রবিউছ ছানী ১৪৪৫ হিঃ

তোমাদের জন্য লেখা

দু’টি করুণ মৃত্যু আমাকে ছুঁয়ে গেলো!একটি সান্ত¡না দিলো, একটি দিলো আনন্দ!

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

 দু’টি করুণ মৃত্যু আমাকে ছুঁয়ে গেলো!একটি সান্ত¡না দিলো, একটি দিলো আনন্দ!


একটি মেয়ে দূরের কোন জনপদের, আমার সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক নেই, তবে হৃদয় ও আত্মার বন্ধন ছিলো, আছে এবং আল্লাহ্ ইচ্ছায় চিরকাল থাকবে। তার কোমল সত্তাকে অবলম্বন করে একটি নতুন সত্তার অঙ্কুরোদ্গম হলো এবং পৃথিবীর আলো দেখতে  পেলো! তবে সে নিজে পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণ করলো চিরকালের জন্য! না মাতৃদুগ্ধ শিশুটির ভাগ্যে হলো, না মায়ের মাতৃমমতা ছায়া বিস্তারের সুযোগ পেলো!মেয়েটি একজন বাবার যেমন মেয়ে ছিলো তেমনি আমারও মেয়েই ছিলো! এমনকি আমার স্ত্রীও তার মা ছিলো। মাতৃহৃদয়ের  দহন এবং পিতৃহৃদয়ের যন্ত্রণা, তার তো কোন তুলনা হয় না! তবে এ মৃত্যুশোক আমাদের দু’জনকেই বড় বেশী আহত করেছে! রক্তের বন্ধন নেই, এমন কারো মৃত্যুতে কাতর হওয়া এবং অশ্রæ ঝরা, এর আলাদা মূল্য আছে নিশ্চয়! সেই মূল্য আশা করি পাবো আল্লাহ্র কাছে, মায়া ও মমতার বন্ধনে দূরকে যিনি কাছে আনেন এবং পরকে করেন আপন! কত হাসিখুশি ছিলো মেয়েটি! কত কোমল ছিলো তার হৃদয়! যে দেখে সেই তাকে ভালোবাসে এবং আপন করে নেয়! বন্ধন তো ছিলো বহু বছরের, তবে জীবনের শেষ দু’টি বছর বলতে গেলে আমাদের ঘরেই ছিলো স্বামীর সঙ্গে তার বসবাস! উম্মে মুহম্মদের কাছে কিছুটা হলেও মায়ের যতœ পেয়েছিলো! আমি কখনো একটা আপেল, একটা আনার, কিছু খেজুর ওর স্বামীর হাতে তুলে দিয়ে বলতাম, এটা ওর জন্য! ও যদি তোমাকে দেয় তাহলে তোমারও। এভাবে কেন বলতাম তা শুধু আমারই জানা ছিলো, কামনা করি, এর কল্যাণ যেন জান্নাত পর্যন্ত ওর সঙ্গে যায় এবং ওর সন্তানের সঙ্গে যেন থাকে চিরকাল।এমন সময় মেয়েরা মা হওয়ার জন্য মায়ের কাছে যায়! কারণ  মাতৃমমতার যে শীতল ছায়া তার কোন তুলনা নেই পৃথিবীতে! ব্যথার কঠিন সময়ে মায়ের মমতার হাতটি যদি আঁকড়ে ধরা যায়, তখন একটু যেন সান্ত¡নার শীতল ছায়ার স্পর্শ পাওয়া যায়। কারণ তখন মনে পড়ে, এমন ব্যথা তো আমিও দিয়েছি আমার মাকে! এ ব্যথা তো সকল মায়ের জন্য আল্লাহ্র দান!কোন সন্দেহ নেই, মেয়েটি জ্যোতির্ময় হৃদয়ের অধিকারী ছিলো। তাই তো সে অনুভব করেছিলো মৃত্যুর ছায়া! তাই তো মাকে বারবার বলতো, মা, আমি কি আমার সন্তানকে দেখতে পাবো, তাকে কোলে নিতে পারবো!মা বলেন, আমি খুব বিচলিত হতাম। বড় মেয়ে তো এমন কথা বলেনি। সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছিলো। এ মেয়ে এমন করে বলতো কেন! তাহলে কি আগেই সে...সবার কাছে এমন করে মাফ চেয়েছিলো কেন! বড় বোনকে বলে গিয়েছে, যেন তার পুত্রকে আপন সন্তানের মত প্রতিপালন করে! পুত্রের পৃথিবীর আলোতে আসা এবং মায়ের পৃথিবীর আলো ত্যাগ করা, মাঝখানে সময়ের ব্যবধান ছিলো দু’টি দিন। মায়ের অবস্থা যেমন ছিলো নাযুক, তেমনি সদ্যজাত সন্তানের অবস্থাও ছিলো ঝুঁকিপূর্ণ। জানতে পারিনি, জানতে পারিনি, মা কি তার সন্তানকে চোখের দেখা দেখতে পেয়েছিলো এবং কোলে! কেউ আমাকে বলেনি, আমিও জিজ্ঞাসা করিনি। একবার ইচ্ছা হয়েছিলো, এখনো ইচ্ছা হচ্ছে, উম্মে মুহম্মদকে জিজ্ঞাসা করি, কিন্তু শেষপর্যন্ত মন বলছে, থাক!মৃত্যু তো জন্মের যমজ! মৃত্যুর স্বাদ তো প্রত্যেক প্রাণীকেই আস্বাদন করতে হয়। তবে মৃত্যু যদি সত্যি সত্যি হয় স্বাদের মৃত্যু তাহলে তো তা আনন্দের মৃত্যু! শোকের মধ্যেও সে আনন্দই আমি অনুভব করেছি তার মৃত্যুর বিবরণ শুনে! আহ! কেমন সুন্দরভাবে কালিমার মিষ্টি মধুর উচ্চারণের সঙ্গে প্যরওয়ায করে গেলো তার রূহ রাব্বুল আরওয়াহের কাছে! ইচ্ছে হয়, আল্লাহ্কে বলি, এমন সুন্দর মৃত্যু, এমন আসানির মউত আমাদেরও যেন নছীব হয়।কত স্বপ্ন ছিলো, সন্তান কোলে করে মাতৃরূপ ধারণ করে আবার ফিরে আসবে আমাদের মাঝে, মাদরাসাতুল মাদীনাহ্র ছায়ায়! আমাদেরও আকক্সক্ষা ছিলো, মা ও পুত্রকে বরণ করে নেবো আনন্দের সঙ্গে এবং নতুন জীবনের শুভকামনার সঙ্গে, কিন্তু ...!আল্লাহ্র ইচ্ছায় সমর্পিত হওয়ার মধ্যেই তো মুমিনের জীবনের সার্থকতা!শোকার্ত হৃদয়ের জন্য সময় সবচে বড় উপশম, এটা সত্য, তবে এটাও সত্য যে, কোন কোন হৃদয়ে কোন কোন মৃত্যু এমন গভীর ক্ষত রেখে যায় যে, তার উপশম এত সহজে হয় না, হতে চায় না। আল্লাহ্ সবাইকে ছবরে জামীল নছীব করেন, আর আমাদের মেয়েটিকে তাঁর রহমতের ছায়ায় আশ্রয় দান করেন, আমীন!এই এখন সম্পাদনার শেষ মুহূর্তে জানলাম, সে জানতে পেরেছিলো, তার প্রিয় পুষ্পের ফিরে আসার কথা। উম্মে মুহম্মদকে ফোন করে জানিয়েছিলো তার আনন্দের কথা এবং আশঙ্কার কথা, আমি কি পুষ্পের দেখা পাবো!আরো জানলাম, এবং এজন্য তার স্বামীর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ, মাদরাসার প্রাঙ্গণ থেকে মুমূর্ষু স্ত্রীকে সে নাকি পড়ে শুনিয়েছিলো‘আমার দরদে দিলের আফসানা’! তার নাকি মন্তব্য ছিলো, ‘এ তো সত্যি সত্যি আমারই দরদে দিলের আফসানা!আমি বড় ভাগ্যবান, পুষ্পের প্রতি এমন ভালোবাসাও ছিলো Ñএবং হয়ত আছেÑ কারো হৃদয়ের বাগানে, কারো হৃদয়ের আকাশে!মরহূমার পুত্রের নাম রাখার দায় আমার উপর ছিলো, আসমানের ইশারায় নাম রেখেছি যাকিয়ার পুত্র যাকী! আয় আল্লাহ্! তাকে তার নিজের নামের পবিত্রতা এবং মায়ের নামের পবিত্রতা একসঙ্গে তুমি দান করো, আমীন।***দ্বিতীয় মৃত্যুটি যার, নাম তার ইসহাক বিন হাবীবুর রহমান। আলিম পিতার আলিম পুত্র এবং শিক্ষক পিতার শিক্ষক পুত্র! এখনো তরুণ বয়স ছিলো, হয়ত জীবনকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিলো, কিন্তু মৃত্যুর ডাক যখন আসে, সবাইকে সাড়া দিতেই হয়। কেউ সাড়া দেয় দুনিয়ার প্রতি করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে তাকিয়ে, আর কেউ আখেরাতের এবং জান্নাতের শান্তির দৃশ্য অবলোকন করতে করতে!আমরা যে দু’টি মৃত্যুর কথা বলছি, আশা করি, আল্লাহ্ উভয়কেই শান্তির দৃশ্য অবলোকনের মৃত্যুই নছীব করেছেন। তাই যেন হয় আল্লাহ্, তাই যেন করেন।ক্যানসার কত কঠিন ব্যাধি, যার হয়নি তার বোঝার কথা নয়, তবে যদ্দুর জেনেছি তাতে অন্তর দিয়ে কামনা করি, শত্রæকেও যেন আল্লাহ্ এমন কষ্টের ব্যাধি না দেন। রোগ শনাক্ত হয়েছে একেবারে শেষ সময়ে শেষ পর্যায়ে, যখন ‘চেষ্টা’ হিসাবেও চিকিৎসকের কিছু করার থাকে না!তবে মৃত্যুর সময় একটি শীতল বাতাস এসেছিলো, শান্তির বার্তা নিয়ে! যারা কাছে ছিলেন, এটা তাদের কথা! এমন কঠিন রোগের রোগীর এমন আসান মৃত্যু নাকি সচরাচর ঘটে না।মৃত্যুর একদিন কি দু’দিন আগে অস্থির হয়ে বললেন, আমাকে মাদরাসায় নিয়ে যাও! নেয়া হলো, আর তিনি তালিবানে ইলমের কাছ থেকে বিদায় নিলেন, যেন আপন সন্তানদের কাছ থেকে বিদায় নেয়া! তখন বড় মর্মস্পর্শী মুনাজাত হয়েছিলো।সন্তানের জন্য মায়ের সাক্ষি দুনিয়ার কাছে প্রশ্ন-ঊর্ধ্ব হতে চায় না, তবে আল্লাহ্র কাছে সন্তানের জন্য মায়ের সাক্ষিই হলো বড় সাক্ষি! মরহূমের মা, যিনি মাত্র একবছর আগে স্বামীর মৃত্যুশোকে কাতর হয়েছেন, তিনি বলেছেন, আমার এ পুত্র জীবনে কখনো ছগীরা গোনাহ করেছে বলেও আমার জানা নেই! জীবনের কোন আচরণে, কোন উচ্চারণে সুন্নাহ্ থেকে সামান্য বিচ্যুতি ঘটেছে বলেও দেখিনি। মায়ের সাক্ষি তুমি গ্রহণ করো হে আল্লাহ্!মরহূমের আম্মা উম্মে মুহম্মদের ফুফাতো বোন! ছেলের মৃত্যুতে শোকের উপশমের জন্য যে লেখা নিজের কলমে লিখেছিলেন তা তার সূত্রে আমার হাতে এসেছে। ভেবে পাই না, জীবনে যিনি কিছু লেখেননি, কলমের স্পর্শ যিনি কখনো গ্রহণ করেননি তার কেন ইচ্ছে হলো কলমের মাধ্যমের রাব্বুল কলমের সান্ত¡না গ্রহণ করার! কলমের সঙ্গে ¯্রষ্টার এবং সৃষ্টির সম্পর্ক তাহলে আসলে কী! শোকে কাতর এই মায়ের হাতে যে কলম তা আমাদের জন্য কী শিক্ষা বহন করে! মরহূম এবং মরহূমার আমলনামার ওজন হিসাবে এখানে আমরা তা লিখে রাখতে চাই, আশ্চর্য কী যে, আমাদেরও আমলনামা তাতে কিছুটা ওজনদার হবে!

*** 

শোকাহত মায়ের কলমের অশ্রæ চোখের অশ্রæর সঙ্গে হলো যেন একাকার!জান্নাতের পাখী জান্নাতের বাগানে চলে গিয়েছে তাই খুঁজে পাই না কোথাও তাকে! তাকে আমি খুঁজেছি গাছের ফুলে, লতায় পাতায়

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা