শাবান ১৪৩১হিঃ (১৭)

তোমাদের জন্য

চন্দ্রবিন্দুসমাচার, প্রসঙ্গ-ব

লিখেছেনঃ ইবনে মিছবাহ

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট
চন্দ্রবিন্দুটা কিন' আমাদের বাঁচা-মরার প্রশ্ন। কেন? কারণ খোদ ‘বাঁচা'তেই আছে চন্দ্রবিন্দু। সুতরাং বাঁচতে হলে চন্দ্রবিন্দু তোমাকে দিতেই হবে, যদি ভুল করো তাহলে মরার প্রশ্ন আসতেই পারে। শুধু বাঁচা ও মরার প্রশ্নই না, চন্দ্রবিন্দু আসলে আমাদের আবরু-ইজ্জতেরও প্রশ্ন। কেন? কারণ কলকাতার নাক-উঁচু বাবুরা বলেন, ‘মুচলমান’দের নাকে গোশত নয়, মাংস বেশী, তাই তারা চন্দ্রবিন্দু উচ্চারণ করতে পারে না। বলো দেখি, মশায়দের এ কেমন গায়ে জ্বালা ধরানো মন-ব্য! ঘটনা আরো আছে। রবিবাবুসহ কলকাতার বাবুসমাজ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’-এর প্রবল বিরোধী ছিলেন, কিন' পেরে উঠেননি। পূর্ববাংলার ‘চাষাভূষা’ মুসলমান-দের দাবীর মুখে শেষ পর্যন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। কিন' কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মত এখানেও ছিলো হিন্দু শিক্ষকদের একচ্ছত্র প্রভাব। কবি মোহিতলাল মজুমদার তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাবিভাগে। আমাদের পল্লীকবি জসীমুদ্দীন একদিন গেলেন মুহিতবাবুর বাসায় দেখা করতে। তিনি তখন কাঁচিহাতে বাগান-পরিচর্যা করছেন। পল্লীকবি বললেন, দাদা কাঁচিটা দিন, আমি ছেঁটে দিই। মোহিতবাবু কাঁচিটা দিলেন না, আর না দেয়ার কারণটাও বলে দিলেন মুখের উপর। পল্লীকবির ‘অপরাধ’, কাঁচির চন্দ্রবিন্দুটা নাকি ঠিক মত নাকে আসেনি। মোহিতবাবুর ভাষায় ‘এমন বর্বরের হাতে গোলাপগাছের পরিচর্যার ভার অর্পণ করা অসঙ্গত।’ আমার বিবেচনায় অবশ্য ‘দাদা-তোষণের’ এরকম নগদপ্রাপ্তি অসঙ্গত নয়। বলছিলাম, চন্দ্রবিন্দুটা আমাদের বাঁচা-মরার প্রশ্ন যেমন তেমনি ইজ্জত-আবরুরও সোয়াল। সুতরাং এ বিষয়ে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। তো আলোচনাটা কী দিয়ে শুরু করি! বাঁশ দিয়ে, না বাঁশী দিয়ে? যুক্তির দাবী অবশ্য বাঁশ। কারণ বাঁশই তো বাঁশীর মূল। কিন' মুশকিল হলো, ‘বাঁশভীতি’ আমার সেই ছোটকাল থেকে। কারণ নর্দমায় পড়েছিলাম বাঁশের সাঁকো পার হতে গিয়েই । আর এখন তো আদালত থেকে আমজনতা সবাইকে দেখতে হচ্ছে বাঁশের লাঠির ‘খেল’। তাই বাঁশ ছেড়ে বাঁশী দিয়েই শরু করি। আগে পল্লীগাঁয়ে নির্জন দুপুরে এবং গভীর রাতে শুনতে পেতাম রাখাল ছেলের বাঁশীর সুর। এখনো মনে হলে মন কেমন করে। বাঁশীর সুর কখনো যদি বেসুরো লাগে, বুঝতে হবে, বেচারা চন্দ্রবিন্দু দেয়নি। বাঁশঝাড় দেখেছি শৈশবে নানীর বাড়ী, দাদার বাড়ীতে, তখন চন্দ্র-বিন্দুর কথা জানা ছিলো না। জানলাম যখন ‘বাঁশবাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠলো, অথচ শ্লোক বলা কাজলা দিদিকে পাওয়া গেলো না!’ দাদা বললেন, ‘বাঁশবাগানের মাথার উপর যে চাঁদ, তাতে যেমন চন্দ্রবিন্দু আছে, তেমনি আছে স্বয়ং বাঁশের মাথার উপর। মানুষ বানরের বংশধর, কথাটা মিথ্যা, তবে বাঁদরামিতে মানুষ বানরকে ছাড়িয়ে গেছে, কথাটা মিথ্যা নয়। বানরে চন্দ্রবিন্দু নেই, তবে বাঁদর ও বাঁদরামি, দু'টোতেই পরিষ্কার চন্দ্রবিন্দু আছে। বাক্য-তে চন্দ্রবিন্দু নেই, সুতরাং বাকশক্তি বা বাকস্বাধীনতায় থাকার কথা নয়। কিন' রাস-াটা বা নদীটা যখন একদিকে ‘বাঁক’ নেয় তখন চন্দ্রবিন্দুটা ভুলে গেলে চলবে না। কারণ মূল সংস্কৃত শব্দটি হলে ‘বঙ্ক’। কোথায় যেন পড়েছি, ‘মোরগে বাঁক দিলো, আর ভোর হলো’। তো মোরগের বাঁক, তাতে চন্দ্রবিন্দু আছে, যেমন আছে মোরগের মাথার ঝুঁটিতে! বাঁকা, মানে বক্র, তাতে চন্দ্রবিন্দু না দিলে কলকাতার বাবুরা কিন' বাঁকা চোখে তাকাবেন, আর বাঁকা কথা শোনাবেন। বাবুদের কথা থাক, ব্যাকরণও যে বেঁকে বসবে তাতে! কারণ বাঁকা-এর সাধুরূপ হলো বঙ্কিম। সুতরাং বঙ্কিম বাবুকে খুশী রাখতে হলে চন্দ্রবিন্দু দিতেই হবে। ভাগবাঁটোয়ারা করতে কেউ চন্দ্রবিন্দু দেয়, কেউ দেয় না। কোনটা ঠিক, আমি বলবো না, শুধু স্মরণ করিয়ে দেবো যে, মূল হচ্ছে ভাগবণ্টন। ছুরির বাঁট, ছাতার বাঁট এবং গাভীর ওলানের বাঁট, সব বাঁটে একটা করে চন্দ্রবিন্দু। কারণ মূল সংস্কৃত শব্দটি হচ্ছে বণ্ট। বাম হাতকে যখন বলি ‘বাঁ’ হাত তখন বাম-এর ‘ম’টাই আসলে চন্দ্রবিন্দু হয়ে ‘ব’-এর মাথায় গিয়ে বসে। ক্রিকেটে বাঁ-হাতি বোলারের অত তেজ তো ঐ চন্দ্রবিন্দুর কারণেই। বামদিক ও বাঁদিকের ঘটনাটাও একই। রাস-াটা কিছু দূর গিয়ে বাঁয়ে মোড় নিয়েছে, কিন' প্রশ্ন হলো, চন্দ্রবিন্দুসহ, না চন্দ্রবিন্দু ছাড়া। চন্দ্রবিন্দু ছাড়া ডানে মোড় নিতে পারে, বাঁয়ে নয়। দাসী-বাঁদীতে চন্দ্রবিন্দু কেন? কারণ মূল ফারসিটা হলো ‘বান্দী’। এখানে আসলে ‘ন’টাই জায়গা ছেড়ে চন্দ্রবিন্দু সেজে ‘ব’-এর মাথায় গিয়ে বসেছে। নদীতে বাঁধ দিতে হয় চন্দ্রবিন্দু দিয়ে, তাতে বাঁধ ভাঙ্গার আশঙ্কা থাকে না। ফারাক্কা বাঁধে বাবুরা ঠেসে চন্দ্রবিন্দু দিয়েছেন বলেই তো এদিকে একফোঁটা পানি আসার জো নেই! প্রতিবন্ধক অর্থে যে বাধা তাতে চন্দ্রবিন্দু নেই, বন্ধন অর্থে যে বাঁধা তাতে চন্দ্রবিন্দু আছে। যেমন ‘ভালোকাজে বাধা দিতে নেই।’ দড়ি দিয়ে বাঁধা, ঘর বাঁধা, খোঁপা বাঁধা, জোট বাঁধা, আন্দোলন দানা বাঁধা। বাঁধা খরিদ্দার, বাঁধা মাইনে, ধরাবাঁধা নিয়ম। বই বাঁধানো, ছবি বাঁধানো, দাঁত বাঁধানো। বাঁধন ছিন্ন করা। স্নেহের বাঁধনে বেঁধেছি তাকে। রান্নাঘরের বঁটি ধারালো না হলে চলে না, অথচ চন্দ্রবিন্দু ছাড়া বেশীক্ষণ বঁটির ধার থাকে না; পরীক্ষা করে দেখতে পারো। পুকুরে বঁড়শি ফেলো বা বড়শি মাছ ধরা পড়বে একই রকম, শুধু টোপটাা গাঁথতে হবে ঠিকমত, আর টান দিতে হবে সময়মত। বামন হয়ে চাঁদে হাত দিতে যাওয়া যদি ঠিক না হয়, তাহলে চাঁদের চন্দ্রবিন্দু বামনের মাথায় দিতে যাওয়া কি ঠিক? অথচ এ অন্যায় কর্মটা অনেকেই করে। বামন, আর বেঁটে কাছাকাছি হলেও চন্দ্রবিন্দু শুধু দ্বিতীয়টিতে। কাঁটাতে চন্দ্রবিন্দু আছে? তাহলে কাঁটা বিঁধতে চন্দ্রবিন্দু লাগবে। উপন্যাসের একটি সংলাপ শোনো, নায়ককে তার বন্ধু বলছে, ‘সে অমন করে বিঁধিয়ে বিঁধিয়ে কথা বললো, তোমার যে মনে হলো একটুও বিঁধেনি! নায়কের উত্তর, ঠিকই বলেছো, একটুও বিঁধেনি, কারণ তাতে চন্দ্রবিন্দু ছিলো না। একজন লিখেছেন, দীর্ঘ একমাস গোটা পৃথিবী যেন ফুটবলের নেশায় ‘বুদ’ হয়েছিলো। ‘ব’-এর মাথা থেকে চন্দ্রবিন্দুটা যদি নিজে নিজেই পড়ে গিয়ে থাকে তাহলে সমস্যা নেই, আমি তুলে দেবো, কিন' লেখক যদি সজ্ঞানে ফেলে দিয়ে থাকেন তাহলে বলতেই হয়, বড্ড অন্যায় করেছেন। সম্ভবত তার নিজের নেশাটা ভালো করে জমেনি। কী বললে, তোমার মাথাটা বো বো করে ঘুরছে! চন্দ্রবিন্দু ছাড়া! ধ্যত! গাঁটরি-বোঁচকা দু'টোতেই চন্দ্রবিন্দু থাকা ভালো, কেউ কেউ অবশ্য বোচকাটা হালকা রাখার পক্ষপাতী। বোঁচকা-বুচকিতে অবশ্য সেটাই নিয়ম। বোঁটা মানে বৃন-। পানের বোঁটা, ফলের বোঁটা, ফুলের বোঁটা। আবার বোঁটা মানে স-নের অগ্রভাগ। চন্দ্রবিন্দু আছে। চলো, এবার আমরা যাই চাঁদের দেশে!
শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা