যিলক্বদ ১৪৩০হিঃ (১৪)

হযরত আলী নাদাবীর পাতা

(মা যা খাসিরাল আলামু বিনহিতাতিল মুসলিমীন - ধারাবাহিক অনুবাদ )

মুসলিম উম্মাহর অধঃপতনে বিশ্বের কী ক্ষতি হল?

পর্ব: ১৩

লিখেছেনঃ মাওলানা আবুল হাসান আলী নদবী (রাহ.)

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট
(পূর্বপ্রকাশিতের পর)

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদঃ মুসলিম উম্মাহর অধঃপতন দু’টি যুগের মাঝে পার্থক্য-রেখা

জনৈক সাহিত্যিক বলেন, দু’টি ক্ষেত্রে নিখুঁত সূচনাকাল নির্ধারণ করা সম্ভব নয়; ব্যক্তিজীবনে নিদ্রা এবং জাতীয় জীবনে অধঃপতন।’ আসলেও তাই। কোন জাগ্রত ব্যক্তি সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে একথা বলা সম্ভব নয় যে, ঠিক কখন সে ঘুমিয়ে পড়েছে। তদ্রপ কোন জাতি সম্পর্কেও একথা বলা সম্ভব নয় যে, ঠিক কোন্‌ সময়টাতে জাতির অধঃপতন শুরু হয়েছে। বস্তুত এদু’টি বিষয় তখনই পূর্ণ উপলদ্ধিতে আসে যখন তা ভালোভাবে জেঁকে বসে। তবে অধিকাংশ জাতির ইতিহাসে এটা সত্য হলেও মুসলিম উম্মাহর জীবনে অবক্ষয় ও অধঃপতনের সূচনা ছিলো বেশ স্পষ্ট। এমনকি যদি উন্নতি ও অবনতির এই মধ্যবর্তী পার্থক্য-রেখাটির উপর অঙ্গুলিনির্দেশ করতে বলা হয় তাহলে অতি সহজেই আমরা সেই ঐতিহাসিক রেখাটি চি?হ্িনত করতে পারবো যা খিলাফাতে রাশেদা ও আরব-মুসলিম শাসনকে পৃথক করে রেখেছে।

আমরা যদি একনজরে মুসলিম উম্মাহর উত্থানের কারণসমূহ পর্যালোচনা করতে চাই তাহলে দেখতে পাবো যে, সূচনাকালে প্রতক্ষভাবে মুসলিম শাসন এবং পরোক্ষভাবে বিশ্বশাসনের দায়িত্বভার এমন একদল মানুষের হাতে ছিলো যারা প্রত্যেকে ঈমান ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে এবং জীবন ও চরিত্র, নীতি ও নৈতিকতা, মহত্ত্ব ও মহানুভবতা, আত্মশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিকতা এবং পূর্ণতা ও ভারসাম্যপূর্ণতার ক্ষেত্রে মুহম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবন্ত মু‘জিযা ছিলেন।

ইসলামের ছাঁচে তাঁদেরকে তিনি এমন পরিপূর্ণরূপে গড়ে তুলেছিলেন যে, দেহসত্তা ছাড়া অন্যকোন ক্ষেত্রে অতীতের সাথে তাদের কোন সম্পর্ক ছিলো না; না চিন্তা-চেতনায়, না ভাবে ও স্বভাবে এবং না চাওয়া ও চাহিদার ক্ষেত্রে। সূক্ষ্ম বিচারকের দৃষ্টিতে পর্যালোচনা করেও তাঁদের জীবন ও চরিত্রে ইসলামের প্রাণ ও চেতনার পরিপন্থী জাহিলিয়াতের সামান্য কোন চি?হ্নও খুঁজে পাওয়া যেতো না। বরং নির্দ্বিধায় বলা যায়, ইসলামকে একজন মানবরূপে উপস্থিত করা হলে তা হুবহু তাঁদেরই যে কোন একজনের মতই হতো। আগেও যেমন বলেছি, তাঁরা ছিলেন দ্বীন ও দুনিয়ার একত্রসমাবেশের যিন্দা নমুনা ও আদর্শ উদাহরণ। একদিকে তাঁরা ছিলেন মসজিদের মাননীয় ইমাম, অন্যদিকে আদালতের মহামান্য বিচারক। মসজিদে তাঁরা দ্বীন ও ইলম শিক্ষা দিতেন এবং আদালতে বিচারকের আসনে ইনছাফ কায়েম করতেন। একদিকে তাঁরা ছিলেন বাইতুল মালের আমানতদার ও পাহারাদার, অন্যদিকে রণাঙ্গনের যোগ্য সেনাপতি ও কুশলী যুদ্ধ- পরিচালক। রাজ্যশাসন ও প্রজাপালনে যেমন তাঁদের কোন তুলনা ছিলো না, তেমনি ইকামাতে দ্বীন ও আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠায়ও তাঁরা ছিলেন তুলনাহীন। এককথায় তাঁদের প্রত্যেকে একই সঙ্গে ছিলেন মুত্তাকী, পরহেযগার ও আল্লহভীরু ধার্মিক এবং সাহসী মুজাহিদ, ফকীহ মুজতাহীদ, বিজ্ঞ বিচারক, সুদক্ষ শাসক ও কুশলী রাজনীতিক। তাঁদের একই ব্যক্তি ছিলেন দ্বীন ও দুনিয়া এবং ধর্ম ও রাজনীতির ধারক, আর তিনি হলেন খলীফাতুল মুসলিমীন ও আমীরুল মুমিনীন। তাঁর চারপাশে ছিলো এমন এক জামা‘আত, যারা মসজিদে নববীতে এবং নববী শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষা অর্জন করেছিলেন। অভিন্ন ছাঁচে তারা গড়ে উঠেছিলেন এবং অভিন্ন চিন্তা-চেতনা এবং আত্মা ও আত্মিকতার অধিকারী ছিলেন। তাঁদের শিক্ষা, দীক্ষা ও তারবিয়াত ছিলো এক ও অভিন্ন। শাসনকার্যে ও অন্যান্য বিষয়ে খলীফা তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করতেন এবং তাঁদের সাহায্য নিতেন। তাঁদের উপস্থিতি ও পরামর্শ ছাড়া উম্মাহর কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন না। ফলে তাঁদের চিন্তা-ভাবনা ও প্রাণ-চেতনা সমাজে ও প্রশাসনে এবং মানুষের জীবন ও চরিত্রে গভীরভাবে প্রতিফলিত হতো এবং তাঁদের স্বভাব-বৈশিষ্ট্য ও চাহিদা-প্রবণতা সর্বত্র পূর্ণরূপে প্রতিবিম্বিত হতো। তাই মানুষের আত্মা ও জড়সত্তা, ইহ জীবন ও পরজীবন এবং ধর্ম ও রাজনীতির মাঝে কোন দ্বন্দ্ব-সংঘাত ছিলো না। তদ্রূপ নীতি ও প্রবৃত্তি এবং উদ্দেশ্য ও নৈতিকতার মাঝে ছিলো না কোন রেষারেষি, এমনকি বিভিন্ন সমাজশ্রেণীর মাঝেও ছিলো না কোন সংঘর্ষ। এককথায় ইসলামী সালতানাত ও মুসলিম সমাজ ছিলো তার পুরোধাপুরুষদের আখলাক ও চরিত্র, স্বভাব ও বৈশিষ্ট্য এবং পূর্ণতা ও ভারসাম্যপূর্ণতার আদর্শ প্রতিচ্ছবি।

জিহাদ ও ইজতিহাদ থেকে বিচ্যুতি

বস্তুত বিশ্বের বুকে ইসলামী ইমামাত ও নেতৃত্ব এবং শাসন ও রাজত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য বেশ কিছু সংবেদনশীল ও সুবিস্তৃত গুণ ও যোগ্যতার অনিবার্য প্রয়োজন। সংক্ষেপে সেগুলোকে আমরা জিহাদ ও ইজতিহাদ, এদু’টি শব্দে প্রকাশ করতে পারি। যে কোন ব্যক্তি বা দল ইসলামী ইমামাতের মহান মর্যাদায় অভিষিক্ত হওয়ার অভিলাষী হবে তাদেরকে অবশ্যই সততা, সত্যবাদিতা এবং তাকওয়া ও ন্যায়পরতার পাশাপাশি জিহাদ ও ইজতিহাদেরও পূর্ণ যোগ্যতার অধিকারী হতে হবে। বাহ্যত শব্দদু’টি খুব সহজ-সরল, কিন্তু কার্যকত তা অত্যন্ত ব্যাপক ও মর্মসমৃদ্ধ। জিহাদ অর্থ জীবনের প্রিয়তম ও মূল্যবানতম উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য চূড়ান্ত প্রচেষ্টা ও সর্বশক্তি ব্যয় করা। মুসলিম জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর পূর্ণ আনুগত্য ও সন্তুষ্টি অর্জন এবং আল্লাহর আদেশ-নিষেধ ও বিধানের সামনে পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ। আর সেজন্য প্রয়োজন এক সুদীর্ঘ জিহাদ ও সুকঠিন সংগ্রামের। এই জিহাদ ও সংগ্রাম হবে ঐসব চিন্তা -বিশ্বাস, চাহিদা ও প্রবৃত্তি এবং শিক্ষা-দীক্ষা ও আদর্শের বিরুদ্ধে যা আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের পথে প্রতিবন্ধক হয়; তদ্রূপ ভিতরের ও বাইরের ঐ সব মিথ্যা উপাস্যের বিরুদ্ধে যারা আল্লাহর ইবাদত ও বন্দেগীর ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়ায়। পরিপূর্ণ আনুগত্য ও আত্মসমর্পণের এ মহৎ গুণ অর্জনের পর একজন মুসলিমের অবশ্যকর্তব্য হবে আপন সমাজে, চারপাশের জনপদে এবং পর্যায়ক্রমে সারা পৃথিবীতে আল্লাহর আদেশ, বিধান ও শাসন প্রতিষ্ঠার জিহাদে আত্মনিয়োগ করা এবং সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় নিয়োজিত হওয়া। এটা হলো আল্লাহর পক্ষ হতে তার উপর অর্পিত অপরিহার্য দায়িত্ব, তদুপরি মানবজাতির প্রতি দয়া ও সহৃদয়তারও এটাই দাবী। কেননা মানবতা ও সভ্যতাকে রক্ষা করার এটাই একমাত্র পথ, এমনকি তার আত্মকল্যাণের জন্যও এটা অপরিহার্য। কারণ এই জিহাদ ও মুজাহাদা ছাড়া ব্যক্তিজীবনের ইবাদত ও আনুগত্যও দুসাধ্য, বরং অসম্ভব হয়ে পড়ে। কোরআনী পরিভাষায় এটাকেই বলা হয়েছে ‘ফিতনা’।

বলাবাহুল্য যে, মানুষ ও পশু-প্রাণী এবং উদ্ভিদ ও জড়বস্তুসহ সমগ্র বিশ্বজগত আল্লাহর ইচ্ছার অধীন এবং তাঁর জাগতিক নিয়ম ও প্রাকৃতিক বিধানের পূর্ণ অনুগত। ইরশাদ হয়েছে-

তাঁরই আনুগত্য গ্রহণ করেছে যা কিছু রয়েছে আকাশমণ্ডলীতে এবং পৃথিবীতে, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, আর তারা তাঁরই সমীপে প্রত্যাবর্তিত হবে।’
আরো ইরশাদ হয়েছে-
তুমি কি দেখো না যে, আল্লাহর সামনেই সিজদাবনত রয়েছে যারা আছে আকাশমণ্ডলীতে এবং পৃথিবীতে এবং (সিজদাবনত) সূর্য, চন্দ্র, তারকারাজি, পাহাড়পর্বত ও পশু-প্রাণী এবং বহু মানুষ; আর অনেকের উপর অবধারিত হয়ে গেছে আযাব।’

এটা হলো প্রাকৃতিক ও বিশ্বজাগতিক বিধান, যাতে মানুষের প্রয়াস-প্রচেষ্টার কোন ভূমিকা নেই। সৃষ্টিজগতে জীবন-মৃত্যু এবং উন্মেষ- বিকাশের যে বিধান আল্লাহ নির্বাচন করেছেন এবং প্রত্যেক শরীর ও স্বভাবের জন্য যে ব্যবস্থা নির্ধারণ করেছেন সেই নিয়ম ও বিধানের বৃত্তেই সকলে বিচরণ করছে এবং করতেই থাকবে; তা থেকে চুল পরিমাণ বিচ্যুত হওয়ার ক্ষমতা ক্ষুদ্র-বৃহৎ কোন সৃষ্টিরই নেই। সুতরাং এক্ষেত্রে মানুষের চেষ্টা-মেহনতের না প্রয়োজন আছে, না অবকাশ। মুসলিম উম্মাহকে যে জিহাদ ও মুজাহাদার আদেশ করা হয়েছে তা হলো আল্লাহর বিধান ও শারী‘আত প্রতিষ্ঠার জিহাদ এবং ইকামাতে দ্বীন ও ই‘লায়ে কালিমাতুল্লাহ-এর মুজাহাদা, যা নবী-রাসূলগণ নিয়ে এসেছেন। যেহেতু ঐশী বিধান ও আসমানী শারী‘আতের বিপক্ষ শক্তি ও তার আন্দোলন পৃথিবীতে সবসময় আছে এবং থাকবে সেহেতু জিহাদ ও মুজাহাদাও কিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। অবশ্য জিহাদ ও মুজাহাদার অসংখ্য শ্রেণী ও প্রকার রয়েছে, যার মধ্যে একটি হলো যুদ্ধ ও লড়াই এবং পরিবেশ-পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে কখনো তা সর্বশ্রেষ্ঠ জিহাদ বলেও গণ্য হয়, যার উদ্দেশ্য হলো, ইসলামের সমকক্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বী কোন শক্তির অস্তিত্ব যেন পৃথিবীতে না থাকে, যা মানুষকে খাহেশাত ও কুপ্রবৃত্তি এবং শিরক ও কুফুরির দিকে টেনে নিতে পারে।

তাই ইরশাদ হয়েছে-
‘আর লড়াই করো তাদের বিরুদ্ধে, যাতে কোন ফিতনার অস্তিত্ব না থাকে এবং পূর্ণ আনুগত্য যেন আল্লাহর জন্য হয়ে যায়।’

এই জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর অন্যতম দাবী এই যে, মানুষ ইসলামের পূর্ণ পরিচয় ও পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জন করবে, যার প্রতিষ্ঠা ও বাস্তবায়নের জন্য সে জিহাদ করতে চায়, তদ্রূপ কুফর ও জাহিলিয়াত সম্পর্কেও তার পূর্ণ অবগতি থাকবে, যার মূলোৎপাটনের জন্য সে লড়াই করতে চায়। ইসলাম সম্পর্কে তার জ্ঞান হবে সঠিক ও নির্ভুল এবং কুফুর সম্পর্কেও তার অবগতি হবে পুঙ্খানুপুঙ্খ, যাতে বাহ্যিকতার বর্ণচ্ছটা দ্বারা কখনো সে প্রতারিত না হয়। হক-বাতিল এবং সত্য-মিথ্যা যখন যেরূপেই তার সামনে আসুক, সে যেন তা চিনতে পারে। এজন্যই হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা) বলেছেন, ‘আমার আশংকা হয় যে, যার জন্ম ও প্রতিপালন হয়েছে ইসলামের পরিমণ্ডলে, অথচ জাহিলিয়াতের পূর্ণ অবগতি অর্জন করেনি, সে একটি একটি করে ইসলামের অঙ্গচ্ছেদন করে ফেলবে।’

এটা অবশ্য ঠিক যে, কুফুর ও জাহিলিয়াতের যাবতীয় প্রকার ও প্রকৃতি এবং প্রকাশ ও অভিপ্রকাশ সম্পর্কে সূক্ষ্ম-নিখুঁত ও পরিপূর্ণ অবগতি প্রত্যেক সাধারণ মুসলমানের জন্য জরুরি নয় এবং সম্ভবও নয়, তবে কুফুর ও জাহিলিয়াতের বিরুদ্ধে জিহাদে যারা নেতৃত্ব দেবে এবং সামনের কাতারে দাঁড়িয়ে লড়াই করবে তাদের জ্ঞান ও অবগতি অবশ্যই সাধারণ ও মধ্যস্তরের মানুষের চেয়ে বেশী হতে হবে এবং ইসলাম ও কুফুর উভয় সম্পর্কেই তাদের জ্ঞান হতে হবে পরিপূর্ণ ও পূর্ণাঙ্গ।

তদ্রূফ কুফুর ও জাহিলিয়াতের বিরুদ্ধে জিহাদ ও সংগ্রামের ক্ষেত্রে তাদের সর্বপ্রকার শক্তি ও প্রস্তুতিও থাকতে হবে এবং তা হতে হবে সাধ্যের ভিতরে চূড়ান্ত স্তরে, যাতে তারা লোহার মুকাবেলায় লোহা হয়ে, এমনকি সম্ভব হলে ইস্পাত হয়ে এবং বাতাসের বিরুদ্ধে ঝড় হয়ে ময়দানে আসতে পারে এবং যুগের বাতিল শক্তির বিরুদ্ধেসর্বশক্তি দিয়ে লড়াই করতে পারে। সম্ভাব্য সকল উপায়-উপকরণ যেন তারা অর্জন করে এবং মানুষের জ্ঞান-প্রযুক্তি যত অস্ত্র ও যন্ত্র এবং কল ও কৌশল উদ্ভাবন করেছে সবই যেন তারা আয়ত্ত করে।

কারণ আল্লাহ তা‘আলার সুস্পষ্ট আদেশ হলো-
‘আর তোমরা প্রস্তুত করো তাদের মুকাবেলার জন্য তোমাদের সাধ্যের সকল শক্তি এবং অশ্বদল। তা দ্বারা ভীত-সন্ত্রস্ত করবে তোমরা আল্লাহর শত্রুকে এবং তোমাদের শত্রুকে এবং তাদেরকে ছাড়া আরো কিছু লোককে, যাদের তোমরা চেনো না, আল্লাহ তাদের চেনেন। আর আল্লাহর রাস্তায় (জিহাদের প্রস্তুতিতে) যা কিছু তোমরা ব্যয় করবে তার প্রতিদান তোমাদের পূর্ণরূপে দান করা হবে, আর তোমাদের প্রতি কোন অবিচার করা হবে না।’

আর ইজতিহাদ দ্বারা উদ্দেশ্য এই যে, মুসলিম উম্মাহর ইমামাত ও নেতৃত্ব এমন সুযোগ্য মানুষের হাতে থাকবে যারা উম্মাহর জীবনে, বিশ্বের অঙ্গনে এবং মুসলিম শাসিত অঞ্চলে নব-উদ্ভূত সকল সমস্যার সঠিক সমাধান দিতে পারেন, যেগুলোর উত্তর বিধিবদ্ধ মাযহাব ও সংকলিত ফিকাহগ্রন্থে পাওয়া যায় না। শারী‘আতের নিগূঢ় তত্ত্ব এবং ইসলামী আইনের মূলনীতিমালা সম্পর্কে তাদের থাকতে হবে পূর্ণ জ্ঞান এবং থাকতে হবে- একক বা সমষ্টিগত- এমন উদ্ভাবনী ও ইজতিহাদী যোগ্যতা, যাতে নতুন যে কোন সমস্যার যথার্থ ইসলামী সমাধান তারা নির্ধারণ করতে পারেন এবং সংকটকালে মুসলিম উম্মাহকে নির্ভুলভাবে পথপ্রদর্শন করতে পারেন।

তারা হবেন এমন মেধা ও উদ্যম এবং জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারী যাতে তারা আল্লাহর সৃষ্ট সকল প্রাকৃতিক শক্তিকে কাজে লাগাতে পারেন এবং ঐ সকল সম্পদ ব্যবহার করতে পারেন যেগুলো আল্লাহ ভূমিতে ও ভূগর্ভে লুকিয়ে রেখেছেন। তাদেরকে এটা নিশ্চিত করতে হবে যেন সকল শক্তি ও সম্পদ ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর সেবায় নিয়োজিত হয়; শয়তান ও তাগুতি শক্তি যেন নিজেদের অশুভ উদ্দেশ্যে এবং পৃথিবীতে অনাচার ও পাপাচার সৃষ্টির কাজে সেগুলো ব্যবহার করতে না পারে।

যোগ্য হাত থেকে অযোগ্য হাতে উম্মাহর ইমামাত

কিন্তু মানবজাতির দুর্ভাগ্য এই যে, খিলাফাতে রাশেদার পর ইসলামী উম্মাহর ইমামাতের মহাগুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বভার এমন লোকদের দখলে চলে গেলো যারা কোনভাবেই এর যোগ্য ছিলো না এবং এজন্য তাদের যথাযথ প্রস্তুতিও ছিলো না। তাদের পূর্ববর্তীগণ, এমনকি তাদের সমকালীন অনেকে যে দ্বীনী তারবিয়াত ও আধ্যাত্মিক দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন তা থেকে তারা বঞ্চিত ছিলো, বরং আরবদের প্রাচীন গোত্রীয় চিন্তা-চেতনা ও ঝোঁক-প্রবণতা থেকেও তাদের মন-মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ মুক্ত ছিলো না। ইসলামের শিক্ষা, আদর্শ ও ভাবধারায় তারা এতটা আত্মস্থ ছিলো না, ইসলামী উম্মাহর নেতৃত্ব -দানের জন্য যা ছিলো অপরিহার্য। জিহাদী চেতনা ও ইজতিহাদী যোগ্যতা কোনটাই তাদের ছিলো না, যা ইসলামী খিলাফাতের গুরু- দায়িত্ব বহন এবং বিশ্বের নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য যা ছিলো জরুরী। আর এটা উমাইয়া ও আব্বাসী উভয় খিলাফাতের ক্ষেত্রেই ছিলো সমান সত্য। ব্যতিক্রম ছিলেন শুধু আদর্শ খলীফা হযরত ওমর বিন আব্দুল আযীয (রহ)।

উম্মাহর জীবনে রাজতন্ত্রের অশুভ প্রভাব

এর ফলে ইসলামের মযবূত দেয়ালে এমন এমন ফাটল দেখা দিলো, যা আর বন্ধ করা সম্ভব হয়নি এবং ইসলামী উম্মাহর জীবনে এমন বিচ্যুতি ও বিকৃতি ঘটলো এবং একের পর এক এমন সব ফিতনা ও দুর্যোগ ধেয়ে আসতে লাগলো যা রোধ করা কারো পক্ষেই সম্ভব হয়নি। এখানে আমরা খুব সংক্ষেপে তার বিবরণ তুলে ধরছি।

রাজনীতি থেকে ধর্মের নির্বাসন

ইসলাম তো সাধারণ অর্থে একটি ধর্মমাত্র ছিলো না; ইসলাম তো ছিলো মানবজাতির ইহকালীন ও পরকালীন জীবনের একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। মানুষের ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সমাজজীবন ও আন্তর্জাতিক জীবন, সবকিছুকে ইসলাম সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ করে। ইসলামের দ্ব্যর্থহীন দাবী হলো, সবকিছুতে শুধু আল্লাহর আদেশ নিষেধ কার্যকর হবে, অন্যকারো নির্দেশ নয়। সুতরাং রাজনীতি ও দেশশাসনের ক্ষেত্রেও রয়েছে ইসলামের নিজস্ব আদেশ-নিষেধ ও বিধিবিধান। খিলাফতে রাশিদার দায়িত্ব ছিলো ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে রাজ্যশাসন পর্যন্ত সর্বত্র আল্লাহর আদেশ-নিষেধের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন এবং খোলাফায়ে রাশিদীন পূর্ণ আমানতদারির সঙ্গে সে দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু পরবর্তীকালে দ্বীন ও সিয়াসাত তথা ধর্ম ও রাজনীতির মাঝে কার্যত বিভাজন দেখা দিলো। শাসনক্ষমতা এমন লোকদের হাতে এসে গেলো যাদের না দ্বীন ও শারী‘আতের প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও প্রজ্ঞা ছিলো, না তারা ওলামায়ে উম্মতের পৃষ্ঠপোষকতা গ্রহণ করেছিলো। রাজনীতি ও রাজ্যশাসনে তাদের ছিলো একচ্ছত্র ক্ষমতা। খেয়াল-খুশিতে, বা স্বার্থ-সুবিধার তাগাদায় তারা বিশেষজ্ঞ উপদেষ্টা হিসাবে ওলামায়ে উম্মত ও ফোকাহায়ে দ্বীন-এর সাহায্য নিতো এবং রাজনৈতিক ও সামাজিক স্বার্থে নিজেদের মত করে তাঁদের ব্যবহার করতো, অর্থাৎ ওলামায়ে উম্মতের পরামর্শ যতটুকু ইচ্ছা গ্রহণ করতো, যতটুকু ইচ্ছে বর্জন করতো। আবার সুযোগ হলে একেবারেই মুখ ফিরিয়ে নিতো। এমনকি অনেক সময় তাঁদের উপর নির্মম নিপীড়ন নেমে আসতো। এভাবে রাজনীতি ও রাজ্যশাসন দ্বীনের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়ে গেলো এবং ইসলামী খিলাফত হয়ে গেলো রোম ও পারস্যের মত নিছক স্বেচ্ছারী রাজতন্ত্র। খলীফা ও তার খিলাফত হয়ে গেলো, যেন লাগামহীন অবাধ্য উট। পরিস্থিতি যখন এমন গুরুতর, তখন ওলামায়ে ওম্মতের অবস্থা ছিলো এই যে, কেউ হুকুমতের প্রকাশ্য বিরোধিতায় অবতীর্ণ হতেন এবং কখনো কখনো বিদ্রোহ ঘোষণা করতেন। কেউ সংশোধনের চেষ্টায় কখনো কঠোর, কখনো কোমল ভাষায় তিরস্কার করতেন এবং উপদেশ দিতেন। তারা সব দেখতেন, শোনতেন, আর নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলতেন; কার্যত তাদের করার কিছুই ছিলো না। আরেকদল সংশোধনে হতাশ হয়ে সবকিছু থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছিলেন। রাজনীতি থেকে স্বেচ্ছা নির্বাসনে গিয়ে তারা আত্মশোধন ও ব্যক্তিসংশোধন প্রচেষ্টায় নিয়োজিত হয়েছিলেন। হয়ত তারা ভাবতেন, এভাবে যদি নিজেকে ও অল্পসংখ্যক অনুসারীকে দুনিয়ার ফিতনা থেকে বাঁচানো যায় তাহলে সেটাও অনেক বড় কামিয়াবি।

কেউ দ্বীনের কল্যাণ ভেবে শাসক ও সরকারের সঙ্গে সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করেছিলেন। একদল এমনও ছিলো যারা শুধু হালুয়া-রুটির জন্য শাহী দরবারে হাজিরা দিতো। সব মিলিয়ে ফলাফল এই ছিলো যে, তত্ত্বে ও বিশ্বাসে না হলেও কার্যত দ্বীন ও সিয়াসাত এবং ধর্ম ও রাজনীতি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলো। আরো সরল ভাষায় যদি বলি, খিলাফতে রাশেদা-পূর্ব দুনিয়ার শাসনব্যবস্থার মত নামসর্বস্ব খিলাফতও তেমনি ধর্মহীন ও চরিত্রহীন অবয়ব লাভ করেছিলো। দ্বীন ও শরী‘আত যেন ছিলো ডানাকাটা পাখী, কিংবা শেকলপরা বন্দী, আর রাজনীতি ছিলো অবাধ ও মুক্ত-স্বাধীন। ধর্মের বাঁধন ও নিয়ন্ত্রণ শিথিল হতেই থাকলো, আর রাজনীতির ভ্রষ্টাচার ও স্বেচ্ছাচার বেড়েই চললো। শেষ পর্যন্ত আহলে ইলম ও আহলে সিয়াসাত দু’টি বিপরীত শ্রেণীরূপে আত্মপ্রকাশ করলো, যাদের অপরিচয় ও দূরত্ব কখনো কখনো বিরোধ ও বিদ্বেষের রূপ গ্রহণ করতো।

শাসকদের মাঝে জাহিলিয়াতের ভাবধারা

শাসকবর্গ, এমনকি খিলাফাতের ‘আমানতদার’ ব্যক্তিটিও দ্বীন ও আখলাক এবং ধর্ম ও নৈতিকতার আদর্শ ছিলেন না, বরং অনেকেই জাহেলিয়াতের চিন্তা-চেতনা ও রোগজীবাণু বহন করতো। ফলে স্বভাবতই জীবন ও সমাজের সর্বত্র তা সংক্রমিত হয়ে পড়েছিলো এবং মানুষ তাদের স্বভাব-চরিত্র ও নীতি-নৈতিকতাকেই অনুসরণ করতে শুরু করেছিলো। এটাই মানুষের স্বভাব ও ফিতরাত। তাই বলা হয়, ‘আন্‌নাসু আলা দ্বীনি মুলূকিহিম’- রাজার চালে রাজ্য চলে। দ্বীনের নিয়ন্ত্রণ, নৈতিকতার শাসন এবং বিবেকের অনুশাসন একেবারে শিথিল হয়ে পড়েছিলো। ‘আমর বিল মা‘রূফ ও নাহী আনিল মুনকার’ হয়ে পড়েছিলো নিষ্ক্রিয় ও নিষ্ফল। কারণ তার পিছনে ছিলো না সরকারি ব্যক্তি ও শক্তি। দ্বীনদার শ্রেণীর স্ব-উদ্যোগের আদেশ-নিষেধের কেউ পরোয়া করতো না। কেননা তাদের না ছিলো তিরস্কারের ক্ষমতা, না পুরস্কারের সামার্থ্য। অথচ খাহেশাত ও প্রবৃত্তির উপকরণ ছিলো প্রচুর এবং অনাচার ও পাপাচারের হাতছানি ছিলো প্রবল। ফলে ইসলামী সমাজ ও মুসলিম জীবনে জাহিলিয়াত আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো এবং দ্রুত শক্তি বিস্তার করতে লাগলো। আর দ্বীন ও দ্বীনিয়াত ভুলে মানুষ ডুবে গেলো ভোগ-বিলাস, খেল-বিনোদন ও শাহওয়ত-খাহেশাতের গান্দেগিতে। চিরস্থায়ী আখেরাতের পরিবর্তে মানুষের তখন লক্ষ্য ছিলো দুনিয়ার ধনদৌলত এবং ক্ষণস্থায়ী যিন্দেগির শানশৌকত। নফস ও নফসানিয়াতের বাজার ছিলো গরম। নাচ-গান এবং সুর ও সুরার মায়ফিল ছিলো জমজমাট। একথায় সমাজের প্রায় সবমানুষ সবকিছু ভুলে সবকিছুতে ডুবে গিয়েছিলো। ইছফাহানীর কিতাবুল আগানী এবং জাহিযের কিতাবুল হায়াওয়ান খুলুন; এদু'টোই আপনাকে খুলে খুলে বলে দেবে, মানুষ তখন কতটা ভোগবাদী ও প্রবৃত্তিপরায়ণ হয়ে পড়েছিলো! কেমন সর্বগ্রাসী ছিলো দুনিয়ার লোভ-লালসা এবং পাপসর্বস্ব জীবনের আসক্তি! জীবন ও চরিত্রের এত দূর অধঃপতনের পর এবং অনাচার, পাপাচার ও ভোগ-বিলাসের এমন অতলে ডুবে যাওয়ার পর কোন জাতির পক্ষে আর যাই হোক, ইসলামের প্রতিনিধিত্ব করা, দাওয়াত ও তাবলীগের দায়িত্ব পালন করা এবং নবুয়তের স্থলবর্তী হয়ে আল্লাহ ও আখেরাতের পথে ডাকা এবং তাকওয়া ও তাহারাতের প্রতি উদ্বুদ্ধ করা এবং জীবন ও চরিত্রে মানুষের জন্য আদর্শ হওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়, এমনকি দীর্ঘকাল স্বাধীন জীবনের স্বাদ গ্রহণ করাও তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। যিল্লতি ও বরবাদি এবং লাঞ্ছনা ও অপদস্থতাই শুধু হতে পারে তাদের ভাগ্যলিপি। আলাকোরআনের ভাষায়- ‘এটাই ছিলো আল্লাহর শাশ্বত বিধান ঐসকল জাতির ক্ষেত্রে যারা বিগত হয়েছে, আর কিছুতেই পাবে না তুমি আল্লাহর বিধানে কোন পরিবর্তন।’

ইসলামের মন্দ প্রতিনিধিত্ব

এই অপদার্থ শাসকবর্গ তাদের যাবতীয় আচরণে-উচ্চারণে প্রকৃতপক্ষে নিজেদের ভ্রান্ত চিন্তা-চেতনা এবং ভ্রষ্ট রাজনীতি ও শাসনব্যবস্থারই শুধু প্রতিনিধিত্ব করছিলো; ইসলামের শিক্ষা ও আদর্শ, ইসলামের রাজনীতি ও সমরনীতি এবং ইসলামের সভ্যতা ও শাসনব্যবস্থার খুব কম প্রতিফলনই ছিলো তাদের জীবনে। ফলে অমুসলিদের সামনে ইসলামের বাণী ও বার্তা এবং দাওয়াত ও আহ্বান তার সব আবেদন হারিয়ে ফেলেছিলো, বরং ইসলামের প্রতি তাদের আস্থা ও আশ্বস্তিই দুর্বল হয়ে পড়েছিলো। জনৈক ইউরোপীয় ঐতিহাসিকের ভাষায়- ‘ইসলামের অবনতি শুরু হয়েছিলো এজন্য যে, মানবজাতি তাদের সততা ও সত্যতায় সন্দিহান হয়ে পড়েছিলো যারা এই নতুন ধর্মটির প্রতিনিধিত্ব করছিলো।’

জ্ঞানচর্চার মৌলিক ভ্রান্তি

আরেকটি বড় বেদনাদায়ক বিষয় ছিলো এই যে, অবনতি ও অবক্ষয়ের ঐ যুগে মুসলিম জ্ঞানী- মনীষিগণ যে গভীর অধ্যবসায় ও অনুসন্ধিৎসা নিয়ে অতিপ্রাকৃতিক জ্ঞান ও গ্রীক ঈশ্বরতত্ত্ব চর্চা করেছেন, প্রাকৃতিক ও প্রায়োগিক বিজ্ঞানের চর্চা-গবেষণা তারা সেই পরিমাণ করেননি, অথচ জীবন ও জগতের নেতৃত্বের জন্য সেগুলোই ছিলো কার্যকর ও ফলপ্রসূ জ্ঞান। পক্ষান্তরে গ্রীক ঈশ্বরতত্ত্ব ছিলো শুধু গ্রীকদের জাতীয় প্রতিমাতত্ত্ব, যা তারা দর্শনিক পরিভাষা ও শাস্ত্রীয় পোশাকে উপস্থাপন করেছিলো- মাত্র। তাতে তত্ত্ব ও সত্য এবং সার ও সর বলতে কিছুই ছিলো না, ছিলো শুধু ধারণা ও অনুমান এবং শব্দজৌলুস ও বাক্য-ঝিলিক। অথচ মুসলিম উম্মাহর বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনে এসবের না ছিলো প্রয়োজনীয়তা, না ছিলো কোন সার্থকতা। কেননা নবী ও নবুয়তের মাধ্যমে উম্মাহকে আল্লাহ তা‘আলা যাত ও ছিফাত এবং ইলাহিয়্যাত সম্পর্কে সুসংহত ও সুনিশ্চিত জ্ঞান দান করেছিলেন, যার পর ঈশ্বরতত্ত্বীয় এসব চুলচেরা দার্শনিক আলোচনা ও ‘রাসায়নিক’ বিশ্লেষণে যাওয়া ছিলো নিরর্থক, বরং ধ্বংসাত্মক। আল্লাহ তো তাদের দান করেছিলেন ‘আল- ফোরকান’ নামে সুস্পষ্ট হিদায়াত ও নূর। কিন্তু মুসলিম চিন্তানায়করা এ মহান নিয়ামতের ‘শায়ানে শান’ শোকর এবং যথাযোগ্য কদর করেনি, বরং দীর্ঘ কয়েক শতাব্দী তারা গ্রীক-চিন্তাপ্রসূত এসকল জ্ঞান ও শাস্ত্র নিয়েই মাথা ঘামিয়েছে এবং দার্শনিক ও কালামশাস্ত্রীয় এসকল অর্থহীন ও নিষ্ফল জটিলতায় মেধা ও বুদ্ধির অপচয় ঘটিয়েছে। এককথায় জিহাদের প্রকৃত ক্ষেত্র ত্যাগ করে বীরবিক্রমের তারা ‘বুদ্ধিবৃত্তিক জিহাদ’ করেছে এবং নিজেদের হাতে নিজেদের বিপর্যয় ডেকে এনেছে। এই নির্বোধ বুদ্ধিবিলাস তাদেরকে ঐসকল প্রায়োগকি জ্ঞান-গবেষণা ও শাস্ত্রচর্চা থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে, যা দ্বারা প্রকৃতির যাবতীয় শক্তি ও সম্ভাবনা করায়ত্ত করে সেগুলোকে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর কল্যাণে নিয়োজিত করা যায় এবং সমগ্র বিশ্বের উপর ইসলামের জাগতিক ও আধ্যাত্মিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করা যায়। একই ভাবে তারা রূহ ও আত্মা, ফালসাফাতুল ইশরাক ও নবপ্লেটো দর্শন এবং ওয়াহদাতুল ওজূদ ও এককসত্তাবাদ-এর জটিল আলোচনায় আত্মনিয়োগ করেছে এবং সময়, শ্রম, মেধা ও প্রতিভার বিপুল অংশ তাতেই ব্যয় করেছে।

একথা অবশ্য সত্য যে, মুসলিম মনীষিগণ প্রায়োগিক জ্ঞান ও প্রকৃতি বিজ্ঞানে যথেষ্ট অবদান রেখেছেন এবং তাদের কীর্তি ও কর্ম, গবেষণা ও উদ্ভাবনা পূর্ববর্তীদের তুলনায় অনেক বেশী ছিলো; কিন্তু সত্য এই যে, জ্ঞানের অন্যান্য শাখায় তাদের সুবিস্তৃত অবদানের সাথে তা মোটেই সঙ্গতিপূর্ণ ছিলো না। তদ্রূপ ইতিহাসের যে সুদীর্ঘ সময়কাল তারা ভোগ করেছে সে তুলনায় তা সন্তোষজনক ছিলো না। এসময় প্রকৃতি বিজ্ঞানের শাখায় ঐ পরিমাণ প্রতিভা ও মনীষার আবির্ভাব ঘটেনি, জ্ঞান ও শাস্ত্রের অন্যান শাখায় যেমন ঘটেছে।

পক্ষান্তরে পরবর্তী যুগের সাথে যদি তুলনা করি তাহলেও বলতে হবে যে, প্রকৃতি বিজ্ঞান ও মহাজাগতিক বিজ্ঞানের উপর যে পরিমাণ গবেষণা ও গ্রন্থনা তারা রেখে গেছেন যদিও উত্থানকালের ইউরোপ সেগুলো থেকে বিরাটভাবে উপকৃত হয়েছে এবং মোটামুটি মূল্যায়নও করেছে; কিন্তু মাত্র সতের ও আঠারো শতকের সময়সীমায় ইউরোপের জ্ঞানী-বিজ্ঞানিগণ যে বিশাল ও সুসমৃদ্ধ গ্রন্থাগার তৈরী করেছেন তার তুলনায় সেগুলো একেবারেই নগণ্য। স্পেন ও প্রাচ্যের মুসলিম বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার-উদ্ভাবন ও গবেষণাকর্ম নিয়ে আমরা যতই গর্ব করি পাশ্চাত্যের কীর্তি ও কর্মের পাশে তা উল্লেখযোগ্যই নয়। মানে ও পরিমাণেও নয়, নতুনত্ব ও সৃজনশীলতায়ও নয় এবং বৈজ্ঞানিক সূক্ষ্মতা ও শাস্ত্রীয় উৎকর্ষেও নয়। প্রাকৃতিক ও প্রায়োগিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের তুলনায় আধ্যাত্মিক বিষয়াদির প্রতি ইসলামী প্রাচ্য কত বেশী যত্নবান ছিলো তা যদি বুঝতে চান তাহলে উদাহরণস্বরূপ শায়খ ইবনুল আরাবী-এর আলফুতূহাতুল মাক্কিয়্যাহ এবং প্রকৃতি বিজ্ঞানের শ্রেষ্ট গ্রন্থটির মাঝে তুলনা করে দেখুন; প্রথমটির তত্ত্ব ও তথ্যের বিপুলতায় এবং বিষয়বস্তুর প্রতি সযত্ন প্রয়াস ও আত্মনিবেদনের গভীরতায় আপনি হতবাক হয়ে যাবেন এবং তা থেকেই বুঝে যাবেন, প্রাচ্যের রুচি, ঝোঁক ও প্রবণতা মূলত কী ছিলো!

শিরক ও বিদ‘আতের ছড়াছড়ি

মুসলিম উম্মাহর অবক্ষয় ও অধঃপতনের এ চরম সময়কালে বিভিন্ন প্রকার শিরক ও বিদ‘আত এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছিলো যে, আকল হতবাক হয়ে যায়! বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয়, এ উম্মাহ হযরত ইবরাহীমের অনুসারী তাওহীদবাদী উম্মাহ, যার নাম তিনি রেখেছেন মুসলিম উম্মাহ। শিরক ও বিদ‘আত এবং মূর্খতা ও গোমরাহীর ঘোর অন্ধকারে ইসলামের পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন তাওহীদ প্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলো এবং জাহিলিয়াতের ভ্রান্তি ও বিভ্রান্তি, চিন্তা-চেতনা ও কুসংস্কার মুসলিম জীবনের গভীরে অনুপ্রবেশ করেছিলো এবং শিকড় গেড়ে বসেছিলো। এভাবে বলা যায়, সমাজজীবন ও ধর্মীয় জীবনের এক বিরাট অংশ জাহিলিয়াতের কবলে চলে গিয়েছিলো এবং মুসলিম জাতি সঠিক দ্বীন থেকে যেমন বিচ্যুত ছিলো তেমনি বাস্তব দুনিয়া থেকেও পড়েছিলো। অথচ বিশ্বের জাতিবর্গের মাঝে মুসলিম উম্মাহর যা কিছু বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্ব তার মূল হচ্ছে এই আসমানী দ্বীন যা আল্লাহর নবী মুহম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়ে এসেছেন এবং উম্মাহর কাছে আমানত রেখে গেছেন। আর মৌলিকতা, নির্ভুলতা, নির্ভেজালতা ও সংরক্ষণীয়তাই হলো এই দ্বীনের একক বৈশিষ্ট্য ও অলৌকিকত্ব। এই দ্বীন হচ্ছে আল্লাহর অহী, যা চিরসংরাক্ষিত-

‘আমিই নাযিল করেছি এই যিকির এবং অবশ্যই আমিই তার হিফাযাতকারী।’
এই দ্বীন হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ হতে অবতারিত মহাপ্রজ্ঞাপূর্ণ শরী‘আত যা পরিপূর্ণ ও নিখুঁত- ‘সেই আল্লাহর কীর্তি যিনি সকল কিছুকে নিখুঁত করেছেন।’ এই দ্বীন হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ হতে নির্ধারিত এমন এক সত্যপথ, যাতে মিথ্যা ও ভ্রান্তির সামান্যতম অনুপ্রবেশেরও অবকাশ নেই- ‘তাতে আসতে পারে না বাতিল তার সম্মুখ থেকে এবং না তার পশ্চাত থেকে। (তা তো) মহাপ্রজ্ঞার অধিকারী, চিরপ্রশংসিত-এর অবতারণ।’ সুতরাং আল্লাহ না করুন, অন্যান্য ধর্মের মত এখানেও যদি মানব-মস্তিষ্কের অনুপ্রবেশ ঘটে; খাহেশাত ও প্রবৃত্তির চাহিদা চরিতার্থ করার জন্য এখানেও যদি মানুষ হস্তক্ষেপ করে তাহলে অন্যান্য ধর্মের উপর তার কোন বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্বই তো আর অবশিষ্ট থাকে না এবং এ ধর্ম এই উম্মাহর দুনিয়া ও আখিরাতের সৌভাগ্য ও সফলতার যামিন হতে পারে না, এমনকি এ যোগ্যতাও অবশিষ্ট থাকে না, যাতে মানুষের বুদ্ধি ও মস্তিষ্ককে অনুগত করতে হৃদয় ও আত্মার জগতে সে কোন আবেদন সৃষ্টি করতে পারে। দ্বীনের দওয়াত ও তাজদীদেও চিরন্তনতা উপরে যে চিত্র তুলে ধরা হলো তারপরো একথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, অবক্ষয় ও অধঃপতনের এ দীর্ঘ সময়কালেও আল্লাহর প্রেরিত ‘দ্বীনুল ইসলাম’ ছিলো পূর্ণ জীবন্ত এবং সর্বপ্রকার পরিবর্তন ও বিকৃতি থেকে সম্পূর্ণ সুরক্ষিত। দ্বীন ও শরী‘আত মুসলমানদের কোন ভ্রান্তি ও বিচ্যুতিতে কখনো সঙ্গ দান করেনি, বরং সতর্ক করেছে এবং অন্ধকার থেকে আলোতে ফিরে আসার আহ্বান অব্যাহত রেখেছে। এ আলোর মিনার থেকে আলোর বিচ্ছুরণ কখনো বন্ধ হয়নি। তখনো মানুষ দ্বীনের আলোতে সত্যের পথ দেখতে পেতো এবং সত্যের পতে চলতে থাকতো- ‘প্রদর্শন করেন তা দ্বারা আল্লাহ শান্তির পথ ঐ লোকদেরকে যারা তাঁর সন্তুষ্টি অনুসরণ করে এবং বের করে আনেন তিনি তাঁর ইচ্ছায় তাদেরকে যাবতীয় অন্ধকার থেকে নূরের দিকে এবং পথপ্রদর্শন করেন তাদেরকে সরল পথের দিকে।’ কিতাব ও সুন্নাহ তখনো মুসলিম- হৃদয়ে শিরক ও বিদ‘আত এবং গোমরাহি ও জাহিলিয়াতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সৃষ্টি করতো। কোরআন ও সুন্নাহর উদাত্ত আহ্বানে তখনো মানুষ ভোগবাদ ও স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে এবং দ্বীন ও শরী‘আতের যে কোন অবমাননায় ক্রদ্ধ হতো। তখনো বহু মানুষের দিলে জাযবায়ে জিহাদ ও তামান্নায়ে শাহাদাত যিন্দা ছিলো। একারণেই ইসলামী ইতিহাসের প্রত্যেক যুগে এবং মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি অংশে এমন অসংখ্য মহান ব্যক্তি ও সাহসী ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটেছে, শত প্রতিকূলতার মুখেও উম্মাহর মাঝে যারা নবীর নেয়াবাতের হক আদায় করেছেন এবং দ্বীনের তাজদীদ ও পুনর্জাগরণের সুকঠিন দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করেছেন। একদিকে তাঁরা উম্মাহর মুর্দা দিলে জিহাদের রূহ ফুঁকেছেন এবং বহু যুগের শান্ত সমুদ্রে তরঙ্গদোলা সৃষ্টি করেছেন; অন্যদিকে তাদের সামনে ইজতিহাদের বদ্ধ দুয়ার খুলে দিয়েছেন এবং স্বকীয় যোগ্যতা দ্বারা মুসলিম সমাজে চিন্তার বান্ধাত্য দূর করে নতুন ইলমি চেতনা ও বুদ্ধিবৃত্তিক জাগরণ সৃষ্টি করেছেন। এমন মর্দে মুজাহিদেরও তখন অভাব ছিলো না যারা খিলাফাতে রাশেদার অনুসরণে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছেন। এ মহান উদ্দেশ্যের পথে অনেকে যেমন শাহাদাত বরণ করেছেন তেমনি কেউ কেউ খিলাফাতে রাশেদার নূরানি যামানার ছায়াস্বরূপ স্বল্পকালীন শাসন প্রতিষ্ঠায় সক্ষমও হয়েছেন। কোরআনের ভাষায়- ‘মুমিনদের মধ্যে রয়েছে এমন কিছু লোক যারা আল্লাহর সঙ্গে কৃত তাদের ওয়াদাকে সত্য সাব্বস্ত করেছে; তারপর তাদের একদল নিজ নিজ সময় পূর্ণ করেছে, আর একদল অপেক্ষা করছে; তারা কোন প্রকার পরিবর্তন আনয়ন করেনি।’ উম্মাহর এই সুনির্বাচিত জামা‘আত সম্পর্কেই হাদীছ শরীফে বলা হয়েছে- ‘আমার উম্মতের একটি দল সর্বদা হকের উপর অবিচল থাকবে, তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না তারা, যারা তাদের বিরুদ্ধাচরণ করবে, বা সঙ্গ পরিত্যাগ করবে, এমনকি এসে যাবে আল্লাহর ফায়ছালা।’ মোটকথা, জিহাদ ও তাজদীদের ইতিহাস ছিলো ধারাবাহিক ও নিরবচ্ছিন্ন; তাতে কখনো কোন শূন্যতা ছিলো না। ইছলাহ ও সংস্কার এবং তাজদীদ ও সংশোধনের মশাল সবসময় সমুজ্জ্বল ছিলো এবং এক হাত থেকে অন্য হাতে তা প্রজ্বলিত হয়ে এসেছে। উম্মাহর জীবনে প্রবল থেকে প্রবল ঝড়ঝঞ্ঝায়ও ইসলামী জাহানের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত সর্বব্যাপী অন্ধকার ছড়াতে পারেনি। কোথাও না কোথাও, কেউ না কেউ দ্বীনের ঝাণ্ডা এবং সত্যের মশাল সমুচ্চ রেখেছেন। তদ্রূপ ইসলাম, কিংবা ইসলামী জাহানের সামনে যখন নতুন কোন ফেতনা ও খাতরা এবং বিপদ ও দুর্যোগ দেখা দিয়েছে তখনই কোন না কোন শেরদিল মর্দে মুজাহিদ হুঙ্কার দিয়ে ময়দানে এসেছেন এবং বিপদ-দুর্যোগের শুধু মুকাবেলাই করেননি, বরং ইসলামী উম্মাহ ও মুসলিম জাহানকে নতুন প্রাণ ও নতুন জীবন দান করেছেন। ইসলামী ইতিহাসের মহান শাসক নূরুদ্দীন ও ছালাহুদ্দীন হচ্ছেন তেমনি দু’টি আলোকিত উদাহরণ। ক্রশেডের প্রতিরোধে মুসলিম জাহান কয়েক শতাব্দী থেকেই খৃস্টান ইউরোপ ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্বেষে টগবগ করছিলো। মুসলিম উম্মাহ খৃস্টানদের সমগ্র পূর্বসাম্রাজ্য অধিকার করে রেখেছিলো। বাইতুল মুকাদ্দাসসহ তাদের সকল পবিত্র ভূমি ছিলো মুসলিম-নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু শক্তিশালী মুসলিম সালতানাত- সমূহের উপস্থিতি এবং প্রতিবেশী খৃস্টান রাজ্যগুলোতে তাদের অব্যাহত অগ্রাভিযানের কারণে এদিকে চোখ তুলে তাকাবারও খৃস্টানবিশ্বর সাহস ছিলো না, হামলা করা তো দূরের কথা। কিন্তু হিজরী ষষ্ঠ শতকে সেলজুকীদের পতনের পর মুসলিম জাহান দুর্বলতার চরমে পৌঁছে গিয়েছিলো, বরং বলা যায়, একধরনের জরাবার্ধক্যে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলো। বিশাল বিস্তৃত মসলিম জাহান ছিলো খণ্ডবিখণ্ড। ‘বড় বড়’ শাসক প্রবল প্রতাপে ছোট ছোট রাজ্য শাসন করতেন। অবস্থা এমনই অবনতিশীল ছিলো যে, ইউরোপের ধর্মোন্মাদ ক্রশেডবাহিনী অভিযান ও আগ্রাসন শুরু করে দিলো। তাদের প্রথম লক্ষ্য তো ছিলো মুসালম-দখল থেকে পবিত্র- ভূমিগুলো উদ্ধার করা। কিন্তু একসময় তারা, ইসলাম ও গোটা মুসলিম উম্মাহর জন্যই চ্যালেঞ্জ এবং সিরিয়ার পার্শ্ববতী রাজ্য- গুলোসহ ইসলামের প্রাণকেন্দ্র জাযিরাতুল আরবের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ালো। ক্রশেডবাহিনী ঝড়- তুফানের মত সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের দিকে ধেয়ে এলো এবং ৪৯২ হিজরীতে (১০৯৯ ঈসায়ী) বাইতুল মাকদিস দখল করে নিলো এবং মাত্র কয়েক বছরের ভিতরে সিরিয়া ও ফিলিস্তিনের প্রায় সব শহর ও জনপদ তাদের দখলে চলে গেলো, এমনকি তারা মদীনাতুর-রাসূল (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের) দিকেও নাপাক দৃষ্টি দেয়ার আস্পর্ধা দেখাতে লাগলো। প্রসিদ্ধ ইংরেজ ঐতিহাসিক ংঃধহষবু ষধহ ঢ়ড়বষ লিখেছেন- ‘ক্রশেড বাহিনী দেশের গভীরে এমনভাবে ঢুকে পড়লো যেমন পঁচা কাঠে পেরেক ঢুকে যায়। কিছু সময়ের জন্য এমনই মনে হচ্ছিলো যে, তারা ইসলাম-বৃক্ষের কাণ্ড চিরে ফালি ফালি করে ফেলবে।’ বাইতুল মাকদিসে প্রবেশের পর বিজয়ের নেশায় উন্মাদ ক্রশেডাররা অসহায় মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর যে চরম পাশবিকতা ও হিংস্রতা চালিয়েছিলো তা এক দায়িত্বশীল খৃস্টান ঐতিহাসিক এভাবে তুলে ধরেছেন- ‘বাইতুল মাকদিসে বিজয়ী বেশে প্রবেশের পর ধর্মযোদ্ধারা এমন ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছিলো যে, বলা হয়, মসজিদে ওমরে যাওয়ার পথে তাদের ঘোড়া হাঁটু পর্যন্ত রক্তে ডুবে গিয়েছিলো। দেয়ালে আছড়ে আছড়ে শিশুদের হত্যা করা হয়েছে, অথবা নগর-প্রাচীর থেকে চরকির মত ঘুরিয়ে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে।’ বস্তুত বাইতুল মাকদিসের বিজয় বা পতন ছিলো ইসলামী সালতানাতের চরম দুর্বলতা এবং নতুন শক্তিরূপে খৃস্টান জগতের উত্থানের প্রতীক এবং ইসলামী জাহানের জন্য বিপদ-ঘণ্টা। খৃস্টানদের সাহস এতটাই বেড়ে গিয়েছিলো যে, কর্ক-এর শাসনকর্তা রেজিনাল্ড পবিত্র মক্কা ও মদীনায় হামলা চালানোর চিন্তা পর্যন্ত করেছিলো। বস্তুত প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর (রা)-এর খিলাফাতের শুরুতে যে ব্যাপক ধর্মত্যাগ ঘটেছিলো (ফিতনায়ে ইরতিদাদ) তার পর ইসলামের ইতিহাসে এর চেয়ে ভয়াবহ ও বিপজ্জনক ফিতনা আর কখনো আসেনি। এই নাযুকতম মুহূর্তে হতাশার অন্ধকারে প্রায় ডুবে যাওয়া ইসলামী উম্মাহর প্রতি আল্লাহ তা‘আলা বিরাট অনুগ্রহ করলেন এবং এমন কতিপয় মর্দে মুজাহিদের আবির্ভাব ঘটালেন যারা আল্লাহর রহমতের ছায়া হয়ে মুসলিম উম্মাহকে রক্ষা করলেন এবং ইসলামী জাহানে নবজাগরণ সৃষ্টি করলেন। তাদেরই একজন হলেন ইমাদুদ্‌-দীন আতাবেক যাঙ্গী (মৃ ৫৪১ হিজরী)। তিনি বিপুল বিক্রমে লড়াই করে বহু রণক্ষেত্রে ক্রশেড বাহিনীকে পর্যুদস্ত করেছিলেন এবং অবশেষে রাহা অধিকার করেছিলেন। তারপর তাঁর সুযোগ্য পুত্র আলমালিকুল আদিল (ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ) নূরুদ্‌-দীন যাঙ্গী জিহাদের ঝাণ্ডা নিয়ে দাঁড়ালেন এবং সিরিয়া ও ফিলিস্তিন থেকে খৃস্টান বাহিনীকে উৎখাত করে বাইতুল মাকদিস মুসলিম-অধিকারে ফিরিয়ে আনার সুদৃঢ় প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করলেন। তিনি বাইতুল মাকদিস ছাড়া ফিলিস্তিনের প্রায় সমগ্র ভূখণ্ড থেকে খৃস্টান বাহিনীকে বিতাড়িত করলেন। বাইতুল মাকদিস পুনরুদ্ধারের স্বপ্ন পূর্ণ হওয়ার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়ে গেলো। কেননা এ মহাসৌভাগ্য আল্লাহ তা‘আলা সুলতান ছালাহুদ্‌-দীন আইয়ূবী (রহ)-এর ভাগ্যে লিখে রেখেছিলেন। মহত্ত্বে ও মহানুভবতায়, ধার্মিকতা ও নির্মোহতায়, সুবিচার ও শাসনকুশলতায়, বিনয় ও সরলতায়, জিহাদী চেতনা ও শাহাদাতের আকাঙ্ক্ষায় এবং ঈমান ও বিশ্বাসের দৃঢ়তায় সুলতান নূরুদ্‌দীন ছিলেন ইসলামী ইতিহাসের উজ্জ্বলতম ব্যক্তিদের একজন। সুপ্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ইবনুল আছীর ছিলেন তাঁর কনিষ্ঠ সমসাময়িক। তিনি বলেন, ‘বিগত শাসকদের জীবন ও জীবনচরিত আমি গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছি। খোলাফায়ে রাশেদীন এবং হযরত ওমর বিন আব্দুল আযীয (রহ)-এর পর নূরুদ্‌-দীনের চেয়ে উত্তম চারিত্রবান এবং অধিক ন্যাপরায়ণ কোন শাসক আমার নযরে আসেনি।’ নূরুদ্‌-দীনের পর তাঁরই প্রিয়পাত্র ও মনোনীত ব্যক্তি সুলতান ছালাহুদ্‌-দীন ইউসুফ বিন আইয়ূব (রহ) মিশরের শাসনক্ষমতা গ্রহণ করলেন, আর তিনিই হলেন সেই মহান ব্যক্তি যাকে আল্লাহ তা‘আলা বাইতুল মাকদিস পুনরুদ্ধারের মহাগুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের জন্য নির্বাচন করেছেন। তিনি ক্রশেড বিশ্বের মুকাবেলার জন্য ইসলামী জাহানের নেতৃত্ব হাতে নিলেন এবং বেশকিছু রণাঙ্গণে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৪ই রবিউল আখির ৫৮৩ হিজরীতে (৪ঠা জুলাই ১১৮৭ ঈসায়ী) হিত্তীনের ভাগ্যনির্ধারণী লড়াইয়ে ক্রশেডবাহিনীকে এমন পর্যুদস্ত করলেন যে, কোমর ভেঙ্গে গেলো এবং তাদের ভাগ্যবিপর্যয় অবধারিত হয়ে গেলো। লেনপোল রণাঙ্গনের যুদ্ধপরবর্তী চিত্র এভাবে এঁকেছেন- ‘একেকজন মুসলিম সৈনিক ত্রিশ ত্রিশজন বন্দী ক্রুশেডারকে রশি-বেঁধে নিয়ে যাচ্ছিলো। ভাঙ্গা ক্রশ ও কর্তিত অঙ্গ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো। ধড়গুলো এমন সতূপ হয়ে ছিলো, যেন পাথরের উপর পাথর রাখা হয়েছে। ছিন্ন মস্তকগুলো পড়েছিলো, যেন তরবুজ ক্ষেতে সাজানো তরবুজ। এ খুনি লড়াই যেখানে হয়েছিলো, যেখানে ত্রিশ হাজার সৈন্য নিহত হয়েছিলো তা হিত্তীনের ময়দান বলে এখনো ইতিহাসে প্রসিদ্ধ হয়ে আছে।’ হিত্তীনের বিজয়ের পর গাজী সালাহুদ্‌-দীন আইয়ূবী ২৭শে রজব ৫৮৩ হিজরীতে (১১৮৭ ঈসায়ী) দ্বিতীয়বার বাইতুল মাকদিস আযাদ করেন এবং মুসলিম উম্মাহর সেই স্বপ্নকে পূর্ণতা দান করেন, যা দীর্ঘ নব্বই বছর পর্যন্ত প্রতিটি মুসলিমের হৃদয়কে ব্যাকুল বে-কারার করে রেখেছিলো। সুলতানের আস্থাভাজন সহচর কাজী শাদ্দাদ লিখেছেন- ‘চারদিকে শোনা যাচ্ছিলো শুধু তাকবীর ও দু‘আর গুঞ্জন। (নব্বই বছর পর) বাইতুল মাকদিসে জুমু‘আর নামায হলো। সাখরা গম্বুজের উপর যে ক্রুশ স্থাপন করা হয়েছিলো তা নামিয়ে ফেলা হলো। অভাবিতপূর্ব সব দৃশ্য ছিলো। আল্লাহর সাহায্য এবং ইসলামের বিজয় সবাই স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছিলো।’ বাইতুল মাকদিস বিজয়কালে গাজী ছালাহুদ্‌-দীন যে উদারতা, মহানুভবতা ও মহোত্তম ইসলামী চরিত্র প্রদর্শন করেছিলেন সে সম্পর্কে লেনপোল লিখেছেন- ‘মানুষ যদি ছালাহুদ্‌-দীনের অন্যান্য কীর্তির মাঝে শুধু এই একটি কীর্তির কথা সঠিকভাবে জানতে পারতো যে, কীভাবে তিনি জেরুযালেম পুনরুদ্ধার করেছেন তাহলে এই একটি কীর্তিই যথেষ্ট ছিলো একথা প্রমাণ করার জন্য যে, তিনি শুধু তাঁর যুগের নন, বরং সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মহানুভব ব্যক্তি ছিলেন। আভিজাত্যে ও মহত্ত্বে সত্যি তিনি অনন্য ও অতুলনীয় ছিলেন।’ বাইতুল মাকদিস হাতছাড়া এবং হিত্তীনে শোচনীয় পরাজয়ের পর সারা ইউরোপে যেন ক্রোধের আগুন জ্বলে উঠলো এবং সমগ্র খৃস্টজগত একজোট হয়ে সিরিয়ার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো, কিন্তু গাজী ছালাহুদ্‌-দীনকে তারা সামান্যও টলাতে পারেনি। সারা ইসলামী জাহানের পক্ষ হতে তিনি এবং তার কতিপয় মিত্র ও সহযোগী একা লড়াই চালিয়ে গেলেন। শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ পাঁচ বছরের লাগাতার যুদ্ধের পর ১১৯৩ ঈসায়ীতে ক্লান্ত-শ্রান্ত ও বিধ্বস্ত উভয় পক্ষের মধ্যে সন্ধি হলো। বাইতুল মাকদিস এবং অন্যান্য বিজিত শহর ও দুর্গ বদস্তুর মুসলিম-দখলেই থেকে গেলো। উপকূলীয় এলাকায় একটি ক্ষুদ্র রাজ্য আক্কা শুধু খৃস্টানদের দখলে ছিলো। এছাড়া বিস্তীর্ণ সমগ্র রাজ্য ছিলো সুলতান ছালাহুদ্‌-দীনের কব্‌জায়। যে মহান দায়িত্ব সুলতান ছালাহুদ্‌দীন নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন, আরো সঠিক ভাষায়, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর কাঁধে অর্পণ করেছিলেন, তা তিনি সুচারুরূপে সম্পন্ন করেই ক্ষান্ত হলেন। লেনপোল লিখেছেন- ‘পবিত্র ধর্মযুদ্ধ শেষ হলো। পাঁচ বছরের অব্যাহত হানাহানি ও রক্তপাত বন্ধ হলো। জুলাই ১১৮৭ খৃস্টাব্দে হিত্তীন রণাঙ্গনে মুসলমানদের মহাবিজয়ের পূর্বে জর্দাননদীর পশ্চিম তীরে তাদের নিয়ন্ত্রণে একইঞ্চি ভূমিও ছিলো না; পক্ষান্তরে সেপ্টেম্বর ১১৯২-এ যখন রামলায় সন্ধি হলো তখন সমগ্র ভূভাগ মুসলিম-অধিকারে চলে গিয়েছিলো, ছোর থেকে ইয়াফা পর্যন্ত একচিলতে উপকূলীয় ভূখণ্ড ছাড়া, যেখানে তখনো খৃস্টানদের নিয়ন্ত্রণ বজায় ছিলো। সুতরাং এই সন্ধিতে ছালাহুদ্‌-দীনের জন্য লজ্জার কিছু ছিলো না। কারণ ক্রুশেডারদের ক্ষয়ক্ষতি ছিলো বিপুল, অথচ অর্জন ছিলো অতি সামান্য। পোপের ধর্মযুদ্ধের আহ্বানে গোটা ইউরোপ ও সমগ্র খৃস্টানশক্তি পবিত্র ভূমির অভিযানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। তাদের লক্ষ্য ছিলো জেরুযালেম দখলে রাখা এবং পতনোন্মুখ খৃস্টানরাজ্য রক্ষা করা। কিন্তু এ বিপুল আয়োজন, তোড়জোর ও সংগ্রামের ফল কী হলো? কাইজার ফ্রেডারিক এসময় মারা গেলেন। ইংলেণ্ড ও ফ্রান্সের সম্রাটদ্বয় স্ব-স্ব দেশে ফিরে গেলেন। তাদের অনুগামী অসংখ্য নাইট ও বীর যোদ্ধা ইলিয়ার মাটিতে দাফন হলো। জেরুযালেম যেমন ছিলো তেমনি ছালাহুদ্‌-দীনের দখলেই থেকে গেলো। খৃস্টানদের ভাগে ছিলো শুধু উপকূলীয় এলাকায় ক্ষুদ্র আক্কা রাজ্য। গাজী ছালাহুদ্‌-দীন একদিকে যেমন ছিলেন অতি উচ্চ প্রশাসনিক যোগ্যতা ও দুর্লভ নেতৃত্বগুণের অধিকারী শাসক তেমনি মানুষ হিসাবে ছিলেন সততা, ধার্মিকতা, আভিজাত্য, মহানুভবতা ও মহোত্তম চরিত্রের অধিকারী। এত অসংখ্য মানবীয় গুণ ও বৈশিষ্ট্যের সমাবেশ আল্লাহ তাঁর মাঝে ঘটিয়েছিলেন, যা বিশ্ব-ইতিহাসের বিরল ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বের মাঝেই শুধু ঘটে থাকে। বস্তুত তিনি ছিলেন ইসলামের অসংখ্য অলৌকিকতার একটি এবং একথার প্রমাণ যে, বিশ্বের মানবমঞ্চে ইসলামের ভূমিকা এখনো শেষ হয়ে যায়নি এবং মুসলিম উম্মাহ তার প্রাণশক্তি ও উৎপাদনশীলতা এখনো হারিয়ে ফেলেনি। দীর্ঘকাল পর এই প্রথমবারের মত ফুরাত ও নীলনদের মধ্যবর্তী মুসলিম ভূখণ্ড সুলতান ছালাহুদ্‌-দীনের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলো এবং ইসলামী জাহানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া ইউরোপের ধর্মোন্মাদ বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলো। মুসলিম উম্মাহর বহু জাতি ও জনগোষ্ঠী জিহাদের উদ্দেশ্যে গাজী ছালাহুদ্‌-দীনের পতাকাতলে সমবেত হয়েছিলো, যা ইতিপূর্বে কখনো হয়নি। দীর্ঘকাল পর ইসলামী গায়রত ও জিহাদী চেতনা প্রজ্বলিত হয়েছিলো। সেযুগে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং সমরশিল্পে ইসলামী বিশ্ব যা কিছু অগ্রগতি অর্জন করেছিলো গাজী ছালাহুদ্‌দীন তা সবই খৃস্টান শক্তির বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছিলেন। তিনি শুধু একজন বিজয়ী সেনাপাতিই ছিলেন না, বরং ছিলেন প্রত্যেক মুসলিম সিপাহীর প্রাণপ্রিয় নেতা। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী নিয়ে গঠিত তাঁর বিশাল বাহিনী এক দীর্ঘ, ক্লান্তিকর ও রক্তক্ষয়ী জিহাদে নিয়োজিত ছিলো। বছরের পর বছর প্রবল শক্তিশালী এক শত্রুবাহিনী বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে হচ্ছিলো, কিন্তু সেনা- পরিচালক থেকে সাধারণ সৈনিক, কারো মুখে কখনো সামান্য অনুযোগের শব্দ উচ্চারিত হতে শোনা যায়নি। যখনই তিনি জিহাদ ও যুদ্ধের ডাক দিয়েছেন ‘জানহাতে’ তারা তাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বাহিনীর বড় বড় আরব-অনারব পরিচালক পরম আনুগত্যে তাঁর ডাকে লাব্বাইক বলেছে। বিভিন্ন জাতি ও জনগোষ্ঠীর লোক ছিলো। ভাষা ও জাতীয়তার যেমন পার্থক্য ছিলো তেমনি ছিলো পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং জাতিগত সংঘাত ও গোত্রীয় কোন্দল, কিন্তু তিনি তাঁর বিরল ব্যক্তিত্বগুণে বিপরীতমুখী বিভিন্ন শ্রেণীর মাঝে আশ্চর্য এক সমন্বয় সাধন করেছিলেন এবং এমন সমপ্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করেছিলেন, যেন এক দেহ, এক আত্মা। সকলে মনে প্রাণে বিশ্বাস করতো যে, সুলতান ছালাহুদ্‌-দীনই তাদের নেতা ও পরিচালক। বিভিন্ন সংকটে, কঠিন থেকে কঠিন মুহূর্তে এবং ঘোরতর সকল যুদ্ধে একটিমাত্র হৃদয় এবং একটি মাত্র ইচ্ছা তাদের নিয়ন্ত্রণ করতো, আর সেটা হলো গাজী ছালাহুদ্‌-দীনের সবল হৃদয় ও লৌহকঠিন ইচ্ছা। কারণ তারা জানতো, তাঁর উদ্দেশ্য ইসলামের হিফাযত এবং জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহ ছাড়া আর কিছু নয়। লেনপোল সঠিক মন্তব্যই করেছেন- ‘তৃতীয় ক্রুশেড যুদ্ধে সম্মিলিত খৃস্টানশক্তি মুকাবেলায় নেমেছিলো, কিন্তু তারা গাজী ছালাহুদ্‌-দীনের শক্তি ও মনোবলে সামান্যতম চির ধরাতে পারেনি এবং পারেনি তার বাহিনীতে কোন ফাটল সৃষ্টি করতে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি সৈনিক তার জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত ছিলো। ছালাহুদ্‌-দীনের পর নেতৃত্বসংকট ২৭শে ছফর ৫৮৯ হিজরীতে ইসলামের এই ওয়াফাদার ও নিবেদিতপ্রাণ মুজাহিদ দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণ করলেন। তিনি তাঁর উপর অর্পিত দায়িত্ব বহুদূর পর্যন্ত সম্পন্ন করে গিয়েছিলেন। যে মহাদুর্যোগ ইসলামের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছিলো অনেকটা দূর হয়ে গিয়েছিলো এবং ক্রুশে-হামলার ঢল থেমে গিয়েছিলো। তবে খৃস্টানজগত তাদের তিক্ত পরাজয় থেকে যথেষ্ট শিক্ষা নিয়েছিলো এবং বিস্তর চিন্তা- গবেষণার মাধ্যমে উভয়পক্ষের শক্তি ও দুর্বলতা চি?হ্িনত করতে পেরেছিলো। তারা আসলে ফিরে গিয়েছিলো নতুন ক্রুশেডের প্রস্তুতি নিতে, যা খৃস্টীয় উনিশ শতকে সংঘটিত হয়েছিলো। কিন্তু মুসলিম উম্মাহ?! হায়, তারা ফিরে গিয়েছিলো তাদের পুরোনো চরিত্রে; সেই বিভাজন-বিভক্তি, আত্মকলহ ও দ্বন্দ্ব-সংঘাত এবং সেই গাফলত ও তন্দ্রালুতা! এরপর ইসলামী বিশ্বে এমন কোন নেতার অবির্ভাব ঘটেনি যিনি ইসলামের প্রতি হবেন নিবেদিতপ্রাণ, যিনি ব্যক্তিগত লোভ ও লাভ এবং স্বার্থ ও চাহিদার উপর ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহকে অগ্রাধিকার প্রদান করবেন, যিনি শুধু জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর জন্য নিজেকে কোরবান করবেন, যিনি আপন ব্যক্তিত্বের আকর্ষণে সর্বহৃদয় জয় করে নেবেন এবং যাকে কেন্দ্র করে সকল বিভক্ত শক্তি আবার ঐক্যবদ্ধ হবে যেমন ছিলেন সুলতান গাজী ছালাহুদ্‌-দীন, যিনি আল্লাহ প্রদত্ত শক্তি ও প্রতিভার বলে মুসলিম উম্মাহকে জিহাদের পতাকাতলে এক করেছিলেন এবং গোটা ইউরোপকে পর্যুদস্ত করেছিলেন; যিনি ‘প্রবলপ্রতাপ’ শত্রুর কবল থেকে ইসলামের সাম্রাজ্য ও মর্যাদা রক্ষা করেছিলেন। এসব কিছুই হলো না, বরং মুসলিম উম্মাহ ও ইসলামী বিশ্ব আরেকবার গৃহবিবাদ ও হানাহানি এবং স্বার্থান্ধ ও কুচক্রী নেতৃবর্গের অবাধ শিকার -ভূমিতে পরিণত হলো। বিশাল বিস্তৃত মুসলিম জাহানের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত অবক্ষয় ও অধঃপতনের মেঘ ছেয়ে গেলো এবং ক্রমশ পরিস্থিতি আরো গুরুতর হতে লাগলো। তবে এই ব্যাপক অবক্ষয়ের যুগে যাবতীয় বিচ্যুতি ও দুর্বলতা সত্ত্বেও ইসলামের অন্তর্নিহিত শক্তি সতত সক্রিয় ছিলো। কখনো কখনো এমন শাসক ও সেনাপতি সামনে আসছিলেন, যারা তাঁদের জীবন ও চরিত্রে এবং ধার্মিকতা ও নৈতিকতায় ছাহাবা কেরাম ও মহান পূর্ববর্তীদের কিছু না কিছু নমুনা ছিলেন। এখানে সেখানে এমন ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটছিলো যাদের আলোকচ্ছটায় ইতিহাস এখনো সমুজ্জ্বল। মুসলিম উম্মাহ যদিও তাদের মহান পূর্ববর্তীদের আদর্শ পথ ও পন্থা থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছিলো তবু সমকালীন জাহিলী জাতিগোষ্ঠীর মুকাবেলায় তারাই ছিলো আম্বিয়ায়ে কেরামের জীবনাদর্শের অধিকতর নিকটবর্তী এবং আল্লাহর প্রতি অধিকতর অনুগত। তাদের নিছক অস্তিত্ব এবং বিপর্যস্ত সাম্রাজ্যের অবশিষ্ট প্রতাপ জাহেলিয়াতের গতি ও অগ্রগতির পথে ছিলো সবচে’ বড় বাধা ও প্রতিবন্ধক । এখনো ইসলামী সাম্রাজ্য ছিলো সমকালীন বিশ্বের একটি বড় শক্তি, যাকে হিসাব করে চলতো সকল জাতি এবং যার ভয়ে কম্পমান ছিলো সকল সাম্রাজ্য। কিন্তু প্রকৃত সত্য ছিলো এই যে, বাইরের অগোচরে ভিতরে ভিতরে এই শক্তি তার প্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলছিলো। অবশেষে হিজরী সপ্তম শতকের মধ্যভাগে ইসলামী উম্মাহর রাজনৈতিক অরাজকতা ও নৈতিক অবক্ষয় হয়ে গেলো খোলামেলা বিষয়, যা আর লুকিয়ে রাখার উপায় ছিলো না। ফলে ইসলামী শক্তির যে ‘ত্রাশছায়া’ দূর থেকে দৃশ্যমান ছিলো এবং সবার সন্ত্রস্ততার কারণ ছিলো তা অদৃশ্য হয়ে গেলো এবং যা ঘটার তাই ঘটলো। শত্রুজাতি এবং অসভ্য ও বন্য জনগোষ্ঠী মুসলিম উম্মাহর উপর উন্মত্ত উল্লাসে ঝাঁপিয়ে পড়লো। বিশাল বিস্তৃত ইসলামী সাম্রাজ্য যেন হয়ে গেলো এক লাওয়ারিছ সম্পত্তি, যা বিজেতাদের খেয়াল-খুশি মত বণ্টিত হতে লাগলো। তাতারী ফেতনা মুসলিম উম্মাহর উপর ঐসময় যত বিপদ ও দুর্যোগ নেমে এসেছিলো তার মধ্যে বর্বর তাতারী জাতির হামলাই ছিলো সবচে’ ভয়াবহ ও মর্মন্তুদ। তাতারীরা পূর্ব দিক থেকে পঙ্গপালের মত দেখা দিলো এবং দেখতে দেখতে সমগ্র মুসলিম জাহানে ছেয়ে গেলো। বস্তুত তাতারী হামলা ছিলো মুসলিম উম্মাহর সুদীর্ঘ ইতিহাসের সবচে’ বড় দুর্যোগ, যা বলতে গেলে উম্মাহর অস্তিত্বকেই কাঁপিয়ে দিয়েছিলো। পরিস্থিতির ভয়াবহতা গোটা জাতিকে যেন দিশেহারা করে ফেলেছিলো। একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে শুধু হতাশা ও নৈরাশ্যের পরিবেশ ছিলো। একপর্যায়ে প্রায় সমগ্র মুসলিম জাহান, বিশেষত তার পূর্ব অংশ তাতারী আগ্রাসনের সর্বনাশা থাবায় এসে গিয়েছিলো। ঐতিহাসিক ইবনে আছীর তাতারী হামলার ইতিহাস লিখতে গিয়ে তাঁর মনোবেদনা ও হৃদয়-যন্ত্রণা চেপে রাখতে পারেননি। তিনি বলেন- ‘এ ঘটনা এমনই লোমহর্ষক ও বেদনাদায়ক যে, কয়েক বছর আমি এ দ্বিধাদ্বন্দ্বেই ছিলাম যে, লিখবো কি লিখবো না! এখনো বড় দ্বিধা ও ব্যথার সাথেই লিখছি। আসলে ইসলামের দুর্দশা এবং মুসলিম উম্মাহর সর্বনাশের কাহিনী শোনাতে পারে এমন দিলগুর্দা কারই বা আছে! হায়, আমি যদি পয়দাই না হতাম, কিংবা এর আগেই মরে যেতাম এবং আমার অস্তিত্ব বিস্মৃত হয়ে যেতো। কিন্তু কিছু বন্ধুর দাবী, এ ঘটনা আমি যেন ইতিহাসের পাতায় সংরক্ষণ করি, তবু দ্বিধান্বিত ছিলাম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভেবে দেখলাম, না লিখেই বা কি লাভ! এ ছিলো এমন এক কেয়ামতি বিপদ ও দুর্যোগ যার নযীর দুনিয়ার ইতিহাসে আর নেই। যদিও এর প্রধান শিকার ছিলো মুসলিম উম্মাহ তবু এর বিস্তার ছিলো অন্যান্য জাতি পর্যন্ত। কেউ যদি দাবী করে যে, আদম থেকে ‘এইদম’ এমন ঘটনা দুনিয়াতে আর ঘটেনি তাহলে তার দাবী মিথ্যা হবে না। কারণ এর ধারেকাছের ঘটনাও ইতিহাসের পাতায় নেই এবং সম্ভবত কেয়ামত পর্যন্ত দুনিয়া এমন ঘটনা আর দেখবে না, ইয়াজূজ-মাজূজের ঘটনা ছাড়া। নারী-পুরুষ ও শিশু-বৃদ্ধ, কারো প্রতি এই পশুরা কোন দয়া করেনি। যাকে পেয়েছে তাকেই খুন করেছে; পেট ফেড়ে গর্ভের সন্তানকে পর্যন্ত। (ইন্‌না লিল্লাহি ওয়া ইন্‌না ইলাইহি রাজি‘ঊন, ওয়া লা হাওলা ওয়া লা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল ‘আলিয়্যিল ‘আযীম।) এ ফিতনা ছিলো বিশ্বব্যাপী ও সর্বগ্রাসী, যা এক ভয়ঙ্কর তুফানের মত ধেয়ে এসেছিলো এবং সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিলো।’ ৬৫৬ হিজরীতে তাতারীরা দারুল খিলাফাহ বাগদাদে বিজয়ীবেশে ঢুকেছিলো এবং তা গুঁড়িয়ে দিয়েছিলো। ঐতিহাসিক ইবনে কাছীর বাগদাদের বরবাদী ও তাতারীদের ‘হালাকাতির’ উল্লেখ করে লিখেছেন- ‘ বাগদাদে চল্লিশ দিন পর্যন্ত গণহত্যা ও লুটতারাজ অব্যাহত ছিলো। চল্লিশ দিন পর এই উদ্যান-নগর, যা পৃথিবীর সুন্দরতম ও সমৃদ্ধতম শহর ছিলো, এমন বরবাদ ও বিরান হলো যে, অল্প ক’জন মানুষই শুধু বেঁচে ছিলো। বাজারে ও অলিতে গলিতে গলিত লাশের সতূপ ছিলো। সেই লাশের উপর বৃষ্টি হয়ে সারা শহরে দুগন্ধ ছড়িয়ে পড়লো এবং শহরের পরিবেশ দুর্বিষহ হয়ে উঠলো। মাহামরি এমন ছড়িয়ে পড়লো যে, সুদূর সিরিয়া পর্যন্ত তার প্রভাব দেখা গেলো। অসংখ্য মানুষ রোগব্যাধিতে মারা গেলো। দুর্মূল্য, মহামারি ও বরবাদি-বাগদাদে যেন এই তিনেরই রাজত্ব ছিলো। তাতারীদের পরাজয় ইরাক ও সিরিয়া দখলের পর স্বাভাবিকভাবেই তাতারীদের রোখ ছিলো মিশর, যা তখন তাতারী-ধ্বংসযজ্ঞ থেকে নিরাপদ একমাত্র মুসলিম দেশ। মিশরের সাহসী শাসক সাইফুদ্দীন কুতুয বুঝতে পেরেছিলেন, এখন মিশরের পালা, আর তাতারীরা চড়াও হলে দেশ বাঁচানো কঠিন হব। তাই তিনি ভাবলেন, মিশরে আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ করার চেয়ে বিজ্ঞতার পরিচয় হবে আগে বেড়ে তাতারীদের উপর হামলা করা। অবশেষে ২৫শে রামাযান সিরিয়ার নিকটবর্তী আইনে জালূত নামক স্থানে তাতারীদের সাথে মিশরের ইসলামী বাহিনীর মুকাবেরা হলো এবং অতীতের সকল অভিজ্ঞতার সম্পূর্ণ বিপরীত তাতারীরা চরম পরাজয় বরণ করলো। তখন দৃশ্য হলো, ময়দান ছেড়ে তাতারীরা পালায়, আর মিশরের বাহিনী পিছু ধাওয়া করে তাদের কচু কাটা করে, কিংবা বেশুমার গ্রেফতার করে। সাইফুদ্দীন কুতুয-এর পর আলমালিকুয্‌যাহির বাইবার্স বেশ কয়েকবার তাতারীদের পরাজিত করেন এবং সমগ্র সিরিয়া অঞ্চল থেকে তাদের বিতাড়ি করেন। ফলে প্রচলিত সেই বিশ্বাস থেকে মানুষ
শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা