কাশ্মীরসংখ্যা

কাশ্মীর সংখ্যা (বিশেষ)

কাশ্মীর-জিহাদের উৎস বালাকোট

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

 

কাশ্মীর-জিহাদের উৎস বালাকোট

কাশ্মীর জ্বলছে দশকের পর দশক, প্রায় একটি শতক। তবু স্বাধীনতার সূর্য উদিত হওয়ার কোন লক্ষণ নেই। খুন-আগুনের এত লম্বা দরিয়া পাড়ি দিয়েছে কি আর কোন জনপদ, ফিলিস্তীন ছাড়া!

ফিলিস্তীনে যেমন তেমনি কাশ্মীরে, অবস্থা দেখে মনে হয়, আলোর দিকে এগিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে আমরা যেন অন্ধকারের দিকেই বরং পিছিয়ে যাচ্ছি! আমাদের সামনে আজ একটি জ্বলন্ত প্রশ্ন, কেন এমন হচ্ছে? আমরা ভুল পথে চলছি না তো? আমাদের আযাদীর সঠিক পথ কোনটি?

দেখুন, আমাদের দুশমন তাদের পথের নিশানা ঠিক রেখেছে। ইহুদিরা ফিলিস্তীনের ভূখ-ণ্ডের জন্য লড়াই করছে, কিসের ভিত্তিতে? এটা নাকি তাদের প্রতিশ্রুত ভূমি! কে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তাদের? ইসরাইলের ঈশ্বর সদাপ্রভু! অর্থাৎ একমাত্র ধর্মই হলো তাদের লড়াইয়ের ভিত্তি!

আমরা কিসের ভিত্তিতে লড়াই করছি ফিলিস্তীনে? ইয়াসির আরাফাত ও আলফাতাহ-এর ভাষায় আরবজাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে!

ফিলিস্তীনের প্রধান মুফতী আমীন আলহোসায়নী ফিলিস্তীনের পবিত্র ভূমিতে জিহাদ শুরু করেছিলেন আলকুদসের জন্য, আমাদের প্রথম কিবলার হুরমত রক্ষা করার জন্য। সেখানে প্রতিটি মৃত্যু ছিলো শাহাদাত! কিন্তু সীরাতুল মুস্তাকীম থেকে আমাদের বিচ্যুতি ঘটলো, আমরা জাতিসঙ্ঘের দ্বারস্থ হলাম! সুতরাং পরাজয় ছাড়া আর কী হতে পারে আমাদের ভাগ্য!

***

হিন্দু-ইহুদি একজোট হয়ে লড়াই করছে আমাদের বিরুদ্ধে। অভিজ্ঞতা বিনিময় করছে এবং সদম্ভে সেটা ঘোষণাও করছে। হিন্দুভারত পরিষ্কার ভাষায় ঘোষণা করছে কাশ্মীরে তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হচ্ছে হিন্দুত্ববাদের প্রতিষ্ঠা এবং সরাট অশোকের স্মৃতি পুনরুদ্ধার...!

কাশ্মীরে আমরা ভুলে গিয়েছি আমাদের সংগ্রামের উৎস ছিলো জিহাদ এবং আল্লাহর যমীনে আল্লাহর কালিমা বুলন্দ করা।

মুসলিম ভূখ- কাশ্মীরের আযাদী ছিলো সৈয়দ আহমদ শহীদ রহ.-এর জিহাদের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এজন্যই তিনি কাশ্মীরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছিলেন সীমান্ত অঞ্চল থেকে।  সরদারানে কাশ্মীর (ফয়য তলবখান, হাবীবুল্লাহ্ খান, যবরদস্ত খান প্রমুখ) সৈয়দ শহীদকে দাওয়াত দিয়েছিলেন কাশ্মীরকে মারকায বানিয়ে জিহাদ পরিচালনা করার, যাতে পুরো কাশ্মীরভূমি আযাদ হয়ে যায়। কাশ্মীরের সীমান্ত অঞ্চল বালাকোটে এসে তিনি বাধাগ্রস্ত হন শিখশক্তি দ্বারা, যাদের হাতে কাশ্মীর ও মুসলিম অধিবাসীরা ছিলো যুলুম নির্যাতনের শিকার। বালাকোটের ময়দানে সৈয়দ শহীদ শিখশক্তির বিরুদ্ধে জিহাদ করে (১৮৩১ খৃ.) শহীদ হয়েছেন। বালাকোটের শাহাদাত ছিলো মূলত কাশ্মীরের আযাদীর জন্য শাহাদাত!

সৈয়দ শহীদের পরবর্তী সময়েও বালাকোটের জামাতে মুজাহিদীন জিহাদে কাশ্মীরে নিয়োজিত ছিলেন এবং আজো নিয়োজিত রয়েছেন।

কিন্তু আফসোস্, আহলে কাশ্মীর এক গাদ্দারে কাউমের ধোকায় পড়ে জিহাদের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে হিন্দুশক্তির লেজুড়বৃত্তিতে লিপ্ত হয়ে পড়েছে, যার মাশুল মুসলিমানে কাশ্মীর আজ আদায় করছে। ৩৭০ আসলে কিছু না, ধোকা, আসল অপরাধ আমাদের। সৈয়দ শহীদের খুনে শাহাদাতের কথা আমরা ভুলে গিয়েছি। সেই রক্তের কাছে ফিরে এলেই আমাদের মুক্তি! *

 

গুলি যেন পিঠে না লাগে, বেটা!

মোবাইল’-এর ঘণ্টি বেজে উঠলো। মায়ের বুকটাও দুরু দুরু করে উঠলো। আমার বাহাদুর বেটার ফোন নয় তো! দুরু দুরু বুকে, কম্পিত হাতে তিনি ‘মোবাইল’ তুলে নিলেন। যা ভেবেছিলেন এবং যা আশঙ্কা করেছিলেন তাই হলো। দশদিন আগে ঘর থেকে বিদায় নেয়া তার মুজাহিদ পুত্রের শান্ত কণ্ঠস্বর

আস্-সালামু আলাইকুম আম্মাজান!

ওয়া‘লাইকুমুস্-সালাম। আয় মেরে লাখতে জিগার, কেয়সে হো তুম? মনে হচ্ছে, গোলাগুলির আওয়ায আসছে?

জি¦ আম্মাজান! দখলদাল হিন্দু ফৌজের ঘেরাউয়ের মধ্যে এসে গিয়েছি আমরা।...

বেটা একবাত ইয়াদ রাখনা... মউত একবারই আসে, কিন্তু দিলে যদি শাহাদাতের তামান্না থাকে তাহলে শাহাদাত বারবার নছীব হতে থাকে!

আমি তো ফোন করেছি মাফ চাওয়ার জন্য আম্মাজান! আর একথা বলার জন্য যে, শহীদ বেটার জানাযার সামনে দাঁড়িয়ে আপনার চোখে যেন পানি না আসে আম্মাজান!

বেটা, দুধের করয তখনই মাফ করবো যখন তুমি বাহাদুরের মত লড়াই করবে, আর বুকে গুলি খাবে। খবরদার বেটা, পিঠে যেন গুলি না লাগে!

বেটা, চোখে আঁসু হয়ত আসবে, তবে সেটা হবে শহীদ বেটার মায়ের খুশির আঁসু!

***

দক্ষিণ কাশ্মীরের কোলগাম জেলার কাযীগুন্ড এলাকায় প্রচ- লড়াই হলো। দুশমনের সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশ। সবার হাতে ভারী অস্ত্রশস্ত্র, আর বুকভরা মৃত্যুর ভয়! পক্ষান্তরে মুজাহিদীন সংখ্যায় মাত্র চারজন। হাতে পুরানা রাইফেল। তবে তবে মৃত্যুভয় -হীন বুকের মধ্যে টগবগ করছে শাওকে শাহাদাত। প্রচ- লড়াই হলো। দুশমন চৌদ্দটি লাশ ‘হযম’ করে ঘেরাউকরা ভবনে ঢুকলো। দুশমন কল্পনাও করেনি, মাত্র চারজন মুজাহিদ! রাইফেল শক্ত করে হাতের মধ্যে ধরা। সবার মুখে যেন বিজয়ের হাসি! দশমন কমান্ডার হয়ত নিজের অজান্তেই শহীদানের উদ্দেশ্যে স্যালুট করলো। হয়ত বীরত্বকে সম্মান জানানোর মত দিল তার বুকের মধ্যে ছিলো।

***

শহীদের জানাযা মায়ের সামনে সামনে রাখা হলো! মায়ের মুখে তখন অশ্রুসজল হাসি! খুশির আঁসু এবং আনন্দের হাসি!

এমন মায়েদের জন্যই বিশ্বাস হয়, কাশ্মীর একদিন আযাদ হবে; হবেই ইনশাআল্লাহ! *

 

প্রেমনাথ বাযায, কে তিনি?

তার জন্ম কাশ্মীরের হিন্দু প-ণ্ডিত- সম্প্রদায়ে (১৯-০৫-৮৪ খৃ.)। কাশ্মীরের প-ণ্ডিত সম্প্রদায় সংখ্যালঘু হলেও রাজপ্রশাসনে তাদের ছিলো অপ্রতিহত প্রভাব, আর বিভিন্ন কৌশলের আড়ালে তাদের অবস্থান ছিলো মুসলিম স্বার্থের প্রতিকূলে।

প্রেমনাথ বাযাযকে মনে করা হয় ব্যতিক্রম। তিনি ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তা দ্বারা পরিচালিত ছিলেন। রাজনীতি, সাংবাদিকতা, ইতিহাস -চর্চা, এ-ই ছিলো তার কর্মজগতের বিচরণক্ষেত্র। তার কর্মজীবনের শুরু ১৯৩০ সালে। হরি সিং-এর শাসনে কাশ্মীরের মুসলমানদের তিনি অধিকার-বঞ্চিত মনে করতেন। তাই তাদের পক্ষে কথা বলতেন এবং তাদের মধ্যে জাগরণসৃষ্টির চেষ্টা করতেন। আযাদির বিষয়ে তিনি গণভোটেরও সমর্থক ছিলেন। ফলে আপন সম্প্রদায়ে তিনি ‘নিন্দিত’ ছিলেন।

আবার স্বাধীনতাকামী মুসলিম সমাজে, অর্থাৎ চৌধুরী গোলাম আব্বাসের নেতৃত্বাধীন মুসলিম কন্ফারেন্স-এর সমর্থকদের কাছে  তিনি ছিলেন চরম অপ্রিয় ব্যক্তি। কারণ যথেষ্ট যুক্তিপ্রমাণের আলোকে মনে করা হতো যে, আসলে তিনি কাশ্মীরের ভারতভুক্তির পক্ষে ছদ্মবেশে বিরাট ভূমিকা পালন করেছেন। শেখ আব্দুল্লাহর সঙ্গে ছিলো তার গভীর হৃদ্যতা। মনে করা হয়, তারই প্ররোচনায় শেখ আব্দুল্লাহ মুসলিম কন্ফারেন্স ত্যাগ করে ন্যাশনাল কন্ফারেন্স গঠন করেন, আর কাশ্মীরের ভবিষ্যতপ্রশ্নে মুসলিম সমাজ প্রবলভাবে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ‘প-ণ্ডিত’ নেহরুর সঙ্গে শেখ আব্দুল্লাহর পরিচয় ও বন্ধুত্ব গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনিই নেপথ্য ভূমিকা পালন করেন।

শেষজীবনে নেহরুর সঙ্গে তার হৃদ্যতা অক্ষুণ্ণ থাকলেও শেখ আব্দুল্লাহ্র সঙ্গে তার দূরত্ব সৃষ্টি হয়। শেখ আব্দুল্লাহ্ সম্পর্কে তিনি প্রচার করতে থাকেন যে, শেখ শুধু ভারতের প্রতিই অবিশ্বস্ত নন, বরং মুসলিম সমাজেরও ‘তরক্কী’র পথে প্রতিবন্ধক!

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা