সফর ১৪৩১ হি:(১৫)

শেখ সাদীর গুলিস্তা

শেখ সাদীর গুলিসত্মাঁ

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

 (ধারাবাহিক)

একটি ঘটনা লোকে করে বর্ণনা; দূরের এক দেশ, সেখানে ছিলেন এক দরবেশ। যেমন জ্ঞানী তেমন গুণী। তার ছিলো কালো কুৎসিত এক কন্যা, দেখলে সবার ধরে যায় ঘেন্না। কন্যা ধীরে ধীরে বড় হলো এবং দেখতে দেখতে বিয়ের বয়স হলো। কিন্তু যেমন তেমন বরও জোটে না মেয়ের কপালে, সবাই যে রূপের পূজারী একালে এবং সেকালে! একে ওকে যতই বলা হয় যৌতুকের কথা, গোমড়া মুখে চলে যায় দুলিয়ে মাথা। বেটে, মোটা, সেও বলে ‘এ মেয়ে নয় পসন্দ, যৌতুকে চালাতে চাও অচল পণ্য, আমি কি অন্ধ! যতই সাজুক বদসূরত দুলহান, শোভে না তার গায়ে রেশমি ‘পিরহান’।’ অবশেষে দরবেশের দুয়ারে দাঁড়ালো এসে সত্যি এক অন্ধ। নাচার বাবা তারই হাতে তুলে দিলেন মেয়ে, চোখ করে বন্ধ।

বহু দূরে লঙ্কা দেশে ছিলেন মস্ত এক বৈদ্য, শোনা গেলো, এদেশে তিনি এসেছেন সদ্য। তার দেশ যেমন লঙ্কা, তেমনি বাজলো তার ডঙ্কা। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে চিকিৎসার খ্যাতি, অন্ধজনে ফিরে পায় আলো দ্রুত অতি। সবাই এসে পিতাকে বলে, শোন আমাদের পরামর্শ, জামাতার চিকিৎসা করো, কন্যার জীবনে আসে যেন হর্ষ। পিতা বলে, তোমাদের কথা ঠিক, কিন্তু ভয় লাগে ভেবে সবদিক, অন্ধ ফিরে পাবে আলো, ধরা যাক; তখন যদি কন্যাকে আমার দিয়ে দেয় তালাক! জ্ঞানীগণ বলেছেন কথা অতি দামী, কালো মেয়েকে এনে দাও অন্ধ স্বামী।

শিক্ষা- যে কোন কাজ করার আগে চিন্তা করা উচিত, যাতে পরবর্তীতে হিতে বিপরীত না হয়।

***

একবার দেশের বাদশাহর দরবারে, দরবেশদের জামাত এলো এক দরকারে। বাদশাহ প্রথমে পুছলেন তাদের পরিচয়, তারপর করলেন কুশল বিনিময়। তিনি তাদের পাশে বসালেন করে আদর-সমাদর, যেন অন্তরে তাদের প্রতি অনেক কদর। বাদশাহ অনেক কিছু করলেন, করলেন না শুধু ভক্তি, যদিও মুখে প্রকাশ করেননি বিরক্তি। তবে যাদের আছে অন্তর্দৃষ্টি ও প্রজ্ঞা, তারা বুঝতে পারে কোনটি কদর, কোনটি করুণা ও অবজ্ঞা! কিন্তু সবাই সবকিছু বুঝতে পারে না এবং আচরণের গভীরে যেতে পারে না। তাই জামা‘আতের সকলে খুশী হলো এবং বাদশাহকে দু‘আ দিলো। সেই জামাতে একজন দরবেশ ছিলেন অতি বিচক্ষণ, বাদশাহর আচরণ-রহস্য তিনি বুঝলেন বিলক্ষণ। তাই ভরা দরবারে সংযত স্বরে বললেন, শুনুন জাহাপনা, এই দুনিয়া হয়ে যাবে ফানা। এখানে ক্ষণিক জীবনে, দিন-রাত যাপনে আমরা সুখী; আপনি দুঃখী। লোকে-লশকরে, ধনে-ভান্ডারে আমরা তুচ্ছ, আপনি অতি উচ্চ। কিন্তু জীবনের শেষক্ষণে, মরণে কাফনে দাফনে এবং কবরের শয়নে উভয়ে সমান। কারণ উপরে মুছে যায় সব নিশান, ভিতরে শুধু মাটির বিছান। আর কিয়ামতে! জানি না কে ওঠবে কী হালতে। তবে ইনশাআল্লাহ আমাদের হিসাব হবে হালকা, যেন শুকনো পাতা, বা পেয়াজের ‘ছিলকা’। কবিতা-

জানি বাদশাহ তুমি বিশ্বজয়ী অশেষ প্রতাপ/ আমি ফকির, টুকরো রুটির তরে করি বিলাপ/ মহলে-কুটিরে যেদিন মরণ করিব বরণ/ অচিন ঘরে সঙ্গে যাবে শুধু শুভ্র কাফন/ রিক্ত হাতে যাবেই যখন তখত-তাজ ছাড়ি/ বাদশাহি নয়, উত্তম ফকিরি, বলতে পারি।

শিক্ষা- তুমি গরীব হতে পারো, কিন্তু আত্মপরিচয় ও আত্মমর্যাদা ভুলে যাওয়া উচিত নয় এবং দুনিয়াদারদের সামনে নিজেকে ছোট করা উচিত নয়।

***

তরীকতের মূল কথা- 

জামায় তালি, ছেঁড়া জুতা আর নেড়ে মাথা, এটা নয় দরবেশির আসল কথা। এটা তো বাইরের খোলস এবং শুকনো নিরস। দরবেশির আসল রহস্য তোমাকে বলবো অবশ্য। যখন দিল হবে যিন্দা এবং নফস হবে মুরদা তখনই তুমি হবে আসল আশিক, জীবনে তোমার হবে ছুবহে ছাদিক। কবিতা-

ফকিরি নয় তো মুখের দাবী, কথার বড়াই/ একটু আঘাতে ফুঁসে ওঠে শুরু করে লড়াই/ পর্বতচূড়া হতে গড়ায় পাথরের চাঁই/ দাঁড়িয়ে থাকে ফকির দিলে যে তার ভয় নাই/ জানে সে খোদার হুকুম ছাড়া পাতা নাহি নড়ে/ কোন শক্তি নাই মারিবে, আল্লাহ রাখে যারে।

***

তরীকতের মূল কথা-

দরবেশের জীবন হবে এমন। মুখে যিকির, দেমাগে ফিকির। দিলে ছবর, যবানে শোকর। অল্পে তুষ্ট, তাকদীরে নয় রুষ্ট। আত্মত্যাগ ও মানবসেবা, এবং ইবাদত-বন্দেগি নিশি-দিবা। তাওহীদ ও একত্বে অটল বিশ্বাস, তাওয়াক্কুল ও আল্লাহ-ভরসায় কাটে শ্বাস-প্রশ্বাস। উপরের প্রতিটি গুণে যে গুণান্বিত, সেই আসল দরবেশি সাজে সজ্জিত, যদিও গায়ে রেশমি জামা এবং মাথায় দামী আমামা। আর যে ভবঘুরে, নাই নামায-রোযা, আছে শুধু খাহেশাত ও প্রবৃত্তির পূজা। সকাল-সন্ধ্যা যে ভোগ-বিলাসে বিভোর, আর গাফলতের ঘুমে রাত করে ভোর। যা পায় তাই খায়, হালাল-হারাম বাছে না, যা মুখে আসে তাই বকে, ভালো-মন্দ ভাবে না, সে তো ফাসিক-ফাজির, যদিও সুরতে মস্ত ফকির। গায়ে যদিও ফকিরি লেবাস এবং কুটিরে করে বসবাস। কবিতা-

ভিতরে নাই তোমার খোদাভীতি, ধর্মভয়/ গায়ে আলখেল্লা, তুমি কপট সুনিশ্চয়/ দুয়ারে তোমার ঝুলিতেছে পর্দার বাহার/ ঘরের ভিতরে নাই একটা চাটাই তোমার/ বাইরের সাজ ত্যাগিয়া ধর ভিতরের সাজ/ হতে চাও যদি দু’জাহানে বাদশাহ বেতাজ।

***

একদিন দেখি ফুলদানিতে তাজা ফুলের তোড়া, কিছু শুকনো পাতায় মোড়া। অবাক মেনে বলি আপন মনে, তাজা ফুলের পাশে শুকনো পাতা কেন আসে! নিজের মাঝে তুচ্ছ পাতা কী গুণ ধরে, যাতে ফুলের সাজে ফুলের সঙ্গ পেতে পারে! শুকনো পাতা কাঁদে আর বলে, আমি না হয় তুচ্ছ, তুমি কেন অবুঝ হলে? জ্ঞানীদের নীতিকথা ভুলে গেলে? ভদ্র যারা সঙ্গীকে ভুলে না তারা? মানি, ফুলের সৌন্দর্য-সুবাস নেই আমার অঙ্গে, তবু কি ছিলাম না আমি বাগানে ফুলের সঙ্গে?

তাই তো! তাই তো! শুকনো পাতার কথা সত্য তো! মহান দয়াময়ের বান্দা আমিও তো! তাঁরই নিরন্তর দানে ও দয়ায় প্রতিপালিত! কোন গুণ ও যোগ্যতা আমার আছে বা নেই, পাবো তাঁর দয়া ও করুণার ছায়া, আশা এই। জানি, আমল-বন্দেগির নেই পাথেয়-পূজি, তাই তো তাঁর দয়া ও করুণার আশ্রয় খুঁজি! অভাগা বান্দার যখন কোন আশা-ভরসা থাকে না, দয়াময়ের দয়াই তখন তার শেষ ঠিকানা! মালিক যখন আযাদ করেন, বুড়ো নাচার গোলাম বেছে নেন। মানুষের সমাজে যুগ যুগের এই তো রীতি, তুমিও যেন তাই করো দয়াময়, এই মিনতি। বুড়ো সা‘দীকে হে মহান বিশ্বপালক, করো মাফ এবং গোনাহ থেকে করে দাও পাক-ছাফ। হে পাপী, ছাড়ো পাপ, চলো তাঁর সন্তুষ্টির পথে, আনুগত্যের সম্পর্ক করো শুধু খোদার সাথে। বড় দুর্ভাগা যে ছেড়ে যায় এ দুয়ার, আর কোন দুয়ার পাবে না সে আশ্রয় নেয়ার।

শিক্ষা- নিজের তুচ্ছতা এবং গোনাহের আধিক্যের কারণে হতাশ ও নিরাশ হওয়া উচিত নয়। কারণ দয়া ও করুণাই হলো আল্লাহ তা‘আলার শান।

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা