আল কুদসসংখ্যা (৩/২)

আল কুদসসংখ্যা (বিশেষ).

ফিলিস্তীন আন্দোলন ঃ জিহাদ না যুদ্ধ!!

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

 

ফিলিস্তীনের পবিত্র ভূমিতে যখন থেকে প্রতিরোধ ও মুক্তি আন্দোলনের শুরু তখন থেকেই মূলত চিন্তা-চেতনা ও আদর্শের ক্ষেত্রে দু’টি বিপরীত ধারা বিদ্যমান। ধর্মনিরপেক্ষবাদী ধারা এবং ইসলামী ধারা। আন্দোলনের রজনৈতিক নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ ছিলো ধর্মনিরপেক্ষ-বাদী শক্তির হাতে, যাদের বক্তব্য ছিলো ফিলিস্তীনসমস্যা সম্পূর্ণ-রূপে মুসলিম-খৃস্টান নির্বিশেষে ফিলিস্তীনীদের জাতীয় সমস্যা; বড়জোর বৃহত্তর পরিসরে আরবদের জাতীয় সমস্যা। ইসলাম ধর্ম বা আলআকছা এখানে মূল বিষয় নয়, মূলবিষয় হচ্ছে ফিলিস্তীনের ভূখণ্ডের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব। এটা হরণ করার চেষ্টা করছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। এ ভূখণ্ডের মুক্তির জন্যই  হচ্ছে আমাদের লড়াই। হাঁ, মুক্তিসংগ্রামের অনুকূলে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর  ধর্মীয় অনুভূতিকে প্রয়োজনে ব্যবহার করা যেতে পারে, বরং ব্যবহার করা দরকার। তাদের বক্তব্য হলো, ফিলিস্তীনের মুক্তি-সংগ্রামের জন্য লড়াই করতে হবে। এ জন্য অস্ত্রপ্রশিক্ষণ দরকার, সমর কুশলতা ও কূটনৈতিক দক্ষতা অর্জন করা দরকার। ধর্ম হচ্ছে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বিষয়। যার ইচ্ছা পালন করবে, যার ইচ্ছা, করবে না। দ্বীনী তারবিয়াত, আলকুদস ও আলআকছার পবিত্রতা রক্ষার জন্য জিহাদের চেতনা ধারণ করা, তাদের দৃষ্টিতে এগুলো হচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীলতা। কারো মুখে কলমে এগুলো প্রকাশ্যে এসে যেতো, আর কৌশলগত কারণে কারো মুখে আসতো না, তবে অন্তরে সেটাই বদ্ধমূল ছিলো, যার প্রকাশ ঘটতো আচরণে ও কর্মতৎপরতায়। এককথায় তারা অস্ত্র, যুদ্ধ, সমরকুশলতা ও সংগ্রামী চেতনায় বিশ্বাসী ছিলো।

পক্ষান্তরে দ্বিতীয় ধারার অনুসারীরা পুরো বিষয়টিকে মনে করতো ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর জাতীয় সমস্যা। ঈমান ও তাওহীদে বিশ্বাসী একজন মুসলিমের দৃষ্টিতেই দেখতে হবে ফিলিস্তীনের সমস্যাকে এবং সমাধানও খুঁজতে হবে কোরআন ও সুন্নাহর নির্দেশিত পথে। জিহাদ এবং একমাত্র জিহাদই হচ্ছে ফিলিস্তীনের সমস্যার সমাধান। আর জিহাদের বুনিয়াদ হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে আল্লাহর রাস্তায় জান কোরবান করার দ্বীনী জাযবা ও চেতনা, যা ছাহাবা কেরাম তাঁদের জীবনে বাস্তবায়ন করেছিলেন। এ পবিত্র ভূমি যারা জিহাদের পথে, শাহাদাতের মাধ্যমে জয় করেছিলেন, আজ তার পুনরুদ্ধারের জন্য তাঁদের পথেই আমাদের চলতে হবে। আর জিহাদের মূল শক্তি হলো আল্লাহর পক্ষ হতে গায়বি মদদ, যেমন হয়েছিলো বদর হোনায়নে, কাদেসিয়া ইয়ারমুকে।

***

চিন্তার এ মৌলিক বৈপরীত্য সত্ত্বেও ইসলামী চেতনায় বিশ্বাসী পক্ষ ঐক্যবদ্ধ থাকার স্বার্থে অভিন্ন মঞ্চ থেকে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলো।

প্রথম চিন্তার ধারক ছিলেন মিশরের রাজা ফারুক এবং পরবর্তীকালে আরব জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা, রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিপ্লবের নেতা, মিশরের প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুন নাছের। পক্ষান্তরে দ্বিতীয় চিন্তার ধারক ছিলেন ইখওয়ানুল মুসলিমীনের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ হাসানুল বান্না। আটচল্লিশের আরব-ইহুদী সঙ্ঘাতে এ দুই ধারার অনুসারীরা একসঙ্গে লড়াই করেছিলো আগ্রাসী ইহুদি শক্তির বিরুদ্ধে। তখন আরব-অনারব পুরো মুসলিম উম্মাহ দেখতে পেয়েছিলো জিহাদ ও যুদ্ধের পার্থক্য। ঐ সময়ে যা কিছু অর্জন তা ছিলো ইখওয়ানের মুজাহিদীনের জিহাদ ও শাহাদাতের চেতনারই ফসল। মূলত আটচল্লিশ ও ছাপ্পান্নের আরব-ইহুদি লড়াই এ ইখওয়ানের গৌরবময় ভূমিকার কারণেই তাদের উপর নেমে আসে জামাল আব্দুন-নাছেরের পক্ষ হতে লোমহর্ষক নির্যাতন, যার ধারাবাহিকতা আজো চলছে ইখওয়ান ও হামাসের উপর।

***

ফিলিস্তীনের মুক্তি আন্দোলনকে সুশৃঙ্খল ও সাংগঠনিক কাঠামোর অধীনে আনার উদ্দেশ্যে ১৯৬৪ সালে আহমদ শাকীরী-এর নেতৃত্বের এবং জামাল আব্দুন-নাছেরের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় আত্মপ্রকাশ করে ফিলিস্তীনমুক্তি সংস্থা (পি এল ও)। এ সংস্থা তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যরূপে যা ঘোষণা করেছে তা হলো, ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত দখল করা প্রতি ইঞ্চি ফিলিস্তীনী ভূমি ইহুদী দখলদারিত্ব থেকে মুক্ত করা। মুক্তি সংস্থা তার ঘোষণাপত্রে দ্ব্যর্থহীনভাবে উল্লেখ করেছে, সশস্ত্র সংগ্রামই হবে মুক্তির একমাত্র পথ এবং ফিলিস্তীনী ভূখ-ের উপর ইহুদীরাষ্ট্র ইসরাইলের অস্তিত্বের কোন বৈধতা নেই। সুতরাং যে কোন মূল্যে ইহুদীরাষ্ট্রটির অস্তিত্ব মুছে ফেলতে হবে এবং প্রতিষ্ঠা করতে হবে জাতীয় ফিলিস্তীন- রাষ্ট্র।

ঘটনার ধারাবাহিকতায় ১৯৬৯ -এর ফেব্রুয়ারিতে ইয়াসির আরাফাত পি এল ও-র নেতৃত্বে আসেন। ১৯৭৪ সালে আরব-রাষ্ট্রগুলো ফিলিস্তীন মুক্তি সংস্থাকে ফিলিস্তীনী জনগণের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধিরূপে ঘোষণা করে। একই বছর একই পরিচয়ে পি এল ও জাতিসঙ্ঘে পর্যবেক্ষকসদস্যরূপে অন্তর্ভুক্ত হয়।

শুরু থেকেই ফিলিস্তীন মুক্তি সংস্থা ছিলো আগাগোড়া ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান। তারা সশস্ত্র সংগ্রাম করছিলো এবং  দুঃসাহসিক ফেদাইন তৎপরতাও পরিচালনা করছিলো, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো বিমানহাইজ্যাক। কিন্তু জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ নামের কোন কিছুর সঙ্গে তাদের না ছিলো সম্পর্ক, না পরিচয়।

***

১৯৪৯ থেকে বিশশতকের সত্তর দশকের শুরু পর্যন্ত জাতিসঙ্ঘ ফিলিস্তীনসমস্যাকে গুরুতর উদ্বাস্তু সমস্যারূপে দেখে এসেছে এবং ফিলিস্তীনীদের আত্মনিয়-ন্ত্রণাধিকার, স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের অধিকার এবং শরণার্থীরূপে নিজ ভূমিতে ফিরে যাওয়ার অধিকার স্বীকার করে এসেছে। এসব বিষয়ে জাতিসঙ্ঘ একের পর এক প্রস্তাব পাশ করেছে, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায়  ইসরাইল ঐ সকল প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এসেছে।

শুরু থেকেই বিভিন্ন আরবদেশ ফিলিস্তীনী মুক্তি সংস্থাকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টা চালিয়েছে। একই ভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েট ইউনিয়ন চেয়েছে নিজ নিজ সমর্থক আরব রাষ্ট্রগুলোর মাধ্যমে ফিলিস্তীনী মুক্তি সংস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করতে। ফলে বিভিন্ন সময় ফিলিস্তীন মুক্তি সংস্থার উপর নেমে এসেছে  বিভিন্ন রকম দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতি। একটা সময় এমনও এসেছে যে, মূল শত্রুকে ভুলে গিয়ে পি এল ওকে কোন কোন আরবরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সঙ্ঘাত-সঙ্ঘর্ষে জড়িয়ে পড়তে হয়েছে। এভাবে তাদের শক্তি ক্ষয় হয়েছে নিজেদের মধ্যে লড়াই করে করে, আর শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করার শক্তি হয়েছে নিঃশেষিত।

***

এদিকে মিশর সমগ্র মুসলিম উম্মহকে হতাশার সাগরে ডুবিয়ে দিয়ে ইসরাইলের সঙ্গে ক্যাম্পডেভিড চুক্তিতে আবদ্ধ হলো ডিসেম্বর ১৯৭৮ সালে। এভাবে সবচে’ বড় আরবশক্তি আরব-ইসরাইল সঙ্ঘাতের বলয় থেকে বের হয়ে গেলো। আরো অনেক ঘটনাই ঘটলো একে একে। সবকিছু মিলিয়ে ফিলিস্তীন মুক্তি সংস্থার শক্তি ও মনোবল ভেঙ্গে পড়লো। কারণ তাদের ভিত্তি জিহাদের উপর এবং আল্লাহর গায়বি মদদের উপর ছিলো না, ছিলো আরবদেশগুলো অর্থসাহায্য এবং রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার উপর। ফলে আজীবন সশস্ত্র সংগ্রামের ঘোষণা দিয়ে অস্তিত্ব লাভকারী ফিলিস্তীন মুক্তি সংস্থার নেতৃবৃন্দও শান্তিচুক্তির জোয়াল কাঁধে নিতে বাধ্য হলো। কারণ তাদের তখন মূল ‘টার্গেট’ লক্ষ্য ছিলো যে কোন মূল্যে আন্তর্জাতিক আনুকূল্যের মাধ্যমে ফিলিস্তীনী জনগণের একক নেতৃত্ব ও প্রতিনিধিত্বের মর্যাদা রক্ষা করা।

অনেক জলঘোলা করার পর অসলো চুক্তি সম্পন্ন হলো, যাতে স্বাক্ষর কারী হলো ইসরাইল ও ফিলিস্তীনমুক্তিসংস্থা। এভাবে নাকে খত দিয়ে স্বীকার করে নেয়া হলো ইসরাইলের অস্তিত্বের বৈধতা এবং ফিলিস্তীনের সাতাত্তর ভাগ ভূমির উপর ইহুদিদের মালিকানা । একই সঙ্গে ফিলিস্তীনমুক্তিসংস্থা সশস্ত্র সংগ্রাম থেকে সরে আসার এবং শান্তিআলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধন করার নীতি ঘোষণা করে। এ জন্য তাদেরকে প্রতিষ্ঠাকালীন ঘোষণাপত্রেও পরিবর্তন আনতে হলো। বাদ দিতে হলো ইসরাইলে অস্তিত্ব মুছে ফেলে সমগ্র ফিলিস্তীনকে মুক্ত করার অনুচ্ছেদটি ।

বস্তুত অসলোচুক্তির মাধ্যমে ইসরাইল লাভ করলো তার অস্তিত্বের বৈধতা, আর ফিলিস্তীন মুক্তিসংস্থা হারালো তার নিজের অস্তিত্বের বৈধতা। বিনিময়ে লাভ করলো ইসরাইলের পক্ষ হতে ফিলিস্তীনী জনগণের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি হিসাবে স্বীকৃতি। তাকে পশ্চিম তীর ও গাজা অঞ্চলে সীমিত পর্যায়ে স্বায়ত্ত শাসনের অধিকার দেয়া হলো। আর দেয়া হলো মৌলিক সমস্যাগুলো আগামী পাঁচবছরের মধ্যে সমাধানের আশ্বাস। তারপর সেই প্রসিদ্ধ বাক্যটাই নতুন করে প্রমাণিত হলোÑ

‘ইহুদী আশ্বাসে যদি করো বিশ্বাস, ওঠবে তোমার নাভিশ্বাস।’

***

এটা হলো এক পক্ষের পরিণতি, যাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিলো ফিলিস্তীনের মুক্তির জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম।

পক্ষান্তরে হামাস এ শান্তিচুক্তি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে জিহাদের পথে অবিচল থাকলো। তারা এ শপথ পুনর্ব্যক্ত করলো যে, ইসরাইলের অবৈধ অস্তিত্ব ধ্বংস করে ফিলিস্তীনের সমগ্র-ভূখন্ডে স্বাধীন ফিলিস্তীনী রাষ্ট্র গঠন করা হবে, যার ভিত্তি হবে কোরআন-সুন্নাহর শাসন। ফলে হামাস হলো ইসরাইল, আমেরিকা ও জাতিসঙ্ঘের দৃষ্টিতে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী!

***

মুসলিমবিশ্বের সর্বজনশ্রদ্ধেয় মুফতিয়ানে কেরাম সর্বসম্মত যে ফতোয়া জারি করেছেন তাতে বলা হয়েছে, ‘ইহুদীবাদী রাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের চাহিদা অনুযায়ী শন্তিচুক্তি বা সমঝোতা করা কোনভাবেই বৈধ নয়। বরং দখলকৃত ভূখ- মুক্ত করার জন্য এবং ইসলামের পতাকাতলে ফিরিয়ে আনার জন্য জিহাদ পরিচালনা করা অপরিহার্য কর্তব্য। কারণ এটা হচ্ছে হক ও বাতিলের মধ্যে এমন এক লড়াই যা যুগপরম্পরায় চলে এসেছে এবং পরবর্তী প্রজন্ম তার উত্তরাধিকার গ্রহণ করতে থাকবে, আল্লাহ তা‘আলা নিরঙ্কুশ বিজয় দান করা পর্যন্ত। কোন প্রজন্ম যদি লড়াই চালিয়ে যেতে কোন কারণে অপারগ হয়, তাহলে তার কোন অধিকার নেই আগামী প্রজন্মকে তার জিহাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার। আর সবাইকে মনে রাখতে হবে যে, ফিলিস্তীনসমস্যা বিশ্বের সকল মুসলিমের সমস্যা, যারা কোন অজুহাতে তাদের অধিকার ত্যাগ করতে রাজী নয়, যামানা যতই দীর্ঘ হোক। এটা শুধু ফিলিস্তীনীদের সমস্যা নয়, পিএলও বা তার নেতৃত্বের সমস্য তো নয়ই।

***

১৯৭৮ পর্যন্ত সমগ্র আরবজাতি বিভিন্ন দুর্বলতা ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এ মর্মে ঐক্যবদ্ধ ছিলো যে, ইসরাইলের অস্তিত্ব সম্পূর্ণ-রূপে অবৈধ, ফিলিস্তীনের ভূমি থেকে তাকে উৎখাত করা অবশ্য কর্তব্য। আরব ও মুসলিমজাতি যদি আজ সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে দুর্বল হয়ে থাকে এবং ইহুদী সন্ত্রাসিদের ফিলিস্তীনের ভূমি থেকে উৎখাত সক্ষম না হয়, তাহলেও কোন পরোয়া নেই। যতটুকু প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব তারা তাই চলিয়ে যাবে, আর সেই সময়ের ইন্তিযার করবে যখন আল্লাহর ইচ্ছায় আবার আমাদের শক্তি হবে। কিন্তু মিশরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট Ñকবরে তার সঙ্গে আল্লাহ উপযুক্ত আচরণই করুনÑ এ ঐক্যবদ্ধ অবস্থান শেষ করে দিয়ে এবং আরব ও মুসলিম বিশ্বকে স্তব্ধ করে দিয়ে ১৯৭৮ সালে আকস্মিকভাবে ইসরাইল সফর করলেন এবং ইসরাইলের অস্তিত্বের বৈধতা স্বীকার করে চুক্তি করে বসলেন, যা ক্যম্পডেভিড চুক্তি নামে খ্যাত। এরপরে জর্ডানও একই পথে হাঁটলো।

এরপর পিএলও আমেরিকার তত্ত্বাবধানে ইসরাইলের সঙ্গে তথাকথিত শান্তিচুক্তিতে আবদ্ধ হয়ে ফিলিস্তীনসমস্যার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দিলো। পিএলও ভুলে গেলো বিশলাখ ভাগ্যবিড়ম্বিত ফিলিস্তীনী শরণার্থীদের কথা। ভুলে গেলো বাইতুল মাকদিসের কথা এবং মসজিদুল আকছার কথা, যা ধ্বংস করে তার উপর ইহুদী সন্ত্রাসীরা হায়কালে সোলায়মানি নির্মাণ করতে চায়।

এভাবে ইহুদীদের সামনে সুযোগ এসে গেলো সমগ্র বাইতুল মাকদিসকে তাদের অবৈধ রাষ্ট্রের রাজধানী ঘোষণা করার, আর পিএলও শুধু সবিনয় আবেদন করার অবস্থানে এসে গেলো যে,  পূর্বজেরুসালেম আমাদের ‘কল্পিত’ ফিলিস্তীনী রাষ্ট্রের রাজধানীরূপে দান করুন, যা কোনদিন অস্তিত্ব লাভ করবে বলে ইসরাইল বিশ্বাস করে না।

তখন আমেরিকা ও ইসরাইলের পক্ষ থেকে বলা হলো, শান্তিচুক্তির প্রতি আন্তরিকতার প্রমাণ দাও। ফিলিস্তীনের মাটিতে শান্তিচুক্তিবিরোধী যত পক্ষ আছে তাদের দমন করো। সমর্থন, সহযোগিতা যা প্রয়োজন আমরা দেবো।

***

ধর্মনিরপেক্ষ ধারার এ আত্মসমর্পণমূলক অবস্থানের পর আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে বিশ্বাসী যারা তাদের পক্ষে বিদ্রোহ ঘোষণা ছাড়া আর কোন উপায় থাকলো না। তারা তাই করলেন। আর ইসরাইল- আমেরিকার ফিলিস্তীনীদের পরস্পর ‘গলাকাটা’ দুই দলে বিভক্ত করার পরিকল্পানা সফল হলো।

ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যু হলো। শুরু হলো মাহমূদ আব্বাসের যুগ, যিনি নিজের ঈমান ও বিবেক ইসরাইল ও আমেরিকার কাছে শুধু বন্ধকই রাখেননি, বরং বিক্রি করে দিয়েছেন।

আমেরিকার নেতৃত্বে সমগ্র পাশ্চাত্য শক্তি নৈতিক ও বৈষয়িক সাহায্য নিয়ে মাহমূদ আব্বাস ও তার ধর্মনিরপেক্ষ দল পিএলওর পক্ষে অবস্থান নিলো, যাদের বর্তমান পরিচয় হলো ‘ফিলিস্তীনী কর্তৃপক্ষ, যার খোলাছা হলো ভূখ- ইসরাইলের, শাসন ও স্বায়ত্তশাসন তোমার’! হায়, বিবেক ও আকলবুদ্ধির কতটা অবক্ষয় হলে মানুষ এতটা নির্বোধ হতে পারে!!

পক্ষান্তরে হামাস হলো সন্ত্রাসী দল। কারণ তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাসে অবিচল এবং ইহুদী সন্ত্রাসিদের অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলের অস্তিত্ব মুছে ফেলে ফিলিস্তীনের পবিত্র ভূমি উদ্ধারের লক্ষ্যে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদে বিশ্বাসী। দেশহীন প্রেসিডেন্ট মাহমূদ আব্বাসের দায়িত্ব হলো এই ‘সন্ত্রাসী’ দলটিকে ফিলিস্তীনের মাটি থেকে উৎখাত করা।

সভ্য পৃথিবীর কোন আইন কিন্তু বলে না যে, স্বদেশের ভূমি জবরদখলকারী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে যারা তারা হতে পারে সন্ত্রাসী। আরো বিস্ময়ের বিষয় হলো, গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী আমেরিকা ফিলিস্তীনের স্বায়ত্তশাসিত এলাকায় ইসলামপন্থী ফিলিস্তীনীদের সরকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা কোনভাবেই বরদাশত করতে রাজী নয়, নির্বাচনে তাদের নিরঙ্কূশ বিজয় সত্ত্বেও। অপরাধ শুধু এই যে, তারা জিহাদের কথা বলে, স্বদেশের ভূমি জরবদখলকারী  ইসরাইলের অবৈধ অস্তিত্ব স্বীকার করতে তারা প্রস্তত নয়। প্রস্তত নয় মাহমূদ আব্বাসের মত ফিলিস্তীনের সমস্যার মূল অবস্থান থেকে সরে আসতে।

মাহমূদ আব্বাস ও তার অনুসারীদের হটিয়ে হামাস গাজার উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠাপূর্বক সরকার পরিচালনা শুরু করে। হামাসের প্রতি ফিলিস্তীনীদের জনসমর্থন ছিলো অভাবিতপূর্ব।

আমেরিকা, ইসরাইল এবং তাদের তাবেদার আরবদেশগুলো গাযায় পূর্ণ অবরোধ আরোপ করে। এখানে এসে আবার পরিষ্কার হয়ে যায় বিশ্ববাসীর কাছে যুদ্ধ ও জিহাদের পার্থক্য! অবরোধের ফলে এমন মানবিক সঙ্কট দেখা দেয় যার দশমাংশেরও অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়নি, তথাকথিত ফিলিস্তীন মুক্তি সংস্থার দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনে। শত শত ফিলিস্তীনী শিশু নারী ও বৃদ্ধ মৃত্যুবরণ করেছে শুধু চিকিৎসা ও খাদ্যের অভাবে। বিদ্যুৎ নেই পুরো অঞ্চলে মাসের পর মাস। এমন কোন নিষ্ঠুরতা নেই যা প্রয়োগ করেনি ইহুদী-মার্কিন তাবেদার মাহমূদ আব্বাস ও তার বাহিনী। দিনের পর দিন বিমানহামলা চালিয়েছে সন্ত্রাসবাদী রাষ্ট্র ইসরাইল ‘মাহমূদ আব্বাসের সমর্থনে’। ধারণা ছিলো দু’দিনের মাথায় হামাসকে আত্মসমর্পণ করতে হবে। অন্তত জনতার বিদ্রোহের মুখে হামাসকে পিছু হটতে হবে। কিন্তু আমেরিকা ও তার দোসর আরবরাষ্ট্রগুলো অবাক বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করলো, হামাস মাথা নত করেনি, হামাস আত্মসমর্পণ করেনি এবং অবরোধে বিপর্যস্ত গাজার ফিলিস্তীনী জনগণ বিদ্রোহও করেনি। কারণ হামাসের প্রতি তাদের ভালোবসা ছিলো আল্লাহর জন্য, জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর জন্য। তারা দেখেছে তাদের প্রতিটি সুখে দুঃখে হামাস তাদের অংশীদার।

২০০৭-এর ১৭ই ডিসেম্বর ‘ফিলিস্তীনের জন্য সাহায্য’ এই শিরোনামে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। তাতে আমেরিকা, ইসরাইল ও বিভিন্ন আরবদেশসহ বিশ্বের নব্বইটিরও বেশী দেশ অংশগ্রহণ করলো। সম্মেলনের আসল উদ্দেশ্য ছিলো মাহমূদ আব্বাসকে বৈষয়িক সাহায্য যোগানো যাতে হামাসকে নির্মূল করার কাজে তিনি আরো উৎসাহ বোধ করেন। সম্মেলনে বিভিন্ন দেশ ৭০০ মিলিয়ন ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিলো।

অবরোধের কারণে গাজায় যখন পৃথিবীর ইতিহাসে কঠিনতম মানবিক বিপর্যয়ের বিভীষিকা চলছে আরববিশ্বের নেতৃবৃন্দ তখন নির্বিকার। শত শত মানুষ যখন মানবিক বিপর্যয়ের শিকার হয়ে মুত্যুবরণ করছে তখনো এগিয়ে আসেনি একটাও আরবদেশ একটুকরো রুটি এবং একবোতল পানি নিয়ে। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলো তুরস্ক। তারপরের রক্তঝরা ও অশ্রুঝরা ইতিহাস সবার জানা।

***

মুসলিমবিশ্বে বিরাজমান চরম নৈরাজ্যের সুযোগে আজ হামাসের উপর নেমে এসেছে নতুন দুর্যোগ। সম্পূর্ণ অন্যায়-ভাবে হামাসকে বাধ্য করা হয়েছে গাযার নিয়ন্ত্রণ মাহমূদ আব্বাসের হাতে ছেড়ে দিতে। গাযার সাধারণ জনগণ হয়ত তাদের সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে, হয়ত বিদ্যমান অবস্থায় প্রতিরোধ চলিয়ে যাওয়া আর সম্ভব ছিলো না। হয়ত অন্য কোন দল বা গোষ্ঠী, এমনকি প্রতিষ্ঠিত কোন রাষ্ট্রও নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করতো এ পরিস্থিতিতে। কিন্তু হামাস তা করেনি।

কয়েকটি সম্মানজনক শর্তে মাহমূদ আব্বাসের সঙ্গে ‘ঐক্যের ডাকে’ গাযার প্রশাসন তথাকথিত ফিলিস্তীনী কর্তৃপক্ষের হাতে ছেড়ে দিয়েছে।

হামাস এখনো দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, তারা পূর্ণ সত্যের পথে রয়েছে; তারা জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর পথে রয়েছে।

আর জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহই হচ্ছে  যিল্লতি থেকে মুক্তির এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের একমাত্র পথ। সুতরাং  যথাসময়ে আল্লাহ পক্ষ হতে গায়বী সাহায্য অবশ্যই নেমে আসবে, ইনশাআল্লাহ।

ويومئذ يفرج المؤ منون بنصر الله

সেদিন মুমিনগণ খুশী হবে আল্লাহর সাহায্য পেয়ে। *

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা