মুহররম ১৪৩২ হি: (১৮)

তোমাদের জন্য

চন্দ্রবিন্দুসমাচার, প্রসঙ্গ-চ ও ছ

লিখেছেনঃ ইবনে মিছবাহ

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট
কী বলছিলে, চাঁদের দেশে যাবে?! তো যাও না চন্দ্রবিন্দুকে নাও বানিয়ে আকাশ-গঙ্গা পাড়ি দিয়ে। ‘চাঁদ’ থেকে মনে পড়লো, ‘রোজ তাই চাঁদাভাই টিপ দেয় কপালে।’ চাঁদমামা বলো, ঠিক আছে, কিন' যদি বলো চাঁদভাই, চাঁদের তাতে মুখ ভার হবে। বলতে হবে চাঁদাভাই। চারদিকে চাঁদাবাজির ধুম। কিন-ু একবেটাও চন্দ্রবিন্দু দেয় না, শুধু বুকে পিস-ল ধরে। চাঁদাটা অবশ্য পেয়ে যায় পিস-লের জোরে। জানের মায়া বড় মায়া তো! চাঁছা-ছোলা কথা বলা অনেকের অভ্যাস। সেটা ভালো, যদি চন্দ্রবিন্দু থাকে, তবে ছোলায় নয়। যারা চাঁছা-পোঁছা খেতে ভালোবাসে তাদের অবশ্য দু'টোতেই দিতে হবে। চাঁচা ও চাঁছা (দ্বিতীয়টি বেশী ব্যবহৃত) মানে অস্ত্র দ্বারা উপরের আবরণ উঠিয়ে মসৃণ ও পরিষ্কার করা। পুষ্পের এক পাঠক লিখেছে- ‘ছুতার রাঁদা দিয়ে চেছে কাঠ মসৃণ করলো।’ আমি বলি, রাঁদায় তো চন্দ্রবিন্দু আছে, তাহলে রাঁদা দিয়ে ‘চাছে’ কীভাবে? দাড়ি যারা চাঁছে, চন্দ্রবিন্দু দিলেও গোনাহ না দিলেও গোনাহ। কারণ দাড়ি হলো নবীর সুন্নত। চাঁটি মারা মানে চপেটাঘাত করা বা করাঘাত করা। কাজটা ভালো না, চন্দ্রবিন্দু ছাড়া আরো ভালো না, অর্থাৎ মন্দের উপর মন্দ। চাঁড়া মানে মটকা, কলস, খোলা ইত্যাদির ভাঙ্গা টুকরো। আমাদের ছোটবেলা বেশ মজা করে সাতচাঁড়া খেলা হতো। হিন্দুদের বিশেষ শ্রেণীকে চাঁড়াল বলে, অবজ্ঞার্থে অবশ্য সবহিন্দুকেই চাঁড়াল বলা হয়; যেমন মুসলমানকে ওরা বলে যবন, ম্লেচ্ছ। অবজ্ঞার্থে সেরা ও প্রধানকে চাঁই বলা হয়, যেমন, ‘দলের চাঁইটা এবার ধরা পড়েছে।’ বাঁশের শলা দিয়ে তৈরী মাছ ধরার একপ্রকার খাঁচাকেও চাঁই বলে। গ্রামে খালে-বিলে এখন মাছও নেই, মাছ ধরার চাঁইও নেই। চাঁপাফুলে চন্দ্রবিন্দু আছে ‘চিঁচিঁ’ হচ্ছে পাখীর ছানার ক্ষীণ স্বর, বা পাখীর আর্তস্বর। চিঁহিচিঁহি (এবং চিঁহিঁহিঁ) হচ্ছে ঘোড়ার ডাক। দেখো, একটি শব্দে কতগুলো চন্দ্রবিন্দু! চিঁড়ে-মুড়ি যত পারো খাও, চন্দ্রবিন্দু দেবে শুধু চিঁড়েতে। চিঁড়ে-চেপটা শব্দটি বেশ মজাদার! ঢেঁকির প্রবল চাপে চিঁড়ে কেমন চেপটা হয় দেখেছো তো! কোন পরিসি'তির প্রবল চাপে পড়ে নাজেহাল হলে বলা হয়, ‘লোকটা একেবারে চিঁড়েচেপটা হয়ে গেছে!’ ‘লোকাল বাসে উঠলে মানুষের চাপে চিঁড়েচেপটা হতে হয়।’ ‘ফের যদি এমন করো, মেরে একেবারে চিঁড়েচেপটা করে ফেলবো।’ ‘খালি কথায় চিঁড়ে ভেজে না’ বলে একটা কথা আছে। অর্থাৎ শুধু মুখের কথায় কাজ হয় না, বাস-বেও কিছু করতে হয়। চুঁটি মানে চূড়া। আশ্চর্য! অর্থ অভিন্ন, কিন' বানান ভিন্ন! চুঁচেরা হচ্ছে দু’টি ফার্সি শব্দের যুক্তরূপ, মানে হলো, এমন কেন? বাংলায় ব্যবহৃত অর্থটি হচ্ছে প্রতিবাদ ও আপত্তি। ‘আমার কথা মানতে হবে, কোন চুঁচেরা শুনতে চাই না।’ ‘চুঁচেরা না করে কাজ করে যাও।’ দাদাবাবুরা তাদের অভিধানে শব্দটি গ্রহণ করেননি। বাংলা একাডেমীকে ধন্যবাদ, তারা সৎসাহসের পরিচয় দিয়েছে। ‘বাঙ্গালী শুধু সভা-সমিতি করে বেড়ায়, আর গলা ছেড়ে চেঁচায়, কাজ করে না কিছুই; চেঁচাচেঁচি ও চেঁচামেচিই সার।’ কথাটি অতি সত্য, তবে চন্দ্রবিন্দু কোথায় একটি, কোথায় দু’টি, দেখে নাও। চোঁ করে এবং চোঁচোঁ করে মানে দ্রুতবেগে। চোঁচোঁ করে দৌড়ে/ছুটে গেলো। এতগুলো দুধ চোঁচোঁ করে খেয়ে ফেললো! আরেকটি বাক্য হলো, ক্ষুধায় পেট চোঁচোঁ করছে, অর্থাৎ ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছে। ছাঁকনা (ছোট হলে ছাঁকনি) দ্বারা দুধ ছেঁকে নেয়া ভালো। ছেঁকে ধরা মানে ঘিরে ধরা। পিঁপড়েয় ছেঁকে ধরেছে। পাওনাদারেরা ছেঁকে ধরেছে। (মানে ঘিরে ধরেছে। তবে চন্দ্রবিন্দু না থাকলে যতই ‘ছেকে’ ধরো, ফাঁক গলে বের হয়ে যেতে পারে।) ছাঁচ মানে ফর্মা, অর্থাৎ একই আকারে অনেকগুলো বস' তৈরী করার জন্য ব্যবহৃত কাঠামো বা ফ্রেম। ‘তাদের চেহারা/চরিত্র যেন একই ছাঁচে গড়া।’ ছাঁট মানে কেটে বাদ দেয়া বাড়তি অংশ (কাপড়ের ছাঁট, কাগজের ছাঁট)। বাড়তি অংশ ছেঁটে ফেলা ভালো, তাই বলে চন্দ্রবিন্দুটাই ছেঁটে ফেলো না যেন! যায়যায়দিন পত্রিকাটি সমস- শব্দ থেকে চন্দ্রবিন্দু ছাঁটাই করে ফেলেছিলো, শেষে কী হলো, প্রকৃতির নির্মম বিধানে নিজেই ছাঁটাই হয়ে গেলো। তার কথা শুনে বুকটা ‘ছাৎ’ করে উঠলো। (দেখো তো, ছ-এর মাথায় ফোঁটাওয়ালা চাঁদটা আছে কি না?! নেই?! হায়, হায়, আমার যে বুকটা ছাঁৎ করে উঠলো! যেখান থেকেই পারো, একটি চন্দ্রবিন্দু যোগাড় করে আনো, নইলে বুকটা আমার ছাঁৎ ছাঁৎ করতেই থাকবে।) বাড়ীর ছাদে চন্দ্রবিন্দু নেই। ‘তোমার লেখার ছাঁদ ভালো’, মানে ধরন বা স্টাইল ভালো। এখানে চন্দ্রবিন্দু আছে। এত সামানপত্র বাঁধাছাঁদা করতে অনেক সময় লাগবে। হাঁ, কী আর করা, দু’দু'টো চন্দ্রবিন্দু! সময় তো একটু লাগবেই। একটা কথা মনে রেখো, গমের ছাতু হোক বা যবের, চন্দ্রবিন্দু দিলে ব্যাকরণের পণ্ডিত কিন' তোমাকেই ছাতু করে ফেলবেন। ছাতু খেতে গিয়ে অনেকে দেয় তো তাই কথাটা বলতে হলো। ছিঁচকে চোর মানে তুচ্ছাতিতুচ্ছ হাতের কাছে যা পায় তাই চুরি করে এমন চোর, এমনকি মাঝেমধ্যে চন্দ্রবিন্দুটাও চুরি করে ফলে। বাধ্য হয়ে পণ্ডিৎ বলেছেন, ‘ছিচকে’ চন্দ্রবিন্দু না দিলেও চলবে, কারণ বদমাশের ধাড়ি ঐ ছিঁচকে চোর আবার তা নিয়ে যাবে। ছিঁচকাঁদুনে মানে অল্পতেই কাঁদে এমন। ‘ছেঁড়া কাপড়টা নিয়ে টানাটানি করো না, আরো ছিঁড়ে যাবে, তাই ছেড়ে দাও।’ ছাড়তে চন্দ্রবিন্দু লাগে না, ছুঁড়ে ফেলতে লাগে। ছুঁইছুঁই মানে প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে। যেমন, ‘তার বয়স আশি ছুঁইছুঁই করছে।’ ছোঁয়া মানে ‘চন্দ্রবিন্দুসহযোগে’ কোন কিছু স্পর্শ করা। আর ছোঁয়াছুঁয়ি করতে গেলে লাগবে দু'টো। ছুঁচ মানে সুচ, সুচ মানে সুই- প্রথমটায় আছে, দ্বিতীটায় নেই, তৃতীয়টায় কেউ দেয় কেউ দেয় না। ছেঁক ও ছ্যাঁক মানে গরম তেলে হঠাৎ কিছু পড়ার শব্দ। আর ছেঁকছেঁক মানে ঐ রকম ক্রমাগত শব্দ। গাটা আমার ছেঁকছেঁক করছে, মানে বেশ তাপ অনুভব হচ্ছে। গরম লোহার ছেঁকা লেগেছে, গরম লোহা দ্বারা ছেঁকা দিয়েছে। এই ছোঁড়া! এই ছুঁড়ি! তোরা দু’টিতে কী ছোঁড়াছুঁড়ি করছিস। ‘ছোঁড়া-ছুঁড়ি দু’টিতে ফুল ছোঁড়াছুঁড়ি করছে।’ সেই কবে ছোটকালে পড়েছিলাম, গল্পের কাক কোন্‌ ছেলের হাত থেকে গোশত ছোঁ মেরে নিয়ে গিয়েছিলো। তা ছোঁ মারতে চন্দ্রবিন্দু লাগে কি না মনে নেই। তোমরা একটু দেখে নেবে লোগাত খুলে?! ছেঁচড় মানে ধূর্ত, প্রতারক। চোর-ছেঁচড় একসঙ্গে ব্যবহার করা হয়। ‘চোর-ছেঁচড়ে শহর ভরে গেছে; পকেট শামলে রাখাই দায়।’ ‘লোকটা ছেঁচড়ামি করে বেড়ায়, তাই কেউ তাকে বিশ্বাস করে না।’ ছেঁচা বা ছ্যাঁচা মানে থেতলানো। ‘নতুন বউ বাটনা বাটতে গিয়ে আঙ্গুলে ছেঁচা লাগিয়েছে। আঙ্গুলটা একেবারে ছেঁচে গেছে গো!’ ‘গাছ-গাছড়া ছেঁচে ঔষধ তৈরী করতে হয়।’ ‘বানানে এত ভুল! যাও না হুজুরের কাছে, ছেঁচে দেবেন!’
শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা