শিশু-কিশোর ও নবীনদের পত্রিকা

মাসিক আল-কলম-পুষ্প

কাশ্মীরসংখ্যা | কাশ্মীর সংখ্যা (বিশেষ)

গান্ধী, নেহরু, শেখ আব্দুল্লাহ্ কাশ্মীর ও আহলে কাশ্মীর!!

 

 

গান্ধী, নেহরু, শেখ আব্দুল্লাহ্

কাশ্মীর ও আহলে কাশ্মীর!!

শুধু কথা, বাণী ও বচন দ্বারা যদি মানবসভায় কোন মানুষের স্থান ও অবস্থান নির্ধারণ করা যায় তাহলে নিঃসন্দেহে হিন্দুভারতের কোটি কোটি মানুষের পূজ্য নেতা করমচাঁদ গান্ধীর নামের শুরুতে ‘মহাত্মা’-এর চেয়ে উপযুক্ত শব্দ আর কিছুই হতে পারে না। তবে এখানে ছোট্ট একটি সমস্যা আছে, কারো ব্যক্তিত্ব নির্ধারণের ক্ষেত্রে শুধু বাণী ও বচনকে সভ্যতার ইতিহাসে কখনো মানদ-রূপে গ্রহণ করা হয়নি। মানবসভ্যতার বুনিয়াদ বাণী ও বচনের উপর নয়, স্থাপিত হয়েছে কীর্তি ও কর্মের  উপর। স্বয়ং করমচাঁদ গান্ধী এ সত্যকে কবুল করে বলেছেন, ‘নামে নয়, কর্মে হবে তোমার পরিচয়’।

***

করমচাঁদ গান্ধীর উপর পাক-ভারত উপমহাদেশের বিপুল-সংখ্যক মুসলমানের কী কারণে যেন একটা যুক্তিহীন ভক্তি ও শ্রদ্ধার অনুভূতি ছিলো। বলতে বাধা নেই, আমার মনে হয়, গান্ধীজীর অহিংসার বাণী ও বচনগুলোই ছিলো বড় কারণ।

সম্ভবত ভারতীয় মুসলিমসমাজের গান্ধীভক্তি প্রথম হুঁচট খায় অবিভক্ত ভারতের বিহারে ভয়াবহ দাঙ্গা-পরিস্থিতির সময়। যখন ওখানে নিরস্ত্র অসহায় মুসলিমসম্প্রদায় রক্তপিপাসু হিন্দুদের হাতে নির্মম গণহত্যার শিকার হচ্ছে তখন বাপু গান্ধী তার প্রিয় ছাগলটি নিয়ে বিহারের মুসলিম-বধ্যভূমি এড়িয়ে চলে এলেন সুদূর নোয়াখালী। কারণ তার কানে গিয়েছে ওখানে হিন্দুরা মুসলমানদের হাতে ‘কচুকাটা’ হচ্ছে। এভাবে অহিংসার পূজারী গান্ধীজী নোয়াখালিতে ছাতা মেলে ধরলেন যখন ‘রক্তবৃষ্টি’ হচ্ছে বিহারের মাটিতে।

***

ভূমিকাটা একটু লম্বা হয়ে গেলো; হওয়াই স্বাভাবিক, কারণ কথা হচ্ছে গান্ধীজী সম্পর্কে। অনেক দিন থেকে আমার জানার প্রচ- ইচ্ছা ছিলো, কাশ্মীর সম্পর্কে গান্ধীজীর নীতি ও অবস্থান এবং বাণী ও বক্তব্য কী? সীমিত সাধ্যের ভিতরে উল্লেখযোগ্য কোন সূত্র খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এর মধ্যে সম্প্রতি বিজেপি ও মোদিজীর ‘দয়ায়’ কাশ্মীরে আগুন জ্বলে উঠলো, কাশ্মীর আবার বিশ্ববাসীর মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠলো। আমি সচেতনভাবেই ‘কাশ্মীর’ বলেছি, আহলে কাশ্মীর বলিনি। এটা নির্মম সত্য যে, কাশ্মীর যখনই আলোচনায় এসেছে, উপত্যকার সৌন্দর্য ও ভূমির ভৌগোলিক গুরুত্বের কারণেই এসেছে, কাশ্মীরের অসহায় মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রতি কিন্তু কখনো কারো দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়নি, না আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের, না ভারতের নেতা ও জনতার; না ভালোবাসার দৃষ্টি, না করুণার! (ঘৃণার দৃষ্টিতে কি দৃষ্টি বলা যায়!)

তো হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার গত ৫ই আগস্ট যখন ভারতীয় সংবিধান থেকে কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদাদানকারী অনুচ্ছেদ ৩৭০ এবং তার অন্তর্গত ৩৫ক ধারা তুলে দিলেন তখন কাশ্মীর আগ্নেয়গিরির মতই জ¦লে উঠলো। আশি লাখ কাশ্মীরীকে দমন করার জন্য নিযুক্ত হলো দশলাখ সৈন্য, একশদিনের পর আরো পঞ্চাশ দিন পার হয়ে গেলো, কাশ্মীরে চলছে নিñিদ্র সান্ধ্যআইন। সভ্যপৃথিবীর ইতিহাসে এত দীর্ঘ কারফিউ আর কোন জনপদে জারি হয়েছে বলে অন্তত আমাদের জানা নেই।

***

অক্ষম মানুষ কী করতে পারে, মুখে বা কলমে আহাজারি ও আর্তনাদ করে মযলুমানের প্রতি হামদর্দি, সহমর্মিতা ও একাত্মতা প্রকাশ করতে পারে, তাও যথেষ্ট সংযমের সঙ্গে! তো সে চেষ্টা হিসাবেই সিদ্ধান্ত হলো পুষ্পের কাশ্মীরসংখ্যা প্রাকাশের। পত্রপত্রিকা, বইপুস্তক ও তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা যখন শুরু হলো, অপ্রত্যাশিতভাবে হাতে এলো ছোট কলেবরের বই ‘বাপু আওর কাশ্মীর’, যা মূলত কাশ্মীরবিষয়ে গান্ধীজীর বক্তৃতাসঙ্কলন। এ বক্তৃতাগুলো তিনি করেছেন (১৯৪৭-এর অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারী ৪৮ সাল পর্যন্ত) ঐ সময়কালে যখন কাশ্মীরে রক্তের নদী বয়ে চলেছিলো, আর সে রক্ত ছিলো মুসলিমের।

বাপুজীর কাশ্মীরবিষয়ক বক্তৃতা-সঙ্কলন পড়ে সত্যি সত্যি আমি বিস্ময়ে বেদনায় বিমূঢ় হয়ে পড়লাম! বলা ভালো, গান্ধীজীর চেহারা থেকে অহিংসার মুখোশটা যেন নিজে থেকেই খসে পড়লো! বর্তমান প্রবন্ধে গান্ধীজীর বক্তৃতার আলোকে আমরা কাশ্মীর সম্পর্কে আমরা বিশেষ করে বাপুজীর, তারপর নেহরু ও শেখজীর প্রকৃত চেহারাটা প্রিয় পাঠক, আপনাকে দেখাতে চাইবো।

***

২৬শে অক্টোবর ১৯৪৭ এর প্রার্থনাসভায় গান্ধীজী বলেন,

০ আপনারা আমাকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন, ‘তুমি এত লম্বা-চওড়া কথা তো বলতে পারো, কিন্তু কাশ্মীরে যা হচ্ছে তারো কি কোন খবর আছে তোমার?!’

হাঁ, খবর আছে আমার, তবে এতটুকুই খবর আছে যতটুকু পত্রিকায় এসেছে। যদি সেগুলো সব সত্য হয় তাহলে তো তা খুবই খারাপ কথা...

০০ বিশ্বাস হয়, গান্ধীজী, নেহরুজী, জিন্নাহজীর মত সর্বভারতীয় ব্যক্তি এভাবে কথা বলতে পারেন! মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কোন সাধারণ মানুষ হয়ত বলতে পারে, কিন্তু গান্দীজী! মহাত্মাজী! কাশ্মীরে তো তখন রক্তের গঙ্গা বয়ে যাচ্ছিলো... তিনি শুধু পত্রিকার খবরের উপর বিশ্বাস করে বসে থাকবেন!

০ অভিযোগ তো পাকিস্তানেরই উপর এসেছে যে, কাশ্মীরকে বাধ্য করছে! ....

০০ মহাত্মাজী! আমি বিশ্বাস করি, আপনার অজানা ছিলো না যে, কাশ্মীরের মুসলিম গোষ্ঠী (যারা ছিলো সেখানকার ভারী সংখ্যাগরিষ্ঠ) পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হতে চাচ্ছিলো মনে প্রাণে, কিন্তু মহারাজার ডোগরা ফৌজ বন্দুকের নলের মুখে তাদের বাধা দিচ্ছিলো! নির্বিচারে হত্যাকা- শুরু করেছিলো! দিশেহারা মুসলিম জনগোষ্ঠী এবং প্রায় নিরস্ত্র কাশ্মীরী মুজাহিদীন তখনকোন উপায় না দেখে তাদের সীমান্তীয় বাহাদূর ভাইদের কাছে ‘বাঁচাও, বাঁচাও আর্তনাদ পাঠাচ্ছিলো! আপনিই বলুন মহাত্মাজী, সীমান্তের আযাদ গোত্রগুলোর তখন কী করণীয় ছিলো, চুপচাপ বসে থাকা, না মযলূম ভাইদের সাহায্যের জন্য ছুটে যাওয়া, হোক না প্রায় খালি হাতে!

আধুনিক ডোগরা ফৌজের মোকাবেলায় ‘জংধরা রাইফেল’, খালিহাতই তো বলতে হবে!

০ কাশ্মীরের যিনি মহারাজা তিনি তো সেখানকার মহারাজা নন। অন্যান্য রাজ্যেও একই কথা, তাদেরকে তো রাজা বানিয়েছে ইংরেজ, কারণ রাজাদের মাধ্যমে শাসন বড় তেজ চলতো। আমার মতে প্রতিটি রাজ্যের আসল রাজা তো রাজ্যের প্রজাগণ।

০০ মহাত্মাজী, সত্য বলেছেন। তবে কাশ্মীরের মহারাজার অবস্থান ছিলো সবচে’ নিকৃষ্ট! কারণ সওদাগর ইংরেজের কাছ থেকে ‘তিনি’ কাশ্মীরের মাটি ও মানুষের সওদা করেছিলেন পচাত্তর লাখ টাকার বিনিময়ে! কেমন লাগবে আপনার, মহাত্মাজী, যদি গুজরাট এবং আপনিসহ গুজরাটের মানুষের এভাবে বেচাকেনা হয়! হায়দারাবাদের নেযাম কিন্তু ইংরেজের ‘তৈরী’ নন! নেযাম তো ঐ সময় থেকে নেযাম, যখন ইংরেজ সওদাগর ভারতের তীরে নোঙ্গর পর্যন্ত ফেলেনি। সুতরাং হায়দারাবাদী নেযামের তো রীতিমত ‘আইনি’ অধিকার ছিলো মাটি ও মানুষের উপর। তার ইচ্ছা ছিলো স্বাধীনতা; না পাকিস্তান, না ভারত। আপনি মহাত্মাজী, সেখানে সামরিক আগ্রাসন  চালিয়েছেন..

০ ... যদি কাশ্মীরের প্রজারা পাকিস্তানের সঙ্গে যেতে চায় তাহলে কোন শক্তি নাই দুনিয়াতে পাকিস্তানের সঙ্গে যেতে বাধা দিতে পারে... তবে পূর্ণ স্বাধীনতার সঙ্গে, পূর্ণ আরামের সঙ্গে যেন তাদের জিজ্ঞাসা করা হয়। ...

০০ জি¦ মহাত্মাজী! মুসলিম কন্ফারেন্সের মাধ্যমে কাশ্মীরের মুসলিম জনতা তো তাদের রায় ঘোষণা করেছিলো, ডোগরা ফৌজের বন্দুকের নল উপেক্ষা করে! কিন্তু সমস্যা হলো, আপনার কানে শেখ আব্দুল্লাহ্ ছাড়া আর কারো আওয়া পৌঁছেই না!

০ তার উপর হামলা তো করতে পারে না! যদি সেখানকার প্রজা হোক না সেখানে মুসলিম আবাদি বেশী চায় যে, ভারত ইউনিয়নে থাকবো, তাহলে কেউ তাকে বাধা দিতে পারে না!

০০  এ আপনি কী বলছেন মহাত্মাজী! কথা তো ছিলো মুসলিম এলাকা পাকিস্তানের হবে, হিন্দু এলাকা ভারতের হবে! কাশ্মীরের বেলা আলাদা কথা কেন, বাপুজী!

তদুপরি, ‘ইউনিয়ন’ তো কাশ্মীরের মুসলিমান চায়নি, চেয়েছে ডোগরারাজা, যিনি আপনারই ভাষায় ‘কাশ্মীরের মালিক নন’!

শেখ আব্দুল্লাহ্! তিনি কিন্তু ভারতভুক্তির ক্ষেত্রে কাশ্মীরের মুসলিম জনতার প্রতিনিধিত্ব করেননি। তিনি তখন ক্ষমতার লোভে আপনাদের দ্বারা প্রতারিত হয়েছিলেন, আর তার দ্বারা প্রতারিত হয়েছিলো কিছুসংখ্যক কাশ্মীরী মুসলিম।

কাশ্মীরের মূলধারা পাকিস্তানের সঙ্গে ছিলো, যাদের উপর দুনিয়ার হিংস্রতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো ডোগরা ফৌজ।

০ এখন যদি  পাকিস্তানের লোকেরা সেখানে যায় তাকে বাধ্য করার জন্য তখন পাকিস্তানের উচিৎ তাদেরকে বাধা দেয়া। যদি বাধা না দেয় তাহলে সব অভিযোগ তার উপরই আসবে। যদি ইউনিয়নের লোকেরা তাকে মজবূর করার জন্য যায় তাহলে তাদের বাধা দিতে হবে এবং তাদেরও কর্তব্য হবে থেমে যাওয়া।

০০ এত সুন্দর কথা আপনি বলতে পারেন বাপুজী! আপনি ঠিকই বলেছেন, ‘পাকিস্তানের লোকেরাই গিয়েছিলো। কারণ দু’মাস বয়সী পাকিস্তানের হাতে তখন বাহিনী বলতে কিছু ছিলোই না, ইন্ডিয়ান বাহিনীর মুসলিম ইউনিটগুলো সারা ভারতে ছড়িয়ে রাখা হয়েছিলো সুপরিকাল্পিত-ভাবে। ভাঙ্গাচোরা যে বাহিনী ছিলো তারো অধিনায়ক ছিলো ইংরেজ যিনি এমনকি কায়েদে আযমের আদেশ পর্যন্ত মানতে ‘অপরাগতা’ প্রকাশ করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের ‘লোক’ ছাড়া আর কে যেতে পারতো ডোগরা ফৌজের হাত থেকে কাশ্মীরীদের রক্ষা করার জন্য!

পক্ষান্তরে ভারতের লোকেরা যায়নি কাশ্মীরে, যাওয়ার প্রয়োজনও ছিলো না। ভারতের হাতে তো তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধজয়ী সেনাবাহিনীই রয়েছে, যারা ডোগরা মহারাজার ডাকে সাড়া দিয়ে ‘কাশ্মীরকে রক্ষা করার জন্য’ গিয়েছিলো!

০ আজ তো কাশ্মীর! পরে হতে পারে, হায়দারাবাদকে মাজবূর করো, জুনাগড়কে মজবূর করো! ... আমি তো একটি নীতি মেনে চলি যে, কেউ কাউকে মজবূর করতে পারে না। ....

০০ ধন্য আপনি মহাত্মা! হায়দারাবাদ, জুনাগড়, সেখানে পাকিস্তানের লোকেরা যায়নি কাশ্মীরের মত। সেখানকার মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করার জন্য আপনি মহাত্মা, সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছিলেন!

(২৯শে অক্টোবর ১৯৪৭) গান্ধীজী বলেছেন

০ আমি তো আজ কাশ্মীরে যা হচ্ছে সে সম্পর্কে বলতে চাই। সেখানে আফ্রিদীরা বন্দুক নিয়ে ঢুকে পড়েছে! পুঞ্ছ পার হয়ে শ্রীনগরের কাছে চলে এসেছে! মাত্র বাইশ মাইল দূরে ছিলো। ওখান থেকে সোজা সড়ক চলে গিয়েছে শ্রীনগর, কোন প্রতিবন্ধক নেই...

০০ আপনি নিজেই বলছেন, শুধু বন্দুক ছিলো আফ্রীদীদের হাতে। রাজ্যের সুপ্রশিক্ষিত এবং আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত ডোগরা বাহিনী বাধা দিতে পারেনি কেন, মহাত্মা?! কারণ ডোগরা বাহিনী ছিলো বুযদিল, ভীরু, কাপুরুষ, আর আফ্রীদী, মহাত্মাজী, ওরা আসলে শুরু থেকেই ‘বুম বুম’ আফ্রিদী!!

সেই সঙ্গে আব্দুল্লাহর গুটি কতেক অনুসারীরা মুসলিম ছাড়া পুরো কাশ্মীর ছিলো আফ্রীদীদের পৃষ্ঠপোষক! এছাড়া আর কোন ব্যাখ্যা আছে আপনার কাছে?

০ কাশ্মীরের মহারাজা যখন এ অবস্থা দেখলেন তখন বললেন ‘আমি ভারতীয় ইউনিয়নে যাবো।’ মহারাজা লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনকে পত্র লিখলেন... আর ব্যাটন বললেন, ‘আপনি আসতে পারেন...’

০০ এই মহারাজা কে মহাত্মা? আপনারই ভাষায় ইংরেজের তৈরী, কাশ্মীরের উপর তার কোন অধিকার নেই। এখন তার অধিকার এসে গেলো কীভাবে?

আচ্ছা, তাহলে তো প্রমাণ হয়ে গেলো, লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন আপনারই লোক!

০ কাশ্মীরে শেখ ছাহেব আছেন। তাকে বলা হয় শেরে কাশ্মীর, অর্থাৎ কাশ্মীরের সিংহ! বেশ তাজাতাগড়া! আপনারা তার ছবি তো দেখেই থাকবেন! আমি তো তাকে চিনি, তার বেগমকেও চিনি।

০০ বেশ রসবোধ আছে আপনার মহাত্মাজী! রীতিমত তরজমা করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন শেরে কাশ্মীর -এর মানে মতলব। ছবি পর্যন্ত দেখিয়ে দিচ্ছেন! ... জি¦ আপনি তার বেগমকেও চেনেন! চিনবেন না কেন, তিনি তো লরেন্স অব এরাবিয়ার সাবেক স্ত্রী! পালিয়ে যাওয়ার সময় ‘বেগম’ বলেছিলেন, ‘তালাক দিয়ে যাও, রাস্তা পরিষ্কার করে দিয়ে যাও।’ সেই ‘রূপসী’ আব্দুল্লাহর গলায় ঝুলে পড়েছিলো! মহাত্মাজী, তখন থেকেই সিংহ আর বনের রাজা সিংহ ছিলেন না, ‘গৃহপালিত ...’ হয়ে গিয়েছিলেন।

০ কিন্তু মহারাজা এতটুকু তো করেছেন যে, শায়খজীকে সবকিছু দিয়ে বলেছেন, তুমি যা কিছু করতে পারো করো। কাশ্মীরকে বাঁচাতে পারলে বাঁচাও!

০০ মহারাজা আব্দুল্লাহ্কে জেলে কেন পুরেছিলেন? এখন জেল থেকে বের করে আনতে হলো কেন? মুসলিম জন-গোষ্ঠীকে প্রতারিত করার জন্য?

০ আফ্রীদীরা কাশ্মীরের মুসলমান নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধকে ধরে ধরে জবাই করছে... এই যখন কাশ্মীরের অবস্থা তখন প-ণ্ডিত জওয়াহের লাল নেহরু এবং মন্ত্রিম-ল চিন্তা করলেন যে, কাশ্মীরী মুসলমানদের বাঁচাতে কিছু না কিছু তো করতে হবে...!

০০ ছোট্ট একটা প্রশ্ন বাপুজী! বারবার আপনি বলছেন, ‘কাশ্মীর কাশ্মীরীদের, মহারাজার নয়।’ তাহলে মহারাজার কাছ থেকে লিখিয়ে নিলেন কেন যে আমি ভারতের সঙ্গে যোগ দিচ্ছি? কাশ্মীরী মুসলমানদের নিঃশর্ত সাহায্য কেন নয়, বাপুজী?

আব্দুল্লাহ্ সম্পর্কে গান্ধীজীর ‘সনদ’

০ তিনি তো পাক্কা মুসলমান! তার বিবিও নামায পড়েন। বিবি আমাকে সুর করে আউযু বিল্লাহ্ পড়ে শুনিয়েছেন...

০০ সুবহানাল্লাহ্ বাপুজী! আপনার সনদ নিয়ে যাকে মুসলমান হতে হয় তিনি ক্যয়সা মুসলমান, বুঝতে কি আর বাকি থাকে! তবে আপনার অবগতির জন্য বলছি,  চৌধুরি আব্বাস, সরদার আব্দুল কাইউম, পাক্কা মুসলমান ছিলেন তারাও এবং তাদের সঙ্গে ছিলো কাশ্মীরের আম মুসলমান! তাদের বিবিরাও মুসলমান ছিলেন, তবে হিন্দুর সামনে সুর করে আউযু বিল্লাহ্ পড়া মুসলমান না! আম মুসলমানের সঙ্গে মিলে মিশে থাকা মুসলমান!

০ শেখ আব্দুল্লাহ্ তো সবাইকে ভাইয়ের মত মনে করেন। যে সব ইংরেজ ওখানে যায় তাদের সবার তিনি বন্ধু! ...

০ এখানেই পার্থক্য আব্দুল্লাহ এবং চৌধুরি গোলাম আব্বাসের মধ্যে। প্রথমজন ইংরেজের বন্ধু ছিলেন, ইংরেজের তালাক দেয়া স্ত্রীকে ঘরে তুলেছিলেন! আর দ্বিতীয়জন বন্ধু ছিলেন শুধু কাশ্মীরের জনগনের! তার স্ত্রী ছিলেন কাশ্মীরের পাকছাফ মেয়ে! আর এজন্যই তিনি নেহরু বা মাউন্ট ব্যাটেনের পছন্দের মানুষ ছিলেন না।

০ এখন আমি জিন্নাহর দিকে ফিরতে চাই। তাকে তো আমি চিনি!

০০ চিনতেই হবে! সারা জীবন তিনি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের অগ্রদূত ছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনিও আপনাদের চিনতে পেরেছেন এবং বুঝতে পেরেছেন, মুসলিম স্বার্থ রক্ষা করতে হলে...!

০ আমি এবং তিনি যখন একটি জিনিসের উপর দস্তখত করেছিলাম তখনো তার সঙ্গে মিষ্টি কথা হতো!

০০ আপনার মিষ্টি কথা বুঝতে তার বেশী সময় লাগেনি! কারণ আব্দুল্লাহর চেয়ে তিনি অনেক প্রজ্ঞাবান ছিলেন।

০ এজন্য আমি তাকে বলবো, এটা কেমন কথা যে, জওয়াহের লাল নেহরুকে ‘ধোকাবায’ বলছেন! আমি তো বলবো, জওয়াহের লাল ধোকাবাজি করার মানুষই নন। যেমন তার নাম, তেমনি তার গুণ! সরদার প্যাটেলকেও আমি জানি। তিনিও ধোকাবায নন!

০০ ওয়াও!!! এই নেহরুজীই তো শেষে আপনার ‘পাক্কা মুসলমান’কে জেলে পুরেছিলেন! নেহরু সম্পর্কেজিন্নাহর মন্তব্যটি কিন্তু তিনিও করেছেন তার আত্মাজীবনীতে।

১৯শে নভেম্বর ১৯৪৭ গান্ধীজী বলেছেন

০ তার নাম বোধহয় শেরওয়ানী! আফ্রীদীরা তাকে ঘিরে ধরে মারতে লাগলো। ঐ বেচারা ছিলো জাতীয়তাবাদী মুসলিম! আফ্রীদীরা তাকে বললো, তোমার জান বাঁচতে পারে যদি বলো, পাকিস্তান যিন্দাবাদ!

শেরওয়ানি বাহাদুরির সঙ্গে বললেন, আপনারা তো মুসলিম মারছেন, হিন্দু মারছেন। এতে ইসলামের কল্যাণ কীভাবে হতে পারে! তো আমি কীভাবে পাকিস্তান যিন্দাবাদ বলতে পারি! ...

০০ বাপুজী! এটাও আপনি জেনেছেন, নিশ্চয়, পত্রিকা থেকে! হয়ত সত্য ঘটনা! এমন কত শত ঘটনা ঘটেছে ঐ সব মুসলিমের ক্ষেত্রে যারা ‘জয় হিন্দ, জয় রামজী’ বলতে রাজী হয়নি! এখন তো আপনি নেই, এখনো ঘটছে দেদার, ‘আপকা ভার‌্যত ভূমি ম্যাঁ’!

শুনেছি আপনার ‘অস্থি’ শ্রীনগরে রয়েছে! কত লাখ সৈন্য এখন কাশ্মীরের মুসলমানদের রক্ষা করছে, বাপুজী!

২৭ জানুয়ারী ১৯৪৮ গান্ধীজী বলেছেন

০ আমি আফ্রীদীদের বলবো, আপনারা ইসলামকে বদনাম করার জন্য এসব কাজ করছেন, আর বলছেন, আমরা কাশ্মীরকে আযাদ করার জন্য করছি। খাদ্যদ্রব্য লুট করা, এটা তো আমি বুঝতে পারি। কিন্তু মা-বোনদের উঠিয়ে নেয়া, তাদের বেইজ্জত করা, এটাও কি কোরআনে আছে! আমি তো  পাকিস্তান সরকারকেও মিনতি জানাবো, এমন যত মেয়ে আছে আপনাদের কাছে, তাদের ফেরত দিন, তাদের নিজেদের ঘরে যেতে দিন!

০০ হায় বাপুজী! হাজার হাজার মুসলিম নারী লুণ্ঠিত হলো পূর্বপাঞ্জাবে! এখনো শিখদের হাতে লাঞ্ছিত জীবন যাপন করছে কত অসংখ্য নারী! আর আপনার মিনতি পাকিস্তানের কাছে, যে পাকিস্তান তখন ‘নারী অপহরণ’ করবে কী, অস্তিত্বের সঙ্কটেই ভুগছে! সারা জীবন আপনি বাপুজী, বৃষ্টি হয়েছে একখানে, ছাতা ধরেছেন অন্যখানে!

বাপুজী! আপনি তো নেই, আপনার আত্মা কোথায় জানি না! আপনার আত্মাকেই সম্বোধন করে বলছি, আজ কাশ্মীরের রক্ষাকবচ তুলে নেয়া হয়েছে। হিন্দু ভারত এখন তার যুবকদের উসকে দিচ্ছে, ‘কাশ্মীরে যাও, ওখানকার ‘টসটসে আপেল’ ভোগ করো।’ বাপুজী! সভ্য পৃথিবীর আর কোথাও কি এর নযির আছে?! কিছু তো লজ্জা করুন, বাপুজী!!! *

(গান্ধীজীর বক্তৃতাসঙ্কলনের উপর বলার মত আরো অনেক কথা ছিলো, তবে বোঝার জন্য এতটুকু যথেষ্ট বলেই মনে হয়।)