রজব ১৪৩০ হিঃ (১২)

শেখ সাদীর গুলিস্তা

শেখ সাদীর গুলিস্তা

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট
পূর্বযুগের এক বাদশাহ জনৈক বুযুর্গকে করেন জিজ্ঞাসা, যার ছিলো অনেক পোষ্যমুখ, আর মনে ছিলো অনেক চিন্তাদুঃখ। জিজ্ঞাসা করেন, আপনার জীবনের প্রিয় সময়গুলো হে জনাব, কীভাবে কাটে দেবেন কি জবাব? তিনি বললেন, সারা রাত কাটে ইবাদত বন্দেগিতে, ভোর রাত কাটে রিযিকের দু‘আ-মুনাজাতে, আর সারাটা দিন যায় রুটি-রুযির ধান্ধায়। বাদশাহর অতি উচ্চ ছিলো চিন্তাধারা, তাই তিনি বুঝে নিলেন তার কথার ইশারা এবং তখনই জারি করলেন হুকুমনামা, দান করো তাকে নতুন জামা-পাজামা, আর জারি করে দাও প্রতি মাসের পর্যাপ্ত ভাতা, যাতে চিন্তুামুক্ত হয়ে সিজদায় পড়ে থাকে তাঁর মাথা। কবিতা- পরিবারের শেকলে বাঁধা তুমি সকাল-বিকাল/ঝেড়ে ফেলো নিশ্চিন্ত ইবাদতের খোশ খেয়াল/ রুটি-রুজির চিন্তা করে যার শান্তিহরণ/ঊর্ধ্বজগতে কেমন করে হবে তার বিচরণ?/ একই ঘোরে নিত্য যে ঘুরি, আর বলি হে মন/ আজ নিশিতে নির্জনে খোদারে করিব স্মরণ/ নিশিতে নামাযে দাঁড়িয়ে হায়, ভাবনা এসে যায়/ সন্তানেরা মোর কী খাবে ভোরে, কী হবে উপায়? শিক্ষা- যারা ইবাদত বন্দেগির স্বাদ পেতে চায়, তাদের কর্তব্য হলো সংসারের ঝামেলায় বেশীমাত্রায় নিজেকে লিপ্ত না করা। নচেৎ দিনরাত পোষ্যপরিজনের চিন্তায় ডুবে থাকতে হবে, ইবাদতের অবসরই আর পাওয়া যাবে না, এমনকি রাজাবাদশা ও দুনিয়াদারদের কাছে হাত পাতারও যিল্লতি ভোগ করতে হতে পারে। *** এক দেশে ছিলেন এক দরবেশ, বুযুর্গিতে ছিলো নামডাক বেশ। একবার তিনি শহরের জীবন ত্যাগ করে চলে গেলন বনের ভিতরে। সেখানেই শুরু করলেন তার নতুন জীবন, দিন-রাত করেন ইবাদত সঁপে দিয়ে তুনমন। বনের ভিতরে তার জায়নামায থাকে পাতা, উদরের ক্ষুধা দূর করেন খেয়ে গাছের পাতা। ঘটনা শুনে দেশের বাদশাহ হন পেরেশান এবং সঙ্গে সঙ্গে দরবেশের খেদমতে ছুটে যান। বলেন তিনি করজোড়ে নিবেদন করে, হুযূর! দয়া করে ফিরে চলুন শহরে। যদি ভালো মনে করেন এবং কবুল করে আপনার যেহেন, তাহলে বলি- আপনার জন্য নির্ধারণ করবো একটি মনোরম প্রাসাদ; সেখানে নির্জনে ইবাদত করবেন মিটিয়ে মনের সাধ। এখানের চেয়ে উত্তম হবে ইবাদতের একাগ্রতা; তাতে কোন সন্দেহ নেই নিশ্চিত তা। তাছাড়া লোকেরা ধন্য হবে আপনার নূরানি ছোহবতে এবং মগ্ন হবে আপনার অনুসরণে বন্দেগিতে। দরবেশের মোটেই পছন্দ হলো না বাদশাহর প্রস্তাব, কারণ তাতে পরে হতে পারে মনস্তাপ। তাই তিনি তার নিবেদন নাকচ করে দিলেন এবং অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তখন বাদশাহর সঙ্গী এক উযির দেখালেন যুক্তি, ঠিক নয় তাকে ফিরিয়ে দেয়া যিনি করেন এত ভক্তি। অন্তত বাদশাহর মনরক্ষার খাতিরে দু’তিন দিন এসে থাকুন শহরে। নিজেই পরীক্ষা করে দেখুন প্রাসাদের পরিবেশ। সেখানে ইবাদতে না হয় যদি মনোনিবেশ, আর সাধারণ মানুষের সঙ্গ, যদি করে আপনার ধ্যান ভঙ্গ, থাকবে তো আপনার অধিকার সবকিছু ছেড়ে চলে আসার। কথিত আছে, দরবেশ শহরে এলেন দুদিনের জন্য। শহরবাসী সকলে তার আগমনে হলো যেন ধন্য। শাহী উদ্যানে এক প্রাসাদ তার জন্য করা হলো খালি। রোয সকালে তার খেদমতে তাজা ফুল হাযির করে মালী। সে বাগানের সৌন্দর্যের কথা আর বলো না; আসলে দুনিয়াতে ছিলো তা জান্নাতের নমুনা। কবিতা- লাল গোলাব যেন প্রিয়তমার গণ্ডদেশ/ ঝুলে থাকা ‘সাম্‌বাল’ যেন তার কৃষ্ণ কেশ/ ‘শীত-সকালে’ ফুলগুলো তরুতাজা দেখতে এমন/ এখনো মায়ের কোলে দুধ না খাওয়া শিশু যেমন/ ডালে ডালে ঐ যে দেখো তুমি শত শত ‘আনারকলি’/ সবুজ গাছে ঝুলে আছে যেন লাল অঙ্গারগুলি। দরবেশের সেবায় বাদশাহ পাঠালেন একদাসী, এমন ছিলো যার সৌন্দর্যরাশি- চাঁদের টুকরো এক, ভাঙ্গে যেন সুফীর ধ্যান/ অপ্সরি, ময়ূরি, তারে হেরি হারায় সবে জ্ঞান/ গুলবাগে চুল খুলে সবুজ ঘাসে করে পায়চারি/ তসবি হাতে রাখতে নারে কেহ ধৈর্য ধরি। দাসীর পরে বাদশা পাঠালেন সুদর্শন এক দাস, যেন এক নাশ, সঙ্গে তার সর্বনাশ। কবিতা- পেয়ালা হাতে সবার মাঝে ঘোরে সে সাকী/ দেয় না কিছু দেখায় শুধু যুলুম এ কী!/ দেখে দেখে আশ না মেটে, শুধু নেশা ধরে/ ফোরাতের তীরে যেন পিপাসায় মরে। দরবেশ তার জায়নামায রেখে একপাশে, মজে থাকে ফলের স্বাদে, ফুলের সুবাসে এবং পানাহারে ভোগবিলাসে। কখনো সুদর্শন দাস, কখনো সুন্দরী দাসী, উপহার দেয় কটাক্ষ আর মধুর হাসি। মুগ্ধ দরবেশ তা করে অবলোকন, তার মন যেন করে ওঠে কেমন! এ কারনেই তো জ্ঞানিগণ বলেন অবিরত, রূপসীর কেশ হলো বুদ্ধির শিকল, জ্ঞানীর জ্ঞান করে দেয় বিকল। কবিতা- তব চরণে করিনু উৎসর্গ ইহ-পরকাল/ আমি মূর্খ পাখী, তুমি যে মনোহর এক জাল। মোটকথা, দীর্ঘ ইবাদতের যা কিছু অর্জন গেলো সব রসাতলে, পুণ্যের সাধনা করলেন বর্জন ভোগের পদতলে। কবিতা- জগতের যত পীর-সাধু, জ্ঞানী, কবি/ ঘোচায় ঘোর আঁধার, হয়ে সত্যের রবি/ দুনিয়ার লোভে যায় যবে যায় অধঃপাতে/ যেন মাছি উড়ে গিয়ে পড়ে যায় মধুতে। এভাবে সুখে-ভোগে দরবেশের দিন কাটে গুলবাগে, বাদশাহর মনে ফের দরবেশের যেয়ারাতের সাধ জাগে। গিয়ে দেখেন, তিনি তখন অন্য মানুষ, ঘীয়ে মাখনে বিলকুল নাদুশনুদুশ! হেলান দিয়ে আছেন মখমলের তাকিয়ায়। রূপসী দাসী মাথার উপর ময়ূরপাখা দোলায়। দরবেশের খোশহাল দেখে বাদশাহ হলেন খোশ; বাড়িয়ে দিলেন মাসোহারা ও খোরপোশ। দরবেশের সঙ্গে বাদশাহর হলো অনেক কথা, অবশেষে বললেন তিনি নত করে মাথা, দু’টি শ্রেণীকে আমি মনে প্রাণে ভালোবাসি, আর কেউ তাদের বাসে না ভালো এত বেশী। এক হলো যারা আলিম, বিদ্যানুরাগী, আর হলো যারা যাহিদ, সংসারত্যাগী। এক উযির অতি বিচক্ষণ, বাদশাহর সঙ্গে থাকেন সর্বক্ষণ, বললেন তিনি ধীরে ধীরে বাদশাহকে সম্বোধন করে, জাহাঁপানা, দাবী হলো ভালোবাসার, উভয়ের সঙ্গে করবেন সদাচার। আলিম যারা তাদের দান করুন বেশুমার, যেন ইলমের প্রতি হয় অনুরাগ সবার। আর যারা যাহিদ সংসার ত্যাগী, দান দ্বারা ঠিক নয় তাদের করা দুনিয়াভোগী। শিক্ষা- দুনিয়ার মোহজাল এবং শয়তানের ধোকা সম্পর্কে সাবধান থাকা উচিত (ক্রমশ)
শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা