রবিউছ ছানী ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

সম্পাদকীয়

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

জীবন ও জীবিকার মূল্য যেন বুঝি!

জীবন ও জীবিকা, শুনতে কাছাকাছি হলেও দু’টোর তাৎপর্য এক নয়! ভাবে, মর্মে ও মূল্যে জীবন ও জীবিকার মধ্যে রয়েছে আকাশ-পাতাল পার্থক্য।অবশ্য পার্থক্য যতই থাক, তিক্ত সত্য এই যে, জীবিকা ছাড়া জীবন অচল, আবার জীবন ছাড়া জীবিকা মূল্যহীন। তাই ইসলাম যেমন জীবনের ধর্ম তেমনি ধর্ম জীবিকারও। কোরআনে যেমন রয়েছে ক্ষণস্থায়ী জীবন ও চিরস্থায়ী জীবনের নিগূঢ় তত্ত¡ তেমনি রয়েছে জীবিকার প্রতি জোরালো আহŸানÑ যখন ছালাত আদায় হয়ে গেলো তখন ভ‚খÐে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহ্র অনুগ্রহ (জীবিকার) সন্ধান করো।সুন্নাহ্ যেমন বলেছে, দুনিয়া মুসাফিরখানা, তেমনি বলেছে, ইবাদত যেমন ফরয, হালাল জীবিকাও ফরয।

***

জীবন ও জীবিকা সম্পর্কে হঠাৎ এ চিন্তার কারণ! সেদিন চলার পথে দেখলামÑ মাঝে মধ্যেই দেখি, তবে সবসময় চিন্তার দুয়ারে ‘দস্তক’ শুনতে পাই না এবং ভিতরের চেতনা জাগ্রত হয় না! সেদিন দেখলাম, আর হঠাৎ করেই যেন চিন্তার দরজায় ‘করাঘাত’ হলো এবং আমার অন্তর্সত্তা বিচলিত হলো। দেখলাম, সড়ক  ও জনপথ বিভাগের পক্ষ হতে একটি সতর্কবাণীÑধীরে চলুন, জীবনের চেয়ে জীবিকা বড় নয়। গুরুত্বপূর্ণ সতর্কবাণী সন্দেহ নেই, তবে মনটা প্রসন্ন হলো না! জীবনকে যেন ছোট করা হয়েছে! ধীরে চলার জন্য জীবন ও জীবিকার দর্শন ব্যবহার করতে হবে! তাছাড়া মানুষ কি শুধু জীবিকার জন্য গতির পিছনে ছোটে!মনে হলো, কোথায় যেন জীবিকার প্রতিও রয়েছে প্রচ্ছন্ন অসম্মান!যার ঘরে ক্ষুধা-অনাহার নিত্যসঙ্গী! জীবনের নির্দয় বাস্তবতায় সন্তানের মুখে দু’মুঠো অন্ন যোগাতে যে বাবা পর্যুদস্ত তার কাছে হয়ত মনে হবে, জীবিকার জন্য তার দৌড়ঝাঁপকে...!জীবন ও জীবিকার সঠিক যে সম্পর্ক তা জেনেছিলাম, দূর অতীতে প্রায় শৈশবে, আজো স্মৃতিতে যা উজ্জ্বল।এখানে বলতে হয় মানুষের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা জীবনবাদী দার্শনিক শেখ সা‘দী রহ.র কথা। পৃথিবীতে বড় দার্শনিক ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন, তবে সাধারণত তাদের বসবাস কল্পনার রাজ্যে, জীবনের অঙ্গনে তাদের বিচরণ কম। শেখ সা‘দীর আলাদা মর্যাদা এখানেই যে, তিনি দর্শনের জগতে বিচরণ করেছেন, তবে বাস করেছেন জীবনের অঙ্গনে! জীবন ও জীবিকা সম্পর্কে তিনি বলেছেনÑ  জীবনের জন্য খাবার, খাবারের জন্য জীবন নয়!

***

আচ্ছা, এবার আসি জীবনের প্রসঙ্গে! আমরা কি জীবনের মূল্য বুঝতে পেরেছি! বুঝতে পারিনি। তাই খেলাধূলায় আমরা হতে পারি এমন মগ্ন ও নিমগ্ন! তাই জীবনের বিনিময়ে পর্বত-আরোহণ করে আমরা পাই বীরের মর্যাদা।জীবনের মূল্য আমরা বুঝতে পারিনি, তাই আমাদের যুবসমাজ মাদকাসক্ত। তাই মাদকবাণিজ্যের বাজার এখন হাজার কোটি ছাড়িয়ে! তাই জীবনকে আমরা তিলে তিলে নিঃশেষ করতে পারি নেশার ধোঁয়ার মধ্যে।জীবনের মূল্য যদি বুঝতে হয় তাহলে শুনতে হবে জীবনের ¯্রষ্টার কথা, কী উদ্দেশ্যে তিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন! জানতে হবে আমাদের জীবনের পরিধি কত! জানতে হবে, জীবন যদি উদ্দেশ্যের পথে পরিচালিত হয় তাহলে তার প্রতিদান কী! জীবন যদি উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয় তাহলে তার পরিণাম কী! জীবন যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনি জীবনকে নির্ধারিত উদ্দেশ্যের পথে যাপনের জন্য পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থাও পাঠিয়েছেন!কিন্তু সমস্যা এখানে নয়, এত উপরে নয়; সমস্যা আরো নীচে, অনেক গভীরে। আমরা তো জীবনের ¯্রষ্টাকেই চিনতে পারিনি! জীবনের উদ্দেশ্য জানবো কী করে! জীবনের মূল্য বোঝবো কী করে! জীবনের ¯্রষ্টাকে যেন আমরা চিনতে পারি, তাই তিনি বড় দয়া ও মায়ার সঙ্গে বলেছেন, আকাশ দেখো, চাঁদ-সূর্য ও তারা দেখো, মেঘ দেখো, বৃষ্টি দেখো, ভ‚মি দেখো, ভ‚মির ফুল-ফল ও ফসল দেখো, আমাকে চিনতে পারবে। জীবনের ¯্রষ্টা আমাদের আরো বলেছেন, আর কিছু না হোক, তোমরা নিজেদের মধ্যে একটু উঁকি দিয়ে দেখো না! তোমাদের চোখ-কান-নাক-মুখ, তোমাদের হাত-পা ও জিহŸা! তোমাদের হৃদয় ও হৃদপিÐ! তোমাদের ধমনীতে প্রবাহিত রক্ত! তোমাদের এমন সূ²জটিল মস্তিষ্ক! তোমাদের দেহে রোগ ও রোগপ্রতিরোধ -ব্যবস্থা! তারপরো কি তোমরা চিন্তে পারো না আমাকে, তোমাদের জীবনের ¯্রষ্টাকে!যারা অন্তর্দৃষ্টির অধিকারী তারা অবশ্যই চিনতে পেরেছেন জীবনের ¯্রষ্টাকে এবং বুঝতে পেরেছেন জীবনের মূল্য। তাই জীবনকে তারা পরিচালিত করেছেন ¯্রষ্টার দেয়া জীবনব্যবস্থা অনুসরণ করে!

***

জীবনের মূল্য যারা বুঝেছেন, জীবিকার মূল্যকে তারা মোটেও অবজ্ঞা করেননি। জীবন যাদের কাছে পবিত্র, জীবনের জন্যই জীবিকাও তাদের কাছে পবিত্র। জীবিকার পবিত্রতা রক্ষার জন্য জীবনের ¯্রষ্টার কাছেই তারা প্রতিশ্রæতিবদ্ধ। কারণ তাঁর সুস্পষ্ট আদেশ, তোমরা হালালে তাইয়েব গ্রহণ করো, খাবীছ ও হারাম বর্জন করো।জীবনের জন্য জীবিকা মূল্যবান বলেই আমরা আশ^াসবাণী পেয়েছিÑ আমার উপর যে ভরসা করবে (আর সাধ্যমত পরিশ্রম করবে) আমি তাকে অকল্পনীয় উপায়ে রিযিক দান করবো।জীবনের জন্য জীবিকার মূল্য জানতেন বলেই আরবের ্্উম্মী মানুষটি, হাতপাতা মানুষের হাতে কুড়াল তুলে দিয়েছেন, আর বলেছেন...!জীবিকার মর্যাদা তিনি জানতেন বলেই তো এমন স্থির প্রত্যয়ের সঙ্গে বলতে পেরেছেনÑ উপরের হাত নীচের হাত থেকে উত্তম!তিনি জানতেন জীবনের মূল্য, তাই বলতে পেরেছেন, একবছর আগে শহীদ হওয়া এবং একবছর পরে মৃত্যুবরণ করা দুই মুমিনের পার্থক্য! শুধু জ্ঞানী বা দার্শনিক হলেই এত বড় সত্য এত সুন্দর করে বলা যায় না। এভাবে তিনিই বলতে পারেন, জীবনের ¯্রষ্টার সঙ্গে রয়েছে যার নিবিড় সংযোগ! যিনি আকাশ থেকে বার্তা লাভ করেন, তারপর জীবনের কথা বলেন এবং মৃত্যুর কথা বলেন, এমনকি কবরের কথা, হাশরের কথাও বলেন। জীবনের সঙ্গে তিনি জানতেন জীবিকারও মূল্য, তাই বলতে পেরেছেন, সত্যবাদী, আমানতদার তাজির (জান্নাতে থাকবে) নবীদের সঙ্গে এবং...!আমাদের এ দুর্ভাগা দেশটার কথা একবার কল্পনা করো তো! এখানে কেউ যদি মুনাফার লোভে বাণিজ্য না করে, সবাই যদি তিজারাত করে সত্য ও সততার সঙ্গে, মানুষের কল্যাণের চিন্তায় এবং নিজের জন্য হালাল জীবিকার চিন্তায় তাহলে ...তাই তিনি বলতে পেরেছেন, জীবিকার জন্য রোদ মাথায় যিনি শ্রম দেন তার ঘামের মূল্য কত এবং কীভাবে আদায় করতে হবে তার ঘামের মূল্য! রিযিকের জন্য যার শরীর থেকে ঘাম ঝরে, তিনি যদি ভাবেন, আমার ঘামে জমিতে যত ফসল ফলবে তাতে আমার দেশের মানুষের ক্ষুধা দূর হবে। তাই আমি আরো শ্রম দেবো, আরো ঘাম ঝরাবো, আর দেহ ও দেহের ঘাম যার, আমার প্রতিদান আমি তাঁর কাছ থেকে নেবো।পক্ষান্তরে আমি তুমি যদি মনে করি, শ্রমিকের শ্রম ও কৃষকের ঘাম তো আমারই জন্য! শ্রমিকের শ্রমে তো আমারই কষ্ট দূর হয়, আমার প্রয়োজন পূর্ণ হয়! কৃষকের ঘামে তো আমারই ক্ষুধা দূর হয়, আমারই জীবন রক্ষা হয়! এমন উপকারী বন্ধুর ঘর্মাক্ত দেহটা একবার আমি আলিঙ্গন করি না কেন!আমাদের জীবনে এত অশান্তি কেন! তদুপরি জীবিকার এত সঙ্কট কেন! এত শ্রম, এত ঘাম, তবু শ্রমিকের মুখে হাসি নেই কেন! তবু কৃষকের দেহ এত জীর্ণ-শীর্ণ কেন! তার ঘামে ফলানো ফসল তার ঘরে নেই কেন!এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে সুশীল সমাজ হয়ত সম্মেলনের আয়োজন করবে! যারা লেখক-বুদ্ধিজীবী তারা হয়ত কাগজ কলম নিয়ে বসে যাবেন! হয়ত তারা সমাধান দেবেন, পুঁজি ও বিনিয়োগের বাজারব্যবস্থার মাধ্যমে এবং চাহিদা ও সরবরাহের সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে।যারা বড় বড় দার্শনিক তারা শুধু মুচকি হেসে বলবেন, একমাত্র সমাধান হলো ‘শ্রেণীসংগ্রাম’ এবং দুনিয়ার মজদুর এক হও!কিন্তু আমি তোমাকে নিয়ে যেতে চাই চিরন্তন সত্যের কাছে! ঐ শোনোÑ স্থলে ও জলে ফাসাদ ছড়িয়ে পড়েছে মানুষেরই কর্মের ফলে...!ঐ শোনো আরবের উম্মী নবীর দরদী উচ্চারণÑশরীরের ভিতরে রয়েছে একটি ‘অঙ্গ’; যদি তা ঠিক হয়ে যায় তাহলে সারা শরীর ঠিক হয়ে যায়। আর যদি তা নষ্ট হয়ে যায় তাহলে সারা শরীর নষ্ট হয়ে যায়। শোনো, সেটা হচ্ছে কলব ও হৃদয়, (যা হৃদপিÐের প্রকৃত রূপ)।এবার শোনো আমাদের জন্য আকাশ থেকে নেমে আসা মূল্যবান বার্তাটিÑ ‘তারা যদি ঈমান আনতো, আর তাক্বওয়া অবলম্বন করতো তাহলে আকাশ থেকে এবং ভ‚মি থেকে সমস্ত বরকতের দুয়ার আমি খুলে দিতাম, কিন্তু তারা তো তাকযীবের পথ ধরেছে...!’এসো আমরা জীবনের মূল্য বুঝি! এসো জীবনের উদ্দেশ্যের পথে চলি! এসো জীবিকার মূল্য বুঝি! এসো জীবিকার পবিত্রতা রক্ষা করি।

***

সড়ক ও জনপথ বিভাগ তখন লিখতে পারবেন, ‘ধীরে চলুন, জীবনের মূল্য বুঝুন! জীবিকার জন্য ¯্রষ্টার উপর ভরসা করুন।

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা