রমযান ১৪৩০ হিঃ (১৩)

হযরত আলী নাদাবীর পাতা

মা যা খাসিরাল আলামু বিনহিতাতিল মুসলিমীন- ধারাবাহিক অনুবাদ

মুসলিম উম্মাহর অধঃপতনে বিশ্বের কী ক্ষতি হল?

পর্ব: ১১

লিখেছেনঃ মাওলানা আবুল হাসান আলী নদবী (রাহ.)

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট
(পূর্বপ্রকাশিতের পর) চতুর্থ পরিচ্ছেদ: খেলাফাতে রাশেদাই হলো সর্বোত্তম আদর্শ নবুয়তে মুহম্মদীর মাধ্যমে মানবজাতির সেই স্বপ্ন ও প্রত্যাশাই পূর্ণ হলো। আসমানী তত্ত্বাবধানে এবং নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তারবিয়াত ও প্রতিপালনে ছাহাবা কেরামের এক আদর্শ জামা‘আত তৈরী হলো। খেলাফাতে রাশেদার মাধ্যমে মানবজাতিকে তাঁরা ধর্ম, কর্ম, চরিত্র, নৈতিকতা ও যোগ্যতার সুসমন্বয়ে এমন এক সুন্দর, সুপরিণত ও সুসমৃদ্ধ সমাজ, সভ্যতা ও শাসনব্যবস্থা উপহার দিলেন যার ন্যূনতম তুলনা মানব-ইতিহাসের কোন অধ্যায়ে আমরা দেখতে পাই না। এককথায়, আদর্শ মানব তৈরী এবং আদর্শ সভ্যতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আধ্যাত্মিক, জাগতিক, নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক এবং জ্ঞান ও ধর্মীয় শক্তিগুলো সেখানে পরস্পর সহায়করূপে পূর্ণ সক্রিয় ছিলো। সেটা ছিলো তদানিন্তন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রব্যবস্থা। রাজনৈতিক ও জাগতিক শক্তির বিচারে তা সমকালীন সকল শক্তিকে ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। সমাজজীবনে ও শাসনব্যবস্থায় উন্নত নৈতিকতা ও আদর্শ চরিত্রেরই পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ছিলো। ব্যবসা-বাণিজ্য, পেশা-শিল্প, লেনদেন ও সামাজিক সম্পর্ক, আচার-বিচার, এককথায় জীবনের সকল ক্ষেত্রে উন্নত মানবিক মূল্যবোধের একচ্ছত্র শাসন ছিলো। বিজয়াভিজানের বিস্তার এবং সভ্যতার ব্যাপ্তির পাশাপাশি নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতিও অব্যাহত ছিলো। ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির, সমাজের সাথে ব্যক্তির এবং ব্যক্তির সাথে সমাজের সম্পর্ক ছিলো আস্থা ও দায়িত্বশীলতা এবং ভালোবাসা ও কল্যণকামিতার বুনিয়াদের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত। ফলে সাম্রাজ্যের বিশালতা ও জনসংখ্যার স্ফীতির তুলনায় অপরাধ ও দুষকৃতির পরিমাণ ছিলো খুবই কম, প্রায় শূন্যের কোঠায়; অথচ পরিবেশ- পরিস্থিতি ও কার্যকারণ সবই ছিলো অপরাধপ্রবণতার অনুকূল। এককথায়, খেলাফাতে রাশেদা ছিলো এমনই এক আদর্শ শাসনযুগ, যার চেয়ে উত্তম ও সমৃদ্ধতর আর কিছু কল্পনা করারও উপায় ছিলো না। আর তা সম্ভব হয়েছিলো শুধু তাদের জীবন ও চরিত্রের সৌন্দর্যের কারণে যারা শাসন পরিচালনা করতো এবং নাগরিক জীবন ও সভ্যতার পরিচর্যা করতো। সম্ভব হয়েছিলো তাদের আকীদা ও বিশ্বাস, শিক্ষা ও দীক্ষা এবং রাজনীতি ও শাসননীতির মহত্ত্বের কারণে। যেখানেই তারা অবস্থান করতেন এবং যে দায়িত্বেই নিয়োজিত হতেন, চরিত্রে ও ধার্মিকতায় তারা হতেন সকলের আদর্শ। শাসক ও শাসিত, কর্মী ও কর্মকতা, পরিচালক ও পরিচালিত, সৈনিক ও সেনাপতি, এককথায় সর্বাবস্থায় সততা ও সত্যবাদিতা, বিনয় ও ‘ভীতি’, ত্যাগ ও আত্মত্যাগ এবং সহমর্মিতা ও কল্যাণকামিতাই ছিলো তাঁদের বৈশিষ্ট্য। রোমের জনৈক বিশিষ্ট ব্যক্তি মুসলিম সৈনিকদের অবস্থা বর্ণনাপ্রসঙ্গে বলেছেন- ‘রাতে তারা ইবাদতগুজার এবং দিনে রোযাদার। তারা ওয়াদা পূর্ণ করে, সৎ কাজে আদেশ করে এবং মন্দ কাজে নিষেধ করে। আর পরস্পর ইনসাফপূর্ণ আচরণ করে। অন্য একজনের মতে, ‘দিনে তারা ঘোড়সওয়ার, রাতে ইবাদত- গুজার। অধিকৃত এলাকায়ও তারা বিনামূল্যে কিছু গ্রহণ করে না এবং বিনাসালামে কোথাও প্রবেশ করে না। তাদের বিরুদ্ধে যারা মাথা তোলে তাদের শেষ না করে তারা ক্ষান্ত হয় না।’ তৃতীয়জনের মতে, ‘রজনীতে তারা সংসারত্যাগী, দিবসে অশ্বারোহী, তীরচালনায় পারদর্শী এবং বর্শানিক্ষেপে কুশলী। তুমি যদি পাশের ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলতে চাও, সে তোমার কথা বুঝতে পারবে না; কারণ চারপাশে শুধু তিলাওয়াত ও যিকিরের গুঞ্জন।’ এ নববী দীক্ষা ও তারবিয়াতেরই ফল ছিলো এই যে, মাদায়েন বিজয়কালে পারস্যসম্রাটের রাজমুকুট এবং ঐতিহ্যবাহী ফরাস সৈনিকদের হস্তগত হলো, যার মূল্য ছিলো কয়েক লাখ দীনার। কিন্তু লোভে পড়ে কেউ তাতে তসরূফ করলো না, বরং অক্ষত অবস্থায় সেনাপতির হাতে তুলে দিলো, আর তিনি তা খলীফাতুল মুসলিমীনের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। খলীফা সন্তোষ প্রকাশ করে বললেন, এ আমানত যারা রক্ষা করেছে তারা অবশ্যই আমানতদার! জীবনের উপর ইসলামী নেতৃত্বের প্রভাব নবীর অনুসারীদের এই যে প্রথম জামা‘আত, তাদের সুশাসনের সুস্নিগ্ধ ছায়ায় মানবজাতি পরম সুখ-শান্তির অধিকারী হবে এবং তাদের নেতৃত্বে সোজা সরল পথে সঠিক গন্তব্যে পরিচালিত হবে, আর পৃথিবী হবে ফলে, ফুলে ও ফসলে পরিপূর্ণ এবং আনন্দরসে সুসিক্ত ‘জান্নাত-নমুনা’ এক শান্তি-উদ্যান, এটাই ছিলো স্বাভাবিক এবং তাই হয়েছিলো। কেননা তারা ছিলেন পৃথিবীর সুখ-শান্তি ও নিরাপত্তার উত্তম ব্যবস্থাপক এবং উত্তম প্রহরী। জীবনের প্রতি তাদের দৃষ্টি ও দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ। জীবন তাদের কাছে লোহার খাঁচা, কিংবা পায়ের বেড়ী ছিলো না, চরম আক্রোশে যা তারা ভেঙ্গে ফেলতে চাইবে, তদ্রূপ তা ছিলো না ভোগ-উপভোগের কোন সুযোগ, যা আর কখনো ফিরে আসবে না বলে এখনই লুটে নিতে হবে এবং চেটেপুটে খেয়ে ফেলতে হবে। একই ভাবে জীবন তাদের কাছে ছিলো না কোন পাপের শাস্তি, যা থেকে মুক্তি লাভের জন্য তারা ছটফট করবে, তদ্রূপ ছিলো না সাজানো বিছানো ও লোভনীয় খাবারে পরিপূর্ণ কোন দস্তরখান, যার উপর এখনই ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে এবং ভোগের ভাগ বৃদ্ধি করার উন্মত্ত প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে হবে। দুর্বল জাতিবর্গ তাদের দৃষ্টিতে কোন লোভনীয় শিকার ছিলো না যে, ‘কে কার আগে’ তাদের উপর হামলে পড়বে। না, এমন ছিলো না, বরং তাদের দৃষ্টিতে জীবন ছিলো আল্লাহর নেয়ামত, যা সকল পুণ্যের এবং সকল কল্যাণের উৎস; জীবন ছিলো তাদের কাছে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের মাধ্যম এবং আল্লাহর পক্ষ হতে নির্ধারিত মানবীয় পূর্ণতায় উত্তোরণের সোপান; জীবন ছিলো তাদের কাছে কর্মের এবং অর্জনের সংগ্রাম সাধনার একমাত্র সুযোগ যা দ্বিতীয় বার ফিরে আসবে না। ‘যিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যুকে এবং জীবনকে, যেন তোমাদের পরীক্ষা করেন যে, তোমাদের মাঝে কে অধিক উত্তম কর্মে ও আচরণে।’ ‘নিঃসন্দেহে বানিয়েছি আমি পৃথিবীস্থ সকল কিছুকে পৃথিবীর জন্য শোভা, যেন তিনি তোমাদের পরীক্ষা করেন যে, তোমাদের মধ্যে কে উত্তম কর্মে ও আচরণে।’ বিশ্বজগতের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো এই যে, তা আল্লাহর রাজত্ব, তাদেরকে তিনি তাতে স্থলাভিষিক্ত করেছেন; প্রথমত মানবসত্তাগত দিক থেকে; কারণ মানবজাতিকে তিনি পৃথিবীতে খলীফারূপে সৃষ্টি করেছেন। ‘অবশ্যই আমি পৃথিবীতে সৃষ্টি করবো একজন খলীফা।’ ‘তিনি ঐ সত্তা যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জন্য যা কিছু আছে পৃথিবীতে, তা সকলই।’ ‘আর অবশ্যই মর্যাদাবান করেছি আমি বনী আদমকে এবং বহন করিয়েছি তাদেরকে স্থলে ও জলে এবং রিযিক দান করেছি তাদেরকে উত্তম বস্তুসকল হতে এবং বিরাট শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি তাদেরকে আমার বহু সৃষ্টির উপর।’ দ্বিতীয়ত এদিক থেকে যে, তারা সেই পুণ্যবান জামা‘আত যারা আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে এবং আল্লাহর আদেশের অনুগত হয়েছে। তাই তাদেরকে তিনি পৃথিবীতে খেলাফাত দান করেছেন এবং পৃথিবীর অধিবাসীদের শাসক নির্বাচন করেছেন। ‘ওয়াদা করেছেন আল্লাহ তাদের প্রতি যারা ঈমান এনেছে এবং নেক ‘আমল করেছে যে, অতি অবশ্যই তিনি তাদের পৃথিবীতে স্থলাভিষিক্ত করবেন, যেমন স্থলাভিষিক্ত করেছেন তাদেরকে যারা তাদের পূর্বে বিগত হয়েছে এবং তাদের অনুকূলে প্রতিষ্ঠা দান করবেন তাদের দ্বীনকে যা তিনি তাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং তারা ভয়তাড়িত হওয়ার পর পরিবর্তে তাদের স্বস্তি দান করবেন। কারণ তারা আমার ইবাদত করে, আর কোন কিছুকে আমার সাথে শরীক করে না।’ আর তাদেরকে তিনি পৃথিবীর যাবতীয় নেয়ামত ভোগ করার অধিকার দান করেছেন, তবে অপচয় ও অপব্যয়ের সাথে নয়। ‘তিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জন্য যা কিছু রয়েছে পৃথিবীতে।’ 'তোমরা আহার করো এবং পান করো, তবে অপচয় করো না, নিঃসন্দেহে তিনি অপচয়কারীদের পছন্দ করেন না।’ ‘আপনি বলুন, কে হারাম করেছে, আল্লাহর (দেয়া) যীনাত (ও শোভা)কে, যা তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য বের করেছেন এবং (কে হারাম করেছে) উত্তম রিযিকসমূহকে? বলুন তা তো ঐ লোকদের জন্য যারা ঈমান এনেছে দুনিয়ার জীবনে, কেয়ামত-দিবসের জন্য নিজেদের নিবিষ্ট করে।’ আর তিনি তাদেরকে পৃথিবীর সকল জাতি ও জনগোষ্ঠীর উপর কর্তৃত্ব দান করেছেন, যাতে তারা তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করে এবং তাদের জীবন ও চরিত্র, গতি ও গতিবিধি এবং ঝোঁক ও প্রবণতাকে কল্যাণের পথে সুনিয়ন্ত্রিত রাখে; যেন তারা ভ্রষ্টকে পথ প্রদর্শন করে এবং বিনষ্টকে সংশোধন করে এবং যাবতীয় ফাটল মেরামত করে; যেন তারা সবল থেকে দুর্বলকে রক্ষা করে এবং যালিমের কাছ থেকে মুযলূমের হক উদ্ধার করে; যেন তারা পৃথিবীতে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করে এবং সারা বিশ্বে শান্তি, স্বস্তি ও স্থিতির ছায়া বিস্তার করে। ‘তোমরা হলে সর্বোত্তম জাতি, যাদের উত্থিত করা হয়েছে মানবজাতির জন্য, তোমরা সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎ কাজের নিষেধ করবে, আর তোমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে।’ ‘হে ঐ লোকেরা যারা ঈমান এনেছো, তোমরা সুবিচারে অবিচল থাকো, আল্লাহর জন্য সাক্ষ্যদানকারী হও।’ জনৈক জার্মান বিদগ্ধ মুসলিম পণ্ডিত মুসলিম ব্যক্তিত্বের একটি বাস্তবানুগ চিত্র এঁকেছেন। তিনি বলেন- ‘খৃস্টবাদের মত ইসলাম জীবন ও জগতের প্রতি কালো চশমার ভিতর দিয়ে দৃষ্টিপাত করে না, বরং একদিকে ইসলাম আমাদের শিক্ষা দেয়, যেন আমরা পার্থিব জীবনের মূল্যায়নে অতিকৃচ্ছতা ও বৈরাগ্যের শিকার না হই, অন্যদিকে আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার মত জীবনের ভোগবাদিতা ও স্বেচ্ছাচারে নিমজ্জিত না হই। খৃস্টধর্ম জীবনকে ঘৃণা করে এবং জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা পোষণ করে। পক্ষান্তরে খৃস্টীয় দৃষ্টিভঙ্গির সম্পূর্ণ বিপরীতে পাশ্চাত্য সভ্যতা জীবনের প্রতি লোভাতুর আচরণ করে, যেমন ভোজনলোভী গোগ্রাসে খাবার গিলতে থাকে, অথচ খাবারের প্রতি তার কোন সম্মানবোধ থাকে না। কিন্তু ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ ভিন্ন। জীবন ও জগতকে ইসলাম শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখে এবং তার প্রতি প্রশান্ত অনুভূতি পোষণ করে। জীবনকে ইসলাম পূজা করে না, বরং ঊর্ধ্বজাগতিক জীবনের অভিযাত্রার পথে এমন একটি পর্যায় বলে গণ্য করে, যা তাকে যোগ্যতা ও কুশলতার সঙ্গে অতিক্রম করতে হবে। যেহেতু এটি মহাজীবনের একটি পর্যায় এবং অপরিহার্য পর্যায়, সেহেতু মানুষের অধিকার নেই এর অবমূল্যায়ন করার। আমাদের মহাজীবনের এ সফরে ইহ জীবনের এই পথটুকু অতিক্রম করতেই হবে, এটাই আল্লাহর পক্ষ হতে নির্ধারিত তাকদীর। সুতরাং পারলৌকিক জীবনের সফলতা অর্জনে পৃথিবীর মানবজীবনের বিরাট মূল্য ও ভূমিকা রয়েছে; তবে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, এ জীবন অন্য জীবনে উত্তরণের জন্য নিছক মাধ্যম; পার হওয়ার সংক্ষিপ্ত অথচ অপরিহার্য এক সেতু। পার্থিব জীবনের মূল্য এর চেয়ে কমও নয়, বেশীও নয়। ইসলাম এই জড়বাদী চিন্তাকে কখনো অনুমোদন করে না যে, আমার চাওয়া-পাওয়া শুধু দৃশ্য জীবন ও দৃশ্য জগত। তদ্রূপ জীবনের প্রতি চরম তাচ্ছিল্যপূর্ণ এই চিন্তাকেও স্বীকার করে না যে, এই পাপপূর্ণ জীবনের কাছে আমার কোন চাওয়া-পাওয়া নেই। ইসলামের চলার পথ হলো এ দুয়ের মধ্যবর্তী পথ। ইসলাম আমাদের শিক্ষা দেয়, তোমার প্রতিপালকের কাছে এভাবে দু‘আ করো- ‘হে আমাদের প্রতিপালক! দান করুন আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ এবং আখেরাতে কল্যাণ।’ সুতরাং জবীন এবং জীবনের সাথে সম্পর্কিত বস্তুসকল আমাদের আধ্যাত্মিক জীবনের সাধনার পথে হোঁচট খাওয়ার জন্য পড়ে থাকা প্রস্তরখণ্ড নয়, বরং জাগতিক উন্নতি ও বস্তুগত সমৃদ্ধি অর্জন করা হচ্ছে জীবনের কাঙ্ক্ষিত বিষয়, তবে নিজস্ব সত্তাগতভাবে তা কখনোই লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নয়। আমাদের সকল চেষ্টা-সাধনার লক্ষ্য হওয়া উচিত এই যে, ব্যক্তি পর্যায়ে ও সামাজিক স্তরে আমরা এমন অবস্থা ও পরিবেশ সৃষ্টি করবো এবং পরবর্তীতে তা রক্ষা করার চেষ্টা করবো যা ইসলামের জীবনদর্শন অনুযায়ী মানুষের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শক্তি অর্জনের ক্ষেত্রে সহায়ক হয়। জীবনের বিস্তৃত অঙ্গনে মানুষ ছোট বড় যে কোন কাজ করুক ইসলাম তাকে নৈতিক দায়িত্ববোধ অর্জনের প্রতি অনুপ্রাণিত করে। ইসলামের জীবনব্যবস্থা কখনোই তা অনুমোদন করে না যা (বর্তমান) ইঞ্জিল তার অনুসারীকে শিক্ষা দিয়ে বলে- ‘সিজারকে দাও যা তার প্রাপ্য এবং ঈশ্বরকে দাও যা তার প্রাপ্য।’ ইসলামের দৃষ্টিতে কোন সিজারের নিজস্ব পাওনা বলে কিছু নেই। সবই আল্লাহর প্রাপ্য। সেই প্রাপ্যের আলোকে সিজারের প্রতি আমাদের অবশ্যই কিছু দায় ও দায়িত্ব রয়েছে। জীবনের প্রয়োজনগুলোকে আধ্যাত্মিক ও জাগতিক এবং নৈতিক ও বস্তুগত- এই বিভাজনে ইসলাম বিশ্বাস করে না। ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের দেহ ও আত্মার সকল প্রয়োজনই জীবনের প্রয়োজন। জীবনের কাছে ইসলামের একমাত্র দাবী হলো হক ও বাতিলের মাঝে একটিকে বেছে নেয়া। হক ও বাতিলের মধ্যবর্তী কোন পথ ও পন্থা ইসলামের কাছে নেই। তাই ইসলামের জোরদার আদেশ হলো কর্মময় জীবনের। কেননা কর্ম জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা থেকে দূরে থাকার কোন সুযোগ নেই। প্রত্যেক মুসলিমের অবশ্য কর্তব্য হলো নিজেকে দায়বদ্ধ মনে করা তার চারপাশের পরিবেশ সম্পর্কে এবং তার সামনে, পিছনে ও ডানে-বামে যা কিছু ঘটছে সে সম্পর্কে। তাকে নিয়োজিত থাকতে হবে হকের প্রতিষ্ঠা এবং বাতিলের বিলুপ্তির নিরন্তর জিহাদে। কারণ তার প্রতি কোরআনের সম্বোধন হলো- ‘তোমরা হলে শ্রেষ্ঠ উম্মত, যাদেরকে উত্থিত করা হয়েছে মানবের (কল্যাণের) জন্য। তোমরা সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অসৎ কাজের নিষেধ করবে, আর আল্লাহর প্রতি ঈমান আনবে।’ এটাই হচ্ছে ইসলামী জিহাদের, প্রারম্ভিক যুগের ইসলামী বিজয়াভিযানের এবং আধুনিক যুগের পরিভাষায় ইসলামী উপনিবেশবাদের নৈতিক বৈধতার ভিত্তি। হাঁ, এ পরিভাষা ব্যবহার করা যদি অপরিহার্যই হয় তবে আমি বলবো, ইসলাম অবশ্যই উপনিবেশবাদী, তবে ঐ শ্রেণীর উপনিবেশবাদ নয়, যার উৎস হলো ক্ষমতা ও আধিপত্য এবং সম্পদ লুণ্ঠন ও স্বাধীনতা হরণ। প্রথম যুগের মুজাহিদগণ নিজেদের এবং প্রতিপক্ষের সামরিক শক্তির অনুপাতের পরোয়া না করে যেভাবে জিহাদের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তেন তার পিছনে বিজিত জাতির সম্পদ লুণ্ঠন ও ক্ষমতা দখল এবং জীবনের সুখ-সচ্ছলতা নিশ্চিত করার আকাঙ্ক্ষা ক্রিয়াশীল ছিলো না, বরং তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিলো মানবজাতির আধ্যাত্মিক উন্নতির সম্ভাব্য সর্বোত্তম বিশ্বপরিবেশের বিনির্মাণ। যেমন ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী মহত্ত্ব-এর জ্ঞান মানুষের উপর মহত্ত্বকে গ্রহণ ও প্রতিপালন করার দায় আরোপ করে। মহত্ত্ব ও নীচতার নিছক তাত্ত্বিক বিভাজন এবং দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করার প্লেটোবাদকে ইসলাম মোটেই সমর্থন করে না। বরং ইসলাম এটাকে অতি নীচতা বলেই গণ্য করে যে, মানুষ হক ও বাতিলের মাঝে তাত্ত্বিক পার্থক্য তো অনুধাবন করবে কিন্তু হকের পৃষ্ঠপোষকতা এবং বাতিলের মূলোৎপাটনের জন্য জিহাদ করবে না। কেননা ইসলাম তার অনুসারীকে এ শিক্ষা দেয় যে, মহত্ত্ব ততক্ষণই জীবন্ত থাকবে যতক্ষণ মানুষ পৃথিবীতে মহত্ত্বের বিস্তারের জন্য জিহাদ ও মোজাহাদা করবে। পক্ষান্তরে যখনই সে মহত্ত্বের পৃষ্ঠপোষকতা পরিত্যাগ করবে মহত্ত্ব নির্জীব হয়ে যাবে এবং একসময় তার অপমৃত্যু ঘটবে। মানবজাতির গতিধারায় ইসলামী সভ্যতার প্রভাব হিজরী প্রথম শতকে ইসলামী সভ্যতা নিজস্ব প্রাণপ্রাচুর্য এবং স্বকীয় গুণ-বৈশিষ্ট্যসহ আত্মপ্রকাশ করেছিলো এবং ইসলামী সালতানাত ও সাম্রাজ্য তার বিশুদ্ধ আকৃতি ও প্রকৃতিসহ সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিলো। মানবজাতির ধর্মনীতি ও চরিত্রনীতির ইতিহাসে সেটা ছিলো এক নতুন অধ্যায় এবং রাজনীতি ও সমাজনীতির জগতে ছিলো এক নতুন ঘটনা, যার ফলে মানবসভ্যতার গতিধারা পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিলো এবং পৃথিবী ও তার জীবন এক নতুন মোড় গ্রহণ করেছিলো। এমনিতে ইসলামী দাওয়াত তো যুগে যুগে নবী ও রাসূলগণের মাধ্যমে আসমান থেকে নাযিল হয়ে আসছিলো এবং নবিদের শিষ্য ও অনুসারিগণ সুসমাচার প্রচার করে আসছিলেন এবং দাওয়াতের পথে পূর্ণ ইখলাছের সাথে জিহাদ ও মুজাহাদা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তাদের পক্ষে কখনো সম্ভব হয়নি দাওয়াতের ভিত্তি ও বুনিয়াদ এবং চিন্তা ও দর্শনের উপর কোন রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং সভ্যতার গোড়াপত্তন করা, যেমনটি সম্ভব হয়েছিলো আখেরী নবী হযরত মুহম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর অনুসারিদের পক্ষে। বস্তুত এক্ষেত্রে খোলাফায়ে রাশেদীনের সফলতা ছিলো অতুলনীয় ও নযিরবিহীন। ফলে ইসলামের এ অনন্যসাধারণ বিজয় ছিলো জাহিলিয়াতের জন্য সম্পূর্ণ নতুন এক চ্যালেঞ্জ, যার সঙ্গে ইতিপূর্বে তার কোন পরিচয় ছিলো না এবং কীভাবে এর মোকাবেলা করা সম্ভব তা সে বুঝেই উঠতে পারছিলো না। প্রথমে সে ইসলামের মুখোমুখি হয়েছিলো নিছক একটি ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক দাওয়াতরূপে, কিন্তু দেখতে দেখতে তা পরিণত হলো ইহকালীন ও পরকালীন শান্তি ও মুক্তির একমাত্র পথরূপে, যেখানে দেহসত্তা ও অন্তর্সত্তার সুসমন্বয় ঘটেছে এবং সমাজ, সভ্যতা, শাসননীতি ও রাজনীতি এবং নৈতিকতা ও ধার্মিকতার অপূর্ব সংমিশ্রণ ঘটেছে। ইসলাম ছিলো আসমানি ওহী এবং ঐশীবিধান- সম্বলিত একটি ধর্ম যা সর্বোতভাবে বুদ্ধি ও যুক্তির সমর্থনপুষ্ট এবং পূর্ণ প্রজ্ঞা ও স্বতঃসিদ্ধতার অধিকারী; অন্যদিকে জাহিলায়াত ছিলো নিছক কতিপয় কুসংস্কার, আজগুবি চিন্তা-বিশ্বাস ও কল্পকাহিনী, মানবীয় বিদ্যাবুদ্ধি এবং মানবীয় অভিজ্ঞতা- প্রসূত কতিপয় জীবনাচারের সমষ্টি। সুতরাং জাহিলিয়াত কীভাবে তার মোকাবেলা করতে পারে? ইসলামী রাষ্ট্র ও সভ্যতা ছিলো মযবূত বুনিয়াদের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং সুসংহত একটি আদর্শ রাষ্ট্র ও সভ্যতা, যেখানে তাকওয়া, পবিত্রতা, সততা ও সত্যবাদিতাই ছিলো সবকিছুর মাপকাঠি, যেখানে নীতি ও নৈতিকতার মূল্য ছিলো পদ ও সম্পদের উপরে এবং আত্মা ও আত্মিকতার মূল্য ছিলো প্রদর্শনবাদিতা ও বাহ্যিকতার ঊর্ধ্বে। সমাজের সর্বস্তরের সকল মানুষ, মানুষ হিসাবে সমান; কেউ কারো চেয়ে বড় নয় কোন বিচারে। সেখানে মানুষে মানুষে যা কিছু পার্থক্য তা শুধু তাকওয়ার ভিত্তিতে সেখানে মানুষের একমাত্র চিন্তা ও ধ্যান-জ্ঞান হলো আখেরাত। তাই পার্থিববিষয়ে হৃদয় ও আত্মা ছিলো প্রশান্ত এবং আখেরাতের বিষয়ে কলব ও রূহ ছিলো খুশু-খুযুতে আচ্ছন্ন। দুনিয়ার ‘মুরদার’ নিয়ে তাদের মাঝে কুকুরের কামড়াকামড়ি ছিলো না, এমনি কি ছিলো না কোন পার্থিব প্রতিযেগিতা। হিংসা-বিদ্বেষ ও রেষারেষি, লোভ-লালসা ও কৃপণতা এবং ইতরতা, স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতা ছিলো অনুপস্থিত। পক্ষান্তরে জাহিলিয়াতের কাছে ছিলো ঘুণে ধরা ও জরাগ্রস্ত এক সমাজ ও সভ্যতা, যেখানে ছিলো শুধু কোলাহল ও গোলযোগ, হানাহানি ও রেষারেষি এবং সীমাহীন অশান্তি ও নৈরাজ্য। সবল যেখানে দুর্বলের উপর যুলুম করে, শাসক যেখানে শুধু শোষণ করে, অথচ শোষণের শিকার যারা তারা করতে পারে না ফরিয়াদ, করে শুধু আর্তনাদ। সমাজের উচ্চস্তর ও অভিজাত শ্রেণীর লোকেরা মেতে থাকে ভোগবিলাস ও অনাচার-পাপাচারে, আর পদ ও সম্পদ এবং প্রতিষ্ঠা ও প্রতিপত্তি অর্জনের উন্মত্ত প্রতিযোগিতায়। তাদের দিন-রাতের চিন্তা, কে কাকে ছাড়িয়ে যাবে ভোগের উপাদান ও বিলাস উপকরণের প্রাচুর্যে। ফলে সমাজ ও সভ্যতা মানুষের জন্য ছিলো যেন এক ‘কুরুক্ষেত্র’ এবং জীবন ও জীবন- ব্যবস্থা ছিলো এক জ্বলন্ত অভিশাপ ও মূর্তিমান আযাব। কোরআনের ভাষায় (তরজমা)- ‘আর অতি অবশ্যই ভোগ করাবোই আমি তাদেরকে বড় আযাবের আগে ছোট আযাব, যাতে তারা ফিরে আসে।’ ইসলাম মানুষকে দান করেছিলো এমন এক ন্যায়ভিত্তিক শাসনব্যবস্থা, যা ছোট-বড়, ধনী-গরীব ও সাধারণ-অভিজাত সকল প্রজার মাঝে ইনসাফ ও সাম্য প্রতিষ্ঠা করে এবং সবলের হাত থেকে দুর্বলকে রক্ষা করে। মানুষের জান-মাল ও ইয্‌যত-আবরুর যেমন হিফাযত করে তেমনি তাদের স্বভাব-চরিত্র ও নীতি-নৈতিকতা রক্ষার নিশ্চয়তা বিধান করে। সেখানে সমাজের সর্বোত্তম লোকেরাই হলো শাসক এবং যার যত সম্পদ ও প্রাচুর্য সে তত সংযমী ও ভোগবিমুখ; পক্ষান্তরে জাহিলিয়াতের শাসন-ব্যবস্থায় ছিলো নির্যাতন-নিপীড়ন ও শোষণ-লুণ্ঠনের আধিপত্য। শাসক, কর্তা ও কর্মকর্তা সবাই যেন জোট বেঁধেছে দুষকৃতি, দুর্নীতি ও আত্মসাতের উপর। যেন এক উন্মত্ত প্রতিযোগিতা ছিলো যে, মানুষের জান-মাল ও ইয্‌যত-আবরুর উপর কে কত ‘হাতসাফ’ করতে পারে। সমাজের সামনে তারা ছিলো যাবতীয় অন্যায় ও দুষ্কর্মের নিকৃষ্টতম উদাহরণ। ফলে সমাজের নৈতিক পচন ও চারিত্রিক অধঃপতনের জন্য তারাই ছিলো দায়ী। সমপ্রদায়ের নিকৃষ্টতম লোকেরা ছিলো সমাজের ‘মাথা ও ব্যথা’। তাদের পশু ও কুকুরের তো উদরপূর্তির ব্যবস্থা ছিলো, কিন্তু তাদের প্রজাদের ছিলো না ক্ষুধার অন্ন। তাদের প্রাসাদে ছিলো মূল্যবান গালিচা ও দামী পর্দা, অথচ প্রজাদের ঘরে ছিলো না স্ত্রী-কন্যার লজ্জা ঢাকার আবরণ। তাই পরবর্তী যুগে মানুষের সামনে ইসলামের সত্য ও জাহিলিয়াতের মিথ্যা ছিলো আলো-অন্ধকারের মতই সুস্পষ্ট। ইসলামের দিকে এগিয়ে যাওয়ার এবং ইসলামকে আলিঙ্গন করার পথে তাদের সামনে কোন প্রতিকূলতা, প্রতিবন্ধকতা ও নির্যাতনের হুমকি ছিলো না এবং ছিলো না জাহিলিয়াতের দিক থেকে কোন পিছুটান। ইসলাম গ্রহণ করে মানুষ কিছুমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত হতো না, বা কোন কিছু হারাতো না; না পারিবারিক অবস্থা, না সামাজিক অবস্থান। বরং হৃদয় ও আত্মার জগতে সে লাভ করতো চেতনা ও বিশ্বাসের প্রশান্তি এবং ঈমান ও ইয়াকীনের স্বাদ ও লজ্জত। লাভ করতো ইসলামের প্রভাব ও প্রতাপ এবং একটি অপ্রতিহত রাষ্ট্রশক্তির ছত্রচ্ছায়া। সর্বোপরি সে অর্জন করতো এমন একটি জাতির ভ্রাতৃবন্ধন যারা জান-মাল ও সর্বশক্তি দিয়ে তাকে রক্ষা করার জন্য ছিলো প্রস্তুত। মৃত্যুর পর অনন্ত জীবনের সুখ-শান্তির নিশ্চিন্ততা তাদের অন্তর্সত্তায় এনে দিতো এমন এক প্রশান্তি ও স্নিগ্ধতা এবং স্বস্তি ও ইতমিনান যে, তখন মৃত্যুকে মনে হতো জীবনের চেয়ে প্রিয়। তাই মানুষ স্বেচ্ছায় ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে জাহিলিয়াতের কাঁটাবন ত্যাগ করে ইসলামের পুষ্পোদ্যানে প্রবেশ করতো। ফলে জাহিলিয়াতের ভূমি চারদিক থেকে সংকুচিত হয়ে আসছিলো, আর ইসলামের ভূমি ক্রমশ সমপ্রসারিত হচ্ছিলো। কালিমার আওয়ায উচ্চ থেকে উচ্চ এবং সবুজ বৃক্ষের সুশীতল ছায়া আরো সুবিস্তৃত হয়ে চলেছিলো। এভাবে একসময় যাবতীয় ফিতনা বিলুপ্ত হয়ে গেলো এবং আল্লাহর দ্বীন একচ্ছত্র হয়ে গেলো। সকল সমাজে ও জনপদে ইসলামের এ মহাবিপ্লবের প্রভাব ছিলো ব্যাপক ও বিস্তৃত। যখন জাহিলিয়াতের শক্তি ও প্রতাপ ছিলো, আর ইসলাম ছিলো দুর্বল ও শক্তিহীন তখন আল্লাহর দিকে অগ্রসর হওয়ার পথ ছিলো কঠিন ও বিপদসঙ্কুল এবং দুর্গম ও ঝুঁকিবহুল। সেই পথ এখন হলো সহজ-সুগম এবং নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ। জাহেলি সমাজে আল্লাহর আনুগত্য করা যেমন কঠিন ছিলো, এখন ইসলামী সমাজে তেমনি কঠিন হলো আল্লাহর নাফরমানি করা। তখন পাপাচার ও জাহান্নামিয়াতের প্রচার হতো প্রকাশ্যে, এখন তা গোপনে ও সঙ্গোপনে করাও হয়ে গেলো কঠিন। তখন দাওয়াত ইলাল্লাহ ছিলো মহাঅপরাধ, যা চলতো সঙ্গোপনে এবং যার শাস্তি ছিলো ভয়াবহ, কিন্তু এখন দাওয়াত চলতে লাগলো প্রকাশ্যে ও স্বাধীনভাবে। না ছিলো কোন বাদ-প্রতিবাদ, না ছিলো ঘাত-সংঘাত। না ছিলো নির্যাতন-নিপীড়ন, না ছিলো অন্যকিছু। দাওয়াত দেয়া হতো যেমন নির্বিঘ্নে তেমনি তা কবুল করা হতো নির্ভয়ে। কোরআনের ভাষায় (তরজমা)- ‘স্মরণ করো তোমরা ঐ সময়কে যখন ছিলে (সংখ্যায়) অল্প (এবং শক্তিতে) দুর্বল। তোমরা আশঙ্কা করতে যে, মানুষ তোমাদের ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে, অনন্তর তিনি আশ্রয় দান করেছেন এবং আপন সাহায্য দ্বারা তোমাদের সুদৃঢ় করেছেন, আর উত্তম বস্তুসমূহ হতে তোমাদের রিযিক দান করেছেন।’ মানুষকে তারা নির্ভয়ে সৎ কাজের আদেশ দিতেন এবং অসৎ কাজের নিষেধ করতেন। সঠিক অর্থেই তারা আদেশ-নিষেধের দায়িত্ব পালন করতেন নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে। মানুষের স্বভাব ও চিন্তা-বুদ্ধিও পরিবর্তিত হতে লাগলো এবং চেতনে, কিংবা অবচেতনে। তাদের জীবনের সবকিছু ইসলামের আলো দ্বারা উদ্ভাসিত হতে লাগলো, যেমন বসন্তের আগমনে সবুজ-সজীব হয় গাছের পাতা এবং মানুষের হৃদয়। একসময় যে হৃদয় ছিলো নিষ্ঠুর ও নির্দয়, এখন তা হয়ে গেলো কোমল ও সদয়। ইসলামের আদর্শ, বিশ্বাস ও চেতনা হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করলো এবং মানুষের অন্তর্সত্তায় মিশে গেলো। মূল্যবোধ পরিবর্তিত হলো এবং পুরোনো চিন্তা-চেতনা ও মানদণ্ডের স্থান গ্রহণ করলো নতুন চিন্তা-চেতনা ও নতুন মানদণ্ড। জাহিলিয়াত ও তার জীবনদর্শন হয়ে গেলো পশ্চাদমুখিতা, স্থবিরতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্যের আলামত। পক্ষান্তরে ইসলাম ও ইসলামী জীবনদর্শন হয়ে গেলো আধুনিকতা, প্রগতিশীলতা ও প্রাগ্রসরতার প্রমাণ এবং গর্ব ও গৌরবের বিষয়। ফলে সকল জাতি এবং সমগ্র পৃথিবী ধীরে ধীরে ইসলামের নিকটবর্তী হতে লাগলো, যদিও তা ছিলো অননুভূত- ভাবে, যেমন পৃথিবীর মানুষ পারে না তাদের গ্রহের গতি অনুভব করতে। ইসলামের অপ্রতিহত এ প্রভাব প্রকাশ পেয়েছিলো জাতিবর্গের ধর্মে, দর্শনে, সাহিত্যে, সংস্কৃতিতে এবং সভ্যতার সকল অঙ্গনে। মানুষের চিন্তা, বিবেক ও অন্তর্জগতেও এ প্রভাবের স্বাক্ষর ছিলো; এমনকি মুসলিম সালতনাতের অধঃপতনের পর বিভিন্ন জাতির জীবনে যে সকল সংস্কার আন্দোলনের আবির্ভাব ঘটেছিলো তাতেও ইসলামের প্রভাব ছিলো সুস্পষ্ট। ইসলামের মূল প্রাণ ছিলো তাওহীদ ও আল্লাহর একত্বে বিশ্বাস। তাই শিরক ও মূর্তিপূজার নিন্দা-সমালোচনায় সে এমন কঠোর ছিলো এবং এর গোড়ায় এমন জোরদার আঘাত হেনেছিলো যে, শিরক ও মূর্তিপূজার ‘ভাবমূর্তি’ই গুঁড়িয়ে গিয়েছিলো। এমনকি মুশরিকদের কাছেও তা হয়ে পড়েছিলো লজ্জার বিষয়। ফলে একসময় যেখানে তারা মহাউৎসাহে শিরক ও মূর্তিপূজার যুক্তি-দর্শন উপস্থাপন করে বলতো, ‘তিনি কি উপাস্যসকল (প্রত্যাখ্যান করে) এক উপাস্য সাব্যস্ত করছেন! এ তো বড় অদ্ভুত কথা! সেখানে তারাই মূতিপূজার কথা স্বীকার করতে লজ্জাবোধ করতো এবং প্রতিটি ধর্মব্যবস্থায় বিদ্যমান প্রতিমাপূজার যাবতীয় আচার-বিশ্বাসের ‘তাওহীদ-আশ্রয়ী’ বিকল্প ব্যাখ্যা দিতে শুরু করলো। আহমদ আমীন বলেন- ‘খৃস্টধর্মের অনুসারীদের মাঝে এমন কিছু ঝোঁক ও প্রবণতা প্রকাশ পেয়েছিলো যাতে ইসলামের প্রভাব ছিলো সুস্পষ্ট। যেমন একটি সম্প্রদায় যিশুর ঈশ্বরত্ব অস্বীকার করে ত্রিত্ববাদের প্রায় তাওহীদমুখী ব্যাখ্যা পেশ করতো। সেখানে একসময় এমন সংস্কারকও এসেছিলেন যিনি ঈশ্বর ও মানবের মাঝে গীর্জার মধ্যস্থতা এবং গীর্জাপতিদের বিশেষ অধিকারের ধারণা কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। অষ্টম শতাব্দী তথা হিজরী দ্বিতীয় ও তৃতীয় শতকে ফ্রান্সের সিপ্টিমানিয়ায় (ংবঢ়ঃরসধহরধধ) একটি আন্দোলনের অভ্যুদয় ঘটেছিলো যার মূল কথা ছিলো, পাদ্রীদের অধিকার নেই পাপের স্বীকৃতি গ্রহণের। মানুষ মানুষের সামনে পাপ স্বীকার করবে, এর কোন ধর্মীয় ভিত্তি নেই; মানুষ শুধু আল্লাহর সামনে পাপস্বীকার ও ক্ষমা প্রার্থনা করবে। বলাবাহুল্য যে, ইসলামে যেহেতু ‘পোপ’ নেই সেহেতু ‘পাপ স্বীকারের’ও অবকাশ নেই। একই ভাবে খৃস্টীয় অষ্টম ও নবম শতাব্দীতে (হিজরী তৃতীয় ও চতুর্থ শতক) ধর্মীয় চিত্র ও মূর্তি অপসারণের একটি আন্দোলন প্রবলভাবে দানা বেঁধে ওঠে। তারা চিত্র ও প্রতিমার পবিত্রায়নের কঠোর বিরোধী ছিলো। এ আন্দোলন একসময় এতটাই শক্তি ও প্রতিপত্তি অর্জন করেছিলো যে, তৃতীয় লুই, পঞ্চম কনস্টান্টাইন ও চতুর্থ লুই-এর মত প্রবল প্রতাপান্বিত রোমান সম্রাটগণও এর সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে এসেছিলেন। ৭২৬ ও ৩০ খৃস্টাব্দে রোমান সম্রাট তৃতীয় লুই সরকারীভাবে চিত্র ও মূর্তির পবিত্রায়ন নিষিদ্ধ করে ফরমান জারি করেন এবং এটিকে মূর্তিপূজা বলে অভিহিত করেন। পক্ষান্তরে পোপ দ্বিতীয় ও তৃতীয় গ্রেগরী, কনস্টান্টিনোপলের পাদ্রী গ্রেম্যান্স ও সম্রাজ্ঞী ইরীনী ছিলেন চিত্র-উপাসনার সমর্থক। উভয় সমপ্রদায়ের মাঝে এবিষয়ে যে তীব্র দ্বন্দ্ব-বিবাদ হয়েছিলো তার বিশদ আলোচনার অবকাশ এখানে নেই। এখানে আমরা শুধু বলতে চাই, রোমান ও গ্রীক সভ্যতার প্রতীমাপ্রেম ও ভাস্কর্যপ্রীতির খ্যাতি তো জগৎ-জোড়া এবং সেখান থেকেই খৃস্টধর্মে মূর্তিপূজার অনুপ্রবেশ, এমনকি একসময় তা প্রবলভাবে শিকড় গেড়ে বসেছিলো। সুতরাং সেখানে প্রতীমাবিরোধী এই প্রবল আন্দোলন নিঃসন্দেহে একথা প্রমাণ করে যে, এটা ছিলো ইসলামের মূর্তিবিনাশী ভূমিকা ও তাওহীদী চেতনারই প্রতিধ্বনি, যা ইসলামের দাওয়াত ও তাবলীগের মাধ্যমে মুসলিম স্পেন থেকে পাশ্চাত্বে পৌঁছেছিলো। বেশ কিছু ঐতিহাসিক এ সত্য স্বীকারও করেছেন যে, চিত্র ও প্রতীমাবিরোধী আন্দোলন ছিলো ইসলাম দ্বারা প্রভাবিত। এ বক্তব্যের সমর্থনে তারা উল্লেখ করেছেন যে, টুরীনের বিশপ ক্লেডিয়াস (পষধধফরঁং) যিনি ৮২৮ খৃস্টাব্দ মোতাবেক ২১৩ হিজরীতে নিযুক্তি লাভ করেন এবং যিনি তার বিশপ-অঞ্চলে ক্রশ উপাসনা নিষিদ্ধ করেছিলেন এবং ক্রশ জ্বালিয়ে দেয়ার আদেশ জারি করেছিলেন তার জন্ম ও প্রতিপালন হয়েছিলো মুসলিম স্পেনে। আর ইসলামের চিত্র ও মূর্তিবিদ্বেষ তো সর্বস্বীকৃত। বুখারী ও মুসলিম হযরত আয়েশা (রা) হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক সফর থেকে প্রত্যাবর্তন করলেন, আমি জানালায় ছবিওয়ালা পর্দা টানিয়েছিলাম। তিনি তা দেখে ছিঁড়ে ফেললেন, তাঁর মুখমণ্ডল বিবর্ণ হয়ে গেলো। তিনি বললেন, হে আয়েশা, কেয়ামতের দিন কঠিনতম আযাব হবে তাদের যারা আল্লাহর সৃজন-এ সাদৃশ্য গ্রহণ করবে। হযরত আয়েশা (রা) বলেন, তখন আমি তা কেটে একটি বা দু’টি বালিশ বানালাম। এসম্পর্কিত হাদীছ প্রচুর। ইউরোপের ধর্মীয় ইতিহাস এবং খৃস্টীয় গীর্জার সমগ্র কার্যক্রম যদি গভীরভাবে অধ্যয়ন করা হয় তাহলে সমকালের সুসংহত বিশপীয় ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহকারী সংস্কারকদের উপর ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রভাব সুস্পষ্টরূপেই অনুভব করা যায়। স্বয়ং মার্টিন লুথারের সংস্কার আন্দোলন ছিলো ইসলামের প্রভাব গ্রহণের স্পষ্টতম প্রমাণ, যদিও তাতে যথেষ্ট ত্রুটি-বিচ্যুতি ছিলো। ঐতিহাসিকগণ পরিষ্কার ভাষায় স্বীকার করেছেন যে, আন্দোলনের প্রাণপুরুষ লুথারের জীবনে ইসলামের বিভিন্ন নীতি ও শিক্ষার প্রভাব ছিলো। শুধু ধর্মই নয়, বরং ইউরোপের সমগ্র জীবন ও সভ্যতার উপর ইসলামের বিপুল প্রভাব ছিলো। রবার্ট ব্রিফল্ট (ৎড়নবৎঃ নৎরভধঁষঃ) তার ঃযব সধশরহম ড়ভ যঁসধহরঃু গ্রন্থে বলেন- ‘ইউরোপের উন্নতি ও অগ্রগতির এমন কোন দিক নেই যেখানে ইসলামী সভ্যতার বিরাট অবদান নেই। বস্তুত ইউরোপীয় জীবনের উপর ইসলামের বিপুল প্রভাবক ভূমিকা রয়েছে।’ একই গ্রন্থের অন্যত্র তিনি বলেন- ‘প্রকৃতি বিজ্ঞান (যাতে মূল অবাদন আরবদের), এটাই শুধু ইউরোপে নবজাগরণ সৃষ্টি করেনি, বরং সামগ্রিকরূপেই ইসলামী সভ্যতা ইউরোপের জীবনে সুগভীর ও বহুমুখী প্রভাব বিস্তার করেছে এবং এর শুভ সূচনা হয়েছে তখন থেকে যখন ইসলামী সভ্যতার প্রথম আলোকরশ্মি ইউরোপের উপর পড়েছে।’ একই ভাবে মূর্তিপূজক ভারতীয় জাতিবর্গের নীতি ও চরিত্র, সমাজ ও সংস্কৃতি এবং আইন ও বিধানের ক্ষেত্রেও ইসলামী শরিয়া ও বুদ্ধিবৃত্তির বিপুল প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এক্ষেত্রে নারীর অধিকার ও মর্যাদার স্বীকৃতি এবং বিভিন্ন শ্রেণী ও সমপ্রদায়ের মাঝে সাম্যনীতির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ্য, যা ইসলামী সভ্যতা ও জীবনবিধানের একক বৈশিষ্ট্য এবং ইসলামই যা সর্বপ্রথম ঘোষণা করেছে। ভারতবর্ষে যখন ইসলামের বিজয়াভিযান শুরু হলো এবং ভারতীয় জাতিবর্গ মুসলিম জাতির সংস্পর্শে আসতে শুরু করলো তখন থেকেই ভারতীয় সমাজজীবনে এর প্রভাব অব্যাহতরূপে বৃদ্ধি পেয়ে এসেছে। প্রসিদ্ধ ভারতীয় গবেষক এবং মিসরে ভারতের সফল রাষ্ট্রদূত শ.স. ঢ়ধহরশশধৎ ভারতীয় জনগোষ্ঠীর মনমানস এবং তাদের ধর্মবিশ্বাসে ইসলামের তাওহীদ ও একত্ববাদের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে বলেন- ‘এটা সুস্পষ্ট ও সুস্বীকৃত যে, হিন্দুধর্মে তখন ইসলামের প্রভাব ছিলো সুগভীর একং হিন্দুমানসে ঈশ্বর-উপাসনার চিন্তা ইসলামেরই অবদান। তখনকার চিন্তানায়ক ও ধর্মপুরুষগণ উপাস্যদের বিভিন্ন নাম দিলেও তারা ঈশ্বরের উপাসনার আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছিলেন যে, উপাস্য মাত্র একজন এবং তিনিই উপাসনার একক অধিকারী। তাঁরই কাছে মুক্তি ও সৌভাগ্য প্রার্থনা করতে হবে। ইসলামী যুগে ভারতবর্ষে যে সকল ধর্ম ও সংস্কারপ্রচেষ্টা আত্মপ্রকাশ করেছে সেগুলোর মাঝে উপরোক্ত প্রভাব ছিলো সুপ্রকাশিত। যেমন ভক্তিধর্ম (ইযধমঃর) এবং গুরু কবিরের ধর্মমত।’ (অ ঝধৎাবু ড়ভ ওহফরধহ ঐরংঃড়ৎু, ঢ় ১৩২) ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওয়াহের লাল নেহরু তার উরংপড়াধৎু ড়ভ ওহফরধ গ্রন্থে বলেন- উত্তর-পশ্চিম ভারতের দিক থেকে বিজেতাদের আগমন এবং ইসলামের প্রবেশ, ভারতের ইতিহাসে এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ভারতীয় সমাজে যে ব্যাধি ও পচন ছড়িয়ে পড়েছিলো, ইসলামই তা প্রকাশ করেছে। বর্ণবিভেদ ও অচ্ছুত প্রথা এবং বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার প্রবণতা, যাতে ভারতবর্ষ তখন আচ্ছন্ন ছিলো, ইসলামই তা চি?হ্িনত করেছে। ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব যা ছিলো মুসলিম জাতির জীবন ও বিশ্বাসের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ তা ভারতীয়দের মনমানসে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিলো এবং এর প্রভাব ঐসকল হতভাগ্য জনগোষ্ঠীর মাঝেই ছিলো সর্বাধিক, ভারতীয় সমাজ যাদের সাম্য ও মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রেখেছিলো। আধুনিক যুগের বিদগ্ধ লেখক ঘ. ঈ. গবযঃধ তার ওহফরধহ ঈরারষরুধঃরড়হ অহফ ওংষধস গ্রন্থে বলেন- ‘ভারতবর্ষে ইসলাম এমন এক আলোর মশাল নিয়ে এসেছিলো যা মানুষের জীবন থেকে অন্ধকার দূর করেছে, যে অন্ধকার প্রাচীন সভ্যতাগুলোর পতনকালে জেঁকে বসেছিলো। কিছু উত্তম আদর্শ তখন চিন্তানৈতিক বিশ্বাসের রূপ লাভ করেছিলো। বস্তুত ইসলামের বিজয়াভিযানের প্রভাব রাজনৈতিক ক্ষেত্রের চেয়ে চিন্তার জগতেই ছিলো অধিকতর ব্যাপক ও শক্তিশালী, যেমনটি হয়েছিলো অন্যান্য ভূখন্ডেও। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে এখানে (ভারতবর্ষে) ইসলামের ইতিহাস রাজশাসনের সাথে যুক্তরূপে পরিচিত হয়ে এসেছে। ফলে ইসলামের মূল সত্য পর্দার আড়ালে রয়ে গেছে এবং ইসলামের মহান দান ও অবদান লোকচক্ষুর আড়ালে রয়ে গেছে।’ মোটকথা, ইসলাম ও নবুয়তে মুহম্মদির আবির্ভাবের পর সভ্য পৃথিবীর কোন ধর্ম ও সমাজ এ দাবী করতে পারবে না যে, তা ইসলাম দ্বারা কমবেশী প্রভাবিত হয়নি। জীবন ও সভ্যতা এবং ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহ মহাকালের পথে যেভাবে চলছিলো সেভাবেই যদি চলতে থাকতো এবং মানবজাতি যদি সেই মহান জামা‘আতের নেতৃত্বেই পরিচালিত হতে থাকতো যাদের উত্থানই হয়েছিলো কল্যাণের পথে মানবসভ্যতার নেতৃত্বদানের জন্য তাহলে মানবজাতির ইতিহাস অবশ্যই এই কলঙ্কিত রূপ থেকে অনেক ভিন্ন হতো যা এখন আমাদের সামনে রয়েছে, যাতে লেখা আছে শুধু মানবতার দুর্ভোগ ও দুর্যোগের মর্মন্তুদ কাহিনী। তখন আমাদের সামনে থাকতো এমন এক সুন্দর সমুজ্জ্বল ইতিহাস যা নিয়ে গোটা মানবজাতি গর্ব করতো এবং যা মানবতার চক্ষু জুড়িয়ে দিতো। কিন্তু তাকদীরের লিখন অন্যকিছু লিখে দিলো এবং স্বয়ং মুসলিম উম্মাহর জীবনেই শুরু হয়ে গেলো অবক্ষয় ও অধঃপতন।
শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা