রমযান ১৪৩০ হিঃ (১৩)

তোমাদের জন্য

কাকে বলে ইসলাম?

লিখেছেনঃ মাওলানা ইয়াহয়া (রহ)

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট
(ধারাবাহিক) তাওহীদ ও রিসালাত এবং পরকাল ও আখেরাত যেমন দ্বীন ও শরী‘আতের মূল সত্য, তেমনি তা বিশ্বজগত ও সৃষ্টিকুলেরও মূল তত্ত্ব। অর্থাৎ সৃষ্টিজগতের ক্ষুদ্র-বৃহৎ প্রতিটি বস্তু; আকাশের তারা হতে গাছের ফুল এবং পাহাড়ের চূড়া হতে সাগরের তলদেশের সবকিছু আল্লাহর অস্তিত্ব ও তাঁর একত্ব, রিসালাতের অপরিহার্যতা এবং আখেরাতের অনিবার্যতার প্রমাণ বহন করে। বিশ্বজগত ও সৃষ্টির মূল সম্পর্কে যদি প্রশ্ন করা হয়, যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, কীভাবে বিশ্বজগতের অস্তিত্ব হলো? জীবন ও প্রাণ কোত্থেকে এলো? সৃষ্টির পরিণাম কী? প্রাণের পরিণতি কী? মানুষ কোত্থেকে এলো? কোথায় যাবে? জগতে আমরা যতগুলো গতি ও স্পন্দনের সঙ্গে পরিচিত সেগুলোর শুরু কীভাবে এবং শেষ কোথায়? এসব প্রশ্নের সঠিক, সুনিশ্চিত ও অভ্রান্ত উত্তর আমরা কোথায় পাবো? যদি বলি, মানুষ তার বিদ্যা-বুদ্ধি দ্বারা চিন্তাভাবনা ও বিচার-গবেষণা করে উত্তর দেবে এবং সেটাই হবে নির্ভুল উত্তর তাহলে তা হবে যুক্তিবিরোধী কথা। কারণ মানুষ নিজেই হলো বিশাল সৃষ্টিজগতের অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ। বিশ্বজগতের বিশালতার তুলনায় তার অবস্থান একটি কণার চেয়েও ক্ষুদ্র। সুতরাং সে কীভাবে গোটা সৃষ্টিজগতের অস্তিত্বের রহস্য উন্মোচন করবে? আকল-বুদ্ধি এবং বিবেক ও যুক্তি নির্দ্বিধভাবে এ সিদ্ধান্তই ঘোষণা করে যে, এসকল প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসার নির্ভুল উত্তর আসতে পারে সৃষ্টিজগতের ঊর্ধ্বসত্তা ও ঊর্ধ্বশক্তির কাছ থেকে; যিনি সৃষ্টিজগতের সকল বিষয় সম্পর্কে সম্যক অবগত এবং সৃষ্টিজগতের সকল রহস্য যার সামনে সম্পূর্ণ- রূপে উন্মোচিত, যিনি নিজে সবকিছু সৃষ্টি করেছেন এবং স্রষ্টারূপে যিনি সর্বদা সবকিছু পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ করছেন। মানুষ তো নিজের অজ্ঞতা সম্পর্কে নিজেই অবগত। সৃষ্টিজগতের কয়টি রহস্য এপর্যন্ত তার জানা হয়েছে? কত রহস্য এখনো তার অজানা? কত জ্ঞাত রহস্য আবার তার কাছে অজ্ঞাত হয়ে যায়? আজকের সত্য আগামীকাল মিথ্যা হয়ে যায় এবং সে নিজেই তার জানা সত্যকে মিথ্যা বলে প্রমাণ করে? সুতরাং মানুষ যদি দাবী করে যে, জীবন ও জগতের মূল রহস্যের নির্ভুল উত্তর তার কাছে রয়েছে এবং তা সে বলতে পারে, তাহলে বলতে হবে যে, নিজেই সে নিজের মূর্খতার প্রমাণ তুলে ধরছে। সৃষ্টির মূল রহস্যের নির্ভুল উত্তর দিতে পারেন সৃষ্টিজগতের ঊর্ধ্বসত্তা এবং ঊর্ধ্বশক্তি, অর্থাৎ স্রষ্টা, যাকে আমরা আল্লাহ বলে জানি। রাসূলের মাধ্যমে তিনি তাঁর কালাম অবর্তীণ করে এসকল প্রশ্ন ও জিজ্ঞাসার উত্তর দান করেছেন। তিনি তো সর্বশক্তি ও একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী, সুতরাং তিনি তাঁর শক্তি ও ক্ষমতার অধিকারে মানুষের উপর ঈমান ও তাওহীদ এবং রিসালাত ও আখেরাতের বিশ্বাস চাপিয়ে দিতে পারতেন। মানুষের কোন অধিকার ছিলো না যুক্তি ও প্রমাণ দাবী করার। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা যেহেতু কাদিরে মুতলক(সর্বশক্তিমান) হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রহীম ও রহমান সেহেতু বান্দার উপর কোন কিছু তিনি চাপিয়ে দেননি। বরং তিনি তাঁর পাক কালামে বান্দার সামনে আপন অস্তিত্বের, এককত্বের, স্রষ্টাত্বের এবং অসীম কুদরতের প্রমাণ বর্ণনা করেছেন; রিসালাতের সত্যতা এবং আখেরাতের অনিবার্যতার যুক্তি পেশ করেছেন। শুধু তাই নয়, বরং সৃষ্টিজগতের সর্বত্র তিনি তাঁর অস্তিত্বের এবং তাওহীদের সত্যতার সুস্পষ্ট নিদর্শন রেখে দিয়েছেন, আর চিন্তাশীল মানুষকে আহ্বান জানিয়েছেন সৃষ্টিজগত সম্পর্কে চিন্তা করার এবং চিন্তা করে স্রষ্টার অস্তিত্ব সম্পর্কে অবগত হওয়ার, বিশ্বাস করার এবং বিশ্বাস অনুযায়ী আচরণ করার। সুতরাং আসুন, আল্লাহর আদেশ পালন করার নিয়তে আমরা সৃষ্টিজগত সম্পর্কে চিন্তা করে দেখি। প্রথমে চিন্তা করে বলুন তো, আমরা যদি সৃষ্টিজগতকে দেখতে চাই তাহলে কতটুকু দেখতে পারি? শুধু যদি পৃথিবী ও তার যাবতীয় বৈচিত্র্য দেখতে চাই তাহলে কি একটি জীবনে তার সম্ভব? সব থাক, শুধু মানবদেহের রহস্য উন্মোচন করাও কি সম্ভব? মানুষ তো এত দিন ‘জ্বিন’-এর অস্তিত্ব স্বীকার করতে চাই তো না, অথচ এখন তার নিজের মধ্যে ‘জিন’-এর অস্তিত্ব খুঁজে পেয়ে অবাক হয়ে গেছে। মানবদেহের আরো কত রহস্য লুকিয়ে আছে এবং তার অতি ক্ষুদ্র কিছু অংশ উন্মোচন করতেই আরো কত জীবন পার হয়ে যাবে কে জানে? মহাশূন্যের কতটুকু আমরা দেখতে পাবো? কত আলোকবর্ষ দূরে আমরা যেতে পারবো? সৃষ্টির শেষ সীমানা কোথায়; কবে আমরা সেখানে পৌঁছতে পারবো? আমরা কি এ কথা বলতে পারি না যে, সৃষ্টিজগত সম্পর্কে আমাদের এ বিপুল অজ্ঞতাই একজন সর্বজ্ঞানী সত্তার অস্তিত্বের অকাট্য প্রমাণ। নইলে তো সৃষ্টিজগতের অস্তিত্বই তাৎপর্যহীন হয়ে পড়ে। যা কেউ জানে না, তা বিদ্যমান থাকার সার্থকতা কোথায়? আচ্ছা আসুন, বিশ্বজগতের এবং সৃষ্টিকুলের যতটুকু আমরা জানি ততটুকু সম্পর্কেই ভেবে দেখি। সবকিছু কত সুন্দর! কত সুশৃঙ্খল! কত সূক্ষ্ম কলাকৌশল! কোথাও চুল পরিমাণ বিচ্যুতি নেই। সবকিছুতে এত নিখুঁত অংক ও জ্যামিতি! এত বিপুল আয়োজন ও সমারোহ! উপায়-উপকরণের এত আশ্চর্য রকমের প্রাচুর্য! কী প্রমাণ করে সৃষ্টিজগতের সৌন্দর্য? বিশ্বজগতের শৃঙ্খলা? কী প্রমাণ করে এত আয়োজন, এত প্রাচুর্য? এ কথাই কি প্রমাণ করে যে, সৌন্দর্যের পিছনে কোন ‘সুন্দর’ নেই? শৃঙ্খলার পিছনে কোন ব্যবস্থাপক নেই? এত আয়োজনের পিছনে মহান কোন আয়োজক নেই? এত প্রাচুর্যের পিছনে মহান কোন দাতা নেই? এ কথাই কি প্রমাণ করে যে, এ বিশাল বিশ্বজগত একটি আকস্মিক দুর্ঘটনার ফসল মাত্র? সৃষ্টি নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেছে? নিজেই নিজের জন্য নিয়ম, শৃঙ্খলা ও ব্যবস্থা নির্ধারণ করে নিয়েছে? এবং কোন নিয়ন্ত্রণ ছাড়া সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে প্রতিটি নিয়ম, শৃঙ্খলা ও ব্যবস্থা মেনে চলছে। ব্যত্যয়হীন এ আনুগত্য তার নিজেরই প্রতি নিজের? প্রাণীজগতে যৌবন ও বার্ধক্যের বিধান এবং জন্ম-মৃত্যুর শাসন নিজেরই প্রতি নিজের? আপনার উত্তর যদি হয় হাঁ, তাহলে আমি বলবো, আপনি তো বিজ্ঞানী ও দার্শনিক, আপনার কথা কি আর ভুল হতে পারে! তবে আপনারই কাছ থেকে পাওয়া একটি শিক্ষা হলো, ‘প্রমাণ ছাড়া কোন কথা গ্রহণ করো না।’ সুতরাং এত বিশাল ও বৈচিত্র্যপূর্ণ সৃষ্টিজগত সম্পর্কে আপনার এত বড় দাবীর সমর্থনে ছোট্ট একটি প্রমাণ পেশ করুন? নির্মাতা ছাড়া নির্মাণের, ব্যবস্থাপক ছাড়া ব্যবস্থার এবং নিয়ন্ত্রক ছাড়া নিয়ন্ত্রণের একটি, শুধু একটি উদাহরণ আপনার ‘মহান’ জীবন থেকে, অথবা আপনার চারপাশের পরিবেশ থেকে পেশ করুণ; আমরা আপনার কথা মেনে নেবো অবনত মস্তকে, বিনাবাক্যব্যয়ে। যদি না পারেন, এবং বিশ্বাস করুন, কখনো তা পারবেন না, কারণ যা হয় না তা পারা যায় না, সুতরাং আপনার উদ্ভট দাবী আমি প্রত্যাখ্যান করলাম। কারণ আপনারই বিজ্ঞান ও দর্শন আমাকে শিক্ষা দিয়েছে, আগুন ছাড়া ধোঁয়া হয় না, কণ্ঠ ছাড়া কণ্ঠস্বর হয় না এবং কারণ ছাড়া কার্য হয় না। তাছাড়া এ বিশ্বজগত তো পথে কুড়িয়ে পাওয়া লাওয়ারিছ কোন সম্পদ নয়! এর একজন এবং মাত্র একজন দাবীদার রয়েছে। তিনি দাবী করেছেন বিশ্বজগতের সৃষ্টির, প্রতিপালনের, ব্যবস্থায়নের এবং সার্বিক নিয়ন্ত্রণের। তিনি দাবী করেছেন, সর্বশক্তির এবং পরিপূর্ণ কুদরতের। তিনি দাবী করেছেন, রিসালাত ও কিতাব প্রেরণের এবং হিসাব ও শাস্তি-পুরস্কারের, আর তিনি আদেশ করেছেন তাঁকে বিশ্বাস করার, তাঁর আনুগত্য করার এবং তাঁর রাসূল ও কিতাব গ্রহণ করার ও মেনে চলার। সুতরাং আমরা বিশ্বাস করলাম এবং মেনে নিলাম। হে গর্বিত বিজ্ঞানী, হে অহংকারী দার্শনিক, আপনাকেও তা মানতে হবে, হয় জীবনে, না হয় মরণে। অবশ্য জীবনের বিশ্বাসই শুধু গ্রহণযোগ্য, মরণের বিশ্বাসকে বিশ্বাসই বলা হয় না। কারণ মৃত্যুর পর কোন গায়ব আর গায়ব থাকবে না। তখন বলে দেয়া হবে, ‘এখন! অথচ ইতিপূর্বে তুমি করেছো নাফরমানি! আপনি বলছেন, আখেরাত নেই, পুনরুত্থান নেই; অথচ আপনি শিক্ষা দিয়েছেন এবং প্রমাণ করেছেন, কোন বস্তুর ক্ষয় নেই, আছে শুধু রূপান্তর! নিজের শিক্ষা নিজেই বিস্মৃত হবেন? দোহাই এমন বোকামি থেকে বিরত হোন, এখনো সময় আছে, সুযোগ এখনো ফুরিয়ে যায়নি। (চলবে, ইনশাআল্লাহ)
শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা