শিশু-কিশোর ও নবীনদের পত্রিকা

মাসিক আল-কলম-পুষ্প

কাশ্মীরসংখ্যা | কাশ্মীর সংখ্যা (বিশেষ)

১৩ জুলাই ১৯৩১ কী ঘটেছিলো সেদিন কাশ্মীরে?

১৩ জুলাই ১৯৩১

কী ঘটেছিলো সেদিন কাশ্মীরে?

১৯৩১ সালের ১৩ই জুলাই, কাশ্মীরের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়পরিবর্তনকারী ও দিকনির্ধারক দিনরূপে স্বীকৃতি লাভ করেছে। প্রকৃতপক্ষে ঐ দিনটিই ছিলো কাশ্মীরের তাহরীকে আযাদী বা স্বাধীনতা আন্দোলনের সূচনাবিন্দু। এজন্যই এরপর থেকে প্রতিবছর ১৩ই জুলাই কাশ্মীরদিবসরূপে পালিত হয়ে আসছে। সেদিন স্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয়েছিলো যে, কাশ্মীরের স্বাধীনতার যে আন্দোলন তার পিছনে একমাত্র প্রেরণাশক্তি হচ্ছে ইসলাম এবং শুধু  ইসলাম; জিহাদ এবং একমাত্র জিহাদ। আরো সুনির্দিষ্টভাবে যদি বলি, কাশ্মীরের আযাদির একমাত্র মাকছাদ হলো লা-ইলাহা এবং ইল্লাল্লাহ্! যেমন ছিলো পাকিস্তানের মাকছাদ ...!

পাকিস্তানের যারা ‘কায়েদীন’ তাদের দিল ও দেমাগ এই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং মাকছাদের বিষয়ে সৎ ও নিবেদিত ছিলো না, শুধু সময়ের প্রয়োজনরূপে তারা সেটা ব্যবহার করেছিলেন মুসলিম জনতার ভাব ও আবেগকে কাজে লাগানোর জন্য, তারপর যথারীতি তা ভুলে গিয়েছিলেন, যার পরিণতিতে পাকিস্তান দু’টুকরো হয়েছে। কাশ্মীরের আযাদির যারা কায়েদীন তাদেরও এ সত্য মনে রাখতে হবে। ইতিহাস কোন প্রতারণা কখনো সহ্য করে না।

আসুন, এবার ইতিহাসের পাতায় খুঁজে দেখি, কী ঘটেছিলো সেদিন কাশ্মীরের পবিত্র ভূমিতে?

ঘটনার শুরু আসলে ১৯শে জুন থেকে। সেদিন কাশ্মীরে প্রধান ঈদগাহে খতীবকে অস্ত্রের মুখে খুতবা থেকে বিরত রাখা হয়েছিলো, তার উপর ‘তেলে ঘী ঢালা হয়েছিলো’ কোরআনের অবমাননা করার মাধ্যমে। এ দু’ ঘটনার কারণে কাশ্মীর যেন ক্রোধে ফুঁসে উঠেছিলো। তো এর প্রতিবাদে ২১শে জুন জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের সুপ্রসিদ্ধ দ্বীনী মারকায খানকা মু‘আল্লায় স্বাধীনতাপাগল মুসলিম জনতার এক বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছিলো।

সেই সমাবেশে একপর্যায়ে সীমান্ত প্রদেশের অজ্ঞাত অখ্যাত এক যুবক, আব্দুল কাদীর, কাশ্মীরের সঙ্গে যার ভাষা ও বর্ণ এবং মাটি ও রক্তের কোন সম্পর্ক ছিলো না, একমাত্র সম্পর্ক ছিলো ঈমান ও বিশ্বাসের এবং কালিমা ও আকীদার, সেই সম্পর্কেরই দাবী রক্ষা করে সেদিন তিনি ঐ সমাবেশে দাঁড়িয়ে দরদভরা কণ্ঠে মুসলিমানে কাশ্মীরকে সম্বোধন করে বলেছিলেন

আয় মুসলমানো, উঠো, জাগো, এখন সময় এসেছে প্রতিবাদের, প্রতিরোধের এবং জিহাদের। আবেদন-নিদেন ও স্মারকলিপি অর্পণ, এগুলো দ্বারা যুলুম থেকে নাজাত পাওয়া যাবে না; এর মাধ্যমে দ্বীনের, কোরআনের অবমাননা বন্ধ হবে না। এখন তোমাদের দাঁড়াতে নিজেদের পায়ে এবং লড়াই করতে হবে যুলুমের বিরুদ্ধে।

যুবক আব্দুল কাদীর কাশ্মীরের মহারাজার প্রাসাদের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, এই প্রাসাদ গুঁড়িয়ে দাও, আযাদির ইমারত গড়ে তোলো।...

যুবক আব্দুল কাদীরকে রাজবিদ্রোহের প্রতি প্ররোচিত করার অভিযোগে তখনই গ্রেফতার করা হয়, আর কাশ্মীর হঠাৎ করেই যেন অগ্নিগর্ভ রূপ ধারণ করে। দলমত নির্বিশিষে কাশ্মীরের মুসলিম জনতা যুবক আব্দুল কাদীরের পাশে এসে দাঁড়ায় এবং তার প্রতি সংহতি প্রকাশ করে। প্রতিদিনই আব্দুল কাদীরের গ্রেফতারির প্রতিবাদে মিছিল, সমাবেশ ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হতে থাকে। এভাবে পুরো কাশ্মীর হয়ে ওঠে একদেহ একপ্রাণ।

রাজদ্রোহ মামলার শুনানির তারিখ নির্ধারিত হলো ১৩ই জুলাই। স্থান হলো শ্রীনগর কেন্দ্রীয় কারাগার। তখনো শুনানি শুরু হয়নি, কেন্দ্রীয় কারাগারের বিশাল প্রাঙ্গণে লাখ লাখ কাশ্মীরী মুসলমান জড়ো হয়ে গেলো। সেখানে তখন তিলধারণেও স্থান ছিলো না। রাজপক্ষ কল্পনাও করতে পারেনি যে, অজ্ঞাত অখ্যাত একজন পরদেশীর জন্য পুরো কাশ্মীর এভাবে জ্বলে ওঠবে।

এর মধ্যে যোহরের ওয়াক্ত হলো, আর একজন যুবক আযান শুরু করলেন। ইন্না লিল্লাহ্! আযান শুরুর সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠলো ডোগরা সিপাহীর বন্দুক। আর মুআজ্জিন যুবক মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ে শহীদ হয়ে গেলেন! আযান কি থেমে গেলো? না, ঈমান ও জিহাদের বলে বলীয়ান দ্বিতীয় যুবক আযান এগিয়ে নিলেন। আবার বন্দুকের নল গর্জে উঠলো, তিনিও মাটিয়ে লুটিয়ে পড়লেন এবং জামে শাহাদাত পান করলেন। মুহূর্ত বিলম্ব হলো না, তৃতীয় যুবক তার স্থানে দাঁড়িয়ে গেলেন। আযান আরো কিছু দূর এগিয়ে গেলো। তিনিও শহীদ হলেন। চতুর্থ, পঞ্চম, ... এভাবে সতেরটি শব্দের আযান সমাপ্ত করার জন্য বাইশজন মায়ের বাইশজন সন্তান তাদের বুকের তাজা খুন ঢেলে দিলেন!

ঘটনার আকস্মিকতায় উপস্থিত জনতা শাব্দিক অর্থেই স্তব্ধ হয়ে পড়েছিলো। যখন হুঁশ হলো তখন জনতার সাগরে এমন ঢেউ সৃষ্টি হলো যে, সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেলো। ...

এভাবে ১৯৩১ সালের ১৩ই জুলাই কাশ্মীরের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকলো।

***

পরদিন শহীদানে আযানের জানাযা অনুষ্ঠিত হলো ইদগাহ ময়দানে। তখনকার সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা যায়, অন্তত পাঁচলাখ মানুষ শরীক হয়েছিলো জানাযায়। আর তাতে যে কান্নার রোল পড়েছিলো, তা আপনতম মানুষের জানাযাও দেখা যায় না। কয়েকশ মানুষ শোকে বিহ্বল হয়ে সেদিন সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছিলেন।

জানাযার সমাবেশে ঘোষণা করা হয়েছিলো, ‘এই শহীদানের খুনের কাছে কাশ্মীর চিরঋণী হয়ে থাকলো। কাশ্মীরের যমীন হবে আযানের যমীন, ইসলামের যমীন। আজ থেকে কাশ্মীরের যমীন হবে মুসলিমের যমীন। তবে অমুসলিমরা এখানে পূর্ণ নিরপাদ থাকবে।

***

কাশ্মীরের নেতা শেখ আব্দুল্লাহ ভুলে গিয়েছিলেন শহীদানে আযানের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতার কথা। তিনি সঙ্গী হয়েছিলেন হিন্দুভারতের। নেহরুকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করেছিলেন তিনি, আর ভেবেছিলেন, পাকিস্তানের চেয়ে হিন্দুস্তানই হবে তার ক্ষমতা ও রাজনীতির উচ্চাভিলাষ পূরণের উত্তম ক্ষেত্র। নিজের ক্ষণস্থায়ী ভাগ্য গড়ে তোলার লোভ ও লালসার কাছে তিনি বিসর্জন দিয়েছিলেন কাশ্মীরের পুরো মুসলিম জনগোষ্ঠীর স্থায়ী ভাগ্য। তার পরিণতিও তাকে ভোগ করতে হয়েছে। খুব দেরী হয়নি, প্রাণের বন্ধু নেহরু তাকে অত্যন্ত নির্দয়ভাবে কারাগারে নিক্ষেপ করেছিলেন। শেখ সাহেব পরে অবশ্য অনুতাপ প্রকাশ করেছেন, কিন্তু ...! শুধু তিনি কেন! প্রজন্মপরম্পরায় শেখপরিবার সেই ভুলের কাফফারাই তো দিয়ে যাচ্ছেন! এখন তাঁর নাতী ওমর আব্দুল্লাহ্ কাদছেন জেলখানায় বসে। কাঁদছেন আর বললেছন, ভারত কাশ্মীরের জনগণকে ধোকা দিয়েছে!

***

পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দও ভুল করেছেন এবং ভুলে গিয়েছেন কাশ্মীরের আযাদীর ক্ষেত্রে জিহাদ ও শাহাদাতের ভূমিকা। জিহাদের মাধ্যমেই অর্জিত হয়েছে আযাদ কাশ্মীর, তারপর জিহাদের ময়দান ত্যাগ করে তারা দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন, রাজনীতি ও কূটনীতির অঙ্গনে। নতীজা সামনেই রয়েছে! *

১৯৩১ সালের ১৩ই জুলাই কাশ্মীর কেন্দ্রীয় কারাগারের চত্বরে আযান ও শাহাদাতের যে বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটেছিলো তাতে একে একে বাইশজন ফারযান্দানে তাওহীদ শহীদ হয়েছিলেন। এখানে তাদের নামের তালিকা দেয়া হলো

১ খালিক সোহরা

২ আকবার দার

৩ গোলাম আহমদ রাঠের

৪ উছমান মিছগার

৫ গোলাম আহমদ ভাট

৬ গোলাম মুহম্মদ হালওয়াঈ

৭ গোলাম নবী কালওয়াট

৮ গোলাম আহমদ নাগাছ

৯ গোলাম রাসূল র্দোরা

১০ আমীরুদ্দীন মাকাঈ

১১ সোবহান মাকাঈ

১২ গোলাম কাদীর খান

১৩ রামাযান চৌলা

১৪ গোলাম মুহম্মদ ছূফী

১৫ নাছীরুদ্ধীন

১৬ আমীরুদ্দীন ঝান্ডগারু

১৭ মুহম্মদ ছুবহান খান

১৮ মুহম্মদ সুলতান খান

১৯ আব্দুস্-সালাম

২০ গোলাম মুহম্মদ তেলী

২১ ফাকীর আলী

২২গোলাম আহমদ দার

আরো দু’জন ‘মাস্তানে তাওহীদ’ আযান শেষ হওয়ার পর সম্ভবত সংশ্লিষ্ট কোন কারণে শাহাদত বরণ করেছেন, তাদের নাম পাওয়া গিয়েছে, কিন্তু শাহাদতের সূত্র জানা যায়নি। তারা হলেন

১ মোগলী

২ আব্দুল্লাহ্ আহানগের