মুহাররম ১৪৪৫ হিঃ

তোমাদের পাতা

জীবনের পাথয়

আমার স্মৃতি; কিছু সুখের, কিছু দুঃখের! - ৭

লিখেছেনঃ শায়খুল ইসলাম আল্লামা মুফতি তক্বী উছমানী (দা.)

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

আব্বাজান ও আম্মাজান এতদিন, লাসভিলায় আমাদের যে বাড়ী সেখানেই থেকে আসছিলেন। আমাদের বড় দু’ভাইও তাঁদের সঙ্গে থাকতেন। আমরা দু’ভাই, দারুল উলূম শারাফীতেই থাকতাম। সপ্তাহের ছুটিতে শুধু একটি দিন ও একটি রাত্রের জন্য, আর অন্যান্য ছুটিতে কয়েকদিনের জন্য আমাদের সেখানে যাওয়া হতো। দারুল উলূমের প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনাগত দায়িত্বের দাবী তো ছিলো আব্বাজানের স্থায়ী বসবাসও দারুল উলূমেই হবে। কিন্তু শহরেও তার বহুমুখী ব্যস্ততা ও দায়দায়িত্ব ছিলো, যার জন্য শহরে অবস্থান করা ছিলো খুব জরুরি। একসময় দারুল উলূমের দাবীই প্রবল হয়ে উঠলো এবং আব্বাজানের মনে হলো, শহরের ব্যস্ততা যত গুরুত্বপূর্ণই হোক এখন দারুল উলূমের দাবী রক্ষা করাই সময়ের দাবী। তখন তিনি শহরের পাট চুকিয়ে দারুল উলূমে চলে আসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। বলাবাহুল্য, এ সিদ্ধান্ত তাঁর জন্য কঠিন ছিলো, তবে দারুল উলূমের দিক থেকে অনিবার্য ছিলো। হাজী কবীরুদ্দীন মারহূম ছাহিবের তৈরী যে দু’টি কামরায় আমরা থাকতাম তার সংলগ্ন আরো দু’টি কামরা তৈরী করা হলো, যার ছাদ ছিলো...। এভাবে শেষ পর্যন্ত ৯ই যীকা‘দাহ ১৩৮২ হি./ ৪ঠা এপ্রীল ১৯৬৩ খৃ তারিখে আব্বাজান-আম্মাজান লাসভিলার বাড়ী ছেড়ে  দারুল উলূম চলে এলেন। তাতে আমাদের খুশির যেন কোন ঠিকানা ছিলো না! কেননা একে একে ছয়টা বছর মা-বাবার স্নেহছায়া থেকে দূরে থাকার পর স্থায়ীভাবে তাঁদের মমতার শীতল ছায়ায় বাস করার সুযোগ এসে গিয়েছিলো। তাছাড়া আব্বাজানের কাছ থেকে যখন ইচ্ছা তখন ইলমী ও তারবিয়াতি ফায়দা হাছিল করার নেয়ামতও হাছিল হয়ে গিয়েছিলো। হজ্বের মউসুম নিকটবর্তী ছিলো, আর আব্বাজানেরও হজ্বের নিয়ত ছিলো। সুতরাং এখানে আসার অল্পকিছুদিনের মধ্যেই হজ্বের আয়োজন ইন্তিযাম শুরু হয়ে গেলো। আব্বাজানের সঙ্গে আম্মাজান এবং ভাই মুহম্মদ রাযী ছাহেব রহ. হজ্বের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলেন। মা-বাবার সৌভাগ্য তো সন্তানেরই সৌভাগ্য, সুতরাং তাদের এ হজ্বসফর আমার জন্যও বড় সৌভাগ্যের বিষয় ছিলো। তবু আবার কিছুদিনের জন্য তাঁদের বিচ্ছেদ ও একাকিত্বের কষ্ট আমার উপর এসে ভর করেছিলো। জীবনে আনন্দ ও বেদনা এভাবেই পাশাপাশি চলতে থাকে। তবে এবার একাকিত্বের কষ্ট অতটা পীড়াদায়ক হতে পারেনি, কারণ আমার বহুমুখী কর্মব্যস্ততা আমাকে একেবারে ডুবিয়ে রেখেছিলো। একে তো ছিলো দারুল উলূমে শিক্ষকতা, ইফতা ও লেখার দায়িত্ব, তদুপরি ছিলো ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেয়ার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি।

শাওকে হারাম, শাওকে যিয়ারাত

অন্তরে যাদের ঈমান আছে, তারা তো ঈমানের দাবীতেই বাইতুল্লাহর প্রতি আকুল এবং রাওযাতুন্নবীর প্রতি ব্যাকুল হবে এবং এটাই স্বাভাবিক। তবে এপর্যায়ে আমার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে আলাদা একটি অনুষঙ্গ যুক্ত হয়েছে। দাওরায়ে হাদীছের বছর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীরাত ও সুন্নাহর সঙ্গে গভীর ও নিবিড় সম্পর্কের কল্যাণে সেই আকুলতা ও ব্যাকুলতা রীতিমত ‘তড়প’ ও অস্থিরতায় পরিণত হলো। দিন-রাত আমার তখন একই চিন্তা, একই স্বপ্ন- কবে হবে আমার যিয়ারাতে বাইতুল্লাহ এবং যিয়ারাতে রাওযাতুন্নবী! হবে তো! এটা সত্য যে, আল্লাহ্ তা‘আলার অশেষ দয়া ও মেহেরবানিতে শৈশবে আব্বাজান-আম্মাজান রহ.র সঙ্গে হজ্বের সৌভাগ্য অর্জিত হয়েছিলো, যার সংক্ষিপ্ত আলোচনা পিছনে করে এসেছি। কিন্তু আমি তো তখন আটবছরের শিশু! পানির জাহাযে যাওয়ার পথে এবং আসার পথে পুরো জাহাযজুড়ে ছোটাছুটির আনন্দই ছিলো আমার কাছে প্রধান। হজ্ব ও যিয়ারাতের হালকা কিছু ছায়া ও ছাপই শুধু স্মৃতির মধ্যে ছিলো, এর বেশী কিছু না! তখন সেই অনুভব-অনুভূতি কোথায় যার দ্বারা হজ্ব ও যিয়ারাতের আযমত ও পবিত্রতা অন্তরে জাগ্রত হবে! সেই রূহানিয়াত ও নূরানিয়াত কোথায় যার দ্বারা ঐ মাকামাতে মুকাদ্দাসা ও পবিত্র স্থানসমূহের সঙ্গে অন্তরের নিবিড় সম্পর্ক তৈরী হবে এবং সেগুলোর আধ্যাত্মিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব কিছু পরিমাণে হলেও বুঝে আসবে! কিন্তু বিশেষ করে দাওরাতুল হাদীছের বছর থেকে দিলের দুনিয়া এবং হৃদয়ের জগতই যেন অন্যরকম হয়ে গেলো! সারা অন্তরজুড়ে শুধু শাওক ও তামান্না এবং আকাঙ্ক্ষা ও আকুতি! যখনই আল্লাহর ঘরের উদ্দেশ্যে হজ্ব ও ওমরার কাফেলা রাওয়ানা হতো, হাসরত -ভরা দিল ও বিষণ্ন হৃদয় নিয়ে অশ্রুসিক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতাম!আমার কল্পনা আমাকে নিয়ে যেতো ঐ কাফেলার সঙ্গে! আমিও দেখতে পেতাম, কী জোশ ও জাযবা এবং কী আবেগ ও উদ্দীপনা নিয়ে তারা তাওয়াফ করছে, মীনায় আরাফা ছুটে যাচ্ছে! তাদের মুখের লাব্বাইক ধ্বনি নিজের কানেই যেন শুনতে পেতাম! কীভাবে যেন তাদের সঙ্গে আমি একাত্ম হয়ে যেতাম। কিন্তু বাস্তবের জগতে তারা কোথায়, আর আমি কোথায়! তারা তো দূর হিজাযে মক্কার পথে পথে, মদীনার গলিতে গলিতে, আর আমি আজমের ঊষর ভূমিতে! তখন বিগলিত হৃদয় থেকে কিছু ফরিয়াদ ও আহাযারি যেন আসমানের দিকে উঠে যেতো! আয় আল্লাহ্ আমাকেও তুমি এ মহাসৌভাগ্য দান করো! আমার উপায় নেই, উপকরণ নেই, তবে তোমার কুদরতের কাছে অসম্ভব তো কিছুৃ নেই!

এরই মধ্যে মুহাররম ১৩৮২ হি./ জুন ১৯৬২ খৃ. আমার বড় বোন মুহতারামা আতীকা খাতুন (রহ.), আমরা যাকে বলি ‘আপাবী’  তিনি হজ্বের সফর থেকে ফিরে এলেন। তখন আমি তাঁর হজ্বসফরকে স্বাগত জানিয়ে যে কবিতা লিখেছিলাম তা থেকে আমার তখনকার দিলের তড়প ও হৃদয়ের ব্যাকুলতা কিছুটা হলেও অনুভব করা যাবে। (তরজমা): আপাবী, তুমি ধন্য, তোমাকে মোবারকবাদ! রূহানিয়াতের জগতে বড় সম্পদ তুমি অর্জন করেছো। সব নেয়ামতের বড় যে নেয়ামত তাই তুমি হাছিল করেছো। হাবীবের ‘দর ও দীওয়ার’ দেখে আসা তোমার ধন্য হোক! করুণাময়ের করুণার ‘আশা-অঞ্জলি’ পূর্ণ করে ফিরে আসা তোমার ধন্য হোক! তোমার কদম বাইতুল্লাহর তাওয়াফ করেছে, বাতহার উপত্যকায় কঙ্কর চুমু খেয়েছে, এর চে’ বড় সৌভাগ্য আর কী হতে পারে! আমার তো আসে ‘রাশ্ক’ ঐ নিগাহের প্রতি যা দেখে এসেছে নবীর সিজদাগাহ! বড় খোশকিসমত তোমার নিগাহ! আয় মাওলা, আয় করীম, তোমার এই গোনাহগার বান্দার প্রতি, এই দয়া ও অনুগ্রহ করো, একটু করো; একবার আবার তাকে পৌঁছে দাও ওয়াদিয়ে বাতহার কঙ্করভূমে!

মোটকথা, অন্তরে যেমন শাওক ও তামান্না ছিলো, হৃদয়ে যেমন আকুতি ও মিনতি ছিলো তেমনি আল্লাহর করুণা ও রহমতের প্রতি এ আশা ও ভরসাও ছিলো যে, দয়াময় আল্লাহ্ অবশ্যই তাঁর এই নালায়েক বান্দার উপর দয়া করবেন এবং এই উত্তাপপূর্ণ মুনাজাত তাঁর দরবারে অবশ্যই কবুল হবে! তবে বাস্তব অবস্থা ছিলো এই যে, না উপায় আছে, না আসবাব আছে! না মাধ্যম আছে, না অবলম্বন আছে! ব্যস, শুধু আকুতি ছিলো, আর রহমতের উপর ভরসা ছিলো! কারণ তাঁর রহমতের বারিশ ও করুণার বৃষ্টি যখন হয় তখন...!

১৯৬৩তে হযরত আব্বাজান, হযরত আম্মাজান এবং ভাই মুহম্মদ রাযী ছাহেব রহ. হজ্বের সফরে রওয়ানা হয়েছিলেন, একথা তো আগেই বলেছি। আমার রোযনামচায় ১৪ই মে ১৯৬৩/৩সরা মুহররম ১৩৮৩ হি. তারিখের পাতায় নিজের এ লেখাটি দেখতে পেলাম- ‘রাত এখন দু’টো, আমাকে আচ্ছন্ন করে আছে বড় প্রশান্তিপূর্ণ একটি নীরবতা ও নির্জনতা! এই নির্জনতার ছায়ায় আমি ঐ সমস্ত আনন্দদায়ক ঘটনা কল্পনা করছি, যা আজকের দিনটি তার আঁচলে করে নিয়ে এসেছিলো। আজ সকালে প্রথমে তো আমার ইন্টারের দ্বিতীয় পত্র অত্যন্ত স্বস্তিদায়কভাবে পূর্ণ হয়েছে। সন্ধ্যা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত সময়টা বড় কষ্টের সঙ্গে পার হলো। কারণ আজ আব্বাজান-আম্মাজান দিয়ারে হাবীব ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রত্যাবর্তন করার কথা ছিলো। উড়োজাহায রাত এগারটায় পৌঁছলো, আর রাত একটায় তারা ঘরে তাশরীফ নিয়ে এসেছিলেন। দিয়ারে হাবীবের আবেগপূর্ণ বৃত্তান্ত শুনে মনের যে অবস্থা এবং দিলের যে হালাত হয়েছে তা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয। ঐ সমস্ত মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের মাঝেই আমার ‘তুনমন’ সমাহিত থেকেছে, যেখান থেকে শান্তি ও নিরাপত্তার জীবনের বার্তা নিয়ে আলোর সূর্য সভ্যতার পূর্বদিগন্তে উদিত হয়েছিলো।

পরবর্তী দিনের রোযনামচায় লেখা ছিলো- আজ সারাদিন আমি কল্পনায় কল্পনায় শান্তি ও নিরপত্তার ঐ বসন্তবাহারে স্নিগ্ধ উপত্যাকা-গুলোতেই বিচরণ করেছি, যেখানে আজ থেকে চৌদ্দশ বছর আগে মানবতার রক্ষকগণ তাহযীব ও তামাদ্দুন এবং সভ্যতা ও সংস্কৃতির মশাল জ্বেলেছিলেন। আজ নিজেকে আমি হিজাযের পূণ্যভূমিতে, জীবনের প্রশান্তির কোলে দেখতে পাচ্ছিলাম। আমার কল্পনার দৃষ্টি ঐ সব খেজুরবাগানকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিলো যার শীতল ছায়ায় মুমূর্ষু মানবতা জীবনের সঞ্জীবনীসুধা ও আবেহায়াত পান করেছিলো, যেখান থেকে মানুষ ইনছাফ ও ন্যায়বিচারের শিক্ষা লাভ করেছিলো। কখনো কখনো আমি ঐ সমস্ত তলোয়ারের ঝলক চমক দেখতে পাচ্ছিলাম, যার ছায়ায় ঐ আলোর স্ফুরণ ঘটেছিলো, যা পরবর্তীকালে মাশরিক-মাগরিব আলোকিত ও প্লাবিত করেছিলো। কখনো কখনো আমি ঐ রূহানিয়াত ও নূরানিয়াতপূর্ণ মজলিসের আলো-আভা দেখতে পেতাম যার দীপশিখায় জগতের বুকে একসর্বোত্তম জীবনব্যবস্থার রূপরেখা উদ্ভাসিত হয়েছিলো। মাঝে মধ্যে ভাব ও আবেগের এবং আনন্দ ও প্রশান্তির অভাবিতপূর্ব এক অবস্থা আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখতো, তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি বাস্তবজগতে ফিরে আসতাম! তখন বুঝতাম, কল্পনা ও বাস্তব কত ভিন্ন, কল্পনায় যে আরবসাগর সহজেই পাড়ি দিয়েছি, বাস্তবে তার ঢেউগুলো মনে হয়েছে অলঙ্ঘনীয়। তখন কী হতো! কল্পনার সুরঝঙ্কার হারিয়ে যাওয়া বসন্তের শোকে কাতর বুলবুলির কান্নায় পরিণত হতো। বস্তুত যামানার বেরহম তুফান এবং সময়ের নির্দয় ঝড় সংবেদনশীল যে কোন মুমিনের অন্তরে এমনই উথাল-পতাল অবস্থা সৃষ্টি করে, যা কবির কবিতায় এভাবে প্রকাশ পায়- হে শ্রেষ্ঠ নবী, শ্রেষ্ঠ রাসূল, উম্মতের জন্য দু‘আ-মুনাজাতের এখনই তো সময়! দেখো, দেখো, তোমার এতীম উম্মতের উপর এসে পড়েছে কী কঠিন সময়! স্বদেশভূমি থেকে বিশ্বের উদ্দেশ্যে যে দ্বীনের যাত্রা হয়েছিলো কত না শান ও জৌলুসের সঙ্গে, সেই দ্বীন পরদেশে দেখো আজ কত মজবূর অসহায়!বস্তুত ঐ সময় হারামের আকুতি আমার অন্তর্জগতে কীভাবে প্রতিপালিত হয়েছে এবং পবিত্র ভূমির প্রতি হৃদয়ের আবেগ-উচ্ছ্বাস কেমন ছিলো তার কিছুটা প্রকাশ তখনকার রোযনামচার লেখায় অবশ্যই ঘটেছে। তবে বাস্তব অবস্থা এটাই ছিলো যে, আকাঙ্ক্ষাপূরণের আশু কোন উপায় নযরে আসছিলো না। কিন্তু হজ্ব থেকে প্রত্যাবর্তনের পর হযরত আব্বাজান এমন কিছু কথা বললেন, যা তার মত মানুষের পক্ষেই বলা সম্ভব ছিলো। তাতে অন্তরে আশার নতুন নতুন প্রদীপ প্রজ্বলিত হলো। আসলে এমন বাবার এমন ছায়া যার মাথার উপর তার তো...!

এর মধ্যে একটি সম্ভাবনার আলো যেন উঁকি দিলো। আব্বাজান জানালেন, ইসলামিক স্টীম শিপ কোম্পানির মালিক তাঁকে এই মর্মে একটি প্রস্তাব দিয়েছে যে, তাদের পানির জাহায হজ্বের পর যখন হাজীদের করাচী বন্দরে নামিয়ে, নতুন হাজীদের আনার জন্য জিদ্দা ফিরে যায় তখন তা প্রায় যাত্রিশূন্যই থাকে। তো এ সময় কেউ যদি ওমরার জন্য যেতে চায় সে নামমাত্র ভাড়ায় যেতে পারে। যদ্দুর মনে পড়ে, সেই নামমাত্রের চেয়েও কম ভাড়ার পরিমাণ ছিলো মাত্রই নব্বই টাকা।

তথ্যটা আমার জন্য যেন উদ্দীপকের মতই কাজ করলো! খুশির কোন সীমাই থাকলো না, স্বপ্নকে যখন বাস্তবের কিছুটা কাছে দেখতে পেলাম! এতদিন যা কল্পনার আবর্তে ঘোরপাক খাচ্ছিলো, একদিন পর এখন মনে হতে লাগলো, হয়ত স্বপ্নপূরণের শুভলগ্ন আসতে শুরু করেছে! তো আমি এবং আমার বড় ভাই মুহম্মদ রাযী সঙ্গে সঙ্গে এ সুবর্ণ সুযোগটি কাজে লাগাবার নিয়ত করে ফেললাম। আর নিয়ত মানে ইচ্ছা নয়, নিয়ত মানে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা এবং সর্বাত্মক প্রচেষ্টা। শুরুতে যে সমস্যাটা দেখা দিলো, আমার তো পাসপোর্টই নেই!  আর তখন আন্তর্জাতিক পাসপোর্ট বের করা বড় একটা কঠিন কাজ ছিলো, উর্দূর বাগধারায় যাকে বলে বাঘের ওলান থেকে দুধ আনা। তাছাড়া বিদেশের সফরের জন্য স্টেট ব্যাঙ্ক থেকে আলাদা অনুমতি নিতে হতো। অর্থাৎ বিদেশ ভ্রমণ আর হজ্ব-ওমরার সফর যেন প্রায় একই রকম ছিলো। তো পাসপোর্টসমস্যার এ মহাসমুদ্র কীভাবে পাড়ি দিলাম তা এক আলগ দাস্তান! অনেকগুলো পর্যায় ছিলো। প্রথম পর্যায় হলো পাসপোর্টের দরখাস্ত দেয়ার জন্য পুলিশ সদর দফ্তর থেকে মঞ্জুরি হাছিল করা। আর ঐ দুর্লভ বস্তুটি হস্তগত করার জন্য লাগাতার কয়েকদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা ওখানে ধরণা দিতে হয়েছে! আল্লাহর কোন বান্দা একবার যদি জানতে চাইতো, গরীব তালিবে ইলম কেন এভাবে বসে থাকে! আমার কাজ ছিলো পুলিশ-সদর দফতরের বারান্দায় যাকে পাই তাকেই তোশামোদ করে প্রয়োজনের কথা বলি, আর তাদের ‘বে-পাত্তা’ আচরণ মুখ বুজে সহ্য করি, এমন কি বড় নির্দয় তিরস্কারও শুনতে হতো! শুনতাম, কারণ আমাকে তো যেতে হবে আল্লাহর ঘরে আল্লাহর নবীর দেশে! মাঝে মধ্যে শুধু পেরেশানি হতো, সময় ফুরিয়ে আসছে বলে। যাক, কয়েকদিন এভাবে পার করার পর আল্লাহ্ আল্লাহ্ করে ‘এনওসি’ নামের কাগজটি হাতে এলো! এমন মায়াভরা চোখে কাগজটার দিকে তাকালাম যে নীরব একটা কান্নাই এসে গেলো!

এর পর শুরু হলো পাসপোর্ট দফতরে চক্কর লাগানো। তাই লাগালাম বেশ ‘খোশদিলে’। তারপর একসপ্তাহ ম্যাকলোড রোডের (বর্তমান চন্দ্রিগড় রোড) ‘মাটি চালার’ পর আল্লাহ্ অশেষ দয়ায় সমস্ত পর্যায় অতিক্রম করা হলো, এমনকি পাসপোর্টের উপর ভিসাও লেগে গেলো। আর ঐ যে ‘নব্বই রুপি’, সেটারও ব্যবস্থা কোন না কোনভাবে হয়ে গেলো। তারপর সেই শুভদিনটিও এসে গেলো, যখন নিজেকে আমি আবিষ্কার করলাম সফীনাতুল হুজ্জাজে ‘সম্মানিত’ যাত্রীরূপে। আমার শ্রদ্ধেয় বড় ভাইয়ের সঙ্গে যেদিন আমি ওমরার উদ্দেশ্যে সাফীনাতুল হুজ্জাজে আরোহণ করি, তারিখটি ছিলো ১৭ই মুহাররম ১৩৮৩ হি./১০ই জুন ১৯৬৩ খৃ.। এটা ছিলো প্রায় দশতলা একটা জাহায, দেখতে পুরো একশহরের মত। জাহাযটা যেহেতু হাজীদের দেশে ফেরত আনার জন্য জিদ্দাবন্দরে যাচ্ছিলো তাই বলতে গেলে যাত্রিশূন্য ছিলো। আর ঐ নব্বই টাকার মধ্যেই আমাদের প্রথম শ্রেণীর একটি আরামদায়ক কামরা দেয়া হলো, যেখানে আমাদের দু’ভাইয়ের সঙ্গে অন্যএকজন যাত্রী ছিলেন, তিনিও ওমরার যাত্রী। উদ্দেশ্যের অভিন্নতা দূরের মানুষকে কতটা কাছে আনতে পারে তার কিছু নমুনা ঐ সফরে দেখতে পেয়েছিলাম।জাহাযের কাপ্তান আগে থেকেই হযরত আব্বাজানের নিসবতে আমাদের উপর বেশ সদয় ছিলেন। এরমধ্যে, আমরা যখন কেবিনে এসে বসেছি, তার কিছুক্ষণ পর জাহাযের আরেকজন কর্মকর্তা দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, মুহম্মদ তক্বী উছমানী কে? আমার উত্তর পেয়ে তিনি বললেন, আমার নাম রশীদ। এই জাহাযের প্রধানপ্রকৌশলী। আমি আপনার একটি কিতাব পড়ছিলাম, আমাকে বলা হলো যে, আপনি জাহাযে আছেন, ওমরার উদ্দেশ্যে জিদ্দা যাচ্ছেন। তাই আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য এসে পড়লাম। এভাবে জাহাযের দু’জন বড় দায়িত্বশীল কাপ্তান ও প্রধান প্রকৌশলীর সঙ্গে জানাশোনা হয়ে গেলো, যার সুবাদে জাহাযের পুরো ‘আমালা’ সফরের পুরো সময় আমাদের প্রতি সহানুভূশীল ছিলো। কাপ্তান ও প্রধান প্রকৌশলী আমাদের জাহাযের ব্রীজ থেকে শুরু করে ইঞ্জিনরূম পর্যন্ত সবকিছু পরিদর্শন করালেন এবং জাহায পরিচালনার সমস্ত কলাকৌশল বোঝালেন, এমননি কিছু সময়ের জন্য জাহাযের স্টিয়ারিং পর্যন্ত আমার/আমাদের হাতে ছেড়ে দিলেন। জাহায চলছে হিজাযের অভিমুখে, আর আমি স্টিয়ারিং হাতে কাপ্তানের আসনে, সত্যি ঐ সামান্য সময়ের সুখকর অনুভূতি বর্ণনার অতীত! বাস্তব সত্য এই যে, পানির জাহাযে হারামাইনের যে সফর, তাতে দিন-রাত ও সকাল-সন্ধ্যা, সময়ের সমান্তরালে আবেগ ও জাযবার যে ক্রমবর্ধমান জোয়ার আসতে থাকে এবং যে বর্ণনাতীত ভাবের সঞ্চার হতে থাকে আজকের হাওয়াই জাহাযের হাওয়াই সফরে তা কল্পনাও করা যায় না।

এই সফরে আমি প্রতিদিনের রোযনামচা সংক্ষিপ্ত স্মারকরূপে নিয়মিত লিখে রেখেছিলাম। আফসোস, এখন সেই রোযনামচার খাতা বের করে দেখি, বহু পৃষ্ঠায় কীভাবে যেন কালি এমন ছড়িয়ে গিয়েছে যে, পড়াই মুশকিল। সুখের বিষয়, কয়েকটা পৃষ্ঠা পড়া যাচ্ছে। যাত্রার দিনের (১০ই জুন ১৯৬৩) পাতায় যা লিখেছিলাম তা এই-সাফীনাতুল হুজ্জাজের বুকে বসে যখন আমি আমার মালিকের অসীম কুদরতের কথা চিন্তা করছি তখন হয়রান হওয়া ছাড়া কোন উপায় থাকে না যে, কীভাবে এই অল্প সময়ের মধ্যে ধূলিকণার চেয়ে অধম এক ইনসানকে তিনি ঐ মহান মানযিলের দিকে রওয়া করিয়ে দিলেন, এই সেদিন যা কল্পনায়ও সম্ভব বলে মনে হয়নি! ব্যস, সুবহান তেরী কুদরত! আমাদের জাহায তরঙ্গবিক্ষুব্ধ সাগরের বুক চিরে এগিয়ে চলেছে হিজাযের বন্দর জিদ্দার উদ্দেশ্যে। জাহাযের গায়ে এসে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের যে ‘শোর’ তা হৃদয় ও আত্মাকে সম্মোহনকারী সুরসঙ্গীতের মতই মধুর মনে হচ্ছে। পূবের দিগন্ত থেকে আঠারো তারিখের চাঁদ এই তো মাত্র উদিত হতে দেখলাম। চাঁদের শুভ্র আলোতে মাথাতোলা ঢেউগুলো মনে হয় যেন  গলিত রূপা। এমন চিকচিক করা, এমন ঝলমল করা রূপ যে, উপমাই যেন খুঁজে পাওয়া যায় না।

পরবর্তী দিনের রোযনামচায় লেখা ছিল- দিন শেষে এখন রাত। আমাদের জাহায যেন কাগজের নৌকার মত ঢেউয়ের কোলে দোল খাচ্ছে। জাহাযের বাইরে পুরো অস্তিত্ব যেন অন্ধকার। অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। ঘোর কালো অন্ধকার যমীন আসমান যেন একাকার করে দিয়েছে। কোথায় সাগরের শেষ, কোথায় আসমানের শুরু, নির্ণয় করা কঠিনই নয়, বরং অসম্ভব।বাস্তব সত্য এই যে, কোরআনুল কারীমে সূরা নূরে অশেষ অন্ধকারের মাঝে সাগরের ঢেউগুলোর বর্ণনা যেভাবে এসছে তার গভীরতা সঠিকভাবে অনুভব করা সাগরের অন্ধকার দেখা ছাড়া সম্ভব নয়। আমি আমার কামরায় আধশোয়া অবস্থায় ঐ সমস্ত বিক্ষপ্ত চিন্তাভাবনা জড়োর করার চেষ্টা করছি, যা দিনভর আমার চেতনা আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো। বস্তুত এই মধুর কল্পনা আমার হৃদয়জগতে বসন্ত-জাগ্রত একটি পুষ্পোদ্যান যেন রচনা করেছে, যার সুবাসে সৌরভে আমার পুরো অস্তিত্ব বিমোহিত; এই কল্পনা যে, প্রতিটি মুহূর্ত আমাকে ঐ প্রিয় পবিত্র ভূমির নিকটবর্তী করে চলেছে, যার কত অসংখ্য চিত্র ও মানচিত্র আমার অন্তর্জগতে এতদিন রচিত হয়েছে। বস্তুত প্রত্যেক মুমিনের হৃদয়েই রয়েছে ঐ পবিত্র ভূমির প্রতিটি ধূলিকণার সঙ্গে প্রেমের অনুরাগের সম্পর্ক, তার প্রতিটি উপত্যকা ও পর্বতের দৃশ্য অবলোকনের  এবং তার পথের প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি চড়াই উৎরাই কাছে থেকে দেখার আকুতি।

হিজাযের সবকিছু সন্দর, পবিত্র ভূমির সবকিছু মধুর! এটা মুসলিম হৃদয়ের বিশ্বস! আর বিশ্বাসের কারণেই তার অজীবনের আকাঙ্ক্ষা হলো, হিজাযের ও পবিত্র ভূমির প্রতিটি সৌন্দর্যকে, প্রতিটি মাধুর্যকে নযরের নাযরানা এবং দৃষ্টির শোকরানা নিবেদন করা। যেমন একটু আগে বলেছি, সাফীনাতুল হোজ্জাজ ছিলো এত বড় জাহায যে, মনে হতো আস্ত একটা শহর। ওদিকে আমাদের সফর ছিলো মধ্যজুনে, যা সাগরের ভরা যৌবনের মউসুম। তাই একেকটা ঢেউ পাহাড়ের উচ্চতায় ধেয়ে আসতো, আস্ত শহরের মত বিরাট জাহাযটাকে মনে হতো তুচ্ছ তৃণখণ্ড, বা কাগজের নৌকা!সকালে যে প্রশস্ত কক্ষে আমরা নাস্তা করতাম, দু’দিক থেকেই সমুদ্র দেখা যেতো! ওখানে প্রতিদিন একটি দৃশ্য ছিলো আমাদের মুগ্ধতার কারণ। প্রথমে ধরুন ডানদিকের কথা, যতদূর দৃষ্টি যায়, কুলকিনারাহীন সাগর, যার শেষ মাথায় দেখা যায়, আসমান যেন উঠে এসেছে। তারপর পাহাড়সমান কোন ঢেউ অতিক্রম করার সময় জাহায ডানদিকে ওঠা শুরু করতো, যার ফলে দৃষ্টিসীমা পর্যন্ত বিস্তৃত সাগর যেন গুটিয়ে আসতো। অল্প সময়ের মধ্যেই পুরো সাগর ডানদিক থেকে অদৃশ্য হয়ে বামদিকে দৃশ্যমান হতো। ডানদিকে তখন শুধু মধ্য-আকাশ দেখা যেতো। তারপর সাগর ধীরে ধীরে বামদিক থেকে গুটিয়ে আসতে শুরু করতো। প্রথমে ডানদিকে সাগরের একটি ক্ষীণ রেখা দৃষ্টিগোচর হতো, আর দেখতে দেখতে বামদিকের পুরো সাগর চলে আসতো ডানদিকে। বামদিকে দেখা যেতো শুধু মধ্য-আকাশ। এদৃশ্য ছিলো প্রতিদিনের, কিন্তু এত অপূর্ব ও চিত্তাকর্ষক ছিলো যে, মনে হতো, আজই প্রথম দেখা হলো!

সফরের পঞ্চম দিন আমাদের জাহায ‘আদন উপকূলে ভিড়লো। ‘আদন বন্দর এত গভীর ছিলো না (এবং তার ব্যবস্থাপনাও এমন পর্যাপ্ত ছিলো না যাতে বড় জাহাজ ভিড়তে পারে। তাই সাফীনাতুল হুজ্জাজ উপকূল থেকে নির্ধারিত দূরতে নোঙ্গর করলো।এখানে জাহায একদিন অবস্থান করার কথা। এদিকে আমাদেরও উপকূলে যাওয়ার অনুমতি পাওয়া গেলো। তাই আমরা রশির সিঁড়ির সাহায্যে নীচে নেমে এলাম এবং ছোট কিশতীতে সওয়ার হলাম। উপকূল বেশ দূরে দেখা যাচ্ছিলো, তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই কিশতি আমাদের এডেনের উপকূলে পৌঁছে দিলো। দীর্ঘ পাঁচদিন পর আমরা মাটির ছোঁয়া পেলাম।উপকূলের এ স্থানটিকে বলা হতো স্টিমার পয়েন্ট। এর আশেপাশে সামান্য কিছু আবাদিও ছিলো, তবে শহরের মূল আবাদি, যার নাম ক্রেটর, এখান থেকে বেশ দূরে ছিলো। তাই আমাদের ট্যাক্সি নিতে হলো। মরুভূমির মাঝখান দিয়ে মোটামুটি চলনসই রাস্তা ছিলো এবং প্রচণ্ড গরম ছিলো। গাড়ীতে শীতাতপব্যবস্থার প্রচলন তখনো ছিলো না। তবে গরমের মধ্যে দু’দিকের এবং সামানের দৃশ্য ছিলো যথেষ্ট উপভোগ্য। ‘আদন তো হিজাযভূমিরই অংশ! পথে পড়লো মধ্যম পর্যায়ের একটি বসতি বা শহর, সম্ভবত যার নাম ছিলো মু‘আল্লাত। সেটা পার হয়ে আমরা মূল শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা অব্যাহত রাখলাম। শহর থেকে বেশ কিছু আগে মসজিদে আবান নামে একটি প্রাচীন মসজিদের যিয়ারাত হলো। মসজিদের পাশে একটি মাযারও ছিলো। এখানে যিনি শায়িত তারই নামে মসজিদের পরিচয়। তখন আমাদের ধারণা ছিলো, হয়ত এটি কোন ছাহাবীর নাম। পরে হযরত আব্বাজান রহ.র একটি লেখা থেকে, যা তিনি ১৩৮২ হিজরীতে সম্পন্ন ওমরার সংক্ষিপ্ত সফরের উপর লিখেছিলেন (এবং ইনশাআল্লাহ্ যা তাঁর সফরনামাসমগ্রে সঙ্কলিত হতে যাচ্ছে), সেই লেখা পড়ে জানা গেলো যে, এটি হচ্ছে হযরত হাকাম বিন আবান বিন উছমান রহ.র মাযার। তিনি ছিলেন দ্বিতীয় হিজরী শতকের বুযুর্গ। ইমাম আহমদ বিন হাম্বল রহ. তাঁর থেকে হাদীছ গ্রহণ করেছেন বলে বর্ণিত আছে।হযরত আব্বাজান রহ. এখানে এসেছিলেন এবং মসজিদের ইমাম শায়খ মুতাহ্হার আলগিরবানীর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিলো। তিনি ছিলেন গ্রন্থপ্রণেতা আলিম। হযরত আব্বাজানকে তিনি এ তথ্য জানিয়েছিলেন যে, এ মসজিদ নববী যুগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। হযরত আলী রা. যখন ইয়ামান আগমন করেছিলেন তখন এখানে দুই ওয়াক্ত ছালাত আদায় করেছিলেন।

যা হোক, অল্পসময়ের মধ্যে ‘আদন শহরটি ঘুরে ফিরে যদ্দুর দেখা সম্ভব হলো দেখলাম। তারপর ফিরে এসে একই ভাবে রশির সিঁড়ি বেয়ে জাহাযে আরোহণ করলাম। আর জাহায আবার নিজের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলো। আমার রোযনামচার পরবর্তী দিনের পাতায় লেখা ছিলো- ধীরে ধীরে জিদ্দা যত কাছে আসছে এবং আমরা জিদ্দার যত নিকটবর্তী হচ্ছি, আমাদের দিলের ধড়কন ও বুকের স্পন্দন তত বেড়ে চলেছে। এখন আমরা জিদ্দা থেকে মাত্র ১৮০ মাইলের দূরত্বে রয়েছি। ইনশাআল্লাহ্ কাল দুপুর বারোটায় ঐ প্রিয় গন্তব্যে উপনীত হবো, যার শুধু কল্পনাও চিন্তা ও মস্তিষ্ককে সুরভিত পুষ্পোদ্যানে পরিণত করে। সূর্যাস্তের কিছু আগে জাহায তার গতি পরিবর্তন করে উত্তর-পশ্চিম অভিমুখী হলো। পশ্চিমে রয়েছে আফ্রিকা মহাদেশ, আর পূবে ইয়ামান ও হিজাযের অবস্থান। জাহায থেকে এখানকার পাহাড়-পর্বতের দৃশ্য সত্যি যেমন দৃষ্টিনন্দন তেমনি হৃদয়গ্রাহী। আজই আমরা নিয়ন্ত্রণকক্ষ ও ইঞ্জিনরুমের বিশদ পরিদর্শন করলাম, আমাদের জন্য যা বড় শিক্ষণীয়ই ছিলো, যেমন তথ্য-উপাত্তের দিক থেকে তেমনি চিন্তাভাবনার দিক থেকে।

পরবর্তী দিন (১৭ই জুন) এর রোয নামচার পাতায় এভাবে লেখা হয়েছে- আজ আমাদের পানির জাহায এবং আমাদের সৌভাগ্যের তরী ঐ উপকূল পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে, যা শান্তি ও নিরাপত্তার স্বর্গ-উপত্যকার প্রবেশদ্বার বলে পরিচিত, জিদ্দা। হাঁ, জিদ্দা সেই প্রিয় উপত্যকার দিকে আমাদের পথ দেখিয়ে দেয় যা সমগ্রমানবতাকে প্রাণসজীবতা দান করেছে, আমাদের প্রিয় মক্কা, আমাদের প্রিয়তম উম্মুল ক্বোরা। আজ দুপুর বারটার কিছু পর থেকেই ডানদিকে জাযীরাতুল আরবের পর্বতশ্রেণীর আবছা দৃশ্য দৃষ্টিপথে চলে আসছিলো এবং হৃদয় ও আত্মাকে প্রশান্তির সুশীতল পরশ বুলিয়ে চলেছিলো। ভোরের আলো ফোটার সময় থেকেই প্রতিমুহূর্তে হৃদয়ের স্পন্দন বেড়ে চলেছিলো। এমনকি একসময় ভোরের আলো যেমন উজ্জ্বল হলো তেমনি দিগন্ত রেখায় জিদ্দার ইমারত ও জনপদ উঁকি দিলো। তখন তো এক একটি মুহূর্ত পার করা আমাদের জন্য কঠিন থেকে কঠিন হয়ে চলেছিলো। কিন্তু মনে হলো, আমাদের ছবর ও ধৈর্যের আরেকটা পরীক্ষা নেয়া কুদরতের মঞ্জুর ছিলো। বন্দর থেকে কিছু দূরে জাহায কাছাকাছি একঘণ্টা সময় নোঙ্গর করা অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকলো। সমস্যা কী ছিলো, আমাদের জানা ছিলো না, আমরা শুধু দেখলাম, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, বহু মুশকিল পার হয়ে জাহায আগে বাড়লো। ‘শিপটাইম’ অনুযায়ী প্রায় দুপুর দু’টোর সময় আমরা বন্দরে নেমে এলাম।সামানপত্র রাখার ব্যবস্থা হলো হযরত আব্বাজানের জনৈক ভক্ত জনাব আশরাফ সুরূজী ছাহেবের ওখানে। দিল তো তখন এমনই অস্থির বেকারার যে, এখনই মক্কা মুর্কারামার পথে ছুটে চলি এবং যত দ্রুত সম্ভব আল্লাহ্র ঘরের সামনে হাযিরা দিই। কিন্তু জিদ্দায় রাতের অবস্থান জরুরি ছিলো, তাই বুকের উপর পাথর রেখে কালকের প্রতীক্ষায় থাকলাম। ঘটনা এই যে, মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার আগে কিছু আইনগত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা জরুরি ছিলো, যা কাল ভোরেই হতে পারতো। জনাব আশরাফ সুরূজী ছাহেবকে আল্লাহ্ তা‘আলা উত্তম থেকে উত্তম বিনিময় দান করুন। তিনি হযরত আব্বাজান রহ.র ভক্তকুলে শামিল ছিলেন। তাছাড়া নিজের ঘরকে তিনি হজ্ব-ওমরায় আগতদের জন্য উন্মুক্ত করে রেখেছিলেন। আমাদের নিয়ে আসার জন্য তিনি নিজে জিদ্দা বন্দরে গিয়েছিলেন। তার ঘরেই রাত যাপনের ব্যবস্থা হয়েছিলো। ভোরে ছালাতুল ফজরের জন্য নিকটস্থ মসজিদে গেলাম। ছোট্ট মসজিদ, তবে বেশ ভাবগম্ভীর, হয়ত যিনি বানিয়েছেন তার ইখলাছের বরকত। যখন সিজদায় গেলাম, খুশি ও শোকর এবং আনন্দ ও কৃতজ্ঞতার অনুভূতি দিল থেকে যেন উপচে পড়ছিলো। এ এক অনির্বচনীয় অপার্থিব অনুভূতি যে, সারা জীবন যে বাইতুল্লাহ্র অভিমুখে আমরা সিজদা করে এসেছি, তা এখান থেকে খুব দূরে নয়, হয়ত একঘণটার পথ, এখান থেকেই, এই সিজদার মধ্যেই যেন তার সুবাস পাওয়া যায়! আমরা আর কতটুকু পেলাম, আল্লাহ্র নেক বান্দারা হয়ত পেয়ে থাকেন এর বহুগুণ।

মসজিদ থেকে ফেরার পথে একটি ‘ছাউনী বাজার’ পড়লো। সেখানে থালায় থালায় করে তেলে চুবানো যায়তুন বিক্রি হচ্ছিলো। আমি আগে না যায়তুন দেখেছি, না তার স্বাদ গ্রহণের সুযোগ হয়েছে। আমার কাছে তখন মনে হলো, দেশের রসে ভেজানো কালো জামন। আমি আগ্রহের সঙ্গে সংগ্রহ করলাম এবং একই আগ্রহ নিয়ে একসঙ্গে কয়েকটা মুখে দিলাম। ধারণা তো ছিলো, হবে কোন মিষ্টি ফল এবং মিষ্টি ফলের স্বাদ, কিন্তু যা হলো তা ধারণার বিলকুল উল্টো! এমন কাষ্টে বিস্বাদ যে, গলা দিয়ে নামানোই মুশকিল হয়ে গেলো। আমি তখন ভেবে হয়রান যে, এত ‘বাহবা’ শুনে এসেছি যে যায়তুনের, এমন হয় তার স্বাদ! এবং এত মজা করে খায় মানুষ! আসলে ভুল তো ছিলো আমারই! মুখে নেয়া দরকার ছিলো একটা করে, আর জিহ্বাকে কিছুটা সুযোগ দেয়ার প্রয়োজন ছিলো, যাতে নতুন স্বাদের সঙ্গে অভ্যস্ত হতে পারে। পরে তাই হলো। হিজাযের ঐ সফরেই যখন মানুষের দেখাদেখি অল্প অল্প করে খাওয়ার অভ্যাস হলো তখন ধীরে ধীরে, যা ছিলো কাষ্টে বিস্বাদ, জিহ্বা সেটাকেই গ্রহণ করে নিলো সুস্বাদুরূপে! এখন তো যায়তুন আমার প্রিয় খাবারের একটি। শরী‘আতের আহকাম ও বিধান প্রথম দিকে আসলে সেই যায়তুন, যা মুখে দেয়ার পর গলা দিয়ে নামানো হয়ে পড়ে কঠিন। প্রথম প্রথম বান্দা যখন ছালাত ও ছিয়াম শুরু করে, মনে হয় কত না কঠিন, কত না তিক্ত! তার চেয়ে ভোররাতের ‘মিঠাঘুম’, বাজারে, খেলাঘরে মজে থাকা কত না আনন্দের! সারা দিনের ক্ষুধা-পিপাসা কত না কঠিন! পক্ষান্তরে সুস্বাদু খাবার, ঠাণ্ডা মিঠা পানি কত না শান্তির!এভাবে শরী‘আতের যে কোন আমল, বান্দা যখন শুরু করে, তখন শুরুতে তিক্ত ও কঠিন মনে হয়। কিন্তু যখন হিম্মতের সঙ্গে, অবিচলভাবে লেগে থাকে, আর নফসকে সুযোগ দেয়া হয় তার আসল স্বাদ বোঝার জন্য তখন ধীরে ধীরে ‘তন-মন’ তাতে এমনই অভ্যস্ত হয়ে পড়ে এবং এমনই স্বাদ পেয়ে যায় যে, আর ছাড়তে পারে না! বরং আমলগুলো এতই প্রিয় হয়ে যায় যে, তা ছাড়া শান্তিই আসে না।

প্রিয় মক্কার প্রিয় পথে, পথের ধূলিকণা মেখে!

ফিরে আসি আগের কথায়, জিদ্দার ঐ রাত সম্পর্কে এতটুকু মনে পড়ে যে, আর্দ্র আবহাওয়ার গরম ছিলো এত প্রচণ্ড যে, রীতি-মত ‘হাঁস-ফাঁস’ অবস্থা! পাখার নীচে বসে আছি, অথচ দরদর করে ঘামছি! গরমের সঙ্গে পরিচয় ছিলো না, এমন নয়, তবে এ একেবারেই ভিন্ন অভিজ্ঞতা! ঘরের ভিতরে পাখার নীচে যখন এ অবস্থা, পথে আগুনঝরা রোদের মধ্যে অবস্থা কেমন হতে পারে! এদিকে আশরাফ সুরূজী ছাহেবের মেহমানদারিও ছিলো উপভোগ্য! কিন্তু দিলের ‘চাহাত’ ও মনের চাহিদা ছিলো তখন এই যে, দেখতে দেখতেই যেন রাত পার হয়ে যায়, আমরা প্রিয় মক্কার পথে রওয়ানা হয়ে যাই! মক্কার পথের ধূলিকণা মেখে ধন্য হই! তো আল্লাহ্ আল্লাহ্ করে রাত পার হলো! যথাসময়ে যথানিয়মে আইন -গত আনুষ্ঠানিকতাও সম্পন্ন হলো! সকাল আটটার কিছু পরে ট্যাক্সি-ক্ষেত্রে পৌঁছা হলো। নাস্তার কথা তো আমাদের মনেই ছিলো না! তবে মেযবান নাস্তার ভরপুর আয়োজন সঙ্গে দিয়ে দিলেন। আল্লাহ্ তাকে উত্তম বিনিময় দান করুন, আমীন।ট্যাক্সি কখন ছাড়বে তার কোন নির্ধারিত সময় ছিলো না, যাত্রীবোঝাই হলো, ছেড়ে দিলো! আমরা প্রায় যাত্রীপূর্ণ এক ট্যাক্সি পেয়ে গেলাম। তাতে সওয়ার হলাম। আর ট্যক্সি জিদ্দা শহর থেকে বের হয়ে মক্কায় যাওয়ার পথে উঠে এলো। জিদ্দা ও মক্কার মধ্যে বর্তমান যে আধুনিক ও সুপরিসর মহাসড়ক, সেটা তখন ছিলো না। পথ সাধারণ ছিলো, তুলনামূলক সঙ্কীর্ণ ছিলো, তবে মসৃণ ও সুগম ছিলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ী খালি ও খোলা পথে ‘চারচাকার’ উপর গতি লাভ করলো, আর আমরা কল্পনার ডানায় ভর করে ‘আলবাইতুল আতীকের’ উদ্দেশ্যে যেন উড়ে চললাম!

(চলবে ইনশাআল্লাহ্)

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা