যীকা‘দা ১৪৩৯ হিঃ (৩/৫)

হযরত আলী নাদাবীর পাতা

ডাক দিয়ে যায় মুসাফির!

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

 

হযরত মাওলনাা সৈয়দ আবুল হাসান আলাী নাদাবী রহ-এর মধ্যপ্রাচ্য সফরের রোযনামচা

 

মঙ্গলবার২২/৪/১৩৭০ হি. ৩০/১/১৯৫১ খৃ.

ঠা-াজনিত কারণে আজ বেশ আলস্য ও নিস্তেজতা বোধ হচ্ছিলো। তাই সারা দিন কামরায় থাকলাম; বের হওয়ার ইচ্ছেই হচ্ছিলো না। তবে সময়টা কাজে লাগাতে চেষ্টা করেছি। প্রধান কাজ ছিলো (আমার রচিত) المد والجزر في تاريخ الإسلام(ইসলামের ইতিহাসে জোয়ারভাটা/উত্থান ও পতন) পুস্তিকাটির পরিমার্জন-পরিবর্ধন এবং পা-ুলিপিটিকে ছাপাখানার উপযোগীরূপে প্রস্তুতকরণ। কেননা এ সফরেই এটিকে আমি মিশর থেকে প্রকাশ করতে চাই। মোটামুটি এ কাজেই ব্যস্ত ছিলাম।

শায়খ আহমদ মুহাম্মাদ উছমান ফোনে জানালেন, বিকেল চারটায় তিনি আসবেন এবং আমাকে শায়খ আমীন খাত্তাবের কাছে নিয়ে যাবেন। যথাসময়ে তিনি এলেন। আমরা তাঁর সঙ্গে জাম‘ঈয়্যা শার‘ঈয়্যা-এর প্রধান কার্যালয়ে গেলাম। ওখানে মাগরিব  আদায়ের পর শায়খ আমীনের সাক্ষাতে গেলাম। তিনি পূর্ণ সৌজন্য রক্ষা করে আমাদের সঙ্গ দিলেন, তারপর আগামী শনিবার দুপুরে দস্তরখানের দাওয়াত দিলেন। সুবর্ণ সুযোগ মনে করে সানন্দে আমি তাঁর দাওয়াত কবুল করলাম। কারণ আমার একান্ত ইচ্ছা ছিলো, শায়খের সঙ্গে কিছু সময় যাপন করি এবং আমাদের দেশে দাওয়াতের যে কাজ হচ্ছে তার তরীকা, পন্থা ও কর্মকৌশল সম্পর্কে আলোচনা করি। হতে পারে, কোন বিষয়ে তিনি একমত হলেন এবং উপকারী ও কল্যাণকর মনে করে এখানে তা কার্যকর করলেন। কারণ হিকমত ও প্রজ্ঞার বাণী হচ্ছে মুমিনের হারানো সম্পদ। যেখানেই সে তা পাবে, যতেœর সঙ্গে কুড়িয়ে নেবে।

এখান থেকে আমরা জাম‘ঈয়্যাতু শুব্বানিল মুসলিমীন (মুসলি যুবসংস্থা)-এর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গেলাম। আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো ড. আব্দুল হামীদ সা‘ঈদ মিলনায়তনে। তখন এই মর্দে মুমিনের জীবন ও জীবন-সংগ্রাম এবং দ্বীনের জন্য তাঁর ত্যাগ ও কুরবানির ইয়াদ অন্তরে তাজা হয়ে গেলো। তিনি ছিলেন বিশেষভাবে মিশরের যুবসমাজের, আর সাধারণভাবে সমস্ত মুসলিম যুবকদের অভিমুখকেন্দ্র ও পথিকৃৎ। তাকে মনে করা হতো ইসলামী যুব-আন্দোলনের প্রাণপুরুষ। আমি নীরবে তাঁর জন্য কল্যাণপ্রার্থানা করে গেলাম। বস্তুত এ সংস্থার ভবন ও স্থাপনা, বিভিন্ন শাখা ও বিভাগে পরিচালিত এর যাবতীয় কাযক্রম ঐ মহান ব্যক্তির গৌরবময় অমর কীর্তি-অবদান ছাড়া আর কিছু নয়।

আজ রাতে এখানে স্বনামধন্য আযহারী আলেম এবং মুসলিম যুবসমাজের অগ্রদূত উস্তায আহমদ শিরবাছী’র বক্তৃতার নিয়মিত কর্মসূচী ছিলো। তিনি তখনো এসে পৌঁছেননি।

এ অবসরে আমরা শুব্বানুল মুসলিমীনের প্রধান জেনারেল মুহাম্মদ ছালেহ হরব পাশার কক্ষে গেলাম। অসুস্থতার কারণে তিনি  তাঁর কক্ষের মধ্যেই ‘আবদ্ধ’ থাকেন। সালাম ও সৌজন্য বিনিময়ের পর আমরা তাঁর। ‘বিমারপুরসি’ করলাম। তারপর শায়খ মাহমূদ শুআইলের পক্ষ হতে ‘পরিচিতিপত্র পেশ করলাম। পাশা আমার মিশর-আগমনের অভিপ্রায় সম্পর্কে আগেই শুনেছিলেন। অল্প সময়ের দেখায় তাঁকে আমার সুশিক্ষিত, সংস্কৃতিবান, সদালাপী, সদাচারী ও নিপাট ভদ্রলোক মনে হলো।

জেনারেল সাহেব আকাক্সক্ষা প্রকাশ করলেন, আমরা যেন সংস্থার ভবন এবং বিভিন্ন শাখা ও বিভাগের কার্যক্রম ঘুরে দেখি এবং সামগ্রিক কর্মকা- পর্যবেক্ষণ করি। সুতরাং আমরা জাম‘ঈয়্যার একজন কর্মকর্তার পথনির্দেশনায় সবকিছু ঘুরে ঘুরে দেখলাম। যুবকদের বিভিন্ন দলÑ দেখলাম, কুস্তি ও মুষ্টিযুদ্ধের চর্চা করছে এবং বিভিন্ন প্রকার শরীরচর্চামূলক ক্রীড়া অনুশীলন করছে। শরীরের শক্তি ও উপযোগিতা (ফিটনেস) রক্ষার বিষয়ে তাদের প্রচেষ্টা ও উদ্যম-উদ্দীপনা আমার ভালো লাগলো। তাদের স্বাস্থ্যপ্রাচুর্য ও যৌবন-উচ্ছলতা দেখে মুগ্ধ হলাম। পাঞ্জাব ও তাঁর যুবশক্তির উদ্যম-উচ্ছলতার কথা মনে পড়লো, তারো আগে মনে পড়লো আল্লাহর পেয়ারা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সেই অমর বাণীÑ

المؤمن القوي خير من المؤمن الضعيف

সবল ও শক্তিশালী মুমিন দুর্বল ও কমযোর মুমিনের চেয়ে উত্তম।

আমরা বিভিন্ন আলোকচিত্র সংরক্ষণের কক্ষেও গেলাম। প্রচুর স্মারকছবি ও আলোক-চিত্রে কক্ষটি সুসজ্জিত, যা তোলা হয়েছে বিভিন্ন উপলক্ষে সংস্থার পক্ষ হতে প্রেরিত বা সংস্থার কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য আগত বিভিন্ন দল ও ব্যক্তির স্মৃতিসংরক্ষণের উদ্দেশ্যে। একটা কথাই শুধু মনে হলো যে, আমরা পরিদর্শন করছি এমন কোন স্থানীয় সংস্থা, যার কর্ম ও কর্মসূচীতে রয়েছে পশ্চিমা সংস্কৃতির ছাপ, কিংবা পরিদর্শন করছি স্পোর্টিং-স্কাউটিংবিষয়ক কোন আধুনিক কমপ্লেক্স।

শেষে যাওয়া হলো সংস্থার গ্রন্থাগারে। সেখানে পত্র-পত্রিকা, গল্প-উপন্যাস এবং সাহিত্যের বিভিন্ন শাখার ভালো-মন্দ ও শ্লীল-অশ্লীল সব রমকের সংগ্রহই দেখা গেলো। বস্তুত সাহিত্য ও সংস্কৃতির জগতে এ এমনই সর্বগ্রাসী ব্যাধি যা সবদেশে সবজনগোষ্ঠীর মধ্যে বেশ ভালোভাবেই শিকড় গেড়ে বসেছে। শহর ও পল্লী, কোন জনপদই এখন এর ছোবল থেকে মুক্ত নয়। (১৯৫১ ও ২০১৮ এর মধ্যে পার্থক্য কত বিশাল!Ñঅনুবাদক)

***

আজ রাতে আনছারুছ্-ছুন্নাহর কার্যালয়ে আমার বক্তৃতা ছিলো। তাই তাড়াতাড়ি সেখানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। বড় একটা ‘সমাগম’ প্রতীক্ষায় ছিলো। এশার ছালাত আদায়ের পর আমরা বক্তৃতা-মিলনায়তনে প্রবেশ করলাম। শ্রোতাদের মধ্যে আধুনিক শিক্ষিত যুবশ্রেণীর যেমন বিপুল উপস্থিতি ছিলো তেমনি সংস্থার কর্মী ও কর্মকর্তা এবং সভ্য ও শুভানুধ্যায়িদের উপস্থিতিও ছিলো উল্লেখযোগ্য। আনছারুছ্-ছুন্নাহর প্রধান শায়খ মুহাম্মদ আলফাকী মঞ্চে এলেন এবং সংক্ষিপ্ত আকারে উদ্বোধনী ও ভূমিকাধর্মী বক্তব্য রাখলেন। তারপর আমাকে বক্তব্যের জন্য আহ্বান জানালেন। তাঁর প্রতি শুকরিয়াজ্ঞাপন করে আমি আলোচনা শুরু করলাম। তাতে দাওয়াতের গুরুত্ব ও মহত্ত্ব, দাওয়াতের দায় ও দায়িত্ব এবং পন্থা ও পদ্ধতির নাযুকতা ও সংবেদনশীলতা, বিভিন্ন ক্ষেত্রে দাওয়াতের বহুমুখী দাবী ও চাহিদা এবং সর্বোপরি দাওয়াতের জন্য অপরিহার্য যোগ্যতা, কুশলতা ও শর্ত-শারায়েত সম্পর্কে পর্যাপ্ত আলোকপাত করলাম। আমি বললামÑ ‘বহু মানুষ আছেন যারা কোন পেশা ও কর্মক্ষেত্রে  দক্ষতা ও সফলতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হন। পরে তারা দাওয়াতকেই পেশা হিসাবে গ্রহণ করেন। হয়ত তারা ভাবেন, এটা হচ্ছে সবচে’ সহজ কাজ। অথচ বাস্তব সত্য এই যে, দাওয়াতের কাজ হচ্ছে সবচে’ ব্যাপক ও বিস্তৃত, সবচে’ নাযুক, সংবেদন-শীল, গুরুত্বপূর্ণ, জটিল ও  ঝুঁকিপূর্ণ। দাওয়াতের কাজ, আমি বলবো, রাজনীতি ও অর্থনীতির চেয়ে এবং তাত্ত্বিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক যে কোন কর্মকা- ও আন্দোলনের চেয়ে অনেক বেশী দায়িত্বপূর্ণ ও জটিলতাপূর্ণ কাজ। সমাজের জীবনে কোন ইনকিলাব ও বিপ্লব সৃষ্টি করা এবং সমাজের কাঠামো ও অবয়বে পরিবর্তন সাধন করা এবং পুরোনো মতবাদের স্থলে নতুন কোন মতবাদ প্রতিস্থাপন করাÑএগুলো মোটামুটি সহজ কাজ। কারণ তা আখলাক ও চরিত্র, মানবিক মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতার দাবী রক্ষা করা ছাড়াও সম্ভব। দুনিয়ার বিভিন্ন বিপ্লব ও আন্দোলনের ক্ষেত্রে দেখা যায়, কর্মী ও কর্ণধারগণ তাদের বিপ্লব ও আন্দোলন এবং প্রয়াস-প্রচেষ্টার প্রতি পূর্ণ নির্বেদিত হয়েও কখনো কখনো আখলাক ও চরিত্র এবং নীতি ও নৈতিকতার ক্ষেত্রে খুবই নি¤œস্তরের হয়ে থাকেন। কিন্তু এটাকে বিপ্লব ও আন্দোলনের জন্য ক্ষতিকর মনে

করা হয় না। সাঙ্ঘর্ষিক ও বিপর্যয়কর মনে করা তো দূরের কথা। কিন্তু দাওয়াত ইলাল্লাহর বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে ইসলামী আখলাক ও চরিত্রের  যেমন অপরিহার্য প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন যাবতীয় মানবিক মূল্যবোধ রক্ষা করা। এই দাওয়াতের মেহনত শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যা দাবী করে এবং করতে থাকে তা হলো ঈমান ও ইয়াকীনের বলে বলীয়ান চিন্তা-চেতনা, চূড়ান্ত ত্যাগ ও কুরবানী, মৃত্যুভয়হীন  সাহস ও বীরত্ব এবং বিশুদ্ধ বোধ ও অনুভূতি, বিশুদ্ধ ইলম ও আমল, কুরআন ও সুন্নাহর পূর্ণ অনুসরণ, যিকির দ্বারা সজীব যবান এবং আল্লাহর ভয়ে ভীত আখেরাতমুখী দিল। দাওয়াতের মেহনতে সজীবতা ও প্রাণশক্তি আসেই তখন যখন ইবাদতে খুশুখুযূ ও ভয়-একাগ্রতা, দু‘আ-মুনাজাতের মধ্যে কাকুতি-মিনতি ও আত্মনিবেদন এবং সব দুয়ার ছেড়ে আল্লাহর দুয়ারে পড়ে থাকার আকুতি সৃষ্টি হয়। দ্বীনের দাওয়াত মানে প্রচার-প্রচারণা ও যুক্তির বিস্তার নয়, দাওয়াত হচ্ছে তাবলীগ, তা‘লীম, তারবিয়াত ও তাযকিয়া- এসবের সারনির্যাস। দাওয়াত হচ্ছে সেই উম্মী নবীর খেলাফত ও প্রতিনিধিত্ব যাঁর গুণ ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে চারটি মৌলিক ধারার উপর। ইরশাদ হয়েছেÑ

هو الذي بعث في الأميين رسولا منهم يتلو عليهم آياته ويزكيهم ويعلمهم الكتاب والحكمة وإن كانوا من قبل لفي ضلال مبين

তিনিই ঐ মহান সত্তা যিনি উম্মী কাউমের মধ্যে প্রেরণ করেছেন তাদের মধ্য হতে একজন রাসূল, যিনি তাদের তিলাওয়াত করে শোনান তাঁর আয়াতসমূহ এবং তাদের সংশোধন করেন এবং তাদের, কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেন, যদিও এর আগে ছিলো তারা সুস্পষ্ট ভ্রষ্টতার মধ্যে।

হিন্দুস্তানের আহলে দাওয়াত ও মুজাহিদীনের কতিপয় উদাহরণ

দাওয়াতের স্বভাব ও প্রকৃতি সম্পর্কে এ মৌলিক আলোচনার পর আমি ইসলামী যুগের প্রথম পর্বের দাওয়াত ও কুরবানির কিছু উদাহরণ পেশ করলাম। তারপর হিন্দুস্তানের কতিপয় দা‘ঈ ও মুজাহিদীনের ঈমানোদ্দীপক ঘটনা তুলে ধরলাম। যেমন মাওলানা ইয়াহয়া আলী আযীমাবাদী, মওলভী মুহাম্মাদ জা‘ফর থানেশ্বরী। এছাড়াও আরো কিছু মরদানে খোদার কাহিনী যারা ছিলেন আল্লাহ তা‘আলার এই আয়াতের উপযুক্ত অভিপ্রকাশÑ

من المؤمنين رجال صدقوا ما عاهدوا الله عليه، فمنهم من قضى نحبـه، ومنهم من ينتظر، وما بدلوا تبديلا

মুমিনীনের মধ্যে এমন কত আছে যারা আল্লাহর সঙ্গে কৃত ওয়াদা সত্য করে দেখিয়েছে। তো তাদের মধ্যে এমনও রয়েছে যারা নিজ নিজ আয়ু সম্পূর্ণ করে ফেলেছে, আর তাদের মধ্যে এমনও আছে যারা এখনো ইনতিযার করছে, আর তারা তাদের ‘বচন’ বিন্দুমাত্র পরিবর্তন করেনি।

আমি হিন্দুস্তানের দাওয়াত ও জিহাদের সেই ‘দিলকুশা মানযার’ ও ঈমানোদ্দীপক দৃশ্য বর্ণনা করলাম যে, কী খুশি ও মাস্তির সঙ্গে তারা ফাঁসির খবর গ্রহণ করতেন! এবং কেমন ওয়াজ্দ ও ভাবতরঙ্গের সঙ্গে জেলাখানায় গিয়ে তারা ছাহাবী হযরত খাব্বাব রা.-এর কবিতা আবৃত্তি করতেনÑ

فلست أبالي حين أقتل مسلما

على أي جنب كان لله مصرعي

وذلك في ذات الإله وإن يشأ

يــبـارك في شلو أوصال مـمزع

‘মুসলিমরূপে যখন হত্যা করা হচ্ছে তখন আর কী চিন্তা, কোন্ পার্শ্ব দিয়ে হবে আল্লাহর জন্য আমার লুটিয়ে পড়া! এ শাহাদাত তো আল্লাহরই জন্য। সুতরাং চাইলে টুকরো টুকরো শরীরেও আমার আল্লাহ বরকত দিতে পারেন।’

মাওলানা ইয়াহয়া আলী কেমন জোশ-জাযবার সঙ্গে জেলের জল্লাদকে সম্বোধন করে আয়াতে ইউসুফী তিলাওয়াত করতেনÑ

يا صاحبي السجن أأرباب متفرقون خير أم الله الواحد القهار؛ ...

‘হে আমার ‘জেলসাথী’ ভিন্ন ভিন্ন খোদা উত্তম, নাকি মহাপরাক্রম- শালী এক আল্লাহ?! সেই মহান সত্তাকে ছেড়ে তোমরা যাদের পূজা করো তারা কতিপয় নাম ছাড়া তো কিছু নয়,  যা তোমরা এবং তোমাদের পূর্ববর্তীরা নির্ধারণ করেছে। সেগুলোর পক্ষে আল্লাহ তো কোন প্রমাণ অবতীর্ণ করেননি। রাজত্ব তো কারো জন্য নয় আল্লাহ ছাড়া। তিনি আদেশ করেছেন যে, তোমরা তাঁকে ছাড়া কারো পূজা করবে না। এটাই হলো সোজা-সরল দ্বীন। কিন্তু বহু মানুষ (এ সহজ সত্য) বোঝে না।’

আমি আরো বয়ান করলাম যে, তাঁর ওয়ায-উপদেশে অমুসলিম-দের মধ্যে কেমন কান্নার রোল পড়ে যেতো! তারা কেঁদে কেমন জারজার হতো, কিন্তু নিজের জায়গা থেকে সরে যাওয়া পছন্দ করতো না। আর তাঁর ফাঁসির আদেশ যাবজ্জীবনে পরিবর্তিত হওয়া! তার কারণ ছিলো এই যে, ইংরেজ বিচারকের পছন্দ হয়নি ফাঁসির রায় শুনে আসামীর আনন্দ প্রকাশ করা। সাদা চামড়ার বিচারকের কথা হলো, আসামীকে আমি খুশী হতে দেবো কেন?! ‘শাহীদ হওয়া যদি আসামাীর এতই ‘দিলপসন্দ’ হয় তাহলে ‘নো শাহাদাত!!’

বস্তুবাদী দাওয়াত ইসলামী দাওয়াতের প্রতিপক্ষ

এর পর আমি সাম্প্রতিক হিন্দুস্তানে দ্বীনী দাওয়াতের কর্মপন্থা সম্পর্কে আলোচনা করলাম যে, কীভাবে সকল শ্রেণী ও পেশার মুসলিমগণ মসজিদে সাপ্তাহিক ইজতিমা-শবগুজারিতে শরীক হয় এবং সম্পূর্ণ নিজ খরচে শহরে গ্রামে এবং বস্তিতে জনপদে দওয়াত ও তাবলীগের সফরে বের হয়। এই ত্যাগ ও কুরবানিভিত্তিক আম দাওয়াতের ফায়দা ও কল্যাণের বাস্তব চিত্র তাদের সামনে তুলে ধরলাম। তারপর বললাম, ‘আজ সমস্ত দাওয়াতি মেহনত দুর্বল, নিস্তেজ ও প্রাণহীন হয়ে পড়েছে। রমরমা ও জমজমা অবস্থা শুধু বস্তুবাদী দাওয়াতের। বস্তুত এ দাওয়াতই আজ দ্বীন ও মিল্লাতের জন্য মেহনতকারী দাওয়াতি কাফেলার সবচে’ বড় ও সবচে’ খতরনাক প্রতিপক্ষ। এখন আমাদের প্রধান কর্তব্য হচ্ছে, নিজেদের শক্তিকে পূর্ণ সংহত করা এবং এই প্রতিপক্ষ বস্তুবাদী দাওয়াতের মুকাবেলার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা। আজ আমাদের, চোখে চোখ রেখে এ বস্তুবাদী দাওয়াতের মুখোমুখি হতে হবে, বরং তার সঙ্গে আজ আমাদের পাঞ্জা লড়তে হবে। আর সে জন্য ইলমী ও বুদ্ধিবৃত্তিক এবং ফিকরী ও নৈতিক এবং রূহানী ও আত্মিক শক্তিতে বলীয়ান হতে হবে। এছাড়া আমাদের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হবে না সময় ও সমাজের উপর যথাযথ প্রভাব বিস্তার করা এবং বস্তুবাদের ঐ মোটা পর্দা ছিন্ন করা, যা মানুষের দিল-দেমাগ এবং চক্ষু ও অন্তর্চক্ষু আচ্ছন্ন করে রেখেছে।

চৌম্বকীয় দ্বীনী ব্যক্তিত্ব এবং ‘সর্বপ্রভাবী’ আত্মিক শক্তি দ্বারাই শুধু বস্তুবাদী দাওয়াত/প্রচারণার উপর আমরা প্রাধান্য বিস্তার করতে এবং চূড়ান্তরূপে বিজয়ী হতে পারি।

মোটামুটি এই ছিলো আমার বক্তব্য। শ্রোতাদের চেহারা ও অভিব্যক্তি থেকে মনে হলো, তাদের অন্তরে কথাগুলো আছর করছে এবং রেখাপাত করছে। বারবার তাকবীরধ্বনির মাধ্যমে ভিতরের উপচে পড়া আবেগ তারা প্রকাশ করছিলেন।

আসলে এ আবেগ ও আবেদন বক্তা বা বক্তৃতার কারণে নয়, বরং হয়ত ঐ মহান দা‘ঈ ও মুজাহিদীনের মর্মস্পর্শী ঘটনাবলীর কল্যাণে যা আমি শ্রোতাদের সামনে তুলে ধরেছি। এরূপ আবেদন ও প্রভাব এসব ঘটনা দ্বারাই শুধু হতে পারে, অন্যকিছু দ্বারা নয়।

বক্তব্য শেষ হওয়ার পর শায়খ মুহাম্মদ হামিদ বক্তার প্রতি শুকরিয়া জ্ঞাপন করলেন এবং বিনয় প্রকাশ করে বললেন, তিনি নিজেও আজকের বয়ান দ্বারা অত্যন্ত উপকৃত হয়েছেন।

মঙ্গলবার২৩/৪/৭০ হি. ৩১/১/ ৫১ খৃ.

গত রাতে মুহাম্মাদ রাশাদ আব্দুল মুত্তালিব আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে জানালেন, ড. আহমদ আমীন আমাদের সাক্ষাৎ কামনা করছেন।

ভোরে আমরা সংস্কৃতি-দফতরে গেলাম। আহমদ আমীন উষ্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে আমাদের গ্রহণ করলেন। তিনি কিছু কিতাব হাদিয়া দিলেন। তার মধ্যে আরবী সাহিত্যের বিখ্যাত গ্রন্থ (ছয়খ-ে তাঁর প্রকাশনাসংস্থালাজনাতুত্-তালীফ থেকে প্রকাশিত) আলইকদুল ফারীদ কিতাবটিও ছিলো। এটির বিশুদ্ধায়ন, পরিমার্জন ও ব্যাখ্যা-পর্যালোচনার কাজে আহমদ আমীনও শামিল ছিলেন। তাঁর আত্মকথা ‘হায়াতী’-এর একটি নোসখাও দিলেন। স্মারক হিসাবে একটি ঝর্ণাকলমও হাদিয়া দিলেন। এ বদান্যতার জন্য আমি তাঁকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলাম এবং আনন্দের সঙ্গে হাদিয়া গ্রহণ করলাম।

এরপর আমরা আলাপ-আলোচনায় মশগুল হলাম। অনির্ধারিতভাবে বিভিন্ন প্রসঙ্গ এলো। এক পর্যায়ে আমি তাঁকে বললাম, ‘আমার দিলের তামান্না যে, এখন থেকে আপনি কোরআনের তিলাওয়াত ও অধ্যয়নে বেশী সময় ব্যয় করবেন এবং কোরআনের বিভিন্নমুখী খেদমতে নিয়োজিত হবেন।

তিনি বললেন, এখন তো الإسلام ماضيه وحاضرهইসলামের অতীত ও বর্তমান) কিতাবটির রচনা কর্মে নিমগ্ন রয়েছি। এতেই বেশীর ভাগ সময় চলে যায়। তবে আশা করছি, অচিরেই তা থেকে অবসর হতে পারবো। (তখন আপনার আকাক্সক্ষার বিষয়টি বিবেচনা করা যাবে।)

আমি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললাম, ‘আশা করি, আপনার কলম থেকে এমন কিছু আসবে না            , যা তথাকথিত স্বাধীন চিন্তার যুবকদের অন্তরে সংশয়-সন্দেহ বা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সৃষ্টির কারণ হতে পারে। তিনি জানতে চাইলেন, এটা কি নির্দিষ্ট কোন ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত, না আগাম সতর্কবাণী? আমি বললাম, এটি আমার আকাক্সক্ষা ও নিবেদন। তিনি বললেন, কিন্তু মুক্ত আলোচনা ও স্বাধীন সমালোচনাও তো জরুরি! আমি বললাম আপনার কথা (হয়ত) ঠিক, তবে এ যুগের স্বভাব ও মানসিকতা এই যে, মন্দকে তো মানুষ লুফে নেয়, কিন্তু শুভ ও সুন্দরকে এড়িয়ে যায়!

তিনি আমরা কথায় সায় দিলেন, (তবে মূল বিষয়ে আর কিছু বললেন না।)

আমীনের একটি কিতাব সম্পর্কে আমার পর্যালোচনা

ড. আহমদ আমীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হলো

زعماء الإصلاح في العصر الحديث(আধুনিক যুগের সংস্কার-পুরোধাগণ)

নাম থেকেই বোঝা যায়, এমন কতিপয় বিশিষ্ট ব্যক্তি সম্পর্কে তিনি আলোচনা পর্যালোচনা করেছেন, তাঁর মতে বর্তমান যুগে যারা মুসলিম উম্মাহর সংস্কার আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। এ প্রসঙ্গে আমি তাঁকে বললাম, আপনার কিতাবটি আমি পবিত্র হিজাযভূমিতে থাকা অবস্থায় পড়েছি। খুবই পছন্দ হয়েছে এবং যথেষ্ট উপকৃত হয়েছি, বিশেষ করে আব্দুর-রহমান কাওয়াকিবী, খায়রুদ্দীন পাশা তিউনিসী ও মিদহাত পাশা সম্পর্কে যা লিখেছেন। নজদের বিশিষ্ট আলেম শায়খ আব্দুল ওয়াহ্হাব সম্পকেও গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য রয়েছে, যা আমি আলে শায়খের কতিপয় বিশিষ্ট ব্যক্তিকে পড়ে শুনিয়েছি। তারা সমর্থন জানিয়েছেন এবং প্রশস্তিমূলক মন্তব্য করেছেন।

তিনি বললেন, আলহামদু লিল্লাহ; তবে কোন কোন বিদগ্ধ ব্যক্তি শায়খের বাগদাদ সফর সম্পর্কে যা লেখা হয়েছে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন।    

আমি বললাম, হাঁ, আলে শায়খের বিশিষ্ট ব্যক্তি শায়খ ওমরেরও তাই মত।

তিনি বললেন, কিন্তু আমি তো ইউরোপীয় লেখক-গবেষকদের গবেষণাপত্রে আমার বক্তব্যের সমর্থন পেয়েছি!

আমি বললাম, সৈয়দ আমীর আলীকে সংস্কার-আন্দোলনে নেতৃত্ব ও প্রতিনিধিত্বের যে উচ্চাসন আপনি দান করেছেন তিনি ঐ স্থানের মানুষ নন। হাঁ, তিনি অতি উচ্চস্তরের লেখক যিনি ইংরেজি ভাষায় ইসলামের গুণ ও সৌন্দর্য (তার মত করে) তুলে ধরেছেন এবং ইংরেজিতে বেশ মূল্যবান গ্রন্থ লিখেছেন। একই ভাবে স্যার সৈয়দ আহমদ খানও ইসলামের চিন্তানৈতিক নেতৃত্বের ঐ স্থানের উপযুক্ত নন যেখানে আপনি তাঁকে বসিয়েছেন। আসল কথা হলো তাঁর সৃজনশীল মেধা তার জ্ঞান-পরিধি থেকে বেশী ছিলো; ফলে তিনি এমন বহু স্খলন ও বিচ্যুতির শিকার হয়েছেন যা মুসলিম সমাজের অনেক ক্ষতি করেছে। হিন্দুস্তানে এমন কতিপয় ব্যক্তি ও ব্যক্তিত্ব ছিলেন যারা ঐ দু’জনের তুলনায় আপনার গ্রন্থে আলোচিত হওয়ার বেশী হকদার ছিলেন।

তিনি বললেন, যেমন? আমি বললাম, সৈয়দ আহমদ শহীদ এবং শাহ ইসমাঈল শহীদ, (যারা ইসলামী খেলাফতের পুনরুজ্জীবনের জিহাদে যামানার সবচে’ বড় তাগুতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। আর শেষ পর্যন্ত শিখশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে শহীদ হয়েছেন।)

তিনি সেই দুঃখজনক কথাটাই বললেন, যা মিশরে আরো অনেক মুখে শুনেছি। তিনি বললেন, আফসোস, এঁদের সম্পর্কে পর্যাপ্ত তথ্য সংগ্রহ করতে পারিনি।

আমি বললাম, المهدية والمهديون(মেহদীবাদ ও মেহদীবাদিগণ) কিতাবে সৈয়দ আহমদ শহীদ সম্পর্কে আপনি আলোচনা করেছেন। কিন্তু তথ্য সংগ্রহ করেছেন পশ্চিমা লেখকদের থেকে, যারা বিদ্বেষ-বশত সত্যের ও তথ্যের বিকৃতি ঘটিয়েছে, অতিরঞ্জনের আশ্রয় নিয়েছে। আমি আরো বললাম, একই ভাবে আল্লামা ইকবাল আপনার কিতাবে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থান লাভ করার হকদার ছিলেন। তিনি একই ওজর পেশ করে বললেন, তাঁর সম্পর্কে আমি ‘আলোচনা করার মত’ তথ্য সংগ্রহ করতে পারিনি। আমাদের বন্ধু ড. আব্দুল ওয়াহ্হাব আয্যাম তাঁর সম্পর্কে অল্প সামান্য লিখেছেন। কায়রোয় ইকবালের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। তিনি বড় আহলে দিল (জীবন্ত হৃদয়ের অধিকারী) ছিলেন।

আমি বললাম, হৃদয়ই তো ছিলো তাঁর চিন্তা ও কাব্যসাধনার উৎস। আমি একটি কথিকায় তাঁর মোটামুটি পরিচয় তুলে ধরেছি, যা সউদি রেডিও থেকে প্রচারিত হয়েছে। আপনাকে সেটা দেয়ার চেষ্টা করবো।

আযহার ও ফুয়াদ ইউনিভার্সিটি সম্পর্কে আমীনের মত

এরপর আলোচনা অন্যান্য প্রসঙ্গের দিকে গড়ালো। একপর্যায়ে আহমদ আমীন বললেন, সম্প্রতি হল্যান্ডের জনৈক বিদ্যানুরাগী ও প-িৎ ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হয়েছে। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আযহার সম্পর্কে আপনি কি আশাবাদী? আমি বললাম, নাহ! কারণ আযহার অতীতমুখী। প্রতিক্রিয়াশীল আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়; অথচ যুবসমাজে এখন চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে এবং তাদের মধ্যে প্রগতিবাদের জোর জোয়ার দেখা দিয়েছে। তাছাড়া রাজতন্ত্র আযহারকে কুক্ষিগত করে রেখেছে, যারা না ভালো কিছু করে, না করতে দেয়।

হল্যান্ডের প-িৎপ্রবর এরপর জিজ্ঞাসা করলেন, ফুয়াদ ইউনিভার্সিটি (পরবর্তীকালে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়) সম্পর্কে কি আপনি আশাবাদী? আমি একই রকম নেতিবাচক উত্তর দিলাম। তিনি জানতে চাইলেন, কেন? (এমন মনে করার কী কারণ?)

আমি বললাম, কারণ সেটা আগাগোড়া পাশ্চাত্যভাবধারার বিদ্যাঙ্গন, দ্বীন ও ধর্মের সঙ্গে যার কোন হৃদ্যতা নেই, (আমাদের সমাজমানসের জন্য যা অপরিহার্য)।

ধর্ম ও রাজনীতির বিচ্ছেদ সম্পর্কে আহমদ আমীন

আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, শায়খ আলী আর্ব্দু-রায্যাক-এর ‘ইসলাম ও শাসনব্যবস্থা’ গ্রন্থটির সঙ্গে আপনি একমত? তিনি ‘নাবাচক’ উত্তর দিলেন এবং ব্যাখ্যা করে বললেন, উস্তায আলী আর্ব্দু-রায্যাক মনে করেন, ইসলাম শুধু আত্মিক ও আধ্যাত্মিক পায়গাম বহন করে, জীবন ও জগত এবং রাজনীতি ও সিয়াসাতের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই। পক্ষান্তরে আমি ঠিক বিপরীত মত পোষণ করি যে, সামাজিক জীবনের সঙ্গেও রয়েছে ইসলামের গভীর সম্পর্ক। ক্রয়-বিক্রয়, ইজারা ও অন্যান্য লেনদেন সম্পর্কে ইসলামের রয়েছে নিজস্ব বিধি-বিধান। আসলে তিনি চেয়েছেন রাজনীতি ও সমাজ-বিষয় থেকে ইসলামী চিন্তাকে মুক্ত রাখতে; কিন্তু এজন্য তো ইজতিহাদের দরজা খোলা রাখাই যথেষ্ট, দ্বীন ও ধর্মকে রাজনীতি ও সিয়াসাত থেকে পৃথক করার প্রয়োজন তো দেখি না।

আধুনিক সভ্যতা ও ধর্মচেতনা...

একই প্রসঙ্গ ধরে আমি বললাম, হিজাযে কোন কোন উপলক্ষে আমি বলেছি, আধুনিক সভ্যতা এবং দ্বীনী রূহ ও ধর্মচেতনার মধ্যে সঙ্গতিবিধান করার ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সাধারণভাবে আধুনিক সভ্যতার ধারা, ধর্মীয় ধারার অধিকার খর্ব করেছে। এটা আসলে তাদের দুর্বলতার কারণে হয়েছে যারা দ্বীন ও ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করে এসেছেন।

এ সম্পর্কে আহমদ আমীন নিজের দৃষ্টিকোণ ব্যখ্যা করে বললেন, এ ব্যর্থতার কারণ দু’টি। প্রথম কারণ এই যে, ইসলামী বিশ্বে এমন আলেম ও দ্বীনী ব্যক্তিত্ব খুবই কম যারা শরী‘আতের সমগ্র উদ্দেশ্য সম্পর্কে সম্যক অবগতি রাখেন এবং পশ্চিমা সভ্যতার চুলচেরা পর্যালোচনা করে কল্যাণ-অকল্যাণ নির্ধারণ করতে পারেন। দ্বিতীয় কারণ সেটাই যা আপনি মাযা খাসিরা... কিতাবে উল্লেখ করেছেন; অর্থাৎ আধুনিক সভ্যতা ও তামাদ্দুন সম্পর্কে মুসলিম জাতির হীনমন্যতাবোধ। এর সঠিক প্রতিকার হচ্ছে এমন আলেম ও আহলে ইলমের উপস্থিতি নিশ্চিত করা যারা যুগপৎ ধর্মীয় ও জাগতিক জ্ঞানের অধিকারী হবেন; তারপর মুসলিম জাতির মধ্যে এ চিন্তা ও বিশ্বাস স্থিত করা যে, আধুনিক সভ্যতার না সবটুকু ভালো, না সবটুকু মন্দ, বরং ভালো ও মন্দ দু’টোই নির্দিষ্ট অনুপাতে রয়েছে।

এখান থেকে আলোচনা অন্যদিকে মোড় নিলো। এক পর্যায়ে আহমদ আমীন বললেন, পাশ্চাত্যসভ্যতার বুনিয়াদে সাহিত্য-সংস্কৃতির উপাদান কম, জ্ঞান-বিজ্ঞানের উপাদান বেশী; পক্ষান্তরে প্রাচ্য, বেশী উন্নতি করেছে সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে নয়।

যোহাল ইসলাম ও মুতাযিলা সম্পর্কে আমার মত

এবার কথা শুরু হলো আহমদ আমীনের (তিনখ-ে রচিত) বিখ্যাত গ্রন্থ যোহাল ইসলাম সম্পর্কে। এ বিষয়ে আমি রাখঢাক ছাড়া সুস্পষ্ট ভাষায় আমার পর্যালোচনা তুলে ধরে বললাম, যোহাল ইসলাম সম্পর্কে আমার কিছু আপত্তি রয়েছে; প্রথম কথা হলো মু‘তাযিলা সম্প্রদায়কে আপনি প্রাপ্যের চেয়ে অনেক বেশী উঁচু মর্যাদা দিয়েছেন। আমার মতে বুদ্ধিচর্চার ক্ষেত্রে মুতাযিলারা শৈশব-স্তরে ছিলো; তাদের চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তি তখনো পরিপক্বতা অর্জন করেছিলো না। ...

তিনি বললেন, হাঁ, তবে তারা মুহাদ্দিছীনের চেয়ে প্রশস্ত চিন্তার অধিকারী ছিলো। একারণেই তাদের অস্তিত্বরক্ষা ও অগ্রযাত্রা উম্মাহর জন্য কল্যাণকর হতে পারতো। এ পর্যায়ে তাদের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া এবং শাসকদের ছত্রচ্ছায়া গ্রহণ করাকে আমি ভুল মনে করি।

আমি বললাম, এটা করে আসলে তারাÑ যেমন আপনি লিখেছেনÑ নিজেদের উপরই অবিচার ডেকে এনেছে (এবং বুদ্ধিবৃত্তির দৈন্য ও অপরিপক্বতার প্রমাণ রেখেছে। চিন্তাকে যুক্তির পরিবর্তে শক্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করার অপচেষ্টাকে আর কী বলা যেতে পারে!)

তিনি বললেন, প্রতিকূল সময়ের ঝাপটায় তাদের বহু গ্রন্থ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সম্প্রতি ঘটনাক্রমে কাযী আব্দুল জাব্বার মু‘তাযিলীর কিতাব আমার হাতে এসেছে। অচিরেই আমি তা প্রকাশের ব্যবস্থা করবো। এর মাধ্যমে আমরা মু‘তাযিলী ফেরকার বহু দ্বীনী চিন্তাভাবনা ও মতামত সম্পর্কে অবহিত হতে পারবো। ...

কথা হতে হতে যথেষ্ট সময় হলো। আমাদেরও উঠতে হলো। যখন বিদায়ের অনুমতি চাইলাম, তিনি আগামীকালের জন্য ‘ফুন্দুকে নীল’ এ ‘যুহরানা’র দাওয়াত দিলেন। আমরা সাদরে তা গ্রহণ করলাম এবং ছাকাফাহ দফতরে তার সঙ্গে মিলিত হওয়ার ওয়াদা করলাম।

শায়খ আহমদ শাকিরের সঙ্গে

আছরের সময় আমরা সুপ্রসিদ্ধ লেখক-গবেষক ও সাবেক বিচারপতি আহমদ মুহাম্মাদ শাকিরের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে বের হলাম এবং শায়খ আহমাদ উছমান ও তাঁর বন্ধূ আব্দুর-রহমান আফেন্দী-এর সঙ্গে নতুন মিশরের জাম‘ঈয়্যা শার‘ঈয়্যার মসজিদে পৌঁছলাম। নতুন মিশর বাস্তব অর্থেই নতুন।  সবদিক থেকেই তা একটি পরিপূর্ণ ও স্বতন্ত্র আধুনিক শহর। জানা গেলো, মাত্র কয়েক বছর আগে শহরের এ অংশটি আবাদ হয়েছে। আমরা ঐ মসজিদেই আছর আদায় করে আহমদ শাকিরের বাসভবনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। বাসভবন বললে ঠিক পরিচয়টা উঠে আসে না, বলতে হয় ‘বালাখানা’! উযির-মন্ত্রিদেরও যেন ছাড়িয়ে যায়! আলেম-ওলামার বাড়ী এমন হয় না, হওয়ার কথা না। এই দেখো, আসলে এখনো আমি হিন্দুস্তানেই রয়ে গিয়েছি! হিন্দুস্তানের গ-ি থেকে কবে যে বের হতে পারবো! হিন্দুস্তানের আহলে ইলম এবং মিশর (আরবজাহান) -এর আহলে ইলমের মধ্যে যে আসমান যমীনের পার্থক্য রয়েছে তা তো আমাকে মনে রাখতে হবে! হিন্দুস্তানী আলেমদের তো জীর্ণ কাপড় ও ছেঁড়া চাটাইয়ের সঙ্গেই হৃদ্যতা ও অন্তরঙ্গতা! পক্ষান্তরে এখানে আহলে ইলমকে আল্লাহ তা‘আলা যেমন সম্পদ-প্রাচুর্য দান করেছেন তেমনি দান করেছেন বিলাস-উপভোগের জীবন। যেন আব্বাসী বিচারকদের জীবন তারা এ যুুগে ফিরিয়ে এনেছেন! (কোনটা ভালো ও কল্যাণপূর্ণ, সে আলোচনা এখানে না হয় থাক।)

অত্যাধুনিক সাজসজ্জার একটি প্রশস্ত কামরায় আমরা তার সাক্ষৎ লাভ করলাম। বেশ কিছু সময় বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্নমুখী কথা হলো। কিছুক্ষণ আযহারের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত সম্পর্কে, কিছুক্ষণ মিশরের বিভিন্ন দ্বীনী আঞ্জুমান ও সংগঠন সম্পর্কে। মনে হলো, শায়খের জানাশোনার পরিধি অনেক বিস্তৃত। অধ্যয়নের ব্যাপ্তি ও বিস্তৃতি এবং জীবনমুখী দীর্ঘ অভিজ্ঞতা তাঁর মধ্যে ‘কালামী’ ও ফিকহী মতভিন্নতার ক্ষেত্রে যথেষ্ট উদারতা ও সহিষ্ণুতা এনে দিয়েছে।

আমি তাঁকে কিছু পুস্তিকা ও মুদ্রিত বক্তৃতা উপহার দিলাম। ‘মাযা খাসিরা’র কথা উঠলে তিনি বললেন, ছেপে আসামাত্র আমি তা সংগ্রহ করেছি। এখনো আমার টেবিলে রয়েছে। পড়ে শেষ করতে পারিনি। তাড়াহুড়া করে পড়ার মত কিতাবও নয়।

আমি আমার আব্বাজানের রচিত الثـقـافـة الإسلاميـة فـي الـهنـد(ভারতে ইসলামি সংস্কৃতির বিকাশ) কিতাবটি মিশরের কোন অভিজাত প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশের সম্ভাব্যতা সম্পর্কে কথা বললাম এবং জানতে চাইলাম, এ বিষয়ে তিনি কোন প্রকাশনা-সংস্থার সঙ্গে কথা বলতে পারেন কি না!

তিনি বেশ নিরুদ্যমপূর্ণ কথাই বললেন। তাঁর বক্তব্য হলো, ‘প্রকাশকরা এখন এতই বাণিজ্য-মুখী যে, মুনাফার চিন্তা ছেড়ে শুধু ইলমি খিদমতের উদ্দেশ্যে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করতে তারা প্রস্তুত নয়। আমার মনে হয় না, কেউ এ কাজে আগে বাড়বে।’

শেষে তিনি ‘ক্ষমাপ্রার্থনা’র মত করে বললেন, যাই হোক পা-ুলিপি রেখে যান। একটু দেখি, তারপর এ বিষয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলি।

আমরা বিদায়ের অনুমতি চাইলাম। কারণ মাগরিবের পর শরী‘আ অনুষদের ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতার সময় নির্ধারণ করা ছিলো।

আযহার ও বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের সঙ্গে

মাগরিবের পর আমরা শাবরা গেলাম। সেখানে ‘উভয় ধারা’র যুবকদের সুনির্বাচিত একটি সমাবেশ দেখতে পেলাম, অর্থাৎ জামে আযহার ও জামেয়া ফুয়াদ -এর বিভিন্ন অনুষদের মেধাবী, উদ্যমী ও প্রাণচাঞ্চল্যে পূর্ণ যুবকদের মিশ্রসমাবেশ। তাদের উৎসাহ উদ্দীপনা ছিলো এমন যে, সবারই স্বঃতস্ফূর্ত দাবী, ইচ্ছে হলে সারা রাত কথা বলুন। আমরা একই রকম আগ্রহ ও একাগ্রতার সঙ্গে শুনতে প্রস্তুত। তাতে আমাদের না হবে ক্লান্তি, না হবে বিরক্তি।

স্বীকার করতে দ্বীধা নেই যে, দ্বীন ও দ্বীনী আন্দোলন এবং ভবিষ্যতের কর্মপন্থা সম্পর্কে জানার এমন আগ্রহী ও পিপাসু যুবশ্রোতা এ পর্যন্ত আমি খুব কমই পেয়েছি। তাদের উৎসাহ উদ্দীপনা দেখে আমিও ভিতর থেকে কথা বলার অত্যন্ত প্রেরণা বোধ করলাম।

(ইসলামের) মূলনীতি অনুষদের মেধাবী ও চৌকশ ছাত্র ইউসুফ কারযাবী মঞ্চে এলেন এবং বেশ উচ্ছ্বাস, উদ্দীপনা আন্তরিকতাপূর্ণ উদ্বোধনী বক্তব্য রাখলেন এবং আজকের রাতের বক্তাকে স্বাগত জানিয়ে শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে তাকে পেশ করলেন। বস্তুত এটা হলো আধুনিক যুগের সেমিনার সমাবেশের প্রচলিত রীতি, যা মেনে নিতেই হয়।

এরপর শুরু হলো আমার বক্তব্য, যার খোলাছা ছিলোÑ ‘পৃথিবীর দু’টি স্তর বা রূপ রয়েছে। একটির সম্পর্ক হলো খালিক ও ¯্রষ্টার সঙ্গে, বান্দার ইচ্ছার তাতে কোন দখল ও ভূমিকা নেই। সুতরাং এ বিষয়ে আমাদের কিছু জিজ্ঞাসাও করা হবে না যে, এমন কেন হলো, তেমন কেন হলো না? এটা হলো সৃষ্টির স্তর। আল্লাহ তা‘আলা যেভাবে চেয়েছেন সেভাবেই বিশ্বজগত ও তার সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি সম্পর্কে তিনিই সর্বজ্ঞ ও পূর্ণ অবগত। এটা মহাজ্ঞানী ও মহাপ্রজ্ঞার অধিকারী আল্লাহরই সৃষ্টিকুশলতা যে, সবকিছুকে তিনি পূর্ণ নিখুঁত ও সুসংহত রূপ দান করেছেনÑ

ما ترى في خلق الرحمن من تفاوت، فارجع البصر هل ترى من فطور؛ ثم ارجع الصر كرتين ينقلب إليك البصر خاسئا وهو حصير

‘রহমানের সৃষ্টিতে তুমি দেখবে না কোন অসঙ্গতি। তো ফেরাও দৃষ্টি, দেখলে কি কোন খুঁত, কোন ‘ফাট’? তারপর আবার দৃষ্টি ফেরাও, ফিরে আসবে তোমার দিকে দৃষ্টি পর্যুদস্ত হয়ে এমন অবস্থায় যে, তা অক্ষম-অসহায়!’

তো এ স্তরে আমাদের প্রতি শরী‘আতের আদেশ হলো শুধু আল্লাহর কুদরত অনুধাবনের উদ্দেশ্যে সৃষ্টিজগত সম্পর্কে চিন্তা করা এবং সৃষ্টির মাধ্যমে ¯্রষ্টার পরিচয় ও মা‘রিফাত অর্জন করা। যেমন ইরশাদ হয়েছেÑ

الذين يذكرون الله قياما وقعودا وعلى جنوبـهم ويتفكرون في خلق السموات والأرض، ربـنا ما خلقت هذا بـاطلا؛ سبحانك فقنا عذاب النار

‘যারা আল্লাহকে স্মরণ করে দাঁড়িয়ে, বসে এবং আপন পার্শ্বের উপর (সর্বাবস্থায়), আর চিন্তা করে আকাশ-ম-লী ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্পর্কে (তারপর স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে ওঠে, (হে) আমাদের রব্ব, সৃষ্টি করেননি আপনি এটিকে অনর্থক (উদ্দেশ্যহীন)। আমরা আপনারই পবিত্রতা বর্ণনা করি। সুতরাং (হে) আমাদের প্রতিপালক, রক্ষা করুন আমাদের আগুনের আযাব হতে।’

তো যেহেতু সৃষ্টির আকার-অবয়ব, আকৃতি-প্রকৃতি এবং সৃষ্টির গুণ-বৈশিষ্ট্য ও কার্যক্রম সম্পর্কে আমাদের কোন ভূমিকা ছিলো না এবং নেই সেহেতু এ সম্পর্কে আমাদের কিছুই জিজ্ঞাসা করা হবে না যে, কেন বিশ্বজগতকে এভাবে সম্প্রসারিত করা হয়েছে। কেন, কী উদ্দেশ্যে তারকারাজির এরূপ বিস্তার ও বিক্ষিপ্তি? সূর্যের উদয়-অস্ত পূর্ব-পশ্চিমে কেন, পশ্চিম-পূর্বে নয় কেন? পাহাড় ও পর্বতশ্রেণী এখানে এভাবে কেন? ওখানে ওভাবে নয় কেন? মোটকথা বিশ্ব -জগত সম্পর্কে এধরনের কোন প্রশ্ন আমাদের করা হবেনা।

আমরা মুকাল্লাফ ও আদেশপ্রাপ্ত হয়েছি দ্বিতীয় স্তর সম্পর্কে। আর সেটা হলো পৃথিবীনামক এই বিস্তৃত বাসভূমির ব্যবস্থাপনা, যে বাসভূমি আল্লাহ তা‘আলা আমাদের জন্য স্থাপন করেছেন এবং এমনভাবে সুসজ্জিত ও সুবিন্যস্ত করেছেন যা আমাদের সৃষ্টির উদ্দেশ্যের সঙ্গে পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ। ঐ সকল মৌলিক নিয়ম ও বিধান যাকে বলা হয় আসমানি শরী‘আত, যা আমাদের জীবনযাপনকে সুন্দর, সুশৃঙ্খল এবং খালিক ও ¯্রষ্টার সন্তুষ্টির অনুগত করার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে, এই স্তরের জন্য আমাদের মুকাল্লাফ ও আদেশপ্রাপ্ত করা হয়েছে। পৃথিবীনামক এ বাসভূমির যাবতীয় ব্যবস্থাপনা এবং ¯্রষ্টার  ইচ্ছা অনুযায়ী এর পরিচালনা যেন সুসম্পন্ন হয়, এ বিষয়ে ্আমরা মুকাল্লাফ ও আদেশপ্রাপ্ত। সুতরাং এ বিষয়ে আমাদের অবশ্যই জিজ্ঞাসা করা হবে। এটাকেই বলা হয়েছে পৃথিবীতে মানবের খেলাফতÑ

إنـي جاعـل فـي الأرض خليـفة

অবশ্যই আমি পৃথিবীতে খলীফা ও প্রতিনিধি বানাবো।

পৃথিবীতে একের পর এক নবী-রাসূল এসেছেন এ উদ্দেশ্যেই যে, মানবের বাসভূমিরূপে পৃথিবীর ব্যবস্থাপনাকে তাঁরা সুশৃঙ্খল করবেন এবং আল্লাহর খলীফা ও প্রতিনিধিরূপে মানবের জীবনকে তাঁরা আল্লাহর পছন্দ ও সন্তুষ্টি অনুযায়ী পরিচালিত করবেন। প্রত্যেক নবীর প্রাণের আকুতি ছিলো এই যে, পৃথিবীর জীবন-ব্যবস্থার শৃঙ্খলা ও সুসজ্জা তাঁরা রক্ষা করবেন এবং যেখানে যতটুকু প্রয়োজন তার সংশোধন-প্রয়াস চালিয়ে যাবেন। কারণ এটাই ছিলো নবী ও রাসূলরূপে পৃথিবীতে তাঁদের প্রেরণের উদ্দেশ্য। তাই দেখা যায়, দুষ্কর্মারা যখনই পৃথিবীর জীবন-ব্যবস্থার মধ্যে নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা ও ফাসাদ সৃষ্টি করতে চেয়েছে, যার সংশোধন ও শৃঙ্খলাবিধান তাঁরা করেছেন তাঁদের নবুওয়ত ও রিসালাতের সর্বোচ্চ শক্তি ব্যয় করে; যখনই দুষ্কর্মারা অনাচার ও ফাসাদসৃষ্টির অপপ্রয়াস পেয়েছে এবং কোমর বেঁধে উঠেপড়ে লেগেছে তখনই আল্লাহর এই ‘বরগুযীদা’ বান্দাগণ যেন আর্তনাদ করে উঠেছেনÑ

لا تفسـدوا فـي الأرض بـعـد إصلاحـهـا

‘ফাসাদ সৃষ্টি করো না তোমরা পৃথিবীতে, (এত পরিশ্রম ও সাধনার মাধ্যমে) তাকে সংশোধন করার পর।’

যিনি বিশ্বজগতের ও পৃথিবীর ¯্রষ্টা, তিনি স্বয়ং নবী-রাসূলদের মাধ্যমে প্রেরিত ও প্রতিষ্ঠিত এই জীবনব্যবস্থার স্থিতি ও স্থায়িত্বকে পৃথিবীর জন্য, এমনকি বিশ্বজগতেরও জন্য জরুরি ও অপরিহার্য মনে করেন। এ জীবন-ব্যবস্থা তাঁর কাছে এতই প্রিয় এবং জরুরি যে, যারাই এর বিরুদ্ধে যায়, এটাকে নষ্ট করার জন্য ‘উঠেপড়ে’ লেগে যায়Ñ হোক বাদশাহ ও শাহানশাহ, হোক কোন জাতি ও সভ্যতাÑ তাদের তিনি হালাক ও বরবাদ করে দেনÑ

فـقـطـع دابـر القوم الذين ظلموا والـحمد لله رب العـالـمين

‘তাদের গোড়া কেটে দেয়া হয়েছে যারা সীমালঙ্ঘন করেছে। আর সমস্ত প্রশংসা রাব্বুল আলমীন আল্লাহরই জন্য।’ 

এর মধ্যে কিছু কাউম ও সম্প্রদায় এবং কিছু তাহযীব ও সভ্যতা অগ্রসর হয়েছে এবং পৃথিবী ও তার জীবন-ব্যবস্থাকে নিজেদের চিন্তা-বিশ্বাস, জ্ঞান-অভিজ্ঞতা এবং নিজেদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনুযায়ী গড়ে তুলেছে। সবকিছু তারা নিজেদের মত করে সাজিয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা নিজেই তাদের এ সুযোগ ও স্বাধীনতা দিয়েছেন যেন তিনি তাদের পরীক্ষা করেন, তাদের মধ্যে আমলে কে উত্তম!Ñ

هو الذي جعلكم خلائف في الأرض وجعل بعضكم فوق بعض درجات ليبلوكم فـيما آتـاكم إن ربك سريع العقاب وإنه لغفور رحيم

তিনিই ঐ সত্তা যিনি বানিয়েছেন তোমাদের, খলীফা পৃথিবীতে, যেন পরীক্ষা করেন তোমাদের ঐ বিষয়ে যা দান করেছেন তিনি তোমাদের। নিঃসন্দেহে তোমার প্রতিপালক ক্ষিপ্র শাস্তিতে এবং নিঃসন্দেহে তিনি ক্ষমাশীল দয়ালু।

পৃথিবীর স্বঘোষিত ব্যবস্থাপকদের সময় শেষ

আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে সুযোগ ও স্বাধীনতা দেয়ার যে কথা উপরে বলা হলো তারই ভিত্তিতে পৃথিবীতে প্রথমে রোমক ও গ্রীকদের যুগ শুরু হয়ে শেষ হলো। তারপর মুসলিম জাতির যুগ শুরু হলো এবং দীর্ঘ দিন বহাল থাকার পরও তাও অপসৃত হলো। তারপর এলো ইউরোপীয় -দের যুগ, যাকে আমরা বলি পশ্চিমা দর্শন ও পাশ্চাত্য সভ্যতার যুগ। প্রত্যেক জাতি ও সভ্যতা তাদের সাধ্য ও সামর্থ্যরে সর্বোচ্চটুকু ব্যয় করেছে, শেষ বিন্দুটুকু পর্যন্ত নিজের কাছে রাখেনি। বলা যায়, এর চেয়ে বেশী কিছু দেয়া তাদের পক্ষে সম্ভবই ছিলো না।

এখন ইউরোপীয় জবনদর্শন ও পাশ্চাত্য সভ্যতার যুগ। কুদরতের পক্ষ হতে তাদেরও দেয়া হয়েছে দীর্ঘ সুযোগ ও পূর্ণ স্বাধীনতা, যাতে মানবতার জন্য তারা তাদের সর্বোচ্চ শক্তি-সামর্থ্য উজাড় করে দিতে পারে। ইউরোপ তার জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও যোগ্যতার তূণীর থেকে সবক’টি তীর একে একে  নিক্ষেপ করেছে! এ বস্তুসভ্যতার ঝুলি এখন একেবারে খালি। এখন হিসাব মিলানোর সময়। পৃথিবী ও তার জীবনব্যবস্থা ইউরোপীয় সভ্যতার কাছে কী পেয়েছে?

ইউরোপ স্বীকার করুক, আর না করুক, সত্য এই যে, পৃথিবীর জীবন-ব্যবস্থার শৃঙ্খলায়নে তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে এবং পৃথিবীতে শুধু ফাসাদ সৃষ্টি করেছে, বরং মানবের বাসভূমি এই পৃথিবীকে তারা নষ্ট করে বসবাসের অনুপযোগী করে ফেলেছে।

শেষ আশা আবার মুসলিম উম্মাহ

এটা আজ উত্তমরূপে প্রমাণিত সত্য যে, নতুনভাবে এই পৃথিবীর সংশোধন ও বিনির্মাণ সেই (ক্লান্ত শ্রান্ত ও বিক্ষত) হাতগুলোই করতে পারে, একদিন যারা হারামের নির্মাণ করেছিলো; একদিন যারা তা‘মীরে হারামের গৌরব অর্জন করেছিলো। যত দূরেই সরে গিয়ে থাক, পৃথিবীর শৃঙ্খলা এবং জীবনের শোভা ও সজ্জা ঐ জাতির পক্ষেই শুধু ফিরিয়ে আনা সম্ভব, সমস্ত খুঁত ও ক্ষতি সত্ত্বেও এখনো যারা হারামের কেবলা অভিমুখে সিজদা করে; এখনো যারা হারামের হেফাজত ও নেগাহবানি করে চলেছে।

বর্তমান সময়ের যে দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত সেটা আসলে ইসলাম ও পাশ্চাত্য সভ্যতা এবং মুসলিম উম্মাহর আসমানী জীবনবিধান এবং ইউরোপের বস্তুবাদী জীবন-দর্শনের দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাত, যে দর্শন কখনো গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের নামে মঞ্চে আসে, কখনো আসে জাতীয়তাবাদ ও মানবতাবাদের নামে।

আমাদের আজ বুঝতে হবে, এটা বেঁচে থাকার, টিকে থাকার এবং অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম-সঙ্ঘাত। আর এটাই হয় জাতি ও উম্মাহর যুবসমাজের জেগে ওঠার, আগে বাড়ার, শৌর্য-সাহস প্রদর্শনের এবং রাহবারি ও নেতৃত্ব গ্রহণের সঠিক সময়। প্রতিটি দুর্যোগে, আঁধার যখন পথের নিশান মুছে ফেলে, জাতির যুবকদের কাছেই তখন সময়ের ডাক আসে। কারণ তারাই পারে সময়ের ডাকে সাড়া দিতে এবং সময়ের দাবী পূরণ করতে! এজন্যই যুবশক্তি ও তরুণ রক্তকে বলা হয় জাতির আসল সম্পদ ও মূল প্রাণ। সুতরাং হে আরবের যুবসমাজ! হে উম্মাহর টগবগে রক্ত!! আপনাদের কাছেই ডাক এসেছে নয়া যামানার নয়া ইনকেলাবের! আপনাদেরই গ্রহণ করতে হবে নতুন যুগের নতুন বিপ্লবের মহাদায়িত্ব, যেমন করেছে যুগে যুগে উম্মাহর প্রতিটি দুর্যোগে উম্মাহর তরুণদল।

অনেকে ভুল ধারণা করে; ছাহাবা কেরাম, যাদের কাঁধে ভর করে ঘটেছিলো ইসলামের উত্থান, তাঁদের সম্পর্কে ভুল ধারণা করে যে, তাঁরা বুঝি জীবনের রাজপথ থেকে পার্শ্বে চলে যাওয়া বুড়োদের দল ছিলেন। জীবন তাঁদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলো, তাই তাঁরা ইসলামের অভিমুখী হয়েছিলেন। না, এটা ঠিক ধারণা নয়। তাঁরা বরং ছিলেন তখনকার জীবন ও সমাজের স্তম্ভপুরুষ। একারণেই কোরায়শ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলো এবং ইসলামকে তাদের অস্তিত্বের প্রতি হুমকিরূপে ধরে নিয়েছিলো যখন তারা দেখতে পেলো যে, গোত্রের জ্ঞানী ও প্রাজ্ঞ ব্যক্তিগণ এবং যুবকদের শ্রেষ্ঠ অংশটি ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে। তাই তারা ইসলামকে প্রতিহত করার এমন মারমুখী ঘোষণা দিয়েছিলোÑ

إن هذا لشىء يـرادএটা তো এমন বিষয় যা করতেই হয়।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

শেয়ার করুন:     
প্রিন্ট

অন্যান্য লেখা