রবিউল আউয়াল ১৪৪০হিঃ (৩/৭)

হযরত আলী নাদাবীর পাতা

ডাক দিয়ে যায় মুসাফির!

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

 

হযরত মাওলানা সৈয়দ আবুল হাসান আলী নাদাবী রহ-এর মধ্যপ্রাচ্যসফরের রোযনামচা

ধারাবাহিক-৪

 

আল্লামা যাহিদ কাওছারী-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ

এখান থেকে আমরা সুপ্রসিদ্ধ লেখক-গবেষক আল্লামা যাহিদ কাওছারী-এর সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে গেলাম। তিনি শায়খ ছাবরীর সহপাঠী ও বন্ধু। আল্লামা কাওছারী অত্যন্ত বিনয় ও সৌজন্যের সঙ্গে মিলিত হলেন। তাঁর বিনয়, ন¤্রতা ও হাস্যস্মিতি আমাদের, ওলামায়ে হিন্দের কথা স্মরণ করিয়ে দিলো। আমরা বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনায় মশগুল হলাম। বেশীর ভাগ আলোচনা ছিলো মাওলানা শিবলী নো’মানী ও সৈয়দ সোলায়মান নদবী রহ.-এর রচিত গ্রন্থ সীরাতুন্-নাবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর তুর্কী তরজমা সম্পর্কে, মাওলানা ইউসুফ বিন্নোরী রহ.-এর কর্ম ও কীতি এবং হিন্দুস্তানে সংরক্ষিত বিভিন্ন পা-ুলিপি সম্পর্কে।

তিনি আমাকে তাঁর কিছু রচনা উপহার দিলেন। দুঃখের বিষয়, ধর্মীয় বিবাদ-বিতর্ক ও বাহছের এখন আমার না রুচি আছে, না আগ্রহ। ইমামদের মর্যাদা হননে বা পক্ষসমর্থনে যা কিছু লেখা হয়েছে, সে সম্পর্কে আমার জানাশোনাও কম। নইলে তাঁর সঙ্গে একটা উপভোগ্য মজলিস হওয়ার সুযোগ ছিলো।

কিছুক্ষণ পর আমরা ওঠার জন্য তাঁর অনুমতি চাইলাম। আল্লামার যে বিষয়টি আমাদের ভালো লেগেছে তা হলো তাঁর বিনয় ও সরলতা, উদ্যম ও জ্ঞানব্যাপকতা এবং এরূপ বার্ধক্যের মধ্যেও তাঁর লেখালেখি ও অধ্যয়নমনস্কতা। বার্ধক্যের এ বয়স তো সাধনা ও জ্ঞান-গবেষণার কষ্ট সহ্য করতে পারে না!

২৭/৪/৭০ হি. ৪/২/৫১ খৃ. রোববার

ফৌজদারি আদালতে ইখওয়ানের মামলা পর্যবেক্ষণ

আব্দুল্লা আকীল ইরাকী এলেন। পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচী অনুযায়ী আমরা ফৌজদারি আদালত পরিদর্শনে গেলাম। আজ ইখওয়ানের গ্রেফতারকৃতদের মামলার শুনানি ছিলো এবং অভিযুক্তদের পক্ষে উস্তায সাঈদ রামাযানের বক্তব্য রাখার কথা ছিলো। ইচ্ছে ছিলো, কোন মিশরীয় আদালতের মামলা পরিচালনার ধরন ও প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করবো। কারণ জীবনধারা ও রাষ্ট্রব্যবস্থার এটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক।

আমরা আদালতচত্বরে পৌঁছার পর কয়েকজন আর্দালী আমাদের হালকা তল্লাশি নিয়ে প্রবেশের অনুমতি দিলো। আদালতকক্ষে বিপুলসংখ্যক ছাত্রযুবক ও নারীর উপস্থিতি ছিলো। আইনজীবীদের সমাগমও ছিলো যথেষ্ট। আদালতের আর্দালী ও প্রহরীদের কাছ থেকে যে সৌজন্যমূলক আচরণ ও সম্ভাষণ পেয়েছি তা আমাদের দেশে আদালতপ্রাঙ্গণে কল্পনাও করা যায় না। সেখানে তো আমরা অপ্রসন্ন চেহারা ও ভীতিপ্রদ আচরণের সঙ্গেই পরিচিত। পক্ষান্তরে এখানে দেখি, আর্দালী ও প্রহরী হাসিমুখে বলছে, ‘আসুন, আপনার কল্যাণ হোক’। ‘এদের জায়গা দাও, এরা আমাদের মেহমান!’

আসল কথা হলো আরবীয় স্বভাব ও প্রকৃতির মধ্যেই রয়েছে কোমলতা, প্রসন্নতা ও অতিথিপরায়ণতা। কোন অবস্থাতেই এটা তাদের স্বভাব থেকে পৃথক হয় না।

জুরী ও বিচারকদের মঞ্চের উপরে দেখি, বড় বড় হরফে লেখা রয়েছে কোরআনের আয়াত, ‘আর যখন তোমরা বিচার করো তখন ন্যায়পরতার সঙ্গে বিচার করো।’(নিসা, ৫৮)

মনে মনে বললাম, হায়, এটাই যদি হতো মুসলিম দেশগুলোর বিচার ও ফায়ছালার বুনিয়াদ! হায়, এ আয়াত যদি -এখন যেমন দেখতে পাচ্ছি- বিচারকদের মাথার পিছনে না থেকে তাদের চোখের সামনে থাকতো!

তিনজন জুরী আদালতী পোশাকে মঞ্চে আসন গ্রহণ করলেন। তারপর অভিযুক্তদের আনা হলো। তারা কাঠগড়ায় দাঁড়ালো।

সাঈদ রামাযানের আবেদনপূর্ণ বক্তব্য

সরকারপক্ষীয় উকিল একপাশে বসলেন। অন্যদিকে সাঈদ রামাযান ইখওয়ানের আইনজীবী হিসাবে বক্তব্য রাখার জন্য দাঁড়ালেন। অত্যন্ত জাদুময় ও সাহসী বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি মামলা উপস্থাপন করলেন। হক ও বাতিলের চিরন্তন দ্বন্দ্ব এবং নবুয়তের মহান শিক্ষা ও আদর্শের সঙ্গে শয়তানের চিরবৈরিতা ও বিদ্বেষের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে তিনি আলোচনার সূত্রপাত করলেন। তারপর ইসলামী খেলাফতের স্বর্ণকাল ও অবক্ষয়যুগ-উভয়ের চিত্র তুলে ধরে তাতারী হামলা ও ক্রুশেডের আগ্রাসন সম্পর্কেও আলোচনা করলেন। তারপর পর্যায়ক্রমে ঊনিশ শতকের ইউরোপীয় ক্রুশেড -অভিযান, ইইদি-আগ্রাসন এবং মুসলিম বিশ্বের উপর তার ভয়াবহ বিপদের চিত্র তুলে ধরলেন। তারপর বললেন, সময়ের এ নাযুক প্রেক্ষাপটে ইখওয়ানের জন্ম ও উত্থান সম্পন্ন হয়েছে। তিনি বললেন, মুসলিম উম্মাহকে ইহুদি-খৃস্টান অক্ষশক্তির বিপদ থেকে রক্ষার মহান উদ্দেশ্যে ইখওয়ান নিবেদিত। তারা মহান মোজাহিদীনের অবস্থানে রয়েছে; অপরাধ ও চক্রান্তের সঙ্গে তাদের দূরতম সম্পর্কও নেই।

তিনি তাঁর পুরো বক্তব্য আয়াত ও হাদীছ দ্বারা সুপ্রমাণিত ও সুসংহত করছিলেন। ফলে আদালতের পুরো বিচারিক পরিবেশ ইসলামী আবেগ-উদ্দীপনার পরিবেশে রূপান্তরিত হলো। তাতে আল্লাহর ভয়ে উপস্থিত সবার হৃদয় যেন বিগলিত হলো এবং চক্ষু অশ্রুসিক্ত হলো। সবাই যেন ভুলে গেলো, তারা আদালতের বিচারকক্ষে রয়েছে; অবস্থা থেকে বরং মনে হলো, সবাই যেন দ্বীনের কোন মাহফিলে দিল নরমকরা বয়ানের শ্রেতা! বস্তুত আইনজীবী হিসাবে এটা সাঈদ রামাযানের পেশাগত যোগ্যতা ও ঈমানি শক্তির যেমন প্রমাণ তেমনি প্রতিকূল পরিবশকে অনুকূল করার অসাধারণ কুশলতারও প্রমাণ। ইখওয়ানের চিন্তা, আদর্শ ও বিপ্লবের প্রতি তিনি কতটা নিবেদিত, আজ তা আরো পরিষ্কার হলো। তিনি যখন জুরীদের হৃদয় ও বিবেকের প্রতি দয়া ও ন্যায়পরতার উদ্দাত্ত আহ্বান জানালেন এবং তাদের ভিতরের ঈমানী চেতনা জাগ্রত করার প্রয়াস পেলেন -যাদের মধ্যে কিছু না কিছু ঈমানের স্ফুলিঙ্গ রয়েছে- তখন পুরো সমাবেশ ভাবে আবেগে উদ্বেলিত হয়ে উঠলো। অবশেষে যখন তিনি অভিযুক্তদের উদ্দেশ্যে আবেগময়ী ভাষায় দৃঢ়তা ও অবিচলতা এবং ছবর ও ধৈর্যের আহ্বান জানালেন এবং আয়াত ও হাদীছ উল্লেখ করে তাদের সান্ত¡না জ্ঞাপন করলেন আদালতকক্ষে কান্নার রোল পড়ে গেলো। এভাবে এক অভাবিতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হলো। বিশেষ করে কোমল হৃদয়ের নারীদের অবস্থা ছিলো সত্যি সত্যি বড়ই মর্মবিদারক। আদালতকক্ষে যা দেখলাম এবং শুনলাম, আমাদের জন্য তা ছিলো সম্পূর্ণ নতুন এক অভিজ্ঞতা। অত্যন্ত ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আমরা আদালতকক্ষ থেকে বের হয়ে এলাম।

 

হাসানুল বান্নার পিতার সান্নিধ্যে

আদালতচত্বর থেকে আমরা সোজা শহীদ হাসানুল বান্নার পিতা শায়খ আহমদ বিন আর্ব্দু -রহমান বান্নার খেদমতে উপস্থিত হলাম। হিন্দুস্তানে আমরা তাঁকে চিনতাম আলফাতর্হু-রাব্বানী কিতাবের লেখক এবং হাদীছের নিবেদিতপ্রাণ খাদেমরূপে। এখানে এসে জানলাম, তিনি হলেন শহীদ হাসানুল বান্নার মহান পিতা। সমাজ-সংস্কৃতির মধুর অভিজ্ঞতা এই যে, অনেকে তো পিতার নামে পরিচিতি লাভ করেন, কিছু লোক এমন আছেন যারা তাদের মহান সন্তানের পরিচয়ে নন্দিত হন।

অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা তাঁর ঘরে পৌঁছলাম। দরজায় কড়া নাড়তেই তিনি স্বয়ং বের হয়ে এলেন। শ্রদ্ধায় অভিভূত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আমরা তাঁর দিকে তাকিয়েই থাকলাম। এ ভাবনায় মন প্রাণ শীতল হয়ে গেলো যে, আমরা শহীদ ইমাম ও মুরশিদ হাসানুল বান্নার মহান পিতার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। বয়সের ভার এবং সময়ের দুর্যোগ তাঁকে যেন আরো বেশী বার্ধক্যে নিপতিত করেছে। জ্ঞানসাধনা ও গ্রন্থরচনার জন্য বিনিদ্র রাত যাপনের ছাপ মুখম-লে স্পষ্ট। অধ্যবসায়ের একটি জ্যোতির্বলয় যেন তাঁর সত্তাকে বেষ্টন করে আছে।

বসার জন্য তিনি আমাদের একটি স্বল্পপরিসর কামরায় নিয়ে গেলেন, যা প্রচুর কিতাবে পরিপূর্ণ। তিনি আমাদের জানালেন, মুসনাদে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল-এর পর তিনি মুসনাদে ইমাম শাফেঈ-এর পরিমার্জনের কাজ করেছেন। মুসনাদে আবু দাউদ তায়ালেসীর উপরও তিনি কাজ করেছেন। তিনি আরো জানালেন, মুসনাদে তায়ালেসী-এর হিন্দুস্তানী নোসখা তার হস্তগত হয়েছে। তিনি তাঁর লেখায় হিন্দুস্তানী আলিমদের ইলমি অবদান ও কীর্তি সম্পর্কে যে সকৃতজ্ঞ আলোচনা করেছেন, প্রসঙ্গক্রমে তিনি আমাদের সে সম্পর্কেও অবহিত করলেন। তারপর অতিথি আপ্যায়নের উদ্দেশ্যে তিনি আরবীয় কাহওয়া আনালেন। আমরা সানন্দে তা পান করলাম।

পিতার মুখে মহান সন্তানের কাহিনী!

আমরা আরয করলাম, যদি কষ্ট না হয়, আমরা আপনার মুখে আপনার মহান শহীদ পুত্র সম্পর্কে কিছু কথা শুনতে চাই, যিনি এখন শুধু আপনার নন, বরং ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর হারানো সম্পদ। আপনার মুখেই শুনতে চাই, তাঁর শৈশব, কৈশোর ও যৌবন সম্পর্কে। কারণ আল্লাহ বলেছেন- ولا يــنـبـئـك مثل خبير খাবীরের মত খবর তোমাকে কেউ দিতে পারবে না!

তিনি বললেন, আপনাদের সম্মানে; আপনাদের মুহাব্বাতে অবশ্যই বলবো।

তার তিনি মনের দুয়ার খুলে দিয়ে খুব বিশদভাবে শহীদ পুত্রের জীবনকাহিনী শুনালেন। তিনি বলেন, বহু দিন কোন সন্তান না হওয়ায় অন্তরে সন্তান লাভের আকাক্সক্ষা বড় তীব্র হলো। তখন আল্লাহর কাছে দু‘আ করলাম যেন আমাকে একটি নেক পুত্র সন্তান দান করেন এবং তাকে উত্তম প্রতিপালন দান করেন। একবার মসজিদে দেখি, একটি ছোট্ট ছেলে বড় সুন্দর করে নামায পড়ছে! দেখে খুব ভালো লাগলো। তখন মনে মনে বললাম, সেও যেন এভাবে নামায পড়ে!

অনেক দু‘আ-প্রার্থনার পর পুত্র সন্তান হলো, আর আমি তার নাম রাখলাম হাসান। কারণ বিবাহের পর আমার আম্মাজান তার পুত্রবধুকে কেন জানি

‘ইয়া উম্মাল হাসান’ এই কুনিয়াতে ডাকতেন।

চার বছর বয়সে তাকে মক্তবে দাখেল করে দিলাম। আর সে এক মক্তব থেকে আরেক মকক্তবে যেতে থাকে। শেষ পর্যন্ত সাতাশ পারা হেফয হয়। তখনো তিন পারা বাকি।

আমার তামান্না ছিলো, তাকে দামনাহূর এলাকার প্রসিদ্ধ শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিদ্যালয়ে ভর্তি করাবো। কিন্তু সমস্যা ছিলো এই যে, সেখানে ভর্তির শর্ত হলো পুরো হাফেয হওয়া।

এমনিতে সে ছিলো ন¤্র ও অনুগত ছেলে। একদিন তাকে ডেকে বললাম, বাবা, আমার তো দৃঢ় ইচ্ছা, তোমাকে শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিদ্যালয়ে ভর্তি করাই। অথচ তুমি হেফয সম্পূর্ণ করছো না! এখন তোমার কী ইচ্ছা বলো?!

সে বললো, আপনার ইচ্ছা পূর্ণ করুন, আমি সবসময় আপনার আদেশের অনুগত। সে তার কথা রাখলো এবং অল্প সময়ে কোরআনের হিফয সম্পূর্ণ করলো এবং উক্ত শিক্ষক প্রশিক্ষণ বিদ্যালয়ে দাখেল হলো।

বালেগ হওয়ার আগেই সে অত্যন্ত ইবাদাতমুখী হয়ে উঠেছিলো। ইবাদাতে তার উদ্যম ও শক্তি এমন ছিলো যে, বড় ও বয়স্কদেরও ছাড়িয়ে যায়। তবে আমি পেরেশান হলাম একারণে যে, রজব, শা‘বান ও রামাযান, তিন মাস সে রোযা রাখতো। আমি বললাম, বাবা, তুমি তো এখনো বড় হওনি; রোযাও তোমার উপর ফরয হয়নি; তদুপরি এত দীর্ঘ নফল রোযা রেখে কেন নিজেকে কষ্ট দিচ্ছো!

সে বললো, আব্বাজান, রোযার প্রতি আমার অন্তরের খুব অনুরাগ। আর আমার কোন কষ্ট হয় না।

একথা শুনে আমি আর কিছু বললাম না।

সে আমার মসজিদের দরসে নিয়মিত উপস্থিত হতো। দাওয়াতি জাযবা ও উদ্দীপনা ছিলো তার প্রবল। উপদেশ দেয়া,  সৎ কাজের আদেশ এবং মন্দ কাজের নিষেধ ছিলো তার প্রিয় বিষয়। তার এ সময়ের একটি অবাক করা ঘটনা এই যে, একবার সে মাহমূদিয়া অঞ্চলে নদীর তীরে বেড়াতে গেলো। তখন দেখে, হৈহুল্লোড় কিসিমের একদল যুবক নৌকা ভ্রমণে বের হয়েছে। সঙ্গে রয়েছে নগ্ন নারীমূর্তি। এটা তার সহ্য হলো না। সঙ্গে সঙ্গে থানায় গিয়ে দায়িত্বরত পুলিশ অফিসারকে বললো, শরীয়াত ও সামাজিক কোন দৃষ্টিতেই এটা তো সঙ্গত নয়। এখনই মূর্তিটা ভাঙ্গা দরকার।

বাচ্চা ছেলের জোশ দেখে, পুলিশ অফিসার বেশ কৌতুক বোধ করলেন। শেষে তাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য সঙ্গে একজন পুলিশ দিয়ে বললেন, যাও, যদি ওরা রাজী হয়, তো মূর্তি ভেঙ্গে ফেলো। তিনি ভেবেছিলেন, ওরা তো আর রাজী হবে না! সুতরাং কোন ঝামেলাও হবে না।

কিন্তু আল্লাহর কী শান! সে গেলো এবং দিলের দরদ-ব্যথা নিয়ে যুবকদের বুঝালো যে, এটা হারাম! এজন্য আখেরাতে কঠিন শাস্তি হবে। যুবকদের অন্তরে আল্লাহর ভয় জেগে উঠলো, আর তারা নিজের হাতে মূর্তি ভেঙ্গে ফেললো!

এখানে (শায়খ যাহরান নামে) একজন আলিমে বা-আমল বুযুর্গ ছিলেন। হাসানকে আমি পরামর্শ দিলাম ঐ বুযুর্গের ছোহবতে আসা -যাওয়া ও ওঠা-বসা করার জন্য। এতে একসময় শায়খের সঙ্গে তার অত্যন্ত গভীর আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা তার জীবন, চরিত্র ও ব্যক্তিত্বের জন্য বহুমুখী কল্যাণ বয়ে আনে।

শিক্ষকপ্রশিক্ষণ বিদ্যালয়ে যখন তার শেষ বছর ছিলো তখন দারুল উলূম কায়রো, আরবী-ইসলামী জ্ঞান ও শাস্ত্রের পাশাপাশি আধুনিক বিভিন্ন জ্ঞান-বিজ্ঞানও পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছিলো। আরবী ও ইসলামী বিষয়ে তো দারুল উলূম আগে থেকেই বেশ অগ্রসর ছিলো। তো দারুল উলূমের শিক্ষার মান ও সুখ্যাতি, বিশেষ করে পাঠ্যসূচীর আধুনিকায়নের বিষয়টি বিবেচনা করে আমি তাকে সেখানে দাখেল করার ইচ্ছা করলাম। এ বিষয়ে তার সঙ্গে আমি আলোচনা করলাম। তখন সিদ্ধান্ত হলো যে, এ বছরটি সে বর্তমান শিক্ষাকার্যক্রম সমাপ্ত করা এবং দারুল উলূমের দাখেলার প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণে ব্যয় করুক।

সে আমাকে বললো, আব্বাজান, আপনি তো আমাকে শরী‘আহ- ভিত্তিক জ্ঞান, তাফসীর, হাদীছ, ফেকাহ প্রভৃতি বিষয়ে প্রস্তুত করুন, বাকি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে প্রস্তুত হওয়া, সেটা আমি নিজ দায়িত্বেই করে নিবো।

সে তার কথা অনুযায়ী কাজ করলো এবং পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে কায়রো গেলো। পরীক্ষার পূর্ব-রাত্রিতে সে বেশ উৎকণ্ঠার মধ্যে ছিলো। কারণ তার মনে হচ্ছিলো, বীজগণিতে সে দুর্বল। পরীক্ষায় হয়ত ...।

্এরূপ উৎকণ্ঠার মধ্যেই তার চোখ লেগে গেলো। তখন সে দেখে, নূরানী চেহারার একজন শায়খ তাকে বলছেন, সুস্থির হও হে হাসান! পরীক্ষার প্রশ্ন আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি।

এই বলে শায়খ তাকে নিয়ে একটি নদী পার হলেন এবং বইয়ের পৃষ্ঠা নির্ধারণ করে বলে দিলেন, এটা ভালো করে বোঝো এবং আত্মস্থ করো।

শায়খ আহমদ আবদুর-রহমান বলেন, আমার ছেলে হাসান আল্লাহর নামে কসম করে বলতো, ঘুম থেকে জেগে সে দেখে, ঐ বলে দেয়া অংশটি তার মুখস্থ ও আত্মস্থ হয়ে গিয়েছে। পরীক্ষায় ঠিক ঐ প্রশ্নগুলোই এলো এবং সহজেই সে কৃতকার্য হলো।

কায়রোর শিক্ষাকালে প্রত্যেক পরীক্ষায় অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে সে প্রথম স্থান অধিকার করতো। ফলে তার এক সহপাঠী তার প্রতি অত্যন্ত ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ে। সে ছিলো স্থানীয় এবং হাসানের চেয়ে দশবছরের বড়।

ঈর্ষা ও বিদ্বেষ তাকে এতটাই ক্ষীপ্ত করে তুললো যে, একবার সে ‘তেযাব’ ও বিষ নিয়ে এলো। তার পরিকল্পনা ছিলো, ঘুমন্ত অবস্থায় তেযাব নিক্ষেপ করে হাসানের চেহারা ঝলসে দেবে এবং চোখ নষ্ট করে দেবে; আর সম্ভব হলে বিষ প্রয়োগ করে মেরেই ফেলবে। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় তেযাব লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে কপালে পড়লো, আর বিষ প্রয়োগের চেষ্টাও ব্যর্থ হলো। হাসান তেযাবের যন্ত্রণায় ঘুম থেকে জেগে আর্তনাদ করে উঠলো, আর ছেলেটি পালিয়ে গেলো। ঘটনা শেষে থানা-পুলিশ পর্যন্ত গড়ালো। কিন্তু হাসান এই বলে অপরাধীকে মাফ করে দিলো, আল্লাহ আমাকে এ জঘন্য চক্রান্ত থেকে রক্ষা করেছেন, এর শোকর ও কৃতজ্ঞতারূপে আমি তাকে মাফ করে দিচ্ছি, আর আল্লাহর কাছে আখেরাতে এর প্রতিদান আশা করছি।  

শেষ পরীক্ষায় হাসান অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে তারকা নম্বর পেয়ে কৃতকার্য হলো এবং ইসমা‘ঈলিয়া অঞ্চলের এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরূপে নিযুক্ত হলো।

শিক্ষকতার পাশাপাশি সেখানে সে দাওয়াতি মেহনত শুরু করে এবং আলইখওয়ানুল মুসলিমূন প্রতিষ্ঠা করে। বিভিন্ন মসজিদে, এমনকি কফি- হাউজে গিয়ে সে দ্বীনের দাওয়াত পেশ করতো এবং আখলাক ও শরী‘আতবিরোধী কার্যকলাপের নিন্দা করতো। তার ভাষা ও বক্তব্য ছিলো এত দরদমাখা ও আবেদনপূর্ণ যে, মানুষের দিলে খুব আছর করতো এবং তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তার দাওয়াত কবুল করতো।

ধীরে ধীরে তার দাওয়াতি তৎপরতা জোরদার হতে থাকে এবং আন্দোলনের পরিধি বিস্তৃত হতে থাকে। ফলে একটি সুপরিসর ভবনে এর জন্য কেন্দ্র স্থাপন করা হলো।

ইসমা‘ঈলিয়া থেকে অন্যান্য জেলায়ও সে যাতায়াত করতে লাগলো। ইসকান্দারিয়া ও সুয়েজসহ যেখানেই সে গিয়েছে, একজন উদ্যমী ও দরদী দা‘ঈ-রূপেই নিজ দায়িত্ব পালন করেছে এবং সর্বত্র তার ব্যক্তিত্বের বিরাট প্রভাব পড়েছে।  বিভিন্ন স্থানে ইখওয়ানের ভিত্তি স্থাপন করা, দাওয়াতকে সংহত ও সংগঠিত করা, আর জ্বালাময়ী বক্তৃতা করা, এই ছিলো তার দিন-রাতের নিমগ্নতা। আল্লাহ তা‘আলার গায়বি মদদও তার শামিলে হাল ছিলো। ফলে অল্প সময়ের মধ্যে মিশরের সর্বত্র ইখওয়ানের শাখা-প্রশাখার বিস্তীর্ণ জাল স্থাপিত হয়ে গেলো। এই সময়ের মধ্যে জীবন, সমাজ ও চরিত্রের উপর ইখওয়ান ও তার দাওয়াতি মেহনতের কী প্রভাব ও প্রতাপ সৃষ্টি হয়েছে তা তো আপনারাই ভালো জানেন।

এরপর আমার ছেলে দেশের শিল্প ও অর্থব্যবস্থার প্রতি মনোযোগ নিবদ্ধ করে। কারণ সে পরিষ্কার দেখতে পায়, দেশের শিল্পখাত, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতি বিদেশীদের একচেটিয়া দখলে চলে গিয়েছে; বিশেষ করে খনিজসম্পদ সম্পূর্ণরূপে তাদের কুক্ষিগত। এভাবে তারা মানুষের রক্ত শোষণ করছে এবং গরীব জনগণ আরো গরীব হয়ে চলেছে।

এ পরিস্থিতির মোকাবেলার জন্য আমার ছেলে বিভিন্ন শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয় এবং উচ্চজ্ঞানসম্পন্ন প্রকৌশলী তৈরীর ব্যবস্থা করে, যাতে তারা দেশের খনিজসম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে বিদেশীদের স্থান গ্রহণ করতে পারে এবং মিশর তার নিজের সম্পদের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

বলাবাহুল্য, তার এ প্রজ্ঞাপূর্ণ উদ্যোগ ও সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ উপনিবেশবাদী শক্তিগুলোকে ক্ষিপ্ত করে তোলে। ইউরোপীয় কোম্পানীগুলোর এমন গাত্রদাহ শুরু হয় যে, হাসানুল বান্নার বিরুদ্ধে তারা বহুমুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় এবং ইখওয়ানকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার অপচেষ্টায় মেতে ওঠে। মূলত তাদেরই প্রাকাশ্য-অপ্রকাশ্য চক্রান্তের ফলে তখনকার প্রধানমন্ত্রী নাকরাশী ও ইখওয়ানের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। একপর্যায়ে ইখওয়ানকে নাকরাশীর বিরোধিতায় নামতে হয়। ফলে রাজা ফারুক তাকে পদত্যাগ করতে বলেন, আর তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। বস্তুত এটাই ছিলো হাসানুল বান্না ও তার দাওয়াতি সংস্থা ইখওয়ানের প্রতি বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসার অন্যতম শক্তিশালী কারণ।

এরপর ঘটনাপ্রবাহ দ্রুত নতুন নতুন মোড় নিতে থাকে। নাকরাশীর মন্ত্রিসভা আবার ফিরে আসে এবং ফিলিস্তীনে জিহাদ শুরু হয়ে যায়, আর ইখওয়ান নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। এরপর যা যা ঘটেছে তা তো আপনারাও জানেন, সারা পৃথিবী জানে; নাকরাশী আততায়ীর গুলিতে নিহত হন, আর আমার পুত্র হাসান শাহাদাত বরণ করে।

এভাবে বৃদ্ধ শায়খ তার প্রিয় পুত্র ও কলিজার টুকরা হাসানুল বান্নার ঘটনা বলে গেলেন পূর্ণ প্রশান্তি ও ভাবগম্ভীরতার সঙ্গে, যেন ইতিহাসের পাতা থেকে কাহিনী পড়ে শুনাচ্ছেন। এই ঈমানী শক্তি ও পৌরুষের অভিপ্রকাশ দেখে আমরা অত্যন্ত মুগ্ধ হলাম। বস্তুত এটা তাঁর জন্য সহজ হয়েছিলো একারণে যে, তিনি তাঁর পুত্রকে দাওয়াত ও জিহাদের পথে আখেরাতের সঞ্চয়রূপে গ্রহণ করেছেন এবং মুমিনের ছবর-ধৈর্য ও মুজাহিদের হিম্মত-অবিচলতা দ্বারা এত বড় বিপর্যয়ের মুকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছেন। এই বৃদ্ধ মর্দে মুজাহিদকে দেখে মনে পড়লো সেই দু’টি কবিতাপংক্তি, যা এরূপ কোন উপলক্ষে হযরত আলী রা. আবৃত্তি করতেন।

فإن تسألينـي كيف أنت فأنـنـي

صبور على ريب الزمان صليـب

যদি জিজ্ঞাসা করো, কেমন আছি? বলবো, যুগের সব দুর্যোগে আমি অটল অবিচল।

يـــعــــز عـلـي أن تــرى لــي كآبــــة

فـيـشمـت عاد أو يـسـاء حـبـيـب

কারণ আমার জন্য বড় পীড়াদায়ক যে, বিপদে অস্থিরতা প্রকাশ পাবে, আর শত্রু উল্লসিত হবে, বন্ধুরা হবে ব্যথিত।

এরপর আরো কিছুক্ষণ আমরা সেখানে অবস্থান করি এবং বৃদ্ধকে আখেরাতের আজর ও প্রতিদানের কথা বলে - যা তিনি আমাদের চেয়ে ভালো জানেন- বিদায় নিলাম এবং ভারাক্রান্ত হৃদয়ে বের হয়ে এলাম।

উলূবা পাশার সঙ্গে সাক্ষাৎ

বিকেল চারটায় আমরা সুহৃদ বন্ধু উস্তায আহমদ উছমানকে সঙ্গে করে জনাব মুহাম্মাদ আলী উলূবা পাশার খেদমতে হাজির হলাম। তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিলো ১৯৩৩ সনে লৌখনোতে, যখন তিনি মুফতী আমীন হোসায়নীর সফরসঙ্গী হয়ে হিন্দুস্তানেএসেছিলেন এবং দারুল উলূম নদওয়াতুল উলামা পরিদর্শন করেছিলেন। লৌখনো অবস্থান-কালে তার সঙ্গে দেখা করার জন্য আমি বার্লিংটন হোটেলে যেতাম। তখন আমি ছিলাম বিশ বছরের যুবক। নতুন কায়রোস্থ তার বাসভবনে যখন আমরা তার সঙ্গে দেখা করলাম তখন আঠারো বছর আগে তাকে যে অবস্থায় দেখেছি তারচে’ অনেক ভালো অবস্থায় দেখতে পেলাম, যেমন স্বাস্থ্য ও সুস্থতার দিক থেকে তেমনি উদ্যম ও সজীবতার দিক থেকে। প্রথমে তো দ্বিধার মধ্যেই পড়ে গেলাম যে, ইনি কি তিনিই, না অন্য কেউ! পরে শুনলাম, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন চিকিৎসার উদ্দেশ্যে এবং ফিরে এসেছেন স্বাস্থ্য উদ্ধার করে।

তিনি আমাদের সামনে উপস্থিত হলেন, আর আমাকে এমনভাবে দেখতে লাগলেন যেন পুরোনো কাউকে চেনার চেষ্টা করছেন। পরে পরিচয় পেয়ে মনে হলো, কিছুটা অবাক হলেন। নিজে থেকেই তিনি দারুল উলূম নদওয়াতুল উলামার প্রসঙ্গ তুললেন, আর বললেন, দারুল উলূম আমার স্মৃতিতে পূর্ণ জাগরূক রয়েছে।

তিনি দারুল উলূমের অবস্থা এবং মুসলিম জনগোষ্ঠীর পরিস্থিতি জানতে চাইলেন। তারপর তিনি পাকিস্তান সম্পর্কে তার প্রয়াস-প্রচেষ্টা ও কর্মপরিকল্পনার কথা বললেন। আরো বললেন, তিনি তার সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন পাকিস্তান ও মিশরের মধ্যে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার বিষয়ে। এ প্রসঙ্গে তিনি  পাকিস্তান ও ভারতে মিসর-সরকারের অর্থানুকূল্যে কিছু ‘আরবী মাদরাসা’ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের কথাও বললেন। মনে হলো, ভারত ও পাকিস্তানের মুসলমানদের বিষয়ে তার অন্তরে যথেষ্ট দরদ এবং চিন্তা রয়েছে।

আলোচনাপ্রসঙ্গে উলূবা পাশা বললেন, বর্তমান সময়ে যদি কিছু আশা করা যায়, তাহলে তা পাকিস্তান, হিন্দুস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানদের কাছ থেকেই আশা করা যায়। কারণ এ অঞ্চলের মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যেই রয়েছে ঈমানী উদ্যম-উদ্দীপনা এবং ধর্মীয় চেতনা ও উচ্চমনোবল।

পক্ষান্তরে আরববিশ্ব সম্পর্কে তাকে খুব আশাবাদী ও আস্থাশীল মনে হলো না। তিনি বিশ্বাস করেন না যে, একতা ও সংহতি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আরব নেতৃবর্গের তেমন কোন আন্তরিকতা ও ঐকান্তিকতা রয়েছে। তারপর তিনি বললেন, প্রাচ্যের যে সব দেশের কথা বললাম, তারা নিজেদের শক্তি সামর্থ্য ও বিপুল জনবসতি সত্ত্বেও মিসরকেই মুসলিম জাহানের নেতা ও পথপ্রদর্শক মনে করে। উদাহরণ-স্বরূপ, পাকিস্তানের শিক্ষামন্ত্রী, যেখানকার মুসলিম জনসংখ্যা মিসরের চারগুণ, তিনি মিসরে এসে বলছেন, মিসর হচ্ছে দ্বীন ও ইলমের ক্ষেত্রে আমাদের রাহবার।

আমার মতে মিসরের সর্বোত্তম স্বার্থ ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞার দাবী হলো, এসকল উদীয়মান মুসলিম অঞ্চলগুলোর সঙ্গে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং নিজের যথাযোগ্য অবস্থান গ্রহণ করা। মিসরের অবশ্যকর্তব্য হচ্ছে মুসলিম জনগোষ্ঠীর এ আশা -আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া।

কিছু সুখকর অনুভূতি নিয়ে আমরা তার বাসভবন থেকে বের হলাম এবং উস্তায ইসমা‘ঈলের ওয়ার্ক শপে মাগরিব আদায় করলাম। পরে তারই গাড়ীতে করে আতাবাতুল খাযরা পৌঁছলাম।

সোমবার ২৮-৪-৭০হি./৫-২-৫১ খৃ.

নির্ধারিত সময়ে আমরা আল- আযহার পত্রিকার দফতরে গেলাম এবং উস্তায ফরীদ ওয়াজদীকে একনোসখা ‘মাযা খাসিরা’ পেশ করে বললাম, আশা করি, আলআযহার পত্রিকায় কিতাব সম্পর্কে আপনার মতামত ও পর্যালোচনা লিখবেন। তিনি ওয়াদা করলেন। কথার ফাঁকে ফাঁকে তিনি কিতাবের কিছু পাতা উল্টালেন এবং সূচিপত্রটি দেখে সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেন।

কিছুক্ষণ পর উস্তায মুহাম্মাদ ফুয়াদ আব্দুল বাকী এলেন তার গ্রন্থ

 تيسير المنفعة بكتابـي مفتاح كنوز السنـة والمعجم المفهرس لألفاظ الحديث النبوي

উপহার দিলেন। এক নোসখা আমাকে, এক নোসখা আল্লামা সৈয়দ সোলায়মান নদবী ছাহেবকে।

শায়খ মুহাম্মাদ গাযালীর সাক্ষাৎ লাভ ছিলো আমার দীর্ঘ দিনের আন্তরিক আকাক্সক্ষা। কারণ একদিকে তিনি ইখওয়ানের অন্যতম শীর্ষ ব্যক্তিত্ব, অন্যদিকে মিসরে ধর্মীয় নাবজাগৃতির অন্যতম পুরোধা লেখক। আমার দীর্ঘদিনের সে আকাক্সক্ষা আজ পূর্ণ হলো।

আমি الإسلام والأوضاع الاقتصادية (ইসলাম ও অর্থব্যবস্থা) الإسلام والمناهج الاشتراكيـة (ইসলাম ও সমাজতান্ত্রিক দর্শন) الإسلام المفترى عليه (অপবাদের শিকার ইসলাম) من هنا نعلم (এখান থেকে

শিখতে পারি) প্রভৃতি গন্থের নন্দিত লেখকের সাক্ষাৎলাভে ধন্য হলাম। সেই মানুষটিকে আজ নিজের চোখে দেখতে পেলাম, ইখওয়ানকে যিনি সঠিক ও বিশুদ্ধ চৈন্তিক ও আত্মিক পুষ্টি সরবরাহ করছেন এবং তাদেরকে সমৃদ্ধ ইসলামী সাহিত্যের পাথেয় দান করছেন। এমন মহান ব্যক্তির সাক্ষাতে আমি অত্যন্ত পুলকিত হলাম। তার মধ্যে আমি একজন সৎ, সুশীল ও উদ্যমী ব্যক্তির সন্ধান পেলাম, যিনি আলোকিত বুদ্ধি এবং সজীব হৃদয়ের অধিকারী, যার মুখম-ল থেকে উপচে পড়ে ঈমানের উদ্ভাস। আলাপ-আলোচনায় দেখা গেলো আমরা কলম ও লেখার মাধ্যমে পরস্পর পরিচিত। তাঁর গ্রন্থাবলী থেকে তাঁর চিন্তা-চেতনা ও মতাদর্শ সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা অর্জন করা যায় এবং তা অত্যন্ত প্রশান্তিদায়ক।

কিছুক্ষণ পরে রেডিওতে তাঁর বক্তৃতার সময় নির্ধারিত ছিলো। ইমাম হোসায়নের জন্মদিন উপলক্ষে আযহারের আলেম ও বক্তাদের নিয়মিত ধর্মীয় অনুষ্ঠান থাকে, যাতে তারা নিজ নিজ বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তো শায়খ মুহাম্মাদ গাযালীর সঙ্গে আমরা উক্ত অনুষ্ঠানে গেলাম।

ইমাম হোসায়নের জন্ম-উৎসব

মিসর এখন ইমাম হোসায়ন রা.-এর জন্মদিনের উৎসবে মুখরিত। কায়রোর যেদিকে তাকাও, দেখতে পাবে শুধু আলোকসজ্জা, পুষ্প-সজ্জা, মিষ্টিবিতরণ ও জাঁকজমক-পূর্ণ অনুষ্ঠান। একজন হয়ত গরীবের জন্য রুটি বিতরণ করছে, আর ধনী-গরীব সবাই একটুকরো রুটির জন্য ধাক্কাধাক্কি করছে। গরীবের গরিবি তো বুঝে আসে, কিন্তু ধনী! হয়ত তিনি ভাবছেন বরকতপ্রাপ্তির কথা। এখানে ও ওখানে জাঁকজমকপূর্ণ কোন অনুষ্ঠান, যার সমাগমকে কেন্দ্র করে দোকানিরা দোকান সাজিয়ে বসেছে। প্রতিটি সড়কে, প্রত্যেক বিপণী বিতান ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানে আকর্ষণীয় আলোকসজ্জা। কায়রোর প্রত্যেক অঞ্চলে দেখা যাবে গ্রাম থেকে আগত দলে দলে উৎসাহী মানুষ, যাদের বলা হয় হোসায়নী মেহমান। এরা আসলে এসেছে শহীদ মাযলূমের জন্ম উৎসবের অনন্দ উপভোগ করার জন্য। অনেকে এসেছে ইমাম হোসায়নের মস্তকের কথিত দাফনক্ষেত্র যিয়ারাতের উদ্দেশ্যে। এ বিষয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা নেই যে, কীভাবে পবিত্র মস্তক কায়রো পৌঁছলো? কে এবং কবে তা এনেছে? অবাক বিষয় এই যে, অনেক আহলে ইলমও চিন্তা-গবেষণা করছেন না যে, এই গুজবের কোন ইলমী বুনিয়াদ ও ঐতিহাসিক ভিত্তি রয়েছে কি না! সাধারণ্যে ছড়িয়ে পড়া ধারণাকেই যেন যথেষ্ট মনে করা হচ্ছে এবং তারই উপর দ্বীনী ছাপ ও ধর্মীয় আবহ দান করা হচ্ছে! অবশ্য এ বিষয়ে এক অদ্ভূত ঘটনা বর্ণিত রয়েছে যে, জনৈকা নারী তার পুত্রকে হত্যা করে তার মাথা ইমাম হোসায়নের মস্তকের স্থানে রেখে সবার অগোচরে হোসায়নী মস্তক নিয়ে এসেছেন, যাতে মিসর এ সৌভাগ্য অর্জন করতে পারে। তো মিসরীয়রা ঐ নারীর অবদানও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করে এবং তার কবরও যিয়ারাত করে, যা মস্তক-মাদফানের নিকটেই অবস্থিত।

মঙ্গলবার ২৯-৪-৭০হি./৬-২-৫১ খৃ.

আজকের দিনটা একরকম অবসাদের মধ্যেই পার হলো। গত রাত্রে ‘শোনো হে মিসর’ পুস্তিকাটির লেখায় মগ্ন ছিলাম। লেখাটির চিন্তায় এমনই আচ্ছন্ন ছিলাম যে, বিনিদ্রার সম্মুখীন হলাম। এটা অবশ্য আজকেরই বিষয় না; যখনই কোন বিষয়ে দেমাগ চিন্তামগ্ন হয়, এরকম বিনিদ্রার কষ্ট দেখা দেয়। বেশ দেরীতে সামান্য ঘুম এসেছিলো, কিন্তু যথাসময়ে জাগ্রত হওয়ার কারণে ঘুমের প্রয়োজন পূর্ণ হয়নি।

যোহরের আগে শায়খ ছালেহ আশমাবীর সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে গেলাম। কয়েকদিন হয়ে গেলো, দেখা হয়েছে; এরপর আরদেখা করার সুযোগ হয়নি। মিশরে আমাদের অবস্থান যেখানে অল্প-কিছুদিনের জন্য সেখানে অল্পকিছু সময় দেখা না হওয়াকে সত্যি সত্যি ‘দীর্ঘকাল’ মনে হচ্ছিলো। যাদের অন্তরে রয়েছে ইসলামের চিন্তাচেতনা, দ্বীনের দরদ-ব্যথা এবং দাওয়াতের আবেগ-জাযবা তাদের সঙ্গে যদি নিয়মিত দেখা-সাক্ষাৎ ও ভাববিনিময় না হয় তাহলে মিসরে আমাদের পড়ে থাকার সার্থকতাই বা কী?!

যাই হোক, আমরা ‘আদ্-দাওয়া’ -এর দফতরে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। বিভিন্ন আলোচনার এক পর্যায়ে তার কাছে এ আকাক্সক্ষা নিবেদন করলাম যে, তিনি যদি এখানকার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করতেন, ভালো হতো। তিনি ওয়াদা তো করলেন, তবে পত্রিকার ব্যস্ততার কারণে সঙ্গে যাওয়া বিষয়ে ওযর পেশ করলেন। পত্রিকার সম্পাদনা ও প্রকাশের কাজ তো আসলেই বড় জটিল, ধৈর্যক্ষয়ী ও সময়সাপেক্ষ কাজ।

ওখান থেকে আমরা শায়খ আহমদ উছমানকে ফোন করে কিছু সময়ের জন্য আসতে বললাম, যাতে তিনি, যাদের সঙ্গে দেখা করতে চাই, তাদের কাছে আমাদের নিয়ে যান। কারণ কে কোথায় থাকেন আমাদের চেনা- জানা নেই। আল্লাহর এ বান্দা সব ব্যস্ততা ছেড়ে যথাসময়ে চলে এলেন। তার রাহবারিতে আমরা বের হলাম।

আলফাতাহ-এর সম্পাদকের সঙ্গে সাক্ষাৎ

আছরের সময় আমরা আলফাতাহ সাময়িকীর সম্পাদক উস্তায মুহিব্বুদ্দীন আলখতীবের সঙ্গে দেখা করার উদ্দেশ্যে ‘জাযীরাতুর রাওযা’য় গেলাম। আলফাতাহ ও তার সম্পাদকের সঙ্গে আমার পরিচয় প্রায় বিশবছরের পুরোনো, যখন আমরা শায়খ তাকিউদ্দীন হেলালী (বর্তমানে ড. হেলালী)-এর ছাত্র ছিলাম। আলফাতাহ সাময়িকী নদওয়ার ছাত্রসংস্থা ‘আল-ইছলাহ’র দফতরে এবং আমাদের ঘরে আসতো। এটি ছিলো আমাদের অতি প্রিয় সাময়িকী। আমীর শাকীব আরসালান ও শায়খ হিলালী তাতে নিয়মিত লিখতেন। আমি ও সুহৃদ বন্ধু মাওলানা মাসঊদ আলম নাদাবীও তাতে লেখার সৌভাগ্য অর্জন করেছি। আমার কয়েকটি প্রবন্ধ তখন তাতে প্রকাশিত হয়েছে। তার মধ্যে একটি ছিলো ‘লিসানুল আছ্র’ শিরোনামের প্রবন্ধ। তাতে আমি হিন্দুস্তানের উর্দূ ভাষার প্রসিদ্ধ কবি আকবর ইলাহাবাদীর কিছু কবিতার তরজমা করেছিলাম, যিনি তির্যক ও আলঙ্কারিক শৈলীতে পাশ্চাত্য সভ্যতার কড়া সমালোচনা করে খ্যাতি অর্জন করেছেন। কবিতার অনুবাদের সঙ্গে পর্যালোচনাও ছিলো। কয়েক কিস্তিতে সেটি ছাপা হয়েছিলো।

উস্তায মুহিব্বুদ্দীনের লেখাও আমি যথেষ্ট পড়েছি। ‘আলহাদীকা’র কয়েকটি খ- পড়া ছিলো যা সমকালের সৎ ও বিশুদ্ধ ইসলামী আরবী সাহিত্যের আদর্শ নমুনার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়েছিলো। এর মাধ্যমে বহু উদীয়মান সাহিত্যিকের লেখা ও কর্মের সঙ্গে আমি পরিচিত হয়েছি। আয্যাহরা সাময়িকীর ভলিউম দ্বারাও আমি যথেষ্ট উপকৃত হয়েছি।

জাযীরাতুর-রাওযা ছিলো শহরের একেবারে শেষ প্রান্তে। আমাদের বন্ধু শায়খ আহমদ উছমান বললেন, মুহিব্ব তো দুনিয়ার শেষ প্রান্তে বাস করেন; তার সঙ্গে দেখা করতে কে আর যাবে! আমি বললাম, মহিব্ব (প্রেমিক)ই মুহিব্ব-এর সঙ্গে দেখা করতে পারে।

মুহিব্বুদ্দীন আলখাতীব আমাদের আন্তরিকভাবেই গ্রহণ করলেন। আমার স্মৃতিপটে ঐ সময়ের কথা জেগে উঠলো যখন আমি পূর্ণ যৌবনের অঙ্গনে বিচরণ করি, যখন জীবনের পাতাগুলো ছিলো স্বচ্ছ অমলিন। আমি আলফাতাহ সাময়িকীর বর্তমান অবস্থা জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, যখন আলফাতাহর পাঠক অপরাধীরূপে তল্লাশি ও ধরপাকড়ের শিকার হতে লাগলো; তখন আমি তার প্রকাশনা বন্ধ করে দিয়েছি।

আসলে তার ইঙ্গিত ছিলো ইখওয়ানের সদস্যদের বিভিন্ন উপায়ে হেনস্থা ও দেশছাড়া করার মর্মবিদারক ঘটনাবলীর দিকে। এরপর তিনি দেশের বর্তমান পরিবেশ পরিস্থিতির সঙ্গে নিজের অপরিচয়, স্বদেশেও প্রবাসের অনুভূতি এবং হৃদয়ভগ্নতার কথাই বলতে থাকলেন। বোঝা গেলো, যামানার কঠিন দুর্যোগ ভিতর থেকেই তাকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে।

একপর্যায়ে শায়খ উছমান এখানকার প্রসিদ্ধ লেখক সাহিত্যিকদের সঙ্গে আমার সাক্ষাতের আগ্রহ সম্পর্কে বললেন। তখন তিনি অত্যন্ত নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করে তাদের সুযোগসন্ধানী স্বভাব ও চাটুকারিতার সমালোচনা করলেন। তিনি বললেন, তাদের  সঠিক পরিচয় তো এই যে, তারা বহুরূপী ও কুশলী অভিনেতা। যখন যে চরিত্র তাদের দেয়া হয়, পূর্ণ দক্ষতা ও কুশলতার সঙ্গে ঐ চরিত্রের রূপায়ণ ঘটায়। এমনকি সেটাকে তখন আর অভিনয় মনেই হয় না, বরং সবকিছু যেন জীবন্ত ও বাস্তব। যদি বলা হয়, বাদশাহর চরিত্রে অভিনয় করো, তারা এমন স্বতঃস্ফূর্ততা ও রাজকীয়তার সঙ্গে অভিনয় করে যে, দর্শক বিশ্বাস করতে শুরু করে, ইনি আসলেই বাদশাহ। সময়ের পূজারী এই সব লেখক-সাহিত্যিকদের যদি বলা হয়, কোরআনের জীবন-দর্শনের উপর মর্মস্পর্শী কোন লেখা তৈরী করো, কিংবা সীরাতের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আকর্ষণীয় কোন প্রবন্ধ প্রস্তুত করো, তারা সঙ্গে সঙ্গে তাই করবে এবং এমন কুশলতার সঙ্গে করবে যে, ফরমায়েশকারী খুশী হয়ে পুরস্কার দেবে। এরা কোন নেতা ও শাসকের জীবনীও লিখতে পারে একই রকম কুশলতার সঙ্গে, যদি কিছু প্রাপ্তির আশা থাকে।

আবার ইসলামের কোন নীতি ও মূলনীতি এবং শরী‘আতের কোন আহকাম ও বিধানের সমালোচনা করে কিছু লিখতে বলা হলে তারা বিন্দুমাত্র পিছপা হবে না, বরং একই রকম দক্ষতা ও কুশলতার সঙ্গে তাদের কলম চলবে। তাই দেখবেন, যিনি ইসলামী লেখক ও সাহিত্যিক বলে পরিচিত, নির্দ্বিধায় তিনি ইসলামী চেতনার সঙ্গে সঙ্ঘর্ষপূর্ণ গল্প উপন্যাস লিখে দেদার পয়সা কামাচ্ছেন!

মনে হলো মুহিব্বুদ্দীন আলখতীব তখন দ্বিনী জাযবা ও গায়রাতের এমন একটা হালাতের সম্মুখীন যেখানে কাউকে তিনি ক্ষমা করতে প্রস্তুত নন। তিনি বললেন, নির্ভরযোগ্য একব্যক্তি আমাকে বলেছেন, ইসলামের উপর যথেষ্ট লেখালেখি করেন, এমন একজন বড় সাহিত্যিকের সঙ্গে একদিন বিভিন্ন ইসলামী বিষয়ে তার আলোচনা হচ্ছিলো। একপর্যায়ে ঐ লেখক -আল্লাহ পানাহ- বলে বসলেন, মুহাম্মাদ যদি মিসরে আসেন, আর পূর্ণাঙ্গ ইসলামী বিধান জারি করতে চান তাহলে তার বিরুদ্ধে সবার আগে আমি মাঠে নামবো!

দুঃখের বিষয়, আবেগের তোড়ে মুহিব্বুদ্দীন আলখতীব যা বলেছেন, আসলে সেটাই আজকের বাস্তবতা, সমকালের বহু লেখক সাহিত্যিকের ক্ষেত্রেই তা সত্য। ইসলামের উপর লেখালেখি যাদের পেশা ও জীবিকা তারা ‘নেতা ও জনতার’ চাহিদা বুঝে যা ইচ্ছা তাই লিখতে পারে এবং লেখে। শুধু মিসর কেন, বহু মুসলিম দেশেরই এ অবস্থা। সমাজে তাদেরই তাপ ও প্রতাপ। কলমের মাধ্যমে ইসলামের সত্যিকারের সেবা করতে যারা বদ্ধপরিকর তারা সর্বত্র কোনঠাসা।

মুহিব্বুদ্দীন আলখতীব আমাকে ‘লিসানুল আছর’ প্রবন্ধটির মুদ্রিত কাগজগুলো দেখালেন, যা আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। লেখাটি দেখে আমার এমনই খুশি হলো যেমন হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর সঙ্গে বহুদিন পর অপ্রত্যাশিত দেখা হলে হয়। তিনি বললেন, প্রবন্ধটি তিনি আলাদাভাবে ছাপার ব্যবস্থা করছেন।

জশনে মীলাদে ইমাম হোসায়ন

শায়খ আহমদ উছমান বললেন, আপনার কি মীলাদে জশনে হোসায়ন দেখার আগ্রহ আছে? আমি পরিহাসচ্ছলে বললাম, কেন নয়, আপনার মত সুন্নাহপ্রেমী ও বিদআতবিরোধী যদি সঙ্গ দান করেন!

আসলে আমার জানার আগ্রহ ছিলো, এই জশনের হাকীকত ও প্রকৃতি কী, মিসরের এমনকি দ্বীনী মহলেও যার এত গুরুত্ব ও প্রিয়তা! এ উছিলায় সড়কে জনতার দর্পণে দেখা হয়ে যাবে মিসরের আসল দ্বীনী অবস্থা কী, শুধু খালেছ দ্বীনী মহলে আবদ্ধ থাকলে যা সাধারণত বোঝা যায় না।

প্রথমে আমরা শায়খ আহমাদ উছমানের সঙ্গে একটি জলসায় উপস্থিত হলাম, যা অনুষ্ঠিত হচ্ছে  ইমাম হোসায়নের স্মরণে কুব্বাতুলগোরী অঞ্চলে। অনুষ্ঠানটির আয়োজন করছে যৌথভাবে দু’টি পরিবহণসংস্থা। আমরা শুনেছিলাম, এ জলসায় শায়খ ছাবী শা‘লান স্বরচিত কাছীদা আবৃত্তি করবেন।

জলসাস্থলের ভিতরে প্রবেশ করে যা দেখলাম, এককথায় তা অদ্ভুত! মানুষ অল্প, লাইটিং ও সজ্জা প্রচুর। প্রথমে শায়খ আব্দুছ্ -ছামাদ কিছু তিলাওয়াত করলেন। বিভিন্ন আওয়ায ও শব্দজটের কারণে প্রায় কিছুই শোনা গেলো না। এখানে একজন তিলাওয়াত করছেন; ওখানে জলসার বাইরেও বিভিন্ন ক্বারীর তিলাওয়াত হচ্ছে, যা মাইকে প্রচারও করা হচ্ছে। শান্তিমত শোনাই তো সম্ভব ছিলো না, একাগ্রতা ও আত্মসমাহিতি তো দূরের কথা। তারপর জলসা ও জশনের উপকারিতা সম্পর্কে বক্তব্য রাখলেন আযহারী ওয়ায়েযদের তত্ত্বাবধায়ক উস্তায শায়খ হাসান ছক্র। তখনো শোরগোলের একই অবস্থা। স্মরণ ও শিক্ষাগ্রহণের পরিবর্তে রসম রেওয়াজ ও ভ্রান্ত আকীদা বিশ্বাসেরই ছিলো অবাধ চর্চা। তো এসব অনৈসলামী কার্যকলাপ ও শোরগোল হৈহুল্লোড়ে অতিষ্ঠ হয়ে ব্যথিত চিত্ত ও ভগ্ন হৃদয় নিয়ে আমরা সেখান থেকে বের হয়ে এলাম। শায়খ ছাবী শা‘লানের কাছীদা-পাঠের সময় ফিরে আসার চিন্তা করে আমরা নিকটস্থ মসজিদে হোসায়নের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। পুরো পথ লোকে লোকারণ্য; কেউ যিয়ারাতকারী, কেউ পরিদর্শক, আর কেউ নিছক তামাশার দর্শক। ভিড় এতই প্রচ- ও ভয়াবহ যে, হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা হলো। তাই আমরা হাতধরাধরি করে সতর্কতার সঙ্গে চললাম এবং বহু কষ্ট-কসরতের পর মসজিদের কাছাকাছি পৌঁছলাম। সেখানে দেখি আরেক কা-! রাস্তার উপর বসেছে যিকিরের হালকা, যাকে শারীরিক কসরতের আসর বললে যেন বেশী মানায়। শুনলাম, এরা নাকি বিশেষকোন ছুফী তরীকার সঙ্গে সম্পৃক্ত।

শায়খ উছমান বললেন, এ তামাশা পরেও দেখা যাবে; এখন চলুন, বহু আলোচিত ঐ ‘বালকের মা’-এর মাযারে যাই, যিনি ইমাম হোসায়নের মস্তক এনেছেন বলে বহু মিসরীয়-এর অটল বিশ্বাস। মাযারগামী ঐ পথে দেখতে পেলাম হরকিসিমের তামাশা ও ক্রীড়া-কসরতজাতীয় আয়োজন; রকমারি পণ্যের সারি সারি দোকান, আর মানুষের উপচে পড়া ভিড়, সেই সঙ্গে দুনিয়ার শোরগোল ও হৈহুল্লোড়। এরই মধ্যে দেখি, আগুনের মশাল নিয়ে ভিড়ের ভিতরেই কারো কারো বেপরোয়া ছোটাছুটি! আবার একদল ক্ষেপাটে যুবক লাইন ধরে কাঁধ উঁচিয়ে ধাক্কাতে ধাক্কাতে ভিড় চিরে সোজা চলে যাচ্ছে, যেন লম্বা রেলগাড়ী। হঠাৎ সেখানে মদ-ভাঙ-এর ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে এসে লাগলো, আর সারা শরীর যেন গুলিয়ে উঠলো। সামনে যাওয়া আর সঙ্গত মনে হলো না, তাই পিছনে ফিরে এলাম। মসজিদের দরজার সামনে এসে দেখি, চলছে

যিকিরের ‘তুমুল’ এক হালকা। বিচিত্র শক্তিক্ষয়ী শারীরিক কসরত প্রদর্শনের মধ্যে চলছে ‘আল্লা হুয়াল্লা’ এবং ‘হু হু, ইয়া হু’এর ভয় ধরিয়ে দেয়া যিকির। এত জোরে শ্বাস নিচ্ছে, আর বের করছে যে, ‘আমার তোমার’ পক্ষে সম্ভবই নয়। অর্ধেক শরীর বাঁকিয়ে তারপর হঠাৎ এমন সোজা দাঁড়িয়ে যায়, মনে হবে কঠিন জিমন্যাস্টিক কসরত।

হালকার শায়খ ছিলেন ‘দাড়িছাফ’ এক যুবক, মাথায় ফেজ টুপী; সুর সহযোগে তরীকতের কোন কাছীদা গাইছে, যার মর্মার্থ হলো, ‘আমার ভিতরে আছে এমন গোপন ভেদ, যদি পাহাড়ের উপর রাখা হয়, পাহাড় গুঁড়িয়ে যাবে, যদি সাগরে নিক্ষেপ করা হয় সাগর শুকিয়ে

যাবে, আর যদি রেখে দেয়া হয় কোন মুরদারের উপর, মাওলার সেরা মাওলা যিনি তার হুকুমেসে যিন্দা হয়ে যাবে।’

এই তামাশায় চোখ যখন আমাদের বিস্ফারিত, আর যিকিরের কসরত যখন তুঙ্গে এবং ‘হু, ইয়া হু’-এর আগুন যখন গরম তখন একবুড়িকে দেখা গেলো, একের পর এক পুরুষ-আলিঙ্গন গ্রহণ করছে। এমনই তার বেহাল অবস্থা, যেন পুরুষের ভিড়ে ‘ফানা’ হয়ে যাবে। একজনকে বলতে শুনলাম, নবীর সাচ্চা ইশক ও খাঁটি প্রেম তাকে দেওয়ানা করেছে। হবে হয়ত! তবে ‘নবীর তরীকা ভুলে নবীর প্রেম’, এর মাজেযা বোঝা আমাদের কর্ম নয়। শুনলাম, এরা নাকি ছানাবিয়া আহমাদিয়া তরীকার পন্থী। মসজিদের আরেক কোণে যিকিরের ‘অপেক্ষাকৃত শান্ত’ এক হালকা; বলা হলো এরা বূমীয়া তরীকার মানুষ।

অনেক কষ্টেসৃষ্টে ভিড়ের ভিতর দিয়ে পথ করে করে আমরা সেখান থেকে বের হয়ে এলাম।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

হযরত আলী মিয়াঁ রহ.কে ফায়ছাল পুরস্কারে ভূষিত করা ১৪০০ হিজরী সালে চিন্তা-ফিকির, দাওয়াহ ও ইসলামী সাহিত্যে মৌলিক অবদান রাখার জন্য। বস্তুত ফায়ছাল পুরস্কার আলী মিয়াঁকে মর্যাদাবান করেনি, বরং সউদী বাদশাহ শহীদ ফায়ছালের নামে প্রচলিত এ আন্তর্জাতিক পুরস্কার হযরত আলী মিয়াঁর মাধ্যমে আরো মহিমা ও মর্যাদা লাভ করেছে। তিনি তো পুরস্কার গ্রহণ করতেই প্রস্তুত ছিলেন না, শুধু আপন মুরশিদ হযরত শায়খুল হাদীছ রহ.এর আদেশ পালন করেছেন। 

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা