শিশু-কিশোর ও নবীনদের পত্রিকা

মাসিক আল-কলম-পুষ্প

কাশ্মীরসংখ্যা | কাশ্মীর সংখ্যা (বিশেষ)

কাশ্মীরের আযাদীর পথে শহীদ

 

কাশ্মীরের আযাদীর পথে শহীদ

মুহম্মদ মাকবূল বাট

কাশ্মীরের আযাদীর পথে এ পর্যন্ত যারা শহীদ হয়েছেন, তাদের অল্পক’জনেরই নাম ইতিহাসের পাতায় সংরক্ষিত হয়েছে। অধিকাংশই হলেন অজ্ঞাত শহীদ, যাদের নাম আল্লাহ্ ছাড়া কেউ জানে না। জানার প্রয়োজনও নেই। কারণ খুনে শহীদানের প্রতিদান তো একমাত্র আল্লাহ্ কাছে। শহীদানের কাফেলায় যাত্রী যারা তারা তো খ্যাতি ও সুখ্যাতি এবং পুরস্কার ও প্রাপ্তির প্রত্যাশী নন। কে তাদের মনে রাখলো, আর কে ভুলে গেলো তাতে তো তাদের কিছু যায় আসে না!

***

কাশ্মীরের আযাদির পথে এ পর্যন্ত যারা শহীদ হয়েছেন তাদের মধ্যে একটি উজ্জ্বল নাম হলো শহীদ মুহম্মদ মাকবূল বাট। তার গৌরবময় জীবনের ব্যতিক্রমী দিক এই যে, অধিকৃত কাশ্মীরে যেমন তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং আদালত মৃত্যুদ- প্রদান করেছে তেমনি পরবর্তীকালে আযাদ কাশ্মীর ও পাকিস্তানেও তিনি কারাবরণ করেছেন এবং তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হয়েছে। আরো চিত্তাকর্ষক বিষয় এই যে, অধিকৃত কাশ্মীরে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো দুশমন মুলক পাকিস্তানের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি। একই ভাবে আযাদ কাশ্মীর ও পাকিস্তানে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিলো দুশমন মুলক ভারতের পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি!

***

মাকবূল বাটের জন্ম ১৮ই ফেব্রুয়ারী ১৯৩৮ খৃ. (অধিকৃত) কাশ্মীরের জেলা কাপূড়া, তহশীল হিন্দুয়াড়া, গ্রাম ত্রিগাম। পিতার নাম গোলাম কাদির বাট। তার আম্মা ১৯৪৯ সালে ইনতিকাল করেন। তখন মাকবূল বাট এগার বছরের বালক। মাকবূল বাটের শৈশব অতিবাহিত হয়েছে ডোগরা রাজের শাসন-শোষণের শেষ দিকে। তখনো জম্মু-কাশ্মীরে জায়গীরদারি ব্যবস্থা বহাল ছিলো যদিও গণবিদ্রোহের আলামত শুরু হয়ে গিয়েছিলো।

তার শৈশবের দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এখানে উল্লেখ করা সঙ্গত হবে। কারণ তার পরবর্তী জীবনে এর গভীর প্রভাব ছিলো।

প্রথম ঘটনা, তিনি তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্র। খারাপ আবহাওয়ার কারণে ফসল ভালো হয়নি, কিন্তু জায়গীরদার নির্ধারিত খাযনা উশুল করবেই। কৃষকরা অনন্যোপায় হয়ে তাদের কঙ্কালসার বাচ্চাদের শুইয়ে দিয়েছিলো জায়গীরদারের গাড়ীর সামনে। ‘খাযনার ফসল নিয়ে যেতে হলে আমাদের বাচ্চাদের লাশের উপর দিয়ে নিতে হবে’, এই ছিলো কৃষকদের কথা।

দ্বিতীয় ঘটনা। তখন ধনী-গরীব ও আশরাফ-আতরাফ, সামাজিক বিভেদ ছিলো প্রবল। এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সামাজিক অনুষ্ঠানেও ধনী ও গরীব অভিভাবক আলাদা বসতো। গরীবের ছেলে মাকবূল বাট, প্রথম পুরস্কারের অধিকারী হয়েছিলেন। কিন্তু ঐ বয়সেই তিনি এতটা সচেতন ও আত্মমর্যাদাবোধের অধিকারী

ছিলেন যে, পুরস্কার গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়ে বললেন, মা- বাবাদের বসার বৈষম্য দূর না করলে..! অবশেষে কর্তৃপক্ষ তার অনমনীয়তার সামনে নতি স্বীকার করেছিলো। ...

স্কুলজীবন শেষে তিনি শ্রীনগর সেন্ট যোশেফ কলেজে ভর্তি হয়ে ইতিহাস ও রাজনীতিতে বিএ করেছেন।

***

শেখ আব্দুল্লাহ্র গণভোট আন্দোলনে যোগ দেয়ার মাধ্যমে মাকবূল বাটের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। ডিসেম্বর সাতান্নতে এবং এপ্রিল আটান্নতে শেখ আব্দুল্লাহ্কে যখন পরপর গ্রেফতার করা হলো তখন গ্রেফতারী থেকে বাঁচার জন্য মাকবূল বাট চাচার সঙ্গে আযাদ কাশ্মীরে হিজরত করেন এবং পেশাওয়ার ইউনিভার্সিটি থেকে আইন ও সাংবাদিকতার সনদ অর্জন করেন।

১৯৬১-এর আইয়ূবী নির্বাচনে আযাদ কাশ্মীরের মুহাজিরীনের সংরক্ষিত আসনে প্রার্থী হন এবং জয়লাভ করেন।

১৯৬৫-এর এপ্রিলে বেশ কিছু অনুগামী ও সহগামীসহ অধিকৃত কাশ্মীরে প্রবেশ করে একমুঠ মাটি হাতে নিয়ে মাকবূল বাট শপথ গ্রহণ করেন যে,  জম্মু-কাশ্মীরের আযাদীর জন্য নিজের জানমাল সবকিছু কোরবান করবেন। ওখান থেকেই মূলত গণভোট ফোরাম নামে জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে, যার প্রচার সম্পাদক হন মাকবূল বাট। সভাপতি ছিলেন আব্দুল খালেক আনছারী, সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আমানুল্লাহ্ খান।

পরে ১৩ই আগস্ট ১৯৬৬ ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি নামে একটি গোপন সামরিক সংস্থা গড়ে তোলা হয়, যার উদ্দেশ্য ছিলো কাশ্মীরের স্বাধীনতা আন্দোলনকে গতিশীল ও সংহত করা এবং পাকিস্তান ও হিন্দুস্তান-সহ গোটা বিশ্বকে বুঝিয়ে দেয়া যে, কাশ্মীরের আসল উত্তরাধিকার কাশ্মীরীদের, অন্য কারো নয়।

ইন্ডিয়ান সিকিউরিটি ফোর্স মাকবূল বাটের গোপন তৎপরতা সম্পর্কে অবগত হয়ে ঝটিকা অভিযানের মাধ্যমে কতিপয় সহকর্মীসহ তাকে গ্রেফতার করে। ঝটিকা হামলায় তার সহকর্মী আওরঙ্গযেব শহীদ হন। পক্ষান্তরে ক্রাইম ব্রাঞ্চ-এর সিআইডি ইনস্পেক্টর অমরচান্দ নিহত হন।

শ্রীনগর সেন্টার জেলে রাখা অবস্থায় তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদোহিতা এবং অমরচান্দ হত্যার অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়। মামলা করা হয়েছিলো ইন্ডিয়ান পেনাল কোড এনিমি অ্যাক্ট ১৯৪৩-এর অধীনে। মামলা চলাকালে আদালতের উদ্দেশ্যে মাকবূল বাট বলেছিলেন, আমি কিছুতেই মানতে রাজী নই যে, মাকবূল বাট শত্রুপক্ষের হয়ে কাজ করছে। আমি তো নিজেই ভারতের প্রথম শ্রেণীর শত্রু! সুতরাং এভাবে মামলা করুন, আমি গর্বের সঙ্গে আমার অপরাধ স্বীকার করবো।

কাশ্মীর হাইকের্ট যখন মৃত্যুদ- ঘোষণা করে তখন এই অকুতোভয় মুজাহিদ দম্ভভরে আদালতের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, মাকবূল বাটকে ফাঁসি দেয়ার রশি এখনো তৈরী হয়নি জজসাহেব!

***

মাকবূল বাট আদালতের মাধ্যমে ভারত সরকারের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দেয়া চ্যালেঞ্জ রক্ষা করেছিলেন। সঙ্গত কারণেই তাকে উচ্চস্তরের নিরাপত্তাবেষ্টনীতে রাখা হয়েছিলো। কিন্তু ৯ই ডিসেম্বর ১৯৬৮ তিনি জেলের দেয়াল ভেঙ্গে পলায়ন করেন।

তার জেল থেকে পলায়ন এবং তুষারাবৃত পর্বতমালা অতিক্রম করে আযাদ কাশ্মীরে গমন, সত্যি বলতে কি গোয়েন্দাকল্পকাহিনী-কেও হার মানাবে।১

কিন্তু নিয়তির কী নির্মম পরিহাস! ২৩শে ডিসেম্বর তিনি আযাদ কাশ্মীরে প্রবেশ করেন, আর ২৫শে ডিসেম্বর আযাদ কাশ্মীর সরকার তাকে গ্রেফতার করে। মুযাফ্ফরাবাদ ব্ল্যাক ফোর্টে তাকে রাখা হয়। তবে প্রচ- গণবিক্ষোভের কারণে (৪ঠা মার্চ ৬৯) সরকার তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। তখন থেকে তিনি রাজনৈতিক কর্মকা-ণ্ডের মধ্যেই নিজেকে পরিপূর্ণভাবে নিয়োজিত রাখেন। নভেম্বর ৬৯ এ তিনি গণভোট ফোরামের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।

***

এর মধ্যে ৩০শে জানুয়ারী ৭১ এ বিখ্যাত ভারতীয় বিমান ছিনতাই-এর ঘটনা ঘটে। ধারণা করা হয় ছিনতাইকারী দুই যুবক হাশিম কোরায়শী ও আশরাফ কোরায়শী তারই কাছ থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলো।

ছিনতাইকারী দুই যুবক বিমানটি লাহোর বিমানবন্দরে নিয়ে আসে। ভারত সরকারের কাছে তাদের দাবী ছিলো এন এল এফ-এর চব্বিশজন বন্দীকে নিঃশর্ত মুক্তি দেয়া এবং আযাদ কাশ্মীরে পৌঁছার ব্যবস্থা করা। ভারত সরকার দাবী মানতে অস্বীকার করে। তখন যাত্রীদের নামিয়ে গঙ্গা নামের বিমানটিকে ১লাফেব্রুয়ারী লাহোর বিমানবন্দরে উড়িয়ে দেয়া হয়।

সমগ্র পাকিস্তানী জাতি এ ঘটনায় মাকবূল বাট এবং তার শিষ্যদের কর্মকা-ণ্ডেএকাত্মতা প্রকাশ করে।

বিমানছিনতাই ঘটনা পাকিস্তানের জন্য কূটনৈতিক জটিলতা সৃষ্টি করেছিলো, কোন সন্দেহ নেই, তবে এর মাধ্যমে কাশ্মীরসমস্যা শুধু নবজীবন লাভ করেছে তাই নয়, বরং কাশ্মীরের স্বাধীনতা-কামী শক্তির সক্ষমতাও বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছে।

এঘটনার পর পর্দার আড়ালে আযাদকাশ্মীর কর্তৃপক্ষ এবং পাকিস্তান সরকার পৃথক পৃথক-ভাবে তার সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝোতায় আসার প্রচেষ্টা গ্রহণ করে। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, (আযাদ কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রিত্ব আমার পথের মানযিল নয়; আমার মানযিল হলো কাশ্মীরের পূর্ণ স্বাধীনতা। অবশেষে পাকিস্তান সরকার ৭১ সালের শেষ দিকে শত শত অনুসারীসহ তাকে গ্রেফতার করে। পাকিস্তানের কারাগারে তার উপর এবং তার সহকর্মীদের যে বর্বর নির্যাতন চালানো হয়েছে তা শুনলে গায়ে কাঁটা দেয়। এর বিশদ বিবরণের জন্য আলাদা কিতাবের বয়ান দরকার।

দীর্ঘ মামলার পর ১৯৭৩ সালের মে মাসে আদালত তাকে এবং তার সঙ্গীদেরকে রেহাই প্রদান করে। শুধু হাশিম ও আশরাফ কোরায়শীকে ১৪ বছরের কারাদ- প্রদান করা হয়।

আযাদ কাশ্মীরের রাজনীতির প্রতি হতাশ হয়ে আবার তিনি কতিপয় অনুসারীসহ গোপনে যুদ্ধবিরতি রেখা অতিক্রম করে অধিকৃত কাশ্মীরে প্রবেশ করেন। এটা ১৯৭৬ সালের মে মাসের ঘটনা।

বলাবাহুল্য, ভারতের মাটিতে এবং অধিকৃত কাশ্মীরের ভূমিতে তার মত ব্যক্তির অবস্থান গোপন থাকা সম্ভব ছিলো না। অল্পক’দিন পরেই ভারতীয় নিরাপত্তা সংস্থার হাতে কয়েকজন সঙ্গীসহ তিনি বন্দী হন এবং সাবেক মামলার ফাইল দ্বিতীয় বার খোলা হয়। দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ার পর আদালত তার বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশ বহাল রাখে।

তার পক্ষের আইনজীবীগণ তাকে বাঁচানোর সর্বসাধ্য চেষ্টা করেন, কিন্তু ঘটনা এই যে, তার বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় লেখা হয়েছিলো আগে, বিচার করা হয়েছিলো পরে। সুতরাং তাকে বাঁচানো তাদের পক্ষে সম্ভব ছিলো না।

১১ই ফেব্রুয়ারী ১৯৮৪ দিল্লীর তেহার জেলে মাকবূল বাটকে ফাঁসি দেয়া হয়। বিশাল ভারত এই শহীদকে এতটাই ভয় পেতো যে, দাফন করার জন্য তার জানাযা পরিবারের কাছে হস্তান্তর করতে পর্যন্ত সাহস পায়নি, সম্পূর্ণ গোপনে তিহার জেলেই তাকে দাফন করা হয়। শ্রীনগরে তার জন্য তৈরী কবর টি আজো শূন্য অবস্থায় সংরক্ষিত রয়েছে।

কাশ্মীরের আযাদির ইতিহাসে তার নাম চিরভাস্বর থাকবে। কাশ্মীরই ছিলো প্রথম ভালোবাসা এবং শেষ ভালোবাসা। কাশ্মীরের প্রতি তার শেষ বার্তা ছিলো, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি হে কাশ্মীর! আর এ জন্য আমার কোন অনুতাপ নেই। আগামীকাল আমি চলে যাবো, তবে আমি বিশ্বাস করি, ইনশাআল্লাহ্ তোমার স্বাধীনতা একদিন আসবেই।’ *

উদয়ের পথে শুনি কার বাণী/ভয় নাই ওরে ভয় নাই/

নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান/ ক্ষয় নাই, তার ক্ষয় নাই!

এ পিঞ্জর একদিন ভাঙ্গবে/আমাদের স্বপ্ন সত্য হবে/

পর্বতচূড়ার বরফ গলে যাবে/ আমাদের স্বপ্ন সত্য হবে! আমরা অমর হবো। মাকবূল বাট