যীকা‘দা ১৪৩৯ হিঃ (৩/৫)

প্রথম পাতা

সম্পাদকীয়

জীবনের প্রতি আশাবাদী এবং শঙ্কিত!!

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

 

সুদূর অতীত থেকে আজ পর্যন্ত বহুবার দেখেছি জীবনের হঠাৎ হঠাৎ মোড়পবির্তন। বড় অদ্ভুত এবং অবিশ্বাস্য! একটা জীবন শুরু হলো ঝলমলে আলোর মধ্য দিয়ে; তার সামনে শুধু উজ্জ্বল ভাবিষ্যতের হাতছানি। কিন্তু জীবন হঠাৎ যেন পড়ে গেলো রাহুর গ্রাসে। ধীরে ধীরে তা হারিয়ে গেলো অন্ধকারের অতলে।

একই সময় আরেকটা জীবন শুরু হলো গভীর অন্ধকারের মধ্য দিয়ে, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার বেদনা বহন করে। সামনে আশার কোন আলো নেই এবং নেই কোন আশ্বাসবাণী! এখানেও হঠাৎ করেই শুরু হলো জীবনের মোড়পরিবর্তন! ধীরে ধীরে আঁধার দূর হতে লাগলো! একটা একটা করে আলোর রেখা ফুটে উঠতে শুরু করলো! জীবনটা এমন উজ্জ্বল হলো যে, সারাটা পৃথিবী সেই জীবনের আলোতে উদ্ভাসিত হলো!

জীবনের এরূপ অদ্ভুত মোড়পরিবর্তন ইতিহাসের পাতায় যেমন পড়েছি তেমনি দেখেছি আমাদের নিজেদেরও জীবনের বিভিন্ন অঙ্গনে। আমি দেখেছি, তুমি দেখেছো; আমরা সবাই দেখেছি। বিশ্বাস হতে চায় না, তবু তা সত্য! রহস্যময় মানবজীবনের এক ব্যাখ্যাহীন সত্য!

***

চলো, একটু উঁকি দেই ইতিহাসের পাতায়। ইউরোপের এক রাজপরিবারে সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে একরাজপুত্র, তাদের ভাষায় ‘যেন স্বর্গ থেকে নেমে আসা দেবশিশু!’ রাজ্যের প্রজাসকল কয়েকরাত উৎসব করেছে, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। আলোকসজ্জা হয়েছে! আতশবাজি হয়েছে! রাজদরবারে শরাবের নহর বয়েছে! শাবাব ও কাবাবের জলসা বসেছে।

এভাবে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের নিশ্চয়তার সঙ্গে কুসুমাস্তীর্ণ পথে শুরু হলো রাজপুত্রের জীবনের যাত্রা। রাজকীয় বাহনে আরোহণ করে যুবরাজদের জন্য নির্ধারিত বিদ্যালয়ে প্রতিদিন তিনি শুধু যে পদার্পণ করেন তা নয়, বরং পদধূলি দান করেন এবং সদয় হয়ে কিছু পরিমাণ বিদ্যাও অর্জন করেন। করবেনই তো! তিনি যে পিতার সা¤্রাজ্যে আগামী দিনের স¤্রাট, ‘মর্তের দেবতা, ঈশ্বরের ছায়া!!

দেখতে দেখতে রাজপুত্রের বয়স হলো দশ। সে উপলক্ষে রাজ্যব্যাপী হলো বিশাল উৎসব-আয়োজন। ভরা রাজদরবারে রাজপুত্রের হাতে তুলে দেয়া হলো ‘সুন্দর’ এক চাবুক; নিছক হস্তশোভারূপে নয়, আগামী দিনের প্রজাশাসনের ‘মশ্ক’রূপে। প্রজার পিঠে রাজার চাবুক, এটাই তো আদর্শ প্রজাপালন!

একদিন তিনি বিদ্যার্জনের মহৎ উদ্দেশ্যে বিদ্যালয়ে গমন করছেন। পথে এক দরিদ্র কৃষক অসাবধানে পড়ে গেলো রাজপুত্রের শকটের সামনে। কৃষক আহত হলো, সেটা বড় কথা নয় এবং নয় গুরুতর কিছু! গুরুতর বিষয় হলো রাজপুত্রের বিদ্যালয়গমন ও বিদ্যার্জনের পথে বিঘœ ঘটেছে!! রাজপুত্র কষ্ট করে শকট থেকে অবরণ করলেন না; আহত কৃষককেই তুলে আনা হলো ‘রাজরোষের’ সম্মুখে। রাজপুত্রের হাতে চাবুক ঝলসে উঠলো; কৃষকের যন্ত্রণাকাতর মুখ থেকে হালকা একটা আর্তনাদ বের হলো! বিরক্ত রাজপুত্র সেদিন ফিরে গেলেন প্রাসাদে। ত্যক্ত-বিরক্ত মন নিয়ে তো আর বিদ্যার্জন হয় না! কেউ দেখলো না; কৃষকের চোখ থেকে দু’ফোটা অশ্রু ঝরে পড়লো।

সময়ের চাকা খুব বেশী দূর পাড়ি দিতে পারেনি; হঠাৎ জীবনের মোড়পরিবর্তন হলো। রাজপুত্র ‘রাজরোগে’ আক্রান্ত হলেন এবং ...!!

***

আরো দূর অতীতে একটি জীবন শুরু হয়েছিলো এক দরিদ্র জেলের ঝুপড়িতে। অন্ধকার ঝুপড়িতে অন্ধকার জীবন! জেলের ছেলে, তবু খেয়ে না খেয়ে বিদ্যালয়মুখী হলো।

একদিন, জেলের ছেলে বিদ্যালয়ের পথে। দুপুরের জন্য নেকড়া পেঁচিয়ে মা দিয়ে দিয়েছেন একটুকরো আলু, একটুকরো কেক। পথে দেখতে পেলো, এক ভিখারিণী মা, কঙ্কালসার পুত্রকে কোলে করে দাঁড়িয়ে আছে।

জেলের ছেলে ছোট্ট বালক, কিন্তু তার দয়া হলো। সামান্য খাবার, নিজের জন্য রাখলো না; মায়ের হাতে তুলে দিয়ে বিদ্যালয়ের পথে চলে গেলো। কেউ দেখলো না, মায়ের চোখ থেকে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।

হঠাৎ তার জীবনেও মোড়পরিবর্তন ঘটলো। জীবন থেকে অন্ধকার সরে গিয়ে ধীরে ধীরে আলোর রেখা ফুটতে শুরু করলো। একদিন তিনি হলেন রোমের সেনাপতি, যিনি বহু যুদ্ধ জয় করেছেন, কিন্তু নিজের হাতে কখনো মানুষ হত্যা করেননি।

***

খুব বেশী দিন হবে না। পঁচিশ ত্রিশ বছর আগের ঘটনা। বিশ্বমিডিয়ায় নাড়া পড়ে গিয়েছিলো। ছয়বছরের একটি শিশু। অঙ্কের জটিল জটিল প্রশ্নের সমাধান বলতে পারে মুখে মুখে। মানুষ শুধু অবাক হয় না, রীতিমত হতবাক হয়, এইটুকু ছেলের এরূপ মেধা ও বুদ্ধিমত্তা দেখে! মানুষ ভাবে, এ ছেলে বড় হয়ে বড় কিছু না হয়ে যায় না! কিন্তু ছেলেটি শেষ পর্যন্ত কালের অন্ধকারে হারিয়ে গেলো!

কেন এমন হলো? হয়ত কারো চোখে অশ্রুঝরেছিলো!!

***

আরো আগের ঘটনা। বিদ্যালয়ের সবচে’ মেধাহীন ছাত্রটি, শিক্ষকের কাছে যার একমাত্র উপাধি ছিলো ‘গর্দভ’! বিদ্যালয় থেকে তাকে বের করে দেয়া হয়েছিলো এজন্য যে, অঙ্ক তার মাথায় ঢোকে না। এখানেও হঠাৎ করে হলো জীবনের মোড়-পরিবর্তন। সেই ছেলে একদিন সেই বিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী অধ্যাপক হলেন এবং তাঁর অধ্যাপনার বিষয় হলো গণিত। কীভাবে হলো? হয়ত কারো চোখ থেকে অশ্রু ঝরেছিলো!!

***

আসুন, একটু থামি, একটু বসি; আসুন একটু চিন্তা করি, জীবন সম্পর্কে, জীবনের রহস্য সম্পর্কে!! হয়ত বেশী কিছু বুঝতে পারবো না; ¯্রষ্টার সৃষ্টি ও তার রহস্য বোঝবার মত কতটুকু বুদ্ধিই বা আছে আমাদের!! বুদ্ধির চেয়ে অহঙ্কারই তো বেশী!! আসুন, তবু একটু চেষ্টা করি; জীবনের এই অদ্ভুত মোড়পরিবর্তন সম্পর্কে প্রকৃত সত্যটি অনুধাবন করতে।

জীবনের এই যে আকস্মিক মোড়পরিবর্তন আলো থেকে অন্ধকারের দিকে এবং অন্ধকার থেকে আলোর দিকে, এটা কি নিছক কাকতালীয় ঘটনা! কিংবা শুধুই নিয়তির লীলাখেলা?! জীবনের এই মোড়পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মানুষের কর্ম ও কর্মফলের কি কোনই ভূমিকা নেই?! ‘লাহা মা কাসাবাত, ওয়া আলাইহা মাকতাসাবাত, কী চিরন্তন বার্তা বহন করে আমাদের জীবনের জন্য?!

***

আমাকে যারা ভালোবাসে মানুষ হিসাবে এবং মানুষের প্রতি দরদী হিসাবে; আমাকে যারা শ্রদ্ধা করে কলমের কালিতে জীবনের হাসি-কান্না ও আনন্দ-বেদনার কথা লিখি বলে, তাদের কাছে আমি তুলে ধরতে চাই জীবনের সেই পরম সত্য, যা আজকের এই জোসনাধোয়া রাতের নির্জনতায় আমার সামনে উদ্ভাসিত হয়েছে অদৃশ্যের করুণায়।

জীবনের সেই পরম সত্যটি হলোÑ

‘নিয়ত ও নিয়তি’ দু’টোরই ভূমিকা রয়েছে মানুষের জীবনে মোড়পরিবর্তনের ক্ষেত্রে; আলো থেকে অন্ধকারের দিকে যেমন তেমনি অন্ধকার থেকে আলোর দিকে।

কেড়ালকে বেঁধে রেখে কষ্ট দেয়ার কী পরিণতি হয়েছিলো সেই নারীর যার বড় খ্যাতি ছিলো ইবাদতবন্দেগির?!

কুকুরের শুকনো জিহ্বায় শুধু এক কাতরা পানি দেয়ার কী পুরস্কার পেলো সেই নারী, মানুষ যাকে ভাবতো কলঙ্কিনী!

কী বার্তা বহন করে এ দু’টি ঘটনা আমাদের জন্য?!

হয়ত আমরা ভুলে যাই ছোট ছোট ঘটনা জীবনের নিরন্তর শোরগোলের মধ্যে ডুবে থাকার কারণে! ‘আকাশ’ কিন্তু ভোলে না! আমাদের মাথার উপর আকাশ কখনো আগুন ঝরায়, কখনো শিশির বর্ষণ করে, আমাদেরই জীবনের সামান্য সামান্য ঘটনার কারণে।

জীবনের প্রতি আমি হতাশ নই, বরং আশাবাদী, এজন্য যে, ছোট্ট একটি ঘটনা জীবনের সব অন্ধকার দূর করে  জ্বালতে পারে আশার আলো।

একই ভাবে জীবন সম্পর্কে আমার শঙ্কা ও আশঙ্কারও শেষ নেই এবং আমি উৎকণ্ঠামুক্ত নই, এজন্য যে, ছোট্ট একটি ‘স্বেচ্ছাচার’ নিভিয়ে দিতে পারে জীবনের সব আলো!

হে সুহৃদ, হে বন্ধু, আমি খুবই দরিদ্র ও নগণ্য। শব্দের কিছু ফুল ছাড়া কিছু নেই আমার কাছে তোমাকে দেয়ার মত। সেই ফুলগুলো দিয়ে একটি মালা গেঁথে, এসো আজ জীবনের সন্ধ্যাবেলা উপহার দেই তোমাকে। এখন তোমরা যারা জীবনের সোনালী প্রভাত উদ্যাপন করছো, হয়ত তাতে তোমাদের জীবনের আলোকিত প্রভাত একই সঙ্গে হবে সুবাসিত।

কারো কষ্টের অশ্রুতে তোমার আঁচল যেন না ভেজে,বরংতোমার আঁচল যেন সিক্ত হয় দুঃখী মানুষের কৃতজ্ঞতার অশ্রুতে।

একটুকরো রুটি তুলে দিয়ো ক্ষুধার্ত মানবশিশুর মুখে, এমনকি ....! যদি পারো সবার জীবনে ফুল হয়ে ফোটো, কারো জীবনে কাঁটা হয়ে বিঁধো না! ¯্রষ্টার করুণায় আশা রাখো এবং ¯্রষ্টার ক্রোধকে ভয় করো।

প্রিয় বন্ধু, আমি কি বোঝাতে পেরেছি তোমাকে জীবনের পরম সত্য! আমি কি তুলে ধরতে পেরেছি তোমার সামনে জীবনের পরম রহস্য! আমি কি জ্বালতে পেরেছি তোমার জীবনের চলার পথে আলোর সামান্য একটি প্রদীপ! আমি কি আশা করতে পারি, আমার জন্য তোমার নির্জন রাতে প্রার্থনার ঝিরঝির শিশির!!

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা