মুহররম.১৪৪০হিঃ (৩/৬)

হযরত আলী নাদাবীর পাতা

পাকিস্তানে আলী মিয়াঁর বয়ান ইসলামের দৃষ্টিতে ক্ষমতা ঃ দায়িত্ব ও কল্যাণ

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

(এ বক্তৃতা করা হয়েছিলো ফরেন ক্লাব-এর পক্ষ হতে করাচির প্রসিদ্ধ মেট্রোপল হোটেলে আয়োজিত এক গুরুত্বপূর্ণ সমাবেশে। সময় ২৭শে মে ১৯৮৪ সাল। উক্ত সমাবেশে শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, উচ্চ শিক্ষিত, উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা এবং অভিজাত শ্রেণীর লোকজন বিপুল সংখ্যায় উপস্থিত ছিলেন।)হামদ ও ছালাতের পর-আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-এরা ঐ সকল (পুণ্যবান) মানুষ, যদি আমি তাদের ক্ষমতা দান করি ভূখ-ে তাহলে তারা ছালাত কায়েম করে, যাকাত আদায় করে, নেক কাজের আদেশ করে, আর মন্দ কাজের নিষেধ করে। আর সবকিছুর পরিণতি তো আল্লাহরই নিয়ন্ত্রণে।উপস্থিত সম্মানিত সুধিবৃন্দ! আমি এই সোসাইটি ও তার কর্মকর্তাদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞ যে, এমন একটি মহতী সমাবেশের আয়োজন তারা করেছেন এবং তাতে বক্তব্য রাখার সুযোগ দিয়ে আমাকে বাধিত করেছেন।হাযারাত! ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষভাগ এবং সপ্তম শতাব্দীর প্রথমভাগের ইতিহাস আপনাদের সামনে রয়েছে। ঐ সময়কালেই ইসলাম আত্মপ্রকাশ করেছে এবং মুহাম্মাদী নবুয়তের আবির্ভাব ঘটেছে, যা মানবজাতির ইতিহাসে এক নতুন মোড় সৃষ্টি করেছে; নতুন যুগ ও নতুন বিপ্লবের শুভসূচনা করেছে। বস্তুত মানব-সভ্যতার জন্য এবং মানবতার মুক্তির জন্য ইসলাম ও নবুয়তে মুহাম্মাদীর আত্মপ্রকাশ ছিলো এমনই এক অনন্যসাধারণ ঘটনা যার মর্যাদা ও মহত্ত্বের গভীরতা, ব্যাপ্তি ও বিস্তার প্রকাশ করার জন্য পৃথিবীর কোন ভাষার শব্দভা-ারে উপযুক্ত কোন শব্দ নেই। আপনাদের মধ্যে যারা ঐ সময়ের ইতিহাস সম্পর্কে কিছু হলেও অবগতি রাখেন, যারা নবুয়তের সমকাল ও তার পূর্বকালের ইতিহাস পড়েছেন, যাকে ‘জাহিলিয়াত’-এই গভীর তাৎপর্যপূর্ণ শব্দ দ্বারা চিহ্নিত করা হয়; যারা জাহেলিয়াতের ইতিহাস পড়েছেন তারা জানেন, সম্ভবত পৃথিবীতে তখন এমন কোন ভূখ- ছিলো না যেখানে কোন ভালো মানুষ ছিলো না। আল্লাহর ভয় ও পরিচয় আছে, মানবতার প্রতি শুভকামনা আছে এবং কিছুটা হলেও পবিত্রতা ও নৈতিকতা রয়েছে এমন মানুষ বিভিন্ন ভূখ- ও জনপদে অবশ্যই ছিলো। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় ছিলো এই যে, মানুষের জীবন ও চিন্তাচেতনার উপর এবং সময় ও সমাজের গতিপ্রকৃতির উপর ঐ ভালোমানুষগুলোর কোন সুপ্রভাব দেখা যাচ্ছিলো না। যাওয়ার কথাও না। কারণ ব্যক্তির প্রভাব সাধারণত ব্যক্তি পর্যায়েই পড়ে থাকে। সভ্যতা ও সংস্কৃতির উপর, মানবসমাজের বিভিন্ন শ্রেণী ও তাদের জীবনাচারের উপর, তাদের চিন্তা, বিশ্বাস এবং বোধ ও বুদ্ধির উপর বিচ্ছিন্ন একদু’জন ব্যক্তি প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে না।ঐ সময়ের বিস্তারিত রোয়েদাদ ও রেকর্ড যদি সামনে থাকতো তাহলে অবশ্যই আমাদের জানা হতো যে, যেসকল পুণ্যাত্মা, জ্ঞানী-গুণী, দার্শনিক, নীতিশিক্ষক ও সাধুপুরুষদের বিবরণ আমরা পড়ি, সমাজ-সভ্যতা তো দূরের কথা, অনেক সময় পরিবার-পরিজন ও কাছের মানুষদের উপরও তাদের কোন প্রভাব ছিলো না। হয়ত তারা বিষয়টা এভাবে ব্যাখ্যা করে নিতো এবং আত্মবুঝ অর্জন করে নিতো যে, এদের সাধুতা ও পুণ্যমনস্কতা এদের নিজেদের জন্য ঠিকই আছে। এছাড়া এদের করারইবা কী আছে?! তাদের সাধ্য সীমিত, চাহিদা সীমিত; তদুপরি তারা এখন বয়সের এমন স্তরে, যখন জীবন মুখ ফিরিয়ে নেয়। তো তারা ত্যাগ করার আগে, পৃথিবীই তাদের ত্যাগ করেছে; জীবন ও সমাজ তাদেরজিজ্ঞাসা করে তো আর চলে না, সমাজের রয়েছে নিজস্ব ধারা এবং জীবনের রয়েছে নিজস্ব গতি। এসব কারণে কতকটা নাচার হয়েই এরা নিরাপদ কোণে আশ্রয় নিয়েছে। এরা এখন খাব-খেয়ালে মগ্ন। এরা এদের পথে চলছে চলুক, আমরা আমাদের পথে চলি।মানুষের আকল-বুদ্ধি ও চিন্তার মধ্যে সত্যের এবং রহস্যের গভীরতায় উপনীত হওয়ার যে স্বভাবযোগ্যতা আল্লাহ তা‘আলা রেখেছেন তা ততক্ষণ পর্যন্ত জাগ্রত ও সক্রিয় হয় না যতক্ষণ না তা বাস্তবরূপে, বিপুল গভীরতা ও বিস্তার এবং বিপুল ব্যাপ্তি ও শক্তি নিয়ে তার সামনে উপস্থিত হয়; যতক্ষণ না তাকে তা চিন্তায় নিমগ্ন হতে বাধ্য করে।মানবজাতির এটা সত্যি বড় দুর্ভাগ্য ছিলো যে, ব্যক্তি-প্রভাব তখন সঙ্কুচিত হতে হতে বৃহৎ জীবনের অঙ্গনে যেন একটা বিন্দু হয়ে রয়ে গিয়েছিলো, এত ক্ষুদ্র এক বিন্দু যা অনেক সময় ‘অনুবীক্ষণ’ ছাড়া দেখা সম্ভব হবে না। সমাজ-সংসারের কর্মকা- যেভাবে চলছিলো চলতে থাকলো; জীবনের চাকা যেভাবে ঘুরছিলো ঘুরতে থাকলো। যারা ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণে ছিলো তাদেরক্ষমতা ও প্রতাপ সেভাবেই বহাল থাকলো। ভিতরে বা বাইরে এমন শক্তি ছিলো না যা তাদের, হুঁশে আসার মত ঝাঁকুনি দিতে পারে এবং ভিতর থেকে তাদের বিবেককে নাড়া দিতে পারে; তারপর অধিকারের অবস্থান থেকে বলতে পারে, আজ তোমাকে জবাব ও ব্যাখ্যা দিতেই হবে যে, এটা কী হলো? এসব কী হচ্ছে?আসলে এটা তখনই সম্ভব যখন সাধুতা ও পবিত্রতা, ধার্মিকতা ও পুণ্যমনস্কতা এবং আল্লাহভীতি ও পরকালপ্রীতি ব্যক্তি পর্যায় অতিক্রম করে সামষ্টিক পর্যায়ে উপনীত হতে পারে। যখন  কোন জাতি, সমাজ ও সভ্যতার স্তরে, যেখানে রয়েছে প্রত্যেক শ্রেণী ও পেশার মানুষ, আম আদমী থেকে অভিজাত মানুষ সবাইকে এবং সবকিছুকে বেষ্টন করে যখন একটি নতুন সমাজ অস্তিত্ব লাভ করে, যখন একটি নতুন জীবনব্যবস্থার অভিজ্ঞতা ও পরীক্ষা সামনে আসে তখন পৃথিবী ওসমাজসংসার চিন্তা করতে বাধ্য হয় যে, এটা তাহলে কী হচ্ছে? কীভাবে সম্ভব হচ্ছে? এমনও কি তাহলে হতে পারে?এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই একটিউম্মতকে জীবনের অঙ্গনে এবং সমাজ ও সভ্যতার মঞ্চে উপস্থিত করা হয়েছে। কোরআনের শব্দ পরিষ্কার প্রমাণ করে যে, এ উম্মতের অবস্থান এটা ছিলো না যে, কোন দাওয়াত ও আহ্বান ধীরে ধীরে সে গ্রহণ করবে এবং নিভৃতে বসে তার উপর আমল করতে থাকবে। এ উম্মতকে তো আল্লাহর ফায়ছালা অনুযায়ী বিশ্বের জীবনমঞ্চে আনা হয়েছে, আল্লাহ না করুন, এক্টররূপে নয়, বরং ফেক্টররূপে। নিছক অভিনেতারূপে নয়, নেতা ও নিয়ন্তারূপে। এক শক্তিশালী ঐতিহাসিক অনুঘটকের ভূমিকা সে পালন করবে, এ জন্য!নতুন উম্মতের উত্থান, নতুন বিশ্বাস ও ব্যবস্থার উন্মেষ এবং নতুন চিন্তা-চেতনা ও আদর্শের উদ্গম এমনই এক ঘটনা ছিলো যা পৃথিবী ও মানবজাতির ইতিহাসই নয়, ভাগ্য ও তাকদীর পর্যন্ত বদলে দিয়েছে। এমন এক নতুন উম্মত প্রেরণ করা হয়েছে  যে আদেশের স্বরে, নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় পৃথিবী ও মানবজাতির মনোযোগ নিজের দিকে আকৃষ্ট করে নিয়েছে। সবাই এখন অবাক বিস্ময়ে জানতে চায়, এটা কী হলো, কীভাবে হলো, এমন কীভাবে হতে পারে?! অজুহাতমূলক ব্যাখ্যা তো একজন দু’জন, দশজন বিশজন সম্পর্কে পেশ করা যায়, কিন্তু পুরো একটা জনগোষ্ঠী, হাজার মানুষের পুরো একটা সমাজ ও জীবন-পরিম-ল! এই যে এত বিপুল জনগোষ্ঠী আলাদা কিছু নীতি ও নৈতিকতা, স্বতন্ত্র কিছু বিশ্বাস ও প্রত্যয় গ্রহণ করেছে এবং আগেরজীবনকে সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে এবং বর্জন করে জীবনের এমন এক উদাহরণ তুলে ধরেছে যা একদিন পৃথিবীতে ছিলো, কিন্তু পৃথিবীর মানুষ তা বিস্মৃত হয়েছে।অবাক বিস্ময়ে মানুষ দেখতে পেলো, সবকিছুর উপর নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ এখন আল্লাহর, আল্লাহ ছাড়া কারো নয়, কোন কিছুর নয়!! জীবনের সর্ব-অঙ্গনে শাসন ও ক্ষমতা এখন ইসলামের এবং শরী‘আতে মুহাম্মাদীর। জীবন এখন পরিচালিত হয় মানবতার কল্যাণকামনার উপর, ত্যাগ ও আত্মত্যাগ এবং ঈছার ও কোরবানির উপর, ইখলাছ ও আল্লাহমুখিতা এবং আখেরাত ও পরকালচিন্তার উপর; যেদিকে তাকাও শুধু যুহদ ও সংসার নিরাসক্তি, শুধু কর্মোদ্যম ও আত্মনিবেদন: আগে কাজ করেছো, এখনো করো, তবে নিজের জন্য কম, মানুষের জন্য বেশী, দুনিয়ার দু’দিনের জীবনের জন্য কম, আখেরাতের অনন্ত জীবনের জন্য বেশী।রাজত্ব এখন খাহেশাত ও প্রবৃত্তির নয়, লাগামহীন চাহিদা ও ভোগ-বিলাসের নয়, রাজত্ব এখন সংযম ও আত্মদমনের, রাজত্ব এখন ঊর্ধ্ব-জাগতিক শক্তির দাসত্বগৌরবের। জীবনের সবকিছুর ভিত্তি এখন ঊর্ধ্ব-জাগতিক সত্তার আনুগত্যের উপর।নিরন্তর তাকবীরধ্বনী, যা জগতের অসীমতায় রণিত হচ্ছিলো, এখন তা ঘরের নির্জনতা এবং বাজারের কোলাহলে শোনা যায়! এ ধ্বনি এখন উপাসনালয় ও ইবাদত-খানার চারদেয়ালে সীমাবদ্ধ নয়, কর্মমুখর জীবনের সর্বত্র, এমনকি যুদ্ধের ময়দানে, খুন-তুফানের ভয়ঙ্কর পরিবেশেও শ্রুত হয়। শান্তির পরিবেশে যেমন তারা নামাজে মগ্ন, তেমনি যুদ্ধের ধূলি -ঝড়ের মধ্যেও ছালাতুল খাওফের অনুগত। সেখানেও তারা আল্লাহকে ভোলে না, আল্লাহর ইবাদত বিস্মৃত হয় না।তাদের খলিফা ও শাসক হচ্ছেন ঐ সকল পুণ্যাত্মা যাদের পায়ের নীচে জড়ো হয়েছে রোম ও পারস্যের বহু শতাব্দীর সঞ্চিত খাযানা ও ধনসম্পদ, অথচ ভোগের চিন্তাও তাদের স্পর্শ করতে পারে না। তাদের দৃষ্টিতে এগুলো হচ্ছে উম্মতের আমানত, বাইতুল মাল। এর একটি মুদ্রাও ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য নয়। তাদের প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর রা.-এর ঘটনা-অনেকদিন পর একবার স্ত্রীর সাধ হলো বাচ্চাদের জন্য মিষ্টান্ন প্রস্তুত করার। স্বামীর কাছে মনের ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন, আর তাকে শুনতে হলো, ‘মুসলমানদের বাইতুল মাল তো আবুবকরের পরিবারের মিষ্টান্নের জন্য নয়!’স্ত্রী সংসারের খরচ থেকে কিছু কিছু বাঁচিয়ে কয়েকদিনের চেষ্টায় মিষ্টান্ন প্রস্তুত করলেন, আর আবুবকর রা. বাইতুলমালের যিম্মাদারকে লিখে পাঠালেন,‘ভবিষ্যতে এই পরিমাণ ভাতা কমিয়ে দাও। কারণ পরীক্ষা করে দেখা গেছে আবুবকরের পরিবার এই পরিমাণ কম খরচেও চলতে পারে। ....’হযরত ওমর বিন আবদুল আযীয রহ. এক রাতে সরকারী কাগজ-পত্র দেখছেন। সরকারী মোমের আলো জ্বলছে। এমন সময় দূরের প্রদেশ থেকে তার কোন নিকটজন সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে এলো। সালাম-মুছাফাহা ও কুশলবিনিময় হলো। খলীফা তার কাছে ঐ এলাকার খোঁজ-খবর জিজ্ঞাসা করলেন। আগন্তুক যা যা জানেন খলীফাকে অবহিত করলেন। এটাও ছিলো খেলাফতের কাজ। খলিফার দায়িত্ব শাসিত এলাকার অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হওয়া। এতক্ষণ সরকারী মোমের আলো জ্বলছে। এর মধ্যে আগন্তুক জিজ্ঞাসাকরলেন, বলুন ঘরের কী হাল অবস্থা? সবকিছু কুশলে আছে তো? সবাই সুস্থ আছে তো? হযরত ওমর বিন আব্দুল আযীয সঙ্গে সঙ্গে বাতি নিভিয়ে নতুন বাতি জ্বাললেন। আগন্তুক অবাক! ঘটনা কী!! খলীফা ওমর বিন আব্দুল আযীয স্বাভাবিক-ভাবে বললেন, ‘সরকারী মোমের বাতি তো আব্দুল আযীযের ব্যক্তি -গত আলাপচারিতার জন্য নয়! এ কাজে তো আমাকে ব্যক্তিগত মোমবাতিই ব্যবহার করতে হবে!!’এখানে শুধু নমুনার দু’টি ঘটনা বলা হলো; নচেৎ খেলাফতে রাশেদা ও প্রথম যুগের ইতিহাসে এরূপ ঘটনা একটি দু’টি নয়, অসংখ্য।নতুন সমাজের এ নতুন রূপ দুনিয়ার রাজা-বাদশাহ ও শাসক-নৃপতিদেরও জানা ছিলো; কায়ছার-কিসরারও জানা ছিলো।কায়ছার রাজদরবারের ‘রাযদার’ -কে জিজ্ঞাসা করেন, ‘ঘটনা কী! বাহিনীর পর বাহিনী পাঠাই, রসদের পর রসদ নিয়ে সাহায্য-কারী বাহিনী যায়। কিন্তু ফল? পরাজয় এবং পরাজয়; পরাজয় ছড়া আর কিছু নয়। এমনকি যে অভিজ্ঞ সেনাপতি এই সেদিন ইরানী বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে পারস্যের হৃদপি- পর্যন্ত পৌঁছে গেলো তার বাহিনীও পরাস্ত হলো! ঘটনা কী?! এরা তাহলে কারা?!দরবারী নিবেদন করলেন, জাহাঁপনা, অভয় দিলে নির্ভয়ে বলি।  রাজ-আসন থেকে অভয় পেয়ে দরবারী বললেন, জাহাঁপনা, তাদের অবস্থা এই যে, রাতে ইবাদতগুযার, দিনে ঘোড়সাওয়ার।রাতে যদি দেখেন, মনে হবে, যুদ্ধের সঙ্গে, জীবনের সঙ্গে তাদের কোন সম্পর্ক নেই! তালোয়ার কীভাবে ধরতে হয়, জানে না; বাজার কীভাবে চালাতে হয়, বলতেপারে না। ইবাদত ও বন্দেগি ছাড়া আর কিছু তারা জানে না। আবার দিনে যখন ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়, মনে হয় যুদ্ধ ও তলোয়ার ছাড়া আর কিছুর সঙ্গে তারা পরিচিত নয়। তাদের জীবনে যেন ইবাদত-বন্দেগির কোন সুযোগই নেই। বিজিত অঞ্চলে যখন তারা বিচরণ করে, সামান্য থেকে সামান্য জিনিসও মূল্য না দিয়ে নেয় না। তাদের অভিজাত পরিবারের কেউ চুরি করলে তারও হাত না কেটে তারা ছাড়ে না।সব শুনে কায়সার বললেন-‘তুমি যা বলছো তা যদি সত্য হয় তাহলে আমি যেখানে বসে আছি, একদিন না একদিন এখান পর্যন্ত তাদের ক্ষমতা পৌঁছে যাবে।’প্রিয় বন্ধুগণ! বক্তব্যের শুরুতে আমি যে আয়াত তেলাওয়াত করেছি তাতেও এ কথাই বলা হয়েছে। যদি কোন ভূখ-ের ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ তাদের দান করি তখন এমন হবে না, হতে পারে না যে, তারা ভোগ-বিলাসে ডুবে যাবে; ইমারাত-বালাখানার নির্মাণপ্রতিযোগিতায় মেতে ওঠবে; বিপুল থেকে বিপুল সম্পদ সঞ্চয়ের প্রয়াসে লিপ্ত হবে; তাদের দস্তরখানে উন্নত থেকে উন্নত ও বৈচিত্র্যপূর্ণ খাদ্য পরিবেশিত হবে; তাদের জীবন-সংস্কৃতিকে মনে হবে এক সুন্দর গুলদাস্তা ও রকমারি ফুলের তোড়া; না, এমন কিছুতেই হবে না; যদিও বিজয়াভিযান ও রাজ্যজয়ের ইতিহাস, যদিও মানবস্বভাব ও তার উচ্চাভিলাষের অভিজ্ঞতা এমনই, কিন্তু এখানে এর বিপরীতে অবস্থা হলো-‘যদি আমি তাদেরকে কোন ভূখ-ে শাসন, ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ দান করি, তারা সেখানে ছালাত কায়েম করে এবং যাকাত আদায় করে‘ছালাত পড়ে’-এ তরজমা করার সুযোগ নেই। কারণ বলা হয়েছে ‘আকামূ’- তারা ছালাত শুধু আদায় করে না, সমাজের মধ্যে ছালাত কায়েম করে, প্রতিষ্ঠা করে। মসজিদের অঙ্গনে এবং জীবনের প্রাঙ্গণে ছালাতের ফেযা ও পরিবেশ তারা তৈরী করে। ছালাতের জন্য যা কিছু দরকার সবই তারা করে। প্রয়োজনীয় ইলমের ব্যবস্থা যেমন করে, তেমনি প্রয়োজনীয় স্থানেরও আয়োজন করে, যাকে বলা হয় মসজিদ। ‘আকামু’ শব্দের মধ্যে এসবই এসে যায়।তারা আর কী করে? যাকাত আদায় করে। অর্থাৎ জীবন যাপনের ব্যবস্থারূপে যাকাতের বিস্তার ঘটায়। ধনীর কাছ থেকে গ্রহণ করে, আবার গরীবের হাতে অর্পণ করে। তারপর সমাজের পরিবেশে, জীবনের বিস্তৃত ক্ষেত্রে সাধুতা ও পবিত্রতা নিশ্চিত করার জন্য এবং অনাচার ও পাপাচার রোধ করার জন্য তারা একদিকে সৎ কাজের আদেশ করে, অন্যদিকে মন্দ কাজের নিষেধ করে। এখানে বিশেষভাবে এ কথা মনে রাখতে হবে যে, আয়াতে আদেশ ও নিষেধের কঠিন ও প্রত্যক্ষ শব্দব্যবহৃত হয়েছে, যাতে রয়েছে ক্ষমতা ও শক্তি প্রয়োগের সুস্পষ্ট আবহ। কারণ আদেশ-নিষেধ করবে, আর তা কার্যকর করার ব্যবস্থা নেয়া হবে না, তা তো হতে পারে না! এজন্যই এখানে অনুরোধ-উপদেশ এবং দাওয়াত-আহ্বানের মত নিরীহ ও আপোশমুখী কোন শব্দ ব্যবহার করা হয়নি।মোটকথা আদেশ-নিষেধ হচ্ছে অনুরোধ-উপদেশ থেকে ভিন্ন বিষয়। এর জন্য প্রয়োজন কিছু না কিছু শক্তি ও ক্ষমতা এবং আধিপত্য ও প্রতাপ, যাতে ভীতি ও সমীহের অনুভূতি বিরাজ করে এবং তাদের আদেশ-নিষেধকে মর্যাদা ও গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়। সর্বোপরি আদেশ-নিষেধ অমান্য করার অবস্থায় সাজা ও শাস্তির ভয় যেন সবার অন্তরে থাকে।তো যে জামাত ও উম্মতকে এত বড় নিয়ন্ত্রণমূলক দায়িত্ব পালন করার জন্য উত্থিত করা হয়েছে তাদের হাতে রাজনৈতিক শক্তি ও শাসনক্ষমতা থাকার অপরিহার্য প্রয়োজন রয়েছে।বস্তুত এটাই ছিলো রায ও রহস্য ঐ ঘটনার অলৌকিকত্ব, বিশ্বব্যাপিতা ও বিস্ময়করতার যা নবীর আবির্ভাব ও উম্মতের উত্থানরূপে ষষ্ঠ শতকের শেষভাগে আত্মপ্রকাশ করেছে। এটা ছিলো এমনই বাস্তব ও সত্যবিপ্লব যা সারা দুনিয়াকে এবং দুনিয়ার মানুষকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছিলো এবং শেষ পর্যন্ত সারা দুনিয়ার দৃষ্টি ইসলামের প্রতি নিবদ্ধ করে দিয়েছিলো।এখন আমি আপনাদের সামনে যে কথাটি নিবেদন করতে চাই তা এই যে, বর্তমান সময়েও পৃথিবী ও তাতে বসবাসকারী মানবগোষ্ঠীর সবচে’ বড় প্রয়োজন হলো, সবার সামনে যেন একটা ‘জীবন-উদাহরণ’ এসে যায়; নিজের চোখে সবাই যেন ইসলামের একটা জীবন্ত ছবি দেখতে পায়। যাকে আমরা বলি হায়াত বা যিন্দেগি (প্রাণ বা জীবন) প্রকৃতিগতভাবেই তাতে রয়েছে কম্পন ও স্পন্দন, আলোড়ন ও আন্দোলন এবং জোশ, জাযবা ও আবেগের উচ্ছ্বাস। জীবনের বিস্তৃত অঙ্গনকে সামনে রেখে যদি ভাবি তাহলে বলবো, তাতে রয়েছে ব্যবসা ও বাজার, কৃষি ও শস্য উৎপাদন; রয়েছে বিজ্ঞানের সাধনা ও প্রযুক্তির প্রতিযোগিতা; আরো রয়েছে শিক্ষিত ও অশিক্ষিত, বিশিষ্ট ও সাধারণ এবং শাসক ও শাসিত,এই সব বহুমুখী বিভাজন। এখানে রয়েছে চঞ্চল শৈশব, দুরন্ত কৈশোর, উচ্ছল তারুণ্য ও অপ্রতিরুদ্ধ যৌবন; তারপর রয়েছে ভারাক্রান্ত বার্ধক্য। মানুষ এখানে স্বাস্থ্য ও সুস্থতা যেমন ভোগ করে তেমনি অসুস্থতা ও রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হয় এবং চিকিৎসা ও চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়। এ সকল বৈচিত্র্য, বিস্ময় ও বহুমুখিতা নিয়েই জীবন এবং জীবনের জাঁকজমক ও চাহাল-পাহাল। যে ভূখ- ও জনপদ এবং যে দেশ ও জাতি এরকম বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনের সঙ্গ দিতে পারবে তারাই অর্জন করতে পারবে মানবজাতি ও তার সকল জনগোষ্ঠীর মাঝে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান। ইসলামের জীবন্ত প্রতিনিধিত্বকারী ঐ দেশ ও জাতি, যদি প্রয়োজন হয় পৃথিবীকে সাহায্য করার, চিন্তার ক্ষেত্রে, নীতি ও নৈতিকতার ক্ষেত্রে এবং ইনসানিয়াত ও মানবতার ক্ষেত্রে, যদি প্রয়োজন হয় তাহলে এসব ক্ষেত্রেও সে হবে পূর্ণ যোগ্যতার অধিকারী। তা হবে স্বাধীন, স্বনির্ভর, মযাদাপূর্ণ ও শক্তিশালী দেশ ও  জাতি, যারা এমন সুপরিসর ও সুবিস্তৃত এবং বৈচিত্র্য, বিস্ময় ও আড়ম্বরপূর্ণ জীবনের অধিকারী, যাতে জীবনের জন্য অপরিহার্য কোন বিষয়ে কোন শূন্যতা ও অসম্পূর্ণতা নেই। সেই সঙ্গে ঐ দেশ ও জাতি এমন এক সৎ, পুণ্যমুখী, নীতি ও নৈতিকতায় সমৃদ্ধ এবং জাগ্রত বিবেক ও মূল্যবোধের সমাজ-সংস্কৃতির অধিকারী হবে যেখানে বস্তু ও সম্পদই সবকিছু নয়, ভোগ-বিলাস ও প্রবৃত্তির চাহিদাই সবকিছু নয়; এককথায় দুনিয়ার দু’দিনের জীবনের জাঁকজমক ও চাকচিক্যই সবকিছু নয়, বরং আসল জিনিস যেখানে আল্লাহর ইচ্ছা ও সন্তুষ্টি এবং আখেরাতে অনন্ত জীবনের সুখ-শান্তি ও কল্যাণ; যেখানে সবকিছুর আগে চিন্তা করা হয়, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আহকাম ও বিধানের উপর কীভাবে পূর্ণ আমল হবে; যেখানে সভ্যতা, সংস্কৃতি ও জীবনাচার সমাজমানসের উপর চেপে বসবে না, বরং সমাজ-মানসই সভ্যতা, সংস্কৃতি ও জীবনাচারকে পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ করবে। ‘মানুষ হবে বাহন, আর সভ্যতা, সংস্কৃতি ও জীবনাচার হবে তার আরোহী’, এটা কখনোই হবে না, বরং মানুষই হবে আরোহী, আর সভ্যতা, সংস্কৃতি ও জীবনাচার হবে তার বাহন; যেখানে মানুষ জীবনের আরাম আয়েশ ও ভোগ-বিলাসের কাছে আত্মসমর্পণ করবে না, বরং জীবনের অনুগতরূপে সেগুলোকে প্রয়োজনমত ব্যবহার করবে; যেখানে শরী‘আতের আহকাম ও বিধিবিধানের সীমালঙ্ঘন কেউ কল্পনাও করতে পারে না; যেখানে সবাই সবার সঙ্গে ইনছাফ করে, হামদর্দি  ও সহানুভূতির আচরণ করে, কেউ কারো উপর যুলুম-অবিচার করে না এবং নির্দয় আচরণ করে না; যেখানে উৎকোচ-দুর্নীতি, অসততা ও অসদুপায় অবলম্বনের চিন্তাই কারো মধ্যে নেই; যেখানে অন্যায়-অনাচারের অস্তিত্বই নেই; যেখানে বিচারক বিচার করেন নির্ভয়ে; কোন শক্তি ও প্রতাপের দাবীতে নয়, যুক্তি ও ন্যায়পরতার আদেশে। যেখানে অফিস, আদালত ও দফতরে ‘বিলম্বে আসা, আগে বের হওয়া’, এরূপ ‘কর্মশৈথিল্যের’ প্রবণতা নেই; যেখানে বেতন-ভাতা ওসুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির অন্যায় আব্দার ও দাবীদাওয়া নেই; যেখানে শাসক ও শাসিত সবার নীতি হলো (প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর রা.এর ভাষায়-) ‘তোমাদের সবচে’ সবল ব্যক্তিও আমার কাছে দুর্বল, যদি সে যুলুম করে; পক্ষান্তরে তোমাদের দুর্বলতম ব্যক্তিও আমার কাছে সবল, যদি তার উপর যুলুম হয়।’প্রিয় বন্ধুগণ! এটা হলো সেই আদর্শ সমাজ এবং সেই সৎ, কল্যাণমুখী ও পবিত্র সংস্কৃতি যার জন্য পৃথিবী আজ তৃষ্ণার্ত, যার জন্য পৃথিবীর মানবসম্প্রদায় এখন অস্থির ও ব্যাকুল। আজকের সময়ে মানবতার সবচে’ বড় কোন সেবা ও উপকার যদি হতে পারে তাহলে সেটা একমাত্র এই যে, একটি স্বাধীন, মর্যাদাবান ও শক্তিশালী দেশ ও জনগোষ্ঠীর অবস্থান থেকে আপনারা ঐ আদর্শ জীবন ও ইসলামী সমাজ-সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করুন। বিশ্বাস করুন এর মধ্যে রয়েছে এমন মহাচৌম্বকাকর্ষণ, এমন মোহনীয়তা ও হৃদয়গ্রাহিতা যা আমেরিকা, রাশিয়া ও ইউরোপকে পর্যন্ত নিজের দিকে আকৃষ্ট করতে পারে এবং চিন্তার প্রতি নিবিষ্ট হতে বাধ্য করতে পারে।স্বীকার করি, আমাদের স্থান এখন সবচে’ পিছনের কাতারে এবং বহু বিষয়ে আমরা তাদের মুখাপেক্ষী, কিন্তু যদি আমরা ঐ জীবন ও সমাজের আদর্শ নমুনা পেশ করতে পারি তাহলে কোন সন্দেহ নেই, শ্রদ্ধায়, বিস্ময়ে, ভক্তিতে তাদের মাথা আমাদের সামনে নত হয়ে যাবে। চিন্তা করে দেখুন, তাদের সমাজেতারা পারেনি অপরাধ নির্মূল করতে, মদ ও মাদকাসক্তি রোধ করতে, জুয়ার ব্যবসা ও সুদের অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে; পারেনি যুলুম অনাচার বন্ধ করতে এবং ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান দূর করতে। অথচ আপনাদের এখানে যদি এগুলোর অস্তিত্ব না থাকে!! তো এটাই হলো মানবতার সেই মহান সেবা যা আজকের পাকিস্তান ও তার মুসলিম সমাজ পৃথিবীকে উপহার দিতে পারে।প্রিয় বন্ধুগণ! একটি স্বাধীন, আত্মমর্যাদাশীল ও শক্তিমান দেশ ও জনগোষ্ঠী সম্পর্কে যে বিষয়ে আমি সবচে’ বেশী ভয় ও বিপদ অনুভব করি তা হলো মনস্তাত্ত্বিক ব্যাধি, যশলিপ্সা ও সম্পদের লালসাএবং ক্ষমতার সেই সর্বগ্রাসী ক্ষুধা যা মুসলিম সমাজের বহু দেশ, জাতি ও জনগোষ্ঠীকে ভিতর থেকে খোকলা করে ফেলেছে এবং শেষ পর্যন্ত গ্রাস করে ছেড়েছে।আমার যা কিছু ভয় তা হলো ব্যক্তিস্বার্থসিদ্ধির ঐ অন্ধ উন্মাদনা সম্পর্কে যার ধ্বংসাত্মকতা মুসলিম উম্মাহ বারবার প্রত্যক্ষ করেছে। আপনারা জানেন, ইসলামের সুদীর্ঘ ইতিহাস একথাই বলে যে, যুগে যুগে বিভিন্ন ইসলামী সমাজ ও মুসলিম সালতানাতের যা কিছু ক্ষতি হয়েছে তা ব্যক্তিস্বার্থের অন্ধ পূজারীদের দ্বারাই হয়েছে। আব্বাসী যুগের ইতিহাস পড়–ন, ইবনে আলকামী ও নাছীরুদ্দীন তূসীর নাম আপনাদের সামনে আসবে, যারা হালাকু খানকে বাগদাদে হামলা করার গোপন আহ্বান জানিয়েছিলো। ভারতবর্ষের ইতিহাস যদি পড়েন, আপনাদের সামনে মীর জা‘ফর ও মীর ছাদিকের নাম আসবে, যাদের সম্পর্কে ইকবাল বলেছেন- ‘বাংলার জা‘ফর, দক্ষিণাত্যের ছাদেক, এরাই মানবতার লজ্জা, দ্বীন ও ধর্মের কলঙ্ক এবং দেশ ও জাতির কালিমা।’তো এই জাফর-ছাদিক ও তাদের অনুচরেরা এ যুগেও সামনে আসতে পারে মাযহাবী ফেরকা ও সাম্প্রদায়িক বিভেদকে আড়াল করে এবং দেশ ও সমাজের মধ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা সৃষ্টির মাধ্যমে। আমার যা কিছু ভয় ও বিপদের আশঙ্কা তা এই ‘ঈমানফরোশ’ ও যামীর-ফরোশ (ঈমান ও বিবেক বিক্রিকারী) মীর জা‘ফর ও মীর ছাদিকদের কারণে।দ্বিতীয় বিপদঘণ্টি হচ্ছে রাজনৈতিক দলাদলি ও কোন্দল যা দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থকে ভুলে যায় এবং নিজ নিজ সঙ্কীর্ণ দলীয় স্বার্থকেই শুধু সামনে রাখে। তদ্রƒপ যদি আশঙ্কার কিছু থাকে তাহলে সেটা হলো আঞ্চলিক, প্রাদেশিক ও ভাষাভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা। আল্লাহ না করুন, এমন যেন না হয় যে, ভাষা ও সংস্কৃতির দৈত্য কোন প্রদেশের ঘাড়ে এমনভাবে সওয়ার হলো যেন সিন্দাবাদের দৈত্য, যাকে কোনভাবেই নামানোসম্ভব নয়। এটা যদি কোন প্রদেশে উপাস্য মূতির অবস্থানে চলে আসে, আর পুরো জনগোষ্ঠী তার সামনে সিজদায় লুটিয়ে পড়ে, যদি পুরো জনগোষ্ঠীকে তার বেদিতে বলি দেয়ার উন্মাদনা পেয়ে বসে তাহলে ...!বন্ধুগণ, এগুলোই হচ্ছে সেই বাস্তব আশঙ্কা যা আপনাদের দেশের সামনে আমি দেখতে পাচ্ছি। হিম্মতের সঙ্গে, পূর্ণ সাহসিকতা, পৌরুষ ও জোয়াঁমার্দির সঙ্গে আপনারা এগুলোর মোকাবেলা করুন। পৃথিবীকে আপনারা দেখিয়ে দিন, শুধু জীবন থেকে ছিটকে পড়া এবং জীবনের কাছে প্রত্যাখ্যাত কিছু ব্যক্তিই ইসলামের অনুসারী নয়, বরং পুরো একটি জনগোষ্ঠী, যাদের কাছে রয়েছে জীবনকে ভোগ করার সর্বপ্রকার উপকরণ ও সুযোগ-সুবিধা, যাদের কাছে রয়েছে প্রয়োজনীয় শক্তি ও ক্ষমতা এবং একটি স্বাধীন, আত্মপ্রত্যয়ী ও মর্যাদাসম্পন্ন দেশ, তারাও ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শের অনুসারী; যাতে মানুষ চোখে দেখে বিশ্বাস করতে বাধ্য হয় যে, এই পরিবর্তিত সময়েও এবং এই বিপ্লবমুখী যুগেও ইসলামের শিক্ষা, নীতি-বিধান ও  আইনের পূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব এবং দেশের সকল নাগরিক মনে প্রাণে তা গ্রহণ এবং তার সফল বাস্তবায়নও করতে পারে।এখানে একটা জরুরি কথা; সব মতভেদ, মতবিরোধ ও বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা, সমালোচনা ও পর্যালোচনা, যদি করতেই হয়, এগুলো মাদরাসার চারদেয়ালের ভিতরেই করা উচিত এবং মিলনায়তন ও আলোচনাকক্ষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা উচিত; এগুলো আগাগোড়া গবেষণা ও গ্রন্থরচনার মধ্যেই আবদ্ধ রাখাউচিত। এগুলোর ভিত্তিতে সমাজে নৈরাজ্য ও অশান্তি সৃষ্টি করা, দেশকে গৃহযুদ্ধের আগুনে ঝুঁকে দেয়া, আল্লাহর ওয়াস্তে এরূপ আত্মঘাতী প্রবণতা থেকে বিরত থাকুন। এভাবে নিজেদের শক্তি, সক্ষমতা, যোগ্যতা ও সম্ভাবনার অপচয় করা, নষ্ট করা বন্ধ করুন, আল্লাহর দোহাই বন্ধ করুন। যোগ্য ও প্রতিভাসম্পন্ন আলিমদের আমি বলবো, আপনাদের উচিত ইউরোপ আমেরিকায় ইসলামের দাওয়াত নিয়ে সফর করা।এটা দেখবেন না যে, কৃতিত্ব কোন জামাতের ভাগে পড়লো,  গৌরব ও সুখ্যাতি কার কোঁচড়ে জমা হলো? শুধু চিন্তা করুন এবং চেষ্টা করুন, মাথা যেন নিরাপদ থাকে। এরপর তাতে মর্যাদা ও গৌরবের মুকুট যার হাত দিয়েই রাখা হয়, হোক। আল্লাহর সন্তুষ্টি ও প্রতিদান এবং আখেরাতের সৌভাগ্য তো সবার আমলনামাতেই আসবে। দেশ, জাতি ও সমাজের সাধারণ স্বার্থ ও কল্যাণ উপেক্ষা করে, দলীয় স্তরে নেমে কাজ করা, একজন আলিমে দ্বীন হিসাবে আপনি তো এত নীচ স্তরের নন। আপনার মর্যাদা তো এই যে, যা কিছু করবেন দ্বীনের ফায়দা ও কল্যাণ এবং আল্লাহর রিযা ও সন্তুষ্টিকে সামনে রেখেই করবেন; সময়ের দাবী এবং চারপাশের বিপদ, খাতরা ও আশঙ্কা হিসাবের মধ্যে রেখে ইখলাছ ও আত্মত্যাগের মহান জাযবা ও আবেগ নিয়ে কাজ করুন। আর আজর ও প্রতিদান শুধু আল্লাহর কাছে আশা করুন। জীবনের পতিটি ক্ষেত্রে قوامين لله شهداء بالقسط(শুধু আল্লাহর জন্য উত্থিত এবং ন্যায় ও ইনছাফের পক্ষে সাক্ষ্যদান-কারী) হোন। তারপর দেখুন, আল্লাহ তা‘আলা আপনাদের সঙ্গে কী আচরণ ও মু‘আমালা করেন! কী নেয়ামত ও সৌভাগ্য দ্বারা তিনি আপনাদের আপ্লুত করেন! কোরআনের এই আয়াতটি তেলাওয়াত করে আপনাদের থেকে বিদায় গ্রহণ করতে চাই-وقل اعملوا فسيرى الله عملكم ورسوله والمؤمنون،  وسـتردون إلى عالم الغيب والشهادة فينـبئـكم بما كنتم تعملونআর আপনি (তাদের) বলুন, কাজ করে যাও তোমরা। আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল এবং মুমিনগণ তোমাদের আমল দেখতেই পাবেন। আর অতিসত্বর তোমাদের ফেরানো হবে ঐ সত্তার অভিমুখে যিনি অদৃশ্য ও দৃশ্য সব জানেন। তো তিনি তোমাদের অবহিত করবেন ঐ আমল সম্পর্কে যা তোমরা (দুনিয়ার জীবনে) করতে।আল্লাহ হাফেয।



শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা