মুহাররম ১৪৪৫ হিঃ

তোমাদের জন্য লেখা

একটি করুণ মৃত্যু এবং..

লিখেছেনঃ মুফতী গোলাম রাব্বানী ভুঁইয়া

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

হৃদয়ের ক্ষত এখনো বেশ তাজা। তার কথা লিখতে তো বসেছি, কলমও হাতে নিয়েছি, কিন্তু এখনি চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এসেছে, লিখতে পারবো কি না, জানি না।

তিনি তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে পরিপূর্ণ এক যুবক। ত্রিশ পার হয়নি এখনো। নিজের মহলে একজন আদর্শ শিক্ষক হিসাবে যথেষ্ট সম্মানের পাত্র।

মাদরাসার বিরতিতে বাড়ী এসেছেন, সন্ধ্যায়। নিজে যেমন অলস নন, তেমনি কারো অলসতা দেখতে রাজী নন। কিছু জমি ছিলো তার, তাতে ধানের চাষ করেছেন। আগামীকাল জমিতে পানি দেবেন। রাতেই সব ব্যবস্থা করে রাখলেন। ভোর হতেই যেন কাজ শুরু করা যায় এবং কাজ শুরু করলেন, তবে জানতেন না, এটাই তার জীবনের শেষ কাজ! এখান থেকে তিনি বাড়ী ফিরবেন না, তাকে বাড়ীতে নেয়া হবে এবং নেয়া হলো। যিনি হাসিমুখে তাকে বিদায় দিয়েছিলেন, তিনি নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন, না বিলাপ, না কান্না! এমনকি চোখে অশ্রুর আভাসও দেখা গেলো না। বড় চিন্তার কথা! এটাকেই বোধহয় বলে শোকে পাথর হওয়া।

মুস্তাফিযুর-রহমান নামের কালকের একজন তরতাজা টগবগে যুবক আজ এখন একটি নিথর জানাযা, বিশ্বাসই যেন হতে চায় না, এরই নাম জীবন এবং এরই নাম মৃত্যু! মাঝখানে সূক্ষ্ম একটি পার্থক্য রেখা। তবু আমরা জীবন নিয়ে কত ব্যস্ত, আর মৃত্যু সম্পর্কে কত নির্লিপ্ত! আসলে কী ঘটেছিলো ওখানে ধানের জমিতে! প্রত্যক্ষদর্শী কেউ ছিলো না, তবে সরেজমিনে ছূরতে হাল দেখে যা বোঝা গিয়েছে তাহ হলো, মুস্তাফিয পানির যন্ত্র সচল করার জন্য সুইচে হাত দিয়েছেন, আর বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে সঙ্গে সঙ্গে মারা গিয়েছেন।

একজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে, পৃথিবীর অসংখ্য মানুষের ভিড়ে, এটা খুব সাধারণ খবর। আমাদের চারপাশে প্রতিমুহূতে স্বাভাবিক মৃত্যু যেমন ঘটে তেমনি অস্বাভাবিক মৃত্যুও ঘটে। তো প্রতিদিনের প্রতিমুহূর্তের এত মৃত্যুর মাঝে কে কার খবর রাখে! জীবন তো আর থেমে থাকে না, জীবন চলতে থাকে জীবনের গতিতে।

কাছের মানুষ যারা, কিছুদিন তারা কষ্ট পায়, এ ওকে সান্ত্বনা দেয়, তারপর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যায়। যারা আরো কাছের তারা আরো কিছু দিন মনে রাখে; যারা একেবারে কাছের তাদের ভুলতে আরো সময় লাগে, তবে ভুলে যায়, জীবনের নির্মম দাবী রক্ষা করার জন্য মৃত্যুর নির্মম স্মৃতি ভুলে যেতে হয়। কিন্তু আমাদের মুস্তাফিযের মৃত্যু এমন ছিলো না। মানুষটি তিনি এত ভালো ছিলেন, আর মৃত্যুটি তার এমনই নিঃসঙ্গ ও মর্মান্তিক ছিলো যে, দূরের যারা তাদেরও ভুলতে সময় লেগেছিলো। আর মুস্তাফিযের স্ত্রী, তিনি তো এখনো স্বামীর মৃত্যুশোক বুকে নিয়ে, আর স্বামীর একটি স্মৃতিচিহ্ন কোলে নিয়ে জীবনের ভার বহন করে চলেছেন।এখন একটু পিছনে ফিরে যেতে চাই,মুস্তাফিরে মা-বাবা ছিলেন খুবই সাধাণ ও গরীব পরিবারের। মা  ছিলেন ধর্মের প্রতি পূর্ণ অনুরাগিণী, আর বাবা, এর যতটা বিপরীত হতে পারেন। মুস্তাফিয যখন দুনিয়াতে আসেন, তার মা তখন দুনিয়া থেকে বিদায় নেন। এভাবেই শুরু হয় তার জীবন মায়ের মমতার আঁচল থেকে বঞ্চিত হয়ে।

মায়ের বিদায়ের পর মায়ের আসতে খুব একটা দেরী হয়নি। যে সৎ মায়েরা শুধু মা হয়ে যান মুস্তাফিযের নতুন মা তাদের মত ছিলেন না। মাতৃজাতির ইতিহাসে এমন সৎ মা বহু ছিলেন, সন্তান কোনদিন জানতেই পারেনি যে এই মা তাকে শুধু প্রতিপালন করেছেন, গর্ভে ধারণ করেননি। এমন একজন ‘নতুন মায়ের কথা আমি জানি, যিনি বাসর রাতেই জানতে চেয়েছেন, আমার ছেলেটা কোথায়? কেন ও অন্যখানে কেন? ওকে এখানে আমার পাশে আনো! আর বাবা, সন্তানের জন্মদাতা বাবা বলছিলেন, আজ থাক না ও খালার সঙ্গে!

যিনি বলেছেন, সত্য বলেছেন, বাবা তখন বাবা থাকে না, স্ত্রীর স্বাামী হয়ে যায। এখানে কিন্তু নতুন মা শুধু মা হয়ে বললেন, তাকে যিনি গর্ভে ধারণ করেছেন তিনি যদি কবর থেকে জানতে পারেন, খুশী হবেন! এই জগত এই সংসার বড় বিচিত্র! এমন নতুন মায়ের কথাও জানি, যিনি চিরকাল ‘নতনু’ই থেকে গিয়েছেন। দু’ই সন্তানই আমার কাছে তাদের মায়ের কথা বলেছেন। বলতে গিয়ে দু’জনই অশ্রু সজল ছিলেন। একজনের অশ্রু ছিলো কৃতজ্ঞতার, আরেক-জনের অশ্রু কষ্টের, বেদনার ও বঞ্চনার। একজন বলেছেন, আমার মায়ের প্রতি একটাই অভিযোগ, আমাকে তিনি আমার ‘মায়ের’ কথা ভুলিয়ে দিয়েছেন। আরেকজন বলেছেন, নতুন মায়ের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ, আমার কবরের মাকে তিনি ভুলতে দেননি।

মুস্তাফিজের নতুন মা সবসময় তাকে মনে রাখতে সাহায্য করেছেন যে, তাকে গর্ভে ধরাণ-কারিণী মা এখন কবরে। বললে তো অনেক কথা বলা যায় মুস্তাফিযের শৈশব সম্পর্কে, তারপর কৈশোর থেকে এই বড় হওয়া পর্যন্ত পুরো জীবন সম্পর্কে। থাক, শুধু তিনটি বাক্য বলেই এ প্রসঙ্গ শেষ করি। শৈশব থেকেই ক্ষুধা এবং চোখের নোনাজল ছিল তার সঙ্গী। বাবা, ‘শুধু’ প্রহার করতেন, আর ‘মা’ করতেন বেদম প্রহার! এই যে শিক্ষক অবস্থায় মুস্তাফিযের মৃত্যু হলো, এ পর্যন্ত তিনি পৌঁছেছেন, কঠিন থেকে কঠিন প্রতিকূলতার মধ্যে নিজের চেষ্টায়, নিজের সাধনায় এবং নিজের সংগ্রামে পৌঁছেছেন। বাবার কাছে, মায়ের কাছে মুস্তাফিয যা পাননি, সন্তান হিসাবে তাদের তিনি তা দিতে চেষ্টা করেছেন নিজের সাধ্যের ভিতরে, বরং সাধ্যের বাইরে।

***

জীবননদীর স্রোতের উজানে নৌকা বাইতে গিয়ে মুস্তাফিয কখনো হাল ছেড়ে দেননি। ঝড় এসেছে, ঢেউ উঠেছে, পাল ছিঁড়েছে, নৌকা টালমাটাল হয়েছে, তবু তিনি অবিচল ছিলেন। অকুল দরিয়ার নির্ভীক মাঝির মত তিনি নৌকার হাল ধরে ছিলেন এবং আল্লাহর রহমতে একসময় তার জীবনতরী ভিড়েছিলো একটি সুখের বন্দরে। যাদের ধৈর্য আছে, সাহস আছে এবং উদ্যম আছে পৃথিবীটা তাদের জন্য সবসময় উর্বর। এ গুণগুলো মুস্তাফিযের স্বভাবের মধ্যে ছিলো। তাই জীবনের মঞ্চে নিজের জন্য তিনি সন্তোষজনক একটি অবস্থান অর্জন করতে পেরেছিলেন।এরপর তিনি জীবনের সেই স্বপ্নটি দেখতে শুরু করলেন, যা প্রত্যেক যুবকেরই বৃষ্টিভেজা রোদেলা আকাশে রঙধনু ছড়ায়।

মুস্তাফিযের স্বপ্নের ময়ূরটি একসময় পেখম মেলে এক জ্যোতির্ময়ী তরুণীর রূপ ধারণ করলো। মুস্তাফিযের জীবনসঙ্গিনী হয়ে যে মেয়েটি তার ঘরে এলো সে সত্যি সত্যি ছিলো জ্যোতির্ময়ী! যে দেখেছে সেই বলেছে, মুস্তাফিয বড় ভাগ্যবান। তখন থেকে মুস্তাফিযের জীবনের উদ্যানে বসন্তের আগমন হলো, কোকিল ডাকলো, বুলবুলি গাইলো, আর তারা দু’জন শুধু আল্লাহর শোকর আদায় করলেন। জীবন জীবনের গতীতে এগিয়ে চললো। মুস্তাফিয ও তার স্ত্রীর জীবনে সুখের অভাব ছিলো না। দুঃখ যদি থাকে তবে তা এই যে, তখনো মুস্তাফিযের স্ত্রীর কোল আলো করে জান্নাত থেকে কোন ফুল ঝরেনি। পরপর দু’বার কলি এসেছিলো, ফুল হয়ে ফোঁটার আগেই ঝরে গিয়েছিলো। মুস্তাফিযের স্ত্রী, যখন তার মনে পড়তো, চোখ থেকে শুধু নীরবে অশ্রু ঝরতো। তার প্রথম কষ্ট ছিলো স্বামীকে সন্তানসুখে সুখী করতে না পারা।

দ্বিতীয় কষ্ট ছিলো মাতৃত্বের গৌরব থেকে নিজে বঞ্চিত থাকা।কিন্তু এবার তাদের জীবনে আশার আলো অনেক দূর বিস্তৃত হয়েছিলো এবং শেষ পর্যন্ত ঐ ঘর আলোকিত হয়েছিলো, সেই আলো দেখে যাওয়া মুস্তাফিযের জীবনে আর হলো না।যেদিন তিনি এমন মর্মান্তিক- ভাবে মৃত্যু বরণ করলেন, তারপর মাত্র একটি সূর্য উদিত হলো, যে সূর্যোদয়ের কোন রাঙা আলো মুস্তাফিযের স্ত্রী অনুভব করতে পারেন নি। সূর্যাস্ত হলো, আর রাতের অন্ধকারে তার কোল আলো করে, জানি না কী বলবো, ফুটফুটে চাঁদের মত, না ভোরের রাঙা সূর্যের একটি পুত্রসন্তান জন্মলাভ করলো। তখনই জন্ম হলো একজন মায়ের, যার কদমের নীচে রক্ষিত হলো ঐ পুত্রের জান্নাত। তখনো ঐ জ্যোতির্ময়ী তরুণী স্ত্রী হয়ে কাঁদতে পারলো না এবং মা হয়ে হাসতে পারলো না।তবু জীবন জীবনের গতিতে এগিয়ে চললো। মুস্তাফিজ নিজের জীবনের জন্য যে সংগ্রামসাধনা করের্ছিলেন, তার স্ত্রীর এখন স্বামীর রেখে যাওয়া স্মৃতিচিহ্নটি রক্ষা করার জন্য সংগ্রাম সাধনা করে যাচ্ছেন। এভাবেও বলা যায়, মা তার সন্তানপ্রদীপকে জীবনের ঝড়ে নিভে যাওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য আচল দিয়ে আড়াল করে রেখেছেন। সন্তানের জীবন-প্রদীপের আলো ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হচ্ছে, আর মায়ের জীবনপ্রদীপ যেন নিভে নিভে আসছে। তবু জীবন জীবনের গতিতে এগিয়ে চলেছে। আমি শুধু কামনা করি, এই সন্তান যেন জীবনের শেষ দিনগুলোতে অভাগিনী মায়ের মুখে একটু হলেও হাসি ফোটাতে পারে! * একটু হলেও যেন তার চোখদু’টো হয় অশ্রুসজল, সুখের হাসি এবং সুখের অশ্রুজল।

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট