রবিউছ ছানী ১৪৪৫ হিঃ

তোমাদের পাতা

আমার স্মৃতি; কিছু সুখের, কিছু দুঃখের!-৮

লিখেছেনঃ শায়খুল ইসলাম আল্লামা মুফতি তক্বী উছমানী (দা.)

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

আমার স্মৃতি; কিছু সুখের, কিছু দুঃখের!(৮)

পথের ডানে পাহাড়, বামে পাহাড়; পাহাড়, আর পাহাড়! ভেজা চোখের ঝাপসা দৃষ্টিতে পাহাড় দেখছি, আর মরুভ‚মির ‘বালুপথ’ দেখছি। অসম্ভব কী, হয়ত এ পাহাড়-পর্বত দোজাহানের বাদশাহ্ রাসূলুল্লাহ্ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর ‘জানকোরবান’ আছহাবের দৃষ্টিপথে এসেছিলো। হয়ত মরুভ‚মির বালুপথের বালুকণা তাঁদের কদম চুমেছিলো!নিমগ্ন হৃদয়ে নীরব দৃষ্টিতে আমরা পাহাড় ও মরুভ‚মি দেখে দেখে অতীতের সুমধুর কল্পনায় আত্মসমাহিত ছিলাম। একে একে দূর অতীতের স্পষ্ট-অস্পষ্ট কত রকমের দৃশ্য যে ভেসে আসছিলো! আর তাতে হৃদয়ের গভীরে কত রকম ভাব ও ভাবনার উদয় হচ্ছিলো, সবকি আর কাগজের পাতায় কলমের কালিতে তুলে ধরা সম্ভব!এরমধ্যে শুনতে পেলাম, ‘শোমায়ছি’ এসে গিয়েছে! শোমায়ছি জিনিসটা কী!? মনে পড়লো, হযরত আব্বাজান বলেছিলেন, শোমায়সি হলো হোদায়বিয়ার নতুন নাম!এখন জিদ্দা থেকে মক্কায় যাওয়ার যে মহাসড়ক, সেটা এখান থেকে কিছুটা দূর দিয়ে গিয়েছে। কিন্তু বর্তমান ছোট পথটি ঠিক হোদায়বিয়ার মধ্য দিয়েই গিয়েছে। তাই এখানে এসে রাসূলুল্লাহ্ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হোদায়বিয়া সফরের যাবতীয় ঘটনা একের পর এর কল্পনায় ভেসে উঠছিলো, ঠিক যেন চলমান ছবিগুচ্ছ!আল্লাহ্র নবী ওমরার জন্য, বাইতুল্লাহ্র তাওয়াফ ও যিয়ারাতের জন্য এ পর্যন্ত এসেছিলেন! তাঁর বাহন উটনী এখানে এসে সামনে যেতে অস্বীকার করেছিলো! আল্লাহ্র রাসূলের দূত হয়ে হযরত উছমান মক্কায় দাখেল হলেন, আর তার শাহাদাতের (ভুল) খবর ছড়িয়ে পড়লো! বাইআতে রিযওয়ান হলো, যার প্রশংসা স্বয়ং আল্লাহ্ করেছেন তাঁর পাক কালামে। কোরায়শের প্রতিনিধি সোহায়ল এলেন। অনেক রকম কথা হলো, অনেক রকম অবস্থা ও পরিস্থিতি হলো। সোহায়লের সন্তান আবূ জান্দাল, যিনি কোরায়শের হাতে বন্দী ছিলেন এবং পিতা সোহায়লের নির্যাতনের শিকার ছিলেন, তিনি শৃঙ্খলিত অবস্থায় এসে হাযির হলেন। সবকিছু এখানে এই হোদায়বিয়ার যমীনে ঘটেছিলো!কী হৃদয়বিদারক দৃশ্য ছিলো! কোরায়শী দূত সোহায়লের অনমনীয়তার কারণে আবূ জান্দালকে ফেরত দিতেই হলো! ছাহাবা কেরামের ডান হাত তখন তলোয়ারের হাতলে! জিহাদের জোশ এবং শাহাদাতের তামান্না তাঁদের অন্তরে তখন তুঙ্গে!এমন কঠিন পরিস্থিতিতেও আল্লাহ্র নবী পূর্ণ শান্ত! ধৈর্য ও সহনশীলতার সর্বোচ্চ পরিচয় দিলেন তিনি! সেটাই যে ছিলো আল্লাহ্র আদেশ! কোরায়শের সমস্ত শর্ত স্বীকার করে আল্লাহ্র নবী কোরায়শের সঙ্গে সন্ধি করলেন, ইতিহাসে ও সীরাতে যা প্রসিদ্ধ হোদায়বিয়ার সন্ধি নামে। আর (বাহ্যত) ‘নতিস্বীকারমূলক’ এ সন্ধিকে আল্লাহ্ ঘোষণা করলেন ফাতহে মুবীন ও সুস্পষ্ট বিজয় বলে!সবকিছু তো এখানে এই হোদায়বিয়ার যমীনেই ঘটেছে! এখান থেকেই আল্লাহ্র নবী ফিরে গিয়েছেন ওমরা না করে, আল্লাহ্র ঘরের তাওয়াফ ও যিয়ারাত না করে!ঐ পাক যমীন, ঐ পবিত্র ভ‚মি এই যে এখানে আমার দৃষ্টির সামনে! এখানেই ঘটেছে ইতিহাসের মোড় পরিবর্তনকারী মহাঘটনার প্রতিটি খÐ ঘটনা!এখান থেকে সামান্য দূরত্বে হারামের সীমানা শুরু হয়, যার আলামত হিসাবে রাস্তার উভয় পার্শে¦ স্তম্ভ স্থাপন করা হয়েছে। এই স্তম্ভগুলোর বলতে গেলে একেবারে ছায়ায় ছোট্ট একটি মসজিদ রয়েছে। খুব প্রসিদ্ধ যে, হোদায়বিয়ায় অবস্থানকালে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এখানে এসে ছালাত আদায় করতেন, যাতে হারামের সীমানার ভিতরে ছালাত হয়। সীরাতের বর্ণনা থেকেও এর সত্যতা ও সমর্থন পাওয়া যায়।ঐ যে জাবালে নূর!(সীরাতে নববীর) হোদায়বিয়া (এবং আজকের শুমাইসিয়া) থেকে সামনে কিছুদূর গেলেই আপনি দেখতে পাবেন দীর্ঘ পর্বতশ্রেণী। তার মধ্যে একটি পর্বত আলাদা করেই যেন চেনা যায়। আকৃতি ও প্রকৃতি দু’দিক থেকেই পবর্তটি আগের ও পরের পর্বতগুলো থেকে যেন সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। ব্যাখ্যা করে হয়ত বোঝানো যায় না, তবে মন যেন ভিতর থেকে বলতে চায়, এ পর্বত অন্যকিছু। এ যেন পর্বত-জগতের বাদশাহ, আর তাই তার মাথায় শোভা পায় মুকুট আকারের বিরাট এক প্রস্তরখÐ। কেউ বলে দিতে হবে না, দূর থেকে আপনার নিজেরই মনে হবে, এ যেন পর্বতের চ‚ড়ায় ‘স্থাপিত’ অনন্য মর্যাদার এক মুকুট। দৃষ্টি ফেরানো যায় না, তন্ময় হয়ে তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছা করে।গাড়ী তার নিজের গতিতে চলতে থাকলেও বহু দূর পর্যন্ত দেখা যায় পবর্ত ও তার চ‚ড়া। আমাদের এক আরব সফরসঙ্গী পর্বতচ‚ড়ার দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, জাবালে নূর!শব্দটি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে অপূর্ব এক কম্পন ও শিহরণ অনুভব করলাম। এবার আর বুঝতে বাকি থাকলো না, মন কেন বলছিলো, পর্বতশ্রেণীর মাঝখানে এ পর্বতটি আলাদা কিছু!এ তো সেই পর্বত যার প্রায় শীর্ষস্থানে হেরাগুহা অবস্থিত। হেরাগুহার কথা শুনেনি, এমন মুসলিম কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে, মনে হয় না। নবুয়তপ্রাপ্তির সময় যখন আসন্ন, আমাদের পেয়ারা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন এখানে এই হেরাগুহার নির্জনতায় একাধারে কয়েকদিন ধ্যানমগ্ন অবস্থায় থাকতেন। গুহার মধ্য হতেও সরাসরি আল্লাহ্র ঘর বাইতুল্লাহ্ দেখা যেতো। এখানেই পেয়ারা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নবুয়তের মহামর্যাদায় ভ‚ষিত করা হয়। এখানেই ইক্বরা বিসমি রাব্বিক্ এর মাধ্যমে ঐ পবিত্র অহীর অবতরণের শুভসূচনা হয় যা সুদীর্ঘ তেইশ বছর অব্যাহত থাকে, যার নাম আল্লাহ্র কালাম আলকোরআন, যা সারা বিশে^র জন্য নূর ও হিদায়াত।আমাদের গাড়ী যেমন তার নিজের গতিতে এগিয়ে চলেছিলো তেমনি হৃদয়ের গভীরে ভাব ও আবেগের  তরঙ্গ-দোলা প্রবল থেকে প্রবল হয়ে চলেছিলো। আমি যেন তখন আমার মধ্যে নেই। আমি যেন অন্যকিছুর আকর্ষণে অন্যকিছুতে বিলীন হয়ে গিয়েছি। এই অপূর্ব তরঙ্গদোলার অপার্থিব আনন্দের মধ্যেই একসময় আমরা মুক্কা মুকাররামায় দাখেল হলাম; সময় যেন সার্থক হলো, জীবন যেন ধন্য হলো! হিন্দুস্তান ও পাকিস্তান থেকে যারা হজ¦ ও যিয়ারাতে আসেন তাদের কাছে ছাওলাতিয়া মাদরাসা যথেষ্ট পরিচিত। তখন সেটির অবস্থান ছিলো হারাতুল বাব নামের একটি স্থানে। মাদরাসার তখনকার মুহতামিম হযরত মাওলানা মুহম্মদ সালীম ছাহেব রহ. অত্যন্ত ¯েœহের সঙ্গে মাদারাসার একটি প্রশস্ত কামরায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। আমরা সেখানেই মেঝেতে বিছানা বিছিয়ে আরামের সঙ্গে থাকার ইন্তিযাম করে নিলাম।তখন হিন্দুস্তান ও পাকিস্তান থেকে অধিকাংশ মানুষ পানির জাহাযে করেই হজে¦র সফরে আসতো। হারামাইন শরীফাইনে তাদের অবস্থান একমাসেরও বেশী হতো। এখনকার মত তখন হোটেলব্যবস্থা ছিলো না। হাজী ছাহেবান হারামের যত কাছে সম্ভব ঘর ভাড়া নিয়ে থাকার ব্যবস্থা করতেন। তাছাড়া হিন্দুস্তান-পাকিস্তানসহ আরো কিছু দেশের দ্বীনদার ও দানশীল ব্যক্তি হাজী ছাহেবানের খেদমতের নিয়তে মুসাফিরখানা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, হারামে যার পরিচিত নাম ছিলো রিবাত। প্রয়োজনে হাজীগণ নামমাত্র-ভাড়ায় সেখানে থাকার সুযোগ পেতেন। অবশ্য যাদের সচ্ছলতা ছিলো তারা আলাদা ঘর ভাড়া করাই পছন্দ করতেন। তো রিবাত ও ভাড়াঘর, সেটাই ছিলো তখন হাজী ছাহেবানের থাকার ব্যবস্থা। হোটেল এবং আলীশান টাওয়ারের প্রচলন তখন বলতে গেলে ছিলোই না।পানাহারের ব্যবস্থাও তখন এখনকার মত ছিলো না। হাজীছাহেবান কাফেলার ছূরতে আসতেন এবং খাদ্যসামগ্রী ও রান্নার আয়োজন পানির জাহাযে করে নিজেদের সঙ্গেই নিয়ে আসতেন এবং সবাই মিলে মিশে নিজেদের রান্না নিজেরাই করে নিতেন।বহু দ্বীনদার ও দানশীল ব্যক্তি প্রয়োজনগ্রস্ত হাজী ছাহেবানের খেদমতের নিয়তে বিপুল পরিমাণ খাদ্যসামগ্রী সাওলতিয়া মাদরাসায় পাঠিয়ে দিতেন। মাদরাসার কর্তৃপক্ষ হাজী ছাহেবানদের মধ্যে তা বিতরণের ব্যবস্থা করতেন।আল্লাহ্র ঘরের সামনেআমাদের মন তো তখন অস্থির যিয়ারাতে বাইতুল্লাহ্র জন্য, তাই দ্রæত তাজা অজু করে নিলাম এবং দুরু দুরু বুকে হারামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। কদম যেন আগে বাড়তে চায় না দ্বিধায় সঙ্কোচে, আবার মন যেন ডানায় ভর করে উড়ে যেতে চায় শাওক ও তামান্নার প্রবলতার কারণে। এভাবে ধীর ন¤্র পদক্ষেপে অল্প সময়ের মধ্যে আমরা হারাম শরীফে হাজির হলাম।সবকিছু মনে হচ্ছিলো সুন্দর কোন স্বপ্নের মত। চোখে দেখেও যেন বিশ^াস হতে চায় না, আমরা এখন আল্লাহ্র ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি! এই সেই বাইতুল্লাহ্ যার যিয়ারাতের স্বপ্ন দেখে দেখে জীবনের বহু বছর পার হয়েছে! আল্লাহ্ যখন ইচ্ছা করেন, দয়া করেন, মায়া করেন, এভাবেই তখন বান্দার মনের আশা ও স্বপ্ন পুরা হয়।তখন সকাল দশটা। ‘সৌভাগ্যক্রমে’ মাতাফ তখন প্রায় খালি। বিশত্রিশজনের বেশী হবে না, আল্লাহ্র বান্দা আল্লাহ্র ঘর তাওয়াফ করছেন। তাই আমরা পূর্ণ ইতমিনান ও স্বস্তির সঙ্গে তাওয়াফ সম্পন্ন করলাম। তাওয়াফের প্রত্যেক প্রদক্ষিণেই হাজরে আসওয়াদ চুম্বনের সৌভাগ্য হলো। মুলতাযামে যখন হাযির হলাম, আহ কী সৌভাগ্য! অল্পক’জন মানুষ তখন সেখানে। ফলে যতক্ষণ সাধ হলো, বুকের তাপ ও প্রাণের উত্তাপ জুড়িয়ে নিলাম। এমন সুবর্ণ সুযোগ পরবর্তী জীবনে কমই হয়েছে।তখন মাকামে ইবরাহীম ছোট্ট একটি স্থাপনার মধ্যে ছিলো। হারাম শরীফে যতদিন আসা হয়েছে, মাকামে ইবরাহীমের সামনেই আমাদের বসা হতো। কারণ এখান থেকে আল্লাহ্র ঘরের দুয়ার এবং মুলতাযাম দৃষ্টির সামনে থাকতো। নিজেকে তখন মনে হতো, ঘরের দুয়ারে ঘরের মালিকের ভিখারী!ছালাতের সময় ইমাম ছাহেব এখানেই দাঁড়াতেন। যমযমের কুয়া তখন একটি ইমারতের মধ্যে ছিলো। সেখানে নিজের হাতে বালতি দ্বারা যমযমের পানি তোলা হতো। ঠিক এ ব্যবস্থাটাই ছিলো আল্লাহ্র নবীর যামানায়। তো আমাদেরও এ সৌভাগ্য হলো। আমরাও নিজের হাতে বালতিতে করে পানি তুলে প্রাণভরে যমযম পান করলাম।দিন গেলো, রাত এলো, আমরা ফিরে এলাম ছাওলাতিয়ার অবস্থান ক্ষেত্রে এবং ফজরের প্রস্তুতিরূপে শুয়ে পড়লাম।ফজরের বেশ আগেই হারামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। দূর অতীতের হিজরতের রাতের কথা মনে পড়লো। সেই আলোকিত দৃশ্যগুলো একে একে চোখের সামনে যেন ভেসে উঠলো।  দুশমন কোরায়শ পেয়ারা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘর অবরোধ করে রেখেছে, ভোরের অপেক্ষায়। আর তিনি তাদের চোখে ধূলো নিক্ষেপ করে নির্বিঘেœ বের হয়ে গেলেন! হারামের বিভিন্ন পথ পার হয়ে হযরত আবূ বকর রা.র ঘরে গিয়ে উপস্থিত হলেন। তারপর রাতের আঁধারে নিজেদের গোপন করে জাবালে ছাওরের উদ্দেশ্যে তাঁরা রওয়ানা হলেন। কত না কঠিন ছিলো হিজরতের সেই রাত!মাদ‘আ বাজার দেখা হলোহযরত আব্বাজান রহ.র দোস্ত হাজী দাউদ মায়েত ছাহেবের নামে একটি চিঠি ছিলো। সেটা তাঁকে দেয়ার জন্য এশরাকের পর সূকুল মাদ‘আ গেলাম। এই নামে তখন একটি বাজার ছিলো, ছাপরার তৈরী। হারামের পূর্ব উত্তর কোণে অবস্থিত। এখন সেই বাজারো নেই, সেই পারিপাশির্^ক অবস্থাও নেই। বাজারের শুরুর দিকটা ছিলো ক্রমশ উঁচু। উচ্চতার পর যেখান থেকে ঢাল শুরু হয়েছে সেখানে চারকোণা আকারের বেশকিছুটা খালি জায়গা ছিলো। যুগ যুগ ধরে প্রজন্ম পরম্পরায় কথিত আছে যে, এখানে এই জায়গাতেই হযরত ইবরাহীম আ. আপন স্ত্রী হযরত হাজেরা এবং আপন পুত্র হযরত ইসমাঈল আ.কে রেখে শামে ফিরে গিয়েছিলেন। জলবৃক্ষহীন এ বিরান উপত্যকায় আল্লাহ্র হুকুমে স্ত্রীপুত্রকে রেখে যাওয়ার সময় এখানেই দাঁড়িয়ে তিনি হৃদয়বিগলিত-কারী সেই দু‘আ করেছিলেন, কোরআনে যার বয়ান এভাবে এসেছেÑ(তরজমা) আয় হামারে রব্ব! আমি আমার কিছু পরিজনের বসত করিয়েছি আপনার পবিত্র ঘরের নিকটে এই ফল-ফসলহীন উপত্যকায়। আয় হামারে রব্ব, (এটা আমি এজন্য করেছি) যেন তারা (এখানে) ছালাত কায়েম করে। সুতরাং কিছু মানুষের অন্তরকে আপনি  এমন করে দিন যাতে তা তাদের প্রতি অনুরক্ত হয়, আর তাদের আপনি রিযিক দান করুন ফলফলাদি থেকে, যাতে তারা শোকর-গুযার হয়।জনশ্রæতি অনুযায়ী এ স্থানটির নাম মাদ‘আ এজন্যই হয়েছে যে, এখানেই হযরত ইবরাহীম আ. এই মশহূর দু‘আটি করেছিলেন। মাদ‘আ শব্দের অর্থই হলো দু‘আ করার স্থান। পরে বাজারটিও ‘মাদআ বাজার’Ñ সূকুল মাদ‘আ নাম গ্রহণ করে। চাক্ষুষ পর্যবেক্ষণেও এ ধারণার সমর্থন পাওয়া যায় যে, সম্ভবত এটাই তাঁর দু‘আর স্থান ছিলো। কারণ এখানেই চড়াই শেষ হয়েছে, সামনে শুরু হয়েছে ঢাল। সুতরাং খুবই সম্ভব যে এখান থেকে তিনি স্ত্রীপুত্রের দিকে শেষ দৃষ্টি দান করেছিলেন। সামনের ঢালে নেমে যাওয়ার পর তো তাঁরা তাঁর দৃষ্টির আড়ালে চলে যাওয়ার কথা।বাহ্যত বাইতুল্লাহ্র নিকটবর্তী এ স্থানেই রচিত হয়েছিলো সেই অভ‚তপূর্ব ইতিহাস, যার মর্ম ছিলো দ্বীনের প্রতি দৃঢ়তা ও অবিচলতা এবং আল্লাহ্র প্রতি অটুট ভরসা ও তাওয়াক্বুল। হজ¦ ও ওমরাহ্র পালনস্থানরূপে বাইতুল্লাহ্ ও তার চারপাশের স্থানকে আল্লাহ্ তা‘আলা কিয়ামত পর্যন্ত অমরত্ব দান করেছেন।মাদ‘আ নামের এ স্থানটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরেকটি পবিত্র ইতিহাস ও কল্যাণপূর্ণ স্মৃতি। সীরাতের বয়ান থেকে জানা যায়, মক্কাবিজয়ের সময় পেয়ারা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই উঁচু স্থান থেকেই ঢাল বেয়ে হারামে দাখেল হয়েছিলেন।মক্কার মহান বিজয়ী নবীর প্রতি হাযার দুরূদ ও সালাম, যিনি তাঁর রক্তপিপাসু শত্রæর উপর বিজয় অর্জন করেছিলেন সম্পূর্ণ রক্ত-পাতহীন অবস্থায়, কারো শরীর থেকে একফোঁটা রক্তও তিনি ঝরতে দেননি, বরং আগে থেকেই সবার প্রতি তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিলেন। শহর-নগরের বিজেতারা যেভাবে মাথা উঁচিয়ে, বুক ফুলিয়ে দম্ভের সঙ্গে বিজিত ভ‚মিতে প্রবেশ করে, তিনি সেভাবে মোটেও প্রবেশ করেননি। তারীখ ও সীরাত সেই দৃশ্য এখনো ধারণ করে রেখেছে যে, তিনি মক্কায় প্রবেশ করেছিলেন অশ্রæসজল চোখে অবনত মস্তকে। তাঁর কণ্ঠে তখন উচ্চারিত হচ্ছিলো কোরআনের এই আয়াতÑإنَّـا فَـتَـحْـنـا لَـكَ فَـتْـحًـا مُـبِـيـنـاমাদ‘আ বাজারের উপর থেকে হারামের দিকে যাওয়ার পথে বাম দিকে পড়ে হযরত আবূ সুফয়ানের বাড়ী, ফাতহে মক্কার সময় যিনি ছিলেন কোরায়শের সরদার। কিন্তু পেয়ারা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে এমন অনন্য মর্যাদা দান করেছিলেন যে, ঘোষণা করলেন, আবূ সুফয়ানের ঘরে যে দাখেল হবে সে নিরাপদ। ঐ ঘর তখন বসবাসহীন অবস্থায় ছিলো। সবসময় বন্ধই থাকতো। বিশেষ বিশেষ অবস্থায় মেহমানদের জন্য খুলে দেয়া হতো। আল্লাহ্র শোকর, আমাদেরও সুযোগ হলো ঐ ঘরে প্রবেশ করার। তখন অন্তরের গভীর থেকে দু‘আ এলো, আয় আল্লাহ্! এ ঘরে যারা দাখেল হবে, আপনার হাবীব ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে নিরাপত্তা দান করেছেন। আয় আল্লাহ্! আপনার আযাব-গযব থেকে আমাদেরও আপনি নিরাপদ রাখুন।মাদ‘আ বাজার থেকে ফেরার সময় আসমান-যমীনের এবং কুলমাখলূকাতের জন্য পরম সৌভাগ্যের ঐ পবিত্র স্থানটিও এই গোনাহগার চোখে দেখার খোশকিসমত হলো, যেখানে আমাদের পেয়ারা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জন্মগ্রহণ করেছেন। আশ্চর্যের কী, যদি পৃথিবীর আর সমস্ত ভ‚খÐ এই স্থানকে ঈর্ষা ও গিবতার নযরে দেখে! কিন্তু এ স্থানটিকে তো স্বয়ং আল্লাহ্ এ অনন্য মর্যাদা দান করেছেন নিজের মাহবূব ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্য জন্মস্থানরূপে নির্বাচন করে। এখানে এখন একটি দোতালা ভবনে গ্রন্থাগার ও পাঠাগার স্থাপন করা হয়েছে।সত্য কথা এই যে, প্রথমে তো আমার সাহসই হচ্ছিলো না যে, এখানে এই মহান বরকতপূর্ণ স্থানে এই নাপাক কদমে প্রবেশ করি। তারপরো দুরু দুরু বুকে প্রবেশ করলাম এ কথা চিন্তা করে যে, আমার পূর্ববর্তী আকাবিরীন তো বরকত লাভের নিয়তে এখানে প্রবেশ করেছেন। খুব সামান্য সময় এখানে ছিলাম, কারণ বারবার মনে হচ্ছিলো, আমার নাপাক অস্তিত্ব দ্বারা এই নূরানি স্থানকে আর বেশীক্ষণ...! তবে যতক্ষণই ছিলাম, আমার কলব ও রূহ এবং আমার হৃদয় ও আত্মা যে সুক‚ন ও সাকীনা, যে শান্তি ও প্রশান্তি এবং যে নূর ও জ্যোতি অনুভব করেছে তা সত্যি কোন ভাষায় ও কোন শব্দে প্রকাশ করা সম্ভব নয়।সেই জাবালে আবূ কোবাইস!হায়, এখন তো আর জাবালে আবূ কোবায়সের চিহ্নপর্যন্ত নেই। এখন তো ঐ পাহাড় কেটেকুটে সেখানে গড়ে উঠেছে সউদী রাজপুরুষদের বিশাল আলিশান রাজপ্রাসাদ।তখন হারাম শরীফের দক্ষিণের চত্বর থেকেই কত সুন্দর দেখা যেতো, জাবালে আবূ কোবায়স! যেন অতীত তার সমস্ত জালাল ও জামাল এবং সমস্ত ভাবগম্ভীর সৌন্দর্য নিয়ে আপনার সামনে উপস্থিত। দেখুন, দেখতে থাকুন এবং অতীতের নূরানিয়াতের কাছে কিছুক্ষণের জন্য হলেও নিজেকে অর্পণ করুন।জাবালে আবূ কোবায়সের চ‚ড়ায় অল্প আয়তনের একটি মসজিদও ছিলো, হারামের চত্বর থেকে নীল আসমানের দৃশ্যপটে তা অন্যরকম মনে হতো। মসজিদের দিকে তাকালে বহু দূর থেকে যেন বেলালী আযানের সুর ভেসে আসতো। আশ্চর্য, নামের এমন নূরানিয়াত, এমন জ্যোতির্ময় প্রভাব! হাঁ নামটি ছিলো মসজিদে বিলাল! সম্ভবত মক্কা বিজয়ের সময় ওখান থেকে তিনি কোন ওয়াক্তের আযান দিয়েছিলেন।কিতাবের পাতায় দেখা যায়, আল্লাহ্র নবী যখন কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও মক্কায় কোরায়শকে আল্লাহ্র পথে তাওহীদের দাওয়াত দেন তখন কোরায়শ একদিন আজীব এক আব্দার করে বসলো! ‘হে মুহম্মদ, তুমি যদি সত্য নবী হও তাহলে এই যে, পূর্ণিমার গোল চাঁদটা, এটা দু’টুকরো করে দেখাও!আল্লাহ্র নবী কোরায়শের আচরণে ব্যথিত হলেও আল্লাহ্র হুক‚মে হাতে ইশারা করলেন, আর চাঁদ দু’টুকরো হলো! এ মু’জিযার কথা কোরআনেও আছে, যা এখানে জাবালে আবূ কোবায়সে ঘটেছিলো। এ কারণে চ‚ড়ার মসজিদটির আরেক নাম ছিলো মসজিদে শাক্কুল কামার।আবূ কোবায়সে, পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে একেবারে চ‚ড়া পর্যন্ত মানুষের কিছু বসতি ছিলো। তাই পায়ে হেঁটে উপরে ওঠার জন্য যেমন তেমন একটা পথও ছিলো। মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে নিজেদের মত করে রাস্তা তৈয়ার করে নিয়েছিলো। তারা আরামসেই ঐ পথে ওঠানামা করতো।আছরের পর আমরা ঐ রাস্তা বেয়ে জাবালে আবূ কোবায়সের একদম চ‚ড়ায় উঠে দম নিলাম। পাহাড়ের মানুষ, আর সমতলের মানুষ, শক্তিতে সাহসে কত পার্থক্য, বোঝা যায়!মসজিদে বিলাল বলুন, বা মসজিদে শাক্কুল কামার, আমরা ঐ মসজিদ যিয়ারত করি এবং আমাদের ভালো লাগে। আসলে সুন্দর ইতিহাসের সুন্দর সান্নিধ্য মানুষকে মানুষের পাত্র অনুযায়ী আত্মিক প্রশান্তি দান করে।কোথায় এখন সেই জাবাল, সেই মসজিদ!জাবালে আবূ কোবায়সের চ‚ড়া থেকে মক্কার পুরো উপত্যকা দেখা যায়। আমরা দেখলাম। সেই দেখা কত না সৌভাগ্যের দেখা! ধীরে ধীরে বর্তমান মুছে যায়, অতীত ভেসে ওঠে, তারপর দূর অতীত যেন জেগে ওঠে! এ ভ‚মি তখন ছিলো জলহীন, বৃক্ষহীন কঠিন পাথরের এক ওয়াদী, যেখানে না ছিলো মানুষ, না মানুষের ছায়া! জনমানবশূন্য পাথরের এ উপত্যকাকেই, আল্লাহ্র ইচ্ছা হলো, আর তিনি নিজের ঘর কা’বা ও বাইতুল্লাহ্র জন্য একে নির্বাচন করলেন, আর মক্কা হয়ে গেলো, অনন্য সৌন্দর্যের, অনন্য গৌরব ও মর্যাদার মক্কাতুল মুর্কারামা! এখানে শুধু নূর, আর নূর! আলো, আর আলো! পৃথিবীর যেখানে যত সুন্দর বাগান আছে, ফলের বাগান, ফুলের বাগান! পৃথিবীর যেখানে যত সবুজশ্যামল ভ‚খÐ আছে, নহর ও ঝর্ণার প্রবাহ আছে, মক্কাতুল মুর্কারামার  ঊর্ধ্বজাগতিক সৌন্দর্যের সঙ্গে তার কোন তুলনাই হয় না।তখন মৌসুম ছিলো গরমের। আর গরম ছিলো মরুভ‚মির বালুর এবং উপত্যকার পাথরের!কল্পনা করুন, অতীতের মানুষ দুধের পাত্রে পাথরের টুকরো ফেলে দুধ গরম করতো! সেই গরম! সামান্য সময়ের জন্য হলেও খালি পায়ে পাথরের উপর... যেন আগুনের উপর পা রাখা হলো! হারাম শরীফে মাতাফের মধ্যেও, যদি পাথরকণা বিছানো যমীনের উপর পা রেখেছেন, খালি পা, মুহূর্তে যেন পা ঝলসে যায়! গরমের তাপ-উত্তাপ যেন পুরো শরীর...। কিন্তু এ পবিত্র ভ‚মির সৌন্দর্যে, এর নূরানিয়াত ও জ্যোতির্ময়তায়, এর আত্মিক শান্তি ও ঊর্ধ্বজাগতিক প্রশান্তিতে আমরা এমনই আত্মসমাহিত ছিলাম যে, চিন্তায় তখন গরমের কোন অনুভ‚তিই ছিলো না, ছিলো শীতল প্রশান্তির অনির্বচনীয় এক অনুভ‚তি, যা শীতল ছায়ার কোন সবুজ মরূদ্যানেও কল্পনা করা যায় না।মদীনাতুল মুনাওয়ারার পথে!মক্কাতুল মুর্কারামায় দু’দিন অবস্থানের পর, জানি না, কী কারণে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে, এখন মদীনাতুল মুনাওয়ারায় হাজিরা দেবো, তারপর আবার ফিসে এসে এখানে যত বেশী দিন থাকা সম্ভব থাকার চেষ্টা করবো।

(চলবে ইনশাআল্লাহ্)

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা