রবিউল আউয়াল ১৪৪০হিঃ (৩/৭)

প্রথম পাতা

সম্পাদকীয়

আমাদের মর্যাদা খেদমতে খালক ও মানবতার সেবায়

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অত্যন্ত বেদনাদগ্ধ হৃদয়ে আজ এই গভীর রাতে লিখতে বসেছি কাছের এবং দূরের জানা অজানা সেই মানুষগুলোর কথা স্মরণ করে, যারা এখন ক্ষুধায় অনাহারে অস্থির, অথচ একলোকমা খাবার তাদের মুখে তুলে দেয়ার কেউ নেই!

আমি লিখতে বসেছি সেই বনী আদমগুলোর কথা স্মরণ করে, এই মানুষের পৃথিবীতে কোথাও না কোথাও যারা এখন কোন না কোন বিপদে দুর্যোগে বিপর্যস্ত, অথচ কেউ নেই তাদের পাশে দাঁড়াবার, একটু সান্ত¡না ও সমবেদনা জানাবার!

আমি লিখতে বসেছি সেই কঙ্কালসার শিশুদের কথা স্মরণ করে, যাদের অসহায় মায়েরা নিজেদের কথা ভুলে গিয়ে সন্তানের কান্নায় অস্থির হয়ে তাকিয়ে আছে আসমানের দিকে এই ফরিয়াদ নিয়ে, যমিনের বসিন্দারা তো আমাদের ভুলে গিয়েছে, তারা তো ‘পূর্ণ উদরে’ ঘুমিয়ে আছে তৃপ্তির ঘুম! তোমার তো নিদ্রা-তন্দ্রা কিছু নেই হে আসমানের বাসিন্দা! তুমি তো সবার রিযিকদাতা হে আল্লাহ! আমার এই জীর্ণ শীর্ণ সন্তানটির জন্য একটুকরো রুটির কোন উপায় কি হতে পারে না হে আল্লাহ! হে রাহীম, রাহমান!

আমি জেগে আছি; চোখে আমার ঘুম নেই! মনে আমার শান্তি নেই এবং দিলের মধ্যে নেই সুকূন ও ইতমিনান! না, আমার ক্ষুধা-অনাহারের কষ্ট নেই; দয়াময়ের দয়ায় কখনো ছিলো না! বিপদ-পেরেশানি, আল্লাহর মেহেরবানি, তাও নেই! অন্তত এমন কোন বিপদ পেরেশানি তো নেই যা চোখের ঘুম কেড়ে নেয়! আমার আজকের পেরেশানি ও অস্থিরতার কারণ এই যে, দূর হিন্দুস্তান থেকে আমার প্রিয় ছাত্র আমাকে স্মরণ করে, আমাকে ভালোবেসে এবং হয়ত আমাকে কল্যাণের দিকে পথ দেখাতে একটি অমূল্য কিতাব হাদিয়া পাঠিয়েছে, ‘খিদমতে খালক’!

কিতাব তো নয়, যেন একটি চাবুক! একটি করে ঘটনা পড়ি, একটি করে হাদীছ দেখি, আর পিঠের উপর একটি করে চাবুক যেন পড়ে! এমন তো নয় যে, এ হাদীছ আগে পড়িনি, ‘সমস্ত মাখলূক আল্লাহর পরিবারভুক্ত। সুতরাং যে আল্লাহর পরিবারের প্রতি সদয় হবে সে-ই আল্লাহর অধিক প্রিয় হবে’!

এমন তো নয় যে, এ হাদীছ আগে শুনিনি, ‘যারা যমীনে আছে তাদের প্রতি সদয় হও, যিনি আসমানে আছেন তিনি তোমাদের প্রতি সদয় হবেন’!

এমন তো নয় যে, যবানে নবুয়তের এ হুঁশিয়ারি আর কখনো আমার সামনে উচ্চারিত হয়নি, ‘যে উদরপূর্তি করে ঘুমোলো অথচ তার প্রতিবেশী থাকলো ক্ষুধার্ত ... ’!

কিন্তু আজকের সবকিছু যেন অন্যরকম হলো! প্রতিটি হাদীছ যেন চাবুকের আঘাত হয়ে আমার উপর বর্ষিত হলো, আর আমার অন্তরাত্মা যেন আর্তনাদ করে উঠলো, আমাকে উদ্ধার করো হে আল্লাহ! আমাকে সাহায্য করো হে আল্লাহ! তোমার দুঃখী বান্দাদের কাছে যাওয়ার, পাশে দাঁড়াবার তাওফীক দাও হে আল্লাহ!!

প্রিয় পাঠক, অনেকবারের মত এবারও এমন হলো, হৃদয় যখন ব্যাকুল হলো, দিল যখন বে-কারার হলো, তোমাকে মনে পড়লো! ইচ্ছে হলো, তোমাকেও শামিল করি আমার হৃদয়ের ব্যাকুলতায় এবং দিলের অস্থিরতায়।

***

আচ্ছ, বলো তো, আমার বহু দিনের স্বপ্ন ‘খিদমতে খালক’ একটি সুন্দর বাস্তব হয়ে আজ যখন আত্মপ্রকাশ করলো, আর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈয়ার হয়ে আমার কাছে এলো ঠিক তখন সুদূর হিন্দুস্তান থেকে কেন এই কিতাবটি আমার হাতে এলো!! কেন আজ এই নির্জন রাতে আমার দিলের যখম নতুন করে তাজা হলো? আর কেন প্রিয় পাঠক, বলো তো কেন তোমাকে আমার মনে পড়লো? আমি কি ভাবতে পারি না, তুমি কি ভাবতে পারো না, এতে রয়েছে আসমানের পক্ষ হতে কবূলিয়াতের ইশারা! আমার জন্য, তোমার জন্য, খিদমতে খালকের দাওয়াতে যারা লাব্বাইক বলবে তাদের সবার জন্য! আল্লাহ যেন তাই করেন, আমীন।

***

খিদমতে খালক, আর্তমানবতার সেবা, একসময় এটাই তো ছিলো আমাদের জীবনের সবচে’ উজ্জ্বল, সবচে’ গৌরবপূর্ণ অধ্যায়; এর মাধ্যমেই জগতের বুকে আমরা অর্জন করেছিলাম ইজ্জতের যিন্দেগী ও মর্যাদার জীবন! স্বয়ং আল্লাহর পেয়ারা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সারা জীবনের আচরণ দিয়ে, উচ্চারণ দিয়ে আমাদের সামনে রেখে গিয়েছেন খিদমতে খালক ও মানবসেবার এ উজ্জ্বল আদর্শ! অথচ কীভাবে যেন ধীরে ধীরে আমরা তা ভুলে গেলাম! খিদমতে খালক ও মানবসেবার নববী আদর্শ আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গেলো! আর আমরা যিল্লত ও লাঞ্ছনার শিকার হলাম!

মনে পড়ে, আজ থেকে সত্তর বছর আগে এ দেশেরই একজন দরদী মানুষ, বড় ব্যথা নিয়ে তার গাফেল কাউমকে ডাক দিয়েছিলেন এই বলে, ‘আমি আমার মুসলমান ভাইদেরে সাধারণভাবে এবং ওলামা ভাইদেরে খাসভাবে বলিতেছি- আপনারা খেদমত করেন, আখলাক-চরিত্র উন্নত করেন, দেখিবেন, আপনাদেরও ইযযত ফিরিয়া আসিবে। ...’

‘খেদমতে খালকের জাযবা আবার যেদিন আলেম সমাজ এবং মুসলিম নেতৃসমাজে জাগিবে সেই দিন আবার মুসলিম জাতির উন্নতি ও মর্যাদা দুনিয়াতে প্রতিষ্ঠিত হইবে। ... ’

(মুজাহিদে আ‘যম আল্লামা শামসুল হক রহ. গ্রন্থাবলী, পৃ. ১২০-২১)

***

প্রিয় পাঠক, এখানে বোধহয় আমাদের কর্তব্য হবে প্রথম অহী অবতরণের সময়কালটি স্মরণ করা। বুখারী শরীফের বর্ণনায় আমরা সবাই পড়েছি; জাবালে নূরের হেরা গুহায় প্রথম অহী যখন নাযিল হলো, আমাদের পেয়ারা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অত্যন্ত উৎকণ্ঠা ও পেরেশানির অবস্থায় আম্মাজান হযরত খাদীজা রা.-এর নিকট ছুটে এলেন!

ঘটনা শুনে জ্ঞানবতী ও প্রজ্ঞাবতী আমাদের মা  হযরত খাদীজা রা. নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সান্ত¡না দিয়ে বললেন, ‘কিছুতেই না, আল্লাহর কসম, আল্লাহ আপনাকে কিছুতেই অপদস্থ করবেন না।’

কেন?! কী তাঁর কামাল ও ফযীলত? কিসে তাঁর এমন মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য?! তিনি দিনের পর দিন হেরা গুহায় ধ্যানমগ্ন থাকেন, এজন্য? দুনিয়ার কোন কিছুর সঙ্গে তাঁর কোন সম্পর্ক নেই, পরকাল ছাড়া কোন চিন্তা নেই, এজন্য?

না। কারণ এই যে, ‘আপনি আত্মীয়তার হক রক্ষা করেন, (অন্যের) বোঝা বহন করেন, উপার্জনহীনের উপার্জনের ব্যবস্থা করেন এবং যামানার দুর্বিপাকে সাহায্য করেন...!

এখান থেকে ওলামায়ে উম্মত এ সিদ্ধান্ত আহরণ করেছেন যে, দুনিয়াতে ইযযত, সম্মান, মর্যাদা ও প্রিয়তা অর্জন করার পথ হলো, এককথায় খিদমতে খালক ও আর্তমানবতার সেবা।

এটাই ছিলো আমাদের পেয়ারা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নবুয়তপূর্ব ও নবুয়তপরবর্তী সারা জীবনের আদর্শ। এটাই ছিলো ছাহাবা কেরামের জীবনের সর্ব-উজ্জ্বল দিক। পরবর্তী যুগেও খেদমতে খালকই ছিলো উলামায়ের উম্মতের পরিচয়বৈশিষ্ট্য। সমাজের অভাবগ্রস্ত ও বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে তাঁরাই সবার আগে দাঁড়াতেন! আমাদের মহান আকাবিরীনের জীবনে এধরণের ঘটনা এত অসংখ্য যে, সংক্ষেপে তার বিবরণ দিতে গেলেও বড় দফতর হয়ে যাবে। সর্বোপরি এ বিষয়ে এত বেশী হাদীছ বর্ণিত হয়েছে যে, অন্য কোন বিষয়ে কমই বর্ণিত হয়েছে। আর এ হাদীছে কুদসী তো আমরা সবাই জানি-

কেয়ামতের দিন আল্লাহ তা‘আলা বান্দাকে বলবেন, হে আদমের বেটা, আমি অসুস্থ ছিলাম, তুমি ...! আমি তোমার কাছে খাবার চেয়েছিলাম, পানি চেয়েছিলাম, তুমি...!  

মুসলমান কেন, কাফের ও মুশরিক জাতিও যদি খেদমতে খালক ও মানবসেবার পথ গ্রহণ করে- যে উদ্দেশ্যেই হোক- তারাও দুনিয়াতে ইযযত ও মর্যাদা লাভ করবে।

হযরত আমর ইবনুল আছ রা. বলেছেন, আখেরি যামানায় নাছারাদের বড় ইয্যত ও মর্যাদা হবে, কারণ তারা খেদমতে খালক ও মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করবে এবং ...! নিজের চোখেই আমরা আজ দেখতে পাচ্ছি এ ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা ও বাস্তবতা।

***

আমাদের বড়রা বলেছেন এবং সত্য বলেছেন, খিদমতে খালক যদি ব্যক্তি পর্যায়ে করা হয়, ব্যক্তি পর্যায়ে মর্যাদা আসবে, যদি পারিবারিক বা জাতীয় পর্যায়ে করা হয়, পারিবারিক ও জাতীয় পর্যায়ে ইযযত ও মর্যাদা অর্জিত হবে।

আসুন, আজ আমরা নতুন করে শপথ করি, আমরা প্রতিটি ব্যক্তি এবং প্রতিটি পরিবার নিজ নিজ অবস্থান থেকে সাধ্যমত খেদমতে খালক ও মানবতার সেবায় নিয়োজিত থাকবো। তারপর জাতি ও উম্মাহ হিসােেখদমতে খালক ও মানবতার সেবাকে আদর্শরূপে গ্রহণ করবো। এটাই নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত, এটাই ছাহাবা কেরামের উসওয়া এবং যুগ যুগের ওলামায়ে উম্মাত ও ছুলাহায়ে উম্মতের অনুসৃত পথ, এই বিশ্বাস অন্তরে ধারণ করে জীবনের শেষ পর্যন্ত এবং যিন্দেগির আখেরি লামহা ত্যক এ পথেই আল্লাহর ইচ্ছায় ও তাওফীকে আমরা অবিচল থাকবো।

***

খেদমতে খালকের জন্য বিশাল বিশাল প্রকল্প ও পরিকল্পনার অপেক্ষায় বসে থাকার কোন প্রয়োজন নেই। প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে নিজ নিজ সাধ্যমত এটা করতে পারে। আমি যদি ঘরের খাদেম-খাদেমার সামান্য একটু খেদমতও করতে পারি; যদি একজন রিকশাওয়ালার একটু ঘামও মুছে দিতে পারি; যদি একজন দুঃখী মানুষের মুখেও একটু হাসি ফুটাতে পারি; এমনকি ... তাহলেও আল্লাহ তা‘আলা আমাকে দান করতে পারেন পুরো ইনসানিয়াতের খেদমতের আজর ও ছাওয়াব!

যদি আমরা জাতীর প্রয়োজনে জাতীয় পর্যায়ে খেদমতে খালকের ঝান্ডা হাতে পথ চলতে চাই! যদি আমরা পুরো ইনসানিয়াত এবং সমগ্র মানবতার পরিম-লে সেবা ও খেদমতের আদর্শকে বিস্তৃত করতে চাই এবং তার প্রয়োজন অনস্বীকার্য- তাহলে সেজন্য সমষ্টিগত প্রচেষ্টা এবং ইজতিমা‘ঈ মেহনতের কোন বিকল্প নেই। এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই আমরা ব্যক্তি পর্যায় হতে এখন জাতীয় পর্যায়ে কাজ করার নিয়তে একমাত্র আল্লাহর রহমতের উপর ভরসা করে খেদমতে খালক ফাউন্ডেশন-এর ভিত্তি স্থাপন করেছি। আল্লাহ কবুল করুন, মাকবূল করুন, আমীন।

প্রিয় পাঠক, যেদিন থেকে কলম হাতে নিয়েছি, প্রতিজ্ঞা করেছি, যে কোন খায়র ও কল্যাণের পথে আমি, আপনি আমরা সবাই একসঙ্গে পথ চলবো এবং ইনশাআল্লাহ একসঙ্গে জান্নাতে দাখেল হবো। তাই আমাদের এ জাতীয় পর্যায়ের খেদমতে খালকের মেহনতে আপনাকেও আন্তরিকভাবে দাওয়াত দিলাম। আসুন আমরা একসঙ্গে জান্নাতের পথে চলতে শুরু করি।

(আমার ¯হের ছাত্রদ্বয় মাওলানা ইউনুস এবং তার বড় ভাই মাওলানা ইউসুফ, আল্লাহ উভয়কে আজরে আযীম দান করুন, আমীন। সুদূর হিন্দুস্তান থেকে তাদেরই পাঠানো হাদিয়া ‘খিদমতে খালক, এক আযীম ইবাদত’ কিতাবটির ওছিলায় আজকের গভীর রাতের নির্জনতায় এ লেখাটির জন্ম! ১৪-২-৪০ হি. রাত ৩. ২৫

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা