবক্ষয় সম্পর্কে। তাতে যে চিত্র উঠে এলো তা যেমন লজ্জাজনক ও বেদনাদায়ক তেমনি মুসলিম উম্মাহর ভবিষ্যতের জন্য...।

একপর্যায়ে আমি মন্তব্য করলাম, ‘আগে উম্মাহর আলিমগণ ‘রিজাল’ সম্পর্কে পর্যবেক্ষণগ্রন্থ রচনা করতেন, পরিভাষায় যার পরিচয় হলো ‘জারাহ্-তা‘দীল’। সেটা ছিলো ব্যক্তিগত রাগ-বিরাগের ঊর্ধ্বে সম্পূর্ণ শাস্ত্রীয় বিষয় এবং আগাগোড়া গঠনমূলক, যার পিছনে একমাত্র কার্যকর ‘প্রেরিকা’ ছিলো উম্মাহর কল্যাণকামনা। কিন্তু এখন যেহেতু রাজনীতি এবং নেতা ও নেতৃত্বের নতুন যুগ; সবকিছুর উপর যেহেতু রাজনৈতিক দর্শনের একচ্ছত্র প্রভাব, বরং বলা যায়, সর্বপ্রকার ইলমসাধনা ও জ্ঞানগবেষণার স্থান দখল করে নিয়েছে রাজনীতির দর্শন সেহেতু আপনি রাজনৈতিক নেতৃবর্গ ও ইসলামী নেতৃত্বের উপর সমালোচনা -গ্রন্থ রচনা করেছেন

১। সমসাময়িক বিভিন্ন ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে উস্তায মুহম্মদ আলী তাহিরের সব মতামত ও পর্যবেক্ষণের সঙ্গে আমি একমত নই। আমার মনে হয়েছে, তাতে যথেষ্ট কঠোরতা, এমনকি কিছুটা সীমালঙ্ঘনও রয়েছে।

বিদায়ের সময় আমরা নিজেদের লেখা গ্রন্থের বিনিময় করলাম। আমি তাকে মাযা খাসিরা-এর নোসখা দিলাম। তিনি আমাকে তাঁর সম্পাদিত ‘আমীর শাকীব আরসালান’ স্মারকগ্রন্থটি দিলেন। তাতে ঐ সকল শোকগাঁথা ও শোকপ্রবন্ধ সঙ্কলিত হয়েছে যা মরহূমের মৃত্যুর পর অনুষ্ঠিত বিভিন্ন শোকসভায় পঠিত হয়েছে, বা মরহূমের বন্ধুমহল ও ভক্তবৃন্দ পত্রপত্রিকায় লিখেছেন।

তিনি আমাকে আরো দু’টি মূল্যবান কিতাব উপহার দিলেন, যার একটি হলো فَظائِعُ الانْـجِليز فـي فِلَسطينَ وَغَدْرُ اليَهودِ وَصَبْرُ العَرَبِ

(ফিলিস্তীনে ইংরেজের বর্বরতা, ইহুদিদের ধূর্ততা এবং আরবদের ধৈর্য)

দ্বিতীয়টি হলো معتقل هاكستب (একটি বন্দীশিবিরের কাহিনী)

এর মধ্যে কতিপয় দর্শনার্থী উপস্থিত হলেন। তিনি তাদের সঙ্গে আমাদের পরিচয়বিনিময় করিয়ে দিলেন। তাদের একজন হলেন আরবলীগের সহকারী মহাসচীব উস্তায আহমদ শাকীরী, আরেকজন হলেন ইয়ামেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচীব কাযী মুহম্মদ আব্দুল্লাহ্ আলউমারী। কথা হলো, সচীব মহোদয়ের সঙ্গে তার হোটেলে দেখা হবে মঙ্গলবার এবং আহমদ শাকীরীর সঙ্গে দেখা হবে মঙ্গল বা বুধবার।

হাম্মামখানার দুঃখজনক নির্লজ্জতা

৫/৫/৭০ হি.Ñ ১১/২/ ৫১ খৃ.

রোববার

আজ গরম পানির উত্তম স্নানের উদ্দেশ্যে হাম্মামখানায় গেলাম। মিশরের হাম্মামখানা তুর্কী রীতি-নীতি ও ব্যবস্থাপনার অনুরূপ। তবে হাম্মামখানায় প্রবেশ করে রীতিমত স্তম্ভিত হতে হলো। কিশোর, তরুণ, যুবক ও বয়স্ক সবাই উলঙ্গ। বলা যায়, গায়ে একটা সুতাও নেই। পশুতে মানুষে কোন পার্থক্যই যেন নেই, বরং ভুল হবে না, যদি বলি, পশুরাও লজ্জাপাবে, এমন অবস্থা। শরীয়ত তো শরীয়ত, সাধারণ ভদ্রতা ও মানবত্ব থেকেও যেন নীচে নেমে গিয়েছে। শেষ পর্যন্ত ¯স্নানের ইচ্ছা বর্জন করে ‘ম্লান বদনে, বিষণ মনে’ তখনই হাম্মামখানা থেকে বেরিয়ে এলাম। ‘হাম্মামখানায় সবাই নাঙ্গা’ কথাটা তাহলে এমনি এমনি তৈরী হয়নি!

আজ রাজা ফারুকের জন্মদিন। এ উপলক্ষে সারা শহর নতুন সাজে সেজেছে। মিশরীয়দের অন্ধ রাজভক্তি ও চরম আত্মনিবেদনের কাহিনী তো প্রাচীন কাল থেকেই প্রসিদ্ধ। আহমদ উছমান আগ্রহ দেখালেন, তার সঙ্গে আবেদীন রাজমহল যেন দেখতে যাই। আমিও ‘নিমরাজি’ হলাম, যাতে মিশরীয়দের উৎসব ও আনন্দ- বিনোদনের রীতিপ্রথা বুঝতে পারি। নিয়ম অনুযায়ী আহমদ উছমান আগেই আমাদের নাম তালিকাভুক্ত করে নিলেন।

সংবাদপত্রের বেহায়াপনা

রাজা ফারুকের জন্মদিন উপলক্ষে সবক’টি জাতীয় দৈনিক ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে। তাতে রাজার বিভিন্ন ছবি যেমন এসেছে তেমনি হবু রাণী, যার সঙ্গে আজই রাজার বাগদান সম্পন্ন হয়েছে, তারো বিভিন্ন পোজের ছবি রয়েছে। ছবিগুলো এমন যে, কোন মুসলিম নারীর পক্ষেই শোভন ও গ্রহণযোগ্য নয়। যে ভদ্রমহিলা কয়েক দিনের ব্যবধানে মিশরের রানীরূপে বরিত হতে চলেছেন তার এমন খোলামেলা ছবি পত্রপত্রিকায় আসা কিছুতেই সমীচিন ছিলো না, যার উপর ভালো-মন্দ সব মানুষেরই নযর পড়বে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা তো এই যে, রুচি ও দৃষ্টিভঙ্গিরই পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। সংবাদপত্র এখন এমনই ‘প্রগতিশীল’ যে, বাকস্বাধীনতা থাক বা না থাক, শালীনতার বিষয়ে রয়েছে অবাধ স্বাধীনতা, কোন বাধানিষেধই যেন নেই। নগ্নতা অপছন্দ করে, এমন মানুষ সংখ্যায় খুবই কম, তদুপরি তাদের কোন ‘ধার-ভার’ নেই।

যাই হোক, শায়খ আহমদ যথাসময় এলেন। আমরা আবেদীন মহলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম এবং জনাকীর্ণ পথ অতিক্রম করে মহলপ্রাঙ্গণে উপস্থিত হলাম। সেখানে বড় তাজ্জব দৃশ্য! উৎসবের নানা রঙ্গের জাঁকজমকপূর্ণ পোশাকে অসংখ্য মানুষের সমাগম! সবার যেন আজ জীবনের সেরা আনন্দের দিন! আমরা দর্শকখাতায় স্বাক্ষর করে ভিতরে প্রবেশ করলাম। ঘুরে ফিরে যা দেখলাম, এককথায় বলা যায়, একজন মানুষের বিলাসী জীবনের অকল্পনীয় আয়োজন, আর শুধু দেখেই মুগ্ধ একদল বঞ্চিত মানুষের অর্থহীন আনন্দ।

পিরামিডের পীড়া

মিশরের পিরামিড সম্পর্কে অনেক কিছু পড়েছি, অনেক কিছু শুনেছি। তাই পিরামিড দেখার আগ্রহ ছিলো। বলা হয়, একজন পর্যটক মিশরে এসে পিরামিড দেখলো না, তো কিছুই দেখলো না। এরূপ প্রবচনে আমাদের বিশ্বাস ছিলো না। সম্ভবত, এটা নিছক ‘পর্যটনীয় প্রচারণা’। তবু আমরা পিরামিড দেখতে গেলাম এবং দেখলাম। দেখে অবাকও হলাম। কিন্তু কথাটার কোন সার্থকতা খুঁজে পেলাম না! এটা ঠিক যে, পিরামিড হচ্ছে প্রাচীন ইতিহাসের সবচে’ দীর্ঘস্থায়ী বিশাল এক স্থাপনা এবং তা পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের একটি; কিন্তু...!পিরামিড আছে বেশ কয়েকটি, তবে সবচে’ বড় পিরামিডটি সমরাট খুফু-এর সমাধিরূপে প্রসিদ্ধ। পিরামিড আসলেও ফারাউঁ (বা ফিরআওন) নামে খ্যাত প্রাচীন মিশর-সমরাটদের সমাধিক্ষেত্র ছাড়া আর কিছু নয়। বড় বড় পাথরখ- জোড়া দিয়ে নির্মিত এক বিশাল ও সুউচ্চ স্থাপনা। এর ভিত্তি সমচতুর্ভুজ, তবে উপরের দিকে ক্রমশ সঙ্কুচিত হতে হতে ত্রিভুজ আকারে একেবারে চূড়ায় একটি বিন্দুতে গিয়ে মিশেছে। পুরোস্থাপনাটির জ্যামিতিক মাপ এমনই নিখুঁত যে, এযুগের মানুষও অবাক বিস্ময়ে শুধু তাকিয়ে থাকে। এত বড় বড় প্রস্তরখ- দূরবর্তী পাহাড় থেকে কেটে কেটে কীভাবে আনা হতো তাও এক বিস্ময়ের বিষয়।

পিরামিডের শানদারি এবং তার প্রততাত্ত্বিক গুরুত্ব ও দুর্লভতার বিষয় না হয় মেনে নিলাম। কিন্তু এর অস্তিত্বের সঙ্গে যে জড়িয়ে আছে হাজার হাজার বনী আদমের উপর বর্বর নির্যাতন এবং বেগার-শ্রমের নিষ্ঠুর কাহিনী তা ভুলি কীভাবে?! সুতরাং আমার চোখের সামনে তো ছিলো, পিরামিডের বিস্ময়, কিন্তু কল্পনায় ছিলো সেই সব অসহায় বেগার শ্রমিকদের ছবি, যাদের পিঠের উপর ‘কাজে শিথিলতা’র নামে চলতো শপাং শপাং চাবুকের আঘাত; যাদের শরীর থেকে ঘাম এবং ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরতো একই সঙ্গে। এমনকি অনেকে পাথর টানতে টানতেই হয়ত মাটিতে লুটিয়ে পড়তো লাশ হয়ে। এসব বিশাল বিশাল স্মৃতিস্তম্ভের মূলে ছিলো কী? আর কিছু না, শুধু ক্ষমতার বুভুক্ষা ও অমরত্বের উদগ্র লালসা। পিরামিডের এই যে বিশাল স্থাপনা, এর হাকীকত কী? কোন সমরাটের সমাধি বা কবর ছাড়া তো আর কিছু নয়! সে জন্য তো দু’গজ জমিই যথেষ্ট! কিন্তু না, প্রতাপ ও পরাক্রম প্রদর্শনের এবং নিজেদের কলঙ্কিত অস্তিত্বের স্মৃতি রেখে যাওয়ার উদগ্র লালসাই তাদের প্ররোচিত করেছে দীর্ঘকাল ধরে এ অর্থহীন কাজের পিছনে সময় ও সম্পদের দেদার অপচয় এবং অসংখ্য বনী আদমের বেগার শ্রমের ঘাম শুষে নেয়ার পিছনে। তাই মনের ভিতর থেকে শুধু ঘৃণার অনুভূতিই বের হয়ে আসতে চায় এই বিশাল পিরামিড ও তার ‘নির্মাতাদের’ প্রতি। চোখের সামনে এসব দেখে শুধু মনে পড়ে কোরআনের আয়াত, যার চিরন্তন সত্যতারই যেন বাস্তব চিত্র এগুলো

أَتَـبْـنُـونَ بِـكُلِّ رِيـعٍ آيـَــةً تَـعْـبَـثـون وَتَـتَّـخِـذُونَ مَصـانِـعَ لَعَـلَّــكُمْ تَـخْـلُدُون

তোমরা কি প্রত্যেক উঁচু স্থানে ইয়াদগার ও স্মৃতিস্থাপনা তৈরী করো নিছক খেলাচ্ছলে, আর...!

মোটকথা, পিরামিড নামের এ অর্থহীন কর্মযজ্ঞে যে বিপুল সময় ও সম্পদ এবং শ্রম ও শক্তি ব্যয় হয়েছে এবং মানষের চিন্তা ও যোগ্যতার যে নির্দয় অপচয় ঘটেছে তার জন্য আমাদের অন্তরে বড় আফসোস হলো; অথচ এখন এগুলোর আর কোন ক্ষতিপূরণ নেই।

এখান থেকে আমরা কতিপয় মন্দির ও দেবালয় দেখতে গেলাম যেখানে বহু ভাস্কর্য, মূর্তি ও প্রতিমার অধিষ্ঠান ছিলো, আর ছিলো অসংখ্য দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ। ‘দেবালয় ও দেবতা’ সম্পর্কে গাইড আমাদের ঐ সব তথ্যই শুনিয়ে যাচ্ছিলেন যা তিনি প্রততত্ত্বের বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে বা অন্যকোন সূত্রে আয়ত্ত করেছেন। তার বর্ণনা ছিলো একেবারেই নির্বিকার ও ভাবলেশ-হীন, যেন চাবিদেয়া টেপরেকর্ডার! জীবিকার প্রচেষ্টারূপে গ্রহণযোগ্য!

আবুল হাওল নামের সবচে বড় ও বিশাল (দৈর্ঘ্যে ২৪০ ফুট, উচ্চতায় ৬৬ ফুট) ভাস্কর্যটাও দেখা হলো, যার শরীর সিংহের, আর মুখম-ল পুরুষের। কত অদ্ভুত আর উদ্ভট মানুষের কল্পনা!

এই দর্শন, পরিদর্শন ও ভ্রমণের পিছনে কয়েক ঘণ্টা সময় ব্যয় করে তারপর আমরা অবস্থান-ক্ষেত্রে ফিরে এলাম।

আযহার ও তার চারপাশে কিছু সময়

৬/৫/৭০ হি. ১২/২/৫১ খৃ.

সোমবার

দিনটি ছিলো বৃষ্টিভেজা, তবে এমন নয়, যাতে আসা যাওয়া ও বাইরে বের হওয়া বিঘত হবে। হালকা, ঝিরঝির বৃষ্টি। কেউ খালি হাতে, কেউ ছাতামাথায় স্বচ্ছন্দেই বের হচ্ছে। আমরাও বের হলাম দশটার দিকে। প্রততত্ত্ব বিভাগের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক উস্তায হাসান আব্দুল ওয়াহ্হাব বেগ-এর সঙ্গে সাক্ষাতের এবং আযহার ও তার আশপাশের বিভিন্ন প্রততাত্ত্বিক নিদর্শন দেখার জন্য এটাই ছিলো পূর্বনির্ধারিত সময়। আযহারের ফটকের সামনে আমরা একত্র হলাম। শায়খ আহমদ উছমানও আমাদের সঙ্গে ছিলেন। প্রথমে আমরা ঐ গ্রন্থাগার পরিদর্শন করলাম যা খিদবী আব্বাস হিলমীর যামানায় পাশাপাশি অবস্থিত দু’টি মাদরাসায় সম্মিলিতরূপে বিদ্যমান ছিলো এবং তাতে বিভিন্ন মূল্যবান প্রাচীন কিতাব ও পাণ্ডু-লিপির বড় সংগ্রহ ছিলো। পরে তা আযহারে স্থানান্তরিত হয়। কিছু কিছু ব্যক্তিগত সংগ্রহও ঐ গ্রন্থাগারে দান করা হয়েছিলো। তারমধ্যে সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ হলো মরহূম সোলায়মান পাশা ইবাযা’র গ্রন্থাগার।

উস্তায হাসান আব্দুল ওয়াহ্হাব আমাদের ঐ সকল হস্তলিখিত গ্রন্থ দেখিয়ে গেলেন যা চতুর্থ-পঞ্চম হিজরীতে প্রস্তুত করা হয়েছিলো। সেখানে আমরা প্রাচীন কিতাব ও দুর্লভ পাণ্ডু-লিপি পরিদর্শন করলাম এবং বিভিন্ন রাজকীয় মুছহাফ ও পাঞ্জে সূরা-এর পাণ্ডু-লিপি সম্পর্কে অবগত হলাম। এগুলো পৃথিবীর যে কোন কুতুবখানার জন্য শোভাবর্ধকরূপে গণ্য হতে পারে। সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ যে জিনিসটি দেখার সৌভাগ্য হলো তা হচ্ছে আবু ইসহাকের কিতাব

رسوم دار الخلافـة এর পাণ্ডু-লিপি, যা লেখকের নিজের পাণ্ডু-লিপি থেকে নকল করা হয়েছে। সম্ভবত এর কোন নোসখা একমাত্র আযহারের কুতুবখানাতেই বিদ্যমান রয়েছে। এ কিতাবে আব্বাসী শাসনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক চালচিত্র সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। আয়-ব্যয়ের হিসাবেরও একটা চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

উস্তায হাসান আব্দুল ওয়াহ্হাব বিভিন্ন দুর্লভ ও মূল্যবান কিতাব ও পাণ্ডু-লিপি দেখানোর ফাঁকে ফাঁকে কুতুবখানার বিভিন্ন প্রকোষ্ঠ, মেহরাব ও গ্যালারির নির্মাণশৈলীর প্রতিও আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে চলেছিলেন। নির্মাণকাল ও ক্রমইতিহাস সম্পর্কে যেমন আলোচনা করছিলেন তেমনি নির্মাতাদের উদার পৃষ্ঠপোষকতা সম্পর্কেও বলছিলেন। পুরো সময় আমরা মনোযোগী শ্রোতা হিসাবেই ছিলাম।

পরে আমরা প্রাচীন অংশ পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে আযহারের মূল ভাগে গেলাম, যা ফাতেমী খলীফা মু‘ইয লি দ্বীনিল্লাহ তৈরী করেছেন। পরে আমীর আর্ব্দু-রহমান কাত্খোদা ও অন্যরা যা করেছেন তা হলো সংযোজন ও সম্প্রসারণ। এভাবে বহু প্রজন্মের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছে আজকের আযহার।

উস্তায হাসান আব্দুল ওয়াহ্হাব ছাহেব এই মহান ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের ক্রমপরিবর্তন ও বিবর্তনের ধারাবাহিক ইতিহাস তুলে ধরছিলেন। তাতে একদিকে যেমন তার জ্ঞানগভীরতা ও শাস্ত্রীয় প্রজ্ঞার উদ্ভাস ঘটলো তেমনি আযহারের প্রতি তাঁর আন্তরিক ভালোবাসাও প্রকাশ পেলো। এমনিতেও তিনি মিশরে প্রততত্ত্ব-বিষয়ের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব।

আমরা আযহার থেকে বের হলাম এবং প্রাচীন মাদরাসা মানছূর কালাঊন যাওয়ার পথে বিভিন্ন বাজার অতিক্রম করলাম। একসময় মহান বাদশাহ নাজমুদ্দীন আইয়ূবী-এর প্রতিষ্ঠিত মাদরাসার পাশ দিয়ে গেলাম, যিনি এ অঞ্চলে ক্রশেডারদের উপর ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করেছিলেন, যার ফলে পুরো এলাকার নাম হয়েছে মানছূরা (বিজয়প্রাপ্ত)।

মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো চারমাযহাবের (স্বতন্ত্র ও তুলনামূলক) শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে, যা তখনকার বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজে অত্যন্ত ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী অবদান রেখেছিলো। আমরা মাদরাসার (মসজিদের) সুউচ্চ ও সুদর্শন মিনার দূর থেকে দেখতে পেলাম, আর আমাদের অন্তরে এই মহান বাদশাহর হাতে ধরে রাখা ইসলামী ঝাণ্ডার গৌরবপূর্ণ দৃশ্যটি ভেসে উঠলো, যা তিনি ছালীবীদের বিরুদ্ধে লাগাতার জিহাদের সময় ধারণ করেছিলেন।

উস্তায হাসান বললেন, মসজিদে শাসকদের সমাহিত করার প্রথা ফাতেমী আমলে ছিলো না, এমনকি আইয়ূবী শাসনের শুরুতেও না। এ ধারা আসলে শুরু হয়েছে আইয়ূবী আমলের শেষদিকে। এরপরে সুলতানদের মধ্যে এর প্রচলন দেখা যায়।

মানছূর কালাঊন মাদরাসা

আমরা খানখলীলী বাজার অতিক্রম করে মানছূর কালাঊন মাদরাসায় প্রবেশ করলাম। এর অভিজাত ও শানদার ইমারতগুলো ইতিহাসের বড় মূল্যবান ও মহিমাপূর্ণ স্মৃতিরূপে এখনো দাঁড়িয়ে আছে। জনশ্রুতি এই যে, এর নির্মাণে মাত্র চৌদ্দমাস সময় ব্যয় হয়েছে। কিন্তু উস্তায হাসন অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, আসলে সময় লেগেছে সাত বছর আটমাস। এর সমর্থনে উস্তায হাসান তথ্য উপস্থাপন করলেন এভাবে ‘ইতিহাসের সূত্রগুলো এ বিষয়ে একমত যে, নির্মাণকাজের উদ্বোধন-কাল ছিলো ৬৮৩ হিজরীর রবিউছ্-ছানির শুরু। পক্ষান্তরে সুলতান মানছূরের ইন্তিকাল হয়েছে ৬৮৯ হিজরীর জিলকাদ মাসে। তাঁর কফিন পাহাড়ের চূড়াস্থ দুর্গে নিয়ে রাখা হয়। ৬৯০ হি. পয়লা মুর্হরম বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত তার মরদেহ সেখানেই ছিলো। দোসরা মুর্হরম তাঁকে সেখান থেকে মাদরাসা মানছূরিয়ায় তাঁর মূল কবরে সোপর্দ করা হয়, যা তিনি নিজের উদ্যোগে প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। বলাবাহুল্য যে, এখানকার ইমারতের নির্মাণকাজ তখন যদি সম্পন্ন হতো তাহলে এখানেই তাঁকে দাফন করা হতো। কেল্লায় নেয়া হতো না এবং এত দীর্ঘ সময় সেখানে রাখা হতো না। এটাই মনে হয় যে, যখন দেখা গেলো, নির্মাণ শেষ হতে আরো সময় লাগবে তখনই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিলো, আর বিলম্ব না করে মানছূরিয়ার কবরে দাফন করার। পুরো ইমারত বা স্থাপনাটি হচ্ছে মাদরাসা, গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ ও হাসপাতাল, যাতে ঘটেছে নির্মাণ শিল্পের বিভিন্ন চমকপ্রদ নকশার অপূর্ব সমন্বয়। বস্তুত কায়রোর ইসলামী ইমারতগুলোর মধ্যে এটি হচ্ছে খুব শানদার এক ঐতিহাসিকস্মৃতি। এটি মু‘ঈয লিদ্বীনিল্লাহ্ সড়কে দু’টি প্রাচীন ফাতেমী প্রাসাদের মাঝখানে অবস্থিত।

সুহায়মি প্রাসাদে

এর পর আমরা একটি ঐতিহাসিক বাড়ী বা প্রাসাদ পরিদর্শন করতে  গেলাম। এটি সোহাইমী প্রাসাদ নামে পরিচিত, যা তুর্কী আমলের শাসক ও অভিজাত শ্রেণীর, একই সঙ্গে ঐ শ্রেণীর লোকদের জীবন-ধারার নমুনা তুলে ধরে যারা যুগপৎ ইলম, আমল ও সম্পদের অধিকারী ছিলেন। ভবনটির আকার-কাঠামো দেখে মনে হলো আধুনিক বাড়ীঘরের তুলনায় এতে বসবাস করা বেশী আরামদায়ক ও সুবিধাপূর্ণ। ...

আছরের পরের সময়টা আমি

المد والجزر فـي تـاريـخ الإسلام

পুস্তিকার প্রুফ সংশোধনের কাজে ব্যস্ত ছিলাম। এ উপলক্ষে মাগরিবের পর পর্যন্ত আনছারুছ্-ছুন্নাহ ছাপাখানায় থাকা হলো।

৭/৫/৭০ হি. ১৩/২/৫১ খৃ.

মঙ্গলবার

ইয়ামানের পররাষ্ট্রসচীবের সঙ্গে আলোচনা

আজ আমরা ইয়ামানের পররাষ্ট্র-সচীব কাযী আব্দুল্লাহ্ উমারীর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য কাছরুল জাযীরাহ্ হোটেলে গেলাম, যেখানে তিনি অবস্থান করছেন। আমরা উপরের তলায় তাঁর কক্ষে উপস্থিত হলাম। কামরার সাজসজ্জা, জৌলুস ও জাঁকজমক ছিলো দেখার মত এবং দেখে মুগ্ধ হওয়ার মত। তবে বলতেই হবে, এটা কোন অত্যন্ত ধনী দেশের প্রতিনিধির উপযোগী হলে হতে পারে, কিন্তু ...! আসল কথা হলো, আধুনিক রাজনীতি ও রাষ্ট্রাচার এমনই এক অনিবার্য পরিবেশ পরিস্থিতি তৈরী করেছে যে, প্রাচ্যের গরীব থেকে গরীব দেশও ইউয়োপীয় ‘লাইফস্টাইল’ অনুসরণ করতে বাধ্য।

সচীবমহোদয় একজন আলিম ও ধর্মপ্রাণ মানুষের উদারতা ও সদাচারের সঙ্গে আমাদের অভ্যর্থনা ও খোশামদেদ জানালেন। তাঁর বিনয়নরতা ও চিত্তপ্রশস্ততার পরিচয় পেয়ে আমরা মুগ্ধই হলাম। বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর সঙ্গে আমাদের মতবিনিময় হলো।

আমি তাঁর সামনে ইয়ামানের সঙ্গে পাক-ভারত উপমহাদেশের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কের বিষয় তুলে ধরলাম। প্রসঙ্গক্রমে তাজুল আরূছ গ্রন্থের লেখক ভারতের স্বনামধন্য আলিম আল্লামা সাইয়েদ মুরতাযা যাবীদী বিলগ্রামী-এর আলোচনাও উঠে এলো, যিনি দীর্ঘকাল ইয়ামানে থাকার কারণে যাবীদী পরিচয় লাভ করেছেন। শায়খ হোসায়ন বিন মুহসিন আনসারীর প্রসঙ্গও এলো, যিনি বর্তমান শতাব্দীর অধিকাংশ মুহাদ্দিছীনের উস্তায। আমি আরো বললাম, ব্যক্তিগতভাবে আমার শিক্ষাদীক্ষা ও আরবীভাষা অধ্যয়নের ক্ষেত্রে ইয়ামানের বিরাট অবদান রয়েছে। কারণ আমি শায়খ খলীল বিন মুহাম্মাদ বিন হোসাইন ইয়ামানীর ধন্য ছাত্র।

কথাপ্রসঙ্গে বললাম, সময় ও সুযোগ হলে ইয়ামানে যাওয়ার এবং নিজের চোখে ইয়ামানের অবস্থা দেখার আগ্রহ আমার রয়েছে। কারণ আরবজাহানে ইয়ামানই একমাত্র ভূখ- যা আগের সভ্যতা, সংস্কৃতি ও জীবনাচার ধরে রেখেছে। এখনও সেখানে জীবন ও  তার গতিধারায় তেমন পরিবর্তন আসেনি। অথচ অন্যসব দেশ পাশ্চাত্য সভ্যতা ও জীবনধারার অভিন্ন রঙে রঞ্জিত হয়ে গিয়েছে, বরং বলা ভালো, অভিন্ন ¯রতে গা ভাসিয়ে দিয়েছে। সুতরাং ঐসব দেশে গিয়ে একজন মানুষ না নতুন কিছু দেখতে পায়, না নতুন কিছু শিখতে পায়। বরং একটি দেখেই আর সব দেশ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। তিনি আমার ইচ্ছা ও আগ্রহকে স্বাগত জানালেন।

ইয়ামান পথের দোটানায়

তিনি আমাকে ইয়ামান সফরের দাওয়াত দিলেন। আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বললাম, ‘কোন আরব দেশ এখন নিজেদের কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে স্বাধীন নয়। তারা কতকটা যেন হাতপা বাঁধা অবস্থায় পাশ্চাত্যের ইচ্ছা-মর্জির কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে আছে। না তাদের সামান্য স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা আছে, না নিজেরকোন ইচ্ছা প্রকাশ করার ক্ষমতা। সুখের বিষয়, ইয়ামান এখনো স্বাধীন। এখনো সে নিজের ইচ্ছায় চলতে পারে এবং কোন বিষয়ে নিজের মতামত প্রকাশ করতে পারে। তাই আশা করি, পাশ্চাত্যের সভ্যতা, সংস্কৃতি, শিক্ষাব্যবস্থা ও জীবনাচার গ্রহণের ক্ষেত্রে ইয়ামান তাড়াহুড়া করবে না এবং কোন প্রকার অদূরদর্শিতার পরিচয় দেবে না। আশা করি, পাশ্চাত্যের মরীচিকার পিছনে ইয়ামান এমনভাবে ছুটে যাবে না যেমন যায় পিপাসার্ত, পানির দিকে। তদ্রপ ইউরোপের চাকচিক্যপূর্ণ সমাজসংস্কৃতি ও জীবনদর্শনের উপর এমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়বে না যেমন ঝাঁপিয়ে পড়ে আলোর প্রতি পতঙ্গদল। বরং ইয়ামান এ ক্ষেত্রে ধীরস্থিরতা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে শুধু তাই গ্রহণ করবে যা তার নিজস্ব দ্বীন-ধর্ম, স্বভাব ও সভ্যতার উপযোগী এবং যে বার্তা তারা বহন করে চলেছে তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। পাশ্চাত্যের যা কিছু মন্দ ও অসুন্দর, ইয়ামান অবশ্যই তা পরিহার করবে।

ইয়ামান দীর্ঘকাল বাকি বিশ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কারণে হয়ত ভাবতে পারে যে, জীবনের কাফেলা থেকে সে পিছিয়ে পড়েছে। তাই তার মধ্যে তাড়না সৃষ্টি হতে পারে জীবনের এগিয়ে যাওয়া কাফেলায় শামিল হওয়ার জন্য দ্রুত গতিতে পথচলার। ফলে হোঁচট খাবে, বা পথই হারিয়ে ফেলবে। তখন আল্লাহ্ না করুন, এমন অবস্থা সৃষ্টি হবে যে, উঠে দাঁড়ানো বা সামলে নেয়াই আর সম্ভব হবে না। অন্তত এরূপ আশঙ্কা আমি অনুভব করি।’

মুসলিম বিশে জীবনের দু’টি ভিত্তি

কোন মুসলিম দেশে জীবনের রূপ ও প্রকৃতি কেমন হওয়া উচিত, এ আলোচনা যখন উঠলো, আমি বললাম, ‘আমার মতে ইসলামী দেশগুলোতে সঠিক ও বিশুদ্ধ ইসলামী জীবন ও তার স্থিতি নির্ভর করে দু’টি বিষয়ের উপর। বলা ভালো, এ দু’টি হচ্ছে জীবনের অপরিহার্য দু’টি ভিত্তি। প্রথমত জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিশুদ্ধ ও সুসংহত দ্বীনী অনুভব-অনুভূতির উপস্থিতি। আর এ অনুভব-অনুভূতি সৃষ্টি হতে পারে জনগোষ্ঠীর প্রতিটি শ্রেণীর মধ্যে সঠিক দ্বীনী তারবিয়াত ও চিন্তাচেতনা সৃষ্টির মাধ্যমে। যখন আমরা জনগণের খুব কাছে যাবো, তাদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক সৃষ্টি করবো, তাদের জীবনের সমস্যা ও কষ্টগুলো নিকট থেকে অনুধাবন করবো এবং সে আলোকে ব্যাপক দাওয়াতী কাজ পরিচালনা করবো তখন সেই কাক্ষীত বোধ ও চেতনা এবং অনুভব-অনুভূতি সহজেই সৃষ্টি হবে এবং তার শেকড় জনমানসের গভীরে প্রোথিত হবে।

দ্বিতীয়ত, সঠিক শিক্ষাব্যবস্থা, যাতে দ্বীনের ইলম ও আধুনিক জ্ঞানের মাঝে সুসমন্বয় সাধন করা সম্ভব হবে। দ্বীন ও শরীয়াতের যে ইলম তার উৎস হলো ওয়াহি ও নবুয়ত। ইলমে ওয়াহী ও ইলমে নববীর মধ্যে না কোন প্রকার ভুলভ্রান্তির সুযোগ রয়েছে, না তাতে কোন প্রকার ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা কল্পনা করা সম্ভব। এটাই হলো দেশকাল নির্বিশেষে যে কোন আদর্শ সভ্যতা ও জীবনধারার চিরন্তন ও সার্বজনীন জ্ঞানের উৎস। পক্ষান্তরে আধুনিক জ্ঞানবিজ্ঞান, আবিষ্কার-উদ্ভাবন, এগুলোর উৎস হলো মানুষের অধ্যয়ন ও গবেষণা দ্বারা অর্জিত অভিজ্ঞতা। আর স্বীকার করতেই হবে, অনিবার্য কিছু কারণে এ ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য প্রাচ্যকে ছাড়িয়ে অনেক দূর চলে গিয়েছে এবং এর মাধ্যমেই পাশ্চাত্য প্রাচ্যের উপর প্রবলভাবে বির্জয় অর্জন করেছে। তো মুসলিম সমাজে আমাদের অবশ্য-কর্তব্য হলো কোরআন ও সুন্নাহর চিরন্তন ইলম এবং প্রাকৃতিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মধ্যে সুসমন্বয় সাধন করা।’

শেষে বললাম, ‘আমি আশা করি, ইয়ামানের জনগোষ্ঠী ও নেতৃত্ব এ সমন্বয় সাধনে পূর্ণ সক্ষম হবে। আর তখনই আরব জাহানের অন্যান্য দেশ ও জনপদের মাঝে যা ইসলামী ধারার যেমন নয়, তেমনি নয় সম্পূর্ণ পশ্চিমা ধাঁচের এদের মধ্যে ইয়ামান ও তার জনগোষ্ঠী এক অনন্য অবস্থান ও মর্যাদার অধিকারী হবে।’

সামান্য বেশকমসহ মোটামুটি এই ছিলো আমার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য। সচীবমহোদয় বেশ মনোযোগের সঙ্গে আমার কথা শুনলেন এবং একমত হলেন। তাকে আমার মনে হলো যথেষ্ট মেধা, প্রজ্ঞা ও জাগ্রত চেতনার অধিকারী; জানাশোনার পরিধিও যথেষ্ট বিস্তৃত।

তিনি আমাকে ইংরেজী ভাষায় রচিত একটি পুস্তক উপহার দিলেন, যাতে দেশ ও জনপদ হিসাবে ইয়ামান সম্পর্কে জানার বিষয় যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে সেখানকার দর্শনীয় স্থান, ভবন ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ছবি এবং রাজপরিবার সম্পর্কে সচিত্র বিবরণ।

আলোচনার প্রায় শেষ পর্যায়ে ইয়ামানের প্রতিনিধি জনাব আলী মুআইয়্যিদ কয়েকজন ইয়ামানী নাগরিককে নিয়ে উপস্থিত হলেন। সচীবমহোদয় তাদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে, প্রসিদ্ধ হাদীছের অংশবিশেষ অনুসরণ করে বললাম

أتاكم أهل اليمن

আহলে ইয়ামান আপনার কাছে এসেছে।

জনাব উমারী ইয়ামানের রাজধানী ছানা-এর উদ্দেশ্যে সফরের জন্য তখন পূর্ণ প্রস্তুত। আগামী মাসে তার ফিরে আসার কথা। আল্লাহ্ তার সফরকে সার্থক ও নিরাপদ করুন, আমীন।

আযহারের সিরীয় ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য

এশার পর সৈয়দ ইয়াসীন শরীফ আযহারে অধ্যয়নরত ফিলিস্তীন ও সিরিয়ার নির্বাচিত কিছু ছাত্রকে সিরীয় ছাত্রাবাসের একটি কক্ষে একত্র করলেন। আমরাও সেখানে উপস্থিত হলাম। (ছাত্রদের পরিচ্ছদ ও অভিব্যক্তি দেখে) মনে হলো, আমরা ভারতের কোন আধুনিক কলেজ বা বিশবিদ্যালয়ের ছাত্রসমাবেশের সামনে রয়েছি। এতে আমার মধ্যে আশ্চর্য এক বিষণতার অনুভূতি হলো। উস্তায মুহাম্মাদ আলকুনজী শুরুতে পরিচিতিমূলক ও স্বাগত বক্তব্য রাখলেন। তিনি হলেন বিভিন্ন দেশ থেকে আযহারে আগত ছাত্রদের সংগঠনের প্রধান। ইলমে দ্বীন অর্জনকারী তালিবানের দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং তাদের গুণ ও যোগ্যতা সম্পর্কে আমি বক্তব্য রাখলাম। বিশেষভাবে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললাম, ‘জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি কলব ও রূহ এবং হৃদয় ও আত্মার পরিচর্যার প্রতিও গুরুত্ব আরোপ করা উচিত। শরীয়াতের আদেশ-নিষেধ ও দ্বীনী দায়-দায়িত্ব যেমন নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা কর্তব্য তেমনি যথাসময়ে যথাগুরুত্বের সঙ্গে নামায ও জামাতের পাবন্দি করা অবশ্য-কর্তব্য। এমনকি কিয়ামুল্লায়ল ও তাহাজ্জুদ এবং নওয়াফেলের প্রতিও যতবান হতে হবে। এককথায়, দ্বীন ও শরীয়াতের সমগ্র বিধানের উপর অবিচল থাকতে হবে পূর্ণ অনমনীয়তা ও প্রত্যয় এবং উচ্চ মনোবল ও উদ্যমের সঙ্গে। এছাড়া আমাদের দ্বীন ও দুনিয়ার নাজাত বা কামিয়াবির দ্বিতীয় কোন পথ নেই।’

বিশদ আলোচনার দিকে গিয়ে আমি বললাম, যে সকল মহান ব্যক্তি এবং সংস্কারক ও সাধকপুরুষ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মুসলিম জনপদ ও ইসলামী সমাজে দ্বীনের বড় কোন খেদমত করেছেন, বিরাট কোন বিপ্লব, সংশোধন ও সংস্কার সাধন করেছেন তাদের ইতিহাস যদি আমরা অনুসন্ধান করি তাহলে পরিষ্কার দেখতে পাবো যে, আত্মার শক্তি, হৃদয়ের তাপ ও উত্তাপ এবং ইবাদত ও যিকিরের নিমগ্নতায় সাধারণ মানুষের চেয়ে তাঁরা অনেক এগিয়ে ছিলেন এবং তাঁদের অবস্থান অনেক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ছিলো।

এটা এক চিরন্তন সত্য যে, হৃদয় ও আত্মা যদি ঈমান ও বিশসের শক্তিতে বলীয়ান এবং প্রত্যয় ও চেতনার উত্তাপে উদ্দীপ্ত না হয় সর্বোপরি আচরণে উচ্চারণে দ্বীনী ব্যক্তিত্বের পূর্ণ উদ্ভাস যদি না ঘটে তাহলে মানুষ অন্যের উপর কোন প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে না এবং পারে না সমাজজীবনে তাপ, উত্তাপ ও প্রাণসজীবতা সৃষ্টি করতে।’

তারপর আমি বর্তমান অবস্থার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললাম, ‘নিজেদের দিকে তাকিয়ে এখন আমরা কী দেখতে পাই? দুঃখের সঙ্গেই বলতে হয়, এ যুগে জ্ঞান ও তথ্য এবং জানাশোনার পরিধি অনেক বেশী বিস্তৃতি লাভ করেছে। এমনকি যদি কয়েকজনের জ্ঞান ও তথ্যভা-র পুরো সমাজ ও জনপদের মাঝে বণ্টন করে দেয়া হয়, সমাজ ও জনপদের প্রতিটি সদস্যের আলিম, জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান হওয়ার জন্য যথেষ্ট হবে। কিন্তু কলব ও রূহ কমযোর, হৃদয় ও আত্মা দুর্বল; ঈমান, বিশস ও প্রত্যয় নির্জীব। এমনকি আমাদের ইচ্ছাশক্তিও এত নিস্তেজ যে, প্রয়োজনে উঠে দাঁড়ানোর সাহসও যেন হারিয়ে ফেলেছি।

যে কোন বিষয়ে আমাদের ইলম এখন পরিমাণে বিপুল, কিন্তু তা আমাদের মধ্যে কর্মের উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে পারে না। আমাদের অবস্থা না ছাহাবা কেরামের মত, না খায়রুল কুরূনের মত, আর না পরবর্তী যুগের মত। ছালাত বলি, ছিয়াম বলি, আর বলি তা‘আল্লুক মা‘আল্লাহ, সবকিছুতেই আমরা এত পিছিয়ে আছি যে, কোন তুলনাই চলে না। কেন এমন হলো? কারণ আমাদের জ্ঞান ও তথ্যের প্রসার ও বিস্তার ঘটেছে ঈমান ও আমল এবং আত্মিক শক্তি ও সমৃদ্ধি বিসর্জন দেয়ার বিনিময়ে।

আসুন, এখন আমাদের করণীয় সম্পর্কে চিন্তা করি। আমাদের সামনে আজ যুগের বস্তুবাদ ও ইসলামের মাঝে কঠিন সঙ্ঘাত উপস্থিত। বস্তুবাদের মোকাবেলায় ইসলামকে বিজয়ী করার চূড়ান্ত সংগ্রামে আমাদের অবতীর্ণ হতে হবে। এর আগে আমাদের অপরিহার্য কর্তব্য হলো নিজেদের হিসাব নেয়া এবং আত্মসমালোচনায় প্রবৃত্ত হওয়া, নিজেদের সংশোধন, তারবিয়াত ও দীক্ষার প্রতি আমাদের আন্তরিক হতে হবে এবং পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। সীমাহীন মোহমায়া ও বিপুল শক্তির অধিকারী বস্তুবাদের বিরুদ্ধে এই যে আজকের সংগ্রাম সঙ্ঘাত, তাতে বিজয়ী হওয়া, এমনকি টিকে থাকাও সম্ভব নয় যদি আমরা ঈমান ও বিশসের চেতনায় বলীয়ান না হই; যদি না দ্বীনের প্রতি অবিচল থাকার শক্তি ও যোগ্যতা অর্জন করতে পারি। ...’

আশা করি, আবেগ ও জাযবা এবং অন্তরঙ্গতা ও হিতাকাক্সক্ষার মনোভাব নিয়ে বলা কথাগুলো নিষ্ফল যাবে না, শ্রোতাদের হৃদয়ে কিছু না কিছু প্রভাব সৃষ্টি করবে ইনশাআল্লাহ্।

৮/৫/৭০ হি. ১৪/২/৫১ খৃ.

বুধবার

আজ সকাল দশটায় আমরা প্রসিদ্ধ পত্রিকা ‘আলামুল আরাবী’ এর দফতরে গেলাম, যা ইবরাহীম পাশা সড়কে অবস্থিত। পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক উস্তায আস‘আদ হাসানীর খোঁজ নিলাম। তিনি দফতর থেকে কিছু দূরে তাঁর ঘরে ছিলেন। খবর পেয়ে দফতরে এলেন এবং আমাদের স্বাগত জানালেন। পরিচয় দিয়ে বললাম, আমরা হিন্দুস্তান থেকে এসেছি। আপনার পত্রিকার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ও সম্পর্ক রয়েছে।

তিনি সন্তোষ প্রকাশ করলেন এবং আলোচনা শুরু হলো। আমি বললাম, ‘আপনার পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যায় ফিলিস্তীনের সমস্যা ও বিপর্যয়ের বিভিন্ন কারণ আলোচিত হয়েছে। এ সম্পর্কে আমার নিজস্ব কিছু চিন্তা রয়েছে।

তার আগ্রহ দেখে আমি বললাম, ‘ফিলিস্তীনে আমাদের এই যে বেদনাদায়ক বিপর্যয় তার কারণ তো অনেক, তবে সবচে’ বড় কারণ হলো, যে সমস্ত দেশ ও জনগোষ্ঠী ফিলিস্তীনের পক্ষে লড়াই করছে এবং অস্ত্র ধারণ করছে তাদের আত্মিক দৈন্য, ঈমান ও বিশসের দুর্বলতা। নেতা ও জনতা সবার মধ্যেই দ্বীনী গায়রাত ও ধর্মীয় চেতনার আগুন যেন নিভে গিয়েছে। ...’

আরো বললাম, ‘আসলে পাশ্চাত্য সভ্যতা ও তার বস্তুবাদই আরব জাহান ও আরবজাতিকে শেষ করে দিয়েছে এবং তাদের আত্মিক শক্তি ও নৈতিক মনোবল ধ্বংস করে দিয়েছে।...’

আমার বক্তব্য শুনে তিনি বললেন, ‘কিন্তু আমি তো দেখি, ইউরোপীয় জাতিবর্গের মধ্যে আরবদের চেয়ে বেশী ‘আত্মশক্তি’ রয়েছে, যার বলে বলীয়ান হয়ে তারা লড়াই করছে এবং নিজেদের রক্ষা করে চলেছে!’

আমি বললাম, ‘ঘটনা এই যে, হৃদয় ও আত্মা এবং কলব ও রূহ এর শক্তি, পশ্চিমা জাতিবর্গ এর পরিবর্তে রাজনৈতিক চেতনা ও জাতীয়তাবাদকে প্রাণশক্তিরূপে গ্রহণ করেছে, প্রভাব ও প্রতাপের দিক থেকে এটাও বড় একটা শক্তি। পক্ষান্তরে আরব জাতি না হৃদয় ও আত্মার শক্তিকে অক্ষুণ রেখেছে, আর না তার স্থানে বিকল্প কোন শক্তি অর্জন করেছে, যা হৃদয় ও আত্মার শূন্যস্থান কিছুটা হলেও পূর্ণ করবে। ফল এই হয়েছে যে, আরবদের কাছে না আছে আত্মিক প্রেরণা, দ্বীনী উদ্দীপনা, আর না আছে রাজনৈতিক চেতনা ও জাতীয় ঐক্যবোধ। তাই সংগ্রাম ও সঙ্ঘাতের প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা কঠিন পরাজয় ও বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে।’

তিনি বললেন, ‘আমার মতে আরবদেশগুলোর পরাজয়ের কারণ হচ্ছে গোত্রীয় চেতনা, যার সাহায্যে ফিলিস্তীনের অঙ্গনে তারা লড়াই করছে পশ্চিমা শক্তির বিরুদ্ধে, যাদের একদিকে যেমন রয়েছে জাতীয়তাবাদের শক্তি, অন্যদিকে তেমনি রয়েছে আধুনিক অস্ত্র ও প্রযুক্তি।’

তিনি বললেন, ‘আমার পত্রিকার কোন এক সংখ্যায় আমি এ মত তুলে ধরেছি।’

আমি বললাম, ‘আপনার সে বক্তব্য আমি পড়েছি। এ শব্দচয়ন ও অভিপ্রকাশ প্রশংসার যোগ্য।’

এরপর আমি তাকে ‘মাযা খাসিরা’ বইটির শেষ পরিচ্ছেদ ‘আরববিশের নেতৃত্ব’ তার সামনে তুলে ধরে পড়তে বললাম। তিনি সামান্য অংশ পড়ে এবং শেষ পর্যন্ত না পড়েই সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন। আমি নিজে তাকে শেষ অধ্যায়ের প্রথম পরিচ্ছেদের কয়েকটি শিরোনাম পড়ে শোনালাম; যেমন ‘আত্মিক প্রস্তুতি’, ‘শিল্প, প্রযুক্তি ও সামরিক শক্তি অর্জন’, নতুন শিক্ষাব্যবস্থার প্রবর্তন’ ইত্যাদি। আসল কথা হলো, তিনি যতটুকু সময় দিয়েছেন সেটাকেই আমি কাজে লাগাতে চেয়েছি। কারণ এই শ্রেণীর সাংবাদিক সম্পাদক নিজেদের বক্তব্য পাঠকমহলে তুলে ধরার চিন্তায় এত বেশী মগ্ন থাকেন যে, অন্যদের লেখা পড়ার তেমন সুযোগ করে উঠতে পারেন না।

শেষ পর্যন্ত আমি তাকে একটি নোসখা উপহার দিয়ে অনুরোধ করলাম, নিজের মূল্যবান সময় থেকে কিছুটা ব্যয় করে নিবিষ্ট মনে বইটি পড়ে দেখার। তিনি প্রতিশ্রুতি দিলেন, আর নিজের পত্রিকায় পর্যালোচনা প্রকাশের জন্য আমার ছবি চাইলেন। আমি অসম্মতি জানিয়ে বললাম, ‘আমার চিন্তাচেতনা, অনুভব-অনুভূতি ও দরদব্যথার যে ছবি আমার কলম এঁকেছে তা তো আপনার হাতে তুলে দিয়েছি।’ তিনি মৃদু হেসে আমার কথা মেনে নিলেন।

তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আরব জাহানের স্বনামধন্য বুদ্ধিবৃত্তিক সাময়িকী ‘রিসালাহ্’দফতরে গেলাম। ধারণা ছিলো, সম্পাদক আহমদ হাসান যাইয়াতকে সেখানে পেয়ে যাবো, কিন্তু পেলাম না। না পেয়ে আমরা চলে এলাম শাবাব-এর দফতর দারুল আরকামে। জানা গেলো, হোসায়ন ইউসুফ ছাহেব সফরে রয়েছেন, আগামীকাল ফেরার কথা।

তো কী আর করা, দুপুরের দস্তরখান থেকে ফারেগ হয়ে শাবরা গেলাম। সেখানে আহমদ উছমান ছাহেবের সঙ্গে দেখা হলো। সেখান থেকে বন্ধুবর আলহাজ আলী শরীফের সঙ্গে উস্তায হাসান আব্দুল ওয়াহ্হাবের গৃহে উপস্থিত হলাম। চায়ের মজলিসে বেশ অন্তরঙ্গ পরিবেশে তার সঙ্গে ঐতিহাসিক ও প্রততাত্ত্বিক বিভিন্ন বিষয়ের উপর কিছুক্ষণ কথা হলো। তাঁর গবেষণা, অধ্যয়ন ও পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম যে, কায়রোতে সাইয়েদা নাফীসা ছাড়া আহলে বাইতের আর কারো কবর বিদ্যমান থাকা প্রমাণিত সত্য নয়।

তাকে আল্লামা সাইয়েদ মুরতাযা বিলগ্রামীর কবর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম যিনি যাবীদী লকবেই বেশী পরিচিত। তিনি বললেন, ‘তাঁর স্ত্রীকে তো সাইয়েদা রুকাইয়ার মাকবারায় দাফন করা হয়েছে, সেহিসাবে আমার ধারণা তিনিও সেখানেই সমাধিস্থ হয়ে থাকবেন।’ তারপর তিনি তথ্যপ্রমাণ ঘেঁটে দেখলেন তার ধারণাই সত্য।

তার এখানেই ‘সংস্কৃতি সংস্থার’ পাণ্ডু-লিপি বিভাগের পরিচালক মুহাম্মাদ রাশাদ আব্দুল মুত্তালিবের সঙ্গে দেখা হলো। তখন সিদ্ধান্ত হলো, আগামী সোমবার দুপুরদু’টায় তার এবং হাসান আব্দুল ওয়াহ্হাব ছাহেবের সাহচর্যে দারুল কুতুবিল মিছরিয়্যা এবং দারুল আছারিল আরাবিয়্যাহ ঘুরে দেখা হবে।

এখান থেকে শায়খ আহমদ উছমানকে সঙ্গে করে আমরা গেলাম আশীরা মুহাম্মাদিয়্যা দফতরে। সেখানে সংস্থার মহাপরিচালক উস্তায মুহাম্মাদ যাকী ইবরাহীমের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলো। সংস্থার বইপুস্তক ও ‘লিটারেচার’ দেখা হলো। আমার মনে হলো, একটা জরুরি কথা বলা দরকার। আমি বিনয়ের সঙ্গে বললাম, ‘বর্তমান সময়ে ফিক্হি বিষয়ে বিতর্কে জড়ানো বা কোন ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বের অপ্রয়োজনীয় সমালোচনায় লিপ্ত হওয়া কিছুতেই সমীচিন নয়। এ বিষয়গুলো যতের সঙ্গে পরিহার করা উচিত। এখনকার আসল করণীয় হলো, বস্তুপূজা, ভোগবাদ ও নৈতিক অবক্ষয়ের মোকাবেলায় নিজের সবটুকু শক্তি ও সামর্থ্য ব্যয় করা। সেই সঙ্গে খালিছ দ্বীনী দাওয়াতের প্রতি নিজেদের যাবতীয় প্রয়াস-প্রচেষ্টা ও মনোযোগ নিবদ্ধ করা। ...’

আমাদের জানা ছিলো না যে, আজ এখানে নিয়মিত দরসের তারিখ। এটাও ধারণা ছিলো না যে, দরসে শরীক হলে কিছু বলার অনুরোধ আসবে। যাই হোক, মুহাম্মাদ যাকী আমাকে দরসে শরীক হওয়ার এবং কিছু কথা বলার দাওয়াত দিলেন। আমি আল্লাহ্র দেয়া সুযোগ মনে করে তার দাওয়াত কবুল করলাম। প্রথমে জনাব আহমদ উছমান হিন্দুস্তানে শুরু হওয়া দাওয়াত ও তাবলীগের মেহনত সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ও সারগর্ভ আলোচনা পেশ করলেন। আমি তার বক্তব্যের সমর্থনে কিছু কথা বললাম এবং সঙ্গে কিছু ব্যাখ্যা-পর্যালোচনাও যোগ করলাম।

নিজেদের অবস্থানক্ষেত্রে ফিরে আসার আগে আমি জনাব ইয়াসীন শরীফ ও মাওলানা ওবায়দুল্লাহ বালয়াবীর সঙ্গে রিসালাহ্ দফতরে গেলাম। জানা গেলো, আহামদ হাসান যাইয়াত সফরে আছেন। আগামী সোমবার তাঁর, দফতরে আসার কথা।

৯/৫/৭০ হি. ১৫/২/৫১ খৃ.

বৃহস্পতিবার

জনাব আলী গায়াতীর সঙ্গে

দিনের প্রথমে আমরা খিদবী ময়দান অভিমুখে রওয়ানা হলাম। উদ্দেশ্য হলো মিম্বারুশ্-শারক পত্রিকার সম্পাদক উস্তায আলী গায়াতীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। হিন্দুস্তানে বেশ আগে থেকেই আমি এ পত্রিকার গুণমুগ্ধ গ্রাহক ছিলাম। পত্রিকার প্রতিটি পাতায়, প্রতিটি লেখায় রেখায় যেন ঈমান ও প্রত্যয়ের উদ্ভাস ছিলো। তাই সঙ্গত কারণেই এর সম্পাদকের সাক্ষাৎ লাভের আকাক্ষা-আকুতি আমার অন্তরে ছিলো। আজ সৌভাগ্যের সেই সুযোগটি এলো। আসলে দ্বীনের প্রতি যারা দরদব্যথা ও সহমর্মিতার চেতনা পোষণ করেন এবং দ্বীনের প্রতি আত্মোৎসর্গের আকুতি লালন করেন তাদের সংখ্যা ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। সকল মুসলিম জনপদেই তারা এখন ছোট একটা পরিবারে সীমিত হয়ে পড়েছেন। সুতরাং নিজেদের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক ও বন্ধন গড়ে তোলা এখন আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশীজরুরি।

উস্তায আলী গায়াতীর সঙ্গে তাঁর গৃহেই আমাদের সাক্ষাৎ হলো। আমরা বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে তাঁর মুখম-লের দিকে শুধু তাকিয়েই থাকলাম। চেহারায় বার্ধক্যের শুভ্রতা যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে ঈমানের নূর ও নূরানিয়াত। তাঁকে নিজের পরিচয় দিয়ে আমার কিছু পুস্তিকা এবং মাযা খাসিরা... এর একটি নোসখা হাদিয়া দিলাম। তিনি বেশ সমাদরের সঙ্গে গ্রহণ করলেন, যা স্বাভাবিক কারণেই আমাকে যথেষ্ট আপ্লুত করলো। তিনি হিন্দুস্তান-পাকিস্তানের দ্বীনী পরিবেশ, ভবিষ্যত সম্ভাবনা, উভয় সরকারের ভাব ও মনোভাব সম্পর্কে আমাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করলেন, যাতে উপমহাদেশের মুসলিমীনের বর্তমান ও ভবিষ্যত সম্পর্কে তাঁর গভীর আগ্রহই প্রকাশ পেলো। আমি যদ্দুর জানি ও বুঝি সে আলোকে জবাব দেয়ার চেষ্টা করলাম।

প্রথমে বললাম, ‘পাকভারত উপমহাদেশের মুসলিমীনের মধ্যে  দ্বীনের প্রতি আবেগ ও জোশজযবা অনেক বেশী। তাদের অন্তরে দ্বীনের প্রতি যে ভক্তিশ্রদ্ধা ও মর্যাদাবোধ, বলতেই হবে, তা আরবদেশের চেয়ে অনেক বেশী। তিক্ত কথা বলার জন্য মাফ করুন, এখানে তো দ্বীনের প্রতি মানুষের আচরণ ঠিক যেন খাবারের প্রতি ক্ষুধাহীন ও পরিতৃপ্ত মানুষের অনাগ্রহের মত। কিংবা বলা যায়, আরবদের অবস্থা ঐ শিশুর মত যে প্রতিপালিত হয়েছে এবং তার দিন-রাত যাপিত হয়েছে দ্বীনী পরিবারে আগাগোড়া দ্বীনী পরিবেশে। উঠতে বসতে সে হাদীছ-কোরআন ও দ্বীনী কিতাব দেখেছে, শুনেছে। এ অবস্থায় হওয়ার তো কথা দ্বীনের প্রতি গভীর মুহাব্বাত ও নিবিড় সম্পর্ক, কিন্তু দিন-রাত দেখে দেখে হয়ে পড়েছে সাদামাটা, নির্লিপ্ত ও অনুভূতিহীন। সার্বক্ষণিক নিকট সাহচর্যের স্বাভাবিক ফলরূপে তার অন্তরে দ্বীনের প্রতি যেরূপ আদব, ভক্তি, কৌতূহল ও অন্তরঙ্গতা সৃষ্টি হওয়ার কথা ছিলো তার পরিবর্তে হয়েছে সচরাচরতা ও গুরুত্ব-হীনতার অনুভূতি। এভাবেই আরবদেশগুলো, ইসলাম ও আরবত্বের সঙ্গে ছিলো যাদের যুগ যুগের নিবিড় সম্পর্ক, তারা দ্বীনের প্রতি, রাসূলের প্রতি এবং কোরআনের প্রতি তাকাতে লাগলো খুবই সাদামাটা নযরে, যাতে না আছে ভক্তিশ্রদ্ধার অনুভূতি, এমনকি না আছে সাধারণ একটু কৌতূহল। ভাব যেন এই যে, এ আর এমন কী? ঘরে প্রতিদিনের দেখা, দিন-রাতের জানাশোনা। হাত বাড়ালেই ধরা যায়, হাত গুটালেই ছাড়া যায়। পক্ষান্তরে দ্বীন ও ইসলামের প্রতি, রাসূলের প্রতি, কোরআনের প্রতি, এমনকি আরবী ভাষা ও আরবীলেখা কাগজের প্রতি পাকভারতের মুসলমানদের দৃষ্টি হলো ঐ মানুষের মত যে ইসলাম পেয়েছে হঠাৎ করে পাওয়া হীরকখ-র মত। তাই ইসলামের প্রতি তার ভক্তিশ্রদ্ধা ও জোশজযবা এবং দ্বীনের প্রতি তার আনুগত্য ও আত্মনিবেদন ‘বনেদি’ মুসলমানের চেয়ে পরিমাণে অনেক বেশী, এমনকি যা স্বয়ং আরবদের মধ্যেও পাওয়া যায় না। ...’

এরপর আমি ঐ দেশদু’টিতে নতুন যে দ্বীনী কর্মতৎপরতা ও দাওয়াতি মেহনত শুরু হয়েছে সে সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরলাম।

(চলবে ইনশাআল্লাহ