জুমাদাল উলা ১৪৩২ হিঃ (২০)

তোমাদের জন্য

জীবনের সৌন্দর্য ছবরে ও শোকরে

লিখেছেনঃ আমাতুল্লাহ তাসনীম সাফফানা

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

 

একটি কিতাব পড়েছিলাম, তাতে একটি প্রশ্ন ছিলো। প্রশ্নটির সামনে  সেদিন হঠাৎ আমি যেন থমকে দাঁড়িয়েছিলাম।

 ما هي الحياة؟  জীবন কী? জীবনের শুরু কোথায়, শেষ কোথায়? কী জীবনের পরিণতি? এবং কিসে জীবনের পূর্ণতা

 জীবনকে বোঝার জন্য এবং জীবনকে সুন্দরভাবে যাপন করার জন্য, সন্দেহ নেই, এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। দায়িত্বপূর্ণ ও কর্মময় জীবনের শুরুতেই এ প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা থাকা দরকার।  কিন্তু  নিজের সম্পর্কে, নিজের উৎস ও গন্তব্য সম্পর্কে মানুষ বড় উদাসীন। জীবন শুরু হয় এবং জীবন বয়ে যায়; যৌবনের পর বার্ধক্য এসে পড়ে; কবরের দুয়ার খুলে যায় এবং মানুষ কবরে চলে যায়; অথচ ঐ প্রশ্নের উত্তর তার জানা হয় না। কারণ জীবনের মায়াজালে আমরা এমনই জড়িয়ে পড়ি যে, জীবন নিয়ে চিন্তা করারও অবসর থাকে না। আমাদের মনেই থাকে না যে, জীবন শুধু ভোগ করার জন্য নয়, বরং কিছু অর্জন করার জন্য। এমন কিছু অর্জন করার জন্য যা এই জীবনের স্রষ্টা আমাদের জন্য সৃষ্টি করে রেখেছেন অন্য একটি জীবনে। হাঁ, অন্য একটি জীবন, যার শুরু এই জীবনের মৃত্যু থেকে, কিন্তু তার শেষের কোন সীমানা নেই; তা অনন্ত।

যেদিন প্রথম এ প্রশ্নের সম্মুখীন হলাম, আমার ভিতরে প্রচ- আলোড়ন সৃষ্টি হলো। জন্ম দেখেছি, মৃত্যু দেখেছি; জন্ম ও মৃত্যুর মধ্যবর্তী সময়ে জীবনের অনেক সৌন্দর্য-অসৌন্দর্য, অনেক আনন্দ-বেদনা দেখেছি। আমার নিজেরও জন্ম-মৃত্যুর কথা জেনেছি এবং জীবনের অনেক দূর পথ পাড়ি দিয়ে, জীবনের কয়েকটি স্তর অতিক্রম করে আমার বর্তমানকে স্পর্শ করেছি। কেউ জানে না, তার বর্তমান থেকে মৃত্যুর দূরত্ব কতটুকু! আমিও জানি না। শুধু জানি, জন্ম-মৃত্যু চিরন্তন সত্য।

কিন্তু জীবন কখনো এমন জ্বলন্ত প্রশ্ন হয়ে আমার সামনে আসেনি, যেমন সেদিন এসেছিলো। এখনো যেন আমার সামনে জ্বলজ্বল করছে সেই প্রশ্নটি-

ما هي الحياة؟

সত্যি তো! কাকে বলে জীবন? জীবনের শুরু কোথায়? শেষ কোথায়? কী জীবনের পরিণতি এবং কিসে জীবনের পূর্ণতা?

***

একজন অমুসলিম সাহিত্যিক আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘জীবন  এত ছোট কেন?’ আসলে জীবনকে দেখার দৃষ্টিকোণ দু’রকম। যাদের চিন্তা-চেতনায় ও বিশ্বাসে পৃথিবীর জীবন ছাড়া আর কোন জীবনের অস্তিত্ব নেই তাদের কাছে জীবনকে মনে হবে অনেক ছোট। শুরু হওয়ার আগেই যেন শেষ হয়ে যাওয়ার মত! কিন্তু যারা বিশ্বাস করে, জীবনের পর আছে এক অনন্ত জীবন, তারা জীবনকে দেখে অন্য ভাবে, তারা জীবনকে যাপন করে অন্যরকম করে।

উর্দু ভাষার কবি বলেছেন-

موت كو سمجها هى غافل اختتام زندكي/ هى يه شام زندكي صبح دوام زندكي

মৃত্যুকে উদাসীন, ভেবেছে জীবনের সমাপ্তি/ এ জীবনের সন্ধ্যা তো আসলে অনন্ত জীবনের প্রভাত!

অবিশ্বাসীর কাছে কেন জীবনকে মনে হয় ছোট? আমাদের পেয়ারা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আদমের বেটা বুড়ো হয়, আর তার মধ্যে দুটো জিনিস যুবক হয়, লোভ এবং দীর্ঘ আশা।’

আরবী ভাষার যে স্বাদ এবং যবানে নবুয়তের যে নূরানিয়াত, কীভাবে তা আসতে পারে অন্য ভাষার অনুবাদে! তাই যবানে নবুয়তের নূরানি আলফাযই এখানে তুলে ধরছি। তিনি বলেছেন-

يشيب ابن آدم و يشب فيه اثنان, الحرص و طول الأمل

পেয়ারা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চিত্র এঁকে দেখিয়েছেন, যাতে বিষয়টি যথার্থভাবে হৃদয়ঙ্গম হয়। তিনি একটি গোল বৃত্ত এঁকেছেন; তারপর একটি লম্বা রেখা টেনেছেন, যা বৃত্তের নিমণরেখা থেকে শুরু হয়ে ঊর্ধ্বরেখা অতিক্রম করে অনেক দূর চলে গিয়েছে। তারপর তিনি বলেছেন, বৃত্তটি হলো আদমের বেটার জীবন, আর লম্বা রেখাটি হলো তার দীর্ঘ আশা, যা তার জীবনের বৃত্তকে অতিক্রম করে অনেক দূরে চলে যায়। দুনিয়ার কয়েকটি জীবনও তার দীর্ঘ আশা পূর্ণ হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। এজন্য জীবনকে তার কাছে মনে হয় অনেক ছোট।

কিন্তু একজন মুমিনের কাছে জীবন কী? তার কাছে জীবন হলো-

خلق الموت و الحياة ليبلوكم أيكم أحسن عملا

তিনি মৃত্যুকে এবং জীবনকে সৃষ্টি করেছেন, যেন তোমাদের পরীক্ষা করে দেখেন যে, তোমাদের মধ্যে কে আমলের দিক থেকে উত্তম!

সুতরাং জীবন মানে আনন্দ-বিনোদন ও ভোগ-স্ফূর্তি নয়, জীবন হলো উত্তম কর্মের ক্ষেত্র। আর-

وما تقدموا لأنفسكم من خير تجدوه عند الله, هو خيرا و أعظم أجرا

আর যা কিছু কল্যাণ অগ্রে প্রেরণ করবে তোমরা নিজেদের জন্য, পাবে তা আল্লাহর নিকট। আর তা উৎকৃষ্টতর এবং পুরস্কার রূপে মহত্তর।

সেই পুরস্কারের উৎকৃষ্টতা ও মহত্ত্বের বিবরণ নবুয়তের পাক যবানে উচ্চারিত হয়েছে এভাবে-

ما لا عين رأت ولا أذن سمعت ولا خطر على قلب بشر

যা কোন চোখ দেখেনি, কোন কান শুনেনি এবং যার চিন্তা কোন মানবহৃদয়ে উদিত হয়নি।

***

অবিশ্বাসী অনেক পেয়েও মনে করে, কিছু পায়নি। কারণ তার চাওয়া ও পাওয়ার ক্ষেত্র দুনিয়ার দু’দিনের জীবন। সুতরাং তার জীবনে পাওয়ার জন্য শোকর নেই, আর না পাওয়ার উপর ছবর নেই।

পক্ষান্তরে বিশ্বাসী মুমিন অল্প পেয়েও ভাবে অনেক পেয়েছে। কারণ এ জীবন তো ভোগের জন্য নয়, অর্জনের জন্য। তাই অল্প পেয়েও সে শোকর করে এবং তৃপ্তি বোধ করে, আর যা পায়নি তার উপর ছবর করে এবং সংযমের আনন্দ লাভ করে।

ছবর ও শোকরই হলো বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী উভয়ের জীবনের পার্থক্যরেখা। বিশ্বাসীর জন্য ইহ জীবনে আছে শান্তি ও তৃপ্তি, আর মৃত্যুর পর অনন্ত জীবনে আছে অফুরন্ত প্রাপ্তি। সর্বোপরি তার জন্য রয়েছে আল্লাহ তা‘আলার রিযা ও সন্তুষ্টি।

শোকর হলো জান্নাতের ফুল, আর ছবর হলো জান্নাতের ফল। তো জান্নাতি ফলের স্বাদ ও জান্নাতি ফুলের সুবাস দুনিয়ার জীবনেই আমরা পেতে পারি ছবর ও শোকরের মাধ্যমে। কাফিরের জন্য শোকর করা যেমন কঠিন, ছবর করাও তেমনি কঠিন। পক্ষান্তরের মুমিনের জন্য ছবর ও শোকর করা খুব সহজ। কারণ সে জানে, জীবন কী ও কেন? জীবনের শুরু কোথায় এবং শেষ কোথায়? সে জানে, এ জীবন ভোগের জন্য নয়, অনন্ত জীবনের সুখ-শান্তি অর্জনের জন্য।

মুমিন যখন ছবর করে তখন সে জান্নাতের ফল ভোগ করে, আর যখন শোকর করে তখন সে জান্নাতি ফুলের সুবাস গ্রহণ করে। তাই ছবর করেও তার এত শান্তি এবং শোকর করে এত তৃপ্তি।

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা