শিশু-কিশোর ও নবীনদের পত্রিকা

মাসিক আল-কলম-পুষ্প

কাশ্মীরসংখ্যা | তোমাদের পাতা

ইবনে মিসবাহ (একটিিি উর্দূ লেখার ছায়া অবল্বনে

আমি আসছি আপনার কাছে জান্নাতের বাগানে, দাদাজান!

 

 

আমি আসছি আপনার কাছে

জান্নাতের বাগানে, দাদাজান!

 

ইবনে মেছবাহ, (একটি উর্দূ লেখার ছায়া অবলম্বনে)

পাঁচদিন হলো, কাশ্মীরের অকুতোভয় তরুণ মুজাহিদ আসিফ দিল্লীর তেওয়ার কারাগারে। এ কারাগারের কথা বহু আগে থেকেই সে শুনেছে। এখানকার ‘জল্লাদগুলো’ নাকি নিষ্ঠুরতা ও নির্দয়তায় হিংস্রতায় পশুরও নীচে। কিন্তু কত নীচে, তা সে কল্পনাও করতে পারেনি। এখানে আসার রাত্র থেকেই সে তা বুঝতে শুরু করেছে এবং প্রতিদিন অর্জিত হচ্ছে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা! বড় লোমহর্ষক অভিজ্ঞতা!

তাকে ধরা হয়েছিলো দিনে; ওমর আব্দুল্লাহ্র লোকেরাই ফাঁদ পেতেছিলো তাকে ধরার জন্য। ভারতীয় হায়েনাদের কিছুই করতে হয়নি। ওর মুসলিম ভাইয়েরাই ‘পরম উপাদেয় শিকার’রূপে ওকে ধরে ভারতীয় হায়েনাদের হাতে তুলে দিয়েছিলো। নগদ পুরস্কারও উশুল করেছিলো ওরই চোখের সামনে। এটা শুরু হয়েছিলো ওমরের দাদা শেখ আব্দুল্লাহর আমল থেকেই। ওর বাবা ফারুক আব্দুল্লাহর আমলেও এ ‘ঐতিহ্য’ বহাল ছিলো, এখন ওমর আব্দুল্লাহ্ যেন এ পারিবারিক ঐতিহ্য আরো উচ্চতায়, বরং আরো নীচতায় নিয়ে গিয়েছে!

***

হঠাৎ করেই আসিফের মনের পর্দায় ভেসে উঠলো ওর শহীদ দাদাজানের ছবি। ছবি মানে মায়ের কাছ থেকে শুনে শুনে যে ছবি মনের পর্দায় আঁকা হয়েছে। আশ্চর্য, দাদাকে সে দেখেনি, তবু তার ছবি মনের পর্দায় কেমন সমুজ্জ্বল! অথচ বাবাকে দেখেছে, কিন্তু চেষ্টা করলেও বাবার কথা মনে আনতে পারে না। কেমন একটা বিতৃষ্ণায় সবকিছু গুলিয়ে যায়, তারপর আবছা হতে হতে একদম মুছে যায়। এটাই অবশ্য সত্য! তার জীবনে বাবার কোন ভূমিকা ছিলো না, জন্মদানের প্রাকৃতিক ভূমিকাটুকু ছাড়া। যখন তিনি আলীগড় থেকে ‘শিক্ষা’ শেষ করে ফিরে এলেন, কী শিক্ষা সেখানে পেলেন, আল্লাহ্ মালুম! হিন্দুদের চেয়েও উঁচা আওয়াযে বলতে শুরু করলেন, ‘কাশ্মীর ভারত কা অটূট অ্যঙ্গ হ্যয়’! আলীগড় ভারতের মুসলিমদের কী দিয়েছে, ভাববার বোধহয় সময় হয়েছে!

বাবার জীবনের যে করুণ পরিণতি হয়েছিলো সেটা হয়ত তার প্রাপ্য ছিলো। তবে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার কিছু আগে নাকি তার উচ্চারণ ছিলো, ‘আমার ভুল যেন আমার খান্দানে আর কেউ না করে হে আল্লাহ!’

দাদাজানের জান ছিলো বড় শক্ত, ঈমান ছিলো আরো শক্ত, কাশ্মীরের সবচে’ বড় পাহাড়টার মত, যার চূড়ায় সারা বছর বরফ জমে থাকে। কোমলতার সঙ্গে কঠোরতার আশ্চর্য একটা মিশ্রসত্তা নাকি দাদার মধ্যে ছিলো! ঘরে সবার সঙ্গে তিনি এত কোমল ছিলেন, এত হবৎসল ছিলেন যে, অন্যঘরের মেয়েরা দাদার উদাহরণ দিতো। কারো অসুখ হলে এমন অস্থির হয়ে পড়তেন! ডাক্তারের কাছে ছোটাছুটি, আর শিশুর মত কাঁন্না!...

সবই মায়ের কাছ থেকে শোনা! যখন পুরোনো রাইফেলটা হাতে নিতেন, তখনই দাদা অন্যরূপ ধারণ করতেন, মায়ের ভাষায়, ‘বিলকুল যখমি শের!’ মাকে কতবার বলতে শুনেছে আসিফ, ‘আফসোস, একটা ‘গীদর’কে লকব দেয়া হলো শের, আর যিনি ‘হাকীকত কা শের’, তাকে ভুলে গেলো কাশ্মীরের মানুষ!

দাদা ডোগরা বাহিনীতে ছিলেন সাধারণ সিপাহী। শেখ আব্দুল্লাহ্র ডাকে ত্যাগ করেছিলেন ডোগরা বাহিনী। সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন রাইফেলটা। যখন ফাঁদে পড়ে গেলেন, রাইফেলটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন ঝিলামনদীর পানিতে। তারপর বিজয়ের হাসি হেসে বললেন গাদ্দারদের, ‘আমার জিহাদের পাক হাতিয়ারটা তোমাদের নাপাক ছোঁয়া থেকে বেঁচে গেলো!’

শেখ আব্দুল্লাহর সামনে যিনি মুখ খুলতে পারেন ‘শের কা লকব’ তো তাকেই মানায়!

আব্দুল্লাহ্ যেদিন প্রকাশ্যে ঘোষণা করলো, ‘পাকিস্তানের চেয়ে ভারত আমাদের জন্য অধিক নিরাপদ..’

দাদাজান আব্দুল্লাহ্র মুখের উপর হুঙ্কার দিয়ে উঠেছিলেন, ‘আয় গীদর, কিসনে তুঝে শের কা লকব দিয়া! গান্দা হলেও তোমার রগে মুসলিমের খুন রয়েছে, নইলে এখনই তোমাকে গুলি করে মেরে ফেলতাম।...’

আব্দুল্লাহ্র দু’একজন অনুচর উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়েছিলো দাদাজানের উপর হামলে পড়তে। আব্দুল্লাহ্ যেমন ছিলো বুযদিল তেমনি ছিলো চালাক। সে মুচকি হেসে বললো, জানে দো, বেচারা কমসমঝ হ্যয়!’

কিছুদিন পর সুযোগ বুঝে আব্দুল্লাহ্ ঠিকই দাদাজানকে তুলে দিয়েছিলো ভারতীয় সেনাদের হাতে!

লাগাতার দশদিন সীমাহীন নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছিলো দাদাজানকে! কিন্তু ‘জয় হিন্দ’ বলাতে পারেনি বুযদিলের দল তাকে দিয়ে। প্রতিবার তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহু আকবার’।

যেদিন তাকে ফাঁসির মঞ্চে তোলা হলো, তিনি ছিলেন পূর্ণ প্রশান্ত! ভারতের অবসরপ্রাপ্ত এক সামরিক অফিসার সত্য কথাই লিখেছেন, ‘আমরা ফাঁসি দিতে পারি, কিন্তু ওদের চেহারায় মৃত্যুর ভয় আনতে পারি না!’

ফাঁসির রজ্জু যখন তার গলায় পরানো হলো, সেনাবাহিনীর মেজর জিজ্ঞাসা করলো, তোমার কোন ইচ্ছা, যা আমরা পূর্ণ করতে পারি?’

দাদাজান বলেছিলেন, ‘আমার ইচ্ছা কাশ্মীরের আযাদি, যা তোমরা পূর্ণ করতে পারো না।’

***

গেরিলা হামলার জন্য তৈয়ার হয়ে আসিফ যেদিন ঘর থেকে বের হলো, স্পষ্ট মনে আছে, কিছুক্ষণের জন্য তার মনটা দুর্বল হয়ে পড়েছিলো। ‘নওদুলহান’ বিবির ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে সে বলেছিলো, ‘আজকের রাতটা না হয় থেকে যাই!’

বিবির চোখ দু’টো আঁসুতে চিকচিক করছে, কিন্তু মুখম-ণ্ডল সেই হাসিতে উদ্ভাসিত, যা শোভা পায় একজন মুসলিম নারীর মুখম-ণ্ডলে মুজাহিদ শাওহরকে বিদায় জানানোর সময়! কী আশ্চর্য দৃঢ়তা ছিলো তার কণ্ঠস্বরে! ‘চুড়ির জন্য আমাদের বাজু, আর আঁসুর জন্য আমাদের চোখই যথেষ্ট। আপনি আপনার দাদাজানের মত বের হয়ে যান, আমি আপনার ইন্তিযার করবো, এখানে কিংবা জান্নাতে! আমি আপনার আছি, আপনারই থাকবো।...’

ভাবতে ভাবতে নিজের অজান্তেই আসিফের চোখে পানি এসে গেলো। হঠাৎ সবকিছু কেমন যেন বদলে গেলো! তার বিবি যেন তারই চোখের সামনে দাঁড়িয়ে!

আরব কবি তাহলে ঠিক বলেছেন

ওর ধারণা ছিলো, এটা নিছক কবিকল্পনা! কিন্তু আসিফ তো কবি নয়, ওর এমন হলো কীভাবে। একটা আচ্ছন্নতার মধ্যে নিজের অজান্তেই অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠলো, ‘ফওজিয়া, তুমি!’

ফওজিয়া কিছু না বলে শুধু মৃদু হাসলো, সেই হাসি, যা দেখার তামান্না ছিলো বিবির ঠোঁটে, কিন্তু দেখা হয়নি।

ফওজিয়া ধীরে মিলিয়ে গেলো শূন্যে। ছাদটা যেন ফাঁক হলো একটা ছায়া হয়ে ফওজিয়া, ওর বিবি ফওজিয়া, আকাশের ঠিকানায় অদৃশ্য হয়ে গেলো।

***

পরের দিন খবর এলো, দু’টি খবর একসঙ্গে ওকে দেয়া হলো। ‘তোমার বিবি ‘খুদকুশি’ করেছে। সালী নে আপনি ইজ্জত বাঁচা লী’!

ভারতীয় বাহিনীর যে হায়েনা খবরটা দিলো তার মুখে ছিলো একটা ‘বেশরম’ হাসি!

আসিফের ঠোঁটের ফাঁকে ফুটে উঠলো স্বস্তির হাসি।

তারপর যখন তাকে বলা হলো, আগামী তোমার ফাঁসি! আসিফের মনে হলো তার কানে যেন বর্ষিত হলো এক মধুর বাণী ‘আগামীকাল তোমার জান্নাতে...!

আসিফ স্বগতোক্তির মত বললো

‘আপ কে পাস, জান্নাত কে বাগ মেঁ ম্যয়ঁ আরাহাহুঁ দাদাজান!’

ফাঁসির রজ্জু গলায় পরানোর পর তার মুখে সেই আয়াতটি উচ্চারিত হলো যা তার শহীদ দাদাজান উচ্চারণ করেছিলেন

‘নাছরুম্ মিনাল্লাহি ওয়া ফাতহুন ক্বারীব।