যিলক্বদ ১৪৩০হিঃ (১৪)

তোমাদের জন্য

কাকে বলে ইসলাম?

লিখেছেনঃ মাওলানা ইয়াহয়া (রহ)

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

সৃষ্টিজগতের বিশালতা এবং সৃষ্টির উপাদান-ঐক্য

আমরা জানি, বিশ্বজগতের সীমানা ও পরিধি বিশাল, কিন্তু আমরা জানি না, সেটা কত বিশাল! জানা তো দূরের কথা, এপর্যন্ত পৃথিবীতে যত বিজ্ঞানী বিগত হয়েছেন এবং এখন যারা পৃথিবীতে আছেন সকলের সমস্ত জ্ঞান একত্র করেও কল্পনা করা সম্ভব নয়, বিশ্বজগতের সীমানা ও পরিধির বিশালতা! বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী নিউটনের কথা কে না জানে! জীবনের সায়া?হ্েন তিনি এই বলে আক্ষেপ করেছেন, ‘জ্ঞানসমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে বালুভূমিতে বালু নিয়ে খেলা করেই জীবন শেষ হয়ে গেলো, সমুদ্রজলে আর নামা হলো না!’

আসলে যারা প্রকৃত জ্ঞানী ও বিজ্ঞানী তারা জানেন যে, তারা কত কম জানেন! তাই তারা সৃষ্টিজগতের বিশালতার সামনে নিজের ক্ষুদ্রতা অনুভব করে স্রষ্টার সামনে বিনীত হন। সৃষ্টিজগতের অনন্ত রহস্যের ভিতরে ডুবে গিয়ে তারা স্রষ্টার পরিচয় লাভ করেন। যিনি যত বড় বিজ্ঞানী, স্রষ্টার অস্তিত্বে তিনি তত বড় বিশ্বাসী, স্রষ্টার প্রতি তিনি বেশী কৃতজ্ঞ ও অনুগত।

বহু আগে একটি বই পড়েছি, ‘চল্লিশজন বিজ্ঞানীর দৃষ্টিতে আল্লাহর অস্তিত্ব’। বইটি পড়ে আমি অভিভূত হয়েছিলাম। সৃষ্টিজগতের ব্যাপ্তি ও বিশালতা এবং রহস্যের জটিলতা ও নিগূঢ়তা চিন্তা করে বিজ্ঞানিগণ শুধু বিস্ময় ও বিমুগ্ধতা প্রকাশ করেছেন এবং একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন, আছেন! কেউ একজন আছেন অনন্ত রহস্যের আধার এই বিশাল সৃষ্টিজগতের পিছনে। আপন অপ্রকাশিত সত্তাকে এই প্রকাশিত সৃষ্টির মাধ্যমে তিনি আমাদের সামনে প্রকাশ করেছেন। আফসোস বইটি যদি আমার কাছে থাকতো, তা থেকে প্রয়োজনীয় বহু উদ্ধৃতি এখানে দিতে পারতাম! এখন নতুন করে কোন কিছু খোঁজ করা এবং খুঁজে পাওয়া কি আমার পক্ষে সম্ভব! কোথায় এখন সেই উদ্যম-উদ্দীপনা! এখন তো জীবনপ্রদীপের তেল ফুরিয়ে এসেছে। মনে পড়ে, ঐ গ্রন্থে কোন এক বিজ্ঞানী বলেছিলেন, ‘বিজ্ঞান কী? বিজ্ঞান আর কিছু নয়, শুধু বিশাল সৃষ্টিজগতের অসীম রহস্যে হারিয়ে যাওয়া এবং স্রষ্টাকে খুঁজে পাওয়া।’

শব্দের বেশকম হবে হয়ত, তবে বক্তব্যটা এরকমই। তাই আমি বলি, প্রকৃত বিজ্ঞান এবং সত্য ধর্মের মাঝে কখনো কোন সমস্যা ছিলো না, এখনো কোন সমস্যা নেই। মধ্যযুগে বিজ্ঞান ও ধর্মের যে সংঘর্ষের কথা ইতিহাসের পাতায় আমরা পড়ি তা ছিলো বিজ্ঞান ও খৃষ্টধর্মের মাঝে, যা মানুষের হাতে মারাত্মক বিকৃতির শিকার হয়েছে। ইসলামের সঙ্গে বিজ্ঞানের কোন সমস্যা ছিলো না, নেই এবং কখনো থাকবে না; থাকতে পারে না। ইসলাম তো বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক। ইসলাম তো রীতি মত আহ্বান জানায় জ্ঞানীদেরকে সৃষ্টিজগত সম্পর্কে চিন্তা করার, যাতে তারা চিনতে পারে স্রষ্টাকে। কোরআনের ঘোষণা তো এই- ‘নিঃসন্দেহে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে রয়েছে জ্ঞানীদের জন্য বহু নিদর্শন।’

সমস্যা হয় তাদের নিয়ে যারা জানে না বিজ্ঞান কী, অথচ নিজেদের ভাবে মস্ত বড় বিজ্ঞানী। তারাই আসলে আস্পর্ধা দেখিয়ে বলে, ‘আমার অবিশ্বাস’, অথচ তারা জানে না, বিশ্বাস কী, অবিশ্বাসই বা কী? খুব বেশী হলে বলা যায়, তারা বিজ্ঞানের ক্লাশফাঁকি দেয়া অপদার্থ ছাত্র। বিজ্ঞানে তাদের কোন অবদান নেই।

মূল আলোচনা থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি। ফিরে যাই মূল প্রসঙ্গে। আসুন, জগতের সেরা বিজ্ঞানীরা যে দৃষ্টিতে বিশ্বজগতকে দেখেছেন সেই দৃষ্টিতে আমরাও একটু দেখতে চেষ্টা করি। প্রথমেই ভেবে দেখুন বিশ্বজগতের বিশালতার কথা। কত বিশাল এ বিশ্বজগত! আগেই বলেছি, বিশ্বজগতের ব্যাপ্তি ও বিশালতা জানা তো দূরের কথা, তা কল্পনা করাও সম্ভব নয়। গণিতশাস্ত্র এখানে অচল। ১-এর পরে শূন্য বসাতে থাকুন; একসময় আপনার কলমের কালি ফুরিয়ে যাবে, কিন্তু বশ্বিজগতের বিশালতা বেষ্টন করা সম্ভব হবে না। বিশ্বজগত ও মহাশূন্যের বিশালতার অতি সাধারণ একটি ধারণা লাভ করার জন্য বিজ্ঞানীসমাজ আলোকবর্ষ ব্যবহার করেছেন। আলোকবর্ষ অর্থ আলোর একবছরের গতির সমপরিমাণ দূরত্ব। এক সেকেন্ডে আলো একলক্ষ ছিয়াশি হাজার মাইল দূরত্ব অতিক্রম করে। তাহলে আলো কতটা দূরত্ব অতিক্রম করে একমিনিটে! এক ঘণ্টায়! এক দিনে! এক সপ্তাহে! এক মাসে এবং অবশেষে এক বছরে! সেই দূরত্বটাই হচ্ছে এক আলোকবর্ষ! বিশ্বজগতের ব্যাপ্তি কিন্তু একশ, দু'শো বা একদু’হাজার আলোকবর্ষ নয়; নয় কয়েক লক্ষ আলোকবর্ষ; আরো বেশী। কত বেশী তা জানেন শুধু তিনি যিনি বিশ্বজগত সৃষ্টি করেছেন। কোরআনের ভাষায়, ‘তিনিই কি জানবেন না, যিনি সৃষ্টি করেছেন, অথচ তিনি সূক্ষ্মদর্শী, পূর্ণ অবগত!’

আমাদের সূর্য হচ্ছে একটি তারকা। একসময় বলা হতো নয়টি, এখন বলা হয় এগারোটি, সামনে হয়ত সংখ্যা আরো বাড়বে। আসলে এটাই হচ্ছে মানুষের জ্ঞান ও অজ্ঞতার স্বরূপ। যাক, এগারোটি গ্রহ এবং কিছু উপগ্রহ নিয়ে হলো সৌরজগত। গ্রহগুলো সূর্যকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন দূরত্বে এবং বিভিন্ন গতিতে প্রদক্ষিণ করছে। আর বিভিন্ন গ্রহকে কেন্দ্র করে কিছু উপগ্রহ প্রদক্ষিণ করছে। আমাদের পৃথিবী হলো সূর্যকে প্রদক্ষিণকারী তেমনি একটি গ্রহ, আর চাঁদ হচ্ছে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণকারী উপগ্রহ। এসব নিয়েই হলো সৌরজগত। আগেই বলেছি, সূর্য হচ্ছে একটি তারকা। এরূপ অসংখ্য তারকা নিয়ে গড়ে উঠেছে একেকটি ছায়াপথ। বিজ্ঞানীদের ধারণা - প্রকৃত জ্ঞান তো আল্লাহর নিকট- আমাদের ছায়াপথে রয়েছে দশহাজার কোটি তারকা। আমরা যে সৌরজগতের বাসিন্দা সেটার অবস্থান হলো আমাদের ছায়াপথের এক প্রান্তে। ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে আমাদের সৌরজগতের দূরত্ব হলো তেত্রিশ হাজার আলোকবর্ষ। তাহলে ছায়াপথের ব্যাস দাঁড়াচ্ছে কমবেশী ছেষট্টি হাজার আলোকবর্ষ। এখন বুঝুন ছায়াপথের পরিধি ও ব্যপ্তি কত বিশাল! এ তো গেলো একটিমাত্র ছায়াপথের কথা! বিশ্বজগতে একরকম ছায়াপথের সংখ্যা কত, বিজ্ঞানীদের জানা নেই। তারা শুধু ধারণা করছেন, ছায়াপথের সংখ্যা দশকোটি এবং প্রতিটিতে রয়েছে আমাদের ছায়াপথের মত দশহাজার কোটি তারকা। ভাবতে গেলে চিন্তাশক্তি নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা নয় কি? কিন্তু এটুকুই তো আল্লাহর সৃষ্টির সমগ্র নয়, সামান্য অংশমাত্র, যা বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণ ও ধারণার আওতায় এসেছে। বিজ্ঞানীদের জ্ঞান, পর্যবেক্ষণ ও ধারণার বাইরে যা রয়ে গেছে তা আরো কত বিশাল!

আধুনিক বিজ্ঞানমতে সৃষ্টির আদিতে সৃষ্টির সমস্ত কিছু একটি অতি ক্ষুদ্র, অতি ঘন ও অতি উত্তপ্ত অগ্নিপিণ্ডে একীভূত ছিলো। সেই পিণ্ডের ভিতরে স্থান, কাল, পদার্থ, তেজ সমস্তই নিহিত ছিলো। কোন একসময় উক্ত পিণ্ডে এক মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে মহাবিশ্বের সৃষ্টির সূচনা হয়। তার পর থেকে বিশ্বজগত সমপ্রসারিত হয়ে চলেছে এবং সমপ্রসারণের সে ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। ধারাবাহিকভাবে সৃষ্টি হয়েছে কোটি কোটি ছায়াপথ, হাজার হাজার কোটি তারকা। সৃষ্টি হয়েছে যমীন আসমান। সৃষ্টি হয়েছে প্রাণ, উদ্ভিত ও অন্যান্য সবকিছু। সৃষ্টির শুরু থেকে লক্ষ লক্ষ ছায়াপথ, লক্ষকোটি তারকা ও অন্যসবকিছু প্রচণ্ড গতিতে, সুসৃঙ্খলভাবে ঘুর্ণায়মান অবস্থায় সমপ্রসারিত হচ্ছে। এত প্রচণ্ড গতিময়তা সত্ত্বেও কোথাও কোন সঙ্ঘর্ষ নেই। কোরআনের ভাষায়- ‘তুমি কি দেখতে পাচ্ছো কোথাও কোন খুঁত, বিচ্যুতি?’

বিস্ময়ের বিষয় এই যে, চৌদ্দশ’ বছর আগে উম্মী নবীর উপর অবতীর্ণ কোরআন যা ঘোষণা করেছে, আধুনিক বিজ্ঞান এত দিন পর সৃষ্টির সূচনা সম্পর্কে হুবহু সেটাই স্বীকার করে নিয়েছে। দেখুন আলকোরআনের ঘোষণা- ‘যারা কুফুরি করে তারা কি দেখে না যে, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী একদা পরস্পর অতি ঘনিষ্টভাবে মিশে ছিলো, অনন্তর আমি তাদের বিচ্ছিন্ন করেছি, আর আমি সৃষ্টি করেছি পানি থেকে প্রতিটি প্রাণসম্পন্ন বস্তু, সুতরাং তারা কি ঈমান আনবে না?’

এছাড়া আলকোরআনে বারংবার উচ্চারিত ‘কুন’ (বা হও) হচ্ছে সেই মহাবিস্ফোরণের আদেশ যা আল্লাহ তা‘আলা অগ্নিপিণ্ডটিকে সৃষ্টির সূচনালগ্নে দান করেছিলেন।

এখন প্রশ্ন হলো, এমন বিশাল বিশ্বজগত কি আপনা-আপনি শুধু ঘটনাচক্রে সৃষ্টি হয়েছে? তথাকথিত এই ঘটনাচক্রেই কি এত প্রচণ্ড গতিতে এমন সুশৃঙ্খলভাবে বিশ্বজগত ক্রমশ সমপ্রসারিত হচ্ছে? বিজ্ঞান, এবং বিশেষ করে আধুনিক বিজ্ঞান কি ঘটনাচক্র স্বীকার করতে পারে? ঘটনাচক্রের অযৌক্তিক তত্ত্ব মেনে নিলে তো বিজ্ঞানের বিশাল সৌধ মুহূর্তে ধ্বসে পড়বে! কেননা বিজ্ঞানের অস্তিত্বই তো হচ্ছে কারণ ও কার্যকারণের উপর!

বস্তুত বিশ্বজগতের এই বিশালতা, এই প্রচণ্ড গতিময়তা এবং এই সুশৃঙ্খল সমপ্রসারণ দ্ব্যর্থহীনভাবে সর্বশক্তিমান মহাজ্ঞানী, মহাপ্রজ্ঞার অধিকারী এক মহান স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণ করে।

তাছাড়া বিজ্ঞানিগণ প্রমাণ করেছেন যে, বিশ্বজগতের সকল বস্তুর সৃষ্টি-উপাদান এক ও অভিন্ন। সুতরাং সৃষ্টির উপাদানের এই একত্ব নিঃসন্দেহে স্রষ্টারও একত্ব প্রমাণ করে।

(চলবে, ইনশাআল্লাহ)
শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা