সফর ১৪৩১ হি:(১৫)

তোমাদের জন্য

প্রধান ধর্মসমূহে স্রষ্টার ধারণা

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

 আল্লাহর একত্ব

বহুদেবতায় বিশ্বাসী কিছু লোক এই বলে বিতর্ক করে যে, একাধিক ঈশ্বরের অস্তিত্ব অযৌক্তিক নয়। তাদের এটা জানা দরকার যে, ঈশ্বর যদি একের অধিক হতো তাহলে তারা একে অপরের সঙ্গে বিবাদ করতো এবং প্রত্যেক ঈশ্বর অন্য ঈশ্বরের উপর নিজের ইচ্ছা ও সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চাইতো। বহুঈশ্বরবাদী এবং  সর্বেশ্বরবাদীদের পুরাণে এটা দেখা যায়। যদি একজন ঈশ্বর পরাজিত হয়, বা অন্য ঈশ্বরদের পরাজিত করতে অক্ষম হয় তাহলে বলতেই হবে যে, নিশ্চিতভাবেই সে সত্য ঈশ্বর নয়। এছাড়াও বহুঈশ্বরবাদী ধর্মসমূহে ‘বহুদেবতা’র ধারণা প্রচলিত রয়েছে, যাদের প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন দায়িত্ব রয়েছে। প্রত্যেকে মানুষের অস্তিত্বের একটি অংশের বিষয়ে দায়িত্বশীল। যেমন সূর্যের দেবতা, বৃষ্টির দেবতা ইত্যাদি। এটা নির্দেশ করে যে, একজন ঈশ্বর কিছু কাজে অক্ষম, তদুপরি সে অন্যান্য দেবতার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে অজ্ঞ। অজ্ঞ ও অক্ষম কোন সত্তা ঈশ্বর হতে পারে না। ঈশ্বর যদি একাধিক হতো, অবশ্যই তা মহাবিশ্বকে বিশৃঙ্খলা ও ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেতো, অথচ মহাবিশ্ব সুশৃঙ্খল ও সুনিয়ন্ত্রিত অবস্থায় পরিচালিত হচ্ছে। এ  চিরন্তন সত্যটিকেই কোরআন বলেছেন এভাবে-

যদি আকাশে ও পৃথিবীতে আল্লাহ ছাড়া অন্য ঈশ্বর থাকতো তাহলে আকাশ ও পৃথিবী ‘তছনছ’ হয়ে যেতো। সুতরাং আরশের অধিপতি আল্লাহ চিরপবিত্র ঐ দোষ থেকে যা তারা (তাঁর উপর) আরোপ করে। (২১ঃ২২)

কোরআনে আরো ইরশাদ হয়েছে-

আল্লাহ না কোন সন্তান জন্মদান করেছেন, না তাঁর সমকক্ষ কোন ঈশ্বর রয়েছে। (যদি অনেক ঈশ্বর থাকতো) তাহলে তো প্রত্যেক ঈশ্বর নিজ নিজ সৃষ্টি নিয়ে পৃথক হয়ে যেতো এবং একে অন্যের উপর প্রাধান্য বিস্তারে সচেষ্ট হতো। সুতরাং তিনি চিরপবিত্র ঐ দোষ থেকে যা তারা তাঁর উপর আরোপ করে। (২৩ঃ৯১)

সুতরাং একজন মাত্র সত্য, সর্বোচ্চ ও সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের অস্তিত্বই ঈশ্বরের একমাত্র যুক্তিসঙ্গত ধারণা।

বুদ্ধ ও কনফুসিয়াস মতবাদের মত কিছু ধর্ম রয়েছে, যেগুলো অজ্ঞেয়বাদী ধর্ম। তারা ঈশ্বর সম্পর্কে কোন মন্তব্য করে না। তারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব না স্বীকার করে, না করে অস্বীকার। আবার জৈন মতবাদের মত কিছু ধর্ম রয়েছে, যেগুলো নিরীশ্বরবাদী বা নাস্তিক্যবাদী ধর্ম, যেগুলো ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না।

(ইনশাআল্লাহ আমি ‘কোরআন কি আল্লাহর বাণী’ শিরোনামে একটি বই প্রকাশ করবো, যা আলহামদুলিল্লাহ একজন নিরীশ্বরবাদী, নস্তিক ও একজন অজ্ঞেয়বাদীর কাছে যুক্তি ও বিজ্ঞানের আলোকে কোরআনের ভিত্তিতে আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণ করবে।)

সকল ধর্ম শেষপর্যন্ত একেশ্বরবাদ-এ বিশ্বাস করে

প্রধান ধর্মসমূহ যেগুলো ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করে তাদের সবগুলোই পরিশেষে একটি উচ্চতর স্তরে এসে এক সর্বোচ্চ ঈশ্বরে বিশ্বাস করে থাকে। সকল ধর্মগ্রন্থই প্রকৃতপক্ষে একেশ্বরবাদের কথা বলে, অর্থাৎ এক ও অদ্বিতীয় সত্য ঈশ্বরে বিশ্বাসের কথা প্রচার করে। কিন্তু চরম দুঃখজনক হলেও এটাই বাস্তব সত্য যে, কোরআন ছাড়া আর কোন ধর্মগ্রন্থ অবিকৃত অবস্থায় নেই। যুগে যুগে সেগুলো ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে একদল মানুষের হাতে বারবার বিকৃত ও পরিবর্তিত হয়েছে। অনেক ধর্মই এভাবে একেশ্বরবাদ থেকে সর্বেশ্বরবাদ বা বহুঈশ্বরবাদে বিকৃত হয়েছে। পবিত্র কোরআন বলে, ‘সুতরাং দুর্ভোগ তাদের যারা নিজ হাতে কিতাব লেখে, তারপর বলে, এটা আল্লাহর পক্ষ হতে। (এটা তারা করে) তা দ্বারা তুচ্ছ মূল্য লাভ করার জন্য। সুতরাং সর্বনাশ তাদের, ঐ জন্য যা তাদের হাত লিখেছে এবং সর্বনাশ তাদের, ঐ জন্য যা তারা উপার্জন করেছে। (২ঃ৭৯)

তাওহীদঃ সংজ্ঞা ও শ্রেণীবিভাগ 

ইসলামের মূল বিশ্বাসই হচ্ছে তাওহীদ। তবে তাওহীদ অর্থ একেশ্বরবাদ বা একমাত্র ঈশ্বরে বিশ্বাস করাই শুধু নয়, বরং আরো অনেক বেশী কিছু। তাওহীদের শাব্দিক অর্থ এক করা বা একত্ব নিশ্চিত করা। তাওহীদকে তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে।

(ক) তাওহীদ আররবূবিয়্যাহ (প্রতিপালনের একত্ব)

(খ) তাওহীদ আল-আসমা ওয়াস-সিফাত ( সত্তা ও গুণাবলীর একত্ব)

(গ) তাওহীদ আল-ইবাদাহ (ইবাদতের একত্ব)

রব অর্থ প্রভু, রক্ষাকর্তা ও পালনকর্তা, সুতরাং তাওহীদ আররবূবিয়্যাহ অর্থ হলো একথা বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ একাই সকল কিছুকে অস্তিত্ব দান করেছেন, যখন কিছুই ছিলো না।  বিশ্বজগতের সবকিছু তিনি একাই সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি একাই সবকিছুর ব্যবস্থাপনা করছেন, তিনি একাই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন, তিনি একাই সবকিছুর প্রতিপালন করছেন

তাওহীদ আল-আসমা ওয়াস-সিফাত, এর অর্থ হলো সত্তা ও গুণাবলীর একত্বে বিশ্বাস করা। অর্থাৎ

(ক) আল্লাহকে তেমনি মনে করতে হবে যেমনটি তিনি এবং তাঁর রাসূল বর্ণনা করেছেন।

(খ) আল্লাহকে বুঝতে হবে অবশ্যই সেরূপ আদব অনুসারে যেরূপ তিনি এবং তাঁর রাসূল তাঁকে বর্ণনা করেছেন। তাঁর নামসমূহ এবং বৈশিষ্ট্যসমূহের সুস্পষ্ট অর্থ ভিন্ন অন্যকোন অর্থ আরোপের মাধ্যমে ব্যাখ্যা না করে।

(গ) আল্লাহ বলতে অবশ্যই তেমনি বুঝতে হবে যেমনটি তিনি নিজেই নিজেকে বর্ণনা করেছেন। আল্লাহকে বর্ণনা করতে হবে অবশ্যই তাঁকে কোন নতুন নাম না দিয়ে বা তাঁর প্রতি কোন নতুন বৈশিষ্ট্য আরোপ না করে। উদাহরণস্বরূপ, আল্লাহকে ‘আলগাদিব’ নাম দেয়া যাবে না এটা সত্য হওয়া সত্ত্বেও যে, তিনি বলেছেন, তিনি রাগান্বিত (ক্রুদ্ধ) হন। কারণ এই নাম না আল্লাহ, না তাঁর রাসূল ব্যবহার করেছেন।

(ঘ) আল্লাহকে বর্ণনা করতে হবে তাঁর উপর তাঁর সৃষ্টির কোন বৈশিষ্ট্য আরোপ না করে। সৃষ্টির যাবতীয় বৈশিষ্ট্য আল্লাহর প্রতি আরোপ করা থেকে কঠোরভাবে বিরত থাকতে হবে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বাইবেলে ঈশ্বরকে চিত্রিত করা হয়েছে নিজের মন্দ চিন্তার জন্য এরূপ অনুশোচনা- কারীরূপে যেমন মানুষ তার ভুল বুঝতে পারার পর করে থাকে। এটা তাওহীদের মূল তত্ত্বের সম্পূর্ণ বিরোধী। আল্লাহ কখনো ভুল করেন না এবং অনুশোচনা করেন না। পবিত্র কোরআনের সূরা আশশু‘আরা-এ আল্লাহর বৈশিষ্ট্যসমূহের ব্যবহার-এর মূলনীতি উল্লেখ করা হয়েছে এভাবে- ‘তাঁর সমতুল্য কিছুই নেই এবং তিনিই সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা (৪২ঃ১১)

যদিও শ্রবণ ও অবলোকন মানবগুণাবলীর অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু সেগুলো যখন আল্লাহর সত্তা সম্পর্কে বলা হয় তখন সেগুলো পূর্ণতায় ও শ্রেষ্ঠতায় হয় তুলনাহীন। তেমনটি নয়, যখন সেগুলো মানুষের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়, যাদের কান, চোখ ইত্যাদির প্রয়োজন হয় এবং যাদের দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণক্ষমতা সীমাবদ্ধ।

(চ) কোন এক বা একাধিক মানুষকে ঈশ্বরের কোন এক বা একাধিক বৈশিষ্ট্যে ভূষিত করা যাবে না। এরূপ করা তাওহীদের মূলনীতির পরিপন্থী। উদাহরণস্বরূপ কোন মানুষকে এভাবে বর্ণনা করা যাবে না যে, তার শুরু নেই ও শেষ নেই বা তিনি শাশ্বত।

(ছ) আল্লাহর নাম তাঁর কোন সৃষ্টিকে দেয়া যাবে না। যেমন রায্যাক, গাফ্ফার। তবে কিছু ঐশ্বরিক নাম, যেমন ‘রঊফ’ বা ‘রহীম’ অনির্দিষ্ট প্রকৃতিতে মানুষের জন্য অনুমোদনীয়। কারণ আল্লাহ তা‘আলা নবীদের  ক্ষেত্রে তা ব্যবহার করেছেন। কিন্তু আর-রাঊফ ও আর-রাহীম (একমাত্র পরম করুণাময় ও চির দয়ালু) এই নির্দিষ্ট প্রকৃতিতে শুধু আল্লাহ তা‘আলার শানে ব্যবহার করা যাবে, যদি তার পূর্বে আব্দ বা -এর দাস শব্দটি থাকে; যেমন আব্দুর-রাঊফ এবং আবদুর-রাহীম।

তাওহীদুল ইবাদাহ বা ইবাদতের একত্ব সংরক্ষণ করা হলো তাওহীদের প্রায়োগিক স্তর। এজন্য প্রথমে আমাদেরকে ইবাদাহ-এর সংজ্ঞা বুঝতে হবে। ইবাদাহ শব্দটি এসেছে আরবী শব্দ আবদ থেকে, যার অর্থ হলো দাস বা গোলাম। সুতরাং ইবাদাহ অর্থ হলো দাসত্ব এবং উপাসনা। ছালাহ হচ্ছে ইবাদাহ বা উপাসনার সর্বোচ্চ রূপসমূহের একটি, তবে একমাত্র রূপ নয়। মানুষ ভুল ধারণা করে যে, সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের উপাসনা বলতে শুধু আনুষ্ঠানিক প্রার্থনাকেই বোঝায়। কিন্তু ইসলামে উপাসনার ধারণায় সম্পূর্ণ বাধ্যতা, আনুগত্য ও দাসত্ব অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আল্লাহর নির্দেশসমূহ যথাযথরূপে পালন করা এবং তিনি যা কিছু নিষিদ্ধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকাই হচ্ছে ইবাদাহ এবং এই ইবাদাহ একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার অধিকার ও প্রাপ্য, অন্য কারো নয়, কোনভাবেই নয়।

উপরে তাওহীদের যে তিনটি শ্রেণীর কথা বলা হলো, তার প্রতিটিকে একই সঙ্গে একইভাবে মেনে চলতে হবে। তাওহীদ আল-ইবাদাহ-এর  বাস্তবায়ন ছাড়া শুধু প্রথম দুই শ্রেণীর তাওহীদে বিশ্বাস স্থাপন করা নিষ্ফল। কোরআন রাসূলের সময়ের ‘মুশরিকীন’ (পৌত্তলিক)-দের উদাহরণ দেয়, যারা তাওহীদের শুধু প্রথম দু’টি দিক স্বীকার করতো। পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে- ‘বলো কে তোমাদের রিযিক দান করেন আকাশ ও পৃথিবী থেকে, অথবা কে তিনি যিনি শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তির নিয়ন্তা। এবং কে তিনি যিনি জীবিতকে মৃত হতে এবং মৃতকে জীবিত হতে বের করেন এবং কে তিনি, যিনি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন? তখন তারা বলবে, ‘আল্লাহ’। বলো, তবু কি তোমরা কৃতজ্ঞ হবে না (তাঁর প্রতি)? (১০ঃ৩১)

মক্কার প্রতিমাপূজকরা জানতো যে, আল্লাহ তাদের স্রষ্টা, রক্ষাকর্তা, প্রভু এবং মালিক। তথাপি তারা মুসলিম ছিলো না, কারণ আল্লাহ ছাড়াও তারা অন্যান্য দেবতার উপাসনা করতো। আল্লাহ তাদেরকে কাফির, মুশরিক বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘এবং তাদের অধিকাংশই আল্লাহকে বিশ্বাস করে, কিন্তু তাঁর সঙ্গে অংশীদার যুক্ত করে। (১২ঃ১০৬)

সুতরাং তাওহীদ আলইবাদাহ বা উপাসনার একত্ব বজায় রাখা হচ্ছে  তাওহীদের সবচে’ গুরুত্বপূর্ণ দিক।

(সমাপ্ত)

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা