মুহাররম ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

সম্পাদকীয়

আমার দরদে দিলের আফসানা!

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

প্রিয় পাঠক! প্রিয় পাঠিকা (দ্বিতীয় সম্বোধনটি সবসময় প্রচ্ছন্ন থাকে এবং থাকাই সঙ্গত, কিন্তু আজ এখন হৃদয়ের তরঙ্গ-উচ্ছ্বাস এমনই সর্বপ্লাবী যে, ইচ্ছে হলো, আবনায়ে আদাম ও বানাতে হাওয়্যা উভয়ের কাছে সমান সম্বোধনে আমার র্দদে দিলের আফসানা নিবেদন করি।) কেমন আছো তুমি এবং তোমরা?

কামনা করি, চিরকাল তুমি এবং তোমরা সুখে থাকো। জীবনের অনিবার্য দাবী রক্ষা করে যখন দুঃখের সাগর পাড়ি দিতে হয়, তখনো যেন তোমার মুখে থাকে একটুকরো স্নিগ্ধ হাসি! পরম সত্তার সঙ্গে সম্পর্কের স্নিগ্ধতা ও স্বস্তির হাসি! তখনো যেন তোমার চোখের তারায় থাকে স্বপ্নের ঝিলিমিলি, নিজের জন্য না হলেও, অন্তত তাদের জন্য, তোমার রক্তের লালিমা বহন করে একসময় যারা আসবে, কষ্টের এই পৃথিবীতে, জীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হওয়ার জন্য।

জীবনের উদ্যানে সুবাসের আকুতি তোমাকে যখন নিয়ে যায় ফুলের কাছে, আর কাঁটা বিঁধে তোমার কোমল হাতে, রক্ত ঝরে একফোঁটা দু’ফোঁটা! কাঁটার পর কাঁটা বিঁধতেই থাকে, আর ফোঁটা ফোঁটা রক্ত ঝরতেই থাকে, কামনা করি, তখনো যেন ফুলের প্রতি তোমার ভালোবাসা এবং সুবাসের প্রতি তোমার আকুতি থাকে অমলিন। তখনো যেন জীবনের পুষ্প-উদ্যানের পরিচর্যায় তুমি নিমগ্ন থাকো, থাকতে পারো, নিজের জন্য না হলেও, অন্তত সেই চাঁদের কণাটির জন্য, একসময় যে আসবে তোমার কাছে তোমার ঘর আলো করে, তার জীবন যেন মুক্ত থাকে কাঁটার আঘাত থেকে, তার জীবনে থাকে যেন শুধু ফুলের হাসি এবং ফুলের সুবাস!

তোমার জন্য আমার মনের এই যে কামনা, আমার হৃদয়ের এই যে আকুতি, এটাই এখন আমার বেঁচে থাকার অবলম্বন! সময়ের ঝড়, জীবনের ঝঞ্ঝা আমার স্বপ্নের, আমার আশা-আকাক্সক্ষার পুরো বাগানটি তছনছ করে দিয়ে গেছে। বেঁচে থাকার সব অবলম্বন গুঁড়িয়ে দিয়ে গেছে।

এখন জীবনের উদ্যানকে আবার নতুন করে সাজাতে চাই শুধু তোমার জন্য; তোমকে নতুন ফুলের, নতুন সুবাসের এবং নতুন স্বপ্নের নতুন দিগন্তে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সবকিছু হারিয়ে, রিক্ত নিঃস্ব হয়ে এভাবেই এখন আমি বেঁচে থাকতে চাই তোমার এবং তোমাদের জন্য স্বপ্নের নতুন জাল বুনে, পরম সত্তার প্রতি পূর্ণ নিবেদিত থেকে!

***

রাত এখন কত! আমার এখানে গভীর নির্জনতা, তোমার ওখানে? আমি শুনতে পাই টিক টিক শব্দ, দেয়ালের ঘড়িতে এবং জীবনের ঘড়িতে! তুমি কি শুনতে পাও?

আমার এখানে আকাশ এখন মেঘলা, যেন কত দুঃখ তার! তোমার ওখানে? আমার এখানে মেঘের ফাঁকে ফাঁকে পূর্ণিমার চাঁদ হাসে এবং ঝিরঝির জোসনা ঝরে, তোমার ওখানে?

এই যে এখানে বাতায়নপথে আমি দেখতে পাই রাতের নির্জন আকাশে পূর্ণিমার চাঁদের নিঃসঙ্গ ও ভারাক্রান্ত যাত্রা!  তুমি কি দেখতে পাও তোমার বাতায়নপথে?

অন্তত এই সান্ত্বনাটুকু তোমাকে দিতে পারি, আজ ভরা পূর্ণিমার নির্জন রাতের আকাশে মেঘের সঙ্গে চাঁদের এই যে আলোছায়া, এই যে হাসি-কান্নার মিলনমেলা! এই যে ঝিরঝির জোসনায় আমার অবগাহন তা শুধু আমার জন্য নয়, তোমারও জন্য! আমি তো এখন বেঁচে আছি নিজের জন্য নয়, শুধু তোমার জন্য, তোমাদের সবার জন্য!!

এসো আজকের রাতের এ নির্জনতায় নিঃসঙ্গ চাঁদকে বলি; বারবার মেঘের আড়ালে চলে যাওয়া দুঃখী বিষণ্ন চাঁদকে বলি; আমার তোমার দুঃখের সঙ্গে একাকার হওয়া আমাদের প্রিয় চাঁদকে বলি, ‘আয় চান্দ, উন্েেস যাা ক্যর েেমরাা সালাাম ক্যহ্নাা’!!

***

এর চেয়ে সুন্দর সময় কি/কী আর হতে পারে, দিলের দরদ-ব্যথা, বুকের দহনযন্ত্রণা এবং হৃদয়ের ফোঁটা ফোঁটা রক্তক্ষরণের কথা আপনজনের কাছে বলবার জন্য! আপনজনের কাছ থেকে শোনবার জন্য!!

এসো আজ রাতের এ বিষণ্ন মধুর নির্জনতায় কিছু কষ্টের কথা বলি, কিছু কষ্টের কথা শুনি! এসো আজ আমার এবং তোমার হৃদয়ের কিছু ব্যথার, কিছু বেদনার এবং কিছু রক্তক্ষরণের বিনিময় করি!

কিসের ব্যথা? কিসের বেদনা? এবং কেন হৃদয়ের ফোঁটা ফোঁটা রক্তক্ষরণ?!

এই ধূলিমলিন পৃথিবীতে, এই কঠিন ও নির্দয় সংসারে আমরা যে জীবন যাপন করি তাতে, আমার, তোমার, আমাদের সবারই রয়েছে ব্যথা ও কষ্টের, বেদনা ও অতৃপ্তির এবং ফোঁটা ফোঁটা রক্তের নিজস্ব একটা জগত, খুব কাছের মানুষও যা কখনো জানতে পারে না; জানবে কী, কাছের মানুষই তো অনেক সময় এবং বেশীর ভাগ সময়...!!

এই সব কষ্টের কথা, এই সব ব্যথা ও বেদনার কথা, আপনজনদের এই সব আঘাত-যন্ত্রণার কথা থাক, আমারগুলো আমার কাছে, তোমারগুলো তোমার কাছে। এগুলো সঙ্গে করেই তো আমার আগে বহু মানুষ কবরে গিয়েছে, আমিও যাবো, তুমিও যাবে। জীবনের অমোঘ দাবী কে অস্বীকার করতে পারে! সময়ের আঘাত-যন্ত্রণা কে উপেক্ষা করতে পারে!

আমাদের এই দু’দিনের জীবন বিগত হওয়ার পরো জীবনের অঙ্গনে অব্যাহত থাকবে বিক্ষত হৃদয়ের ‘সাদা-লাল অশ্রুর প্রবাহ’। এবং অব্যাহত থাকবে জীবন-মৃত্যুর সেতুবন্ধন। ঈমান ও বিশ^াসের কল্যাণে আমার তোমার তো অন্তত এই সান্ত্বনা রয়েছে, এ জীবনের প্রতিটি কষ্টের বিনিময়ে ঐ জীবনে রয়েছে অনন্ত হাসির ফোয়ারা! এ জীবনের প্রতিটি কাঁটার আঘাত ঐ জীবনের চিরসুখের উদ্যানে হবে একটি করে ফুল!!

এই সব কষ্টের কথা, এই সব ব্যথা-যন্ত্রণার কথা এবং এই সব রক্তঝরা আঘাতের কথা শুধু তাকেই বলবো যিনি যখমি দিল ও বিক্ষত হৃদয়ের আর্তনাদ শুনতে ভালোবাসেন এবং ...!!

***

জীবনের খুব সামান্য যে সময়টুকু আছে তাতে আমরা নিজেদের সব ব্যথা-কষ্টের কথা ভুলে এসো অন্যকিছু কষ্টের জন্য, অন্যরকম কিছু ব্যথাবেদনার জন্য নিবেদিত হই!

যে ব্যথা ও কষ্টের জন্য আজ আমরা অস্থির হতে চাই; যে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রুর জন্য এখন আমরা অশ্রুনিবেদন করতে চাই, যে ফোঁটা ফোঁটা রক্তের জন্য আমরা বুকের রক্ত উৎসর্গ করতে চাই, এসো সবার আগে সেই কষ্টের সঙ্গে, সেই অশ্রুর সঙ্গে এবং সেই ফোঁটা ফোঁটা রক্তের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করি; সেগুলোর সঙ্গে হৃদয় ও আত্মার বন্ধন গড়ে তোলার চেষ্টা করি!

যদি জানতে চাও, কাকে বলে ব্যথা ও কষ্ট! কাকে বলে আঘাতের যন্ত্রণা! কাকে বলে অশ্রুর কান্না এবং রক্তের আর্তনাদ তাহলে তোমাকে যেতে হবে কাশ্মীরের মযলুমানের কাছে, বিধ্বস্ত আরাকানের আগুন-ধোঁয়ার কাছে; তোমাকে যেতে হবে ফিলিস্তীনের সেই অসহায় মুসলিমানের কাছে, অন্ধ সভ্যতা যাদের বিরান ভূমি দেখতে পায় না; বধির মানবতা যাদের আর্তনাদ শুনতে পায় না! তোমাকে যেতে হবে ঐ সব মুসলিম জনপদে যেখানে দিনের আলোতেও আলো থাকে না; যেখানে রাতের আঁধারেও হায়েনাদের হিংস্রতা থেকে বাঁচা যায় না!!

তোমাকে যেতে হবে ঐ সব ‘যিন্দা কবরস্তানে’ যেখানে সর্বগ্রাসী ক্ষুধা আছে, একটুকরো রুটি নেই; যেখানে বুকফাটা পিপাসা আছে, কয়েক কাতরা পানি নেই; যেখানে রোগ-ব্যাধির মহামারী আছে, আছে মৃত্যুর ভয়াল থাবা, নেই ন্যূনতম সান্ত্বনার চিকিৎসা; যেখানে ছিন্নভিন্ন লাশ আছে, একটুকরো কাফনের উপায় নেই এবং নেই দাফন করার...; যেখানে কবর নেই, আছে শুধু ‘গণকবর’!

নিজেদের ছোট-বড় কষ্টের কথা, নিজেদের ফোঁটা দু’ফোঁটা অশ্রুর কথা, কয়েক ফোঁটা রক্তের কথা ভুলে গিয়ে এসো আমরা দূরের কাছের আমাদের ভাইবোনদের ব্যথা ও কষ্টের জন্য ব্যাকুল হই; এসো আমরা তাদের জন্য ব্যথিত হই; তাদের জন্য কাঁদি রক্তের কান্না! ‘কা-জাসাদিন ওয়াহিদিন’-এর এটাই তো বার্তা আমাদের কাছে! যবানে নবুয়তের এ মহান বার্তা বিস্মৃত হয়ে এবং ইয়া নাফসীর ধোকায় পড়েই তো আজ আমাদের এত যিল্লতি, এত দুর্গতি! এমনকি এই যে আমরা ব্যক্তিজীবনের দুঃখ-কষ্ট ও অতৃপ্তিগুলোর জন্য দৃশ্য-অদৃশ্য কোন ‘লোক’ থেকেই পাই না সান্ত্বনার একটুখানি শীতল পরশ, এর জন্যও দায়ী আমাদেরই হৃদয় ও আত্মার এই আত্মকেন্দ্রিক-তা। আমাদের কান্না শুধু নিজের জন্য, আমাদের অশ্রু শুধু ‘আপনজনের’ জন্য এমনকি আমাদের রক্তও নয় অন্য কারো জন্য!

তাই আমাদের নিভৃত জীবনেও আমরা এত দরিদ্র ও নিঃসঙ্গ, এত রিক্ত, নিঃস্ব ও অসহায়!

এসো আজ শরীরসত্তার কষ্ট-ব্যথা ও আঘাত-যন্ত্রণাগুলো বিসর্জন দিয়ে হৃদয় ও আত্মার জগতে কিছু তৃপ্তি, কিছু প্রাপ্তি অর্জন করি।

নিজের জন্য অনেক কেঁদেছি, অনেক অশ্রু ঝরিয়েছি। এতো যে আহাজারি আর্তনাদ করেছি; কিছ্ুই তো পাইনি। ব্যথা ও ক্ষতের উপশম, যন্ত্রণা ও বঞ্চনা থেকে মুক্তি, কিছুই তো ঘটেনি! এসো আজ ঈমান ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে শ্রদ্ধা জানিয়ে, এসো আজ আমরা তাদের ব্যথায় কাঁদি, তাদের দুঃখে শোকে অশ্রুনিবেদন করি, যারা আমাদের ভাই;  রক্তের না হলেও ঈমান ও বিশ^াসের বন্ধনে যারা আমার অতি আপন, অতি প্রিয়!

এসো আজ সেই মাযলুমানের জন্য ফরিয়াদ করি, ঈমান ও বিশ^াসের অপরাধে যাদের সম্পদ সম্ভ্রম সবকিছু লুণ্ঠিত, অথচ তাদের পাশে দাঁড়াবার কেউ নেই, না আপন, না পর! না মানুষ ও মানবতা, না পশু ও ‘পাশবতা’!

এসো আজ দাউ দাউ আগুনের ঐ জনপদগুলোর জন্য আর্তনাদ করি যেখানে ভাঙ্গা মিনার থেকে আর আযান ধ্বনিত হয় না! এমনকি আগুন-তুফানের মধ্যে নতুন যে মেহমানটি এসেছে, তার কানে আযান দিতেও যেখানে কারো সাহস হয় না!

উদরপূর্তি অনেক হয়েছে, এসো আজ নিজেদের ক্ষুধার অন্ন ক্ষুধার্ত শিশুদের মুখে তুলে দিই।

আপনজনের কবর চোখের পানিতে অনেক ভিজিয়েছি। এসো আজ অন্তত দূর থেকে ঐ সব ‘মাটিচাপা’ মানুষের উদ্দেশ্যে দু’ফোটা চোখের জলে একবার ‘ফাতেহা’ পড়ি, যারা পিষ্ট হয়েছে বুলডোজরের নীচে। হয়ত তাতে আমাদের জীবন বেঁচে যাবে মর্মন্তুদ পরিণতির হাত থেকে। *

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা