যিলক্বদ ১৪৩০হিঃ (১৪)

তোমাদের জন্য

শেখ সাদীর গুলিস্তা

পর্ব: ১৩

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

এক সাধু দরবেশ, ইবাদতে বন্দেগিতে ছিলো বেশ। কিন্তু একবার একদল দুর্বৃত্ত, তাকে কষ্ট দিতে হলো প্রবৃত্ত। বলল তাকে জানে যত অকথ্য কথা, পারলে যেন চিবিয়ে খায় তার মাথা। বেচারা দরবেশ অবশেষে হয়ে অতিষ্ঠ, পীরের খেদমতে আরয করলো মনের কষ্ট। বললো, জনাব, এই হলো আমার দুরবস্থা, দুষ্টদের হাতে নাজেহাল হেনেস্থা। সব শুনে বললেন পীরে কামেল, তুমি তো বিলকুল মূর্খ জাহেল! জানো না, দরবেশি লেবাস যে করে ধারণ, হাসিমুখে সব তাকে করতে হয় বরণ! এই লেবাসে সইতে পারে না যে যিন্দেগির বুরা-ভালা, মিথ্যা দাবীদার সে, সাজে না তার গলায় দরবেশির মালা।

কবিতা- ঢিল ছুঁড়িলে দরিয়ার পানি হয় না ঘোলা/ কষ্টে বেসবূর, সে যে এক ক্ষুদ্র নালা/ তোমার বুকে যে দুর্জন আঘাত হানে/ ক্ষমা করো তারে ওগো সাধু নিজের গুণে/ মাটির সঙ্গে একদিন হবে ভাই মাটি/ তাই মাটি হও আসিবার আগে কবর-ঘাঁটি।

শিক্ষা- যারা আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে চায় তাদের কর্তব্য হলো মূর্খ লোকের মূর্খ আচরণের উত্তরে ক্ষমাসুন্দর আচরণ করা।

***

শোনো বাগদাদের রাজ দরবারের খবর, শাহী ঝাণ্ডা ও শাহী পর্দা করে বিতণ্ডা জবর। অনুযোগের স্বরে পর্দাকে বলে ঝাণ্ডা, আমার কথার জবাব দাও মাথা রেখে ঠাণ্ডা। আমি-তুমি করি একই বাদশাহর গোলামি, অথচ দেখো, কিসমতের এ কী যালিমি! যুদ্ধের মাঠে আমার একদণ্ড নাই অবসর, যখন তখন অভিযান, হই ধুলিধূসর। অথচ তুমি! না দেখেছো যুদ্ধের বিভীষিকা, না মরুভূমির পিপাসা ও মরীচিকা। দুঃখ-কষ্ট ও যন্ত্রণা আমি সয়ে যাই অম্লান, অথচ তোমার ভাগে জোটে সব মান-সম্মান। তুমি চাঁদ-বদন, গুলবদন দাস-দাসীর আবরণ, আমি থাকি পড়ে রুক্ষ সিপাহির হাতে, করি লড়াই জীবন-মরণ। বলো কী এর কারণ, সত্য সত্য দিও বিবরণ। বলে পর্দা লাজ-শরমে, যেন মরে যায় মরমে, বিনয়ে আমি ঝুলে থাকি নিম্নমুখী, গর্বে তুমি থাকো সদা ঊর্ধ্বমুখী। অযথা উঁচিয়ে রাখে যে তার মাথা, হবেই হবে একসময় ঘাড়ে তার ব্যথা।

শিক্ষা- যে বিনয় অবলম্বন করে সে অল্প পরিশ্রমেই মর্যাদার উচ্চ শিখরে আসীন হয়, আর অহংকারী যত দৌড়ঝাঁপ করুক, লাঞ্ছনাই হবে তার ভাগ্যলিপি। সুতরাং সর্ববিষয়ে বিনয় অবলম্বন করো এবং অহংকার পরিহার করে চলো।

***

অন্তর্জ্ঞানী এক বুযুর্গান, একদিন দেখেন এক পাহলোয়ান, ক্রোধে দিশেহারা, আত্মহারা, যাকে পায় তাকে করে তাড়া। বুযুর্গান করেন জিজ্ঞাসা, কেন এহেন দশা, কী তার সমস্যা? লোকেরা বলে, কেউ দিয়েছে গালি, তাই মাথায় চেপেছে খুন, রেগে মেগে হয়ে আছে আগুন। তিনি অবাক হলেন এবং বললেন, হায়, উঠাতে পারে লোহার দশমন ভার, পারে না সইতে একটু ভার দু'টো কথার! কবিতা-

পাহলোয়ানির বড়াই তুমি করো না/ ভাই কুশ্‌তি-লড়াই তোমার সাজে না/ কে বলে তারে বীর নফস যার কামীনা!/ মর্দ নয় সে চুড়িপরা ভীরু যানানা/ মানুষের মুখে পারো যদি তুলে দাও মিষ্টি/ বাহাদুরি নয় শুধু আঘাত করা তুলে মুষ্টি/ ফুলিয়ে ছাতি কাবু করো হাতি/ নিজেরে ভাবো তুমি ভদ্র মানুষ অতি/ যুগ যুগের সত্য বচন যেনো সুনিশ্চয়/ মনুষত্ব নেই, তবে মানুষ সে নয়/ আদমের বেটা মাটির গড়া, নয় আগুন/ মানুষ বলি তারে কী করে, যদি না পায় মাটির গুণ।

শিক্ষা- জনৈক বুযুর্গকে জিজ্ঞাসা করলাম খাঁটি বন্ধুর পরিচয়, তিনি বললেন, বন্ধুকে ভুলে আত্মস্বার্থে মগ্ন যে, সে নীচ অতিশয়। জ্ঞানিগণ বলে গেছেন এই বচন, নিজেকে নিয়ে সদা মগ্ন যেজন, সে তোমার না বন্ধু, না স্বজন। কবিতা- ‘সফরে তোমায় ফেলে আগে আগে চলে/ সে নয় সঙ্গী তোমার তারে যাও ভুলে/ দিলে যার নাই ধার্মিকতা ও খোদা-ভীরুতা/ আত্মীয় বলে তার সনে করো না অন্তরঙ্গতা।

মনে পড়ে, জ্ঞানের দাবীদার এক জ্ঞানী, খণ্ডন করেছে আমার এই কবিতার বাণী। সে বলে, ‘কোরআনে তো রয়েছে খোদার ফরমান, আত্মীয়তা যেন ছিন্ন না করি, যদিও করতে হয় জান কোরবান। অথচ তোমার কথা হে কবী, হে গুণী, খোদার কালাম কোরআনের নাফরমানি।’ তাকে বললাম, জ্ঞান তোমার অগাধ, মানি, তবে তুমি কি আয়াত পড়োনি, যদি বাধ্য করে তোমাকে তারা আমার সঙ্গে শরীক করতে এমন কিছুকে যার সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তাহলে তাদের কথা তুমি মান্য করো না।

কবিতা- খোদার বেগানা তোমার আত্মীয়, শত শত/ অনাত্মীয় এক খোদাভীরু শ্রেয় যেনো নিশ্চিত ।

শিক্ষা- আমাদের কর্তব্য হলো রক্তের বন্ধনের চেয়ে দ্বীনের বন্ধনকে অগ্রাধিকার প্রদান করা।

***

বাগদাদের এক ধনী বৃদ্ধ ধনে জনে ছিলেন সমৃদ্ধ। হঠাৎ কী যে হলো তার দুর্মতি, রূপসী কন্যার কপালে ডেকে আনেন দুর্গতি। এক ইতর চামারের সঙ্গে দিলেন তার বিবাহ। চামারের অত্যাচারে কন্যার জীবন হলো দুর্বিষহ। শেষে একদিন বললেন কন্যার পিতা, শোনো হে ইতর জামাতা, তোমার একি পাশবিকতা, কন্যার দশা করে ছেড়েছো যা তা! হাজার দিনার নাও হে চামার, ছেড়ে দাও মাসুম কন্যা আমার।

এঘটনা বলার উদ্দেশ্য আমার নয় শুধু পরিহাস ও বিনোদন। হাস্যরস ভুলে এর উপদেশটুকু করো গ্রহণ। স্বভাব যদি হয় মন্দ কখনো তা দূর হয় না, মৃত্যুর আগে খাছলত কখনো বদল হয় না। জ্ঞান-বুদ্ধি দিয়ে বিসর্জন, ইতরের সঙ্গ যদি করো গ্রহণ। তবে নিজেকেই শুধু করো তিরস্কার, অন্যকে কিছু বলার নেই তোমার অধিকার।

শিক্ষা- এঘটনার উপদেশ পরিষ্কার। স্বভাব যাদের মন্দ তাদের সঙ্গ পরিত্যাজ্য, অন্যথায় নিজেকেই তার খেসারত দিতে হয়। (ক্রমশ)

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা