জিলহজ্ব ১৪৪০ হিঃ (৩/৮)

শেষের পাতা

জীবনের আলোকিত পরিবর্তন! জীবনের আলোকিত প্রত্যাবর্তন!

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

সুপ্রিয়, সালাম নিন। দয়াময়ের ইচ্ছায় পুষ্পের কিছু পাপড়ি আপনার কলমের জন্য নিবেদিত হচ্ছে। সবসময় আমি বলি, পুষ্প প্রবীণ ও প্রতিষ্ঠিতদের জন্য নয়। এ উদ্যান ও তার ফুল, এ ফুল ও তার পাপড়ি শুধু শিশু কিশোর ও নবীনদের জন্য এবং তাদের জন্য, বয়সে বড় হয়েও যারা শিশু-কিশোর ও তরুণ এবং বুড়ো হয়েও যারা নবীন। আপনার কি খুব কষ্ট হচ্ছে, এখন তো কিছু সময়ের জন্য ধৈর্যের অনুরোধ করা ছাড়া কী করা যায়!

দেখা না হয়েও দেখতে পাওয়া, জানা না হয়েও জানতে পারা এবং চেনা না হয়েও চিন্তে পারা এটা শুধু এ অঙ্গনেই সম্ভব। যেখানে কলম আছে এবং কলব আছে। যে জগতে শোধ ও পরিশোধই সবকিছু, যে জগতের বাসিন্দারা দিতে চায় কম, নিতে চায় বেশী, যাদের জীবনদর্শনই হলো আমি এবং আমি ছাড়া আর কেউ না, আর কিছুই না, কাকে বলে কলম ও কলবের বন্ধন এবং কী এর দর্শন, তাদের এটা আসলেই বোঝার কথা না।

তবে স্বীকার করতেই হয়, এ অঙ্গনেও কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। এখানেও জানা ও চেনা কখনো কখনো ঠিকমত হয় না। আর দেখতে পাওয়া তো ভুল হয়, হতেই থাকে। ...

তবু জীবন চলছে জীবনের গতীতে, ওখানেও, এখানেও।

(আ, তা)

(ধারাবাহিক)

২। বুয়েটে ক্লাস শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেলো আমার ‘নেভীলাইফ’, আমার ‘সাগর-জীবন’। এ জীবনে শুধু বাধাবন্ধন -হীন স্বাধীনতা, আর স্বাধীনতা! আরাম আয়েশ আর ভোগ-উপভোগ। সংক্ষেপে যদি বলি, সেই জীবনের চিত্রটা হলো- ‘দুনিয়া কা মযা লে লো, ইয়ে দুনিয়া তুমহারি হ্যয়...!’

হাঁ ঐ স্বাধীন জীবনের একমাত্র শ্লোগান ছিলো, ‘ইয়ে দুনিয়া তুমহারি হ্যয়’। শুধু বলা হয়নি, দুনিয়ার এই জীবন একসময় শেষ হবে এবং শুরু হবে সেই জীবন যার শুরু আছে, শেষ নেই। দুনিয়ার এ জীবন মূলত সেই অনন্ত জীবনের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য। জীবনের এই যে চরম সত্য সেটা জানা যাবে না ভোগের কোন জলসায়। সে জন্য তোমাকে যেতে হবে কোন না কোন আলোকিত মানুষের মাহফিলে।

***

ছোটরা দ্রুত বড় হতে চায়। ইচ্ছেমতো জীবনের আকাশে সময়ের ঘুড়ি ওড়াবার স্বাধীনতা লাভ করার জন্য। কিশোর যুবক হতে চায় সেই অবাধ স্বাধীনতার আনন্দ-নিয়ন্ত্রণ লাভ করার জন্য। কৈশোর থেকে যৌবনে পদার্পণ করা আমি, আমার মধ্যেও সেই যুবকটি ছিলো এবং ছিলো জীবন সম্পর্কে তার আগাগোড়া বস্তুবাদী চিন্তা-চেতনা। এমনকি অবাধ স্বাধীনতাপূর্ণ জীবনের নিয়ন্ত্রণ লাভের উচ্চাভিলাষও ছিলো।

তো আমি এখন ঐ রকম চিন্তাচেতনার এক স্বাধীন যুবক। ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। চাকুরীও করি। ভোগ-উপভোগের ভেলায় ভেসে বেড়াই।

জীবনের সংযমহীন স্বাধীনতার জন্য; বে-লাগাম ভোগ উপভোগের জন্য প্রাচুযের সমর্থন লাগে। আমার জন্য তখন অর্থ আসার নিজস্ব পথ তৈরী হয়ে গিয়েছে। নিয়মিত আমার হাতে এমন অর্থ আসতে শুরু করেছে যা আমিই উপার্জন করি, আমিই ব্যয় করি। হিসাব চাওয়ার এবং হিসাব নেয়ার কেউ নেই; কেউ না!

যৌবনের তরঙ্গ-জোয়ারের এ আনন্দ-উচ্ছ্বাসে একজন প্রাজ্ঞ ও দরদী প্রহরীর উপস্থিতি কত যে গুরুত্বপূর্ণ তার সঠিক উপলব্ধি তাদেরই শুধু হতে পারে, জীবনের দিন-রাত ও সকাল-সন্ধ্যা যাদের একমাত্র আকুতি হলো, প্রতিটি যুবকের জীবনে যেন শুভ পরিবর্তনের বিপ্লব আসে এবং পরিবর্তন থেকে শুরু হয় প্রত্যাবর্তন। আমার তো আর সে অনুভূতি ছিলো না! আমি শুধু খুশী ছিলাম যে, আমার জীবনের এবং উপার্জিত অর্থের হিসাব নেয়ার কেউ ছিলো না।

ফিরে আসি আগের কথায়। পরিমাণে কম হলেও আমার হাতে অর্থ ছিলো। সুতরাং আমি ঐ জীবনের স্বাদ পেতে শুরু করলাম, যা একবার শুরু হলে নেশার মত শুধু জমাট বাঁধতেই থাকে! অক্টোপাশের মত, জীবনকে যা শুধু জড়িয়েই ধরতে থাকে।

আমার বুয়েটের ক্লাসগুলো ছিলো নামেই ক্লাস বাস্তবে শুধু ‘ফ্লাশ’! সেই ক্লাস বা ফ্লাশের পর পুরো সময়টাই ছিলো একান্তভাবেই আমার, যেখানে জীবনকে স্বাধীনভাবে ভোগ করার জন্য অখ- অবসর! ইন্টারের পর সবাই ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। একটা কঠিন সময় পাড়ি দিতে হয় তখন। জীবনের ভোগবাদ রক্ষা করার জন্যই এ কষ্টটুকু স্বীকার করতে হয়।

স্কুলজীবন থেকেই আমার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছা; কিন্তু ভর্তি হয়েছি মেডিক্যাল কোচিং-এ। জীবনের সংস্কার সংস্কৃতিতে যে সকল বৈপরীত্যের সম্মুখীন আমরা হই, আসলে তার শুরুটা হয়ে যায় তখন থেকেই। যে কাজ করা উচিত, যে পথে চলা উচিত, অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় আমাদের করতে হয় বিপরীত কাজ, কিংবা চলতে হয় বিপরীত পথে। এটা আমাদের বাইরের জীবনে যেমন ঘটে তেমনি ঘটে আমাদের ভিতরের জীবনেও।

তো বলছিলাম, প্রকৌশলী হওয়ার ইচ্ছা নিয়ে মেডিকেল কোচিং-এ ভর্তি হওয়ার কথা। তা তো হলাম, কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, সেই কোচিংও শেষ করতে পারিনি। তার আগেই কিছু অনিবার্য পরিস্থিতির কারণে চলে যেতে হলো নেভীতে। ভাবলে আজ সত্যি অবাক লাগে জীবনের কত স্বপ্ন বাস্তবে শুরুই করতে পারিনি; কত স্বপ্ন আবার শুরু করে শেষ করতে পারিনি; মাঝ পথেই হাত ঝেড়েঝুড়ে এমনভাবে সরে এসেছি যে, আর কখনো ফিরেও তাকাবার অবসর হয়নি। এরই নাম জীবন। তবে যারা ভাগ্যবান, এর ভিতর দিয়েও জীবনের পথটি তারা খুঁজে নিতে চেষ্টা করে। আমি কি তেমন ভাগ্যবান ছিলাম! হায়, ভাগ্য জিনিসটাই যে কী তাও তো জানা হলো না আজো!

আমার ব্যাচের সঙ্গীরা ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে বুয়েটে চান্স পেয়েছে। চান্স পেয়েই অবশ্য ক্লাসের ‘মুখ-দর্শন’ করতে পারেনি। এ জন্য দীর্ঘ অপেক্ষার যন্ত্রণাদায়ক সময় পার করতে হয়েছে। সবার উপরে ছিলো সেশনজটের ধাক্কা। আর সেটা যে কী ধাক্কা তা বুঝতে হলে ‘জনাব’ আপনাকে আসতে হবে সরে জমিনে!

যাই হোক, সবকিছুর পর সত্যি সত্যি যখন ক্লাস শুরু হলো তখন ‘মূর্তিমান হনুমান’ আমিও তাদের পিছনে এসে হাজির! নেভী থেকে বুয়েটের ডাইরেক্ট স্টুডেন্ট। এর মধ্যে এক বছর নেভীর অফিসার ক্যাডেট ট্রেনিং করেছি। ট্রেনিং জিনিসটাই কষ্টের। তার উপর যদি হয় সামরিক ট্রেনিং তাহলে তো কষ্টের ষোলকলাই যেন পূর্ণ হয়।

বিএমএ -তে দিনগুলো ছিল দুঃস্বপ্নের। আর রাতগুলো ছিলো দিনের চেয়ে ভয়াবহ। মনে হতো, আমার শত্রুও যেন ভুল করেও কখনো এ পথে পা না বাড়ায়।

অবশ্য সময় সবসময় একরকম কাটত না। কষ্টের সাগরে বিন্দু বিন্দু আনন্দের মত খেল-তামাশাও ছিলো কিছু কিছু। তো কয়েক ফোঁটা আনন্দের কথা বাদ দিয়ে কষ্টের সাগর থেকেই কিছু নমুনা তুলে ধরি। কখনো এমনো হতো। সারাদিনের গর্দভখাটুনির পর রাতে বিছানায় পড়েছি। হয়ত  মধ্যরাত পার হচ্ছে, আর তখনি হুইসেলের কর্ণবিদারী আওয়ায! আর হুইসেল মানে, সঙ্গে সঙ্গে ওঠো, সঙ্গে সঙ্গে ছোটো এবং সঙ্গে সঙ্গে হাজির হও। দেরী

করেছো কি মরেছো! তারপর শুরু হতো খোলামাঠে দৌড়-ঝাঁপ এবং ঝাঁপদৌড়।

তারপর একটা বিষয় ছিলো দেখতে কিছুটা নিরীহ টাইপের, কিন্তু জান নিয়ে শুরু হতো টানাটানি। সেটা হলো ঢালু ড্রেন বরাবর হাতে ভর দিয়ে এক, দুই করে একশ’ কাউন্ট করা। আশি পর্যন্ত এসে শুরু হতো চোখে সর্ষেফুল দেখা! নব্বই পর্যন্ত এসে মনে হতো, অন্তত সর্ষেফুলও যদি দেখা যেতো! পাঁচানব্ব-এর পরে যা দেখা যেতো সেটাকে ভুল করে ভাবতাম ‘মালাকুল মউত! এভাবে অদ্ভুত সব কাজে এবং আরো অদ্ভুত সব অকাজে কেটে যেত সারারাত। প্রশিক্ষক নামে ‘ভিনগ্রহের’ যে মানুষটি ছিলেন তিনি আমাদের মানুষ ছাড়া আর সবকিছু ভাবতেন এবং ঐ সব নামেই সম্বোধন করতেন যখন কোন ভুল হতো, বা পান থেকে চুন খসতো।  এরই নাম ছিলো ট্রেনিং। আনুগত্য শেখার এবং আনুগত্যে অভ্যস্ত হওয়ার ট্রেনিং। এটা চলতেই থাকত দিনের পর রাত এবং রাতের পর দিন।

তখন তো ভাবতে শিখিনি, এখন কিছুটা হলেও ভাবনায় আসে, মানুষের প্রতি মানুষের আনুগত্যের জন্য এমন নির্মম প্রশিক্ষণ! অথচ প্রাপ্তি খুব সামান্য। তাহলে যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন; আমার জীবন যাপনের জন্য ফলে ফুলে ফসলে 

এমন সুন্দর করে পৃথিবীকে যিনি  সাজিয়েছেন তাঁর প্রতি আনুগত্য নিবেদনের জন্য কোন প্রশিক্ষণ গ্রহণের কি প্রয়োজন নেই? অথচ সেখানে সামান্য পরিশ্রমের সামান্য প্রশিক্ষণ, যার প্রাপ্তি অসামান্য এবং অনন্ত!!

এখানেও একই কথা, শুরু হলো এবং এত কষ্টের শুরু, সেটাও শেষ করা হলো না। কমিশন পেতে আরও দেড়বছর ট্রেনিং বাকি ছিল। সেটি অসমাপ্তরেখেই নেভী আমাকে বুয়েটে পাঠিয়ে দিলো। ভালো হলো কি মন্দ হলো, তা বিচার করার যোগ্যতা কি আছে আমার, আমাদের?!

বন্ধুদের পেয়ে আমি বোধহয় খুশীই হলাম, আর বন্ধুরা হলো অবাক। একই ব্যাচের বন্ধুদের সঙ্গে নেভীর কোনো অফিসার বুয়েটে পড়েছে কি না, আমার জানা নেই।

এক্ষেত্রে যা হওয়ার, তা-ই হলো। আমি হয়ে উঠলাম, উসকানি দেয়ার জন্য যাকে বলা হয়, সময়ের সাহসী সন্তান। আনন্দ- উল্লাসে এবং মৌজ-ফুর্তিতে সহপাঠীদের সঙ্গে শুধু যে তাল মেলালাম, তা না। কুশলতায় এবং সৃজনশীলতায় তাদের ছাড়িয়েও গেলাম। তাই অল্প দিনের মধ্যেই হয়ে উঠলাম সবার মধ্যমণি। এসব ক্ষেত্রে তো ‘হাততালি’ দেয়ার লোকের অভাব হয় না কোনকালেই। 

প্রথম যেদিন ওল্ড একাডেমিক বিল্ডিং-এ ক্লাস করতে গেলাম, সেদিন সত্যি বোকা বনে গিয়েছিলাম। নেভী থেকে ছাড়া পেতে দিন দুয়েক দেরি হয়েছিলো। এর মধ্যে ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছে। ওল্ড একাডেমিক বিল্ডিংটার অলি-গলি এত যে, পথ হারানোরই দশা। ক্লাসরুমটা যে কোথায় খুঁজেই পাচ্ছি না। জিজ্ঞাসা করলে দয়া করে কেউ বলেও দিচ্ছে না। তাদেরও বা দোষ কী! তারা ভাবতেই পারে, এটা না জানার কৗ আছে! নিশ্চয়ই আমি তামাশা করছি! বন্ধুদের কাউকে দেখছি না। তাদের পেলে তো সঙ্গে করেই পৌঁছে যেতাম। পরে কিভাবে খুঁজে পেয়েছিলাম, এখন বলতে পারবো না।

ভার্সিটির জীবনটাই এমন  তরল আনন্দের যে, অল্প সময়ের মধ্যেই অপরিচিতরা বড় আপন হয়ে ওঠে! আর যারা আপন তারা তো হয়ে ওঠে যাকে বলে ‘জিগরি ইয়ার’। তো এই নতুন বন্ধু আর পুরোনো ইয়ারদের সঙ্গে তর তর করে কেটে যাচ্ছে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী জীবন।

এ জীবন এখন শেষের দিকে। চার বছরের কোর্স। এক-দুই করে এখন চতুর্থ বর্ষে এসে পড়েছি। এটাই সত্য যে, পড়িনি, শুধু এসে পড়েছি।

***

৩। পরিবর্তনের ছায়া পড়ে সব জায়গাতেই, ছোঁয়াও লাগে। তবে কিনা কিছু জায়গায় সেটা খুব একটা অনুভব করা যায় না, পরিবেশ ও পারিপাশির্^কতার কারণে। এটা আবার বিশেষভাবে সত্য হয়ে ধরা দেয় পরিবর্তনের প্রারম্ভ অংশে। তখন পার্থক্যটা এতই মৃদু হয় যে, বোঝাই যায় না। তাই উভয় অবস্থার মধ্যে পার্থক্যরেখা টানা খুব সহজ হয় না।

টিএসসি এরকম একটি জায়গা। দীর্ঘদিন একইরকম আছে। মানুষের আনাগোনা, চলাচল, কথাবার্তা, বাদ্য-বাজনা সব একইরকম। ভেতরে ঢুকলে লম্বা করিডোর। করিডোরের পাশ ঘেঁষে সবুজ চত্বর। খোলা আকাশ দেখার বোধহয় সবচে’ আদর্শ জায়গা! এখানে আকাশ অন্যরকম। এমনিতে মনে হতে পারে, কী আর অন্যরকম! আকাশ তো আকাশই! নীল, সাদা সাদা মেঘ, পাখীদের উড়াল!

আসলে ঠিক ঐখানটাতে বসে না দেখলে বোঝা যাবে না, কেন বলছি, ‘এখানে আকাশ অন্যরকম’। তবে হাঁ, আকাশটা অন্যরকম হওয়ার জন্য ওখানে উপরে নয়, এখানে মাটিতে একটু আয়োজনের প্রয়োজন আছে। সেটা হলো সঙ্গে একজন ‘বিপরীত সঙ্গী’ থাকা। নদীতে যেমন গুচ্ছ গুচ্ছ কচুরিপানা এখানে তেমনি গুচ্ছ গুচ্ছ আড্ডা। ঠিক কচুরিপানার মতোই ভাসমান।  যেখানে ভেসে যায় জীবনের সব সম্ভাবনা এবং যৌবনের বিপুল শক্তি!

এরকম একটা ভেসে যাওয়া বা বখে যাওয়া পরিবেশেই কাটছে আমার সময়, সংখ্যায় গুণতে গেলে ত্রিশটা করে দিনের ছয়টা মাস! তবে আমার অবস্থা ছিলো কিছুটা ‘ভদ্রস্থ’। কারণ আমি পড়েছিলাম কবি আর কবিতার মায়ায়। আর কবিরা হয়ত একটু আধটু ‘কাক¯œান’ করে, তবে ডুবোডুবি করে না। কবিতার অনেক দোষের মধ্যে এইটুকু যা গুণ। তাছাড়া ছিলো আরেকটা কিঞ্চিত নির্দোষ ব্যস্ততা। একটা ভবঘুরে দলের সদস্য হয়ে ‘ভাড়ায়’ আবৃত্তি করতে যাই। তবে কিনা ‘ছোট ভাই’ বলে ‘ভাড়া’ তেমন কিছু পাই না। না পেলাম! বড় ভাইয়েরা সঙ্গে নেয়, তাতেই তো বর্তে যাওয়ার কথা! তাছাড়া ভবিষ্যত বলে একটা জিনিস আছে তো! আবৃত্তি সেরে আবার এসে আড্ডায় মজে যাই। তাতে ‘বখাবখি’র অবসর বড় একটা থাকে না। বুয়েটের পড়ালেখায় অবশ্য ভাটার টান লেগেই থাকে। তবে অদৃশ্যের বদান্যতায় কিঞ্চিৎ মেধাযোগ ছিল বলে, যাকে বলে ফেল মারা এবং মা-বাবার মুখে চুনকালি লেপা, সেটা হয়নি। আহামরি ভালো কোন ফল যদিও করতে পারিনি।

এসময় টিভিতেও ডাক পড়ে, শুরুতে প্রান্তিক হলেও ধীরে ধীরে লাইম লাইটে আসি। লাল পেড়ে শাড়ীর পাশে উপস্থাপনা মন কেড়ে নেয়। একেবারে তারকাখ্যাতি না হলেও নাম-ডাক ছড়িয়ে ছিটিয়ে হতে থাকে। আড্ডার পরিসরও বাড়ে এবং বাড়ে তার জৌলুস।  

বুয়েটের আহসানউল্লাহ হলটা অনেক পুরোনো। বিল্ডিংটা একসময়ের ‘শ্রীমতী’ হলেও এখন আর ‘শ্রী’ নেই। যেন বিগতযৌবনা! বেছে বেছে এ হলটাতেই কেন ওঠা হলো, বা উঠতে হলো, এখন মনে নেই। তবে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে ভালোই কাটছিলো দিন এবং রাত, বিশেষ করে রাতের সন্ধ্যা অংশটা।

এর মধ্যে হঠাৎ করেই এক বন্ধু এসে কতকটা যেন কানপড়া দেয়ার মত করে বললো, ‘কুরআন পড়া শিখবি? ভালো একটা সুযোগ আছে।’

মানুষ ভেবে চিন্তে যা বলে তা হয় খুব ভালো হবে না হয় খুব মন্দ! আর ভাবনা চিন্তা ছাড়া শুধু ভিতরের তাড়া থেকে যা বলে তা সাধারণত ভালোই হয়। আমি কিচ্ছু না ভেবেই কতকটা যেন নিজের অজান্তেই অথবা ভিতরের তাড়া থেকেই বলে ফেলাম, ‘শেখা যায়।’

তারপর জানতে চাইলাম যেমন জানতে চাওয়া হয়, আজ কী বার, ‘কে শেখাবে?’

‘বুয়েটের একজন প্রফেসর’

‘নাম কী প্রফেসর মহোদয়ের?’

‘হামীদুর রহমান’ 

‘কবে থেকে?’

‘কাল থেকেই।’

‘আচ্ছা; আবৃত্তির মত এটাও না হয় শেখা হলো!’

সেটা হলো ১৯৯৪ সালের কথা। ফোর্থ ইয়ার শুরু হয়েছে। পড়ালেখার চাপ বেশি নেই। থাকলেও আমার মাথায় নেই। রাজী হয়ে গেলাম। প্রফেসর সাহেবকে চিনি না। কোনোদিন দেখিনি। প্রথম ক্লাসে গিয়ে হাজীর হলাম। বুয়েটের কয়েক বন্ধু, ঢাকা মেডিকেলের কিছু ছাত্রও এসেছে। আমি ছাড়া বেশিরভাগ একদলের। তারা একসঙ্গে একটা ‘ইসলামী দল’ করে। কারো কারো দাড়িও আছে। আমি রাজনীতির ধারে কাছে ছিলাম না কখনো, রাজনীতিও ছিলো না আমার আশেপাশে। আসলে নেভীর জীবনে ওদিকটায় উঁকি দেয়ার সুযোগও তেমন নেই। পরিচয়পর্ব সেরে প্রফেসর সাহেব ক্লাস নেওয়া শুরু করলেন। আজ এত দিন পরে যদি বলতে হয়, কী ছিলো আমার ঐ দিনের প্রথম অনুভূতি ঐ মানুষটি সম্পর্কে তাহলে বলবো, প্রথমে মনে হলো, এ্যা! এ দেখি হুযূর মানুষ! যেমন হ্যাংলা তেমন পাতলা! তার উপর যেমন কাপড় তেমন চোপড়!

কিন্তু যখন শুরু করলেন, ভিতরে নিজের অজান্তেই একটা মুগ্ধতা তৈরী হয়ে গেলো! এত সুন্দর ‘ফুলঝরা’ ইংরেজি! কথা বলার এমন মনছোঁয়া ভঙ্গি! তদুপরি বক্তব্য উপস্থাপনের এমন মর্মস্পর্শিতা! অল্প সময়ের মধ্যেই ভিতরে ভালো লাগার একটা শান্ত শীতল অনুভূতি তৈরী হয়ে গেলো। মনটা যেন তৃপ্তিতে ভরে গেল।

আবৃত্তির অঙ্গনে আমার শুধু বিচরণই ছিলো না, ছিলো সগৌরব উপস্থিতি। কিন্তু আমার কণ্ঠে তো এত মধুরতা নেই! প্রথম দিন তিনি বোর্ডে একটা আয়াত লিখলেন :

كَتَبَ عَلَىٰ نَفْسِهِ الرَّحْمَةَ

ঐব যধং ৎিরঃঃবহ গবৎপু ঁঢ়ড়হ ঐরসংবষভ.

তিনি তাঁর নিজের উপর রহমত লিখে নিয়েছেন।

(সূরা আনআম, ৬:১২)  

 

৪। ভর দুপুর। এটা ঘুমের সময় না কোন চঞ্চল যুবকের জন্য, এমনকি তার জন্যও না, আলস্যের সঙ্গে যার পরিচয় আছে। আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। ঘুমটা তখন মাত্র ভেঙেছে, ভাবটা তখনো সরেনি। দরজা-জানালা বন্ধ, কামরার মধ্যে অন্ধকারের আবহ তৈরী করার জন্য। তবে ভেন্টিলেটরের সুবাদে অন্ধকারের মধ্যেও হালকা আলো ছিলো। তাতে দুপুরের ঘুমে অবশ্য ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়নি। আড়মোড়া ভাঙতেই ঘড়ির দিকে চোখ গেল। একটা বাজে।

রুমমেটরা কেউ নেই। আমি ছাড়া এই ঘরে আরও দু-জন থাকে। দু’জনই আমার জুনিয়র। একজন ফার্স্ট ইয়ারে, অন্যজন সেকেন্ড ইয়ারে। জুনিয়র বলে আচরণের মধ্যে কিছুটা পোষমানা ভাব রয়েছে! একেবারে যেন ‘প্রান্তছোঁয়া’ অমায়িকতা! নামায-কালাম পড়ে একজন। আরেকজন ঠিক কী করে, জানি না। তার সঙ্গে তেমন আলাপও নেই। একদিন সময় করে আলাপ করতে হবে। এখন তারা কেউ নেই।

এখন তাহলে উঠতে হয়। যোহরটা পড়তে হবে তো! এর আগে অবশ্য ফজরটাও পড়তে হবে। আজো সেটা কাযা হয়েছে। এখনো পড়া হয়নি। কেউ না ডাকলে ফজরের সময়  ওঠা হয় না। ঘুমের মধ্যেই সূর্য উঠে যায়। ওঠার পর পড়ি পড়ি করে দেরী হয়ে যায়। তারপরো নামায পড়ি। বাবা-মা শিখিয়েছেন। ছোটবেলা থেকে পড়ছি। অভ্যাস হয়ে গেছে। অভ্যাসের জোরেই চলছে এখনো। সঙ্গে অবশ্য গান-বাজনা, কবিতা-নাটক এবং এগুলোর উপসর্গ সবই আছে। বন্ধুদের হৈ-হুল্লোড়ে থাকি। সময় হলে নামাযের জন্য উঠে যাই। কেউ কেউ একটু বিরক্ত হলেও তেমন করে গায়ে মাখে না। আড্ডা জমে উঠলে তো কেউ আর মনেও রাখে না। মডারেট মুসলিমরা সব মহলেই ছাড় পায়। আপন মনে না করলেও ‘ডানে বামে’ কেউ তাকে পর মনে করে না। না হুযুরমহল, না গায়কমহল। আমিও তখন এই প্রকারের ‘উদার’ মুসলিম।  

অযু করে এসেছি। আমার এখন অনেক কাজ। নামায পড়ে নোট তৈরি করতে হবে। গতকালকের আরবি ক্লাসের একটা নোট লিখব।

লোকটা দেখতে অত স্মার্ট না। পায়জামা-পাঞ্জাবিতে কাউকে আমার স্মার্ট লাগেও না। হুযুরদের দেখলেই পালাতে ইচ্ছে করে। প্রফেসর মানুষটা হুযুর না হলে ভালো হতো। গায়ে পড়ে কেন যে হুযূর হতে গেলো! তারপরো, খুব একটা খারাপ বলা যায় না, কিছুটা বরং ভালোই। অন্তত কয়েকবার মনে পড়ার মত ভালো। কথা-বার্তার মধ্যে কিন্তু স্মার্টনেস আছে এবং আশ্চর্য একটা কমান্ডিং টোন। পড়িয়েছে ভালো! রীতিমত শিক্ষকতার আভিজাত্য রয়েছে। আবার যেতে হবে। আর যেতে হলে আয়াতগুলো নোটে তুলতে হবে।

৫। আমি প্রফেসর সাহেবের খোঁজ নেওয়া শুরু করলাম। পুরো নাম মুহাম্মাদ হামীদুর রহমান। ইলেকট্রিক্যাল ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর। আসলে প্রফেসর না, এসিসটেন্ট প্রফেসর। সমীহ করে সবাই বলে প্রফেসর। আমি এরূপ সমীহ করা অসত্য আরোপের কারণ খুঁজে পেলাম না। মনটা বলতেই হয়, কিছুটা যেন দমে গেল। আরও খোঁজ নিয়ে জানলাম লোকটা পিএইচডি করেনি, মাস্টার্সও না। এজন্য প্রমোশন পাননি। পঁচিশ বছর ধরে এসিসটেন্ট হিসেবেই পার করে দিচ্ছেন। লোকটার পড়ালেখার প্রতি এত অনীহা কেন? একই পদে এতদিন কেউ চাকুরী করে? এই মুহূর্তে তার এক ব্যাচ সিনিয়র একজন বুয়েটের ভাইস চ্যান্সেলর। ক’দিন পর তার জুনিয়র ভাইস চ্যান্সলের হবে। এতে তার কোনো বিকার নেই! আমি লোকটাকে স্মার্ট ভেবেছিলাম। এখন দেখছি সেরকম না! যে স্মার্ট, সে সবদিকেই স্মার্ট হবে। কেবল ধর্মকম্ম নিয়ে পড়ে থাকলে হবে? দুনিয়ার পড়া-লেখার কি কোনো দাম নেই? তার ব্যাপারে আমার ভালো লাগা উবে গেল। টিএসসির পথে হাঁটা শুরু করলাম।

বিকেল হয়ে গেছে। বিকেল হলো ওখানকার জন্য সময়ের যৌবনকাল! টিএসসির কাছে যেতেই মাইকের আওয়াজ কানে এল। অডিটরিয়ামের কোনো প্রোগ্রাম হচ্ছে হয়তো। এখানে প্রোগ্রাম লেগেই থাকে। যত কলা আছে, সব কলার ফলন হয় এখানে। এ মুহূর্তে আবৃত্তি হচ্ছে। পরিচিত কণ্ঠ। অসম্ভব সুন্দর লাগে আমার এই কণ্ঠগুলো। আমার কণ্ঠ এখনো এরকম হয়নি। শুনতেই ইচ্ছে করে। দাঁড়িয়ে গেলাম। পুরুষ কণ্ঠ পড়ছে :

...তুমি এই যে বসে আছো / আঙুলে ছোঁয়ানো থুতনি / কপালে পড়েছে চর্ণূ চুল / পাড়ের নকশায় ঢাকা পা / ওষ্ঠাগ্রে আসন্ন হাসি / এই দৃশ্যে অমরত্ব / তুমি তো জানো না, নীরা, আমার মৃত্যুর পরও এই ছবি থেকে যাবে...।

সুনীলের কবিতা। এর অনেক কবিতাই আমার মুখস্থ। এটাও। একটা অনুষ্ঠানে কিছুদিন আগে আবৃত্তি করেছি। এটা অবশ্য একা আবৃত্তি করা যায় না। আরেকজন লাগে। নেভীর অনুষ্ঠান ছিল। অসুবিধা হয়নি। থাক এসব। কবিতায় এখন মন নেই। মনটা আকাশে উড়াল দিয়েছিল। এখন মেঘের মধ্যে পথ হারিয়েছে। প্রফেসর সাহেবের চিন্তা মাথা থেকে যাচ্ছে না। ঘুরপাক খাচ্ছে। পড়ালেখা না করার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছি না!

এখন কাউকে খুঁজে পেতে হবে। নির্দিষ্ট কোনো কাজে আসিনি। কাজ নেই-ও। কয়েকদিন হলো মার্চ মাস শেষ হয়েছে। উত্তাল আন্দোলন এখন ঝিমিয়ে গেছে। মে মাসে আবার একটু হয়তো জাগবে। শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কবিতাপাড়া বরাবরই সরব। এরকম আর কোথাও মনে হয় নেই। দেয়ালে দেয়ালে চিকা উঠবে : ভাত দে হারামজাদা / নইলে মানচিত্র খাবো। বড় অদ্ভুত কথা! কবিরা পারেও।

আমি পুরো টিএসসি চক্কর দিয়ে ফেললাম। কাউকে পেলাম না। মানুষজন যে নেই এমন না। দলের কেউ নেই। বাইরের দেয়ালের পাশ ঘেঁষে টঙ-এর দোকানে চা খেলাম। তারপর লাল আর নীল এবং কিছু হলুদ পাখির জোড়া দেখতে দেখতে ফের হাঁটা শুরু করলাম। একাকী, বিষন্ন এবং অস্থির। সম্ভবত আমার একটি পাখি থাকলে ভালো হতো!

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা