সফর ১৪৩১ হি:(১৫)

তোমাদের জন্য

সম্পাদকের রোজনাচা

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

 ১-১-৩১ হিঃ

দেখতে দেখতে চলে গেলো আমাদের প্রিয় হিজরী সনের আরো একটি বছর। হিজরী সনকে অবশ্য কেউ হিসাবের মধ্যেই রাখে না, তাই কখন শুরু হয় কখন শেষ হয় খবর থাকে না, অথচ ‘ইংরেজি’ নববর্ষে মুসলিম সমাজেও ধূম পড়ে যায়।

পুরোনো বছরকে বিদায় এবং নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়ে ভালো ভালো কথা বলা এখন একটি প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সত্য এই যে, জীবনের মহামূল্যবান সময় সম্পর্কে আমাদের কোন চেতনা নেই।

আমরা বলে থাকি, ‘একটি বছর হারিয়ে গেলো অতীতের গর্ভে’। আসলেই কি সময় হারিয়ে যায়! এখান থেকে ওখানে জমা হয় শুধু। আবার আমাদেরকে এই সময়ের মুখোমুখি হতে হবে, যিনি সময় দান করেছেন তাঁর সামনে। তখন প্রতিটি মুহূর্তের হিসাব দিতে হবে।

১০-১- ৩১ হিঃ

এবার ভেবেছিলাম ছফর থেকে ফিরেই পুষ্পের কাজ শুরু করে দেবো, কিন্তু হলো না। ভিতর থেকে লেখার কোন প্রবাহ আসছে না। আল্লাহ জানেন, কলম কবে আবার ফিরে পাবে তার থেমে যাওয়া গতি! সফর থেকে আনা কিতাবগুলো দেখছি। কুতুবখানায় জমা দেয়ার পর আর কি দেখার সুযোগ হবে! অথচ সামান্য কিছু লেখার জন্য পড়তে হয় অসামান্য। তাই ভাবি, এই যে কলমের গতি থেমে যাওয়া, একদিক থেকে এটা ভালোই, তখন সামান্য কিছু হলেও পড়া হয়।

একটি কিতাব এনেছি, মুসলিম উম্মাহর বিজয় অভিযানের ধারাবাহিক ইতিহাস এবং তার মানচিত্র। মূল হচ্ছে আরবী, এটি উর্দূ অনুবাদ। ইচ্ছে আছে, এটিকে অবলম্বন করে পুষ্পের জন্য কিছু লেখার।

১৭ -১-৩১ হিঃ 

ভালো ভালো লেখক এখন দেখছি লেখা ও ভাষার প্রতি যত্নবান নন। চিন্তা ছাড়াই লিখে যান, লেখার পরিচর্যার তো প্রশ্নই নেই। একটি বই হাতে এসেছে, নাম ‘প্রথম বিশ্বযুদ্ধ’। লেখক লিখেছেন, ‘প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে বাদ দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা লেখা সম্ভব নয়। এ দু’টি বিশ্বযুদ্ধ যেন একই সূত্রে গাঁথা দু’টি ফুল।’

অদ্ভুত! বিশযুদ্ধকে তার কাছে মনে হয়েছে ফুল! বিশ্বযুদ্ধের উপমা তো হলো কেয়ামত বা মহাপ্রলয়! অবশ্য এখানে এভাবে লেখা যায়, ‘কারণ এদু’টি বিশ্বযুদ্ধ যেন একই শিকড় থেকে গজিয়ে ওঠা দু’টি কাঁটাবৃক্ষ।’ অথবা উপমা বাদ দিয়ে সাদামাটাভাবে লেখা যায়, ‘কেননা কারণ ও কার্যকারণের দিক থেকে দু’টি বিশ্বযুদ্ধ একই সূত্রে গাথা।’

এরকম বই বেশীক্ষণ হাতে রাখা সত্যি খুব ‘ছবরতলব’ কাজ, অথচ তথ্য জানার জন্য পড়তে হয়।

২০-১-৩১ হিঃ

দৈনিক পত্রিকাগুলো বেশ কিছু দিন থেকে বিভিন্ন নামে ছোট্ট কলেবরে হালকা চটুল ধাঁচের ম্যাগাজিন বের করছে। বলতে গেলে এটা এখন দৈনিকের অনিবার্য অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে।  মোটামুটি পাঠ-অযোগ্য হলেও মাঝে মধ্যে দেখি। কারণ সেখান থেকেও হঠাৎ হঠাৎ কাজের সহায়ক জিনিস হাতে এসে যায়। আমার দেশ পত্রিকার ম্যাগাজিনটার নাম হলো ভিমরুল। তাতে একটি অভিনব জিনিস পেলাম। ‘বক্তব্য’ শব্দটি লেখা হয়েছে এভাবে- প্রথমে একটি বকের ছবি এঁকে, তার পাশে ‘বক’ শব্দটি; তার পর নীচে ‘তব্য’। চিন্তার অভিনবত্ব আমার কাছে ভালো লেগেছে। তবে মনে হয়, বকের চিত্রটির পাশে শুধু ‘তব্য’ লেখাই যথেষ্ট ছিলো। চিত্রের পাশে ‘বক’ লেখার প্রয়োজন ছিলো না। কারণ বক-এর চিত্রটিই তো ‘বক’ শব্দাংশের বিকল্পরূপে এসেছে।

২৩-১-৩১ হিঃ

পুষ্পের বর্তমান সংখ্যার জন্য অতিথিসম্পাদক নির্বাচিত হয়েছে দু’জন। প্রথমজন ইবনে সাঈদ, সাতকানিয়া, চট্টগ্রাম। তার লেখাটির সম্পাদনা শেষ করে আছরের নামাযে দাঁড়াবো, এমন সময় একটি সুন্দর লেখার বীজ এলো চিন্তায়। এবারের শেষ কথা শিরোনামে তা প্রকাশিত হয়েছে। ইবনে সাঈদের লেখাটি সম্পাদনার পর ১৭-এর পাতায় ছাপা হয়েছে । তার লেখার মূল কথা ছিলো কলমের প্রতি অবহেলা প্রদর্শনের কারণে লেখকের প্রতি কলমের অভিমান। হঠাৎ আমার মনে হলো, আমরা ‘ওয়ানটাইম বলপেন’ ব্যবহার করি, এটাও তো কলমের একপ্রকার অবমাননা! অথচ আমাদের পূর্ববর্তিগণ কঞ্চি চেঁছে চেঁছে অনেক কষ্ট করে নিজেরাই কলম তৈরী করে নিতেন। হয়ত একারণেই তাদের লেখায় যে নূর ও নূরানিয়াত তা আমাদের লেখায় নেই।

ইবনে সাঈদের মূল লেখাটি সম্পর্কে ইচ্ছে আছে আগামী সংখ্যায় কিছু আলোচনা করার। তার লেখাটি এই-

‘আজ অনেক দিন পর খাতা-কলম নিয়ে বসলাম। কিন্তু লেখা আসছে না, অথচ বুকের মাঝে জমা হয়ে আছে অনেক কথা। কিছুই কলমের ডগা দিয়ে বের হচ্ছে না। অনেক চেষ্টা করলাম, কাজের কাজ কিছুই হলো না। কলমের হঠাৎ এই ‘নিষ্ক্রীয়তা’র কারণ কী? চিন্তা করতে লাগলাম। তখন হাতের কলমটি চেচিয়ে উঠে বললো, হয়েছে, আর চিন্তা করতে হবে না। আসল কারণ হলো, আমি রাগ করেছি। আমি বললাম, কার সাথে? সে বললো, তোমার ডান হাতের সাথে। আমি বললাম, কেন? সে বললো, তোমার ডান হাতের সাথে আমার বন্ধুত্ব অনেক দিনের। কিন্তু গত দেড়মাস যাবৎ সে আমার কোন ‘খোজ-খবর’ নেয়নি। আমি তোমার পকেটে পড়ে থাকতাম, আর একবুক আশা নিয়ে অপেক্ষা করতাম, কখন তোমার ডান হাত আমাকে নেবে, কিন্তু তোমার ডান হাত আমার দিকে ফিরেও তাকায়নি।

তখন আমি ডান হাতকে বললাম, কিরে, তুই কলমের খোজ-খবর নিসনি কেন? ডান হাত বললো, আমার কী দোষ! আমি তো তোমার শরীরের একটি ছোট অঙ্গ। তুমি অনুমতি দাওনি, তাই আমি কলমকে নিয়ে লেখালেখি করতে পারিনি।

আমি কলম, আর হাতকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম, তখন টেবিলে পড়ে থাকা খাতাটি চেচিয়ে উঠে বললো, সান্ত্বনা শুধু তাদেরকে দিলে হবে! আমাকে কে দেবে? আমি বললাম, তোমার আবার কী হয়েছে। সে বললো, তুমি তোমার ডানহাতকে অনুমতি দাওনি,তাই সে কলমকে নিয়ে লিখতে পারেনি, আর তাই কলমও আমার উপর লিখতে পারেনি। অথচ আমি প্রতিদিন অপেক্ষা করতাম, কলম আমার উপর লিখবে, আর আমার সাদাপৃষ্ঠাগুলো কলমের কালিতে ভরে ওঠবে, যে কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়ে পবিত্র, কিন্তু তা তোমার জন্য সম্ভব হয়নি। আমি আমার ‘ভূল’ বুঝতে পেরে বললাম, আসলে কি জানো, মাঝে মাঝে আমাকে শয়তানে পেয়ে বসে। তো তোমরা দোয়া করো, যাতে শয়তান থেকে আল্লাহ আমাকে হিফাযত করেন।’

দ্বিতীয় সম্পাদক আমাতুল্লাহ তাসনীম। তার গত সংখ্যার এবং বর্তমান সংখ্যার ‘হৃদয়স্পর্শী’ লেখাদু’টি  আমার হৃদয়কে স্পর্শ করেছে। সার্থক লেখা আমরা তাকেই বলবো যা হৃদয়কে স্পর্শ করে। আর লেখা যখন হৃদয় থেকে উৎসারিত হয়, অবশ্যই তা হৃদয়কে স্পর্শ করে।  আল্লাহ তার মেহনতকে কবুল করুন, আমীন।

২৫-১-৩১ হিঃ

একটি ছেলে একটি লেখা পাঠিয়েছে। কঠিন কঠিন শব্দের ভারে যাকে বলে একেবারে ভারাক্রান্ত। সুন্দর লেখা মানে যে কঠিন কঠিন শব্দের সমাহার নয়, এটা অনেকেই বুঝতে পারে না। আমি প্রায় বলে থাকি। লেখা মানে কোন বিষয় নিয়ে কথা বলা এবং স্বাভাবিকভাবে কথা বলা। ছেলেটি লিখেছে, ‘প্রকৃতির পাঠশালা শিক্ষণীয়োপকরণে সুশোভিত।’

কথাটা যদি এভাবে বলি, ‘প্রকৃতির পাঠশালায় রয়েছে শিক্ষা লাভের অসংখ্য উপকরণ’ তাহলে আরো সহজ-সরল ও স্বাভাবিক হয়। এভাবেও বলা যায়, ‘এই পৃথিবী এক বিরাট পাঠশালা। এখানে চারদিকে ছড়িয়ে আছে শিক্ষার অসংখ্য উপকরণ!’

মোটকথা, কথাটি যত সহজ-সরল ও স্বাভাবিক হবে, ততই ভালো।

অনেকের লেখায় চটকদার চটকদার শব্দ থাকে এবং শব্দের বাহুল্য থাকে, কিন্তু ভাব ও মর্ম থাকে না। এমন একটি লেখা সম্পর্কে আমার ছেলে আজ একটি সুন্দর মন্তব্য করেছে, ‘শব্দের সমাহার, অর্থের হাহাকার’।    মন্তব্যটি সুন্দর, তবে তাকে আমি বললাম, এখন তোমার নিজের লেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকার সময়, অন্যের লেখা সম্পর্কে মন্তব্য করার সময় নয়।

২-২-৩১ হিঃ

প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর করে এসেছেন। ভারতের সঙ্গে আমাদের সমস্যাগুলো ঝুলন্তই রয়ে গেছে, যা পাওয়া গেছে তা হলো ‘আশ্বাস’, অথচ আমাদের প্রতিটি সমস্যা হচ্ছে জীবনমরণ সমস্যা। পক্ষান্তরে আমাদের কাছে ভারতের কিছু চাহিদা ও স্বার্থ ছিলো এবং আমাদের উদার প্রধানমন্ত্রী তা পূরণ করে দিয়ে এসেছেন। তিনিও আশ্বাস দিয়ে আসতে পারতেন যে, আমাদের সমস্যাগুলো দূর হলে আমরাও আপনাদের চাহিদাগুলো বিবেচনা করবো। এখন আমাদের হাতে দরকষাকষির কিছুই থাকলো না।

আশ্চর্য! কিছু কিছু পত্রিকা অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে ভারতের পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। জ্ঞানপাপী আর কাকে বলে!

১৫-১১-৩০ হিঃ

পুষ্পের এক পাঠিকা বড় সুন্দর কথা বলেছে, ‘ইংরেজী নববর্ষ বরণ করতে গিয়ে কিছু মানুষ তো সারা রাত শারাফাতের সঙ্গে অতিবাহিত করে, কিন্তু কিছু লোক সারা রাত ‘শারারাত’ করেই কাটায়।’

সারা রাত, শারারাত ও শারাফাত-এই শব্দতিনটির চমৎকার মিল আমাকে মুগ্ধ করেছে! আল্লাহ সবাইকে তাওফীক দান করুন, আমীন।

২৭-১-৩১ হিঃ

একটি মেয়ে একটা বড়সড় লেখা পাঠিয়েছে। সঙ্গে ছোট্ট একটি চিঠি, তাতে আছে একটি অজ্ঞাত হুমকি। সে লিখেছে, ‘যদি আমার লেখাটা পুষ্পের পাতায় ছাপানো না হয় তাহলে...।

আমি ধরে নিলাম, ‘তাহলে আপনার সঙ্গে আড়ি’, কিংবা ‘তাহলে তেঁতুল খাওয়াবো কাঁড়ি কাঁড়ি’, কিংবা ‘তাহলে ঝাড়ু নিয়ে হাযির হবো আপনার বাড়ি’।

তো প্রথম এবং দ্বিতীয়টা তেমন ভয় পাওয়ার মত নয়, কিন্তু তৃতীয়টা সম্পর্কে ‘সিরিয়াসলি’ ভাবতে হয়!

তেঁতুলে চন্দ্রবিন্দু লাগে, আজ জানা হলো। আশ্চর্য! আমি আবার বানান নিয়ে এত কথা বলি!       (চলবে ইনশাআল্লাহ)

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা