সফর ১৪৩১ হি:(১৫)

তোমাদের জন্য

দাদুর মুখে মায়ের ছবি!

লিখেছেনঃ ইবনে মিছবাহ

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

 

সবাই বলে, কষ্টের সময় মায়ের কথা মনে পড়ে; কিমুত আমার মনে যখন কোন কষ্ট তোলপাড় করে তখন আম্মুকে মনে পড়ে না, মনে পড়ে আমার দাদুকে। দাদুর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ছিলোই কষ্টের। তাই কষ্টের সময়, চোখের পাতা ভিজে ওঠার সময় দাদুকেই মনে পড়তো, আম্মুকে মনে পড়তো না। এখনো দাদুকেই মনে পড়ে, আম্মুকে মনে পড়ে না।

আমার একজন আম্মু ছিলেন, জেনেছি অনেক পরে। কাঁদলে আদর করার জন্য, হাসলে চুমু খাওয়ার জন্য ছোটদের একজন আম্মু থাকেন, এটা বোঝার যখন বয়স হলো তখন একদিন শুনি, আমার আম্মু আসছেন! কী যে খুশী হলাম!

অনেক ধূমধাম হলো, আনন্দ-কোলাহল হলো, বাড়ীঘর কত রকম করে সাজানো হলো! এমন আলোকসজ্জা হলো যে, পুরো গ্রাম অবাক ! আমি বলতাম, আমার আম্মু আসবেন যে! কেউ মুচকি হাসতো, কেউ বলতো আহারে!

আম্মু এলেন, আমি দৌড়ে গেলাম, কিন্তু না পেলাম আদর, না পেলাম চুমু! যা পেলাম তার জন্য বাংলাভাষায় কোমল কোন শব্দ নেই। ভাবলাম, আম্মু ছিলেন না সেই তো ভালো ছিলো! সবার আম্মু একরকম, আমার আম্মু অন্য রকম কেন! কেউ বুঝিয়ে দেয়নি, নিজে থেকেই বুঝে নিয়েছিলাম, যে আম্মু আগে থেকেই থাকেন তিনি একরকম, আর যে আম্মু পরে আসেন তিনি অন্যরকম! আমার তখন খুব কষ্ট হতো। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদতাম! কেউ দেখতো না, জানতো না। দাদু  কিন্ততু বুঝতেন! বুকের সঙ্গে চেপে ধরে জানতে চাইতেন, চোখ ফোলা কেন রে! কাঁদছিলি বুঝি! মাকে মনে পড়ছে?

নতুন মা আসার পর একদিন দাদুর কাছেই জেনেছিলাম, আমার আম্মু ছিলেন। আসল আম্মু! সবার আম্মুরা যেমন তেমন আম্মু! আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এখন আম্মু নেই কেন? কোথায় আমার আম্মু?! দাদু বলেছিলেন, তোমার আম্মু আল্লাহর কাছে চলে গিয়েছে।

আমার ভিতরে কেমন একটা কষ্ট যেন গুমরে উঠলো। মুখে কিছু বললাম না, শুধু ভাবলাম, আমাকে ফেলে আম্মু চলে গেলো আল্লাহর কাছে!! আম্মু বুঝি জানতো না, আমার কষ্ট হবে! কারো আম্মু তো যায়নি আল্লাহর কাছে, আমার আম্মু গেলো কেন?

তখন ভেবেছিলাম, আম্মু হয়ত আমাকে ভালোবাসতো না।

আরো পরে একদিন দাদুকে জিজ্ঞাসা করলাম, আম্মু কীভাবে মারা গেলেন? দাদু মুখ ফসকে বলে ফেললেন কথাটা, আর বলেই জিহবায় কামড় দিলেন। একথা, সেকথা বলে আমাকে ভুলিয়ে রাখতে চাইলেন। দাদু বললেন, তুই-ই তো মেরে ফেললি তোর মাকে!

আমার ছোট্ট বুকে ছুরির মত বিঁধলো কথাটা! আমি চিৎকার করে উঠলাম, মেরে ফেলেছি! আমি! কিভাবে! 

সেদিন জানলাম, আমার জন্মের সময় ভীষণ কষ্ট হয়েছিলো আম্মুর। আমার চোখে যখন আলো ফুটেছিলো তখন আমার মায়ের দু'চোখে চিরকালের মত অন্ধকার নেমে এসেছিলো।

তখন থেকে নিজেকে বড় অপরাধী মনে হতো। যখন দেখতাম, কারো আম্মু তাকে আদর করছেন তখনই মনে পড়ে যেতো, আমার আম্মুকে আমি মেরে ফেলেছি!  আর মনে পড়তো যখন নতুন আম্মু কারণে অকারণে বকা দিতেন। ভাবতাম বকা দেবেই তো! আমি যে আমার আম্মুকে মেরে ফেলেছি!

পরে ধীরে ধীরে সবকিছু জেনেছি। যখন আম্মুর প্রসবব্যথা উঠলো, আম্মুকে হাসপাতালে নেয়া হয়নি। দাদু নাকি আববুকে অনেক করে বলেছিলেন, অবস্থা ভালো নারে, হাসপাতালে নিয়ে যা।

আববা গুরুত্ব দেননি। দেবেন কেন, প্রসবব্যথাটা তো তার ছিলো না, আম্মুর ছিলো। সন্তানের প্রসবব্যথা অর্ধেক যদি মায়ের হতো, অর্ধেক হতো বাবার, তাহলে কেমন হতো!

যখন অবস্থা একেবারে মরণাপন্ন তখন আম্মুর ভাগ্যে হাসপাতালের বিছানা জুটলো। ডাক্তার আববুকে ধমক দিয়ে বললেন, এত দেরী করেছেন কেন?

ডাক্তার সাধ্যমত চেষ্টা করলেন, নিষ্ফল চেষ্টা। তারপর জানিয়ে দিলেন একজনকে বাঁচাতে হবে, হয় মাকে না হয় সন্তানকে। সিদ্ধান্ত আববুর হাতে! এবং আববু মুহূর্ত বিলম্ব না করে সিদ্ধান্ত দিলেন, আমার ছেলে চাই!

সবই দাদুর কাছে শোনা। সেদিন মনে হলো, আববুকে আমি চিনি না। এখনো মনে হয়, আববুকে আমি চিনতাম না।

দাদু নাকি আববুকে তিরস্কার করে বলেছিলেন, কেমন পাষাইণ্যা কথা কও। আগে বউমারে ‘বাচাও’। আল্লায় দিলে পোলা আরো হইব। গাছ ‘বাচাও’, ফল পাইবা।

সেদিন ভাবলাম, এজন্যই কি দাদুকে আমার এত ভালো লাগে! আজো ভাবি, এজন্যই কি দাদুকে আমার এত ভালো লাগতো!

যে মহিলাডাক্তার অপারেশন করেছিলেন, তিনি বলেছেন, তোমার আম্মু আমার হাত ধরে অনুনয় করেছিলেন, ডাক্তার, আমার সন্তান না বাঁচলে তো আমি বাঁচবো না, আমার কথা চিন্তা করবেন না, যেভাবে হোক আমার সন্তানকে বাঁচান।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কী করেছিলেন ডাক্তার? তিনি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আমি চেষ্টা করেছিলাম দু’জনকেই বাঁচাতে। কিন্তু তোমার আম্মুর হায়াত ছিলো না। চারদিন পর আমার সকল চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন। তোমার আম্মুকে আমি কখনো ভোলবো না, মৃত্যুর কয়েক মুহূর্ত আগে তিনি বলেছিলেন, আমার সন্তানকে আমার কোলে দেন ডাক্তার!

তোমার আম্মুর মুখে তখন মৃত্যুর কালো ছায়া, কিমুত তোমাকে কোলে নিয়ে তিনি মৃত্যুযন্ত্রণা ভুলে গেলেন। তার যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখে সেই আশ্চর্য প্রশান্তির হাসিটি এখনো আমার চোখে ভাসে। তুমি কি তোমার আম্মুর জন্য দু‘আ করো? তোমার আম্মু সেই দুর্ভাগিনীদের একজন যারা মাতৃত্বের যন্ত্রণা ভোগ করে, কিন্তু বিধাতা তাদের মাতৃত্বের আনন্দ ভোগ করার অবসর দেন না। বিধাতার তখন কিসের যেন তাড়া থাকে!

নতুন আম্মু আসার পর দাদু যেন আমার আরো আপন হয়ে উঠলেন। আমিও দাদুর অাঁচলের ভিতরে আশ্রয় নিলাম, দাদুর অাঁচলই ছিলো আমার মায়ের অাঁচল, দাদুর বুকই ছিলো আমার মায়ের বুক। রাতে দাদুর খাটে শুতাম। সারা দিনের কষ্টের কথা দাদুকেই বলতাম; দাদুকেই রাতের স্বপ্ন শোনাতাম। দাদু যখন মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন, মনে হতো, হয়ত এমনই ছিলো আমার আম্মুর হাত। দাদু যখন আমাকে বুকে চেপে ধরতেন, আর কচি কচি দু’টি হাতে শক্তভাবে দাদুকে আমি আকড়ে ধরতে চাইতাম, মনে হতো, হয়ত এমনই ছিলো আমার আম্মুর বুক।

অসুস্থ হলে দাদু অস্থির হয়ে পড়তেন। আববু একবার দেখে যেতেন, যাওয়ার আগে বলতেন, অষুধ খেতে থাকো, ভালো হয়ে যাবে।

দাদু সারা রাত জেগে থাকতেন, দাদুর মুখটা খুব করুণ দেখাতো, আমার মনে হতো, হয়ত এমনই ছিলো আম্মুর মুখ।

একদিন খেলার মাঠ থেকে মার খেয়ে ফিরেছি, কেউ বুঝতে পারেনি, দাদু আড়ালে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হয়েছে রে ভাই? খেলতে গিয়ে মার খেয়েছিস! যাস কেন দুষ্টদের সাথে খেলতে! আয় দেখি তো কোথায় লেগেছে!

আমার যে ক্ষুধা পেয়েছে, নতুন মা প্রায় ভুলে যেতেন! দাদু দেখেই বুঝতেন, মাথায় হাত রেখে বলতেন, মুখটা অত শুকনো কেন রে, ভাত খাসনি, আমার খাবার পড়ে আছে, আয় খেয়ে নে! তখন মনে হতো, হয়ত এমনই ছিলো আমার আম্মুর কথা! এভাবে সকালে, সন্ধ্যায়, কষ্টে, ক্ষুধায় দাদুই হয়ে উঠেছিলেন আমার আম্মু! একদিন জ্বরের ঘোরে, দাদুকে বলেছিলাম, তুমি আমাকে ভাই বলো কেন! আমি কি তোমার ভাই! আমি তো তোমার বাবা! ঐ যে নূরুকে ওর আম্মু বাবা বলে ডাকে! তুমি আমাকে বাবা বলতে পারো না!

সেদিন দাদুর চোখে পানি দেখেছি, দাদু বলেছিলেন, তুই আমার চান, তুই আমার কলিজার টুকরা!

শেষদিকে দাদু বারবার বলতেন, আমার পরে কে তোকে দেখবে রে!

আমি ধমক দিয়ে বলতাম, ধ্যত! তুমি মরবে কেন! আমি কি তোমাকেও মেরে ফেলবো!

আমি ভাবতাম, দাদু এত মিথ্যে বলে কেন! কিন্তু দাদুর কথাই

 

সত্য হয়ে গেলো। আমি দাদুকে মেরে ফেলিনি; দাদু নিজেই মরে গেলেন। দাদুর সঙ্গেই ঘুমিয়ে ছিলাম। কত আদর করে দাদু সেদিন কত কথা বললেন! আম্মুর কথা বললেন, আম্মু কত ভালো ছিলেন! দাদুকে মা বলে ডাকতেন। দাদুর মেয়ে  ছিলো না, আম্মুকে দাদু নিজের মেয়ে ভেবেছিলেন। দাদু আম্মুর চুল বেঁধে দিতেন। আরো অনেক কথা বলেছিলেন দাদু।

দাদু আমাকে ঘুম পাড়িয়ে তবে ঘুমুতেন; সেদিন আগেই ঘুমিয়ে গেলেন। আমার মনে হলো, আজ দাদুকে আমি ঘুম পাড়িয়েছি। অনেক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম দাদুর ঘুমন্ত মুখের দিকে। খুব সুন্দর লাগছিলো দাদুকে। আম্মু যখন ঘুমোতেন, আম্মুকে হয়ত এমনই সুন্দর দেখাতো।

সে রাতে অদ্ভুদ এক স্বপ্ন দেখলাম, ধবধবে সাদা কাপড় পরা এক নারী, আমার খুব কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন, আর বললেন, আমাকে চিনতে পেরেছো খোকা! আমি তোমার আম্মু! তোমার দাদুকে নিয়ে যেতে এসেছি। তোমার খুব কষ্ট হবে দাদুকে ছেড়া থাকতে? আমি বললাম, হাঁ, খুব কষ্ট হবে। আম্মু বললেন, আমার যে একা একা আর ভালো লাগে না! আমি তাড়াতাড়ি বললাম, তাহলে দাদুকে নিয়ে যান, আমার কষ্ট হবে না।

আম্মু চলে গেলেন, আর তখনই ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। দাদুকে স্বপ্নটি বলার জন্য হাত ধরে ডাকলাম। দাদুর ঘুম ভাঙ্গলো না। আরো জোরে ডাকলাম এবং হাত ধরে টান দিলাম; দাদুর সাড়া নেই। আমার তখন ভীষণ ভয় পেলো। আমি দাদুগো, বলে চিৎকার করে উঠলাম। আববু দৌড়ে এলেন। দাদুর শান্তির ঘুম আর ভাঙ্গলো না। আম্মু দাদুকে নিয়ে গেলেন। আমি কাঁদলাম না, থাক, আম্মুর একা থাকতে খারাপ লাগে; দাদু আম্মুর কাছেই থাক।

***

আমার মনে যখন খুব কষ্ট হয় তখন দাদুকে মনে পড়ে। আম্মুর মুখের ছবি আমার মনের আয়নায় কখনো ভাসে না। আম্মুর কথা ভাবলেও ভেসে ওঠে দাদুর মুখ। দাদুকে যখন মনে পড়ে, দাদুর কবরের কাছে গিয়ে দাঁড়াই। দাদুর জন্য দু‘আ করি, আম্মুর জন্যও দু‘আ করি। আমার কষ্টগুলো তখন গলে গলে চোখের পানি হয়ে বের হয়ে আসে। আমার খুব শান্তি লাগে। দাদুকে আমার দেখতে বড় ইচ্ছে করে। স্বপ্নে আম্মুকে দেখি, দাদুকে দেখতে পাই না। দাদুকে পেয়ে আম্মু খুব হাসিখুশি! আমার খুব ভালো লাগে।

দাদুর মৃত্যু হয়েছে কত বছর হলো! বিশ বছরের বেশী। আমি এখন অনেক বড়। দাদুর মৃত্যুর সময় আমার যে বয়স ছিলো, আমার ছেলের এখন সেই বয়স। আমার ছেলের মা আছে দাদু নেই, আমার দাদু ছিলো, মা ছিলো না। আমার ছেলে যখন জানতে চায়, তোমার দাদু কেমন ছিলো আববু! আমি আকাশের চাঁদটাকে দেখিয়ে বলি, ঐ যে অমন ছিলো! সে জানতে চায়, আমার দাদু নেই কেন আববু! আমার মুখ থেকে বের হয়ে আসতে চায়, তোমার দাদুকে যে আমি মেরে ফেলেছি! কিন্তু বলি না, নিজেকে সংযত করে ফেলি।

দাদুর কবরে একটি ডালিম গাছ লাগিয়েছিলাম। এখন তা বড় হয়েছে। দাদুর কবরে এখন ডালিম গাছের ছায়া থাকে। জোসনা রাতে দূর থেকে দাদুর কবরের দিকে তাকিয়ে থাকি। ফকফকে জোসনায় দাদুর কবরকে আমার খুব ভালো লাগে। আমি গুন গুন  করে গেয়ে ওঠি- ঐখানে মোর দাদির কবর ডালিম গাছের তলে/ ত্রিশ বছর ধরে ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা