শিশু-কিশোর ও নবীনদের পত্রিকা

মাসিক আল-কলম-পুষ্প

কাশ্মীরসংখ্যা | তোমাদের পাতা

ইবনে মিসবাহ

কাশ্মীরঃ ইতিহাসের দিনপঞ্জি

 

 

কাশ্মীরঃ ইতিহাসের দিনপঞ্জি

(১৩২০ খৃ.- ২০১৯ ৫ই আগস্ট)

ইসলামের শুভাগমনের আগ পর্যন্ত সুদীর্ঘকাল কাশ্মীর ছিলো বিভিন্ন বৌদ্ধ-হিন্দুশাসনের অধীন। তন্মধ্যে কারকোতা ডাইনেস্টি (৬২৫ - ৮৮৫) উৎপালা ডাইনেস্টি (৮৮৫-১০০৩) ও লোহারা ডাইনেস্টি (১০০৩ খৃ - ১৩২০ খৃ) হচ্ছে উল্লেখযোগ্য।

পৃথিবীর অন্যান্য বহু অঞ্চলের মত কাশ্মীরের সহজ-সরল মানুষের মধ্যেও ইসলামের প্রথম আগমন ঘটে আরব থেকে আসা স্ন্দুর আখলাক ও তাহযীবের অধিকারী মুসলিম ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে। তারপর তেরো ও চৌদ্দ শতকে মধ্য এশিয়া থেকে আগত সূফী দাঈদের মাধ্যমে ইসলামের বসন্তবাতাস ছড়িয়ে পড়ে কাশ্মীরের প্রতিটি পাহাড়ী বস্তি ও উপত্যকায়।

১৩২০ খৃস্টাব্দঃ  সায়্যেদ শারফুদ্দিন আব্দুররহমান নামের একজন মহান বুযুর্গের আগমন ঘটে কাশ্মীরে। আহলে কাশ্মীর আজো পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁকে স্মরণ করে বুলবুল শাহ বা বিলাল শাহ নামে। তাঁর উত্তম সান্নিধ্য ও চরিত্রমাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন স্থানীয় রাজা রঞ্জন শাহ। এই দাওয়াতি মেহনত এমনই গতি লাভ করে যে, অল্প কিছুদিনের মধ্যে পাশবর্তী বহু অঞ্চলের মানুষ ইসলামের ছায়াতলে প্রবেশ করেন এবং পার্শবর্তী বহু রাজা ও রাজ্য ইসলাম গ্রহণ করে কাশ্মীরের সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। ১৬ শতক পর্যন্ত স্থানীয় মুসলিম শাসকদের অধীনেই শাসিত হতে থাকে এই বিশাল এলাকা।

১৩২৩ ঃকাশ্মীরের প্রথম মুসলিম শাসক সুলতান সদরুদ্দিনের (রঞ্জন শাহ) ইন্তিকাল। এরপর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও নৈরাজ্য ছড়িয়ে পড়ে উপত্যকায়। এই সুযোগে সাবেক রাজবংশের উত্তরাধিকারীরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সুলতান সদরুদ্দিনের বিধবা স্ত্রী কোটা রাণীর সহযোগিতায় ক্ষমতা দখল করে বসে শেষ লোহারারাজা সুহাদেভার ভাই উদয়ানানদেভা। তবে কোটা রাণীই ছিলেন রাজ-শাসনের নেপথ্য। একসময় তিনি নিজেকে ‘রাণী’ হিসেবে ঘোষণা করেন। তবে মাত্র এক বছরের মাথায় তার শাসনের অবসান ঘটে।

১৩৩৯ঃ দীর্ঘ এক যুদ্ধের পর কোটা রাণী তথা লোহারাদের পরাজিত করে কাশ্মীরের সিংহাসনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন সুলতান সদরুদ্দিনের বিশ্বস্ত উযীর শাহ মীর। পরবর্তীতে তার বংশধররা প্রায় আড়াই শতাব্দী কাশ্মীর শাসন করেন। ইতিহাসে যারা শাহমীরী রাজবংশ নামে সুপরিচিত। শাহমীরী শাসনামলেই কাশ্মীরে ইসলাম সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। শাহমীরীদের মাধ্যমে কাশ্মীরে সুদীর্ঘ পাঁচ শতাব্দীর মুসলিমশাসনের সূচনা হয়। শাহমীরীদের হাত থেকে প্রথমে আফগানরা এবং তারপর মোঘলরা কাশ্মীরকে নিজেদের সালতানাতের অংশ করে নেয়।

১৩৭২ ঃ পারস্যের সুবিখ্যাত সুফী দাঈ মীর সায়্যেদ আলী হামদানী তার দাওয়াতী কাফেলা নিয়ে ইরানের হামদান থেকে কাশ্মীরে আগমন করেন। কাশ্মীরে দাওয়াতের মেহনতে সায়্যেদ শারফুদ্দিন আব্দুর রহমান বুলবুল শাহর পর তিনিই সবচেয়ে মহান কারনামা আঞ্জাম দেন।

১৩৮৯ ঃ ষষ্ঠ শাহমীরী শাসক, পরম ধার্মিক এবং খোদাভিরু, মহান সুলতান সিকান্দার ‘বুতশিকান’-এর শাসনকাল শুরু। একই সময়ে মরহূম পিতার দাওয়াতী মেহনতকে এগিয়ে নিতে কাশ্মীরে আগমন করেন মীর সায়্যেদ আলী হামদানীর সুযোগ্য সাহেবযাদা মীর সায়্যেদ মুহাম্মাদ হামদানী। পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁকে স্বাগত জানায় কাশ্মীরের মানুষ। তার শীষ্যত্ব গ্রহণ করেন সুলতান সিকান্দার। শায়খের আদেশে তিনি সর্বক্ষেত্রে ইসলামী শারিয়াহ্ বাস্তবায়নে সচেষ্ট হন। যাবতীয় বিদআত ও শিরকী কর্মকা- থেকে মুসলিমসমাজকে রক্ষার জন্য তিনি সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। এজন্য তিনি ‘বুতশিকান’ নামে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। সুলতান সিকান্দার বুতশিকানের শাসনামলকে কাশ্মীরে ইসলামী শাসনের স্বর্ণযুগ হিসেবে উল্লেখ করেন অনেক ঐতিহাসিক। তার যামানায়ই নির্মিত হয় শ্রীনগরের বিখ্যাত জামে মাসজিদ যা আজো কাশ্মীরী মুসলমানদের প্রাণকেন্দ্র।

১৫০২ঃইরানের ইস্ফাহান থেকে কাশ্মীরে আগমন করেন প্রখ্যাত শিয়া ধর্মীয় নতা ও শিয়ামতবাদের প্রচারক মীর শামসুদ্দিন আরাকী। তাকে বলা হয় কাশ্মীরে শিয়া মতবাদের পিতৃপুরুষ। ধীরে ধীরে উপত্যকার অনেক গভীরে শেকড় গেড়ে বসে শিয়া মতবাদ।

১৫০০ - ১৫৬০ ঃ বিভিন্ন আভ্যন্তরীণ সমস্যা ও অন্তর্কলহে জড়িয়ে পড়ে দুর্বল হয়ে পড়ে শাহমীরী বংশ। উপত্যকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ভ্রাতৃঘাতী গৃহযুদ্ধ। সুযোগসন্ধানী ও ক্ষমতালোভী ওযীরদের হাতে যিম্মি হয়ে পড়েন সুলতানেরা। মীর শামসুদ্দীনের অনুসারী, কট্টর শিয়ামতবাদী চাক গোত্রপতিরা যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। একসময় শাহমীরীদের আস্থাভাজন এই গোত্রপতিদেরকে প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্ত করা হয়েছিলো। কিন্তু এক সময় শাহমীরীদের অপসারণ করে নিজেরাই ক্ষমতা দখলের চক্রান্ত শুরু করে তারা।

১৫৬১ ঃ শেষ পর্যন্ত শাহমীরীদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে নিজেকে সুলতান হিসেবে ঘোষনা করে সালতানাতের প্রধানমন্ত্রী এক প্রভাবশালী চাক গোত্রপতি গাযী চাক। এর মাধ্যমেই কাশ্মীরে প্রায় আড়াইশ বছরের শাহমীরী শাসনের অবসান ঘটে। শুরু হয় কট্টর শিয়া মতাবলম্বী চাক বংশের শাসন। ১৫৬০ থেকে ৮৫ এই সময়টাতে চাক শাসকদের সহযোগিতায় উপত্যকাজুড়ে ব্যাপক বিস্তার লাভ করে শিয়া মতবাদ। অন্যদিকে বিভিন্ন রকম অন্যায় ও বঞ্চনার শিকার হতে থাকে সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নিরা।

১৫৬৮ ঃ প্রথমবারের মত কাশ্মীরের মাটিতে শিয়া-সুন্নি রক্তাক্ত সঙ্ঘাতের সূত্রপাত।

১৫৮৬ ঃ সম্রাট বাবরের আমল থেকেই মোগলরা কাশ্মীরদখলের চেষ্টা করে আসছিলো। বেশ কয়েকটি ব্যর্র্থ চেষ্টার পর অবশেষে মোগল স¤্রাট আকবর চাকদের হাত থেকে কাশ্মীর দখল করতে সক্ষম হন। ১৫৮৬ থেকে ১৭৭২ পর্যন্ত ১৬৬ বছর কাশ্মীর মেগল শাসনাধীন থাকে। ধর্মীয় ভ্রাতৃত্বের বন্ধন থাকা সত্ত্বেও কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া মোগলশাসন তেমন সুখকর স্মৃতি রেখে যায়নি কাশ্মীরীদের জন্য।

১৭৫২ ঃ মোগলরা তখন খুব দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে বিখ্যাত আফগান মুসলিম শাসক আহমাদ শাহ আবদালী তার তৃতীয় ভারত অভিযানকালে মোগলদের কাছ থেকে কাশ্মীর জয় করে নেন। ১৭৫২ থেকে ১৮১৯ পর্যন্ত আফগানরা কাশ্মীর শাসন করে। কিন্তু আফসোস! মোগলদের মত তারাও কাশ্মীরীদের জন্য তেমন কোন সুখস্মৃতি রেখে যায়নি।

১৮১৯ ঃ আবদালী এবং তাদের প্রতিদ্বন্দী বারিক যাঈ গোত্রের লড়াই হানাহানির সুযোগে বিখ্যাত রাজা রঞ্জিত সিং এর নেতৃত্বে শিখেরা কাশ্মীর দখল করে নেয়। কাশ্মীরে সুদীর্ঘ পাঁচশ বছরের মুসলিম শাসনের মর্মান্তিক সমাপ্তি ঘটে শিখদের হাতে। একদিন মুসলিমচরিত্রের মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে ইসলামে প্রবেশকারী অঞ্চলগুলো মুসলিমদেরই আত্মঘাতী অন্তর্কলহ ও ‘বদআখলাকি’র কারণে এভাবেই ইসলামের হাতছাড়া হতে থাকে। একের পর এক অঞ্চল পদানত করতে থাকে শিখেরা। একসময় খৃস্টপূর্ব যুগে প্রায় সমগ্রভারতবর্ষ শাসনকারী স¤্রাট অশোকের স্মৃতি ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখতে থাকে তারা। এটা সত্য যে, মোগল ও আফগানরা কাশ্মীরীদের প্রতি সুবিচার করেনি। ফলে অনেক কাশ্মীরই তাদের পরাজয়ে খুশি ছিলো। কিন্তু শিখদের জুলুমের তুলনায় ‘ভাই’দের জুলুম তাদের কাছে ‘রহম’ বলে মনে হলো। সেই থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত এক জালিম থেকে আরেক জালিমের পদপিষ্ট হয়ে চলেছে কাশ্মীরীদের সকল শান্তি ও স্বপ্ন। মুসলিমশাসনের সুদীর্ঘ পাঁচশ বছর মোটামুটি স্বাধীনতা, সচ্ছলতা ও শান্তিতে ছিলো কাশ্মীর। কিন্তু হিন্দু এবং শিখশক্তি ক্ষমতা হাতে পাওয়া মাত্র মুসলিম রক্তের ¯স্রোতে বইয়ে দেয় পুরো উপত্যকায়।

১৮২৩ ঃ মহান দাঈ ও মুজাহিদ বালাকোটের শহীদ সায়্যেদ আহমাদ বেরেলবী (রহ.) এর তাজদীদী তাহরীক ও সংস্কার আন্দোলনের শুভসূচনা। এক দিকে ইংরেজ অপরদিকে শিখদের আগ্রাসনে এবং আত্মঘাতী লড়াইয়ে হিন্দুস্তানের মুসলমানরা যখন দিশেহারা তখন তার তাহরীক উম্মাহর মাঝে নতুন আশার সঞ্চার করেছিলো। কোরআন ও সুন্নাহ্র দাওয়াত নিয়ে হিন্দুস্তানে এক মাথা থেকে আরেক মাথা ছুটে বেড়িয়েছেন তিনি। তার ইখলাছপূর্ণ মেহনতে মাত্র দু’বছরে গড়ে উঠেছিলো ‘রুহবান ও ফুরসান’ এর এক বিরাট জামাত। তারপর তিনি তার ‘জাঁনেছার’ অনুসারীদের নিয়ে হিন্দুস্তানের উত্তর সীমান্ত অঞ্চলে পেশাওয়ারকে কেন্দ্র করে আদর্শ ইসলামী হুকুমাতের একটি বীজ রোপণ করেছিলেন। সীমান্ত অঞ্চলের বাসিন্দারা বহু গোত্র ও রসম রেওয়াজে বিভক্ত ছিলো। এই কাবায়েলী মুসলমানদের তিনি ইসলামের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ করছিলেন শিখ ও ইংরেজের বিরুদ্ধে জিহাদের প্রস্তুতি হিসেবে। কিন্তু ফলদার বৃক্ষ হয়ে ওঠার আগেই সীমান্তের মুসলিম-নামধারী কতিপয় বিশ্বাসঘাতক গোত্রপতি তার পিঠে ছুরি বসিয়ে দেয়। সাইয়েদ শহীদের হাতে জিহাদের বায়আতকারী এবং তাঁকে সার্বিক সহযোগিতা ও নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতিদানকারী পেশাওয়ারের সুলতান ... খান এক রাতেই শহীদ করে দেয় সাইয়েদ আহমাদের অনুসারী বহু মুজাহিদকে। বেঁচে যাওয়া মুজাহিদীনকে নিয়ে ক্ষতবিক্ষত হৃদয় সাইয়েদ আহমাদ যখন ভাবছেন, পরবর্তী ঠিকানা কী হবে তখন সুদূর কাশ্মীর থেকে কতিপয় গোত্রপতির দাওয়াত এলো, ‘আমাদের অঞ্চলকে কেন্দ্র করে জিহাদ শুরু করুন এবং শিখজুলুম থেকে কাশ্মীরকে উদ্ধার করুন।’ তাদের দাওায়াত কবুল করে সাইয়েদ আহমাদ রওয়ানা হলেন কাশ্মীরের উদ্দেশ্যে। কিন্তু কাশ্মীরের সীমান্তে ৭০ময়দানে ভয়ঙ্কর লড়াই হলো বিশাল শিখ বাহিনীর সঙ্গে ক্ষুদ্র মুজাহিদীন কাফেলার। সাইয়েদ শহীদের এ পরিকল্পনা যদি বাস্তবায়িত হতো তাহলে হয়ত কাশ্মীরের (এবং ভারতের) ইতিহাস আজ অন্য রকম হতো। বালাকোটের প্রান্তরে শিখ বাহিনীর সাথে পরম বীরত্বের সাথে লড়তে লড়তে শাহাদাত বরণ করেন সায়্যেদ আহমাদ এবং মুজাহিদীনের মুখতাছার কাফেলা। তারপরো কাশ্মীরের আযাদী আন্দোলনে গাযিয়ানে বালাকোট তখন থেকে আজ পর্য্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। তারই উত্তরসূরীদের তারবিয়াতপ্রাপ্ত কাবায়েলী মুজাহিদীন ১৯৪৮ সালে আযাদকাশ্মীরে লড়াই করেছে। সে লড়াই এখনো কিছু না কিছু অব্যাহত রয়েছে বর্তমান আমীরের নেতৃত্বে।

১৮৩৯ ঃ শিখ মহারাজা রঞ্জিত সিং এর মৃত্যু। সেই সঙ্গে শিখদের ‘অশোকসা¤্রাজ্য’ পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বপ্নের ‘সলীল সমাধী’। শিখদের মধ্যে অন্তর্কলহ শুরু। ধূত ইংরেজ এ পরিস্থিতিকে তাদের পাঞ্জাবদখলের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণের সুবর্ণ সুযোগ হিসাবে কাজে লাগালো। শেষপর্যন্ত পাঞ্জাব তথা প্রায় সমগ্র শিখ সারাজ্য ইষ্ট ইন্ডিয়া কম্পানীর পদানত হলো। কাশ্মীরে ২৫ বছরের শিখশাসনের সমাপ্তি ঘটলো। সময়ের হিসেবে খুব দীর্ঘ না হলেও এর মধ্যেই হিং¯স্রতা আর নৃসংশতার চরম দৃষ্টান্ত কায়েম করেছিলো তারা। কিন্তু শিখদের পরাজয়ে খুশি হওয়ার কিছু ছিলো না কাশ্মীরীদের। কারণ জালিমের পরিবর্তন ঘটলেও জুলুমের কিছুমাত্র পরিবর্তন ঘটেনি।

১৮৪৬ ঃ শিখদের পর এবার বৃটিশরা হলো কাশ্মীরের ভাগ্যনিয়ন্তা। তবে এতদূর গিয়ে কাশ্মীর শাসন ঝামেলার বিষয় মনে করে ধূর্ত ইংরেজ নতুন ফন্দি বের করলো। শিখদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে স্থানীয় ডোগরা সম্প্রদায়ের এক গোত্রপতি গুলাব সিং ইংরেজদের যথেষ্ট সহযোগিতা করেছিলো। এর পুরস্কার হিসেবে গোলাব সিং-এর সঙ্গে কুখ্যাত ‘অমৃতসর চুক্তি’ সম্পন্ন করলেঅ, যেটাকে ‘কাশ্মীর বিক্রিরশিদ’ও বলা হয়। মাত্র পঁচাত্তর লাখ রুপির বিনিময়ে বৃটিশরা সমগ্র কাশ্মীর ডোগরাদের কাছে ‘বিক্রি’ করে দিলো এবং গুলাব সিংকে জম্মু-কাশ্মীরের মহারাজা হিসেবে ঘোষণা করলো। এভাবেই মুসলিমকাশ্মীরে চরম অত্যাচারী হিন্দু ডোগরারাজত্বের সূচনা হলো। এই ‘বেচাকেনা’র পর ডোগরা রাজা গুলাব সিং এর প্রথম কাজ ছিলো শিখদের নির্যাতনে পিষ্ট হওয়া ভূখা নাঙ্গা কাশ্মীরীদের কাছ থেকে সম্ভব এবং অসম্ভাব সকল উপায়ে সুদে আসলে ঐ টাকা উসূল করা। এমনকি মুসলমানদের খাৎনার উপরও কর আরোপ করা হয়। কট্টর মুসলিমবিরোধী ঐতিহাসিকরাও স্বীকার করতে বাধ্য হন যে ১৮৪৬ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত ডোগরা শাসনকালটি ছিলো মুসলমানদের জন্য চরম দুর্ভোগপূর্ণ একটি সময়।

১৮৫৭ ঃ ভারতবর্ষে ইষ্ট ইন্ডিয়া কম্পানী তথা ইংরেজের শাসন-শোষন থেকে মুক্তিলাভের জন্য  ঐতিহাসিক ‘সিপাহী বিপ্লবের’ সূচনা। প্রধানত মুসলমানদের অগ্রণী ভুমিকায় শুরু হওয়া এই আযাদী আন্দোলন হিন্দু রাজাদের বিশ্বাসঘাতকতায় আপাতদৃষ্টিতে যদিও ব্যর্র্থ হয় কিন্তু ভারতবর্ষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে এবং স্বাধীনতাআন্দোলনে তা অপরিসীম অবদান রেখে যায়। এই আন্দোলনের প্রধান শক্তি হিসেবে মুসলমানদের দায়ী করে তাদের সকল বিষয়ে চরম কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেবৃটিশরাজ। আযাদী আন্দোলনের সিপাহীদেরকে কাশ্মীরে প্রবেশ করতে শুধু বাধা দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি ডোগরা রাজা। বরং ‘বিদ্রোহী’দের হাত থেকে দিল্লীকে মুক্ত করতে বৃটিশদের সহযোগিতায় বাহিনী পর্যন্ত প্রেরণ করে ডোগরা রাজা রণবীর সিং। পুরস্কারস্বরূপ মুসলমানদের উপর তার শোষন নির্যাতনে অব্যাহতভাবে সমর্থন দিয়ে যায় বৃটিশরা।

১৮৬৫ ঃ মুসলিম কৃষক আর ব্যবসায়ীদের উপর ডোগরা রাজার চাপিয়ে দেয়া অকল্পনীয় করের বোঝা এবং রাষ্ট্রিয় লুটতরাজের ফল হিসেবে কাশ্মীর উপত্যকাজুড়ে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ শুরু। গরীব মুসলিমরাই দুর্ভিক্ষের প্রধান শিকার। ঐতিহাসিকদের মতে দুর্ভিক্ষের প্রভাবে মাত্র দু’বছরের ব্যবধানে উপত্যকায় মুসলিম জনসংখ্যা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছিলো। এ সময়ে কাশ্মীর ভ্রমনকারী বৃটিশ লেখক ওয়াল্টার লোরেন্স লিখেছেন “কাশ্মীরে চলমান দুর্ভিক্ষে একজন হিন্দু প-ণ্ডিতও মারা যায় নি। দুর্ভিক্ষের সময় ডোগরা রাজের নিযুক্ত গভর্ণর প-ণ্ডিত পান্নুর বক্তব্য ছিলো, আমি চাই, শ্রীনগরে একজন মুসলিমও যেন বেঁচে না থাকে”।

১৮৮৫ ঃ ই-ন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের আত্মপ্রকাশ। শুরুতে ভারতবর্ষের সকল মানুষের অধিকার আদায়ে কাজ করার কথা বললেও আসলে এটা ছিলো শুধু হিন্দু এলিটদের একটি ক্লাব।বৃটিশরাজের সাথে আঁতাত করে মুসলমানদেরকে গোলাম বানিয়ে রেখে হিন্দুরাষ্ট্র কায়েম করাই ছিলো তাদের প্রধান লক্ষ্য।  বৃটিশ রাজের সাথে তাদের ছিলো খুবই সদ্ভাব। বৃটিশ গভর্ণরের অনুমোদন নিয়েই ‘জন্মলাভ’ করেছিলো কংগ্রেস। এমনকি এর প্রথম জেনারেল সেক্রেটারিও হয়েছিলেন এলান ওক্টাভিয়ান নামে এক বৃটিশরাজ কর্মকর্তা। পরবর্তীতে করমচাঁদ গান্ধি, নেহরু এবং অন্যান্যদের নেতৃত্বে ভালো মানুষের মুখোশ ধারণের কিছু ব্যর্র্থ চেষ্টা চালায় কংগ্রেস। কিন্তু পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ বারবারই তাদের চরমভাবে ‘নগ্ন’ করে দিয়েছে। বিশেষ করে কাশ্মীরে তাদের গাদ্দারী বলা যায় বালুতে মাথা গুজে রাখা মুসলিম নেতাদেরও হুঁশে আসতে বাধ্য করেছে।

১৮৯০ ঃ তৃতীয় ডোগরা রাজা প্রতাপ সিং এর আমলে বিখ্যাত বৃটিশ লেখক এডওয়ার্ড নাইট কাশ্মীর ভ্রমন করেন। তার বিখ্যাত  “হোয়্যার থ্রী এম্পায়ারস মিট” গ্রন্থে তিনি কাশ্মীরী মুসলমানদের দুরবস্থার কথা সবিস্তারে তুলে ধরেন। তিনি লিখেছেন, “সামান্য সামান্য অজুহাতে ডোগরা পুলিশ মুসলমানাদের ঘরবাড়ী এমনকি পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে ছারখার করে ফেলে”।

১৯০৬ ঃ ঢাকার নবার সলিমুল্লাহর উদ্যোগে ই-ন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের মোকাবেলায় অল ই-ন্ডিয়া মুসলিম লীগের আত্মপ্রকাশ। ভারতবর্ষের মুসলমানদের এক পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্য নিয়ে যাত্রা শুরু করে মুসলিম লীগ।

১৯১৬ ঃ লখনৌতে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের ঐতিহাসিক যৌধ অধিবেশন। এটা ছিলো হিন্দু-মুসলিম সম্প্রিতি অর্জনের পথে একটি বড় পদক্ষেপ এবং বৃটিশদের ডিভাইড এ- রুল নীতির উপর বড় আঘাত। অধিবেশনে এক্যবদ্ধভাবে বৃটিশদের কাছ থেকে ভারতীয়দের স্বরাজ বা সায়ত্বশাসনের অধিকার আদায়ে কাজ করার বিষয়ে এক্যমত। রাষ্ট্র পরিচালনায় মুসলমানদেরকে এক তৃতীয়াংশ অংশিদারিত্ব প্রদানে কংগ্রেসের সায়। তখনো পর্যন্ত দুই রাষ্ট্রের চিন্তা বলা যাই কারোই ছিলো না।

১৯১৯ ঃ ইন্ডিয়ান গভর্ণমেন্ট এক্ট ১৯১৯ ঘোষণা। ৫৭ এর সিপাহী বিপ্নব যদিও কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয় কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বৃটিশরাজ এক সময় এ সিদ্ধান্তে উপনিতে হতে বাধ্য হয় যে, আগের মত কঠোর হাতে আর ভারতবাসীকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছাড় দিয়ে শাসন ব্যবস্থায় কিছু পরিবর্তন এনে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে তারা। ই-িয়ান গভর্ণমেন্ট এক্ট ১৯১৯ এর আওতায় প্রথমবারের মত নির্বচনের মাধ্যমেরাষ্ট্র পরিচালনায় ভারতীয়দের সীমিত অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেয়া হয়। কিন্তু আরো বৃহৎ অংশিদারিত্বের দাবীতে সোচ্চার হন ভারতীয় নেতৃবৃন্দ। বৃটিশ-কংগ্রেসের বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং আচরণ থেকে মুসলিম নেতৃবৃন্দের সামনে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, মুসলিম জনগোষ্ঠীকে অংশিদার করার কোন ইচ্ছাই তাদের নেই। প্রথমবারের মত পাঞ্জাব, কাশ্মীর, বেলুচিস্তান এবং আরো অন্যান্য মুুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলোতে মুসলমানদেরকে প্রাদেশিক সরকার পরিচালনা এবং আত্ময়িন্ত্রন অধিকার প্রদানের দাবী আলোচিত হতে থাকে শীর্ষস্থানীয় মুসলিম নেতৃবৃন্দ ও চিন্তাবিদদের মাঝে।

১৯২২ ঃ কাশ্মীরী নওজোয়ান (পরবর্তীতে আযাদী আন্দোলনের শীর্ষ নেতা) চৌধুরী গোলাম আব্বাসের উদ্যোগে সামাজিক আন্দোলন ‘কাশ্মীরী মুসলিম যুবসংস্থা’র যাত্রা শুরু। যাদের প্রধান লক্ষ ছিলো প্রতিটি বস্তিতে মসজিদে মসজিদে জমায়েত করে কাশ্মীরী মুসলমানদের অধিকারসচেতন, সাহসী ও ঐক্যবদ্ধ করে তোলা। নিষ্ঠা ও আন্তরিকতা, দৃঢ়তা ও অবিচলতা এবং ত্যাগ ও পরোপকারিতা, এসব কারণে অল্প সময়েই চৌধুরি গোলাম আব্বাস ও তার সহযোদ্ধারা বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এই সংস্থার কর্মীরাই পরবর্তীকালে বিভিন্ন আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন।

১৯২৪ ঃ আমানবিক পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য করা, অমানুষিক নির্যাতন এবং নাম মাত্র মজুরীর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসে  ডোগরা রাজার মালিকানাধীন রেশম কারখানার মুসলিম শ্রমিকরা। কিন্তু চরম নিষ্ঠুরতার সঙ্গে তাদের দমন করা হয়। শ্রমিক আসন্তোষ আপাতত দমন হলেও উপত্যকাজুড়ে মানুষের মনে ক্ষোভের আগুন ধিকি ধিকি জ¦লতে থাকে। অপেক্ষা শুধু উপযুক্ত সময়ের।

১৯২৫ ঃ শেষ ডোগরা রাজা হারি সিং এর শাসন শুরু। চলমান মুসলিমনির্যাতনে যোগ হয় নতুন মাত্রা। আরো নতুন নতুন করের বোঝা চেপে বসে মুসলমানদের উপর। এমনকি বিবাহ শাদীর উপরও কর আরোপ করা হয়। দীর্ঘকাল নিরবে সয়ে আসার পর ধীরে ধীরে মুসলিম সমাজে প্রতিবাদী কিছু কণ্ঠ সরব হতে থাকে। একই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে রাজা হারি সিং এর দমন নিপীড়ণ।

১৯২৮ ঃ ভারতবর্ষের স্বায়ত্বশাসনের রূপরেখা তৈরির জন্য কোন ভারতীয় প্রতিনিধিত্ব ছাড়াই  কমিশন গঠন করে বৃটিশরাজ কিন্তু ভারতীয় নেতৃবৃন্দ তা প্রত্যাখ্যান করেন। ভারতীয়দের দাবী মেনে নিয়ে তাদেরকেই একটি রুপরেখা তৈরির সুযোগ দেয় বৃটিশরাজ। তবে তারা নিশ্চিতভাইে জানতো এপ্রশ্নে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য কখনোই সম্ভব হবে না। এ উদ্দেশ্যে মতিলাল নেহরুর নেতৃত্বে কমিটি গঠন করা হয়। কয়েকমাস পর মুসলিম প্রতিনিধির বিরোধিতা সত্ত্বেও চূড়ান্ত রিপোর্ট দাখিল করে কমিটি যা ইতিহাসে নেহরু রিপোর্ট নামে পরিচিত। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলোতে মুসলমানদের অধিকারসহ প্রায় সমস্ত দাবীই রিপোর্টে উপেক্ষা করা হয়, যা ইতিপূর্বে লখনৌ সম্মেলনে ঐক্যমতের ভিত্তিতে গৃহীত হয়েছিলো। বলা যায় এটাই ছিলো মুসলামানদের প্রতি হিন্দুদের ‘শেষ কথা’। নেহরু রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করে কেন্দ্রীয় সরকারে মুসলমানদের এক তৃতীয়াংশ অংশিদারিত্ব, মুসলিম প্রদেশগুলো মুসলমানদের পূর্ণ ক্ষমতাসহ সকল দাবী একত্র করে জিন্নাহ তার বিখ্যাত চৌদ্দ দফা তুলে ধরেন।

১৯২৯ ঃ প্রজাদের সম্পদ লুণ্ঠন ও হরি সিং এর বিলাসী জীবন যাপন এবং মুসলমানদের উপর অব্যাহত জুলুম নির্যাতনের প্রতিবাদে  নৈতিক কারণ প্রদর্শন করে তার প্রধানমন্ত্রী এলবন ব্যানার্জি পদত্যাগ করে বসেন। এটা ছিলো এক অভূতপূর্ব ঘটনা। তার বক্তব্য ছিলো এই, ‘কাশ্মীরের মুসলমানদের অবস্থা খুবই শোচনীয়। পশুর চেয়েও অধম আচরণ করা হয় তাদের সাথে। শিক্ষার সকল সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত। সকল ক্ষেত্রে তাদের চরমভাবে পিছিয়ে রাখা হয়েছে। তাদের প্রতি সরকারের সামান্যতম সহানুভূতি নেই”।

১৯৩০ ঃ এলাহাবাদে মুসলিম লীগের সম্মেলনে ইসলামি জাগরণের কবি, পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা, কাশ্মীরের ‘সন্তান’ আল্লামা ইকবাল তার ঐতিহাসিক বক্তব্যে সুস্পষ্টভাবে ভারতীয় মুসলমানদের করণীয় এবং ভবিষ্যতের রূপরেখা তুলে ধরেন। এর আগ পর্যন্ত মুসলমানদের সকল দাবি এবং আলোচনাই সাধারণভাবে তাদের ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য অধিকারকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতো। এলাহাবাদ ভাষণে আল্লামা ইকবালের যবানেই সর্বপ্রথম স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের ধারণা উচ্চারিত হয়। পরবর্তীতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের আবির্ভাবে মাধ্যমে তার সেই স্বপ্ন পূর্ণতা লাভ করে।

১৩ জুলাই ১৯৩১ ঃ শাসকদের জুলুম নির্যাতনের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী সমাবেশে রাজা হরি সিং এর নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে বক্তব্য দেয়ায় আবদুল কাদির নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করায় ডোগরা প্রশাসন। বিচার চলাকালে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের উদ্দেশ্যে জেলখানার সামনে অবস্থান নেয় হাজার হাজার মানুষ। জোহরের সময় এক নওজোয়ান আযান শুরু করেন। কিন্তু ‘আল্লাহু আকবার’ বলামাত্র  ডোগরা পুলিশ তাকে গুলি করে, আর তিনি শহীদ হন। এভাবে একে একে বাইশ জন জোয়ান শাহাদাত বরণ করেন এবং বাইশটি বুকের তাজা রক্তে পূর্ণ হয় ঐ শহীদী আযান। কাশ্মীরের আযাদী আন্দোলনের এক নতুন যুগেন সূচনা করে এই মর্মান্তিক ঘটনা।

১৪ আগস্ট ১৯৩১ ঃ আল্লামা ইকবালের নেতৃত্বে গঠিত হয় অল ইন্ডিয়া কাশ্মীর কমিটি। বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে ডোগরারাজার জুলুমের বিষয়ে ভারতের মুসলমানদের সচেতন করে তুলতে সচেষ্ট হন আল্লামা ইকবাল। তার দৃঢ় উদ্যোগে ১৩ জুলাইকে কাশ্মীর শহীদ দিবস ঘোষণা করা হয়। আজো প্রতি বছর এই দিনটিকে শহীদ দিবস হিসেবে স্মরণ করে নতুনভাবে জিহাদের শপথ গ্রহণ করে কাশ্মীরের মুসলমানেরা। ডোগরা রাজার জেলে বন্দি মাজলূম মুসলমানদের সহায়তা করার জন্য আইনজীবিদের একটি দল প্রেরণ করেন আল্লামা ইকবাল। কিন্তু তাদের কাশ্মীরে প্রবেশ করতে দেয়নি ডোগরা রাজা। শুধু তাই নয়, আল্লামা ইকবালেরও কাশ্মীরে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়।

১৫ আগস্ট ১৯৩১ঃ অভিযুক্ত গভর্ণরের অপসারন এবং ঘটনার বিচারের দাবি নিয়ে ডোগরা রাজার সাথে সাক্ষাৎ করেন কয়েকজন মুসলিম প্রতিনিধি। কিন্তু তাদের সব দাবী প্রত্যাখ্যান করে এমনকি এত বড় হত্যাকা-েরও উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই দাবি করে এর বিচার করতেও তিনি অস্বীকার করেন। ফলে আরো তীব্রতা লাভ করে কাশ্মীরী জনতার প্রতিবাদ। যুবকদের নেতৃত্বে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে পুরো উপত্যকা। একই সাথে বাড়তে থাকে নিপীড়নের তীব্রতাও।

১৯৩২ খৃস্টাব্দ ঃ শেখ আবদুল্লাহকে প্রেসিডেন্ট করে এবং মুসলিম যুব সংস্থার চৌধুরি গোলাম আব্বাসকে জেনারেল সেক্রেটারি করে কাশ্মীরী মুসলমানদের প্রথম উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক সংগঠন অল জম্মু এন্ড কাশ্মীর মুসলিম কনফারেন্সের আত্মপ্রকাশ। ডোগরাশাসন থেকে মুক্তির আশায় মুসলিম কনফারেন্সের এক পতাকাতলে একত্র হতে থাকে কাশ্মীরী মুসলমানেরা। কিন্তু আফসোস, এমন কঠিন মুহূর্তেও অল্প সময়ের মধ্যেই শেখ আব্দুল্লাহ্ চরম বিরোধ শুরু করেন চৌধুরী গোলাম আব্বাসের সঙ্গে।

১৯৩৫ ঃ অনেক বাদানুবাদের পর অবশেষে গভর্ণমেন্ট অব ইন্ডিয়া এক্ট ১৯৩৫ এর আওতায় ভারতে সর্বদলের অংশগ্রহনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু নির্বাচন চলাকালে এবং পরবর্তীতে ‘মুসলমানপ্রজা’দের সাথে কংগ্রেসের আচরণ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, হিন্দুসংখ্যাগরিষ্ঠ শাসনে মুসলমানদের কী ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে।

১৯৩৭ ঃ মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ মুসলিম লীগের নেতা হিসেবে প্রথমবারের মত কাশ্মীর সফর করেন। ভারতবর্ষের মুসলমানদের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে তিনি তখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে। কাশ্মীরের জনগণ এবং মুসলিম কনফারেন্স নেতৃবৃন্দ তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানান। কিন্তু আফসোস! কাশ্মীরে মুসলিম লীগের মজবুত অবস্থান গড়ে তুলতে ব্যর্র্থ হন জিন্নাহ। তবে পরবর্তীকালে তিনি শেখ আবদুল্লাহকে বোঝাতে চেষ্টা করেছেন কিন্তু নেহরুর ‘পা-ণ্ডিত্য’ ততদিনে তার উপর পুরোপুরি আছর করে বসেছে।

১৯৩৮ ঃ লাহোরে জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে শেখ আবদুল্লাহর প্রথম সাক্ষাৎ এবং ঘনিষ্টতার শুরু। প্রথম সাক্ষাতেই নেহরুর চিন্তাধারায় প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়েন তিনি। এক পর্যায়ে মুসলিম লীগের স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের দাবীর সঙ্গেও দ্বিমত পোষণ করা শুরু করেন শেখ আবদুল্লাহ। দীর্ঘদিন হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের আন্দোল করে শেষ পর্যন্ত হিন্দুদের আসল চেহারা চিনতে পেরে মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ এবং অন্যরা যখন মুসলমানদের আলাদা রাষ্ট্রের আন্দোলন শুরু করছেন ঠিক তখন শেখ আবদুল্লাহ তা থেকে শিক্ষা গ্রহণ না করে কাশ্মীরে হিন্দু-মুসলিম-শিখ ঐক্যের দিবাস্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। এক সময় অবশ্য তারও মোহভঙ্গ ঘটে, কিন্তু ঝিলাম নদিতে ততদিনে গড়িয়ে গেছে অনেক পানি!

১৩৩৯ ঃ নেহরুর প্ররোচনায়ধর্মনিরেপক্ষতার মোহে পড়ে এক ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেন শেখ আবদুল্লাহ। মুসলিম কনফারেন্সের এক জরুরী সম্মেলন ডেকে চৌধুরী গোলাম আব্বাসসহ আরো অনেকের প্রবল বিরোধীতা উপেক্ষা করে কনফারেন্সকে “মুসলিম” মুক্ত করার আত্মঘাতী ঘোষণা দেন শেখ আবদুল্লাহ। এর প্রতিবাদে কনফারেন্স থেকে আলাদা হয়ে যেতে বাধ্য হন চৌধুরী গোলাম আব্বাস এবং আরো কয়েকজন। মুসলিম নাম এবং পরিচয় অক্ষুন্ন রেখে চূড়ান্ত সর্বনাশ রোধের চেষ্টা করে যান তিনি এবং তার সহযোদ্ধারা। কিন্তু শেখ আবদুল্লাহকেই কাশ্মীরের মুখপাত্র হিসেবে তুলে ধরতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে হিন্দুশক্তি।

১৯৪০ ঃ লাহোরে মুসলিম লীগের সম্মেলনে ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব গৃহীত। এটি ছিলো আল্লামা ইকবালের সেই ঐতিহাসিক এলাহাবাদ ভাষণেরই চূড়ান্ত রূপ। লাহোরপ্রস্তাবের মাধ্যমে পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাই মুসলিম লীগ তথা মুসলমানদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারিত হয়।

১৯৪৪ ঃ শেষবারের মত কাশ্মীর সফর করেন জিন্নাহ। অভূতপূর্ব আবেগ ও ভালোবাসায় তাকে ইস্তিকবাল করে কাশ্মীরী মুসলিম জনতা ও নেতৃবৃন্দ। প্রায় দীর্ঘ একমাস কাশ্মীরে অবস্থান করেন জিন্নাহ। তার অবস্থানকালেই অনুষ্ঠিত হয় চৌধুরী গোলাম আব্বাসের নেতৃত্বাধীন মুসলিম কনফারেন্সে বার্ষিক সম্মেলন। সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে কাশ্মীরী মুসলমানদেরকে জুলুম নির্যাতনের মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান তিনি। একই সঙ্গে মুসলিম কনফারেন্সের প্রতি তার সমর্থনের কথা ঘোষণা করেন। কাশ্মীর থেকে ফিরে আসার পূর্বে শেখ আবদুল্লাহর উদ্দেশ্যে জিন্নাহর দরদমাখা সেই কথাগুলো আজ ইতিহাসের সাক্ষী অংশ। তিনি বলেছিলেন, ‘জাতিয়তাবাদের শ্লোগান আপনার জন্য কোন ফলই বয়ে আনবে না। এ সত্য আপনার তখন বুঝে আসবে যখন আপনি ঐ পরিস্থিতির সম্মুখীন হবেন, আমি আজ যার সম্মুখীন। সারা জীবন আমি হিন্দুদের মাঝেই কাটিয়েছি। অমিও স্বপ্ন দেখেছি ঐক্যবদ্ধ হিন্দুস্তানের যেখানে সবধর্মের মানুষ সমতার ভিত্তিতে বসবাস করবে। কিন্তু বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে আমি আমার অবস্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছি। আপনিও একদিন উপলব্ধি করবেন কিন্তু তখন হয়ত সময় থাকবে না”।

১৯৪৬ ঃ পাকিস্তান আন্দোলনের বিরুদ্ধে কংগ্রেস তথা ভারতপন্থি অবস্থানের কারণে ন্যাশনাল কনফারেন্সের জনপ্রিয়তায় ধস। তখন (সম্ভবত জনপ্রিয়তা ধরে রাখাল কৌশল হিসাবে) ডোগরা রাজার বিরুদ্ধে ‘কাশ্মীর ছাড়ো’ আন্দোলন শুরু করেন শেখ আবদুল্লাহ। শেখ আবদুল্লাহকে গ্রেফতার করে ডোগরা পুলিশ। অন্যদিকে ডোগরা রাজার বিরুদ্ধে বিভিন্ন আন্দোলন এবং মুসলিম লীগ তথা পাকিস্তানপন্থী অবস্থানের কারণে চৌধুরী গেলাম আব্বাসও কারাবরণ করেন।

মার্চ ১৯৪৭ ঃ বৃটিশ-কংগ্রেসের ছত্রচ্ছায়ায় দেশব্যাপী হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, তথা হিন্দুদের হাতে পরিকল্পিত মুসলিম গণহত্যা। এরই মধ্যে বৃটিশরাজের বিশেষ মিশন নিয়ে ভারতে আসেন ভারতবর্ষের শেষ ভাইসরয়  লর্ড মাউন্টব্যটেন।

মে ১৯৪৭ ঃ পাঞ্জাবের কংগ্রেস নেতা মেহের চাঁদ মহাজনকে কাশ্মীরের ‘চিফ মিনিস্টার’ হিসেবে নিয়োগ করেন হরি সিং। কাশ্মীরকে ভারতের হাতে তুলে দিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন এই মহাজন।

জুন, ১৯৪৭ ঃ বৃটিশ ভারতকে ভারত এবং পাকিস্তান দুই রাষ্ট্রে বিভক্ত করার পরিকল্পনা পেশ করেন মাউন্টব্যাটেন। বৃটিশ ভারতের শাসনব্যবস্থা তখন দুই ভাগে বিভক্ত ছিলো। একটি হলো প্রাদেশিক ব্যবস্থা, আরেকটি হলো ‘প্রিন্সলি স্টেটস’ ব্যবস্থা। প্রদেশ ছিলো মোট এগারোটি আর প্রিন্সলি স্টেট ছিলো মোট ৫৬৫ টি। প্রদেশসমূহ ছিলো সরাসরি ভাইসরয়ের অধীন আর প্রিন্সলি স্টেটসমূহ শাসিত হতো বৃটিশরাজের অনুকম্পাপ্রাপ্ত বিভিন্ন রাজা, মহারাজা, নওয়াব এবং সুলতানদের দ্বারা। বৃটিশদের বশ্যতা স্বীকার করার ভিত্তিতে যাদেরকে শাসন চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছিলো। মাউন্টব্যাটেনের বিভক্তিপরিকল্পনা অনুযায়ী প্রদেশগুলোকে মুসলিম অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ভারত পাকিস্তান দুই ভাগে ভাগ করা হয় । আর দখলদার বৃটিশদের বিদায়ের মাধ্যমে প্রিন্সলি স্টেটগুলো সম্পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে। যাদের মধ্যে যেমন ছিলো সামান্য কয়েক বর্গমাইল আয়তনের এবং কয়েক হাজার জনসংখ্যার ক্ষুদ্র রাষ্ট্র, তেমনই ছিলো লক্ষাধিক বর্গমাইল এবং বহুলক্ষ্য জনসংখ্যার হায়দারাবাদ, কাশ্মীর, মহিসূর ও অন্যান্য।  এটা ছিলো সম্পূর্ণই তাদের এখতিয়ার, ইচ্ছে হলে তারা ভারত বা পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হতে পারে আবার কারো সাথেই যুক্ত না হয়ে স্বাধীন থাকতে পারে। তবে শাসকগণ তাদের ভৌগোলিক অবস্থান এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ইচ্ছা অবশ্যই বিবেচনা করবেন। শাসক এবং জনতার মাঝে কোন সমস্যা সৃষ্টি হলে ফায়সালা হবে গণভোটের মাধ্যমে। তবে এগুলো ছিলো শুধুই মুখের কথা। বাস্তবতা ছিলো এই যে, বিভক্তি পরিকল্পনা প্রনয়ণের সময় থেকেই পিন্সলি স্টেটগুলোকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য চরম হুমকি ধমকি দিতে থাকে কংগ্রেস। নেহরু-গান্ধীদের বক্তব্য ছিলো, ভারতভুক্ত না হওয়ার মানে ধরে নেয়া হবে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা। কংগ্রেসের দুই শীর্র্ষনেতা সর্দার প্যাটেল এবং ভিপি মেননকে দায়িত্ব দেয়া হয় সকল প্রিন্সলি স্টেটকে যে কোন মূল্যে ভারতীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত করার। কাউকে ‘আ-া’ দিয়ে, কাউকে ‘ডা-ণ্ডা’ দিয়ে একের পর এক স্বাধীন রাজ্যগুলো দখল করে নিতে থাকে ভারত। বলা যায় এটা ছিলো মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দখলদারি আগ্রাসন, যা সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের দেশ ভারতের অমর কীর্তি! পক্ষান্তরে জিন্নাহ বারবার জোর দিয়ে বলে এসেছেন, রাজ্যগুলো নিজের ইচ্ছায় সিদ্ধান্ত নেবে, কোন চাপ বা শক্তি প্রয়োগ করা ঠিক হবে না।

জুলাই , ১৯৪৭ ঃ রাজা হরি সিং এর প্রথম পছন্দ ছিলো, স্বাধীনতা। কারো সঙ্গে যদি যোগ দিতে হয়, সেটা কখনোই পাকিস্তান নয়। জিন্নাহ ঘোষণা করেন, কাশ্মীর যদি স্বাধীন থাকতে চায় তাতে পাকিস্তানের আপত্তি নেই। কিন্তু কারো সঙ্গে যোগ দিতে হলে জনগণের ইচ্ছাকেই বিবেচনা করতে হবে।

অন্যদিকে পাকিস্তানে যোগ দেয়ার দাবি জানিয়ে কাশ্মীরজুড়ে একের পর এক মিছিল, বিক্ষোভ, সমাবেশ হতে থাকে। কিন্তু কংগ্রেসের প্রিয়পাত্র শেখ আবদুল্লাহ এবং তার ন্যাশনাল কনফারেন্স তখন ব্যস্ত কাশ্মীরের মুসলমানদের দাবি উপেক্ষা করে কাশ্মীরকে ভারতের হাতে তুলে দেয়ার ছক কষতে। হরি সিং এর দ্বিধান্বিত মনোভাব আঁচ করতে পেরে কংগ্রেসভক্ত শেখ আবদুল্লাহকে কেন্দ্র করেই কাশ্মীর দখলের পাঁয়তারা করতে থাকে কংগ্রেস।

আগস্ট, ১৯৪৭ ঃ ভারত এবং পাকিস্তান উভয়ের সঙ্গে ‘স্টা-স্টিল’ চুক্তির দাবি জানান হরি সিং। এর অর্থ ছিলো কাশ্মীরকে কোন এক পক্ষে যোগ দেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করা যাবে না, বরং বিদ্যমান অবস্থানে বাকি থাকার সুযোগ দেয়া হবে। জিন্নাহ তাৎক্ষণিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। কিন্তু নেহরু চুক্তির বিভিন্ন দিক নিয়ে আরো আলোচনার কথা বলে সময় ক্ষেপণ করতে থাকেন। একই সাথ তিনি শেখ আবদুল্লাহকে মুক্তি দেয়ার দাবি জানান। কারণ নেহরু জানতেন কাশ্মীরের মুসলমানদের বসে রাখতে হলে আবদুল্লাহরই প্রয়োজন।

আগস্ট , ১৯৪৭ ঃ প্রথমবারের মত পাঁচদিনের সফরে কাশ্মীরে আসেন গান্ধী। রাজার সঙ্গে সাক্ষা করে তিনি বলেন ১৫ই আগস্ট বৃটিশদের বিদায়ের মাধ্যমে অমৃতসর চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে এবং কাশ্মীর স্বাধীনতা লাভ করবে। কিন্তু কাশ্মীরকে অবশ্যই দুই দেশের কোন একটিকে বেছে নিতে হবে।’ একই সঙ্গে কাশ্মীরের ‘গণ মানুষের নেতা’ শেখ আবদুল্লাহকে ছেড়ে দেয়ার জন্যও চাপ প্রয়োগ করেন তিনি । দিল্লিতে ফিরে তিনি বলেন, ‘কাশ্মীরের জনগণের ইচ্ছার ভিত্তিতেই ফায়সালা হবে কাশ্মীরের ভবিষ্যত।’ তবে শেষে এই লেজটা জুড়ে দেন যে, মুক্ত গণভোট হলে শেখ আবদুল্লাহর নেতৃত্বে কাশ্মীরের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ভারতীয় ইউনিয়নের

পক্ষেই রায় দেবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত সেই গণভোট আর অনুষ্ঠিত হয়নি।

রোজ শুক্রবার, লাইলাতুল কদ্র ২৭ রামাদান ১৩৬৬ হিজরী - ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ ঃ ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের অত্মপ্রকাশ।

১৫ আগস্ট ১৯৪৭ ঃ ভারতের স্বাধীনতা লাভ। কিন্তু ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যান ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন। তার ইচ্ছা ছিলো ভারত পাকিস্তান উভয় দেশেরই প্রথম গভর্নর জেনারেল হিবেন তিনি। কিন্তু জিন্নাহর আপত্তিতে তার সে স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে যায়।

আগস্ট , ১৯৪৭ ঃ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমত এবং ভৌগোলিক অবস্থানসহ সবদিক থেকে এটাই স্বাভাবিক ছিলো যে, কাশ্মীর পাকিস্তানের  সাথে যুক্ত হবে। কিন্তু ডোগরা রাজের ভিন্ন মনোভাব বুঝতে পেরে ফুঁসে উঠতে থাকে কাশ্মীরী জনতা। এক পর্যায়ে কাশ্মীরের সীমান্তবর্তী পুঞ্চ এলাকার মানুষ পাকিস্তানে যোগ দিতে বিদ্রোহ করে বসে ডোগরা রাজার বিরুদ্ধে। ডোগরা রাজাকে কর দিতে অস্বীকৃতি জানায় তারা। একই সাথে ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করা হয় পুঞ্চসহ কাশ্মীরের বিভিন্ন এলাকায়। পুঞ্চের নিরস্ত্র মুসলমানদের উপর নির্মম গণহত্যা চালায় ডোগরা বাহিনী। মিরপুর, মোজাফ্ফারবাদ সহ বহু এলাকায় পরিকল্পিতভাবে মুসলিমনিধনযজ্ঞ শুরু করে ডোগরাবাহিনী। তাদের সাথে পাশর্^বর্তী পাঞ্জাব থেকে এসে যোগ দেয় কুখ্যাত হিন্দু রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবকসংঘ বা আর এস এস বাহিনী। আগস্ট থেকে নভেম্বর, এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে জম্মু এলাকার মুসলিম জনসংখ্যার অনুপাতই পাল্টে দেয়া হয়। দেড় থেকে দুই লাখ মুসলমানকে হত্যা করে হিন্দু শিখ বাহিনী। এমনকি গান্ধী পর্যন্ত বলতে বাধ্য হন যে, জম্মুর হিন্দু শিখ ও বহিরাগতরা বিপুল সংখ্যক মুসলিমকে হত্যা করেছে। অসংখ্য মুসলিম নারী তাদের হাতে লাঞ্চিত হয়েছে। মহারাজাকেই এর দায় নিতে হবে।” আড়াল থেকে মহারাজার মদদদাতা যারা তাদের কথা অবশ্য তিনি বেমালুম ভুলে যান, নিপীড়িতদের পক্ষে তার ‘বিখ্যাত অনশনব্রতের কথাও মনে পড়েনি।

অক্টোবর ১৯৪৭ ঃ কাশ্মীরের মুসলমানদের উপর ডোগরারাজের হত্যাযজ্ঞের খবরে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে পাকিস্তানের মুসলিম জনতা। সীমান্ত অঞ্চলের বিভিন্ন সর্দার ও গোত্রপতির নেতৃত্বে হাজার হাজার কাবায়েলী মুজাহিদ ছুটে যান কাশ্মীরী মুসলামানদের সাহায্যে। গঠিত হয় আযাদ কাশ্মীর বাহিনী। ফলে পিছু হটতে বাধ্য হয় ডোগরা বাহিনী। নতুন নতুন এলাকা ডোগরামুক্ত করে এগিয়ে যেতে থাকে আযাদ কাশ্মীর বাহিনী ।

২৬ অক্টোবর ১৯৪৭ ঃ মুজাহিদ বাহিনীর হাতে পরাজয় আসন্ন বুঝতে পেরে কংগ্রেসের কাছে দ্রুত সাহায্যের আবেদন পাঠান হরি সিং।  শেখ আবদুল্লাহও তাতে সায় দেন। ভারত সাহায্য পাঠাতে রাজি, তবে শর্ত হলো, আগে অবশ্যই কাশ্মীরের ভারতভুক্তির চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমের দাবি উপেক্ষা করে হরি সিং তাই করেন। তবে অন্যান্য প্রদেশের মধ্যে কাশ্মীরকে বিশেষ কিছু সুবিধা প্রদানের দাবি জানান। ভারত তা মেনে নেয়। কিন্তু পাকিস্তানের সাথে স্টা-স্টিল চুক্তির পর এবং জনগণের স্পষ্ট বিরোধীতার পর ভারতে অন্তর্ভুক্তির চুক্তি সম্পূর্ণ অবৈধ বলে জানিয়ে দেয় পাকিস্তান।

২৭ অক্টোবর ১৯৪৭ ঃ হরি সিং এর আবেদন পৌঁছামাত্র ভারতীয় বাহিনী কাশ্মীরে হস্তক্ষেপ শুরু করে। আগ্রাসনের খবর পেয়ে সদ্যপ্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানী ফৌজকে কাশ্মীরী মুজাহিদীনের সাহায্যে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেন জিন্নাহ। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! সর্বাধিনায়কের নির্দেশ মানতে অস্বীকৃতি জানায় পাকিস্তানী আর্মিপ্রধান ডগলাস গ্রেসি! হ্যা ডগলাস! এই বৃটিশ অফিসারই ছিলো পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর প্রধান। সেনাপ্রধানসহ বাহিনীর নীতিনির্ধারণী সমস্ত পদেই তখন নিযুক্ত ছিলো বৃটিশ অফিসার। মুসলমানদের পাকিস্তানদাবি মেনে নিতে বাধ্য হলেও শিশুরাষ্ট্রটিকে প্রতিবন্ধী করে রাখার সকল আয়োজন এভাবেই সম্পন্ন করে রেখেছিলো ধূর্ত বৃটিশ ও কংগ্রেশ। বলা যায়, শত্রুকে বাহিনীর নেতৃত্বে রেখে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে পাকিস্তানকে। বৃটিশদের বাধায় রাষ্ট্রিয় বাহিনীকে স্বাধীনভাবে ব্যবহার করতে ব্যর্র্থ হলেও বিভিন্নভাবে অস্ত্র ও জনবল সরবরাহ করে কাশ্মীরী ও কাবায়েলী মুজাহিদীনকে ‘যথাসাধ্য’ সাহায্য করে যায় পাকিস্তান। লোকবল এবং অস্ত্রবলের চরম সঙ্কট সত্ত্বেও সুসজ্জিত ভারতীয় বাহিনীর মোকাবেলায় অসীম বীরত্বের পরিচয় দেয় মুজাহিদীন। প্রায় বছরব্যাপী অসম লড়াইয়ে বিশাল এক ভূখ- হরি সিং এবং আগ্রাসী ভারতের হাত থেকে রক্ষা করতে সমর্থ হয় তারা, যার নাম এখন আযাদ কাশ্মীর।

৩০ আক্টোবর ১৯৪৭ ঃ কংগ্রেসের চাপে শেখ আবদুল্লাহকে প্রধান করে একটি জরুরী সরকার গঠন করতে বাধ্য হন হরি সিং। এই সেদিন যার বিরুদ্ধে লড়েছেন ‘কাশ্মীর ছাড়ো’ শ্লোগানে, সম্ভবত ক্ষমতার লোভেই আজ তারই সঙ্গে হাত মেলান আবদুল্লাহ। ন্যাশনাল কনফারেন্সের কর্মীদের নিয়ে তিনি একটি মিলিশিয়া বাহিনী গড়ে তোলেন যারা আযাদ কাশ্মীর বাহিনীর বিরুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীকে সব ধরণের সহযোগিতা দিয়ে যায়। অস্ত্রের অভাব হয়নি তার।

১৯৪৮ ঃ সবদিক থেকে এগিয়ে থেকেও আযাদ কাশ্মীর বাহিনীর মোকাবেলায়  যখন সুবিধা কতে উঠতে পারছে না ভারত, তখন নেহরু সিদ্ধান্ত নেন জাতিসংঘের দ্বারস্থ হওয়ার। হ্যাঁ আজ যে জাতিসঙ্ঘের নাম শুনতে ভারত প্রস্তুত নয়, সেদিন তারই কাছে ছুটে যেতে বাধ্য হয়েছে ভারত। বোঝা যায়, কেমন বেকায়দায় পড়েছিলেন ‘পণ্ডিত’! জাতিসঙ্ঘও অবিলম্বে ভারতের আর্জিতে সাড়া দেয়। সঙ্কট নিরসনে গঠিত হয় জাতিসঙ্ঘ-ভারত-পাকিস্তান কমিশন।

জানুয়ারী, ১৯৪৯ ঃ জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তাপরিষদের প্রস্তাব-৪৭ অনুযায়ী যুদ্ধবিরতি ঘোষণা। আযাদ কাশ্মীর এবং মাক্ববূযা কাশ্মীর নামে দু’ভাগ হয়ে যায় কাশ্মীর। দুই কাশ্মীরের মধ্যবর্তী সীমানাকে লাইন অব কন্ট্রোল (নিয়ন্ত্রণরেখা) হিসাবে নির্ধারণ। জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীরের ভবিষ্যত নির্ধারনের আহ্বান জানায় নিরাপত্তাপরিষদ। এককথায় রাজি হয় ভারত। তবে গণভোটের জন্য ক্ষেত্রপ্রস্তুতের শর্ত হিসেবে আগে সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে পাকিস্তান এবং যৌক্তিকভাবেই যৌথ সেনাপ্রত্যাহারের দাবি জানায়। কিন্তু ভারত তা মানতে অস্বীকৃতি জানায়।

১৬ জুন ১৯৪৯ ঃ রাজার অনুমোদনক্রমে শেখ আবদুল্লাহ এবং তার তিন সহকর্মী ভারতীয় গণপরিষদে যোগ দান করেন, যাদের দায়িত্ব ছিলো ভারতের জন্য একটি সংবিধান তৈরী করা

২০ জুন, ১৯৪৯ ঃ নেহরু এবং প্যাটেলের দাবির মুখে হরি সিং তার পুত্র করণ সিং এর হাতে শাসনভার তুলে দেন । তবে নিজের মহারাজা উপাধি বহাল রাখেন।

অক্টোবর ১৯৪৯ ঃ রাজা হরি সিং এর ভারতভুক্তির শর্ত অনুযায়ী সকল প্রদেশের মধ্যে কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা এবং সুবিধা দিয়ে ভারতের সংবিধানের বিশেষ একটি ধারা সংযোজন করতে বাধ্য হয় ভারত যা অর্টিকেল ৩৭০ নামে প্রসিদ্ধ। এর মাধ্যমে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র এবং যোগাযোগ ছাড়া সকল বিষয়ে কাশ্মীরকে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার দেয়া হয়। এমনকি কাশ্মীরকে আলাদা সংবিধান এবং আলাদা পতাকা ব্যবহারেরও অধিকার দেয়া হয়। তবে অত্যন্ত চতুরতার সাথে ধারাটির শুরুতে টেম্পরারী বা অস্থায়ী শব্দটি যুক্ত করে দেয়া হয়। পরিস্থিতির চাপে ৩৭০ ধারাটি যুক্ত করতে বাধ্য হলেও নেহরু তার মনের কুটিলতা প্রকাশ করে দিয়েছিলেন এই কথাটি দ্বারা ‘ইয়ে ঘিসতে ঘিসতে ঘিস যায়েগী’ (এটা পিষ্ট হতে হতে পিষে যাবে)। তাই হয়েছিলো। কাশ্মীরে পা রাখার পর থেকেই কাশ্মীর এবং কাশ্মীরের মুসলিমানকে ‘ঘিসতে’ থাকে, ভারত যা আজো অব্যাহত আছে ‘আরএসএস সদস্য’ মোদির হাতে।

ডিসেম্বর, ১৯৪৯ ঃ কানাডিয়ান জেনারেল ম্যাকনাটনকে জাতিসঙ্ঘ মধ্যস্ততাকারী হিসেবে নিযুক্ত করে। অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে তিনি প্রস্তাব করেন, ভারত পাকিস্তান একই সঙ্গে সৈন্য প্রত্যাহার করবে এবং গণভোটের প্রস্তুতি হিসেবে আযাদ কাশ্মীর বাহিনী এবং রাজার নিয়ন্ত্রনাধীন বাহিনী দুটোই ভেঙ্গে দেয়া হবে। পাকিস্তান মেনে নিলেও ভারত তা প্রত্যখ্যান করে। তার প্রস্তাবের ভিত্তিতে নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব ৮০ অনুমোদন হয়। এর ফলে ভারত তা মেনে নিতে বাধ্য হয়। সৈন্য প্রত্যাহারের মাধ্যমে গণভোটের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরীর জন্য উভয় দেশকে পাঁচ মাসের সময় বেঁধে দেয়া হয়।

মার্চ, ১৯৪৯ ঃ সৈন্য প্রত্যাহার তদারক করতে এবং গণভোটের উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে জাতিসঙ্ঘ দূত ডিক্সন আগমন করেন।

সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে তিনি উভয় দেশের সামনে তার বিভিন্ন পরিকল্পনা তুলে ধরেন। প্রথমে তিনি শেখ আবদুল্লাহ এবং চৌধুরী গোলাম আব্বাসের যৌথ নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব দেন। তারপর একটি নিরপেক্ষ সরকার গঠনের প্রস্তাব দেন। তারপর সম্পূর্ণ জাতিসঙ্ঘের তত্তবধানে একটি প্রশাসন তৈরীর প্রস্তাব দেন। কিন্তু একে একে তিনটি প্রস্তাবই নেহরু প্রত্যাখ্যান করেন। অত্যন্ত অযৌক্তিকভাবে তিনি দাবি করতে থাকেন পাকিস্তানকে সৈন্য প্রত্যাহার করতে হবে, কিন্তু ভারত তার সৈন্য মোতায়েন রাখবে। এ কারণে ডিক্সন তার বক্তব্যে খুবই কঠোর ভাষায় ভারতকে তিরস্কার করেন। ভারতের হঠকারিতায় তার আরো কিছু প্রচেষ্টাও ব্যর্র্থ হয়। শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে তিনি দায়িত্ব ছেড়ে দেন। (আসল কথা হলো, জাতিসঙ্ঘ কখনো ভারতের উপর তার ক্ষমতা প্রয়োগই করেনি!)

অক্টোবর, ১৯৫০ ঃ সঙ্কট নিরসনে চলমান বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মধ্যেই কংগ্রেসের প্ররোচনায় শেখ আবদুল্লাহ কাশ্মীরে নির্বাচন করে একটি গনপরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। আলোচনা পণ্ড করতে এবং কাশ্মীরের দখল পাকাপোক্ত করতে এটা ছিলো প-ণ্ডিতের একটা কূটচাল। কাশ্মীরের ভবিষ্যত কী হবে সে ফায়সালাই যখন ঝুলে আছে তখন নির্বাচন কিসের?। পাকিস্তান তাৎক্ষণিক জাতিসঙ্ঘে এর তীব্র প্রতিবাদ জানায়। জাতিসঙ্ঘ (কোন কঠোর পদক্ষেপের পরিবর্তে) ভারতকে শুধু সতর্ক করে দেয় যে, কথিত গণপরিষদের কোন সিদ্ধান্তই প্রজোয্য হবে না। এভাবেই আলোচনা ও সমাধানের পথ এড়িয়ে বিভিন্নভাবে ভারত নিজের দখল পাকাপোক্ত করতে থাকে। আর তিক্ত সত্য এই যে, ভারতের দখলদারিত্ব থেকে কাশ্মীরকে মুক্ত করতে যে আন্তরিকতা এবং ‘শেষপর্যন্ত যাওয়া’ মনোভাবের প্রয়োজন ছিলো, তার বড় অভাব ছিলো পাকিস্তানী রাজনীতিকদের (অন্তত) অধিকাংশের মধ্যে। তখন যেমন, এখনো তেমন।

১৯৫০ ঃ ভারতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হ্যান্ডারসন প্রথম মার্কিন কর্মকর্ত হিসেবে কাশ্মীর সফর করেন। সফরের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি বলেন ‘গণভোট হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতা ভারতের পরিবর্তে পাকিস্তানে যোগ দেয়াকেই সমর্থন করবে।’

এপ্রিল, ১৯৫১ ঃ ডিক্সন ব্যর্র্থ হয়ে ফিরে যাওয়ার পর তার স্থলে ড: ফ্রাঙ্ক গ্রাহামকে জাতিসঙ্ঘের দূত নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু একের পর তারও সকল প্রচেষ্টা ব্যর্র্থ হতে থাকে ভারতের একগুয়েমির কারণে। শেষ পর্যন্ত ‘আংশিক সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেন তিনি। কিন্তু সেখানেও পাকিস্তানের চেয়ে কয়েকগুন বেশী সৈন্য রাখার দাবি করে ভারত, যা তাদের দুরভিসন্ধিকেই প্রমাণ করে। ১৯৫৩ সালে গ্রাহামও ফিরে যান ব্যর্র্থ হয়ে। ভারত নিজেই যে জাতিসঙ্ঘের দ্বারস্থ হয়েছিলো, এভাবেই একের পর এক তার সকল প্রচেষ্টাই ব্যর্থ করে দিতে থাকে ভারত।

অক্টোবর, ১৯৫১ ঃ পাকিস্তানের আপত্তি উপেক্ষা করে কাশ্মীরে গণপরিষদ নামে প্রথম সংসদ নির্বাচন। পুরো কাশ্মীরকে ১০০ আসনে ভাগ করা হয়। ২৫ টি আসন নির্ধারণ করা হয় পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত আযাদ কাশ্মীরের জন্য আর বাকি ৭৫ টি ভারতদখলকৃত কাশ্মীরের জন্য। ১৯৪৭ এ প্রজা পরিষদ নামে একটি হিন্দু রাজনৈতিক দল গঠিত হয় কাশ্মীরে। তারা প্রবলভাবে অর্টিকেল ৩৭০ এর বিরোধীতা করে এবং নিঃশর্তভাবে কাশ্মীরকে ভারতে অন্তর্ভুক্তির দাবি জানায়। কিন্তু শেখ আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে কাউকে দাঁড়াতে না দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় কংগ্রেস। কারণ মুসলমানদের বশে রাখতে আবদুল্লাহকেই তাদের প্রয়োজন ছিলো। গণপরিষদ নির্বাচনে হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও প্রজা পরিষদের সবার প্রার্থিতা বাতিল করা হয়। বিরোধীদলহীন নির্বাচন, তারপরও ব্যাপক কারচুপির মাধ্যমে ৭৫ টি আসনই দখল করে শেখ আবদুল্লাহর দল। নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূর্ণ হয় শেখ সাহেবের। নির্বাচনের পর প্রজা পরিষদ আরেকটি সদ্য গঠিত দল ভারতীয় জনসঙ্ঘের সঙ্গে একীভূত হয়ে যায়। আর্টিকেল ৩৭০ তথা কাশ্মীর ইস্যুতে নেহরুর সঙ্গে মতবিরোধ হওয়া তার এক মন্ত্রী শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এই দলটি গঠন করেন। এই দলটিই পরবর্তীতে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নাম ধারণ করে এবং ৫ই আগস্ট ২০১৯ তাদের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নটি পূর্ণ করে ৩৭০ ধারা বাতিলের মাধ্যমে।

নভেম্বর ১৯৫১ ঃ ৩৭০ ধারাকে কাজে লাগিয়ে প্রথমে মহারাজার সমস্ত ক্ষমতা বাতিল করে সকল ক্ষমতা ‘নির্বাচিত’ সরকারের হাতে অর্পণ করে আইন পাশ হয় কাশ্মীর গণপরিষদে। পরবর্তী আরেকটি আইনের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটিয়ে সাদরে রিয়াসাত পদ সৃষ্টি করা হয় এবং করণ সিংকে প্রথম সদর নির্বাচন করা হয়। ডোগরা রাজা শর্ত আরোপ করে যে ৩৭০ ধারা আদায় করেছিলেন নিজের স্বার্থ চিন্তা করে, শেখ আবদুল্লাহ সেটাই তার বিরুদ্ধে ব্যবহার করেন।

নভেম্বর ১৯৫২ ঃ কাশ্মীরের পুর্ণাঙ্গ ভারতভুক্তির দাবিতে লাগাত মিছিল-সমাবেশ করতে থাকে প্রজাপরিষদ। একই সঙ্ঘে দিল্লীতেও ব্যাপক বিক্ষোভ করে জনসংঘ। কংগ্রেসের সমর্র্থনে শক্তি প্রয়োগ করে প্রজাপরিষদকে দমন করেন শেখ আবদুল্লাহ। ডোগরা রাজা যদিও ৪৭ সালেই ভারতভুক্তির চুক্তিতে সাক্ষর করেছিলেন, কিন্তু কংগ্রেস জানতো, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগোষ্ঠীর সমর্থন ছাড়া তা মূল্যহীন। তাই তাদের পরিকল্পনা ছিলো শেখ আবদুল্লাহর গণপরিষদকে দিয়ে কাশ্মীরের ভারতভুক্তি অনুমোদন করিয়ে নেয়া এবং এটাকেই ‘জনতার রায়’ বলে তুলে ধরা। কিন্তু কংগ্রেসের অব্যাহত তাগাদা সত্ত্বেও শেখ সাহেব বিলম্ব করতে থাকেন। একসময় শেখ আবদুল্লাহ কাশ্মীরের আরো বেশী স্বায়ত্তশাসন দাবি করেন। বিভিন্ন বক্তব্যে তিনি মুক্ত গণভোটের দাবিও পেশ করেন, যাতে কাশ্মীরীরা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেবে, তারা ভারতের সঙ্গে থাকবে, না পাকিস্তানের সঙ্গে যাবে, নাকি স্বাধীনতা ঘোষণা করবে। এমনকি এক বক্তব্যে তিনি বলে ফেলেন, ‘পাকিস্তানে যোগ না দিয়ে তিনি ভুল করেছেন’। কংগ্রেস তখন বুঝতে পারে ভারতের প্রয়োজন আরো অনুগত মানুষের।

মে ১৯৫৩ ঃ কাশ্মীরে প্রবেশের চেষ্টাকালে ভারতীয় জনসঙ্ঘের প্রধান শামা প্রসাদকে গ্রেফতার করে কাশ্মীরী পুলিশ।

জুন ১৯৫৩ ঃ পুলিশি হেফাযতে শ্যামা প্রসাদের মৃত্যু। ভারতজুড়ে শেখ আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ করে জনসঙ্ঘ।

আগস্ট : ১৯৫৩ ঃ শেষ পর্যন্ত চরম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে কংগ্রেস। সদরে রিয়াসাত করন সিং এবং শেখ আবদুল্লাহর ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী, ন্যাশনাল কনফারেন্সের আরেক নেতা বকশি গুলামকে দিয়ে আবদুল্লাহর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটায় কংগ্রেস। বলা হয় মন্ত্রীসভার অধিকাংশ সদস্য তার বিরোধিতা করায় তাকে অপসারণ করা হয়েছে। অপসারণের পরপরই শেখ আবদুল্লাহকে বন্দি করে তারই পুলিশ। এভাবেই সমাপ্তি ঘটে ‘শেরে কাশ্মীরে’র স্বায়ত্তশাসনের স্বপ্নের। প্রতিবাদে ব্যাপক বিক্ষোভ হয় কাশ্মীরজুড়ে। শতাধিক নিহত হয় পুলিশের গুলিতে।

ফেব্রুয়ারীত, ১৯৫৪ ঃ আবদুল্লাহকে বন্দী করার পর ‘গোলামে’র নেতৃত্বে কাশ্মীরের ভারতভুক্তি অনুমোদন করে কাশ্মীরের ‘নির্বাচিত’ গণপরিষদ। এভাবেই বৈধতার ছাপ লাগানোর চেষ্টা করা হয় কাশ্মীরে ভারতের দখলদারিত্বে।

মার্চ ঃ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রতিরক্ষাচুক্তি স্বাক্ষর। ‘খলের অভাব হয় না ছলের’ নীতিতে এটাকেই অজুহাত বানিয়ে জাতিসঙ্ঘের মধ্যস্ততা ও গণভোটের প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসার ঘোষণা দেন ‘প-িত’ নেহরু।

আগস্ট, ১৯৫৫ ঃ শেখ আবদুল্লাহর এক বিশ^স্ত সহযোগী মীর্যা আফযাল বেগ জম্মু এ- কাশ্মীর গণভোট ফ্রন্ট নামে নতুন একটি দল গঠন করে। পরবর্তী এক দশক শেখ আবদুল্লাহর মুক্তি এবং জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে গণভোট আয়োজনের দাবিতে আন্দোলন চালাতে থাকে তারা।

নভেম্বর, ১৯৫৬ঃ কাশ্মীরের সংবিধান প্রনয়ণ করে ‘গোলামে’র নেতৃত্বাধীন গণপরিষদ। সংবিধানের শুরুতেই উল্লেখ করা হয়, কাশ্মীর ভারতীয় ইউনিয়নের অবিচ্ছেদ্য অংশ। অথচ তখনো জাতিসংঘের পরিস্কার নির্দেশ, ‘শান্তিপূর্ণ পরিবেশে গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীরের ভবিষ্যতের ফায়সালা হবে।’

 

জানুয়ারী, ১৯৫৭ ঃ নিরাপত্তা পরিষদ প্রস্তাব ১২২ কর্তৃক এই সংবিধানকে অকার্যকর বলে ঘোষণা।

মার্চ ১৯৫৭ ঃ কাশ্মীরে দ্বিতীয় নির্বাচন। গণপরিষদের স্থলে বিধানসভা গঠন। ৭৫ আসনের মধ্যে ৬৮ টি দখল করে ‘গোলামে’র নেতৃত্বাধীন কনফারেন্স।

আগস্ট, ১৯৫৮ ঃ শেখ আবদুল্লাহকে মুক্তি দেয়ার অল্প সময় পরেই আবার গ্রেফতার আলোচিত ‘কাশ্মীর ষড়যন্ত্র মামলায়’ অভিযুক্ত করে। বলা হয়, ব্যাপক নাশকতার মাধ্যমে কাশ্মীরকে তিনি পাকিস্তানের অংশ বানাতে চাচ্ছেন। হায় আব্দুল্লাহ্! হায় শেরে কাশ্মীর!

১৯৬২ ঃ কাশ্মীরে তৃতীয় নির্বাচন। আবারও ৬৮টি আসন দখল করে কনফারেন্স। এসব নির্বাচন আই ওয়াশ ছাড়া আর কিছু ছিলো না। বিরোধী কাউকে দাঁড়াতেই দেয় না কনফারেন্স। সমাধানে পথ এড়িয়ে এভাবেই সৈন্য মোতায়েন রেখে অস্ত্রের বলে দখলদারিত্ব চালিয়ে যেতে থাকে ভারত। ফলে ভারত এবং তাদের সহযোগী কনফারেন্সের প্রতি বাড়তে থাবে মানুষের ক্ষোভ।

অক্টোবর, ১৯৬২ ঃ লাদাখ সীমান্তু নিয়ে চীনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে ভারত। মাত্র একমাসের যুদ্ধে কাশ্মীরের আকসাই চিন এবং লাদাখের বিশাল এলাকা হারাতে হয় ভারতকে। ‘কৌশলগত পদক্ষেপ’ হিসেবে আযাদ কাশ্মীরের চীনসংলগ্ন পাঁচ হাজার বর্গ কিলোমিটার জায়গা চীনের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেয় পাকিস্তান’ যা ভারতকে আরো বেকায়দায় ফেলে দেয়। (পাকিস্তানের এ সিদ্ধান্ত খোদ পাকিস্তানেই প্রচ- বিতর্কের জন্ম দেয়।)

ডিসেম্বর, ১৯৬৩ ঃ কাশ্মীরের বিখ্যাত হযরতবাল খানকায় সংরক্ষিত নবীজী সঃ এর চুল মোবারক হারানো যায়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয় কাশ্মীরে। পদত্যাগ করতে বাধ্য হন প্রধানমন্ত্রী ‘গোলাম’। কিছু দিন পর তা ‘পাওয়া গেলে’ পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন কনফারেন্সের আরেক নেতা খাজা শামসুদ্দীন। কাশ্মীরে যখনই প্রয়োজন হয়েছে, ভারত অনুগত মুসলিম পেয়েছে।

ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৪ ঃ শুরুফেব্রুয়ারী, ১৯৬৪ ঃ শুরু থেকেই কংগ্রেসের এজেন্ডার কট্টর সমর্থক হিসেবে পরিচিত কনফারেন্সনেতা আরেক ‘গোলাম’ সাদেক এর নেতৃত্বে ন্যাশনাল কনফারেন্সের অধিকাংশ বিধানসভা সদস্য ভারতীয় কংগ্রেসে পার্টিতে যোগদান করে। ফলে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন শামসুদ্দিন। কাশ্মীরে প্রথম কংগ্রেস দলীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন নতুন ‘গোলাম’ সাদেক।

এপ্রিল, ১৯৬৪ ঃ পর্দার আড়ালের অজানা সমঝোতার মাধ্যমে দীর্ঘ প্রায় এগারো বছর টানা বন্দীজীবনের পর কাশ্মীরের বুড়ো শের আবদুল্লাহ্কে মুক্তি দেয়া হয়।

তার বিরুদ্ধে আনিত গুরুতর সব অভিযোগ রহস্যজনকভাবে তুলে নেয়া হয়। এই সামান্য ‘কংগ্রেসবিরোধিতার কারণে মুক্তির পর তাকে বীরোচিত সংবর্ধনা দেয় কাশ্মীরের সরল মানুষ।

নভেম্বর ঃ প্রধানমন্ত্রী হয়েই কংগ্রেসের এজেন্ডা বাস্তবায়নে সক্রিয় হন গোলাম সাদেক। কাশ্মীরের দখল পাকাপোক্ত করতে সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে কাশ্মীরকে ভারতীয় সংবিধানের ৩৫৬ ও ৩৫৭ ধারার আওতায় নিয়ে আসার ঘোষণা দেয় কংগ্রেস। এই ধারার খোলাছা বয়ান হলো পরিস্থিতি দাবী করলে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার কাশ্মীরের বিধানসভা বাতিল করে তার নিয়ন্ত্রন গ্রহণ করতে পারে। এর প্রতিবাদে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয় কাশ্মীরজুড়ে। একই সঙ্গে কাশ্মীরের সদরে রিয়াসাত ও প্রাইম মিনিস্টার পদকে অন্যান্য প্রদেশের মত গভর্ণর ও চিফ মিনিস্টার দ্বারা পরিবর্তন করে সংবিধানে সংশোধনী আনে কাশ্মীর বিধানসভা। এভাইে চলতে থাকে ধাপে ধাপে ৩৭০ ধারাকে ‘ঘিসনে কা কারসাজি’।

জাুনয়ারী, ১৯৬৫ ঃ সমস্ত মুখোশ ছুঁড়ে ফেলে আনুষ্ঠানিকভাবে কংগ্রেসে যোগদান করে ন্যাশনাল কনফারেন্স এবং নিজেকে কংগ্রেসের কাশ্মীরশাখা হিসেবে ঘোষণা করে। এভাবেই চলতে থাকে কাশ্মীর নিয়ে ভারতে খেলা এবং লীলা!

মে ১৯৬৫ ঃ মুক্তির এক বছর পরেই শেখ আবদুল্লাহকে আবার বন্দী করে ভারত, হজের সফর থেকে ফেরার পথে দিল্লী বিমানবন্দরে। অজুহাত, বিদেশে পাকিস্তানী দূতাবাসের সঙ্গে এবং চীনের সঙ্গে যোগাযোগ। আসল কারণ ছিলো তাকে এবং তার গণভোট ফ্রন্টকে আসন্ন নির্বাচন থেকে দূরে রাখা। এভাবেই বন্ধুত্বের সমুচিত প্রতিদান পেতে থাকেন তিনি ভারতের কাছ থেকে।

আগস্ট, ১৯৬৫ ঃ জাতিসঙ্ঘের সমস্ত সমাধানপ্রচেষ্টা উপেক্ষা এবং কাশ্মীরীদের দমন নিপীড়নের মাধ্যমে দখলদারি চালিয়ে যেতে থাকে ভারত। শান্তিপূর্ণ সমাধানের বিষয়ে হতাশ হয়ে সামরিক সমাধানের পথে আগে বাড়ে পাকিস্তান। মুক্তিকামী কাশ্মীরী মুসলমানদের ‘সক্রিয়’ সাহায্য শুরু করে এবং অপারেশন জিব্রাল্টার নামে গোপন অভিযান পরিচালনা করে পাক আর্মি।

সেপ্টেম্বর ১৯৬৫ ঃ অজুহাত পেয়ে যুদ্ধের ঘোষণা ছাড়াই ভারত পাকিস্তানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ৬ই সেপ্টেম্বর।  সতের দিন স্থায়ী যুদ্ধে পাকিস্তান সুস্পষ্টভাবে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকে, যদি অর্থনীরিতর উপর যথেষ্ট চাপ পড়ে। সোভিয়েট রাশিয়ার চাপে যুদ্ধবিরতিতে রাজী হয় পাকিস্তান।

জানুয়ারী, ১৯৬৬ ঃ সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যস্ততায় সম্পাদিত তাসখন্দচুক্তির মাধ্যমে আগের অবস্থানে ফিরে আসতে রাজি হয় উভয় পক্ষ।

আগস্ট ১৯৬৬ ঃ ভারতের দখলদারিত্ব অবসানের লক্ষ্যে জম্মু-কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্ট গঠন করে ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে ‘হাতিয়ার কা জিহাদ’ শুরু করেন কাশ্মীরী তরুণ মকবূল ভাট। এক সঙ্গীর বিশ^াসঘাতকতায় সেপ্টেম্বরে ভারতীয় বাহিনীর হাতে তিনি বন্দি হন বিচারে তার মৃত্যুদ- হয়।

দুই বছর পর দুই সঙ্গিসহ তিনি জেল থেকে পালাতে সক্ষম হন এবং দীর্ঘ ষোলদিনে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে আযাদ কাশ্মীরে পৌঁছতে সক্ষম হন। আযাদ কাশ্মীরসহ সমগ্র কাশ্মীরের স্বাধীনতা দাবি করায় পাকিস্তানে এবং আযাদ কাশ্মীরে তিনি প্রতিকূলতার সম্মুখীন হন। সরকারীভাবে তাকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। তবে জনসমর্থনের অবলম্বনে তিনি তার কার্যক্রম চালিয়ে যান।

১৯৬৭ ঃ কাশ্মীরে চতুর্থ নির্বাচন। বর্তমান চিফ মিনিস্টার গোলাম সাদেকের নেতৃত্বাধীন কনফারেন্স তথা কংগ্রেস আগের মতই ব্যাপক জালিয়াতির মাধ্যমে ৬১ আসনে জয়লাভ করে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বখশী গোলামের দল পাঁচটি আসন লাভ করে।

১৯৭১ ঃ বহুল আলোচিত ভারতীয় বিমানছিনতাইয়ের ঘটনাকে উপলক্ষ করে মকবূল বাটকে সদলকে বন্দী করা হয় এবং মোকদ্দমা দায়ের করা হয়। তবে জনতার চাপে পাকিস্তানের সামরিক সরকার বেকায়দায় পড়ে যায়। আদালত তাকে বেকসুর খালাস দেয়। মকবুল বাট আবার গোপনে মকবূযা কাশ্মীরে চলে যান এবং গোপন তৎপরতা চালাতে থাকেন। পরে তিনি আবার গ্রেফতার হন এবং আদালত আগের সাজা বহাল রাখে।

পূর্বপাকিস্তানে ভারতের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় ‘মুক্তিযুদ্ধ’ শুরু, যা তৃতীয় পাক-ভারত যুদ্ধে। পরিণতি লাভ করে। কাশ্মীরসহ পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যাপক লড়াই। পূর্বপাকিস্তান বাংলাদেশ নামে স্বাধীন রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ করে।

ডিসেম্বর, ১৯৭১ ঃ কাশ্মীরের চিফ মিনিস্টার গোলাম সাদেকের মৃত্যু। কংগ্রেসনেতা মীর কাসেমের চিফ মিনিস্টাররূপে দায়িত্ব গ্রহণ।

১৯৭২ ঃ কাশ্মীরে পঞ্চম নির্বাচন। ৫৮ আসন লাভ করে কংগ্রেস/ন্যাশনাল কনফারেন্স। মীর কাসেম চিফ মিনিস্টার হিসেবে বহাল।

১৯৭২ ঃ ৭১ এর যুদ্ধকে কেন্দ্র করে পাক-ভারত সিমলা চুক্তি সাক্ষর। ভবিষ্যতে উভয় দেশ দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমেই কাশ্মীর ইস্যুর সমাধানে একমত। আযাদ কাশ্মীর এবং মাক্ববূযা কাশ্মীরের মাঝসীমানাকে লাইন অব কন্ট্রোল হিসেবে নির্ধারণ। উভয় দেশ লাইন অব কন্ট্রোল মেনে চলবে বলে প্রতিশ্রুতি প্রদান।

১৯৭৫ ঃ গণভোট ফ্রন্টকে অবলম্বন করে অবস্থান ফিরে পেতে ব্যর্থ হন শেখ আবদুল্লাহ। শেষ পর্যন্ত ক্ষমতার লোভে পড়ে, কাশ্মীরীদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবি ছেড়ে দেয়ার শর্তে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করেন। এর মাধ্যমে কংগ্রেসের সমর্থনে ২২ বছর পর আবার চিফ মিনিস্টার হন শেখ অবদুল্লাহ। কাশ্মীরের মুসলিম জনতা এটাকে ‘গাদ্দারি’ আখ্যা দিয়ে প্রচ- ‘আব্দুল্লাহ্বিরোধী বিক্ষোভ করে সমগ্র কাশ্মীরে। ৩৭০ ধারা অনুযায়ী তাকে রাজ্য পরিচালনার অনুমতি দেয় ভারত। কিন্তু ততদিনে ঐ ধারায় অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়, যাতে কেন্দ্রের ক্ষমতা হয় বিস্তৃত, আর রাজ্যের ক্ষমতা হয় সঙ্কুচিত। এটাকেই নেহরু বলেছিলেন ‘ঘিসনা’। শেখ আবদুল্লাহর নেতৃত্বে পুনর্জীবিত হয় ন্যাশনাল ফ্রন্ট। গণভোট ফ্রন্টকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।

১৯৭৭ ঃ কংগ্রেস সমর্থন তুলে নেয়ায় পদত্যাগ করতে বাধ্য হন শেখ আবদুল্লাহ। ভারতীয় সংবিধানের ৩৫৬ ধারা ব্যবহার করে প্রথমবারের মত কাশ্মীরে রাষ্ট্রপতির শাসন জারী।

মার্চ ১৯৭৭ ঃ ভারতে সাধারণ নির্বাচন। স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মত সরকার গঠনে ব্যর্থ কংগ্রেস। ক্ষমতায় আসে বিরোধী জোট জনতা পার্টি। জোটের শরীক হিসেবে বিজেপির উত্তরসূরী শ্যামা প্রসাদের ভারতীয় জনসঙ্ঘও সরকারের অংশ হয়।

জুলাই ১৯৭৭ ঃ কাশ্মীরে ষষ্ঠ নির্বাচন। ন্যশনাল কনফারেন্সের ৪৮টি আসন লাভ। জনতা পার্টি/প্রজাপরিষদ ১৩ টি আসন লাভ।

আবারও চিফ মিনিস্টার শেখ আবদুল্লাহ।

১৯৭৮ ঃ পাকিস্তানে চরম বিশৃংখলাপূর্ণ এক পরিস্থিতিতে ক্ষমত গ্রহণ করেন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউল হক্ব।

দীর্ঘদিন ধরে মুক্তিকামী জনগণের উপর ভারতের দমন নিপীড়নের বিরুদ্ধে চরম ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে কাশ্মীরে। শান্তিপূর্ণ মিছিল সমাবেশেও ভারতীয় বাহিনীর চরম নিষ্ঠুরতা তাকে আরো বাড়িয়ে তোলে। শান্তিপূর্ণ উপায়ে অধিকার আদায়ের কোন আশা দেখতে না পেয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধের কথা আলোচিত হতে থাকে কাশ্মীরী তরুণ-যুব শ্রেণীতে। অধিকার আদায়ের আন্দোলনে কাশ্মীরীদেরকে সম্ভাব্য সকল উপায়ে সহযোগিতার ফায়সালা করেন জেনারেল জিয়াউল হক্ব।

১৯৮২ ঃ শেখ আবদুল্লাহর ইন্তেকাল। মুসলিম কাশ্মীরকে হিন্দু ভারতের হাতে তুলে দেয়ার বিশাল দায় নিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন শেখ আবদুল্লাহ। এটা সত্য যে জীবনের শুরুতে মাতৃভূমীর জন্য তিনি কিছু ত্যাগ তিনি হয়ত স্বীকার করেছেন। কিন্তু তার ক্ষমতার লোভে, মুসলিম ভাইদের দূরে ঠেলে দিয়ে হিন্দুদের আপন করে নেয়ার নির্বুদ্ধিতা আজো ভুগিয়ে চলেছে কাশ্মীর ও তার মযলূম মুসলিম জনগোষ্ঠীকে। শেখ আবদুল্লাহর পর চিফ মিনিস্টার হন তারই পুত্র ফারুক আবদুল্লাহ।

১৯৮৩ ঃ সপ্তম নির্বাচন। ৪৬ টি আসনে জয়ী হয়ে আবারো সরকার গঠন করে ন্যাশনাল কনফারেন্স। কংগ্রেস পায় ২৩ টি আসন। স্বপদে বহাল থাকেন ফারুক আবদুল্লাহ।কিন্তু ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে কংগ্রেসের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন।

১৯৮৪ ঃ ফারুক আবদুল্লাহর ‘শ্যালক’ কনফারেন্সনেতা গুলাম শাহ বারো জন সংসদ সদস্য নিয়ে দল থেকে বেরিয়ে যান। সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে পদত্যাগে বাধ্য হন ফারুক আবদুল্লাহ। কংগ্রেসের সমর্থনে চিফ মিনিস্টার হন গুলাম শাহ। প্রতিবাদে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। এমনকি একমাসব্যাপী কারফিউ জারি করতে বাধ্য হয় নতুন সরকার।

১৯৮৬ ঃ তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার ঘটনা ঘটে কাশ্মীরে। এর দায়ভার চাপিয়ে গুলাম শাহকে বরখাস্ত করে কাশ্মীরে কেন্দ্রীয় সরকারের নিযুক্ত গভর্ণর জগমোহন। দ্বিতীয়বারের মত কাশ্মীরে রাষ্ট্রপতিশাসন।

নভেম্বর ১৯৮৬ ঃ রাজিব গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত। রাজিব গান্ধীর সঙ্ঘে সমঝোতা করে আবার চিফ মিনিস্টার হন ফারুক আবদুল্লাহ।

এভাবেই ক্ষমতার কামড়াকামড়িতে লিপ্ত থাকেন কাশ্মীরের রাজনীতিকরা, আর ভারতের হাতে নিষ্পেষিত হতে থাকে সাধারণ মানুষ।

১৯৮৭ ঃ কাশ্মীরে অষ্টম নির্বাচন। কয়েকটি ইসলামী দলসমূহের জোট তুমুল জনপ্রিয় মুসলিম ইউনাইটেড ফ্রন্ট নির্বাচনে অংশ নেয়। কিন্তু আবারো ব্যাপক কারচুপি করে ক্ষমতা দখল করে কনফারেন্স-কংগ্রেস জোট। মাত্র চারটি আসনে জয়ী দেখানো হয় মুসলিম ফ্রন্টকে। অথচ সুষ্ঠু নির্বাচন হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে তাদের জয়ী হওয়ার কথা। প্রচ-ণ্ড বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভকারীদের উপর নেমে আসে নির্যাতনের খড়গ। মুসলিম ফ্রন্টের হাজার হাজার কর্মীকে বন্দী করে চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন।

১৯৮৯ ঃ অনেক দিনের জমা ক্ষোভ তো ছিলোই, এবার ধৈর্যের সব বাধ ভেঙ্গে যায় কাশ্মীরীদের। দীর্ঘদিন ‘নীরবে’ সয়ে আসার পর ভারতীয় দধলদারিত্বের বিরুদ্ধে এবার সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে কাশ্মীরী নওজোয়ানেরা। পাকিস্তান থেকে বিপুল সংখ্যক মুজাহিদীন যোগ দেন কাশ্মীরের জিহাদে। জিহাদের চেতনা ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র কাশ্মীরে।

সেপ্টেম্বর ১৯৮৯ ঃ কাশ্মীরে ভারতীয় জনতা পাটির্র (বিজেপি) এক শীর্ষনেতা নিহত হয়। ফলে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে হিন্দুদের মাঝে। এমনই আরো কিছু ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে ব্যাপক হারে কাশ্মীর ছাড়তে শুরু করে হিন্দু প-ণ্ডিতরা। তবে অভিযোগ আছে, প-ণ্ডিতসমাজের গণহারে কাশ্মীরত্যাগের পিছনে ভারতের কারসাজি ছিলো।

১৯৯০ ঃ সশস্ত্র প্রতিরোধ, ব্যাপক বিক্ষোভ সামাল দিতে ব্যর্থ হয়ে সরকার। আবারো রাষ্ট্রপতিশাসন জারি করা হয় কাশ্মীরে। এর পরদিনই কাশ্মীরের ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা চালায় ভারতীয় বাহিনী যা গাওয়াকদাল গণহত্যা নামে পরিচিত। ঠা-ণ্ডা মাথায় গুলি চালিয়ে ২৮০ জন নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীকে হত্যা করে ভারতীয় বাহিনী। শ্রীনগরে মুসলমানদের ঘরে ঘরে ঢুকে নির্যাতন চালায় সেনারা। কাশ্মীর উপত্যকায় এক লাখ পঁচিশ হাজার সেনা মোতায়েন করে ভারতসরকার। পর্যায়ক্রমে বাড়ানো হতে থাকে সৈন্যসংখ্যা।

মার্চ ১৯৯০ ঃ জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাবিত গণভোট আয়োজনের দাবি জানিয়ে প্রায় পাঁচলাখ মানুষের বিক্ষোভ শ্রীনগরে। গুলিবিদ্ধ হয়ে হন পঞ্চাশজন নিরস্ত্র বিক্ষোভকারী শহীদ হন।

এপ্রিল ১৯৯০ ঃ কাশ্মীরের মুক্তিকামী নওজোয়ানদের সংগঠন হিযবুল মুজাহিদীনের যাত্রা শুরু। তখন থেকে আজ পর্যন্ত কাশ্মীরের জিহাদে অপরিসীম অবদান রেখে চলেছে হিযবুল মুজাহিদীন।

১৯৯১ ঃ কুনান-পসসুপরা ট্রাজেডী।  গভীর রাতে কাশ্মীরের উপকণ্ঠে দুটি গ্রামে অভিযান চালায় ভারতীয় বাহিনী। স্বাধীনতাকামীদের তালাশ করার অজুহাতে ঘরে ঘরে ঢুকে শতাধিক নারীর উপর নির্যাতন চালায় পশুর দল। আজ পর্যন্ত এর কোন বিচার বা তদন্ত করেনি ভারত সরকার।

১৯৯৩ ঃ স্বাধীনতাকামীদের হামলায় বি এস এফের এক সদস্য নিহত হয়। এর প্রতিশোধ নিতে ‘সপুর’ এলাকায় পঞ্চান্নজন সাধারণ কাশ্মীরীকে হত্যা করা হয়।

মার্চ ১৯৯৩ ঃ এক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে কাশ্মীরের প্রায় সকল (২৩টি) সংগঠন একত্র হয়ে গঠন করে অল পার্টিজ হুররিয়াত কনফারেন্স।

অক্টোবর ১৯৯৩ ঃ বীজবেহারা গণহত্যা। স্বাধীনতাকামীদের উপস্থিতির ‘গোপন খবর’ পেয়ে ঐতিহাসিক হযরতবাল খানকাহ ঘেরাও করে ভারতীয় বাহিনী। টানা কয়েকদিন অবরোধ চলতে থাকে। ২২ অক্টোবর হাজার হাজার কাশ্মীরী পথে নেমে আসে ঘেরাও তুলে নেয়ার দাবিতে। নিরস্ত্র মিছিলকারীদের উপর নির্বিচারে গুলি চালায় সেনাবাহিনী। শহীদ হন ৫১ জন। এভাবেই চলতে থাকে স্বাধীনতার জন্য কাশ্মীরীদের আত্মত্যাগ, আর হানাদার ভারতীয় সেনাদের নৃশংস দমন-পীড়ন।

১৯৯৫ ঃ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও সংসদে দেয়া বক্তব্যে আশ^স্ত করেন, ৩৭০ ধারা কখনোই বাতিল করা হবে না।

১৯৯৬ ঃ দীর্ঘ ছয় বছর পর কাশ্মীরে রাষ্ট্রপতিশাসনের অবসান। ভয়াবহ সহিংসতার মধ্যে নবম সংসদ নির্বাচন। কনফারেন্সের দখলে ৫৭ আসন, বিজেপি ৮। আবার চিফ মিনিস্টার ফারুক আবদুল্লাহ।

১৯৯৯ ঃ লাহোর ডিক্লারেশন। লাহোরে বাজপেয়ী-নাওয়াজ ঐতিহাসিক বৈঠক। কাশ্মীরসহ সকল বিষয় আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের এবং সঙ্ঘাত এড়িয়ে চলার প্রতিজ্ঞা উভয়পক্ষের। কিন্তু শত্রুদেশের সঙ্গে কোন আলোচনা নয় বলে পুরো আয়োজন বয়কট করে পারভেজ মোশাররফের নেতৃত্বধীন পাক সশস্ত্র বাহিনী।

মে ১৯৯৯ ঃ অঘোষিতভাবে পাক-ভারত কারগিল যুদ্ধ শুরু। প্রধানমন্ত্রী নাওয়াজ শরীফের অজ্ঞাতে এই অপ্রয়োজনীয় এবং বিপর্যয়কর যুদ্ধ বাঁধান সেনাপ্রধান জেনারেল মোশাররফ। শেষ পর্যন্ত পিছু হটতে হয় পাকিস্তানকে এবং দায় গ্রহণ করতে হয় নওয়ায শরীফকে।

২০০১ ঃ ভারতীয় পার্লামেন্টে সশস্ত্র হামলা। হামলায় যুক্ত থাকার অভিযোগে কোন প্রমাণ ছাড়াই বিশিষ্ট কাশ্মীরী মুজাহিদ আফযাল গুরুকে শ্রীনগর থেকে আটক করে পুলিশ। কাশ্মীরীদের প্রতি ভারতের অবিচারের প্রতীকে পরিণত হন আফযাল গুরু।

২০০২ ঃ দশম নির্বাচন। কনফারেন্স ২৮, সাবেক কনফারেন্স নেতা মুফতি সাঈদের পিডিপি ১৬, কংগ্রেস২০, বিজেপি ১। কংগ্রেস-পিডিপি জোট। চুক্তি অনুযায়ী তিন বছর মুফতি সাঈদ, তিন বছর কংগ্রেসের গোলাম নবী আযাদ চিফ মিনিস্টার।

২০০৮ ঃ একাদশ নির্বাচন। হুররিয়াত কনফারেন্সের ভোট বর্জনের আহ্বান। কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে ভোটারহীন নির্বাচন।

কনফারেন্স-কংগ্রেসের সরকার গঠন। চিফ মিনিস্টার হন ফারুক আবদুল্লাহর ছেলে ওমর আবদুল্লাহ।

২০০৯ ঃ বঙ্গাম এলাকা থেকে আয়েশা এবং নিলুফার নামে দুজন নারীকে তুলে নিয়ে যায় সেনাসদস্যরা। একদিন পর এক মাইল দূরে তাদের নির্যাতনের আালামতযুক্ত মৃতদেহ পাওয়া যায়। দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু বলে চালিয়ে দিতে চায় সরকার। বিক্ষোভে ফুঁসে ওঠে জনতা। প্রায় দুইমাস কারফিউ আধা কারফিউ জারি করে রাখে প্রাশাসন।

২০১০ ঃ পাকিস্তান থেকে তিন অনুপ্রবেশকারীকে হত্যার দাবি সেনাবাহিনীর। পরে জানা যায়, নিহত তিনজন স্থানীয় ‘গ্রামবালক’। লোভ দেখিয়ে তাদের ডেকে নেয় সেনারা। তারপর ‘সন্ত্রাসী’ নাম দিয়ে ঠা-ণ্ডা মাথায় হত্যা করে পুরস্কারের লোভে। প্রচ-ণ্ড বিক্ষোভ শুরু হয় উপত্যকায়। মিছিল সমাবেশে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন ১১২ জন।

২০১১ ঃ লাইন অব কন্ট্রোলের কাছে ২০০০ অজ্ঞাত মানুষের গণকবরের সন্ধান পায় হিউম্যান রাইটস কমিশন। এই ভয়াবহ সংবাদে শিউরে ওঠে পুরো বিশ্ব। ধারণা করা হয়, সেনাবাহিনীকর্তৃক গুমকৃত মানুষদের গণকবর এটা।

২০১৩ ঃ বিনা বিচারে দীর্ঘদিন আটকে রাখার পর অপ্রমাণিত অভিযোগে প্রহসনের বিচারে ফাঁসি দেয়া হয় আফযাল গুরুকে।

২০১৪ ঃ ভারতে সাধারণ নির্বাচন। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি।

২০১৪ ঃ হুররিয়াতের বয়কট আহ্বানের মাঝেই দ্বাদশ নির্বাচন। বিজেপির নির্বাচনী প্রচার চালাতে কাশ্মীরে আসেন মোদী।

নির্বাচনে প্রথমবারের মত মুফতি সাঈদের পিডিপি বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। পিডিপি ২৮, বিজেপি ২৫, কনফারেন্স ১৫, কংগ্রেস ১২। দীর্ঘ আলোচনার পর জোট গঠন করে পিডিপি-বিজেপি। এই প্রথম কাশ্মীরে সরকারের অংশ হওয়ার সুযোগ পায় বিজেপি। চিফ মিনিস্টার হন মুফতি সাঈদ।

জানুয়ারী ২০১৬ ঃ চিফ মিনিস্টার মুফতি সাঈদের মৃত্যু। তার স্থলবর্তী হন তার মেয়ে মেহবুবা মুফতি।

জুলাই ২০১৬ ঃ কাশ্মীরী তরুণদের আদর্শ, বিপুল জনপ্রিয় স¦াধীনতাযোদ্ধা হিযবুল মুজাহিদীনের কমা-ণ্ডার বুরহানুদ্দিন ওয়ানী শহীদ হন। কাশ্মীরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় গণজমায়েত হয় তারা জানযায়। জনতার আক্রোশ থেকে বাঁচতে টানা ৫৩ দিন কারফিউ জারি করে রাখে সরকার। বিক্ষোভ মিছিলে গুলি চালিয়ে ৯৬ জনকে শহীদ করে পুলিশ।

সেপ্টেম্বর ঃ উরিতে ভারতীয় সেনাছাউনীতে দুই দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা চালিয়ে ১৭ জন সৈন্যকে হত্যা করে স্বাধীনতাকামী যোদ্ধারা।

২০১৭ ঃ হিযবুল মুজাহিদীনের শীর্ষ কমা-ণ্ডার সাবযার আহমাদ ভাটের শাহাদৎ বরণ। কারফিউ ভেঙ্গে তার জানাযায় মানুষের ঢল।

২০১৮ ঃ পিডিপির সাথে জোট ভেঙ্গে দেয় বিজেপি। ফলে সরকারের পতন ঘটে। বিধানসভা বিলুপ্ত করে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করা হয় কাশ্মীরে।

২০১৯ ঃ কাশ্মীরের পুলওয়ামায় স্বাধীনতাকামীদের হামলায় ৪০ ভারতীয় সৈন্য নিহত। কোন প্রামণ ছাড়াই পাকিস্তানকে দায়ী করে হুমকি দিতে থাকে ভারত। এ ধরণের দায়িত্বহীন আচরণের ফল ভালো নয় বলে সতর্ক করে দেয় পাকিস্তান।

এপ্রিল ২০১৯ ঃ ভারতের সাধারণ নির্বাচন। নির্বাচনের আগে সংবিধানে কাশ্মীরকে বিশেষ সুবিধা প্রদানকারী ৩৭০ ধারা বাতিলের জন্য ব্যাপক প্রাচারণা চালায় বিজেপি। নির্বাচনে ভূমিধ্বস বিজয় অর্জন করে টানা দ্বিতীয়বারের মত সরকার গঠন করে বিজেপি। নির্বাচনের পরই শুরু হয়ে যায় ৩৭০ ধারা বাতিলে আয়োজন। কারণ ‘গণরায়’ ছিলো মোদির পক্ষে।

আগস্ট ২০১৯ ঃ কাশ্মীরে মোতায়েন বিপুল সংখ্যক সেনার সঙ্গে আরো সেনা মোতায়েন করে সরকার। সাবেক তিন চিফ মিসিস্টার ফারুক আবদুল্লাহ, ওমর আবদুল্লাহ, মেহবুবা মুফতিসহ প্রায় সকল বিশিষ্ট নেতাকে বন্দি করা হয়। ইন্টারনেট এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অচল করে রাখা হয়।

৫ আগস্ট, ২০১৯ ঃ  সংসদে ৩৭০ ধারা বাতিলের প্রস্তাব করেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ। একই সঙ্গে দু’ভাগ করা হয় কাশ্মীরকে। একভাগ (লাদাখ) হবে কেন্দ্রশাসিত, আরেকভাগ (জম্মু ও কাশ্মীর) এর জন্য থাকবে বিধানসভা। কাশ্মীরীদের প্রতিবাদ দমন করতে নজিরবিহীন কারফিউ জারি করা হয় উপত্যকায়। যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। এটা হচ্ছে কাশ্মীরের ইতিহাসে দীর্ঘতম কারফিউ-অবরোধ।

(মুহম্মদ বিন মিছবাহ)